হজ্জ ও ওমরাহ

হজ্জ-এর নিয়মাবলী  (مناسك الحج)

(১) মিনায় গমন (الذهاب إلى منى) :

তামাত্তু হজ্জ পালনকারীগণ যিনি ইতিপূর্বে ওমরাহ পালন শেষে ইহরাম খুলে ফেলেছেন ও হালাল হয়ে গেছেন, তিনি ৮ই যিলহাজ্জ সকালে স্বীয় অবস্থানস্থল হ’তে ওযূ-গোসল সেরে সুগন্ধি মেখে হজ্জের জন্য ইহরাম বাঁধবেন ও নিম্নোক্ত দো‘আ পাঠ করবেন- لَبَّيْكَ اَللَّهُمَّ حَجًّا   ‘লাববায়েক আল্লা-হুম্মা হাজ্জান’ (হে আল্লাহ! আমি হজ্জের উদ্দেশ্যে তোমার দরবারে হাযির)। অতঃপর ‘তালবিয়াহ’ পাঠ করতে করতে কা‘বা থেকে প্রায় ৮ কিঃমিঃ দক্ষিণ-পূর্বে মিনা অভিমুখে রওয়ানা হবেন ও যোহরের পূর্বেই সেখানে পৌঁছে যাবেন।

অতঃপর সেখানে রাত্রি যাপন করবেন ও জমা না করে শুধু ক্বছরের সাথে প্রতি ওয়াক্ত ছালাত পৃথক পৃথকভাবে মসজিদে খায়েফে আদায় করবেন। তবে জামা‘আতে ইমাম পূর্ণ পড়লে তিনিও পূর্ণ পড়বেন। ‘ক্বছর’ অর্থ, চার রাক‘আত বিশিষ্ট ফরয ছালাতগুলি দু’রাক‘আত পড়া। সফরে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সুন্নাত সমূহ পড়তেন না।[1] তবে ফজরের দু’রাক‘আত সুন্নাত ও বিতর ছাড়তেন না।[2] এই সময় সিজদায় ও শেষ বৈঠকে ইচ্ছামত হৃদয় ঢেলে দিয়ে দো‘আ করবেন। তবে রুকু ও সিজদায় কুরআনী দো‘আগুলি পড়বেন না।

উল্লেখ্য যে, মক্কার পরে মিনা হ’ল হাজী ছাহেবদের দ্বিতীয় আবাসস্থল। যেখানে তাঁদেরকে আরাফা ও মুযদালিফা সেরে এসে আইয়ামে তাশরীক্বের তিন দিন কংকর মারার জন্য অবস্থান করতে হয়। ৯ তারিখে হজ্জ সেরে ১০ই যিলহাজ্জ সকালে মিনায় ফিরে কংকর মেরে প্রাথমিক হালাল হওয়ার আগ পর্যন্ত তাকে ইহরাম অবস্থায় থাকতে হবে।

(২) আরাফা ময়দানে অবস্থান (الوقوف بعرفة) :

এটিই হ’ল হজ্জের প্রধান অনুষ্ঠান। এটি পালন না করলে হজ্জ হবে না। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, الْحَجُّ عَرَفَةُ  ‘হজ্জ হ’ল আরাফাহ’।[3] ৯ই যিলহাজ্জ সূর্যোদয়ের পর মিনা হ’তে ধীরস্থিরভাবে ‘তালবিয়াহ’ পাঠ করতে করতে ১৪.৪ কিঃমিঃ দক্ষিণ-পূর্বে আরাফা ময়দান অভিমুখে রওয়ানা হবেন এবং ময়দানের চিহ্নিত সীমানার মধ্যে সুবিধামত স্থানে অবস্থান নিবেন।[4] যেখানে তিনি যোহর হ’তে মাগরিব পর্যন্ত অবস্থান করবেন। আরাফাতে পৌঁছে সূর্য ঢলার পরে ইমাম বা তাঁর প্রতিনিধি কর্তৃক হজ্জের সুন্নাতী খুৎবা হয়ে থাকে। যা শোনা যরূরী। অতঃপর যোহর ও আছরের ছালাত এক আযান ও দুই ইক্বামতে ২+২=৪ রাক‘আত জমা ও ক্বছর সহ মূল জামা‘আতের সাথে আদায় করবেন। সম্ভব না হ’লে নিজেরা পৃথক জামা‘আতে নিজ নিজ তাঁবুতে জমা ও ক্বছর করবেন।  

আরাফাতের ময়দানে পৌঁছে হৃদয়ের গভীরে ফেলে আসা স্মৃতিচারণ করতে হবে যে, এ ময়দানেই একদিন আমরা মানবজাতি আমাদের সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর সম্মুখে অঙ্গীকার করেছিলাম যে, আপনিই আমাদের প্রতিপালক। যাকে ‘আহ্দে আলাস্ত্ত’ বলা হয়। অতএব সার্বিক জীবনে আমরা আল্লাহরই দাসত্ব করব এবং শয়তানের দাসত্ব থেকে বিরত থাকব। এই দৃঢ় সংকল্প নিয়ে এখানে অবস্থানকালে সর্বদা দো‘আ-দরূদ ও তাসবীহ-তেলাওয়াতে রত থাকবেন এবং ক্বিবলামুখী হ’য়ে দু’হাত ঊর্ধ্বে তুলে আল্লাহর নিকটে কায়মনোচিত্তে প্রার্থনায় রত থাকবেন। যেন আল্লাহ তাকে জাহান্নাম হ’তে মুক্তদাসদের অন্তর্ভুক্ত করে নেন। কেননা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘আরাফার দিন আল্লাহ সর্বাধিক সংখ্যক বান্দাকে জাহান্নাম হ’তে মুক্তি দান করে থাকেন এবং তিনি নিকটবর্তী হন ও ফেরেশতাদের নিকট গর্ব করে বলেন, দেখ ওরা কি চায়? (মুসলিম)। অন্য বর্ণনায় এসেছে, তিনি নিম্ন আকাশে নেমে আসেন ও ফেরেশতাদের বলেন, তোমরা সাক্ষী থাক আমি ওদের সবাইকে ক্ষমা করে দিলাম’।[5] রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘শ্রেষ্ঠ দো‘আ হ’ল আরাফার দো‘আ...’।[6] আরাফার ময়দানে অবস্থান করে তওবা-ইস্তিগফার, যিকর ও তাসবীহ সহ আল্লাহর নিকটে হৃদয়-মন ঢেলে দো‘আ করাটাই হ’ল হজ্জের মূল কাজ। এ সময় ছহীহ হাদীছে বর্ণিত বিভিন্ন দো‘আ পড়বেন ও কুরআন তেলাওয়াতে রত থাকবেন। আরাফার জন্য নির্দিষ্ট কোন দো‘আ নেই।

