তাফসীরুল কুরআন - (৩০তম পারা)

সূরা ফীল

(হাতি)

সূরা কাফেরূন-এর পরে মক্কায় অবতীর্ণ।

সূরা ১০৫, আয়াত ৫, শব্দ ২৩, বর্ণ ৯৬।

بِسْمِ اللہِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِیْمِ

পরম করুণাময় অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে (শুরু করছি)

(১) তুমি কি শোনো নি, তোমার প্রভু হস্তীওয়ালাদের সাথে কিরূপ আচরণ করেছিলেন?
أَلَمْ تَرَ كَيْفَ فَعَلَ رَبُّكَ بِأَصْحَابِ الْفِيلِ
(২) তিনি কি তাদের চক্রান্ত নস্যাৎ করে দেননি?
أَلَمْ يَجْعَلْ كَيْدَهُمْ فِي تَضْلِيلٍ
(৩) তিনি তাদের উপরে প্রেরণ করেছিলেন ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি
وَأَرْسَلَ عَلَيْهِمْ طَيْرًا أَبَابِيلَ
(৪) যারা তাদের উপরে নিক্ষেপ করেছিল মেটেল পাথরের কংকর  
تَرْمِيهِمْ بِحِجَارَةٍ مِنْ سِجِّيلٍ
(৫) অতঃপর তিনি তাদের করে দেন ভক্ষিত তৃণসদৃশ।
فَجَعَلَهُمْ كَعَصْفٍ مَأْكُولٍ

বিষয়বস্ত্ত :

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর জন্মের ৫০ বা ৫৫ দিন পূর্বে[1] ইয়ামনের খ্রিষ্টান গভর্ণর আবরাহা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হস্তীবাহিনীসহ বিশাল সৈন্যদল নিয়ে কা‘বাগৃহ ধ্বংস করার জন্য এসেছিলেন। আল্লাহ পাক পক্ষীকুল পাঠিয়ে তাদের মাধ্যমে কংকর নিক্ষেপ করে ঐ বাহিনীকে নাস্তানাবুদ করে দেন। অত্র সূরায় অতীব সংক্ষেপে সেই ঘটনা বিবৃত করা হয়েছে। যাতে মানুষ নিজেদের শক্তির বড়াই না করে এবং আল্লাহর উপরে ঈমান আনে।

ঘটনা :

ইবনু কাছীর (রহঃ) বলেন, কা‘বাগৃহকে নিশ্চিহ্ন করার উদ্দেশ্যে আগমনকারী          হস্তীওয়ালাদেরকে পর্যুদস্ত করে আল্লাহ পাক কুরায়েশদের উপরে একটি বড় অনুগ্রহ করেছিলেন। অথচ ঐ সময় কুরায়েশরা (হযরত ইবরাহীম (আঃ)-এর দ্বীনে হানীফের অনুসারী হবার দাবীদার হলেও) তারা ছিল মূর্তিপূজারী। পক্ষান্তরে হস্তীওয়ালারা (ঈসা (আঃ)-এর অনুসারী হওয়ার দাবীদার হ’লেও) তারা ছিল ত্রিত্ববাদী নাছারা। একই বছরে প্রসিদ্ধ বর্ণনা অনুযায়ী রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) জন্মগ্রহণ করেন। ফলে এটি ছিল অদূর ভবিষ্যতে নবী আগমনের পূর্ব সংকেত (من باب الإرهاص)। অবস্থা যেন এটা বলে দিচ্ছিল যে, হে কুরায়েশগণ! হাবশীদের উপরে তোমাদের শ্রেষ্ঠত্বের কারণে আমরা তোমাদের সাহায্য করিনি। বরং বায়তুল্লাহ হেফাযতের জন্য আমরা সেদিন তোমাদের সাহায্য করেছিলাম। যার সম্মান ও মর্যাদা আমরা আরও উন্নীত করব সত্বর তোমাদের মাঝে নিরক্ষর নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে প্রেরণের মাধ্যমে। যিনি হবেন সর্বশেষ নবী। তাঁর উপরে আল্লাহর অসংখ্য অনুগ্রহ ও শান্তি বর্ষিত হৌক!’

ঘটনা এই যে, ইতিপূর্বে আমরা সূরা বুরূজের তাফসীরে গর্তওয়ালাদের কাহিনীতে বলে এসেছি যে, ইয়ামনের হিমইয়ারী গোত্রের সর্বশেষ শাসক ইউসুফ যূ-নওয়াস (يوسف ذو نواس) স্রেফ তাওহীদবাদী নাছারা হওয়ার কারণে একই দিনে বিশ হাযার (মতান্তরে সত্তুর হাযার) ঈমানদার নর-নারী ও শিশুকে আগুনের দীর্ঘ গর্তে জীবন্ত নিক্ষেপ করে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে। যাহহাকের বর্ণনা অনুযায়ী এ ঘটনাটিও ঘটে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর আবির্ভাবের চল্লিশ বছর পূর্বে (কুরতুবী)। অর্থাৎ তাঁর জন্মবর্ষে। গর্তওয়ালাদের সেই মর্মান্তিক হত্যাকান্ড থেকে দাঊদ যূ-ছা‘লাবান (داؤد ذو ثعلبان)  নামক একজন মাত্র ব্যক্তি কোনভাবে পালিয়ে বাঁচে এবং পার্শ্ববর্তী শাম (সিরিয়া)-এর খ্রিষ্টান বাদশাহ ক্বায়ছারের কাছে গিয়ে সাহায্য প্রার্থনা করে। তখন তাকে সাহায্য করার জন্য ক্বায়ছার ইয়ামনের নিকটবর্তী হাবশার শাসক নাজাশীর কাছে লিখিত নির্দেশ পাঠান। নাজাশী তখন আরিয়াত্ব ও আবরাহার (أرياط وأبرهة) নেতৃত্বে ইয়ামনে দু’দল সৈন্য পাঠান। তারা গিয়ে ইয়ামন দখল করেন এবং সেখানকার যালেম শাসক ইউসুফ যূ-নওয়াস সাগরে ডুবে আত্মাহুতি দেয়। তখন থেকে ইয়ামন হাবশার অধিকারভুক্ত হয়। কিন্তু অচিরেই দুই সেনাপতির মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়ে যায়। তখন অধিক রক্তক্ষয় এড়ানোর জন্য উভয়ে উভয়কে দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহবান করেন। যিনি জিতবেন তিনি শাসক হবেন। আরিয়াত্ব ছিলেন অধিক শক্তিশালী ও বিশালবপু। কিন্তু আবরাহা ছিল বেঁটে ও দুর্বল। ফলে আরিয়াত্বের তরবারির আঘাতে তার নাক-মুখ কেটে রক্তাক্ত হয়ে যায়। এ অবস্থায় আবরাহার গোলাম আতাওদাহ (عَةَودَة) হামলা চালিয়ে আরিয়াত্বকে হত্যা করে। আবরাহা আহত অবস্থায় ফিরে আসেন ও পরে সুস্থ হয়ে ইয়ামনের একচ্ছত্র শাসক হন’। যুদ্ধে নাক-মুখ কাটা হওয়ার কারণেই তাকে ‘আশরাম’ (الأشرم) বলা হ’তে থাকে। তখন থেকে أبرهة الأشرم ‘নাককাটা আবরাহা’ নামে তিনি পরিচিত হন। তার পুরা নাম ছিল আবরাহা ইবনুছ ছাববাহ (أبرهة بن الصبَّاح) (কুরতুবী)।

