তাফসীরুল কুরআন - (৩০তম পারা)

সূরা ফজর

(প্রভাতকাল)

সূরা লায়েল-এর পরে মক্কায় অবতীর্ণ।

সূরা ৮৯, আয়াত ৩০, শব্দ ১৩৯, বর্ণ ৫৭৩।

بِسْمِ اللہِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِیْمِ

পরম করুণাময় অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে (শুরু করছি)।

(১) শপথ ফজরের
وَالْفَجْرِ
(২) শপথ দশ রাত্রির
وَلَيَالٍ عَشْرٍ
(৩) শপথ জোড় ও বেজোড়ের
وَالشَّفْعِ وَالْوَتْرِ
(৪) শপথ রাত্রির, যখন তা অতিক্রান্ত হ’তে থাকে।
وَاللَّيْلِ إِذَا يَسْرِ
(৫) নিশ্চয়ই ঐসবের মধ্যে বড় ধরনের শপথ রয়েছে জ্ঞানী ব্যক্তির জন্য।
هَلْ فِي ذَلِكَ قَسَمٌ لِذِي حِجْرٍ
(৬) তুমি কি জানো না তোমার প্রভু কি আচরণ করেছিলেন ‘আদ গোত্রের সাথে?
أَلَمْ تَرَ كَيْفَ فَعَلَ رَبُّكَ بِعَادٍ
(৭) ইরম বংশের। যারা ছিল উঁচু স্তম্ভসমূহের মালিক।
إِرَمَ ذَاتِ الْعِمَادِ
(৮) যাদের ন্যায় কাউকে জনপদসমূহে সৃষ্টি করা হয়নি।
الَّتِي لَمْ يُخْلَقْ مِثْلُهَا فِي الْبِلَادِ
(৯) এবং (কি আচরণ করেছিলেন) ছামূদ গোত্রের সাথে? যারা পাথর কেটে উপত্যকায় গৃহ নির্মাণ করেছিল।
وَثَمُودَ الَّذِينَ جَابُوا الصَّخْرَ بِالْوَادِ
(১০) এবং (কি আচরণ করেছিলেন) ফেরাঊনের সাথে? যে ছিল বহু কীলকের অধিপতি।
وَفِرْعَوْنَ ذِي الْأَوْتَادِ
(১১) যারা দেশে সীমালংঘন করেছিল।
الَّذِينَ طَغَوْا فِي الْبِلَادِ
(১২) অতঃপর সেখানে তারা বহু অনাচার করেছিল।
فَأَكْثَرُوا فِيهَا الْفَسَادَ
(১৩) ফলে তোমার পালনকর্তা তাদের উপরে শাস্তির কশাঘাত হানেন।
فَصَبَّ عَلَيْهِمْ رَبُّكَ سَوْطَ عَذَابٍ
(১৪) নিশ্চয় তোমার পালনকর্তা ঘাঁটিতে সদা সতর্ক থাকেন।
إِنَّ رَبَّكَ لَبِالْمِرْصَادِ
(১৫) কিন্তু মানুষ এরূপ যে, যখন তার প্রতিপালক তাকে পরীক্ষা করেন, অতঃপর তাকে সম্মানিত করেন ও সুখ-সম্পদ দান করেন, তখন সে বলে যে, আমার প্রভু আমাকে সম্মানিত করেছেন।
فَأَمَّا الْإِنْسَانُ إِذَا مَا ابْتَلَاهُ رَبُّهُ فَأَكْرَمَهُ وَنَعَّمَهُ فَيَقُولُ رَبِّي أَكْرَمَنِ
(১৬) পক্ষান্তরে যখন তিনি তাকে পরীক্ষায় ফেলেন এবং তার রূযী সংকুচিত করেন, তখন সে বলে যে, আমার প্রভু আমাকে হেয় করেছেন।
وَأَمَّا إِذَا مَا ابْتَلَاهُ فَقَدَرَ عَلَيْهِ رِزْقَهُ فَيَقُولُ رَبِّي أَهَانَنِ
(১৭) কখনোই এরূপ নয়। বরং তোমরা ইয়াতীমকে সম্মান কর না।
كَلَّا بَلْ لَا تُكْرِمُونَ الْيَتِيمَ
(১৮) এবং অভাবগ্রস্তকে অন্নদানে পরস্পরকে উৎসাহিত কর না।
وَلَا تَحَاضُّونَ عَلَى طَعَامِ الْمِسْكِينِ
(১৯) আর তোমরা মৃত ব্যক্তির পরিত্যক্ত সম্পদ যথেচ্ছভাবে ভক্ষণ করে থাক,
وَتَأْكُلُونَ التُّرَاثَ أَكْلًا لَمًّا
(২০) এবং তোমরা ধন-সম্পদকে অত্যধিক ভালবাস।
وَتُحِبُّونَ الْمَالَ حُبًّا جَمًّا
(২১) এটা কখনই ঠিক নয়। (স্মরণ কর) যেদিন পৃথিবী চূর্ণ-বিচূর্ণ হবে,
كَلَّا إِذَا دُكَّتِ الْأَرْضُ دَكًّا دَكًّا
(২২) এবং তোমার পালনকর্তা আসবেন ও ফেরেশতামন্ডলী সারিবদ্ধভাবে থাকবে,
وَجَاءَ رَبُّكَ وَالْمَلَكُ صَفًّا صَفًّا
(২৩) যেদিন জাহান্নামকে আনা হবে। যেদিন মানুষ (তার কৃতকর্ম) স্মরণ করবে। কিন্তু তখন এই স্মৃতিচারণ তার কি কাজে আসবে?
وَجِيءَ يَوْمَئِذٍ بِجَهَنَّمَ يَوْمَئِذٍ يَتَذَكَّرُ الْإِنْسَانُ وَأَنَّى لَهُ الذِّكْرَى
(২৪) সেদিন সে বলবে, হায়! যদি আমার এই (পরকালীন) জীবনের জন্য অগ্রিম কিছু (নেক আমল) পাঠিয়ে দিতাম!  
يَقُولُ يَا لَيْتَنِي قَدَّمْتُ لِحَيَاتِي
(২৫) অতঃপর সেদিন আল্লাহর শাস্তির ন্যায় শাস্তি কেউ দিবে না।
فَيَوْمَئِذٍ لَا يُعَذِّبُ عَذَابَهُ أَحَدٌ
(২৬) এবং তাঁর বাঁধনের ন্যায় শক্ত বাঁধন কেউ দিবে না।
وَلَا يُوثِقُ وَثَاقَهُ أَحَدٌ
(২৭) হে প্রশান্ত আত্মা!
يَا أَيَّتُهَا النَّفْسُ الْمُطْمَئِنَّةُ
(২৮) ফিরে চলো তোমার প্রভুর পানে, সন্তুষ্ট চিত্তে ও সন্তোষভাজন অবস্থায়।
ارْجِعِي إِلَى رَبِّكِ رَاضِيَةً مَرْضِيَّةً
(২৯) অতঃপর প্রবেশ কর আমার বান্দাদের মধ্যে।
فَادْخُلِي فِي عِبَادِي
(৩০) এবং প্রবেশ কর আমার জান্নাতে।
وَادْخُلِي جَنَّتِي