উল্লেখ্য যে, ৯ই যিলহাজ্জ হাজীগণ ছিয়াম পালন করবেন না। তবে যারা হাজী নন, তাদের জন্য আরাফার দিন ছিয়াম পালন করা অত্যন্ত নেকীর কাজ। এতে বিগত এক বছরের ও আগামী এক বছরের গোনাহ মাফ হয়’।[7] এর দ্বারা পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে অবস্থানকারী মুসলিম নর-নারীগণ হজ্জের বিশ্ব সম্মেলনের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেন। যা মুসলিম ঐক্য ও সংহতির প্রতি গভীরভাবে উদ্বুদ্ধ করে।

৯ই যিলহাজ্জ পূর্বাহ্ন হ’তে ১০ই যিলহাজ্জ ফজরের পূর্ব পর্যন্ত সময়ের মধ্যে আরাফার ময়দানে কিছুক্ষণ অবস্থান করলেই কিংবা ময়দানের উপর দিয়ে হজ্জের নিয়তে হেঁটে গেলেও আরাফায় অবস্থানের ফরয আদায় হয়ে যাবে।

(৩) মুযদালিফায় রাত্রিযাপন  (البيات في مزدلفة) :

৯ই যিলহাজ্জ সুর্যাস্তের পর আরাফা ময়দান হ’তে ‘তালবিয়াহ’ পাঠ ও তওবা-ইস্তিগফার করতে করতে ধীরে-সুস্থে প্রায় ৯ কিঃমিঃ উত্তর-পশ্চিমে মুযদালিফা অভিমুখে রওয়ানা হবেন। কোন অবস্থাতেই সূর্যাস্তের পূর্বে রওয়ানা হওয়া যাবে না। রওয়ানা দিলে পুনরায় ফিরে আসতে হবে ও সূর্যাস্তের পরে যাত্রা করতে হবে। যদি ফিরে না আসেন, তাহ’লে তার উপরে কাফফারা স্বরূপ ফিদ্ইয়া ওয়াজিব হবে।

মুযদালিফায় পৌঁছে ‘জমা তাখীর’ করবেন। অর্থাৎ মাগরিব পিছিয়ে এশার সাথে জমা করবেন। এক আযান ও দুই এক্বামতে জমা ও ক্বছর অর্থাৎ মাগরিব তিন রাক‘আত ও এশা দু’রাক‘আত জমা করে পড়বেন। যরূরী কোন কারণে জমা ও ক্বছরের মাঝে বিরতি ঘটে গেলে তাতে কোন দোষ নেই। দুই ছালাতের মাঝে বা এশার ছালাতের পরে আর কোন ছালাত নেই। এরপর আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) ফজর পর্যন্ত ঘুমিয়ে ছিলেন।[8] এতে বুঝা যায় যে, তিনি এই রাতে বিতর বা তাহাজ্জুদ পড়েননি। অতঃপর ঘুম থেকে উঠে আউয়াল ওয়াক্তে ফজর পড়ে ‘আল-মাশ‘আরুল হারামে’ (অর্থাৎ মুযদালিফা মসজিদে) গিয়ে অথবা নিজ অবস্থানে বসে দীর্ঘক্ষণ ক্বিবলামুখী হয়ে দো‘আ-ইস্তিগফারে রত থাকবেন। তারপর ভালভাবে ফর্সা হওয়ার পর সূর্যোদয়ের পূর্বেই মিনা অভিমুখে রওয়ানা হবেন।

দুর্বল ও মহিলাদের নিয়ে অর্ধরাত্রির পরেও রওয়ানা দেওয়া জায়েয আছে। তার পূর্বে রওয়ানা হওয়া জায়েয নয়। রওয়ানা দিলে ফিরে আসতে হবে। নইলে কাফফারা স্বরূপ ফিদ্ইয়া দিতে হবে।

উল্লেখ্য যে, অর্ধরাত্রির পরে নিয়ত সহকারে মুযদালিফার উপর দিয়ে চলে গেলেও সেখানে অবস্থানের ওয়াজিব আদায় হয়ে যাবে। মুযদালিফা হ’তে মিনায় রওয়ানা হওয়ার সময় সেখান থেকে অথবা চলার পথে রাস্তার পাশ  থেকে ছোলার চেয়ে একটু বড় সাতটি ছোট্ট পাথর বা কংকর কুড়িয়ে নিবেন। যা মিনায় গিয়ে সকালে জামরাতুল আক্বাবাহ বা ‘বড় জামরায়’ মারার সময় ব্যবহার করবেন।

এ সময় বিশেষ ধরনের কংকর কুড়ানোর জন্য মুযদালিফা পাহাড়ে উঠে টর্চ লাইট মেরে লোকদের যে কঠিন প্রচেষ্টা চালাতে দেখা যায়, সেটা স্রেফ বিদ‘আতী আক্বীদার ফলশ্রুতি মাত্র।

মুযদালিফায় গিয়ে মূল কাজ হ’ল : মাগরিব-এশা একত্রে জমা করার পর ঘুমিয়ে যাওয়া। অতঃপর ঘুম থেকে উঠে আউয়াল ওয়াক্তে ফজর পড়ে ক্বিবলামুখী হয়ে কায়মনোচিত্তে দো‘আয় মশগূল হওয়া। রাতে এই বিশ্রামের কারণ যাতে পরদিন কুরবানী ও কংকর মারার কষ্ট সহজ হয়। আরাফা ময়দানের ন্যায় এখানেও কোন নির্দিষ্ট দো‘আ নেই।

(৪) মিনায় প্রত্যাবর্তন  (الرجوع إلى منى) :

১০ই যিলহাজ্জ ফজরের ছালাত আদায়ের পর সূর্যোদয়ের পূর্বে মুযদালিফা থেকে ‘তালবিয়াহ’ পাঠ করতে করতে রওয়ানা হয়ে মুযদালিফার শেষ প্রান্ত ও মিনার সীমান্তবর্তী ‘মুহাসসির’ উপত্যকায় একটু জোরে চলবেন।[9] অতঃপর প্রায় ৫ কিঃমিঃ উত্তর-পশ্চিমে মিনা পৌঁছে সূর্যোদয়ের পর প্রথমে ‘জামরাতুল আক্বাবাহ’ যা মক্কার নিকটবর্তী, সেই বড় জামরাকে লক্ষ্য করে মক্কা বাম দিকে ও মিনা ডান দিকে রেখে সাতটি কংকর নিক্ষেপ করবেন। এরপর থেকে ‘তালবিয়াহ’ পাঠ বন্ধ করবেন এবং ইহরাম খুলে হালাল হ’তে পারবেন, যদিও মাথা মুন্ডন ও কুরবানী বাকী থাকে। কোন কারণে পূর্বাহ্নে কংকর নিক্ষেপে ব্যর্থ হ’লে অপরাহ্নে কিংবা সূর্যাস্তের পূর্বে কংকর মারবেন। উল্লেখ্য যে, দুর্বল ও মহিলাগণ যদি সূর্যোদয়ের পূর্বে মিনায় পৌঁছে যান, তাহ’লে তারা সূর্যোদয় পর্যন্ত অপেক্ষা করবেন। অতঃপর কংকর মারবেন।