আরিয়াত্বকে হত্যা করায় বাদশাহ নাজাশী আবরাহার উপরে ভীষণ ক্রুদ্ধ হন এবং তাকে পত্র পাঠান। যাতে এই মর্মে শপথ করেন যে, ‘সত্বর আমি তার এলাকা পর্যুদস্ত করব এবং তার কপাল ধূলি-ধূসরিত করব।’ এই পত্র পেয়ে আবরাহা ভীত হয়ে কূটনীতির আশ্রয় নেন। তিনি বহু মূল্যবান উপঢৌকনাদিসহ এক থলে ইয়ামনের মাটি পাঠান এবং সেই সাথে নিজের নাক কেটে পাঠান (وجَزَّ ناصيته فأرسلها معه)। নাজাশী এটা পেয়ে বিস্মিত হন এবং খুশী হয়ে তাকে ক্ষমতায় বহাল রাখেন। বাদশাহকে লেখা চিঠিতে আবরাহা বলেন, ইয়ামনের মাটির থলি মাড়িয়ে আপনি আপনার শপথ ভঙ্গ করুন এবং সেই সাথে আমি আমার নাক কেটে পাঠালাম। আমি আপনার গোলাম ছিলাম এবং সর্বদা গোলাম থাকব (ইবনু কাছীর, কুরতুবী)। বাদশাহ তাকে ক্ষমতায় বহাল রাখার পর আবরাহা পুনরায় লিখেন যে, আমি আপনার জন্য ইয়ামনের মাটিতে এমন একটি গীর্জা বানাব, যার কোন তুলনা নেই। অতঃপর তিনি রাজধানী ছান‘আ নগরীতে উক্ত গীর্জা নির্মাণ করেন। যা ছিল সে যুগের বিস্ময়। গীর্জাটি এত উঁচু ছিল যে, তাকালে মাথার টুপী পড়ে যাওয়ার উপক্রম হ’ত। সেজন্য আরবরা তার নাম দেয় ‘কুল্লাইস’ (القُلَّيس)

অতঃপর আবরাহা চিন্তা করলেন যে, আরবদেরকে মক্কায় হজ্জ বাদ দিয়ে এখানে হজ্জ করাতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে সর্বত্র ঘোষণা জারি করলেন যে, এবছর থেকে হজ্জ কা‘বাগৃহের বদলে এই গীর্জায় হবে। তার এই ঘোষণা সর্বত্র দারুণ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করল। কুরায়েশরা রাগে ফেটে পড়ল। কথিত আছে যে, তাঁদের কেউ একজন এসে ঐ জাঁকজমকপূর্ণ ‘কুল্লাইস’ গীর্জায় গোপনে ঢুকে পায়খানা করে যায়। অন্য বর্ণনায় এসেছে যে, কুরায়েশদের একদল যুবক ঐ গীর্জায় ঢুকে আগুন ধরিয়ে দেয়। যাতে গীর্জা পুড়ে ধূলিসাৎ হয়ে যায় (ইবনু কাছীর)।

এর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য আবরাহা বিশাল বাহিনী প্রস্ত্তত করেন। কোন বর্ণনায় ২০ হাযার ও কোন বর্ণনায় ৬০ হাযার সৈন্যের কথা এসেছে। তবে শেষোক্ত বর্ণনাটি আরবী কবিতা থেকে নেওয়া (কুরতুবী)। আর সে যুগে কবিতাই ছিল ইতিহাসের বাহন। অতএব শেষোক্ত সংখ্যাটিই সঠিক বলে অনুমিত হয়। উক্ত বাহিনীর সাথে নাজাশীর পক্ষ হ’তে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বিশালবপু হস্তীবাহিনী পাঠানো হয়। যার নেতৃত্বে ছিল ‘মাহমূদ’ নামক হাতিটি। হস্তীবাহিনীর সংখ্যা কেউ বলেছেন ১টি, কেউ বলেছেন ২টি, ৮টি বা ১২ টি বা তার বেশী। তবে ‘মাহমূদ’ ছিল এদের নেতা। বাকীরা মাহমূদের অনুগামী। এদের নেওয়া হয়েছিল এজন্য যে, লোহার শিকলের এক প্রান্ত কা‘বার দেওয়ালে বেঁধে অন্য প্রান্ত হাতির ঘাড়ে বাঁধা হবে। অতঃপর হাতিকে হাঁকিয়ে দেয়া হবে, যাতে পুরা কা‘বাগৃহ এক সাথে উপড়ে ভেঙ্গে পড়ে (ইবনু কাছীর)