গুরুত্ব :

হযরত জাবের (রাঃ) বলেন, মু‘আয বিন জাবাল (রাঃ) রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে এশার ছালাত আদায়ের পর নিজ মহল্লায় (বনু সালেমাহ) এসে পুনরায় এশার জামা‘আতে ইমামতি করার সময় সূরা বাক্বারাহ দিয়ে ক্বিরাআত শুরু করেন। এতে জনৈক রাখাল ব্যক্তি জামা‘আত ছেড়ে পৃথকভাবে ছালাত আদায় করে চলে যায়। একথা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে জানানো হ’লে তিনি মু‘আযকে ডেকে বলেন, أَفَتَّانٌ أَنْتَ يَا مُعَاذُ؟ ‘মু‘আয তুমি কি ফিৎনাকারী? তুমি কি সূরা আ‘লা, ফজর, শাম্স, লায়েল, যোহা পড়তে পারো না’?[1]

বিষয়বস্ত্ত :

সূরাটিতে তিনটি বিষয় বর্ণিত হয়েছে। (১) পাঁচটি বস্ত্তর শপথ করে আল্লাহ বলেছেন যে, তিনি বান্দার সকল বিষয়ে সদা সতর্ক দৃষ্টি রাখেন। এর প্রমাণ হিসাবে তিনি বিগত যুগের দুর্ধর্ষ ও শক্তিশালী তিনটি জাতিকে ধ্বংস করে দেয়ার কাহিনী পেশ করেছেন (১-১৪ আয়াত)(২) সম্পদের প্রাচুর্য বা অপ্রাচুর্যের মধ্যে কারু সম্মান বা অসম্মান নির্ভর করে না। বরং বান্দাকে সৎকাজের তাওফীক দান করাই হ’ল আল্লাহর পক্ষ হ’তে তাকে সম্মানিত করা এবং এর বিপরীতটার অর্থ হ’ল তাকে অসম্মানিত করা । অতঃপর অকৃতজ্ঞ লোকদের চারটি মন্দ আচরণের কথা বর্ণনা করা হয়েছে (১৫-২০ আয়াত)(৩) সম্মানিত ও অসম্মানিত ব্যক্তি চূড়ান্তভাবে যাচাই হবে ক্বিয়ামতের দিন। যেদিন আল্লাহ সকলের সম্মুখে উপস্থিত হবেন এবং বান্দাকে তার কর্মের যথাযোগ্য প্রতিদান ও প্রতিফল দান করবেন (২১-৩০ আয়াত)

তাফসীর :

(১) وَالْفَجرِ ‘শপথ ফজরের’।

فَجْرٌ অর্থ প্রভাতরশ্মি। যা দু’প্রকার : ছুবহে কাযেব (মিথ্যা প্রভাত), যা অতি ভোরে পূর্বাকাশে সরু ও দীর্ঘ শুভ্ররেখা হিসাবে দেখা যায়। অতঃপর ছুবহে ছাদেক (সত্য প্রভাত), যা ছুবহে কাযেব-এর পরে দীর্ঘ ও উত্তর-দক্ষিণে প্রশস্ত হয়ে উদিত হয়। এটি মৌসুমভেদে সূর্যোদয়ের ১ ঘণ্টা ১৭ মিনিট থেকে ১ ঘণ্টা ৩২ মিনিট পূর্বে হয়ে থাকে। আলোচ্য আয়াতে ছুবহে ছাদিক-এর সপথ করা হয়েছে। কারণ রাত্রির অন্ধকার শেষ করে ফজরের প্রভাতরশ্মি আনার একমাত্র মালিক আল্লাহ। এর মধ্যে পৃথিবীর আহ্নিক গতির বৈজ্ঞানিক উৎসের সন্ধানও বলে দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ বলেন, قُلْ أَرَأَيْتُمْ إِنْ جَعَلَ اللهُ عَلَيْكُمُ اللَّيْلَ سَرْمَدًا إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ مَنْ إِلَهٌ غَيْرُ اللهِ يَأْتِيكُمْ بِضِيَاءٍ أَفَلاَ تَسْمَعُوْنَ ‘বল! তোমরা ভেবে দেখেছ কি আল্লাহ যদি রাত্রিকে ক্বিয়ামত পর্যন্ত দীর্ঘায়িত করেন, তবে আল্লাহ ব্যতীত আর কোন্ উপাস্য আছে, যে তোমাদের নিকট আলো এনে দিতে পারে? এরপরেও কি তোমরা কথা শুনবে না? (ক্বাছাছ ২৮/৭১)

সূরার শুরুতে বর্ণিত পাঁচটি শপথের প্রথম হ’ল ফজরের শপথ। কেননা প্রতিদিনের ছুবহে ছাদেক ঘুমন্ত বান্দার সম্মুখে জাগৃতির নতুন বারতা নিয়ে হাযির হয়। যে আল্লাহ তাকে ৫/৬ ঘণ্টা ঘুমের মৃত্যুর পরে তাযা দেহমন নিয়ে জাগিয়ে তুললেন, সেই মহান সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশ্যে ফজরের ছালাতের মাধ্যমে সারাদিন তাঁর হুকুম মেনে চলার তাওফীক কামনা করে বান্দা ভূপৃষ্ঠে ছড়িয়ে পড়ে নানাবিধ কাজে। তাই প্রতিদিনের ফজর বান্দার জন্য প্রতি রাতের মৃত্যুর পর ক্বিয়ামত স্বরূপ। সেকথার ইঙ্গিত রয়েছে অত্র শপথের মধ্যে ।

