ইক্বামতে দ্বীন পথ ও পদ্ধতি

জিহাদের প্রস্ত্ততি

প্রস্ত্ততির অর্থ নৈতিক ও বৈষয়িক উভয় প্রকার প্রস্ত্ততি। দেশের তরুণ সমাজকে সুন্দর পরিবেশে সুশিক্ষার মাধ্যমে নৈতিক চরিত্রে বলীয়ান করে গড়ে তুলতে হবে। সাথে সাথে আইনের সীমারেখার মধ্যে তাদেরকে দৈহিক সামর্থ্যে ও প্রয়োজনে প্রাথমিক সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়ে প্রস্ত্তত রাখতে হবে। অবশ্য রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নিরাপত্তার স্বার্থে সশস্ত্র প্রস্ত্ততি হিসাবে দেশে সুশিক্ষিত সশস্ত্র বাহিনী সার্বক্ষণিকভাবে প্রস্ত্তত রাখা হয়। এরপরেও কারো জন্য বেআইনীভাবে সশস্ত্র প্রস্ত্ততি গ্রহণের অনুমতি ইসলামে নেই। তবে দ্বীন ও রাষ্ট্রের হেফাযতের জন্য শহীদ বা গাযী হবার জিহাদী জাযবা সর্বদা হৃদয়ে লালন করা প্রত্যেক মুমিনের জন্য অপরিহার্য।

তাওহীদ বিরোধী আক্বীদা ও আমলের সংস্কার সাধনই হ’ল সবচেয়ে বড় ‘জিহাদ’। নবীগণ সেই লক্ষ্যেই তাঁদের সমস্ত জীবনের সার্বিক প্রচেষ্টা নিয়োজিত রেখেছিলেন। আর সেটা করতে গিয়েই তাঁদের উপর নেমে এসেছিল বাধা ও বিপদের হিমালয় সদৃশ মুছীবত সমূহ। জ্বলন্ত হুতাশনে জীবন্ত ইবরাহীমকে নিক্ষেপ করা হয়েছে। তরতাজা নবী যাকারিয়াকে সর্বসমক্ষে জীবন্ত করাতে চিরে দ্বিখন্ডিত করা হয়েছে। মূসাকে নিজ দেশ থেকে বিতাড়িত হতে হয়েছে। ঈসাকে পৃথিবী ছেড়ে আসমানে আশ্রয় নিতে হয়েছে। আমাদের নবীকে জন্মভূমি মক্কা ছেড়ে মদীনায় অবস্থান নিতে হয়েছে। কারণ তাঁরা স্ব স্ব যুগের লোকদের প্রতিষ্ঠিত শিরকী আক্বীদার সংস্কার ও সার্বিক জীবনে এক আল্লাহর দাসত্বের আহবান জানিয়েছিলেন। তাঁরা কেউই অস্ত্র হাতে নিয়ে জনগণের সামনে উপস্থিত হননি। বরং যখনই শিরকের শিখন্ডীরা অস্ত্র হাতে তাদেরকে উৎখাতের জন্য উদ্যত হয়েছে, তখনই তাওহীদের অনুসারীগণ তাদের মুকাবিলায় হয় তাদের জীবন দিয়েছেন, নয় আত্মরক্ষা করেছেন, শহীদ অথবা গাযী হয়েছেন। বদর, ওহোদ, খন্দক সকল যুদ্ধই হয়েছে মদীনায় আত্মরক্ষামূলক। যদি আক্রমণমূলক হ’ত, তাহ’লে এসব যুদ্ধ মক্কায় সংঘটিত হতো এবং তখন রাসূল (ছাঃ) স্বয়ং আক্রমণকারী হিসাবে চিহ্নিত হতেন। কিন্তু ইতিহাস সেকথা বলেনি।

বাস্তব কথা এই যে, যবরদস্তির মাধ্যমে একজনকে সাময়িকভাবে পদানত করা যায়। কিন্তু স্থায়ীভাবে অনুগত করা যায় না। ইসলাম আল্লাহর সর্বশেষ নাযিলকৃত ও পূর্ণাঙ্গ দ্বীন। এ দ্বীন মানবজীবনকে তার মৃত্যু পর্যন্ত আল্লাহর অনুগত বান্দায় পরিণত করতে চায়। অতএব দ্বীন কায়েমের নামে কিংবা জিহাদের নামে আমরা যেন অতি উৎসাহে এমন কিছু না করি, যা ইসলামের মূল রূহকে ধ্বংস করে দেয়। এর বিপরীতে জিহাদী জাযবাকে ধ্বংসকারী অদৃষ্টবাদী আক্বীদা নিঃসন্দেহে আরেকটি ভ্রান্ত আক্বীদা। এটি পানির নীচে ডুবন্ত মাইনের মত। যা মুসলমানের জিহাদী রূহকে সংগোপনে ধ্বংস করে দেয়।