আবরাহার কা‘বা অভিযানের খবর শুনে সর্বত্র আতংক ছড়িয়ে পড়ল। কিছু সাহসী মানুষ তাকে প্রতিরোধের জন্য প্রস্ত্ততি নিল। এদের মধ্যে অন্যতম হ’লেন ইয়ামনের সাবেক শাসক বংশের সর্বজনশ্রদ্ধেয় নেতা যূ-নফর (ذو نفر)। তিনি তার নিজ সম্প্রদায় এবং সমস্ত আরব জনগণকে বায়তুল্লাহ রক্ষার পবিত্র জিহাদে তার সাথে শরীক হওয়ার আহবান জানান। ফলে বহু লোক তার পতাকাতলে সমবেত হয় এবং আবরাহার সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। কিন্তু অবশেষে তারা পরাজিত হয়। যূ-নফর বন্দী হ’লেন। কিন্তু আবরাহা তাকে হত্যা না করে সঙ্গে নিলেন। কিছু দূর যাওয়ার পর খাশ‘আম এলাকা অতিক্রমের সময় নুফায়েল বিন হাবীব আল-খাশ‘আমী (نفيل بن حبيب الخشعمى) তার সম্প্রদায়ের লোকদের নিয়ে বাধা দিলেন। কিন্তু তুমুল যুদ্ধের পর তারাও পরাজিত হ’ল। নুফায়েলকে হত্যা না করে আবরাহা তাকেও সাথে নিলেন পথপ্রদর্শক হিসাবে। অতঃপর ত্বায়েফ অতিক্রম করার সময় সেখানকার প্রসিদ্ধ ছাক্বীফ গোত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলল। কিন্তু সেটা বায়তুল্লাহর স্বার্থে ছিল না, বরং তাদের ‘লাত’ প্রতিমা রক্ষার স্বার্থে ছিল। কারণ তারা ভেবেছিল যে, আবরাহা তাদের মূর্তি ধ্বংস করার জন্য আসছেন। পরে তারা তাদের ভুল বুঝতে পারল এবং আবরাহার সম্মানার্থে একজন দক্ষ পথপ্রদর্শক হিসাবে ‘আবু রিগাল’ (أبو رغال) নামক জনৈক ব্যক্তিকে আবরাহার সাথে পাঠালো। তার নির্দেশনা অনুযায়ী আবরাহা মক্কার অদূরবর্তী ‘মুগাম্মিস’ (المغمِّس) নামক স্থানে অবতরণ করলেন। অতঃপর তার বাহিনী মক্কার উট-দুম্বা ইত্যাদি গবাদিপশু লুট করা শুরু করল। যার মধ্যে মক্কার নেতা আব্দুল মুত্ত্বালিবের দু’শো উট ছিল।

আল্লাহর ইচ্ছায় পথপ্রদর্শক আবু রিগাল মুগাম্মিসে অবতরণ করেই মৃত্যুবরণ করল। সেই থেকে আরবরা তার কবরে পাথর ছুঁড়ে মারে। যেমন জনৈক কবি বলেন,

وأرجُمُ قبره فى كل عام + كرجم الناس قبر أبي رغال

‘আমি তার কবরে প্রতি বছরে পাথর মেরে থাকি। যেমন লোকেরা আবু রিগালের কবরে পাথর ছুঁড়ে মারে’ (কুরতুবী)। এভাবে ‘আবু রিগাল’ কুখ্যাত হয়ে আছে।

অতঃপর আবরাহা হুনাত্বাহ আল-হিমইয়ারী (حُناطة الحِمْيرى) নামক এক ব্যক্তিকে তার প্রতিনিধি হিসাবে মক্কায় পাঠান এই কথা বলে যে, তিনি যেন মক্কার নেতাকে গিয়ে বলেন যে, আমরা তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে আসিনি। আমরা এসেছি কা‘বাগৃহ ধ্বংস করতে। যদি তারা বাধা না দেন, তাহ’লে তাদের নেতা যেন তার সাথে সাক্ষাৎ করেন। হুনাত্বাহ গিয়ে মক্কার নেতা আব্দুল মুত্ত্বালিব-কে সব কথা খুলে বললেন। জওয়াবে আব্দুল মুত্ত্বালিব বললেন, আবরাহার বিশাল বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করার ক্ষমতা আমাদের নেই। এটি আল্লাহর ঘর ও তার বন্ধু ইবরাহীমের ঘর। আল্লাহ তার গৃহের হেফাযত করবেন। অতঃপর তিনি তার কয়েকজন পুত্রসহ আবরাহার কাছে গেলেন। আব্দুল মুত্ত্বালিবের সুশ্রী, সুঠাম, সৌম্যকান্তি দেখে আবরাহা শ্রদ্ধায় বিগলিত হয়ে তার আসন থেকে নেমে এসে তার পাশে বিছানায় বসেন এবং পূর্ণ সম্মান ও মর্যাদা বজায় রেখে দোভাষীর মাধ্যমে কথা বলেন। আব্দুল মুত্ত্বালিব তাঁর লুট করা দু’শো উট ফেরত চাইলেন। কিন্তু কা‘বাগৃহ সম্পর্কে কিছু বললেন না। এতে বিস্মিত হয়ে আবরাহা বললেন, ‘আপনাকে দেখে আমি শ্রদ্ধায় অবনত হয়েছিলাম। কিন্তু এখন আমি বিস্মিত হচ্ছি এজন্য যে, আপনি কেবল আপনার স্বার্থের কথা বললেন। অথচ যে কা‘বাগৃহ আমরা ধ্বংস করতে এসেছি, যা আপনার ও আপনার পিতৃপুরুষের ইবাদতগৃহ, তার সম্পর্কে আপনি কিছুই বললেন না’। তখন জবাবে আব্দুল মুত্ত্বালিব বললেন, أَنَا رَبُّ الْإِبِلِ وَلِلْبَيْتِ رَبٌّ يَحْمِيْهِ ‘আমি মালিক উটের। আর ঐ গৃহের একজন মালিক আছেন, যিনি তাকে রক্ষা করবেন’ (তানতাভী)। আবরাহা বললেন, مَا كَانَ لِيَمْتَنِعَ مِنِّي ‘আজ আমার হাত থেকে ওকে রক্ষা করার কেউ নেই’। আবদুল মুত্ত্বালিব বললেন, أَنْتَ وَذَاكَ ‘এটা আপনার ও তাঁর (অর্থাৎ আল্লাহর) ব্যাপার’।

