তাফসীরুল কুরআন - (৩০তম পারা)

সূরা কুরায়েশ

(কুরায়েশ বংশ)

সূরা তীন-এর পরে মক্কায় অবতীর্ণ।

সূরা ১০৬, আয়াত ৪, শব্দ ১৭, বর্ণ ৭৩।

بِسْمِ اللہِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِیْمِ

পরম করুণাময় অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে (শুরু করছি)

(১) কুরায়েশদের অনুরাগের কারণে
لِإِيلَافِ قُرَيْشٍ
(২) তাদের অনুরাগের কারণে শীত ও গ্রীষ্মকালীন সফরের প্রতি
إِيلَافِهِمْ رِحْلَةَ الشِّتَاءِ وَالصَّيْفِ
(৩) অতএব তারা যেন ইবাদত করে এই গৃহের মালিকের
فَلْيَعْبُدُوا رَبَّ هَذَا الْبَيْتِ
(৪) যিনি তাদেরকে ক্ষুধায় অন্ন দান করেছেন এবং ভীতি হ’তে নিরাপদ করেছেন।
الَّذِي أَطْعَمَهُمْ مِنْ جُوعٍ وَآمَنَهُمْ مِنْ خَوْفٍ

বিষয়বস্ত্ত :

(১) কুরায়েশদের নিকট বায়তুল্লাহর গুরুত্ব তুলে ধরা (১-২ আয়াত)। (২) তাদেরকে একনিষ্ঠভাবে কা‘বার মালিকের ইবাদতের প্রতি আহবান করা (৩-৪ আয়াত)

গুরুত্ব :

উম্মে হানী বিনতে আবু ত্বালেব হ’তে বর্ণিত রাসূল (ছাঃ) এরশাদ করেন,

فَضَّلَ اللهُ قُرَيْشاً بِسَبْعِ خِلاَلٍ : أنِّيْ مِنْهُمْ وَأَنَّ النُّبُوَّةَ فِيْهِمْ وَأَنَّ الْحِجَابَةَ وَالسِّقَايَةَ فِيْهِمْ وَأَنَّ اللهَ نَصَرَهُمْ عَلَى الْفِيْلِ وَأَنَّهُمْ عَبَدُوا اللهَ عَشْرَ سِنِيْنَ لاَ يَعْبُدُهُ غَيْرُهُ وَأَنْزَلَ الله فِيْهِمْ سُورَةً مِنَ الْقُرْآنِ ثُمَّ تَلاَهَا رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: بِسْمِ اللهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيْمِ- لِإِيْلاَفِ قُرَيْشٍ، إِيلافِهِمْ رِحْلَةَ الشِّتَاءِ وَالصَّيْفِ، فَلْيَعْبُدُوْا رَبَّ هَذَا الْبَيْتِ، الَّذِي أَطْعَمَهُمْ مِنْ جُوعٍ وَآمَنَهُمْ مِنْ خَوْفٍ- أخرجه الحاكم-

‘আল্লাহ কুরায়েশদের সাতটি বিষয়ে মর্যাদা দান করেছেন। ১- আমি তাদের মধ্যকার ২- নবুঅত তাদের মধ্যে এসেছে ৩- কা‘বাগৃহের তত্ত্বাবধান ৪- হাজীদের পানি পান করানোর দায়িত্ব পালন ৫-আল্লাহ তাদেরকে হস্তীওয়ালাদের বিরুদ্ধে সাহায্য করেন ৬- উক্ত ঘটনার পর কুরায়েশরা দশ বছর যাবৎ আল্লাহ ব্যতীত কারু ইবাদত করেনি ৭- আল্লাহ তাদের বিষয়ে কুরআনে পৃথক একটি সূরা নাযিল করেছেন। অতঃপর তিনি অত্র সূরাটি তেলাওয়াত করেন বিসমিল্লাহ সহ।[1]

তাফসীর :

(১) لِإِيْلاَفِ قُرَيْشٍ ‘কুরায়েশদের অনুরাগের কারণে’।

الإِلْفُ وَالأُلْفَةُ অর্থ ‘ভালোবাসা’। آلفه إلافًا ومؤالفة وإيلافًا ‘পরস্পরে ভালোবাসা’। সেখান থেকে لِإِيْلاَفِ قُرَيْشٍ অর্থ ‘কুরায়েশদের প্রতি অনুরাগের কারণে’।