প্রতিটি কংকর নিক্ষেপের সময় ডান হাত উঁচু করে বলবেন, الله اكبر  ‘আল্লা-হু আকবর’ (আল্লাহ সবার বড়)। এভাবে সাতবার তাকবীর দিয়ে সাতটি কংকর মারবেন। এই তাকবীর ধ্বনি শয়তানের বিরুদ্ধে মুমিনের পক্ষ থেকে আল্লাহর বড়ত্বের ঘোষণা এবং ঈদের তাকবীরের ন্যায় ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত। কংকর হাউজে পড়লেই হবে। পিলারের গায়ে লাগা শর্ত নয়।[10]

অতঃপর তাকবীর ধ্বনির সময় নিয়ত এটাই থাকবে যে, আমি আমার সার্বিক জীবনে শয়তান ও শয়তানী বিধানকে দূরে ছুঁড়ে ফেলে সর্বাবস্থায় আল্লাহ ও আল্লাহর বিধানকে ঊর্ধ্বে রাখব। বস্ত্ততঃ হজ্জের পর থেকে আমৃত্যু ত্বাগূতের বিরুদ্ধে আল্লাহর বিধানকে অগ্রাধিকার দেবার সংগ্রামে টিকে থাকতে পারলেই হজ্জ সার্থক হবে ইনশাআল্লাহ।

মিনায় পৌঁছেই দুপুরের আগে বা পরে যথাশীঘ্র কংকর মেরে কুরবানী করবেন। অতঃপর পুরুষগণ মাথা মুন্ডন করবেন অথবা সমস্ত চুল খাটো করে ছাঁটবেন। মহিলাগণ কেবল চুলের অগ্রভাগ সামান্য কেটে ফেলবেন। অতঃপর ইহরাম খুলে হালাল হয়ে যাবেন ও সাধারণ পোষাক পরিধান করবেন। তবে এটা হবে প্রাথমিক হালাল বা ‘তাহাল্লুলে আউয়াল’। এই হালালের ফলে স্ত্রী মিলন ব্যতীত সবকিছু সাধারণ অবস্থার ন্যায় করা যাবে। এরপরই মক্কায় গিয়ে ‘ত্বাওয়াফে ইফাযাহ’ করলে পুরা হালাল হওয়া যাবে। এসময় ‘রমল’ করার প্রয়োজন নেই। ‘ত্বাওয়াফে ইফাযাহ’-কে ‘ত্বাওয়াফে যিয়ারত’ও বলা হয়। এটি হজ্জের অন্যতম রুকন। যা না করলে হজ্জ বিনষ্ট হয়। সেকারণ রাত্রিতে হ’লেও ১০ই যিলহাজ্জ তারিখেই এটা সম্পন্ন করা উচিত। নইলে আইয়ামে তাশরীক্বের মধ্যে অর্থাৎ ১১, ১২, ১৩ই যিলহাজ্জের মধ্যে সম্পন্ন করা উত্তম।[11]

উল্লেখ্য যে, যিলহাজ্জ মাসের পুরাটাই হজ্জের মাস সমূহের অন্তর্ভুক্ত। অতএব এ মাসের মধ্যেই ‘ত্বাওয়াফে ইফাযাহ’ সম্পন্ন করতে হবে। কিন্তু যদি কোন কারণ বশতঃ এ মাস অতিক্রান্ত হয়ে যায়, তবে তার হজ্জ হয়ে যাবে। তবে কাফফারা স্বরূপ ফিদ্ইয়া দিতে হবে। ঋতুর আশংকাকারী মহিলাগণ এ সময় ঔষধ ব্যবহারের মাধ্যমে সাময়িকভাবে ঋতুরোধ করে ‘ত্বাওয়াফে ইফাযাহ’ সেরে নিতে পারেন।[12]

‘ত্বাওয়াফে ইফাযাহ’ শেষে সেদিনই মিনায় ফিরে এসে রাত্রিযাপন করবেন।

মিনায় ৪টি কাজ :

১০ই যিলহাজ্জ সকালে মুযদালিফা থেকে মিনায় পৌঁছে মোট চারটি কাজ পর্যায়ক্রমে করতে হয়। (১) বড় জামরায় কংকর মারা (২) কুরবানী করা (৩) মাথা মুন্ডন করা অথবা সমস্ত চুল ছোট করা। টাকমাথা যাদের তারাও মাথায় ক্ষুর দিবেন। এসময় সকলের জন্য গোফ ছাঁটা ও নখ কাটা মুস্তাহাব।[13] (৪) মক্কায় গিয়ে ‘ত্বাওয়াফে ইফাযাহ’ করা। তবে এ কাজগুলির কোনটি আগপিছ হয়ে গেলে তাতে কোন দোষ নেই। যেমন কেউ কংকর মারার আগেই ‘ত্বাওয়াফে ইফাযাহ’ করল অথবা আগেই মাথা মুন্ডন করল ও পরে কুরবানী করল এবং শেষে কংকর মারল, তাতে কোন দোষ নেই। উল্লেখ্য যে, কুরবানী মিনা ছাড়া মক্কাতে এসেও করা যায়। কেননা মক্কা, মিনা, মুযদালিফা, আযীযিয়াহ সবই হারামের অন্তর্ভুক্ত। তবে আরাফাত নয়।

তামাত্তু হাজীগণ ‘ত্বাওয়াফে ইফাযাহ’ করার পর সাঈ করবেন। অতঃপর পূর্ণ হালাল হবেন। এর কারণ এই যে, প্রথম ত্বাওয়াফ ও সাঈ ছিল ওমরাহর জন্য। কিন্তু এবারেরটা হ’ল হজ্জের জন্য। ক্বিরান ও ইফরাদ হাজীগণ শুরুতে মক্কায় এসে ‘ত্বাওয়াফে কুদূম’-এর সময় সাঈ করে থাকলে এখন আর সাঈ করতে হবে না। কেবল ‘ত্বাওয়াফে ইফাযাহ’ করেই হালাল হয়ে যাবেন।