আবদুল মুত্ত্বালিব তাঁর দু’শো উট নিয়ে ফিরে এলেন। অতঃপর সবাইকে মক্কা থেকে বেরিয়ে বিভিন্ন পাহাড়ের চূড়ায় আশ্রয় নিতে বললেন। তারপর তিনি নিজে ও একদল সাথীসহ গিয়ে কা‘বাগৃহের দরজার চৌকাঠ ধরে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেন। সেই প্রার্থনায় তিনি বলেন,

يَا رَبِّ لا أرْجُوْ لَهُمْ سِوَاكَا + يَا ربِّ فَامْنَعْ مِنهُمْ حِمَاكَا

إنَّ عَدُوَّ البَيْتِ مَنْ عَادَاكَا + إِمْنَعْهُم أنْ يُّخَرَِّبُوْا قِرَاكَا

‘হে প্রভু! ওদের প্রতিরোধের জন্য তুমি ব্যতীত কারু কাছে আমি কিছুই আশা করি না। হে প্রভু! ওদের থেকে তুমি তোমার হারামকে রক্ষা কর’। ‘নিশ্চয়ই কা‘বাগৃহের শত্রু তারাই যারা তোমার শত্রু। তোমার এই জনপদকে ধ্বংস করা থেকে তুমি ওদের বাধা দাও।[2] এছাড়া আব্দুল মুত্ত্বালিবের আরও দো‘আ বর্ণিত হয়েছে।

অতঃপর আব্দুল মুত্ত্বালিব ও তাঁর সাথী নেতৃবর্গ এবং মুত্বইম বিন ‘আদী ও অন্যান্য নেতাগণ হেরা পাহাড়ের গুহাসমূহে গিয়ে আশ্রয় নেন এবং অশ্রুসজল নেত্রে তাকিয়ে থাকেন আবরাহা বাহিনীর অবস্থা দেখার জন্য (ইবনু কাছীর)

অতঃপর আবরাহা যখন মক্কা অভিমুখে রওয়ানা হওয়ার উদ্যোগ নেন এবং হাতিকে মক্কার দিকে হাঁকাতে চেষ্টা করেন, তখন হাতি বসে পড়ে। ইবনু ইসহাক বলেন, নুফায়েল বিন হাবীব আল-খাশ‘আমী, যাকে পথপ্রদর্শক হিসাবে আবরাহা সাথে এনেছিলেন, তিনি হাতিকে উদ্দেশ্য করে তার কান ধরে বলেন,

أُبْرُكْ مَحْمُوْدُ أَوِ ارْجِعْ رَاشِدًا مِنْ حَيْثُ جِئْتَ، فَإِنَّكَ فِيْ بَلَدِ اللهِ الْحَرَامِ- ‘বসে পড়ো মাহমূদ অথবা যেখান থেকে এসেছ, সোজা সেখানে ফিরে যাও। কেননা তুমি আল্লাহর পবিত্র শহরে এসেছ’। অতঃপর শত চেষ্টা করেও হাতিকে মক্কা মুখো করা যায়নি। অথচ ইয়ামন মুখো করা হলেই হাতি দৌড় দেয়। মক্কা মুখো করলেই সে বসে পড়ে।

ইতিমধ্যে সাগরের দিক থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে অচেনা পাখি আসতে শুরু করে। যাদের প্রত্যেকের মুখে একটি ও দু’পায়ে দু’টি কংকর ছিল, যা ডাল ও গমের মত সাইজের। এই কংকর যার মাথায় পড়েছে, সে ধ্বংস হয়েছে। সবাইকে লাগেনি। কিছু আঘাতপ্রাপ্তদের মরতে দেখে বাকী সবাই দিগ্বিদিক ছুটে পালাতে শুরু করে। এই দৃশ্য দেখে পাহাড়ে আশ্রয় নেওয়া নুফায়েল বিন হাবীব বলে ওঠেন,

أيْنَ الْمَفَرُّ والإلَهُ الطَّالِبُ + والْأَشْرَمُ الْمَغْلُوبُ لَيْسَ الْغَالِبُ

‘কোথায় পালাচ্ছ, খোদ আল্লাহ আজ তোমাদের ধরেছেন। নাককাটা (আবরাহা) পরাজিত। সে বিজয়ী নয়’। এছাড়াও নুফায়েল-এর আরও কবিতা বর্ণিত হয়েছে।

ইবনু ইসহাক বলেন, আবরাহা বাহিনী মক্কা থেকে পালিয়ে ইয়ামন পর্যন্ত পথে পথে মরতে মরতে যায় এবং আবরাহা তার প্রিয় রাজধানী ছান‘আ শহরে পৌঁছে লোকদের কাছে আল্লাহর গযবের ঘটনা বলার পর মৃত্যুবরণ করে। এ সময় তার বুক ফেটে কলিজা বেরিয়ে যায়’। মুক্বাতিল বিন সুলায়মান বলেন, কুরায়েশরা ঐদিন বহুমূল্য গণীমতের মাল হস্তগত করে। একা আবদুল মুত্ত্বালিব যা স্বর্ণ পান, তাতে তাঁর সমস্ত পাত্র পূর্ণ হয়ে যায়। ইবনু ইসহাক বলেন, এর পরপরই আল্লাহ তাঁর বিশেষ রহমত স্বরূপ কুরায়েশদের গৃহে তাঁর প্রিয়নবী মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামকে প্রেরণ করেন (ইবনু কাছীর)। তিনি বলেন, আবরাহা বাহিনীর এই মর্মান্তিক পরিণতির ফলে সমগ্র আরবে কুরায়েশদের সম্মান ও মর্যাদা অত্যন্ত বৃদ্ধি পায়। তারা তাদেরকে أَهْلُ اللهِ ‘আল্লাহওয়ালা’ বলতে থাকে। তারা বলতে থাকে যে, قَاتَلَ اللهُ عَنْهُمْ، وَكَفَاهُمْ مَئُونَةَ عَدُوِّهِمْ ‘আল্লাহ তাদের পক্ষে লড়াই করেছেন এবং তাদেরকে শত্রুর হাত থেকে রক্ষা করেছেন (কুরতুবী)। এই ঘটনার পর দশ বছর মক্কার লোকেরা মূর্তিপূজা থেকে বিরত থাকে।[3]