আয়াতটিসহ সূরাটি পূর্ববর্তী সূরা ফীল-এর সাথে সম্পৃক্ত নাকি পৃথক- এ নিয়ে মতভেদ রয়েছে। যদি পূর্ববর্তী সূরার সাথে সম্পৃক্ত ধরা হয়, তাহ’লে অর্থ দাঁড়াবে أهلكنا أصحاب الفيل لإيلاف قريش لكى تأمن رحلتيها- ‘আমরা হস্তীওয়ালাদের পর্যুদস্ত করেছি কুরায়েশদের প্রতি আমাদের অনুরাগের কারণে, যাতে তারা তাদের দু’টি ব্যবসায়িক সফরে নিরাপত্তা লাভ করতে পারে’। আর যদি সূরাটিকে পৃথক ধরা হয়, কেননা উভয় সূরার মাঝখানে ‘বিসমিল্লাহ’ রয়েছে, যা পৃথক হওয়ার বড় প্রমাণ, তাহ’লে অর্থ হবে, فليعبدوا هؤلاء رب هذا البيت، لإيلافهم رحلة الشتاء والصيف ‘তাদের উচিত এই গৃহের মালিকের ইবাদত করা শীত ও গ্রীষ্মকালীন সফরের প্রতি তাদের আসক্তির কারণে’। لِإِيْلاَفِ এর لام তখন متعلق হবে فَلْيَعْبُدُوا -এর এবং فا অব্যয়টি অতিরিক্ত হবে, সংযোগকারী (عاطفة) অব্যয় নয়। যেমন বলা হয়, زيدًا فَاضْرِبْ ‘যায়েদকে মারো’ (কুরতুবী)। তবে এটাই প্রসিদ্ধ ও সর্ববাদীসম্মত যে, দু’টিই পৃথক ও প্রতিষ্ঠিত সূরা (ইবনু কাছীর)। ইবনু জারীর বলেন, وفى إجماع جميع المسلمين على أنهما سورتان تامتان، كل واحدة منهما منفصلة عن الأخرى ‘সকল মুসলমানের ঐক্যমত এই যে, এ দু’টি পূর্ণাঙ্গ সূরা এবং প্রত্যেকটিই একে অপর থেকে পৃথক’।[2]

قريش -কে ‘কুরায়েশ’ কেন বলা হয় এ বিষয়ে একবার মু‘আবিয়া (রাঃ) হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, لدابة في البحر من أقوى دوابه يقال لها القِرْشُ، تأكل ولا تؤكل، تَعْلو ولا تُعْلَى. ‘একটি সামুদ্রিক প্রাণীর কারণে, যা সমুদ্রের সকল প্রাণীর চাইতে অধিক শক্তিশালী, যাকে ‘ক্বিরশ’ বলা হয়। যে অন্যকে ধরে খায়। কিন্তু তাকে কেউ খেতে পারে না। সে বিজয়ী হয়। কিন্তু পরাজিত হয় না’ (কুরতুবী)।

উপমহাদেশের খ্যাতনামা জীবনীকার ও রাসূল (ছাঃ)-এর জীবনচরিত ‘রহমাতুল্লিল আলামীন’-এর স্বনামধন্য লেখক ক্বাযী সুলায়মান বিন সালমান মানছূরপুরী (মৃ: ১৩৪৯/১৯৩০ খৃ:) বলেন, ‘কুরায়েশ’ অর্থ সাগরের তিমি মাছ। ইয়ামনের বাদশাহ হাসসান একবার মক্কা আক্রমণ করে কা‘বাগৃহ উঠিয়ে নিজ দেশে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। রাসূল (ছাঃ)-এর ঊর্ধ্বতন দ্বাদশ পিতামহ ফিহর বিন মালেক তাকে যুদ্ধে হারিয়ে তিন বছর বন্দী করে রাখেন। অতঃপর মুক্তি দেন। হাসসান ইয়ামনে ফেরার পথে রাস্তায় মারা যায়। এই বীরত্বপূর্ণ ঘটনার পর থেকে ফিহর قُرَيْشُ الْعَرَبِ বা ‘আরবের কুরায়েশ’ বলে খ্যাতি লাভ করেন’।[3]