কেবল ফজর নয়। বরং প্রতিটি ঘুম বান্দার জন্য মৃত্যুস্বরূপ ও প্রতিটি জাগরণ বান্দার জন্য ক্বিয়ামত স্বরূপ। আর এই স্বাভাবিক নিদ্রা ও জাগরণে বান্দার কোন হাত নেই। এটি সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর ইচ্ছাধীন। তাঁর ইচ্ছা হ’লে যেকোন সময়ের নিদ্রা্ বান্দার জন্য চিরনিদ্রায় পরিণত হতে পারে। আল্লাহ বলেন, وَمِنْ آيَاتِهِ مَنَامُكُمْ بِاللَّيْلِ وَالنَّهَارِ وَابْتِغَاؤُكُمْ مِنْ فَضْلِهِ إِنَّ فِي ذَلِكَ لَآيَاتٍ لِقَوْمٍ يَسْمَعُوْنَ ‘আর তাঁর নিদর্শন সমূহের অন্যতম হ’ল তোমাদের রাত্রি ও দিবসের নিদ্রা এবং (এর মাধ্যমে) তোমাদের আল্লাহর কৃপা অন্বেষণ। নিশ্চয়ই এর মধ্যে নিদর্শন সমূহ রয়েছে (মনোযোগ দিয়ে) শ্রবণকারী সম্প্রদায়ের জন্য’ (রূম ৩০/২৩)

(২) وَلَيَالٍ عَشْرٍ ‘শপথ দশ রাত্রির’। ইবনু আববাস, ইবনু যুবায়ের, মুজাহিদ, সুদ্দী, কালবী প্রমুখ বিগত ও পরবর্তী যুগের অধিকাংশ বিদ্বান এর দ্বারা যুলহিজ্জাহর প্রথম দশদিন অর্থ নিয়েছেন। তবে কেউ কেউ রামাযানের শেষ দশকের কথাও বলেছেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, مَا مِنْ أَيَّامٍ الْعَمَلُ الصَّالِحُ فِيْهِنَّ أَحَبُّ إِلَى اللهِ مِنْ هَذِهِ الأَيَّامِ، يَعْنِى الْعَشْرَ- قَالُوا يَا رَسُوْلَ اللهِ وَلاَ الْجِهَادُ فِى سَبِيْلِ اللهِ؟ قَالَ وَلاَ الْجِهَادُ فِى سَبِيْلِ اللهِ إِلاَّ رَجُلٌ خَرَجَ بِنَفْسِهِ وَمَالِهِ فَلَمْ يَرْجِعْ مِنْ ذَلِكَ بِشَىْءٍ- ‘এই দশদিনের (অর্থাৎ যুলহিজ্জাহর প্রথম দশদিনের) আমলের চাইতে প্রিয়তর কোন আমল আল্লাহর কাছে নেই। ছাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন, ‘আল্লাহর রাস্তায় জিহাদও কি নয়’? রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, আল্লাহর রাস্তায় জিহাদও নয়। তবে ঐ ব্যক্তি, যে স্বীয় জান ও মাল নিয়ে জিহাদে বেরিয়েছে। কিন্তু কিছুই নিয়ে ফিরে আসেনি’। অর্থাৎ শহীদ হয়ে গেছে।[2]

উক্ত দশ দিনের ফযীলত বেশী হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ হ’ল এই যে, ঐ সময় মুমিনগণ হজ্জের প্রস্ত্ততি ও ইবাদতসমূহ পালনে লিপ্ত থাকেন। যারা হজ্জে আসেন না, তারা আরাফার দিনে নফল ছিয়াম পালন করেন, যা বিশ্ব মুসলিম ঐক্যের গভীর অনুভূতি সৃষ্টি করে। যাতে তাদের বিগত এক বছরের ও আগত একবছরের ছগীরা গোনাহসমূহ মাফ করা হয়।[3] এতদ্ব্যতীত এ সময় হাজী ছাহেবদের সফরের প্রস্ত্ততিতে সহযোগিতা ও অন্যান্য ইবাদতের মাধ্যমে মুমিন বান্দাগণ প্রচুর নেকী উপার্জনে লিপ্ত থাকে। পূর্ববর্তী আয়াতের সাথে অত্র আয়াতের সুন্দর সামঞ্জস্য রয়েছে। কেননা ফজরের পরে সকল মানুষ স্ব স্ব কর্মস্থলে সমবেত হয়। হজ্জের মৌসুমে ও উক্ত দশদিনে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আল্লাহর মেহমানগণ ‘লাববায়েক’ বলতে বলতে বায়তুল্লাহতে সমবেত হন। এর মধ্যে একথার প্রতি ইঙ্গিত রয়েছে যে, হজ্জের মওসুমের যাবতীয় ইবাদত বান্দা যেমন শরী‘আতের বিধান মোতাবেক পালন করে থাকে, অনুরূপভাবে ফজরের পর থেকে সারাদিন বান্দা তার কর্মস্থলে যেন শরী‘আতের বিধান মেনে অতিবাহিত করে এবং শয়তানের পায়রবী থেকে নিজেকে বিরত রাখে।