কুরবানী  (الأضحية) : আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে বৃদ্ধ বয়সের একমাত্র পুত্রকে নিজ হাতে কুরবানী দেওয়ার ও পুত্রের পক্ষ থেকে স্বেচ্ছায় তা বরণ করে নেওয়ার অনন্য আত্মোৎসর্গের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পুরস্কার স্বরূপ জান্নাত হ’তে প্রেরিত দুম্বার ‘মহান কুরবানী’র পুণ্যময় স্মৃতিকে ধারণ করেই কুরবানী অনুষ্ঠান পালন করতে হয়। যাতে মুসলমান সর্বদা দুনিয়াবী মহববতের উপরে আল্লাহর মহববতকে স্থান দিতে পারে। প্রায় চার হাযার বছর পূর্বে এই দিনে এই মিনা প্রান্তরেই সেই ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটেছিল। (ক) কুরবানী তাই মিনা সহ ‘হারাম’ এলাকার মধ্যেই করতে হয়, বাইরে নয়। যদি কেউ ‘হারাম’ এলাকার বাইরে আরাফাতের ময়দান বা অন্যত্র কুরবানী করেন, তবে তাকে হারামে এসে পুনরায় কুরবানী দিতে হবে। সামর্থ্য না থাকলে ফিদ্ইয়া স্বরূপ হজ্জের মধ্যে ৩টি ও বাড়ী ফিরে ৭টি মোট ১০টি ছিয়াম পালন করতে হবে। (খ) হাজী ছাহেব সম্পূর্ণ নিজ দায়িত্বে মিনার বাজার থেকে নিজের কুরবানীর পশু খরিদ করে কসাইখানায় যবহ করে গোশত কুটাবাছা করে নিয়ে আসতে পারেন।

কুরবানীর পশু সুন্দর, স্বাস্থ্যবান ও ত্রুটিমুক্ত হ’তে হবে। কুরবানী করার সময় উট হ’লে দাঁড়ানো অবস্থায় ‘হলকূমে’ অর্থাৎ কণ্ঠনালীর গোড়ায় অস্ত্রাঘাত করে রক্ত ছুটিয়ে দিবেন, যাকে ‘নহর’ করা বলা হয়। আর গরু বা দুম্বা-বকরী হ’লে দক্ষিণ দিকে মাথা রেখে বামকাতে ফেলে ক্বিবলামুখী হয়ে তীক্ষ্ণধার অস্ত্র দিয়ে দ্রুত ‘যবহ’ করবেন। তবে ক্বিবলামুখী হ’তে ভুলে গেলেও ইনশাআল্লাহ কোন দোষ বর্তাবে না। নহর বা যবহ কালে নিম্নোক্ত দো‘আ পড়বেন-

بِسْمِ اللهِ وَاللهُ أَكْبَرُ، اَللَّهُمَّ مِنْكَ وَلَكَ، اَللَّهُمَّ تَقَبَّلْ مِنِّى-

‘বিসমিল্লা-হি ওয়াল্লা-হু আকবার; আল্লা-হুম্মা মিন্কা ওয়া লাকা, আল্লা-হুম্মা তাক্বাববাল মিন্নী’।

অর্থ: ‘আল্লাহর নামে কুরবানী করছি। আল্লাহ সবার বড়। হে আল্লাহ! এটি তোমারই তরফ হ’তে প্রাপ্ত ও তোমারই উদ্দেশ্যে নিবেদিত। হে আল্লাহ! তুমি এটি আমার পক্ষ থেকে কবুল কর’। অন্য কোন পুরুষের পক্ষ থেকে হ’লে বলবেন ‘মিন ফুলা-ন’ এবং মহিলার পক্ষ থেকে হ’লে বলবেন ‘মিন ফুলা-নাহ’।[14] জন প্রতি একটি করে বকরী বা দুম্বা ও সাত জনে মিলে একটি গরু অথবা সাত বা দশজনে একটি উট কুরবানী দিতে পারেন।[15] মেয়েরাও যবহ বা নহর করতে পারেন।

জানা আবশ্যক যে, নিজে কুরবানী করে পশুটিকে ফেলে রেখে আসা জায়েয নয়। বরং এতে গোনাহগার হ’তে হবে। কেননা কুরবানীর পশু আল্লাহর উদ্দেশ্যে যবহ করা হয় এবং তা অত্যন্ত

সম্মানিত। অতএব তাকে যত্নের সাথে কুটাবাছা করতে হবে, নিজে খেতে হবে, অন্যকে দিতে হবে এবং ফকীর-মিসকীনের মধ্যে অবশ্যই বিতরণ করতে হবে। নিজে না পারলে বিশ্বস্ত কাউকে দায়িত্ব দিতে হবে। বর্তমানে ব্যাংকে কুরবানী বাবদ নির্ধারিত টাকা জমা দিলে হাজী ছাহেবের পক্ষে তারাই অর্থাৎ সঊদী সরকার উক্ত দায়িত্ব পালন করে থাকেন। সরকার অনুমোদিত সংস্থা সমূহের লোকেরা উক্ত হাজীর নামে মিনা প্রান্তরেই সরকারী কসাইখানায় গিয়ে যবহ বা নহর করে থাকে। অতঃপর এগুলো মেশিনের সাহায্যে ছাফ করে আস্ত বা টুকরা করে ফ্রিজে রেখে মোটা পলিথিনে মুড়িয়ে বিভিন্ন দেশে গরীবদের মাঝে বিতরণের জন্য সংশ্লিষ্ট দেশ সমূহের সরকারের নিকটে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

অতএব মিনা প্রান্তরে মসজিদে খায়েফ-এর নিকটবর্তী সেলুন এলাকার সামনে বা অন্যত্রে অবস্থিত বিভিন্ন ব্যাংক কাউন্টারে কুরবানী বা হাদ্ই বাবদ নির্ধারিত ‘রিয়াল’ জমা দিয়ে রসিদ নিলেই কুরবানীর দায়িত্ব শেষ হ’ল বলে বুঝতে হবে। কুরবানী শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করার কোন প্রয়োজন নেই।  

(গ) কুরবানীর পশু কেনার সামর্থ্য না থাকলে তার পরিবর্তে দশটি ছিয়াম পালন করতে হবে। তিনটি হজ্জের মধ্যে (৯ই যিলহাজ্জের পূর্বে অথবা ১০ই যিলহাজ্জের পরে) এবং বাকী সাতটি বাড়ী ফিরে (বাক্বারাহ ২/১৯৬)। ১০ই যিলহাজ্জ কুরবানীর দিন ও পরবর্তী আইয়ামে তাশরীক্বের তিনদিন সকলের জন্য ছিয়াম পালন নিষিদ্ধ।[16] তবে ফিদ্ইয়ার তিনটি ছিয়াম এ তিনদিন রাখা যায়।[17]