ক্বিরশ-কে تصغير করে ‘কুরায়েশ’ বলা হয় সম্মানের কারণে (ইবনু জারীর, তানতাভী)। প্রচলিত অর্থে নাযার বিন কিনানাহ (نضر بن كنانة) -এর বংশধরগণকে ‘কুরায়শী’ বলা হয়। নাযার ছিলেন রাসূল (ছাঃ)-এর ঊর্ধ্বতন চৌদ্দতম পিতামহ। যেমন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,

إِنَّ اللهَ اصْطَفَى كِنَانَةَ مِنْ وُلْدِ إِسْمَاعِيلَ وَاصْطَفَى قُرَيْشًا مِنْ كِنَانَةَ وَاصْطَفَى مِنْ قُرَيْشٍ بَنِى هَاشِمٍ وَاصْطَفَانِى مِنْ بَنِى هَاشِمٍ ‘আল্লাহ ইসমাঈলের সন্তানগণের মধ্য হ’তে বনু কিনানাহকে বেছে নিয়েছেন। অতঃপর বনু কিনানাহ থেকে কুরায়েশকে বেছে নিয়েছেন। অতঃপর কুরায়েশ থেকে বনু হাশেমকে বেছে নিয়েছেন এবং আমাকে বেছে নিয়েছেন বনু হাশেম থেকে’।[4]

(২) إِيْلاَفِهِمْ رِحْلَةَ الشِّتَاءِ وَالصَّيْفِ ‘তাদের অনুরাগের কারণে শীত ও গ্রীষ্মকালীন সফরের প্রতি’।

কুরায়েশরা ব্যবসার জন্য শীতকালে ইয়ামন যেত। কেননা ইয়ামন ছিল গরমের দেশ এবং গ্রীষ্মকালে শাম বা সিরিয়া যেত। কেননা সিরিয়া ছিল ঠান্ডার দেশ। ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, তারা গরমে ত্বায়েফও যেত সেখানকার মৃদুমন্দ মৌসুমী আবহাওয়ার জন্য। ফলে মক্কার লোকদের জন্য এটা আল্লাহর একটা বিরাট অনুগ্রহ ছিল যে, মক্কার একদিকে যখন গরম, অন্য দিকে তখন ঠান্ডা। আবার একদিকে যখন ঠান্ডা, অন্যদিকে তখন গরম (কুরতুবী)। ইয়ামন থেকে তারা সেখানকার গ্রীষ্মকালীন উৎপন্ন শস্যাদি নিয়ে আসত এবং সিরিয়া থেকে তারা সেখানকার শীতকালীন ফল-ফলাদি নিয়ে আসত। আল্লাহর ঘরের অধিবাসী হিসাবে তাদের ব্যবসায়ী কাফেলা সর্বত্র সম্মানিত হ’ত। তাদেরকে حُمْس ‘কঠোর ধার্মিক’ বা اَهْلُ اللهِ ‘আল্লাহওয়ালা’ বা اهلُ بيتِ الله ‘আল্লাহর ঘরের বাসিন্দা’ বলা হ’ত। কখনোই তাদের কাফেলা অন্যদের দ্বারা লুট হতো না। বরং রাস্তাঘাটে যেকোন বিপদাপদে লোকেরা সর্বদা তাদের সাহায্যের জন্য প্রস্ত্তত থাকত। যদি তাদের এই দু’টি ব্যবসায়িক সফর নিয়মিতভাবে অব্যাহত না থাকত, তাহ’লে তাদের জীবনে সচ্ছলতা ও সুখ-শান্তি কিছুই থাকত না। সেকারণ দু’টি ব্যবসায়িক সফরের প্রতি তাদের অনুরাগ ও আসক্তি ছিল স্বাভাবিকভাবেই প্রবল ও প্রশ্নাতীত।

رِحْلَةَ الشِّتَاءِ যবরযুক্ত হয়েছে ‘মাছদার’ হওয়ার কারণে। অর্থাৎ ارتحالهم رحلةً ‘তাদের সফরের জন্য, অথবা ظرف হওয়ার কারণে (কুরতুবী)।

(৩) فَلْيَعْبُدُوْا رَبَّ هَذَا الْبَيْتِ ‘অতএব তারা যেন ইবাদত করে এই গৃহের মালিকের’।