(৩) وَالشَّفْعِ وَالْوَتْرِ ‘শপথ জোড় ও বেজোড়ের’। الْوَتْرُ وَالْوِتْرُ অর্থ বেজোড়। মুজাহিদ বলেন, الشفع الزوج والوتر الله عز وجل অর্থাৎ الشفع হ’ল সকল জোড়া এবং বিতর হ’লেন আল্লাহ’। অন্য বর্ণনায় তিনি বলেন, الله الوتر وخلقه الشفع الذكر والأنثى ‘আল্লাহ হ’লেন বেজোড় এবং তাঁর সৃষ্টি হ’ল জোড়া, যা নারী ও পুরুষ সমন্বিত’। ইবনু আববাস (রাঃ)ও অনুরূপ বলেন (ইবনু কাছীর)। তানতাভী বলেন, অত্র আয়াতটি কুরআনের শ্রেষ্ঠ মু‘জেযা সমূহের অন্যতম (من أكبر معجزات القرآن) । কেননা এর মধ্যে রয়েছে গণিতশাস্ত্রের মূল উৎসের সন্ধান। যা প্রাচীনকালে পিথাগোরাস (৫৭০-৪৯৫ খৃঃ পূঃ) প্রমুখ গ্রীক বিজ্ঞানীরা জানতেন। কিন্তু ঐসময় তা আরবদের জানা ছিল না। অথচ এত বড় এক গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক সংখ্যাতত্ত্বের খবর নিরক্ষর রাসূলের মুখ দিয়ে সর্বপ্রথম আরবরা জানলো। এ তত্ত্বটি কুরআনের অন্যত্র বর্ণিত হয়েছে অন্যভাবে। যেমন আল্লাহ বলেন, وَخَلَقْنَاكُمْ أَزْوَاجاً ‘আমরা তোমাদের সৃষ্টি করেছি জোড়ায় জোড়ায়’ (নাবা ৭৮/৮)। অন্যত্র তিনি বলেন, وَمِنْ كُلِّ شَيْءٍ خَلَقْنَا زَوْجَيْنِ لَعَلَّكُمْ تَذَكَّرُوْنَ ‘আমরা প্রত্যেক বস্ত্ত জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করেছি। যাতে তোমরা উপদেশ লাভ কর’ (যারিয়াত ৫১/৪৯)। অর্থাৎ তোমরা জানতে পার যে, সকল জোড়ার সৃষ্টিকর্তা মাত্র একজন, যিনি বেজোড়’ (ইবনু কাছীর)

‘জোড়া’ নানা ধরনের হ’তে পারে। যথা (ক) সত্তাগত। যেমন নারী-পুরুষ। (খ) বস্ত্তগত। যেমন কাঁচা-পাকা। (গ) গুণগত। যেমন সত্য-মিথ্যা, ঈমান-কুফর ইত্যাদি। এমনিভাবে সর্বত্র আমরা জোড়া দেখতে পাই। বস্ত্ততঃ সকল বস্ত্তর মূল সত্তায় রয়েছে নেগেটিভ ও পজেটিভ তথা ইলেকট্রন ও প্রোটন নামক দু’টি অণুর মিলন। এসবের বিপরীতে বেজোড় কেবলমাত্র আল্লাহর সত্তা। আল্লাহ বলেন, قُلْ هُوَ اللهُ أَحَدٌ، اللهُ الصَّمَدُ، لَمْ يَلِدْ وَلَمْ يُولَدْ، وَلَمْ يَكُن لَّهُ كُفُواً أَحَدٌ- ‘তুমি বল, তিনি আল্লাহ এক’। ‘তিনি মুখাপেক্ষীহীন’। ‘তিনি কাউকে জন্ম দেননি এবং তিনি কারু জন্মিত নন’ ‘এবং তাঁর সমতুল্য কেউ নেই’ (ইখলাছ ১১২/১-৪)

বস্ত্ততঃ ‘এক’ এমন একটি সংখ্যা যার কোন যৌগ নেই, যার কোন শরীক নেই। বরং সমস্ত সংখ্যা তারই মুখাপেক্ষী। একের সাথে যোগ করলে অন্য সংখ্যা হয়। কিন্তু এককে বাদ দিলে কোন সংখ্যাই হয় না। যেমন হাদীছে এসেছে বিতর ছালাতের মূল হ’ল এক রাক‘আত (اَلْوِتْرُ رَكْعَةٌ وَاحِدَةٌ)[4] তিন, পাঁচ, সাত, নয় রাক‘আতকে বিতর বলা হ’লেও তা সবই এক-এর সঙ্গে জোড় সংখ্যা যুক্ত হয়েই তবে বেজোড় হয়েছে। অমনিভাবে হাদীছে আল্লাহকে ‘বিতর’ বলা হয়েছে। যেমন- إِنَّ اللهَ وِتْرٌ يُحِبُّ الْوِتْرَ ‘আল্লাহ বেজোড়। তিনি বেজোড় পসন্দ করেন।[5]

অতএব অত্র সূরায় الْوَتْرِ অর্থাৎ বেজোড় বলে আল্লাহ স্বীয় সত্তার একত্বের শপথ করেছেন, যা তাওহীদের মূল বিষয়। অতঃপর وَالشَّفْعِ অর্থাৎ জোড় বলে আল্লাহ তাঁর সৃষ্টিজগতের শপথ করেছেন। এর মাধ্যমে আল্লাহ এদিকে ইঙ্গিত করেছেন যে, এক ও দুই সংখ্যাগত দিক দিয়ে যেমন পৃথক, সত্তাগত দিক দিয়েও তেমনি পৃথক। সৃষ্টিকর্তা ও সৃষ্টি তাই কখনো এক নয় বা একটি অপরটির অংশ নয়। যেমন কথিত ছূফীবাদী ও অদ্বৈতবাদী দর্শনের অনুসারী কিছু লোক মনে করে থাকেন যে, সৃষ্টি সবই সৃষ্টিকর্তার অংশ। উভয়ের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। অতএব ‘যত কল্লা, তত আল্লা’ (নাঊযুবিল্লাহ)।

وَالْوَتْرِ অর্থ বেজোড়, যেমন আল্লাহর সত্তা, যা সকল সংখ্যার মূল صل العدد)الشفع অর্থ জোড়, তেমনি সৃষ্টির সত্তা, যা সকল সংখ্যার উৎস (مبدأ العدد)। বাকী অন্যান্য সংখ্যা দুইয়ের সাথে যোগ করেই তৈরী হয়ে থাকে। অংক শাস্ত্র, হিসাব বিজ্ঞান, পদার্থ বিজ্ঞান, সৌর বিজ্ঞান তথা সকল বিজ্ঞানের মূল উৎস লুকিয়ে রয়েছে এই দু’টি সংখ্যার মধ্যে, যা বর্ণিত হয়েছে বিজ্ঞানময় কুরআনের অত্র আয়াতে মাত্র দু’টি শব্দের মাধ্যমে। সুবহানাল্লাহি ওয়া বেহামদিহী