(ঘ) উল্লেখ্য যে, ১০ই যিলহাজ্জ তাকবীর সহ কংকর নিক্ষেপ করা ঈদুল আযহার তাকবীর ও ছালাতের স্থলাভিষিক্ত। সেজন্য রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বিদায় হজ্জের এদিন কংকর নিক্ষেপের পর সকলের উদ্দেশ্যে খুৎবা দিয়েছেন। যেমন তিনি মদীনায় থাকা অবস্থায় ঈদের ছালাতের পর খুৎবা দিতেন। যেহেতু রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও খুলাফায়ে রাশেদীন মিনাতে ঈদুল আযহার ছালাত আদায় করেননি, সেহেতু তা আদায় করা হয় না। তবে (ঙ) এ দিন বড় জামরায় কংকর নিক্ষেপ শেষে ঈদের তাকবীর ‘আল্লাহু আকবর, আল্লাহ আকবর, লা ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু; আল্লা-হু আকবর, আল্লা-হু আকবর, ওয়া লিল্লা-হিল হাম্দ’ (আল্লাহ সবার বড়, আল্লাহ সবার বড়। নেই কোন উপাস্য আল্লাহ ব্যতীত। আল্লাহ সবার বড়, আল্লাহ সবার বড়, আর আল্লাহর জন্যই সকল প্রশংসা) বারবার পড়া উচিত।

মিনায় অবস্থান  (المبيت بمنى) : ১১, ১২, ১৩ই যিলহাজ্জ আইয়ামে তাশরীক্ব-এর তিনদিন মিনায় রাত্রি যাপন করা ওয়াজিব। এ সময় পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত জামা‘আতের সাথে মসজিদে খায়েফে আদায় করা উত্তম। ছালাত ক্বছর করা ও পূর্ণ পড়া দু’টিই জায়েয।[18] ইমাম যেভাবে পড়েন, সেভাবেই পড়তে হবে।[19] রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এ সময় প্রতি রাতে কা‘বা যেয়ারত করতেন ও ত্বাওয়াফ করে ফিরে আসতেন। প্রথম রাতে মিনায় থেকে শেষ রাতেও মক্কা যাওয়া যায়। মিনায় রাত্রি যাপন না করলে তাকে ফিদ্ইয়া স্বরূপ একটি কুরবানী দিতে হবে। ৮ই যিলহাজ্জ দুপুর হ’তে ১৩ই যিলহাজ্জ মাগরিব পর্যন্ত গড়ে ৫ দিন মিনায় ও মুযদালিফায় অবস্থান করতে হয়। অবশ্য ১২ তারিখ সন্ধ্যার পূর্বেও মিনা থেকে মক্কায় ফিরে আসা জায়েয আছে। অনেকে মিনায় না থেকে মক্কায় এসে রাত্রি যাপন করেন ও দিনের বেলায় মিনায় গিয়ে কংকর মারেন। বাধ্যগত শারঈ ওযর ব্যতীত এটি করা সম্পূর্ণরূপে নাজায়েয। যদি কেউ এটা করেন, তবে তাকে ফিদ্ইয়া স্বরূপ একটি কুরবানী দিতে হবে।

কংকর নিক্ষেপ  (رمى الجمار) :মিনায় ৪দিনে মোট ৭০টি কংকর নিক্ষেপ করতে হয়। ১০ই যিলহাজ্জ কুরবানীর দিন সকালে বড় জামরায় ৭টি। অতঃপর ১১, ১২, ১৩ই যিলহাজ্জ প্রতিদিন দুপুরে সূর্য পশ্চিমে ঢলে পড়ার পর হ’তে সন্ধ্যার মধ্যে তিনটি জামরায় ৩´৭=২১টি করে মোট  ৬৩টি। বাধ্যগত অবস্থায় রাতেও কংকর নিক্ষেপ করা যায়। ছোলার চাইতে একটু বড় যেকোন কংকর হ’লেই চলবে এবং তা যেখান থেকে খুশী কুড়িয়ে নেওয়া যায়। তবে ১০ তারিখে বড় জামরায় মারার জন্য প্রথম সাতটি কংকর মুযদালিফা থেকে বা মিনায় ফেরার সময় রাস্তা থেকে  কুড়িয়ে নেওয়া মুস্তাহাব। ‘মুযদালিফা পাহাড় থেকে বিশেষ সাইজ ও গুণ সম্পন্ন কংকর সংগ্রহ করতে হবে’ বলে যে ধারণা প্রচার করা হয়ে থাকে, তা নিছক ভিত্তিহীন।

কংকর মারার আদব  (من آداب الرمى) :

(ক) ১১, ১২, ১৩ তারিখে প্রথমে ‘জামরা ছুগরা’ (ছোট) যা মসজিদে খায়ফের নিকটবর্তী, তারপর ‘উস্তা’ (মধ্যম) ও সবশেষে ‘কুবরা’ (বড়)-তে কংকর মারতে হবে। যদি কেউ সূর্য পশ্চিমে ঢলার পূর্বে কংকর মারে কিংবা নিয়মের ব্যতিক্রম করে আগে ‘বড়’ পরে ‘মধ্যম’ ও শেষে ‘ছোট’ জামরায় কংকর মারে, তবে তাকে ফিদ্ইয়া স্বরূপ একটি কুরবানী দিতে হবে।

(খ) পূর্ণ শালীনতা ও ভদ্রতার সাথে ‘জামরা’-র উঁচু পিলার বেষ্টিত হাউজের কাছাকাছি পৌঁছে তার মধ্যে কংকর নিক্ষেপ করবেন। প্রতিবারে ‘আল্লাহু আকবর’ বলে ডান হাত উঁচু করে সাতবারে সাতটি কংকর মারবেন। খেয়াল রাখতে হবে হাউজের মধ্যে পড়ল কি-না। নইলে পুনরায় মেরে সাতটি সংখ্যা পূরণ করতে হবে।

(গ) কংকর গণনায় ভুল হ’লে বা অনিচ্ছাকৃতভাবে দু’একটা পড়ে গেলে বা হারিয়ে গেলে, তাতে কোন দোষ হবে না। কিন্তু সবগুলি হারিয়ে গেলে পুনরায় কংকর সংগ্রহ করে এনে মারতে হবে। নইলে ফিদ্ইয়া দিতে হবে।

(ঘ) ছোট ও মধ্যম জামরায় কংকর মেরে প্রতিবারে একটু দূরে সরে গিয়ে ক্বিবলামুখী হয়ে দাঁড়িয়ে দু’হাত তুলে দীর্ঘক্ষণ আল্লাহর নিকট দো‘আ করতে হয়। অতঃপর বড় জামরায় কংকর মারার পর আর দাঁড়াতে হয় না বা দো‘আও করতে হয় না।