অর্থাৎ কুরায়েশদের উচিত কৃতজ্ঞতা স্বরূপ এই গৃহের মালিকের ইবাদত করা শীত ও গ্রীষ্মকালীন সফরের প্রতি তাদের আসক্তির কারণে। এ সময় فا অব্যয়টি (سببية وزائدة) কারণসূচক ও অতিরিক্ত হবে। অথবা আল্লাহ তাদের নির্দেশ দিচ্ছেন যেন তারা একনিষ্ঠভাবে কেবল এই গৃহের মালিকের ইবাদত করে। অন্য কোন নে‘মতের কারণে না হ’লেও অন্ততঃ বছরে দু’টি নিরাপদ ব্যবসায়িক সফরের প্রতি তাদের বিশেষ আসক্তির কারণে। فا অব্যয়টি এ সময় শর্তের (شرطية) অর্থ প্রকাশ করবে।

এক্ষণে ‘ইবাদত’ অর্থ কি? ইমাম ইবনু তায়মিয়াহ বলেন, إن العبادة اسم جامع لكل ما يحبه الله ويرضاه من الأقوال والأعمال الظاهرة والباطنة ‘ইবাদত হ’ল প্রকাশ্য ও গোপন কথা ও কর্ম সমূহের সামগ্রিক নাম, যা আল্লাহ ভালবাসেন ও যা তাঁকে খুশী করে’। অতএব কুরায়েশদের ও সকল মানুষের উচিত অনুরূপ কাজ করা যাতে আল্লাহ সন্তুষ্ট হন।

رَبَّ هَذَا الْبَيْتِ ‘এই গৃহের মালিক’ অর্থ ‘কা‘বাগৃহের মালিক’। এটা বলার কারণ দু’টি হ’তে পারে। এক- কা‘বাগৃহে তারা যেসব মূর্তি স্থাপন করেছে, আল্লাহ সেসব থেকে নিজের মুক্তি ও বৈরিতা ঘোষণা করেছেন। দুই- কুরায়েশদের যাবতীয় সম্মান ও সচ্ছলতার কেন্দ্রবিন্দু হ’ল কা‘বাগৃহ, সেকথাটি স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে (কুরতুবী)। মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কেও আল্লাহ একই নির্দেশ দিয়েছেন। যেমন বলা হয়েছে, إِنَّمَا أُمِرْتُ أَنْ أَعْبُدَ رَبَّ هَذِهِ الْبَلْدَةِ الَّذِي حَرَّمَهَا... ‘আমিতো আদিষ্ট হয়েছি এই (মক্কা) নগরীর প্রভুর ইবাদত করতে। যিনি একে সম্মানিত করেছেন ...’ (নমল ২৭/৯১)

(৪) اَلَّذِيْ أَطْعَمَهُمْ مِّنْ جُوْعٍ وَّآمَنَهُم مِّنْ خَوْفٍ ‘যিনি তাদেরকে ক্ষুধায় অন্ন দান করেছেন এবং ভীতি হ’তে নিরাপদ করেছেন’।

অর্থাৎ আল্লাহ তাদেরকে হাযারো নে‘মতের মধ্যে শ্রেষ্ঠ দু’টি নে‘মত দান করেছেন, ক্ষুধায় অন্নদান অর্থাৎ আর্থিক সচ্ছলতা এবং বহিঃশত্রুর হামলা হ’তে নিরাপত্তা। এ দু’টি সেরা অনুগ্রহের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে আল্লাহ তাদেরকে তাঁর প্রতি একনিষ্ঠভাবে ইবাদতের আহবান জানিয়েছেন।

এখানে مِنْ جُوْعٍ অর্থ بعد جوع ‘ক্ষুধার পরে’। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ) বলেন, এ দু’টি নে‘মত ছিল হযরত ইবরাহীম (আঃ)-এর দো‘আর ফসল। কেননা তিনি দো‘আ করেছিলেন, رَبِّ اجْعَلْ هَـَذَا بَلَداً آمِناً وَارْزُقْ أَهْلَهُ مِنَ الثَّمَرَاتِ ‘হে প্রভু! এ স্থানকে তুমি নিরাপদ শহরে পরিণত কর এবং এর অধিবাসীদের তুমি ফল-ফলাদি দ্বারা রূযী প্রদান কর’ (বাক্বারাহ ২/১২৬, ইবরাহীম ১৪/৩৫)।

কা‘বাগৃহে মূর্তি কেন?