(৪) وَاللَّيْلِ إِذَا يَسْرِ ‘শপথ রাত্রির, যখন তা অতিক্রান্ত হ’তে থাকে’।

এটি হ’ল পঞ্চম শপথ। سَرَى يَسْرِى سَرْيَةً অর্থ السير فى الليل ‘রাত্রিতে চলা’। এখানে الليل يسير ‘রাত্রি চলে’ অর্থ সূর্যাস্তের পর থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত অবিরতভাবে চলে। ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, إِذَا يَسْرِ অর্থ إذا ذهب ‘যখন চলে যায়’। আব্দুল্লাহ ইবনু যুবায়ের (রাঃ) বলেন, حتى يذهب بعضه بعضا ‘যখন রাত কিছু কিছু করে চলে যেতে থাকে’। يَسْرِ আসলে ছিল يَسْرِىْ কিন্তু হালকা করার জন্য শেষের ى বর্ণটি ফেলে দেওয়া হয়েছে।

(৫) هَلْ فِيْ ذَلِكَ قَسَمٌ لِّذِيْ حِجْرٍ ‘নিশ্চয়ই ঐসবের মধ্যে বড় ধরনের শপথ রয়েছে জ্ঞানী ব্যক্তির জন্য’। মুক্বাতিল বলেন, এখানে هل অর্থ إنَّ অর্থাৎ ‘নিশ্চয়ই’ (কুরতুবী)هل প্রশ্নবোধক অব্যয় (الاستفهام) আনা হয়েছে মূলতঃ নিশ্চয়তাবোধক (للتقرير) অর্থ বুঝানোর জন্য। অর্থাৎ এগুলির মধ্যে জ্ঞানবানদের জন্য যথাযোগ্য শপথ রয়েছে। আত্মভোলা মানুষের বিবেককে জাগ্রত করার জন্য এটা আরবদের একটি গুরুত্বপূর্ণ বাকরীতি।

لِذِىْ حِجْرٍ অর্থ لِذِى عَقْلٍ وَلُبٍّ ‘জ্ঞানী ও বিবেকবান’। الحِجْرُ অর্থ المنع ‘বাধা’। যে ব্যক্তি নিজেকে সংযত রাখে তাকে ذو حجر বলা হয়’ (কুরতুবী, ইবনু কাছীর)। জ্ঞান ও বিবেক মানুষকে মন্দ ও ক্ষতিকর বিষয়াদি থেকে বাধা দান করে। সেকারণ এখানে ‘হিজর’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। ذِيْ حِجْرٍ অর্থ বাধা দানকারী অর্থাৎ বিবেক। যাকে অন্যত্র النَّفْسُ اللَّوَّامَةُ ‘তিরষ্কারকারী আত্মা’ বলা হয়েছে (ক্বিয়ামাহ ৭৫/২)

জ্ঞানী সমাজকে কুরআনের বিভিন্ন স্থানে لِقَوْمٍ يَعْقِلُوْنَ বা لِأُوْلِي الْأَلْبَابِ ইত্যাদি শব্দে বলা হয়েছে। কিন্তুذِيْ حِجْر ٍ শব্দটি কেবল এখানেই ব্যবহার করা হয়েছে এবং শপথের মধ্যে জ্ঞান-কে কেবল এখানেই আনা হয়েছে। এর গোপন রহস্য কি? তানতাভী বলেন, সেটা কেবল এটাই হ’তে পারে যে, এর দ্বারা কুরআনের পাঠক ও অনুসারীদেরকে আল্লাহর সৃষ্টি ও ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে গভীর জ্ঞান-গবেষণায় লিপ্ত হবার প্রতি আহবান জানানো হয়েছে। যা কেবল ব্যাকরণ ও বালাগাত শিক্ষার দ্বারা অর্জন করা সম্ভব নয়’ (তাফসীর তানতাভী ২৫/১৫৫)। অন্যত্র তিনি বলেন, কুরআনে ফিক্বহ বিষয়ক আয়াতের সংখ্যা দেড়শ’র বেশী হবে না। অথচ সৃষ্টিতত্ত্ব (علوم الكائنات) বিষয়ক প্রকাশ্য আয়াতের সংখ্যা সাড়ে সাতশ’। এছাড়াও রয়েছে ‘প্রায় প্রকাশ্য’ অন্যান্য আয়াতসমূহ, যা থেকে কোন একটি সূরাও খালি নেই’ (সূরা আবাসা ২৪-৩২ আয়াতের তাফসীর দ্রষ্টব্য ২৫/৫৫-৫৬)। তিনি বলেন, একটি প্রসিদ্ধ বিধান হ’ল, مالا يتم به الواجب إلا به فهو واجب ‘যা ব্যতীত ওয়াজিব পূর্ণ হয় না, সেটাও ওয়াজিব’। অতএব সৃষ্টিকর্তা হিসাবে আল্লাহকে যথার্থভাবে জানতে গেলে তাঁর সৃষ্টিকৌশল ও সৃষ্টিতত্ত্ব সম্পর্কে যথাযথভাবে জ্ঞান অর্জন করাটাও ওয়াজিব’ (ঐ, পৃঃ ৫৪)। আর তখনই হাছিল হবে প্রকৃত অর্থে আল্লাহর মা‘রিফাত বা পরিচয়।

উপরে বর্ণিত পাঁচটি শপথের জওয়াব উহ্য রয়েছে। অর্থাৎ لَيُعَذِّبَنَّ ‘অবিশ্বাসীরা অবশ্যই শাস্তিপ্রাপ্ত হবে’ (ক্বাসেমী, তানতাভী)। যা পরবর্তী আয়াত সমূহে ইঙ্গিত করা হয়েছে। যেমন-

(৬-৮) َألَمْ تَرَ كَيْفَ فَعَلَ رَبُّكَ بِعَادٍ، إِرَمَ ذَاتِ الْعِمَاد، الَّتِيْ لَمْ يُخْلَقْ مِثْلُهَا فِي الْبِلاَدِ- ‘তুমি কি জানো না তোমার প্রভু কিরূপ আচরণ করেছিলেন ‘আদে ইরম (১ম ‘আদ) গোত্রের সাথে’? ‘যারা ছিল উঁচু স্তম্ভসমূহের মালিক’। ‘যাদের ন্যায় কাউকে জনপদসমূহে সৃষ্টি করা হয়নি’।