(ঙ) এই সময় হুড়াহুড়ি করা, ঝগড়া করা, জোরে কথা বলা, কারু গায়ে আঘাত করা, হাউজে জুতা-স্যান্ডেল নিক্ষেপ করা, কারু উপরে হুমড়ি খেয়ে পড়া, পা দাবানো ইত্যাদি কষ্টদায়ক যাবতীয় ক্রিয়া-কলাপ থেকে বিরত থাকতে হবে। শয়তান মারার নামে এগুলি আরেক ধরনের শয়তানী কাজ মাত্র। হজ্জের পবিত্র অনুষ্ঠান সমূহ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। এগুলি পালন করতে এসে যাবতীয় বিদ‘আত থেকে বিরত থাকা অপরিহার্য। নইলে হজ্জের নেকী হ’তে মাহরূম হবার সমূহ সম্ভাবনা থেকে যাবে।

(চ) সক্ষম পুরুষ বা মহিলার পক্ষ হ’তে অন্যকে কংকর মারার দায়িত্ব দেওয়া জায়েয নয়। যার কংকর তাকেই মারতে হবে।

(ছ) নির্দিষ্ট সময় ব্যতীত অন্য সময়ে কংকর মারার ক্বাযা আদায় করার নিয়ম নেই।

(জ) তবে যদি কেউ শারঈ ওযর বশতঃ সন্ধ্যার সময়সীমার মধ্যে কংকর মারতে ব্যর্থ হন, তাহ’লে বাধ্যগত অবস্থায় তিনি সূর্যাস্তের পর হ’তে ফজরের আগ পর্যন্ত সময়ের মধ্যে কংকর মারতে পারেন।

(ঝ) বদলী হজ্জের জন্য কিংবা প্রচন্ড ভিড়ের কারণে দুর্বল, রোগী বা অপারগ মহিলা হাজীর পক্ষ থেকে দায়িত্বপ্রাপ্ত হ’লে প্রথমে নিজের জন্য সাতটি কংকর মারবেন। পরে দায়িত্ব দানকারী মুওয়াক্কিল-এর নিয়তে তার পক্ষে সাতটি কংকর মারবেন।

(ঞ) ১২ই যিলহাজ্জ কংকর মারার পর হজ্জের কাজ শেষ করতে চাইলে সূর্যাস্তের আগেই মিনা ত্যাগ করে মক্কা অভিমুখে রওয়ানা হবেন। যদি রওয়ানা অবস্থায় ভিড়ের কারণে মিনাতেই সূর্য ডুবে যায়, তাতেও কোন অসুবিধা নেই। কিন্তু যদি রওয়ানা হবার পূর্বেই মিনাতে সূর্য অস্ত যায়, তাহ’লে থেকে যেতে হবে ও পরদিন দুপুরে সূর্য ঢলার পর আগের দিনের ন্যায় যথারীতি তিন জামরায় ২১টি কংকর মেরে রওয়ানা হ’তে হবে। ১২ তারিখে আগেভাগে চলে যাওয়ার চাইতে ১৩ তারিখে দেরী করে যাওয়াই উত্তম। কেননা এতেই সুন্নাতের পূর্ণ অনুসরণ হয়।

(ট) বাধ্যগত শারঈ ওযর থাকলে মিনায় রাত্রিযাপন না করে ১১-১২ দু’দিনের কংকর যেকোন একদিনে একসাথে মেরে মক্কায় ফেরা যাবে।[20]

(৫) বিদায়ী ত্বাওয়াফ  (طواف الوداع):

ঋতুবতী ও নেফাস ওয়ালী মহিলা ব্যতীত কোন হাজী বিদায়ী ত্বাওয়াফ ছাড়া মক্কা ত্যাগ করতে পারবেন না।[21] যদি কেউ সেটা করেন, তাহ’লে তাকে ফিদ্ইয়া স্বরূপ একটি কুরবানী দিতে হবে। অতএব মিনার ইবাদত সমূহ শেষ করে মক্কায় ফিরে এসে হাজীগণ বায়তুল্লাহর বিদায়ী ত্বাওয়াফ করবেন। এ সময় সাঈ করার প্রয়োজন নেই।

তবে যদি ইতিপূর্বে ‘ত্বাওয়াফে ইফাযাহ’ না করে থাকেন, তাহ’লে তামাত্তু হাজীগণ ‘ত্বাওয়াফে ইফাযাহ’ ও সাঈ করে পূর্ণ হালাল হয়ে দেশে রওয়ানা হবেন। তখন তাকে আর পৃথকভাবে ‘বিদায়ী ত্বাওয়াফ’ করতে হবে না। পক্ষান্তরে ক্বিরান ও ইফরাদ হাজীগণ শুরুতে মক্কায় এসে ত্বাওয়াফে কুদূম-এর সময় সাঈ করে থাকলে এখন আর তাকে সাঈ করতে হবে না। কেবল ‘ত্বাওয়াফে ইফাযাহ’ করেই হালাল হয়ে দেশে রওয়ানা হবেন। অনুরূপভাবে ঋতুবতী বা নেফাস ওয়ালী মহিলাগণ বিদায়ী ত্বাওয়াফ ছাড়াই বায়তুল্লাহ থেকে বিদায় হবার দো‘আ পাঠ করবেন, যা ইতিপূর্বে বর্ণিত হয়েছে (‘সফরের আদব’ দো‘আ-৬ দ্রঃ)

তিনটি হজ্জের সময়কাল  (ميعاد الأنساك الثلاثة) :

তিনটি হজ্জের মধ্যে তামাত্তু হজ্জের জন্য সময় লাগে একটু বেশী এবং এতে কষ্টও কিছুটা বেশী। কেননা তাকে প্রথমে ওমরাহর ত্বাওয়াফ ও সাঈ করতে হয়। পরে নতুন ভাবে হজ্জের ইহরাম বেঁধে হজ্জ শেষে ‘ত্বাওয়াফে ইফাযাহ’ ও সাঈ করতে হয়। ফলে গড়ে দু’টি বা তিনটি ত্বাওয়াফ ও দু’টি সাঈ করতে হয়। অবশ্য এতে তার নেকীও বেশী হয়।