প্রশ্ন হ’তে পারে, পরবর্তীতে যে ইবরাহীমী কা‘বা মূর্তিপূজার কেন্দ্রে পরিণত হ’ল, সেটাও কি তাঁর দো‘আর ফসল? জবাব এই যে, (১) আল্লাহ কোন বাতিলপন্থীকে সরাসরি বাধা দেন না। কেননা এতে তার পরীক্ষা বিঘ্নিত হয়। (২) এটি আদৌ ইবরাহীম (আঃ)-এর দো‘আর ফসল নয়। কেননা এ ব্যাপারে ইবরাহীমের দো‘আ ছিল নিম্নরূপ : আল্লাহ বলেন, وَإِذْ قَالَ إِبْرَاهِيمُ رَبِّ اجْعَلْ هَذَا الْبَلَدَ آمِنًا وَاجْنُبْنِي وَبَنِيَّ أَنْ نَعْبُدَ الْأَصْنَامَ ، رَبِّ إِنَّهُنَّ أَضْلَلْنَ كَثِيرًا مِنَ النَّاسِ فَمَنْ تَبِعَنِي فَإِنَّهُ مِنِّي وَمَنْ عَصَانِي فَإِنَّكَ غَفُورٌ رَحِيمٌ (স্মরণ কর সেকথা) যখন ইবরাহীম বলেছিল, হে আমার প্রতিপালক! এই নগরীকে (মক্কাকে) নিরাপদ কর এবং আমাকে ও আমার সন্তানদেরকে মূর্তিপূজা হ’তে দূরে রাখো! ‘হে আমার প্রতিপালক! এসব মূর্তি বহু মানুষকে পথভ্রষ্ট করেছে। অতএব যে আমার অনুসরণ করবে, সে আমার দলভুক্ত। আর যে আমার অবাধ্যতা করবে, (তার ব্যাপারে) তুমি ক্ষমাশীল ও দয়াবান’ (ইবরাহীম ১৪/৩৫-৩৬)। এখানে মুহাম্মাদ (ছাঃ) ও তাঁর অনুসারীগণ হ’লেন ইবরাহীম (আঃ)-এর দলভুক্ত। কিন্তু আবু জাহলরা দাবী করলেও তাঁর দলভুক্ত নয়। কা‘বা গৃহে মূর্তিপূজা করলেও আল্লাহ তাদের ধ্বংস করেননি। কারণ হয়তবা এটা হ’তে পারে যে, তারা কা‘বা গৃহের তত্ত্বাবধান করত। হাজীদের সেবা করত। সর্বোপরি তাদের বংশেই শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর আবির্ভাব ঘটবে, সেটার কারণে। এছাড়াও আল্লাহর দূরদর্শী পরিকল্পনার খবর বান্দা কিভাবে জানবে?

অত্র সূরা ও পূর্ববর্তী সূরা ফীল-এর মধ্যে আল্লাহ হারাম শরীফের ন্যায় মহান নে‘মত সম্পর্কে কুরায়েশদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। কেননা হারামের কারণেই তারা নিরাপত্তা ও রিযিক লাভ করে থাকে। যেমন আল্লাহ বলেন,

أَوَلَمْ نُمَكِّنْ لَّهُمْ حَرَماً آمِناً يُجْبَى إِلَيْهِ ثَمَرَاتُ كُلِّ شَيْءٍ رِزْقاً مِن لَّدُنَّا وَلَكِنَّ أَكْثَرَهُمْ لاَ يَعْلَمُوْنَ-

‘আমরা কি তাদের জন্য একটি নিরাপদ ‘হারাম’ প্রতিষ্ঠিত করিনি? এখানে সকল প্রকার ফলমূল আমদানী হয় আমাদের দেওয়া রিযিক স্বরূপ। কিন্তু তাদের অধিকাংশ তা জানেনা’ (ক্বাছাছ ২৮/৫৭)। দুগ্ধপোষ্য সন্তান ইসমাঈল ও তার মাকে মক্কার বিরাণভূমিতে রেখে আসার সময় ইবরাহীম (আঃ) আল্লাহর নিকটে দো‘আ করেছিলেন,