‘আদ হ’ল দক্ষিণ আরবের একটি বিখ্যাত গোত্রের নাম। যারা ছিল নূহ (আঃ)-এর পরবর্তী যুগের মানুষ। আল্লাহ তাদের হেদায়াতের জন্য হূদ (আঃ)-কে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু তারা হঠকারিতা করে এবং বলে যে, مَنْ أَشَدُّ مِنَّا قُوَّةً؟ ‘আমাদের চাইতে শক্তিশালী আর কে আছে? (হা-মীম সাজদাহ ৪১/১৫)। ফলে তারা আল্লাহর গযবে ধ্বংস হয়ে যায়।

যালেমরা আখেরাতে জাহান্নামের কঠিন আযাব ভোগ করবে, এটা তো নিশ্চিত। কিন্তু তারা যে দুনিয়াতেও আল্লাহর কঠিন শাস্তির সম্মুখীন হয়ে থাকে, এবিষয়ে বিগত যুগে আল্লাহর গযবে ধ্বংসপ্রাপ্ত তিনটি বড় বড় দুর্ধর্ষ জাতির কাহিনী বর্ণনা করে তুলনামূলকভাবে ছোট যালেমদের আল্লাহ এখানে হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন এবং তাঁর শেষনবী ও উম্মতে মুহাম্মাদীকে সান্ত্বনা দিয়েছেন। উক্ত তিনটি ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতি হ’ল আদ, ছামূদ ও ফেরাঊন। যাদের প্রত্যেকটি ছিল স্ব স্ব যুগের সেরা শক্তিশালী ও সেরা অত্যাচারী। এই তিনটি কওমের কাছে আল্লাহ স্বীয় তিনজন প্রসিদ্ধ নবীকে পাঠিয়েছিলেন তাদের হেদায়াতের জন্য। তারা হ’লেন যথাক্রমে হযরত হূদ, ছালেহ ও মূসা (আঃ)। কিন্তু ঐ তিনটি কওমের নেতারা কেউ তাঁদের কথা শোনেনি এবং উপদেশবাণীর প্রতি ভ্রুক্ষেপ করেনি। তারা অহংকারে মদমত্ত হয়ে পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করেছিল। ফলে তাদের উপরে নেমে আসে এলাহী গযব। যা তাদেরকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়। এখানে বিশেষভাবে উক্ত তিনটি জাতির বর্ণনার কারণ হ’ল এই যে, ‘আদ ও ছামূদ আরব এলাকায় হওয়ায় এদের ধ্বংস কাহিনী আরবদের নিকট প্রসিদ্ধ ছিল। অনুরূপভাবে মিসর আরব সন্নিহিত এলাকা হওয়ায় ফেরাঊনের ধ্বংস কাহিনী লোক মুখে তাদের নিকটে পৌঁছেছিল।

উক্ত কাহিনীত্রয়ের দিকে ইঙ্গিত করেই আল্লাহ স্বীয় রাসূলকে তথা সকল মানুষকে লক্ষ্য করে বলছেন, أَلَمْ تَرَ অর্থাৎ ألم تعلم ‘তুমি কি জানো না’? বস্ত্ততঃ নিরক্ষর নবীর কাছে এসব কাহিনী ছিল অভিনব, যা তিনি কখনোই জানতেন না। আজকের বৈজ্ঞানিক যুগের মানুষ কেবল কুরআনের মাধ্যমেই বিগত যুগের এসব অকাট্য সত্য ঘটনা সমূহের এবং হারানো সভ্যতা সমূহের সন্ধান পেয়েছে।

প্রথমেই বর্ণনা এসেছে ‘আদ জাতি সম্পর্কে। ‘আদ হ’ল হযরত নূহ (আঃ)-এর অধঃস্তন পঞ্চম পুরুষ। ‘আদ বিন ইরম বিন আওছ (عَوص) বিন সাম বিন নূহ (আঃ)। তবে কেউ কেউ ‘আদ বিন আওছ বিন ইরম বলেছেন। এখানে ‘আদ’ বলে ‘আদ জাতি বুঝানো হয়েছে। যেমন হাশেম বলে বনু হাশেম বুঝানো হয় (কুরতুবী)। ‘আদ জাতিকে ‘কওমে হূদ’ (قوم هود) বলা হয়। কেননা হযরত হূদ (আঃ) নবী হিসাবে এই জাতির নিকটে প্রেরিত হয়েছিলেন।

(৭) إِرَمَ ذَاتِ الْعِمَادِ এখানে ‘ইরম’ বলে سِبْط إرم অর্থাৎ ইরমের নিকটতম অধঃস্তন পুরুষদের বুঝানো হয়েছে। অত্র সূরার عاد إرم -কে অন্য সূরায় عاد الأولى অর্থাৎ প্রথম ‘আদ সম্প্রদায় বলা হয়েছে (নাজম ৫৩/৫০)। যারা পরবর্তী ‘আদ সম্প্রদায় থেকে আলাদা। নূহ (আঃ)-এর কওমের পরে সর্বপ্রথম ‘আদ-এর কওম আল্লাহর গযবে ধ্বংস হয়।

ذَاتِ الْعِمَادِ অর্থ ‘স্তম্ভসমূহের মালিক’। কিন্তু পারিভাষিক অর্থে উচ্চ মর্যাদা ও ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যক্তিকে বুঝানো হয়। যেমন কবি খানসা তাঁর প্রশংসিত ব্যক্তির প্রশংসায় বলেন, كثير الرماد رفيع العماد ‘অধিক ছাইওয়ালা ও উঁচু স্তম্ভওয়ালা’ অর্থাৎ অধিক অতিথিবৎসল এবং উচ্চ মর্যাদা ও ক্ষমতার অধিকারী (ذات الرفعت والثبات)। যাহহাক বলেন, অধিক ক্ষমতা ও কঠোরতার মালিক (ذاة القوة والشدة)। পূর্বের আয়াতে বর্ণিত عاد -এর উপরে অত্র আয়াতে বর্ণিত إِرَمَ শব্দটি عطف بيان হয়েছে। অর্থাৎ ‘আদে ইরম বা ইরম বংশীয় ‘আদ।