এর পরের সংক্ষিপ্ত হজ্জ হ’ল ক্বিরান ও ইফরাদ। এতে গড়ে দু’টি ত্বাওয়াফ ও একটি সাঈ করতে হয়। সর্বসাকুল্যে ৮ই যিলহাজ্জ থেকে ১২ বা ১৩ই যিলহাজ্জ পর্যন্ত ৫ বা ৬ দিনে এই হজ্জ সমাপ্ত হয়। উল্লেখ্য যে, বিদায়ী ত্বাওয়াফের পর সফরের গোছগাছ ব্যতীত অন্য কারণে দেরী হ’লে তাকে পুনরায় বিদায়ী ত্বাওয়াফ করতে হবে। বিদায়ের সময় বায়তুল্লাহকে সম্মান দেখাবার জন্য পিছন দিকে হেঁটে বের হওয়া নিকৃষ্টতম বিদ‘আতী কাজ। বরং অন্যান্য মসজিদের ন্যায় স্বাভাবিকভাবে মুখ ফিরিয়ে দো‘আ পড়তে পড়তে বেরিয়ে আসতে হবে।

কিবরান ও ইফরাদ হাজীদের করণীয় :

(أعمال القارن والمفرد)

‘ক্বিরান’ অর্থাৎ যারা ওমরাহ ও হজ্জ একই নিয়তে ও একই ইহরামে আদায় করেন এবং ‘ইফরাদ’ অর্থাৎ যারা স্রেফ হজ্জ-এর নিয়তে ইহরাম বাঁধেন, তাঁরা তামাত্তু হাজীদের ন্যায় মক্কায় গিয়ে প্রথমে বায়তুল্লাহতে ‘ত্বাওয়াফে কুদূম’ বা আগমনী ত্বাওয়াফ সম্পাদন করবেন ও ত্বাওয়াফ শেষে দু’রাক‘আত নফল ছালাত আদায় করবেন। অতঃপর ইচ্ছা করলে সাঈ করবেন অথবা রেখে দিবেন। যা তিনি হজ্জ শেষে ‘ত্বাওয়াফে ইফাযাহ’ করার পর সম্পাদন করবেন। আর যদি ত্বাওয়াফে কুদূমের পরেই সাঈ করেন, তাহ’লে তাকে ‘ত্বাওয়াফে ইফাযাহ’ শেষে পুনরায় সাঈ করতে হবে না। অর্থাৎ শুরুতে একবার সাঈ করলে শেষে আর সাঈ প্রয়োজন হবে না। তবে তাকে ত্বাওয়াফে কুদূমের পর থেকে ১০ই যিলহাজ্জ কুরবানীর দিন হালাল হওয়া পর্যন্ত ইহরামের পোষাকে থাকতে হবে। ‘ক্বিরান’ হজ্জের জন্য কুরবানী ওয়াজিব হবে। কিন্তু ‘ইফরাদ’ হজ্জের জন্য কুরবানী প্রয়োজন নেই।

হজ্জ শেষে মক্কায় ফিরে করণীয় :

(الأعمال في مكة بعد الفراغ من الحج)

হজ্জের সব কাজ সেরে মক্কায় ফিরে দেশে ফেরার জন্য বিদায়ী ত্বাওয়াফের আগ পর্যন্ত মাসজিদুল হারামে যত খুশি ছালাতে এবং দিনে-রাতে যত খুশি ত্বাওয়াফে সময় কাটাবেন। কেননা বায়তুল্লাহর ছালাতে অন্য স্থানের চাইতে এক লক্ষ গুণ বেশী নেকী রয়েছে[22] এবং বায়তুল্লাহর ত্বাওয়াফে প্রতি পদক্ষেপে একটি করে গুনাহ ঝরে পড়ে ও একটি করে নেকী লেখা হয়।[23] এই সময় সর্বদা তেলাওয়াত ও ইবাদতে রত থাকা এবং তাক্বওয়া বৃদ্ধি পায় এমন কিতাব সমূহ পাঠের মধ্যে মনোনিবেশ করা উত্তম। পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছ ভিত্তিক ইলমী মজলিসে যোগদান করা ও গভীর  মনোযোগের সাথে উক্ত আলোচনা শ্রবণ করা নিঃসন্দেহে নেকীর কাজ। 



[1]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/১৩৩৮।

[2]. ইবনুল ক্বাইয়িম, যা-দুল মা‘আদ ৩/৪৫৭ পৃঃ।

[3]. মুসলিম, মিশকাত হা/২৭১৪।

[4]. ওকূফে আরাফাহ : আরাফার ময়দানে অবস্থানের প্রধান কারণ হ’ল বান্দাকে একথা মনে করিয়ে দেওয়া যে, সৃষ্টির সূচনায় এই উপত্যকায় প্রথম ‘আহ্দে আলাস্ত্ত’-র শপথ অনুষ্ঠান হয়েছিল। সেদিন আল্লাহ আদমের পিঠ থেকে ক্বিয়ামত পর্যন্ত আগত সকল বনু আদমকে পিপীলিকার অবয়বে সৃষ্টি করে তাদের জিজ্ঞেস করেন, আমি কি তোমাদের প্রভু নই? জওয়াবে সেদিন আমরা সবাই বলেছিলাম, হ্যাঁ’ (আ‘রাফ ১৭২; আহমাদ, মিশকাত হা/১২১)। সেদিনের সেই তাওহীদের স্বীকৃতি ও বিশ্ব মানব সম্মেলনের কথা স্মরণ করিয়ে দেবার জন্য আরাফার ময়দানে অবস্থান করাকে হজ্জের প্রধান অনুষ্ঠান হিসাবে নির্ধারণ করা হয়েছে। যেখানে বিশ্বের সকল প্রান্তের মুমিন-মুসলমান একত্রিত হয় ও আল্লাহর ইবাদতে রত হয়।