رَبَّنَا إِنِّيْ أَسْكَنْتُ مِن ذُرِّيَّتِيْ بِوَادٍ غَيْرِ ذِيْ زَرْعٍ عِنْدَ بَيْتِكَ الْمُحَرَّمِ رَبَّناَ لِيُقِيْمُوا الصَّلاَةَ فَاجْعَلْ أَفْئِدَةً مِّنَ النَّاسِ تَهْوِيْ إِلَيْهِمْ وَارْزُقْهُم مِّنَ الثَّمَرَاتِ لَعَلَّهُمْ يَشْكُرُوْنَ-

‘হে আমাদের পালনকর্তা! আমি নিজের এক সন্তানকে তোমার সম্মানিত গৃহের সন্নিকটে চাষাবাদহীন উপত্যকায় আবাদ করেছি, প্রভু হে! যাতে তারা ছালাত কায়েম করে। অতএব তুমি কিছু লোকের অন্তরকে তাদের প্রতি রুজূ করে দাও এবং ফল-ফলাদি দ্বারা তাদের রূযী দান কর। যাতে তারা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে’ (ইবরাহীম ১৪/৩৭)।

তখন থেকে মক্কা প্রথম আবাদ হয় এবং মা হাজেরার অনুমতিক্রমে ইয়ামনের বনু জুরহুম গোত্রের লোকেরা যমযম কূয়াকে কেন্দ্র করে বসতি স্থাপন করে। অতঃপর মক্কা মোকাররমায় কখনো খাদ্যাভাব হয়নি। যদিও সেখানে চাষাবাদের তেমন কোন ব্যবস্থা নেই। তথাপি সারা বিশ্বের ফল-ফলাদি সারা বছর সর্বদা সমভাবে সেখানে পাওয়া যায়। কেবল রূযীর প্রাচুর্য নয়, বরং মক্কা সর্বদা শত্রুর আক্রমণ হ’তে নিরাপদ থেকেছে। যেমন আল্লাহ অন্যত্র বলেন,

أَوَلَمْ يَرَوْا أَنَّا جَعَلْنَا حَرَماً آمِناً وَيُتَخَطَّفُ النَّاسُ مِنْ حَوْلِهِمْ أَفَبِالْبَاطِلِ يُؤْمِنُوْنَ وَبِنِعْمَةِ اللهِ يَكْفُرُوْنَ-

‘তারা কি দেখে না যে, আমরা হারামকে নিরাপদ করেছি। অথচ তাদের চতুষ্পার্শ্বে যারা আছে, তারা উৎখাত হয়। তাহ’লে তারা কি বাতিলের উপরে ঈমান আনবে আর আল্লাহর নে‘মতকে অস্বীকার করবে?’ (আনকাবূত ২৯/৬৭)।

এভাবে সূরাটিতে কুরায়েশদের প্রতি উপদেশ এবং তাদেরকে দেওয়া আল্লাহর মহান গৃহের মর্যাদা ও সামাজিক নিরাপত্তার অমূল্য নে‘মতের কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং তার শুকরিয়া আদায়ের প্রতি উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে।

শিক্ষণীয় বিষয় :

বান্দার প্রতি আল্লাহ কত বেশী দয়ালু, তার একটি বড় প্রমাণ হ’ল এই সূরাটি। খোদ আল্লাহর গৃহে আল্লাহর সাথে মূর্তিপূজার মত জঘন্যতম শিরক করা সত্ত্বেও আল্লাহ তাদেরকে গযবে ধ্বংস না করে বরং তাদের রক্ষা করেছেন। রূযীতে সচ্ছলতা দান করেছেন। তাদের সম্মান বৃদ্ধি করেছেন। সবশেষে তাদেরকে তাঁর দেওয়া শ্রেষ্ঠ নে‘মত-এর কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে তাঁর প্রতি একনিষ্ঠ ইবাদতের আহবান জানাচ্ছেন। এরপরে আল্লাহ কুরায়েশদের ঘরে তাঁর সেরা বান্দা ও শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে প্রেরণ করে কুরায়েশদের মর্যাদা আরও বৃদ্ধি করলেন। এতকিছু অনুগ্রহ করার পরেও আবু জাহ্ল, আবু লাহাবরা শিরক বর্জন করেনি। মুখে আল্লাহ ও আখেরাতকে স্বীকার করলেও এবং কা‘বাগৃহকে সম্মান করলেও আল্লাহর আদেশ তারা মানেনি। ফলে তারা দুনিয়া ও আখেরাতে আল্লাহর গযবপ্রাপ্ত হয়েছে। কিন্তু ব্যাপক গযব পাঠিয়ে সবাইকে আল্লাহ ধ্বংস করেননি। কেননা আল্লাহ তাদের মধ্য থেকেই বের করে এনেছেন আবুবকর, ওমর, ওছমান ও আলীর মত বিশ্বসেরা মানুষগুলিকে। যাঁরা তাঁদের জীবদ্দশাতেই জান্নাতের সুসংবাদ পেয়ে ধন্য হয়েছেন। এতে বুঝা যায় যে, আল্লাহ মুসলিম উম্মাহকে ব্যাপক গযবে ধ্বংস করবেন না। তাদের মধ্য থেকেই শ্রেষ্ঠ মানুষগুলিকে বের করে এনে তাঁর দ্বীনকে বাঁচিয়ে রাখবেন। যারা চিরদিন বিশ্বকে সঠিক পথের দিশা দিয়ে যাবেন।

