বহুল প্রচলিত কিছু যুলুম
(১) শরীককে ফাঁকি দেওয়া। বিশেষ করে মেয়ে বা বোনদেরকে এবং ছোট ভাইদেরকে তাদের প্রাপ্য সম্পত্তির অংশ থেকে বঞ্চিত করা।
(২) নিজ পরিবার ও সন্তানদের হক যথাযথভাবে আদায় না করা। অনেকে এগুলোকে গৌণ মনে করেন এবং আল্লাহর রাস্তায় মেহনতের নাম করে দেশান্তরী হন। অথচ তিনি বুঝেন না যে, আল্লাহর রাস্তা তার বাড়ীর আঙিনাতেই ছিল। এগুলোকে ধর্ম মনে করে বরং শয়তানী ধোঁকায় পা দেওয়া হচ্ছে মাত্র।
(৩) স্ত্রীর মোহরানা পরিশোধ না করা এবং স্বামীর মৃত্যুর সময় সেটা মাফ করিয়ে নেওয়া।
(৪) অনেক স্বামী তার উপার্জনের সবটাই তার পিতা-মাতার হাতে তুলে দেন, স্ত্রীর হাতে কিছুই দেন না। অনেক দ্বীনদার ব্যক্তি অধিক ছওয়াব মনে করে এটা করে থাকেন। অথচ গৃহকত্রী স্ত্রীর হাতে সর্বদা কিছু পয়সা থাকা উচিত। যাতে তিনি ইচ্ছামত কিছু খরচ করতে পারেন। তাছাড়া স্বামীর কাছ থেকে কিছু পাওয়ার মধ্যেও একটা গভীর আনন্দ আছে। যা থেকে অনেক স্বামী তাদেরকে বঞ্চিত করেন। এতে স্ত্রী নিঃসন্দেহে মনোকষ্টে থাকেন।
(৫) এর বিপরীত অনেক বিবাহিত ছেলে তার পিতা-মাতার খোঁজ-খবর নেয় না। তাদের হাতে কোন পয়সা-কড়ি দেয় না। উপার্জনের সবটুকু এনে স্ত্রীর হাতে তুলে দেয়। ফলে পিতা-মাতাকে স্ত্রীর মুখাপেক্ষীতে পরিণত করা হয়। এতে পিতা-মাতা মনে কষ্ট পেতে পারেন। এ থেকে অবশ্যই বিরত থাকা উচিত। নইলে পিতা-মাতার দীর্ঘ নিঃশ্বাস আল্লাহর দরবারে কবুল হয়ে গেলে সন্তানের সর্বনাশ অবশ্যম্ভাবী।
(৬) অনেক শ্বাশুড়ী তার পুত্রবধুর উপরে যুলুম করেন। পুত্রবধুর সুখ-দুঃখের প্রতি শ্বশুর-শ্বাশুড়ী খেয়াল করেন না, কেবল নিজেদের সেবা-যত্নের ত্রুটি ধরায় ব্যস্ত থাকেন। অন্য কোন অসুবিধা না থাকলে বিবাহিত ছেলেদের আলাদা সংসার করার অনুমতি দেওয়া উচিত। আজকাল এর মধ্যেই কল্যাণ বেশী। তবে বাপ-মা অসহায় ও বৃদ্ধাবস্থায় থাকলে তাঁদেরকে নিজ সংসারে পূর্ণ মর্যাদা ও যত্নের সাথে রাখতে হবে।
(৭) সমাজে একটা ধারণা চালু হয়ে গেছে যে, মেয়েরা তাদের পিতৃ সম্পত্তির অংশ বুঝে নিলে ভাইদের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক শেষ হয়ে যাবে। এটা মারাত্মক ভুল ধারণা ও অন্যায় রীতি। বোনেরা এসে ভাইদের সঙ্গে বা ছোট ভাইয়েরা বড় ভাইয়ের সঙ্গে শরীকানা অংশ নিয়ে ঝগড়া-ফাসাদ করার আগেই যদি তাদের হক তাদের বুঝে দেওয়া হয়, তাহ’লে তো আর ঝগড়া হওয়ার সম্ভাবনাই থাকে না। অনেক সময় দেখা যায়, বোনেরা শ্বশুরবাড়ীতে চরম দারিদ্রে্যর মধ্যে দিনাতিপাত করছে, অথচ তারই প্রাপ্য পিতৃ সম্পত্তি ভোগ করে ভাইয়েরা ধনের বড়াই করছে। অথচ হাদীছে এসেছে, من اخذ شِبرًا منَ الأرض ظلمًا فإنه يُطَوَّقُه يومَ القيامة عن سَبْعِ أَرضِيْنَ، ‘(শরীক ফাঁকি দিয়ে বা অন্যায়ভাবে) কারু এক বিঘত মাটিও যদি কেউ যুলুম করে ভোগ করে, তার উপরে ক্বিয়ামতের দিন তার গলায় সাত তবক যমীন বেড়ীরূপে পরিয়ে দেওয়া হবে’।[1]
(৮) রাজনীতি ও সমাজনীতি ক্ষেত্রে সর্বদা নেতৃত্বের প্রতি আনুগত্যশীল ও শ্রদ্ধাশীল থাকাটাই হ’ল ‘আদব’। এর বিপরীত করাটা ‘যুলুম’। কিন্তু নেতা যদি কারু উপরে যুলুম করেন, তবে তার শাস্তি হবে সর্বাধিক। ক্বিয়ামতের দিন যালেম ও খেয়ানতকারী নেতাদের কোমরে একটা করে ঝান্ডা গেড়ে দেওয়া হবে, যাতে সকলে তাকে দেখতে পায়।[2] গণতন্ত্রের নামে বর্তমান দলতন্ত্রে নেতৃত্ব বিভক্ত হওয়ার কারণে সুযোগসন্ধানী ও নেতৃত্ব লোভীদের সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। সরকারী ও বিরোধী দলের পারস্পরিক হানাহানিতে সমাজ বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। জোট সরকার হওয়ার কারণে এখন যুলুমের পরিধি আরও বিস্তৃতি লাভ করেছে। কেননা অনেক সময় জোট ঠিক রাখার জন্য শরীকদের অন্যায় আবদার বড় দলকে রক্ষা করতে হয়। ফলে রাষ্ট্র এখন ক্রমেই যালিমের প্রতিমূর্তিতে আবির্ভূত হচ্ছে। ‘রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস’ নামে একটি পরিভাষা ইতিমধ্যেই চালু হয়ে গেছে। যা আগে কারু জানা ছিল না। পৃথিবী ক্রমেই যুলুমের হুতাশনে পরিণত হচ্ছে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, ألظُّلْمُ ظُلُمَاتٌ يَوْمَ الْقِياَمةِ. ‘যুলুম ক্বিয়ামতের দিন ঘনঅন্ধকার হয়ে দেখা দিবে’।[3] অতএব যালেম শাসক ও নেতাদের জন্য মর্মান্তিক শাস্তি অপেক্ষা করছে। মূলতঃ হাক্কুল ইবাদ নষ্ট করাই হ’ল যুলুমের প্রধান কারণ। অতএব সর্বদা এ হকের প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখা কর্তব্য।[1]. মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/২৯৩৮ ‘ক্রয়-বিক্রয়’ অধ্যায়।
[2]. মুসলিম, মিশকাত হা/ ‘ইমারত’ অধ্যায়।
[3]. মুক্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৫১২৫।