দ্বীন বনাম হুকুমত
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর উপরে বর্ণিত যিন্দেগীতেই দ্বীন কায়েমের সঠিক পদ্ধতি বিধৃত হয়েছে। এর বাইরে দ্বীন কায়েমের কোন শর্ট-কাট রাস্তা নেই। বুলেট ও ব্যালটের মাধ্যমে হয়তবা সহজে রাজনৈতিক ক্ষমতা হাছিল করা যায়। কিন্তু দ্বীন কায়েম করা যায় না। ‘দ্বীন’ অর্থ ‘তাওহীদ’ যার দিকে নূহ (আঃ) থেকে মুহাম্মাদ (ছাঃ) পর্যন্ত সকল নবী মানব জাতিকে আহবান জানিয়েছেন’ (শূরা ১৩)। যা প্রথমে স্ব স্ব আক্বীদা ও বিশ্বাসের জগতে প্রতিষ্ঠা করতে হয়। অতঃপর কর্মজগতে তার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, সাইয়িদ আবুল আ‘লা মওদূদী (১৯০৩-১৯৭৯ খৃঃ) ও তাঁর অনুসারী রাজনৈতিক দলটি উক্ত আয়াতের ভুল ব্যাখ্যা করে ‘দ্বীন’ অর্থ ‘হুকুমত’ বলেন। যেমন মাওলানা বলেন,
دين در اصل حكومت كا نام هے- شريعت اس حكومت كا قانون هے اور عبادت اس قانون و ضابطه كى پابندى هے-
‘দ্বীন আসলে হুকুমতের নাম। শরী‘আত হ’ল ঐ হুকুমতের কানূন। আর ইবাদত হ’ল ঐ আইন ও বিধানের আনুগত্য করার নাম’।[1]
অর্থাৎ নূহ (আঃ) থেকে মুহাম্মাদ (ছাঃ) পর্যন্ত সকল নবী প্রেরিত হয়েছিলেন ‘ইসলামী রাষ্ট্র’ প্রতিষ্ঠা করার জন্য। আর তাঁদের দৃষ্টিতে হুকুমত প্রতিষ্ঠাই হ’ল সবচেয়ে ‘বড় ইবাদত’। যেমন তাঁরা বলেন,
اس عبادت كى حقيقت جس كے متعلق لوگوں نے سمجه ركها هے كه وه محض نماز روزه اور تسبيح تهليل كا نام هے اور دنيا كے معاملات سے اس كو كچه سروكار نهيں، حالانكه در اصل صوم و صلاة اور حج و زكاة اور ذكر وتسبيح انسان كو اس بڑى عبادت كے لئے مستعد كرنيوالى تمرينات (Training courses) هيں -
‘উক্ত ইবাদতের তাৎপর্য যার সম্বন্ধে লোকেরা বুঝে রেখেছে যে, ওটা স্রেফ নামায-রোযা ও তাসবীহ-তাহলীলের নাম, দুনিয়াবী বিষয়ে এর কোন সম্পর্ক নেই। অথচ প্রকৃত কথা এই যে, ছওম ও ছালাত, হজ্জ ও যাকাত এবং যিকর ও তাসবীহ মানুষকে উক্ত ‘বড় ইবাদত’ অর্থাৎ ‘ইসলামী হুকুমত’ প্রতিষ্ঠার জন্য প্রস্ত্ততকারী ‘ট্রেনিং কোর্স’ মাত্র।[2] সেকারণ তারা প্রায়ই বলেন, দ্বীনের খেদমত তো অনেক করলেন, এবার ইক্বামতে দ্বীন-এর জন্য কিছু করুন। অর্থাৎ তার দলের রাজনীতিতে যোগ দিন। পবিত্র কুরআনের এই ধরনের ব্যাখ্যা একটি মারাত্মক ভ্রান্তি এবং সালাফে ছালেহীনের পথ হ’তে স্পষ্ট বিচ্যুতি।[3]
মক্কার মুশরিকগণ আল্লাহ ও আখেরাতে বিশ্বাসী ছিল। সেকারণ এক হিসাবে তারাও তাওহীদবাদী ছিল। কিন্তু ঐ তাওহীদ ছিল তাওহীদে রবূবিয়াত অর্থাৎ ‘রব’ বা প্রভু হিসাবে আল্লাহকে স্বীকার করার মধ্যে সীমাবদ্ধ। এই তাওহীদের স্বীকৃতির মাধ্যমে একজন মানুষ ইসলামের গন্ডীর মধ্যে প্রবেশ করতে পারে না। আর সেকারণেই মক্কার লোকদের কাছে শেষনবীর আগমন ঘটলো। বস্ত্ততঃ তাওহীদের মূল দাবীই হ’ল ‘তাওহীদে ইবাদত’ অর্থাৎ সার্বিক জীবনে আল্লাহর একক দাসত্ব কবুল করা। মক্কার মুশরিকরা জীবনের সর্বক্ষেত্রে প্রবৃত্তির দাসত্ব করে আখেরাতে মুক্তির জন্য সহজ রাস্তা মনে করে তাদের দৃষ্টিতে বিভিন্ন নেককার মৃত ব্যক্তির ‘অসীলা’ কামনা করত। তাদের ধর্মনেতা ও সমাজনেতাদের মনগড়া বিধানের অন্ধ অনুসরণ করত। একেই বলে ‘শিরক’ যা ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ। নবীগণ যুগে যুগে প্রেরিত হয়েছেন আত্মভোলা মানুষকে এইসব শিরকী চিন্তাধারা থেকে মুক্ত করে সার্বিক জীবনে আল্লাহর একক দাসত্বের প্রতি আহবান জানাতে। কিতাব ও সুন্নাতের মাধ্যমে শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) আমাদেরকে তাওহীদের বিশ্বাসগত দিক-নির্দেশনা ও কর্মগত বাস্তবতার সর্বোত্তম নমুনা দেখিয়ে গেছেন। মানুষের আক্বীদা ও আমলের সংশোধনের মাধ্যমে তিনি প্রকৃত অর্থে ইসলামী সমাজ বিপ্লবের পথ প্রদর্শন করে গেছেন।