ইবনু কাছীর বলেন, তারা সে সময় উঁচু উঁচু প্রাসাদসমূহে বসবাস করত এবং দৈহিক আকৃতি ও বস্ত্তগত ক্ষমতায় ছিল সেযুগের সেরা শক্তিশালী জাতি। হযরত হূদ (আঃ) তাদেরকে দেওয়া আল্লাহর এই অমূল্য নে‘মতকে আল্লাহর আনুগত্যে ব্যয় করার আহবান জানান। কিন্তু তারা তা অগ্রাহ্য করে। ফলে তাদের উপরে নেমে আসে আল্লাহর গযব। যেমন অন্যত্র বলা হয়েছে, وَاذْكُرُواْ إِذْ جَعَلَكُمْ خُلَفَاءَ مِنْ بَعْدِ قَوْمِ نُوْحٍ وَزَادَكُمْ فِي الْخَلْقِ بَسْطَةً فَاذْكُرُواْ آلاَءَ اللهِ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُوْنَ- ‘আদ কওমের নবী হূদ (আঃ) স্বীয় কওমকে বলেন, ‘তোমরা স্মরণ কর যখন আল্লাহ তোমাদেরকে কওমে নূহের পরে ভূপৃষ্ঠের মালিক বানিয়েছেন এবং তোমাদের দৈহিক আকৃতিতে বিশালতা দান করেছেন। অতএব তোমরা আল্লাহর অনুগ্রহসমূহ স্মরণ কর যাতে তোমরা সফলকাম হ’তে পার’ (আ‘রাফ ৭/৬৯)। কিন্তু তারা হঠকারিতা করল এবং বাপ-দাদার আমল থেকে চলে আসা রেওয়াজের দোহাই দিয়ে শিরকের উপরে অটল রইল। অতঃপর নিজেদের শক্তির বড়াই দেখালো। যেমন আল্লাহ বলেন, فَأَمَّا عَادٌ فَاسْتَكْبَرُوْا فِي الْأَرْضِ بِغَيْرِ الْحَقِّ وَقَالُوْا مَنْ أَشَدُّ مِنَّا قُوَّةً أَوَلَمْ يَرَوْا أَنَّ اللهَ الَّذِيْ خَلَقَهُمْ هُوَ أَشَدُّ مِنْهُمْ قُوَّةً وَكَانُوْا بِآيَاتِنَا يَجْحَدُوْنَ- ‘অতঃপর আদ সম্প্রদায়, যারা পৃথিবীতে অযথা অহংকার দেখাল এবং বলল, আমাদের চাইতে শক্তিশালী আর কে আছে? তারা কি দেখে না যে আল্লাহ, যিনি তাদেরকে সৃষ্টি করেছেন, তিনি তাদের চাইতে অধিক শক্তিশালী। বস্ত্ততঃ তারা আমাদের নিদর্শনাবলীকে অস্বীকার করত’ (হা-মীম সাজদাহ/ফুছছিলাত ৪১/১৫)

অতঃপর তাদের অহংকার ও হঠকারিতার শাস্তি স্বরূপ আল্লাহ তাদের প্রতি প্রবল ঝঞ্ঝাবায়ু প্রেরণ করেন। যা ৮ দিন ও ৭ রাত্রি স্থায়ী হয় এবং সবকিছুকে ধ্বংস ও নিশ্চিহ্ন করে দেয়। এই সময় আল্লাহপাক স্বীয় নবী হূদ ও তাঁর অনুসারী মুমিনদের সরিয়ে নেন। উক্ত গযবের বর্ণনা দিয়ে আল্লাহ বলেন, وَأَمَّا عَادٌ فَأُهْلِكُوْا بِرِيْحٍ صَرْصَرٍ عَاتِيَةٍ، سَخَّرَهَا عَلَيْهِمْ سَبْعَ لَيَالٍ وَثَمَانِيَةَ أَيَّامٍ حُسُوْماً فَتَرَى الْقَوْمَ فِيْهَا صَرْعَى كَأَنَّهُمْ أَعْجَازُ نَخْلٍ خَاوِيَةٍ، فَهَلْ تَرَى لَهُم مِّنْ بَاقِيَةٍ؟ ‘অতঃপর আদ জাতি, যাদেরকে ধ্বংস করা হয়েছিল প্রচন্ড ঝঞ্ঝাবায়ু দ্বারা’। ‘যা তাদের উপরে তিনি প্রবাহিত করেছিলেন একটানা সাত রাত্রি ও আট দিবস ব্যাপী। তখন তুমি থাকলে তাদেরকে দেখতে যে তারা ভূপাতিত হয়ে পড়ে আছে খর্জুর বৃক্ষের অসার কান্ডসমূহের ন্যায়’। ‘তুমি কি এখন তাদের কোন চিহ্ন দেখতে পাও?’ (হা-ক্কাহ ৬৯/৬-৮)

(৮) الَّتِيْ لَمْ يُخْلَقْ مِثْلُهَا فِي الْبِلاَدِ ‘যাদের ন্যায় কাউকে জনপদসমূহে সৃষ্টি করা হয়নি’। অর্থাৎ ‘আদ গোত্রের ন্যায় শক্তিশালী কোন গোত্র তৎকালীন বিশ্বে সৃষ্টি করা হয়নি। তারা দৈহিক আকৃতিতে যেমন বিশালকায় ছিল, বৈষয়িক শক্তিতেও তেমনি অতুলনীয় ছিল।

শাদ্দাদ কে ছিলেন?