হস্তীওয়ালাদের এই ঘটনা আরবদের মধ্যে বহুল প্রচলিত ছিল। এমনকি রাসূল (ছাঃ)-এর সময়ে প্রত্যক্ষদর্শীদের মধ্যে অনেকে জীবিত ছিলেন। যেমন হাকীম বিন হেযাম, হাতেব বিন আব্দুল ওযযা, নওফেল বিন মু‘আবিয়া প্রমুখ। যারা প্রত্যেকে ১২০ বছর করে বয়স পেয়েছিলেন। ৬০ বছর জাহেলিয়াতে ও ৬০ বছর ইসলামে। এছাড়া উক্ত ঘটনার বিষয়ে রাসূল (ছাঃ) থেকে অনেকগুলি ছহীহ হাদীছ এসেছে। যেমন হোদায়বিয়ার দিন রাসূল (ছাঃ)-এর উষ্ট্রী ‘ক্বাছওয়া’ বসে পড়লে তিনি বলেন, حَبَسَهَا حَابِسُ الْفِيْلِ ‘হস্তীবাহিনীকে বাধা দানকারী (আল্লাহ) তাকে বাধা দিয়েছেন’।[4]

আলোচ্য সূরা ফীলে আল্লাহ পাক হারাম শরীফের অসীলায় কিভাবে কুরায়েশদের নিরাপত্তা দান করেন, সেকথা কুরায়েশদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন এবং স্বীয় নবীসহ বিশ্ববাসীকে তা জানিয়ে দিয়েছেন।

তাফসীর :

(১) أَلَمْ تَرَ كَيْفَ فَعَلَ رَبُّكَ بِأَصْحَابِ الْفِيْلِ ‘তুমি কি শোনো নি তোমার প্রভু          হস্তীওয়ালাদের সাথে কিরূপ আচরণ করেছিলেন’?

أَلَمْ تَرَ অর্থ ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, أَلَمْ تَسْمَعْ ‘তুমি কি শোননি?’ ফার্রা বলেছেন ألم تُخْبَر ‘তুমি কি খবর পাওনি?’ মুজাহিদ বলেছেন أَلَمْ تَعْلَمْ ‘তুমি কি জানো না?’ কোন নিশ্চিত বিষয় জানানোর জন্য এরূপ বাকরীতি প্রয়োগ করা হয়। শব্দটি প্রশ্নবোধক হ’লেও বক্তব্যটি নিশ্চয়তাবোধক। আবরাহার কা‘বা অভিযান ও আল্লাহর গযবে তার ধ্বংসের কাহিনীটি আরবদের মুখে মুখে প্রচারিত ছিল। যদিও রাসূল (ছাঃ) সে ঘটনা দেখেননি, তবুও তা ছিল প্রশ্নাতীত একটি নিশ্চিত ঘটনা। أَصْحَابُ الْفِيْلِ বলতে আবরাহা বাহিনীকে বুঝানো হয়েছে। অত্র আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহর অনুগ্রহ ও তাঁর শক্তি-মাহাত্ম্যের কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং বান্দাকে প্রশ্ন করা হয়েছে, এত বড় নিদর্শন দেখার পরেও فَمَا لَكُمْ لاَ تُؤْمِنُوْنَ؟ ‘তোমাদের কি হয়েছে যে তোমরা ঈমান আনো না?’ (কুরতুবী)।

(২) أَلَمْ يَجْعَلْ كَيْدَهُمْ فِيْ تَضْلِيْلٍ ‘তিনি কি তাদের চক্রান্ত নস্যাৎ করে দেননি?’

ইয়ামনী খ্রিষ্টান শাসকদের চক্রান্ত ছিল কা‘বাগৃহকে নিশ্চিহ্ন করা এবং কুরায়েশদের ধ্বংস করা। কিন্তু তারা কোনটাই করতে পারেনি। বরং তারাই ধ্বংস হয়েছে। কা‘বাগৃহ অক্ষত রয়ে গেছে এবং তাদের ফেলে যাওয়া বিপুল গণীমত পেয়ে কুরায়েশরা আরও সচ্ছল হয়েছে। কুরায়েশদের সম্মান সর্বত্র আরও দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

فِي تَضْلِيْلٍ অর্থ فى إبطال وتضييع ‘বাতিল ও ধ্বংস’ (কুরতুবী)।

(৩) وَأَرْسَلَ عَلَيْهِمْ طَيْراً أَبَابِيْلَ ‘তিনি তাদের উপরে প্রেরণ করেছিলেন ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি’।

এখানে طَيْرًا একবচন এলেও তার অর্থ বহুবচন এবং জাতিবোধক।

ইবনু হিশাম বলেন, أَباَبِيلَ অর্থ جَمَاعَاتٍ ‘দলে দলে’। আরবরা এটি একবচনে বলে না (ইবনু কাছীর)। ফার্রা ও আখফাশ বলেন, ‘আবাবীল’ আধিক্যবোধক শব্দ। এর কোন একবচন নেই। যেমন বলা হয় جَاءَتْ اِبْلُكَ أَبَابِيْلَ اَىْ فِرَقًا ‘তোমার উট এসেছে দলে দলে’। অনুরূপভাবে এখানে طَيْراً أَبَابِيْلَ অর্থ ‘পাখি এসেছে ঝাঁকে ঝাঁকে’। অর্থাৎ فى جماعات عظام ‘বিরাট বিরাট দলে’। অনেকে একবচন إبَّالة বা إِبَالَةٌ বা إِبِيْل বলেছেন। কিন্তু তা অপ্রচলিত (কুরতুবী, ইবনু কাছীর)।