মক্কার নেতারা যখন আবু ত্বালিবের নিকটে ‘তাওহীদ’-এর প্রচার বন্ধের শর্তে রাসূলকে নেতৃত্ব সমর্পণ সহ কতগুলি লোভনীয় সন্ধিপ্রস্তাব নিয়ে এসেছিল, তখন রাসূল (ছাঃ) তাদের বলেছিলেন, আপনারা কেবল একটি কালেমার স্বীকৃতি দিন, তাহ’লেই আপনারা আরব ও আজমের নেতৃত্ব লাভ করবেন। এতে বিস্মিত হয়ে আবু জাহল বলল, তোমার পিতার কসম! যদি কথা সঠিক হয়, তবে একটি কেন দশটি কালেমা বলতেও আমরা প্রস্ত্তত আছি’। রাসূল (ছাঃ) তখন বললেন, আপনারা বলুন : ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু’ আল্লাহ ছাড়া কোন উপাস্য নেই এবং বাকী সমস্ত উপাস্য পরিত্যাগ করুন’। এতে তারা হাততালি দিয়ে বলে উঠলো, ‘সব ইলাহ বাদ দিয়ে কেবল এক আল্লাহর দাসত্ব করব, এটা বড় আশ্চর্য ব্যাপার’ (ছেয়াদ ৬)।[4] এখানে রাসূল (ছাঃ) নিজে ক্ষমতা অর্জনের চাইতে প্রকৃত তাওহীদ কবুলের বিনিময়ে তাদেরকে আরব-আজমের নেতৃত্ব লাভের ওয়াদা করেছিলেন। পক্ষান্তরে আরব নেতারা তাদের শিরকী আক্বীদার সাথে আপোষ করার বিনিময়ে রাসূলকে নেতৃত্ব সমর্পণ করার প্রস্তাব দিয়েছিল। আবু জাহ্ল ক্ষণস্থায়ী দুনিয়াবী স্বার্থ দেখেছিল। রাসূল (ছাঃ) চিরস্থায়ী আখেরাতের স্বার্থ দেখেছিলেন। সমাজের স্থায়ী শান্তি ও অগ্রগতির জন্য যেটা একমাত্র রাস্তা বা ছিরাতে মুস্তাক্বীম। বস্ত্ততঃ ক্ষমতার হাত বদল সমাজ বদলে অতি সামান্যই প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়। তারপরেও তা যদি সংক্ষিপ্ত ও নির্দিষ্ট মেয়াদভিত্তিক হয়। যেমন বর্তমান যুগে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় হয়ে থাকে।
ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য অবশ্যই রাসূলের তরীকার অনুসারী হ’তে হবে। নিরন্তর দাওয়াতের মাধ্যমে আগে জনগণের আক্বীদা ও আমলের সংস্কার সাধন করতে হবে। অতঃপর তাদের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত সরকার ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রকৃত অর্থে দ্বীন ও জনগণের কল্যাণে আসবে। নইলে শিরকী আক্বীদা ও বিদ‘আতী আমলের অধিকারী নামধারী ইসলামপন্থী একদল লোককে রাষ্ট্র ক্ষমতায় বসালে ইসলামের কল্যাণের চাইতে বরং ক্ষতিই হবে বেশী। তখন জনগণ ইসলাম থেকে হয়তবা চিরতরে মুখ ফিরিয়ে নেবে।
জানা আবশ্যক যে, আমাদের নবীকে আল্লাহ পাক সশস্ত্র ‘দারোগা’ রূপে প্রেরণ করেননি (গাশিয়াহ ২২)। বরং তিনি এসেছিলেন জগদ্বাসীর জন্য ‘রহমত’ হিসাবে (আম্বিয়া ১০৭)। তাই ‘জিহাদ’-এর অপব্যাখ্যা করে শান্ত একটি দেশে বুলেটের মাধ্যমে রক্তগঙ্গা বইয়ে রাতারাতি ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার রঙিন স্বপ্ন দেখানো জিহাদের নামে স্রেফ প্রতারণা বৈ কিছুই নয়। অনুরূপভাবে দ্বীন কায়েমের জন্য জিহাদের প্রস্ত্ততির ধোঁকা দিয়ে রাতের অন্ধকারে কোন নিরাপদ পরিবেশে অস্ত্র চালনা ও বোমা তৈরীর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করা জিহাদী জোশে উদ্বুদ্ধ সরলমনা তরুণদেরকে ইসলামের শত্রুদের পাতানো ফাঁদে আটকিয়ে ধ্বংস করার চক্রান্ত মাত্র।[1]. আবুল আ‘লা মওদূদী, খুত্ববাত (দিল্লী : মারকাযী মাকতাবা ইসলামী ১৯৮৭), পৃঃ ৩২০।
[2]. আবুল আ‘লা মওদূদী, তাফহীমাত (উর্দূ) ১ম খন্ড, পৃঃ ৬৯ প্রকাশক : মারকাযী মাকতাবা ইসলামী, দিল্লী, জানুয়ারী ১৯৭৯।
[3]. বিস্তারিত জানার জন্য লেখকের ‘তিনটি মতবাদ’ বইটি পাঠ করুন।
[4]. আর-রাহীক্ব পৃঃ ১১৪।