বিশ্বে সর্বদা আদর্শের সংগ্রাম চলছে। উক্ত সংগ্রামে ইসলামকে বিজয়ী করা এবং দ্বীনকে শিরক ও বিদ‘আত মুক্ত করে তাকে তার নির্ভেজাল ও আদি রূপে প্রতিষ্ঠা করাই হ’ল দ্বীনদার মুমিনের সবচেয়ে বড় কর্তব্য। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, جَاهِدُوا الْمُشْرِكِينَ بِأَمْوَالِكُمْ وَأَنْفُسِكُمْ وَأَلْسِنَتِكُمْ ‘তোমরা জিহাদ কর মুশরিকদের বিরুদ্ধে তোমাদের মাল দ্বারা, জান দ্বারা ও যবান দ্বারা’।[1]

অতএব আসুন! আল্লাহর দেওয়া মাল, আল্লাহর দেওয়া জান ও আল্লাহর দেওয়া যবান ও কলম আল্লাহর পথে ব্যয় করি এবং আল্লাহ বিরোধী মুশরিক শক্তির বিরুদ্ধে তথা আধুনিক জাহেলিয়াতের বিভিন্নমুখী চক্রান্তের বিরুদ্ধে আমরা সর্বমুখী প্রস্ত্ততি গ্রহণ করি। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন,

مَا مِنْ نَبِىٍّ بَعَثَهُ اللهُ فِى أُمَّةٍ قَبْلِىْ إِلاَّ كَانَ لَهُ مِنْ أُمَّتِهِ حَوَارِيُّونَ وَأَصْحَابٌ يَأْخُذُونَ بِسُنَّتِهِ وَيَقْتَدُونَ بِأَمْرِهِ ثُمَّ إِنَّهَا تَخْلُفُ مِنْ بَعْدِهِمْ خُلُوفٌ يَقُولُونَ مَا لاَ يَفْعَلُونَ وَيَفْعَلُونَ مَا لاَ يُؤْمَرُونَ فَمَنْ جَاهَدَهُمْ بِيَدِهِ فَهُوَ مُؤْمِنٌ وَمَنْ جَاهَدَهُمْ بِلِسَانِهِ فَهُوَ مُؤْمِنٌ وَمَنْ جَاهَدَهُمْ بِقَلْبِهِ فَهُوَ مُؤْمِنٌ وَلَيْسَ وَرَاءَ ذَلِكَ مِنَ الْإِيْمَانِ حَبَّةُ خَرْدَلٍ- (رواه مسلم عن ابن مسعود)

‘আমার পূর্বে এমন কোন নবী আল্লাহ প্রেরণ করেননি, যার উম্মতের মধ্যে কিছু লোক তাঁর সহযোগী ছিল না। কিছু লোক ছিল যারা তাঁর সুন্নাত সমূহের অনুসরণ করত ও নির্দেশ সমূহ মেনে চলত। অতঃপর তাদের পরবর্তী যুগে তাদের উত্তরসূরিগণ এমন সব কথা বলত, যা তারা করত না। আবার এমন সব কাজ করত, যা করতে তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়নি। এইসব লোকদের বিরুদ্ধে যারা হাত দ্বারা জিহাদ করবে, তারা মুমিন। যারা তাদের বিরুদ্ধে যবান দ্বারা জিহাদ করবে, তারা মুমিন। যারা হৃদয় দিয়ে জিহাদ করবে, তারাও মুমিন। এর বাইরে তার মধ্যে সরিষা দানা পরিমাণ ঈমান নেই’।[2]

অতএব শিরক ও বিদ‘আতের বিরুদ্ধে আপোষহীনভাবে রুখে দাঁড়ানোই হ’ল প্রকৃত জিহাদ। আর তাওহীদের মর্মবাণীকে জনগণের নিকটে পৌঁছে দেওয়া ও তাদের মর্মমূলে প্রোথিত করাই হ’ল প্রকৃত দাওয়াত। তাই একই সাথে তাওহীদের ‘দাওয়াত’ ও তাওহীদ বিরোধী জাহেলিয়াতের বিরুদ্ধে সর্বমুখী ‘জিহাদ’-ই হ’ল দ্বীন কায়েমের সঠিক পদ্ধতি।


[1]. আবুদাঊদ, নাসাঈ, দারেমী, মিশকাত হা/৩৮২১ ‘জিহাদ’ অধ্যায়।

[2]. মুসলিম, মিশকাত হা/১৫৭ ‘ঈমান’ অধ্যায়, ‘কিতাব ও সুন্নাহকে অাঁকড়ে ধরা’ অনুচ্ছেদ।