[5]. রাযীন, বাযযার, ত্বাবারাণী, ছহীহ আত-তারগীব হা/১১৫৪-৫৫।

[6]. তিরমিযী, মিশকাত হা/২৫৯৮; ছহীহাহ হা/১৫০৩।

[7]. মুসলিম, মিশকাত হা/২০৪৪।

[8]. মুসলিম, মিশকাত হা/২৫৫৫।

[9]. ওয়াদিয়ে মুহাসসির : ‘মুহাস্সির’  (المحسِّر)  অর্থ ‘অক্ষমকারী’। এই উপত্যকায় আবরাহার হাতী ‘মাহমূদ’ অক্ষম হয়ে বসে পড়েছিল। মক্কার দিকে এগোতে পারেনি। অল্প দূরে আরাফাত সন্নিহিত মক্কার নিকটবর্তী ‘মুগাম্মাস’ নামক স্থানে এসে আবরাহার পথপ্রদর্শক ত্বায়েফের ছাক্বীফ গোত্রের আবু রেগাল মৃত্যুবরণ করেছিল। এভাবে আবরাহা বাহিনী এ এলাকাতেই আল্লাহর অদৃশ্য বাধার মাধ্যমে আটকে যায় এবং পরে আল্লাহ প্রেরিত পক্ষীবাহিনীর আক্রমণে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। তাই এটি একটি গযবের এলাকা হওয়ার কারণে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) এটি দ্রুত অতিক্রম করেন (ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/৪৬১)। উল্লেখ্য যে, আল্লাহ কা‘বা গৃহকে اَلْبَيْتُ الْعَتِيْقُ  বা ‘মুক্ত গৃহ’ বলেছেন (হজ্জ ২২/২৯)। কাফেরদের অধিকার থেকে যা সর্বদা মুক্ত থাকবে ইনশাআল্লাহ। দ্বিতীয় : ৫০০´৪৫=২২,৫০০ বর্গ হাতের এই স্থানটি একটি নিন্দিত এলাকা। আভিজাত্যগর্বী কুরায়েশ নেতারা নিজেদেরকে অতি ধার্মিক ‘আহলুল্লাহ’ তথা আল্লাহর ঘরের বাসিন্দা দাবী করে হজ্জের সময় আরাফার বদলে এখানে অবস্থান করত এবং নিজ নিজ বংশের ও বাপ-দাদাদের গৌরব বর্ণনা করত। কেননা মুযদালিফা হ’ল হারামের ভিতরে এবং আরাফাত হ’ল বাইরে। তারা সাধারণ লোকদের সাথে আরাফার ময়দানে অবস্থান করাকে হীনকর মনে করত। এর প্রতিবাদ স্বরূপ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) স্থানটি দ্রুত অতিক্রম করেন (শাওকানী, নায়লুল আওত্বার ৬/১৬৬)

[10]. জামরাতুল ‘আক্বাবাহ : হযরত ইবরাহীম (আঃ)-কে এখানেই শয়তান প্রথমে ধোঁকা দিয়েছিল। পুত্র ইসমাঈলকে কুরবানীর জন্য মক্কা থেকে প্রায় ৮ কিঃমিঃ দক্ষিণ-পূর্বে মিনা প্রান্তরে নিয়ে যাওয়ার পথে বর্তমানে যে তিন স্থানে কংকর মারতে হয়, ঐ তিন স্থানে ইবলীস তিনবার ইবরাহীম (আঃ)-কে পুত্র কুরবানী থেকে বিরত রাখার জন্য ধোঁকা দিয়েছিল। আর তিনবারই ইবরাহীম (আঃ) শয়তানের প্রতি ৭টি করে কংকর নিক্ষেপ করেছিলেন’ (আহমাদ হা/২৭০৭, ২৭৯৫; সনদ ছহীহ)। সেই স্মৃতিকে জাগরুক রাখার জন্য এবং শয়তানের প্রতারণার বিরুদ্ধে মুমিনকে বাস্তবে উদ্বুদ্ধ করার জন্য এ বিষয়টিকে হজ্জ অনুষ্ঠানের আবশ্যিক বিষয় সমূহের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে (নবীদের কাহিনী ১/১৩৮ পৃঃ)। মনে রাখতে হবে যে, পিলারটি শয়তান নয়। আর শয়তান মারা লক্ষ্য নয়। বরং লক্ষ্য হবে ইবরাহীমী সুন্নাত পালন করা এবং ইবরাহীমের ন্যায় দৃঢ় ঈমান লাভ করা ও শয়তানের বিরুদ্ধে সর্বদা সতর্ক থাকা।

দ্বিতীয় আরেকটি বিষয় স্মরণ রাখা আবশ্যক যে, ইবরাহীম (আঃ) যেমন এখানেই প্রথম ইবলীসকে পাথর মেরে তাড়িয়ে ছিলেন, তেমনি এখানেই ইবরাহীমের শ্রেষ্ঠ সন্তান মানবকুল শিরোমণি শেষনবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লা-হু আলাইহে ওয়া সাল্লাম ১৩ নববী বর্ষের হজ্জের মওসুমে আইয়ামে তাশরীক্বের মধ্যবর্তী গভীর রজনীতে মানবরূপী শয়তানদের বিরুদ্ধে আল্লাহর অবিমিশ্র তাওহীদ প্রতিষ্ঠায় ঐতিহাসিক বায়‘আত গ্রহণ করেন। ঐ রাতের ঐ বায়‘আত ও আক্বীদার বিপ্লব পরবর্তীতে আরব ভূখন্ডে যেমন সমাজ বিপ্লব সৃষ্টি করে, তেমনি তৎকালীন বিশ্ব রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজনীতি সবকিছুতে ব্যাপক পরিবর্তনের সূচনা করে। বর্তমানের বিশ্বব্যাপী মুসলিম উম্মাহ সে রাতে ইয়াছরিবের ৭৫ জন ঈমানদার নারী-পুরুষের গৃহীত ‘বায়‘আতে কুবরা’-র মাধ্যমে সূচিত সমাজ বিপ্লবের সোনালী ফসল মাত্র \

[11]. মাথা মুন্ডন ও ত্বাওয়াফে ইফাযাহ : মাথা মুন্ডনের তাৎপর্য হ’ল হারাম থেকে হালাল হওয়া এবং ইহরামের কারণে যা কিছু নিষিদ্ধ ছিল, তা সিদ্ধ হওয়া। অতঃপর ত্বাওয়াফে ইফাযাহর তাৎপর্য হ’ল, ৮ তারিখে মক্কা থেকে ইহরাম বেঁধে বিদায় নিয়ে এসে হজ্জ সমাধা করে পুনরায় আল্লাহর ঘরে ফিরে যাওয়া। অতঃপর পূর্ণ হালাল হওয়া।

[12]. ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/৫৩৭-৩৮।

[13]. ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/৫৩৬।

[14]. বায়হাক্বী ৯/২৮৬-৮৭।

[15]. মুসলিম ‘হজ্জ’ অধ্যায় হা/১৩১৮; মিশকাত হা/১৪৫৮; তিরমিযী, নাসাঈ, ইবনু মাজাহ, মিশকাত হা/১৪৬৯ ‘কুরবানী’ অনুচ্ছেদ।

[16]. বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/২০৪৮-৫০।

[17]. বুখারী হা/১৯৯৭-৯৮ আয়েশা ও ইবনু ওমর (রাঃ) হ’তে।

[18]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/১৩৪৭।

[19]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/১১৩৯।

[20]. তিরমিযী, আবুদাঊদ, মিশকাত হা/২৬৭৭; তুহফা হা/৯৬২।

[21]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/২৬৬৮।

[22]. আহমাদ, ইবনু মাজাহ হা/১৪০৬; সনদ ছহীহ।

[23]. তিরমিযী হা/৯৫৯, মিশকাত হা/২৫৮০।