সকল মানুষকে রূযী ও নিরাপত্তা দেওয়া সত্ত্বেও আল্লাহ এখানে নির্দিষ্টভাবে কা‘বা ও কুরায়েশদের কথা বর্ণনা করেছেন। কেননা এ দুইয়ের মর্যাদা পৃথিবীর মধ্যে সেরা। তাই অন্যত্র পাপাচারের চাইতে এখানে পাপাচারের গোনাহ সবচেয়ে বেশী। যেমন আল্লাহ বলেন, وَمَنْ يُرِدْ فِيْهِ بِإِلْحَادٍ بِظُلْمٍ نُذِقْهُ مِنْ عَذَابٍ أَلِيْمٍ ‘যে ব্যক্তি মাসজিদুল হারামে কোন ধর্মদ্রোহী কাজের সংকল্প করে, আমরা তাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির স্বাদ আস্বাদন করাবো’ (হজ্জ ২২/২৫)

এক্ষণে প্রশ্ন হ’ল, সকল মানুষ কুরায়েশ নয় এবং সকল গৃহ কা‘বাগৃহ নয়। অথচ প্রত্যেক মানুষকে আল্লাহ আশ্রয় ও রূযী দান করেছেন। অতএব প্রত্যেক জ্ঞানী মানুষকে মহান আল্লাহর দেওয়া নে‘মতরাজির শুকরিয়া আদায় করা উচিত এবং একমাত্র তাঁরই ইবাদত করা উচিত, যিনি অলক্ষ্যে থেকে আমাদের জন্য খাদ্য-বস্ত্র, চিকিৎসা ও আশ্রয়ের ব্যবস্থা করেছেন। কোন অবস্থায় যেন আমরা আবু জাহল, আবু লাহাবদের মত অবাধ্য ও অহংকারী না হই। বরং আবুবকর, ওমর, ওছমান, আলী (রাঃ) প্রমুখদের মত আল্লাহর কৃতজ্ঞ বান্দা হয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় নেই। আল্লাহুম্মা আমীন!

সারকথা :

রূযী ও নিরাপত্তা দানের প্রকৃত মালিক আল্লাহ। অতএব সর্বাবস্থায় কেবল তাঁরই ইবাদত করতে হবে ও তাঁরই শরণাপন্ন হ’তে হবে।


[1]. বায়হাক্বী, আল-খিলাফিয়াত (الخلافيات) ; হাকেম আল-মুস্তাদরাক ২/৫৩৬, হা/৩৯৭৫; আলবানী, সিলসিলা ছহীহাহ হা/১৯৪৪; ছহীহুল জামে‘ হা/৪২০৯।

[2]. তাফসীর ইবনে জারীর, সূরা কুরায়েশ, (বৈরূত : দারুল মা‘রিফাহ ১৪০৭/১৯৭৮) ৩০/১৯৮ পৃঃ।

[3]. সুলায়মান মানছূরপুরী, রহমাতুল্লিল ‘আলামীন (দিল্লী : ১ম সংস্করণ, ১৯৮০ খৃ:), ২/৫৯ পৃঃ।

[4]. মুসলিম হা/২২৭৬, মিশকাত হা/৫৭৪০ ওয়াছেলা ইবনুল আসক্বা‘ হ’তে।