ইবনু আববাস ও মুজাহিদ বলেন, مةةابعة مجةمعة ‘একের পিছে এক ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি’। ওবায়েদ বিন ওমায়ের বলেন, هى طير سود بحرية فى منقارها وأظافيرها الحجارة ‘সেগুলি ছিল সামুদ্রিক কালো পাখি, যার ঠোঁটে ও পায়ে কংকর ছিল’। ইবনু মাসঊদ, ইবনু যায়েদ ও আখফাশ বলেন, ‘চারিদিক থেকে তারা এসেছিল’ (কুরতুবী, ইবনু কাছীর)। ইকরিমা বলেন, ‘সবুজ পাখি যা সমুদ্রের দিক থেকে এসেছিল’। ওয়াক্বেদী তার সূত্রে উল্লেখ করেন যে, পাখিগুলি ছিল হলুদ যা কবুতরের চেয়ে ছোট এবং পাগুলি ছিল লাল রংয়ের। প্রত্যেকের সাথে ছিল তিনটি করে কংকর। সেগুলি তারা নিক্ষেপ করে। অতঃপর তারা সব ধ্বংস হয়ে যায়’ (ইবনু কাছীর)। সাঈদ বিন জুবায়ের বলেন, সবুজ পাখি। যার ঠোঁট ছিল হলুদ। তিনি বলেন, كانت طيرا من السماء لم يُرَ قبلها ولا بعدها ‘এগুলি ছিল আসমানী পাখি। যার ন্যায় পাখি তার পূর্বে বা পরে আর কখনো দেখা যায়নি’ (কুরতুবী)। এটাই হ’ল সঠিক কথা। কেননা গযবের উদ্দেশ্যে প্রেরিত কোন প্রাণী পৃথিবীতে বেঁচে থাকে না। যেমন ইতিপূর্বে দাঊদ (আঃ)-এর সময়ে কিছু লোককে শূকর ও বানরে পরিণত করা হয়েছিল (বাক্বারাহ ২/৬৫)। কিন্তু তাদের কোন বংশ পৃথিবীতে ছিল না।

অনেকে ‘আবাবীল’-কে এক প্রকার পাখি ধারণা করেন। এমনকি এ পাখির অদ্ভূত সব কাল্পনিক বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করেন। যেমন ‘এরা সারাদিন উড়ে বেড়ায়। কোথাও বসে না। এদের মারলে আল্লাহর গযবে মানুষ ধ্বংস হয়ে যাবে। সাতটা মানুষ খুন করতে রাযী, কিন্তু এদের বাসা ভাঙতে রাযী নই’ ইত্যাদি। বিশেষ করে কারাগারগুলিতে এক ধরনের কালো পাখি দেখা যায়। সেগুলিকে কারাগারের লোকেরা ‘আবাবীল’ পাখি বলে এবং ‘বরকতের পাখি’ মনে করে। অথচ এগুলি স্রেফ ধারণা মাত্র। বাংলা ভাষায় প্রকাশিত কোন কোন তাফসীরে طَيْرًا أَباَبِيْلَ অর্থ ‘আবাবীল পাখি’ করা হয়েছে, যা নিতান্তই ভুল।

(৪) تَرْمِيْهِم بِحِجَارَةٍ مِّنْ سِجِّيْلٍ ‘যারা তাদের উপরে নিক্ষেপ করেছিল মেটেল পাথরের কংকর’।

تَرْمِيْهِمْ স্ত্রীলিঙ্গ হয়েছে উহ্য কর্তা جماعات الطير হ’তে। অর্থাৎ পাখির দলসমূহ নিক্ষেপ করেছিল।

سِجِّيْل আরবদের নিকটে কঠিন ও শক্ত বস্ত্তকে বলা হয়। কোন কোন মুফাসসির উল্লেখ করেছেন যে, এটি ফারসী যৌগিক শব্দ, যা দু’টি শব্দের সমষ্টি। আসলে ছিল ‘সাঙ্গগিল’ (سَنْك وكِلْ)। সেখান থেকে আরবীতে ‘সিজ্জীল’ (سجيل)। ‘সাঙ্গ’ অর্থ পাথর এবং ‘গিল’ অর্থ মাটি। মাটি ও পাথরের মিলিত কংকর (ইবনু কাছীর) । এক কথায় ‘মেটেল পাথরের কংকর’। যেমন হযরত লূত (আঃ)-এর সমকামী কওমকে ধ্বংস করার জন্য তাদের উপরে গযবের যে প্রস্তর বর্ষিত হয়েছিল, সে সম্পর্কে আল্লাহ বলেছেন, حِجَارَةٍ مِّن طِيْنٍ ‘মাটির পাথর’ (যারিয়াত ৫১/৩৩)। সম্ভবতঃ উক্ত আয়াত দৃষ্টে ‘ছেহাহ’ (الصحاح) নামক বিখ্যাত অভিধান গ্রন্থে حِجَارَةٍ مِّنْ سِجِّيْلٍ -এর অর্থ حجارة من طين করা হয়েছে (কুরতুবী)[5] অর্থাৎ ‘মেটেল পাথর’।

ইবনু আববাস (রাঃ) ও ইকরিমা বলেন, ‘ঐ কংকর যার গায়ে লেগেছে, তার গায়ের চামড়া ফেটে বসন্তের গুটি বেরিয়েছে এবং সেবারই প্রথম বসন্ত রোগ দেখা দেয়’। ইবনু ইসহাক বলেন, সে বছরই প্রথম আরবদেশে হাম ও বসন্ত রোগের আবির্ভাব ঘটে (ইবনু কাছীর)।

(৫) فَجَعَلَهُمْ كَعَصْفٍ مَّأْكُوْلٍ ‘অতঃপর তিনি তাদের করে দেন ভক্ষিত তৃণদৃশ’।

الْعَصْفُ বহুবচন। একবচনে عَصيفة، عَصفة، عُصافة অর্থ ভক্ষিত তৃণ। ঘাস-বিচালি চিবিয়ে খেয়ে গবাদিপশু যা ফেলে দেয়। ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, كقشر البر ‘গমের ভূষির ন্যায়’। আবরাহা বাহিনীর উপরে নিক্ষিপ্ত গযবের কংকর যার দেহে আঘাত করেছে, তার দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে গেছে। একথাটিই বুঝানো হয়েছে চিবানো ঘাস-বিচালির উচ্ছিষ্টের সাথে তুলনা করার মাধ্যমে, যা গবাদিপশু গোবর আকারে বা অন্যভাবে ফেলে দেয় (কুরতুবী)।

ইবনু কাছীর বলেন, এর অর্থ হ’ল এই যে, আল্লাহ তাদের ধ্বংস ও নির্মূল করে দেন। তাদের সমস্ত চক্রান্ত ভন্ডুল করে দেন। তাদের প্রায় সকলেই ধ্বংস হয়। যারা ফিরেছিল, তারাও আহত অবস্থায় ফিরেছিল। যেমন তাদের নেতা আবরাহা কিছু সাথীসহ রাজধানী ছান‘আতে পৌঁছেন। কিন্তু তখন তার সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ছিঁড়ে পড়ছিল। অবশেষে তার বুক ফেটে কলিজা বেরিয়ে যায় এবং তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তবে তার আগে তিনি লোকদের কাছে আল্লাহর গযবের কাহিনী বর্ণনা করে যান (ইবনু কাছীর)।  

প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য যে, আবরাহার মৃত্যুর পর তার পুত্র ইয়াকসূম (يكسوم) শাসক হন। তার পরে তার ভাই মাসরূক (مسروق) ক্ষমতাসীন হন। এ সময় সাবেক হিমইয়ারী শাসক সম্প্রদায়ের সায়েফ বিন যী-ইয়াযান (سيف بن ذى يَزَن) বিদ্রোহ করেন এবং পারস্য সম্রাট কিসরার সাহায্য প্রার্থনা করেন। ফলে কিসরার সৈন্যদের সহায়তায় তিনি হাবশী শাসকদের পরাজিত করে ৭২ বছর পর নিজ বংশের হৃত শাসন ক্ষমতা পুনরুদ্ধার করেন।[6]

কুরতুবী বলেন, আমাদের বিদ্বানগণ বলেছেন যে, হস্তীওয়ালাদের এই কাহিনী আমাদের নবীর জন্য অন্যতম মু‘জেযা স্বরূপ ছিল। কেননা তিনি স্বচক্ষে ঘটনা দেখেননি। অথচ যখন তিনি এই সূরা পাঠ করে শুনান, তখন মক্কায় এ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী বহুলোক বেঁচেছিলেন। তারা সবাই এ সূরার বক্তব্যের সাথে ঐক্যমত পোষণ করেন। এমনকি হযরত আয়েশা (রাঃ) ঐ সময় বাল্য বয়সের মেয়ে হওয়া সত্ত্বেও তিনি বর্ণনা করেন যে, لَقَدْ رَأَيْتُ قَائِدَ الْفِيْلِ وَسَائِقَهُ أَعْمَيَيْنِ يَسْتَطْعِمَانِ النَّاسَ- ‘আমি হাতির চালক ও সহিসকে অন্ধ অবস্থায় মানুষের কাছে খাদ্য চাইতে দেখেছি’।[7] একই বর্ণনা তাঁর বোন হযরত আসমা বিনতে আবুবকর (রাঃ) থেকেও এসেছে (ইবনু কাছীর)

উল্লেখ্য যে, মক্কা বিজয়ের ভাষণে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) হস্তীবাহিনী ধ্বংসের কথা উল্লেখ করে বলেন, إِنَّ اللهَ حَبَسَ عَنْ مَكَّةَ الْفِيلَ وَسَلَّطَ عَلَيْهَا رَسُولَهُ وَالْمُؤْمِنِيْنَ قَدْ عَادَتْ حُرْمَتُهَا الْيَوْمَ كَحُرْمَتِهَا بِالأَمْسِ وَلْيُبَلِّغِ الشَّاهِدُ الْغَائِبَ ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ মক্কা থেকে হস্তীবাহিনীকে প্রতিরোধ করেছেন এবং তার উপর তাঁর রাসূল ও মুমিনগণকে বিজয়ী করেছেন। আর এর পবিত্রতা পুনরায় আজ ফিরে এসেছে, যেমন পবিত্র ছিল গতকাল। অতএব হে জনগণ! উপস্থিতগণ অনুপস্থিতগণের নিকট পৌঁছে দাও’।[8]

সংশয় নিরসন :

সূরা ফীল এবং সূরা আনকাবূত ৬৭ আয়াত প্রমাণ করে যে, কা‘বাগৃহ ও হারাম এলাকা চিরকাল নিরাপদ থাকবে। কিন্তু ইবনু আববাস ও আবু হুরায়রা (রাঃ) বর্ণিত হাদীছদ্বয়[9] প্রমাণ করে যে, কা‘বাগৃহ এক সময় ধ্বংস হবে। এর জওয়াবে ইবনু হাজার আসক্বালানী (রহঃ) বলেন, এটি ক্বিয়ামতের প্রাক্কালে সংঘটিত হবে, যখন পৃথিবীতে ‘আল্লাহ’ বলার মত কোন তাওহীদবাদী মানুষ আর থাকবেনা।[10] যা আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে মুসনাদে আহমাদ-এর বর্ণনায়[11] পূর্ণাঙ্গভাবে এসেছে। যেখানে বলা হয়েছে, ثُمَّ تَأْتِى الْحَبَشَةُ فَيُخَرِّبُونَهُ خَرَاباً لاَ يَعْمُرُ بَعْدَهُ أَبَداً ‘অতঃপর হাবশীরা আসবে। তারা বায়তুল্লাহকে এমনভাবে ধ্বংস করবে যে, তা পরে আর কখনো আবাদ হবে না’। প্রশ্ন হ’ল, প্রথমবার কা‘বা ধ্বংস করতে আসা হাবশী নেতা আবরাহার বাহিনীকে আল্লাহ ধ্বংস করে দিলেন, কিন্তু শেষ যামানায় আসা হাবশীদের আল্লাহ ধ্বংস করবেন না কেন? জবাব এই যে, প্রথমবারে সেখানে কোন মুসলমান ছিলনা। দ্বিতীয়তঃ সেটা ছিল রাসূল (ছাঃ)-এর জন্মবর্ষ। যাঁর মাধ্যমে আল্লাহ স্বীয় গৃহের মর্যাদা আরও বৃদ্ধি করতে চেয়েছিলেন। সেকারণ তিনি সাথে সাথে বাধা দিয়েছিলেন। পক্ষান্তরে আখেরী যামানায় ধ্বংসকারীরা হবে নামধারী মুসলমান। যা উক্ত হাদীছেই বলা হয়েছে যে, وَلَنْ يَسْتَحِلَّ هَذَا الْبَيْتَ إِلاَّ أَهْلُهُ ‘এই গৃহকে হালাল করবে না তার অধিবাসীরা ব্যতীত’। অর্থাৎ পথভ্রষ্ট মুসলমানরাই একে বিনষ্ট করবে। যেমন ইয়াযীদ বিন মু‘আবিয়ার শাসনকালে (৬০-৬৪ হি:/৬৮০-৮৩ খৃ:) ৬৪ হিজরীতে এবং আববাসীয় শাসনামলে ক্বারামতীদের হাতে ৩১৭ হিজরীতে কা‘বা গৃহ বিধ্বস্ত ও অসম্মানিত হয়েছিল।[12] কিন্তু আল্লাহ বাধা দেননি। কেননা তারা প্রকাশ্যে মুসলমান ছিল। তাদের শাস্তি আল্লাহ ইহকালে ও পরকালে দিবেন। যেমন তিনি বলেন, وَمَنْ يُرِدْ فِيْهِ بِإِلْحَادٍ بِظُلْمٍ نُذِقْهُ مِنْ عَذَابٍ أَلِيمٍ ‘যে ব্যক্তি এখানে (মসজিদুল হারামে) সীমালংঘনের মাধ্যমে পাপকার্যের সংকল্প করে, আমরা তাকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির স্বাদ আস্বাদন করাবো’ (হজ্জ ২২/২৫)। অতএব অত্র হাদীছের ভবিষ্যদ্বাণী বরং রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নবুঅতের অন্যতম নিদর্শন এবং অত্র হাদীছ উক্ত আয়াতের বিরোধী নয়। যেখানে বলা হয়েছে, أَوَلَمْ يَرَوْا أَنَّا جَعَلْنَا حَرَمًا آمِنًا وَيُتَخَطَّفُ النَّاسُ مِنْ حَوْلِهِمْ ‘তারা কি দেখেনা যে, আমরা হারামকে নিরাপদ করেছি। অথচ তাদের চতুষ্পার্শ্বে যারা আছে তারা উৎখাত হয়’ (আনকাবূত ২৯/৬৭)। কেননা অত্র আয়াতে এমন কথা বলা হয়নি যে, তারা সর্বদা নিরাপদ থাকবে’।[13]

সারকথা :

বায়তুল্লাহর হেফাযত ও নিরাপত্তার দায়িত্ব আল্লাহর। আল্লাহর ইচ্ছা ব্যতীত পৃথিবীর কোন শক্তি একে ধ্বংস করতে পারবে না।


[1]. ছফিউর রহমান মুবারকপুরী, আর-রাহীকুল মাখতূম, পৃঃ ৫১। 

[2]. তাফসীর ত্বাবারী ৩০/১৮৫ পৃঃ।

[3]. হাকেম ২/৫৩৬ হা/৬৮৭৭; ছহীহাহ হা/১৯৪৪।

[4]. বুখারী হা/২৭৩১, ২৭৩২।

[5]. ছেহাহ ফিল লুগাহ ১/৩০৪।

[6]. সীরাতে ইবনে হিশাম ১/৬৮; তাফসীরে ইবনু কাছীর।

[7]. সীরাতে ইবনে হিশাম ১/৫৭; মাজমা‘উয যাওয়ায়েদ হা/৫৭০৪ হাদীছ ছহীহ।

[8]. বুখারী হা/৬৮৮০, মুসলিম হা/১৩৫৫।

[9]. বুখারী হা/১৫৯৫-৯৬ ‘হজ্জ’ অধ্যায়, ‘কা‘বা ধ্বংস’ অনুচ্ছেদ-৪৯; মিশকাত হা/২৭২১।

[10]. মুসলিম হা/১৪৮; মিশকাত হা/৫৫১৬।

[11]. মুসনাদে আহমাদ হা/৭৮৯৭; ছহীহাহ হা/৫৭৯।

[12]. আববাসীয় খলীফা মুক্বতাদির বিল্লাহর শাসনামলে (২৯৫-৩২০/৯০৮-৯৩২ খৃ:) বিদ্রোহী ক্বারামতী দলের নেতা আবু তাহের ক্বারমাত্বী ৩১৭ হিজরীর ৮ই যিলহাজ্জ তারিখে মক্কায় হামলা চালায়। তারা ঐ সময় কা‘বাগৃহের দরজা খুলে নেয়। হাজরে আসওয়াদ ভেঙ্গে উপড়িয়ে ফেলে এবং ১১ দিনে ১০ হাযার হাজী ও মক্কাবাসীকে হত্যা করে। তারা হাজরে আসওয়াদ বহন করে তাদের কেন্দ্র হিজরে (هجر) নিয়ে যায়। যা বর্তমানে সঊদী আরবের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশ আহসা ও বাহরায়েন এলাকায় অবস্থিত ছিল। ২২ বছর পর ৩৩৯ হিজরীতে খলীফা মুতী‘ বিন মুক্বতাদির (৩৩৪-৬৩/৯৪৬-৭৪ খৃ:) ৫০ হাযার স্বর্ণমুদ্রার বিনিময়ে তাদের কাছ থেকে ওটা উদ্ধার করেন। অতঃপর তাদের নেতা সাম্বার বিন হাসান সেটিকে নিয়ে ১০ই যিলহাজ্জ কুরবানীর দিন কা‘বাগৃহে যথাস্থানে বসিয়ে দেন ও তাওয়াফ করেন।

[13]. ইবনু কাছীর, আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ ১১/১৭৩; ফাৎহুল বারী হা/১৫৯৫-৯৬-এর ব্যাখ্যা দ্র: ৩/৫৩৯-৪০ পৃ:।