তাফসীর কুরতুবীতে সূত্রহীনভাবে বর্ণিত হয়েছে যে, ‘আদ-এর দুই পুত্র ছিল, শাদ্দাদ ও শাদীদ। শাদীদের মৃত্যু হ’লে শাদ্দাদ সাম্রাজ্যের একচ্ছত্র মালিক হন। তিনি নয়শ’ বছর বেঁচে ছিলেন। জান্নাতের কথা শুনে তিনি আদনের (صحارى عدن) মরুভূমিতে তিনশ’ বছর ধরে বিশাল শহর নির্মাণ করেন ও তাকেই জান্নাত নামকরণ করেন। যেখানে সোনা-রূপা ও মনি-মাণিক্য দিয়ে বড় বড় ইমারত নির্মাণ করা হয় ও বিভিন্ন জাতের বৃক্ষসমূহ লাগানো হয়। নির্মাণ শেষ হ’লে শাদ্দাদ তার দলবল নিয়ে সেখানে পৌঁছবার একদিন ও একরাতের পথ বাকী থাকতেই এক ভীষণ আসমানী বজ্র নিনাদে সব ধ্বংস হয়ে যায় (কুরতুবী, অত্র আয়াতের তাফসীর ২০/৪৩-৪৪)। এভাবে ত্বাবারী, ছা‘আলবী, যামাখশারী প্রমুখ মুফাসসিরগণ স্ব স্ব তাফসীর গ্রন্থে ছাহাবী আব্দুল্লাহ বিন ক্বিলাবাহর নামে শাদ্দাদের বেহেশতের যেসব কাহিনী বর্ণনা করেছেন, সে সম্পর্কে ইবনু কাছীর (রহঃ) বলেন, هذا كله من خرافات الإسرائيليين ما وضع بعض زنادقهم ليختبروا بذلك عقول الجهلة من الناس أن تصدقهم فى جميع ذلك- ‘এসবই ইহুদী-খ্রিষ্টানদের কিছু ধর্মদ্রোহী লোকের বানোয়াট কাহিনী মাত্র। তারা এর দ্বারা মূর্খ লোকদের জ্ঞানের পরিধি যাচাই করতে চায়। যাতে তারা তাদের সবকিছুকে বিশ্বাস করে নেয়’। তিনি বলেন, ভূগর্ভস্থ সঞ্চিত ধন অনুসন্ধানের নামে ধনী লোকদের ও বোকা লোকদের কাছ থেকে বাতিলপন্থায় অর্থ হাতিয়ে নেয়ার উদ্দেশ্যে তারা এসব কল্পকাহিনী তৈরী করে থাকতে পারে (মর্মার্থ; ঐ, তাফসীর)। বর্তমানে যেমন দক্ষিণ আফ্রিকায় স্বর্ণখনির অংশীদার বানানোর লোভ দেখিয়ে বাংলাদেশে কিছু এনজিও লোকদের পকেট হাতিয়ে নিচ্ছে। ইবনু খালদূন (রহঃ) বলেন, هذه المدينة لم يسمع لها خبر من يومئذ فى شيئ من بقاع الارض ‘ভূপৃষ্ঠের কোথাও এরূপ কোন মহানগরীর নাম কেউ কখনো শোনেনি’। তিনি বলেন,

وأي ضرورة إلى هذا المحمل البعيد الذي تمحلت لتوجيهه لأمثال هذه الحكايات الواهية التي ينزه كتاب الله عن مثلها لبعدها عن الصحة ؟

ذات العماد ‘স্তম্ভওয়ালা’-এর দূরতম ব্যাখ্যা দেবার জন্য এই ধরনের উদ্ভট কাহিনী অবতারণা করার কি প্রয়োজন ছিল? যেখানে আল্লাহর কিতাব এইরূপ সকল অশুদ্ধ বিষয় থেকে পবিত্র? (মুক্বাদ্দামা ইবনে খালদূন পৃঃ ১৩-১৫)। অতএব ‘শাদ্দাদের বেহেশত’ বলে যে কাহিনী প্রচলিত আছে, তা ভিত্তিহীন ও বানোয়াট মাত্র।

(৯) وَثَمُوْدَ الَّذِيْنَ جَابُوا الصَّخْرَ بِالْوَادِ ‘এবং ছামূদ কওমের সাথে? যারা পাথর কেটে উপত্যকায় গৃহ নির্মাণ করেছিল’। অর্থাৎ তুমি কি জানো না ছামূদ জাতির সাথে আল্লাহ কিরূপ আচরণ করেছিলেন? যারা বিগত যুগে পাহাড়ের বুকে পাথর খোদাই করে গৃহ নির্মাণ করত। এছাড়া পাথরকে সাইজ করে কেটে উপত্যকায় বড় বড় ইমারত নির্মাণ করত। এর মাধ্যমে ছামূদ জাতির ধ্বংসকাহিনী বর্ণনার সাথে সাথে বিগত যুগে তাদের উন্নত সভ্যতা ও অতুল্য স্থাপত্যশৈলীর বর্ণনাও পাওয়া যায়।

جَابَ يَجُوْبُ جَوْبًا অর্থ قطع ‘কর্তন করা’। জামার পকেটকে جَيْبٌ বলা হয়। কেননা এটি জামার একটি কর্তিত অংশ। ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, جَابُوا الصَّخْرَ অর্থ ينحتونها ويخرقونها ‘তারা পাথর খোদাই করত ও ছিদ্র করত’ (ইবনু কাছীর)। অর্থাৎ কেবল পাহাড়ের গায়ে খোদাই করা নয় বরং পাথর সুন্দর করে কেটে তারা উপত্যকায় গৃহ নির্মাণ করত। যেমন ছামূদ জাতির নবী হযরত ছালেহ (আঃ) স্বীয় কওমকে উদ্দেশ্য করে বলছেন, وَتَنْحِتُوْنَ مِنَ الْجِبَالِ بُيُوْتاً فَارِهِيْنَ ‘আর তোমরা পাহাড় কেটে জাঁকজমকপূর্ণ গৃহসমূহ নির্মাণ করে থাক’ (শো‘আরা ২৬/১৪৯)। অন্যত্র আল্লাহ বলেন, وَكَانُوْا يَنْحِتُوْنَ مِنَ الْجِبَالِ بُيُوْتاً آمِنِيْنَ ‘আর তারা পাহাড় কেটে নির্মাণ করত নিরাপদ গৃহসমূহ’ (হিজর ১৫/৮২)। এতে বুঝা যায় যে, সে যুগের লোকেরা কারিগরী বিদ্যা ও স্থাপত্য শিল্পে অনেক উন্নত ছিল।

‘ছামূদ’ গোত্র হ’ল ‘ইরম’ বংশের অন্যতম শাখা। কালবী বলেন, ‘আদ ও ছামূদ উভয় গোত্রের মূল দাদা হ’লেন ‘ইরম’। এজন্যেই বলা হয় عاد إرم ثمود إرم। কালবী আরও বলেন, ইরমের বংশধররা আম্মান (عمان) ও হাযারামাউত (حضر موت) এলাকায় বসবাস করত। তাদের প্রধান শহরের নাম ছিল ‘হিজর’ (حجر)। আরবের উত্তর-পশ্চিম এলাকায় শাম হ’তে মক্কার পথে অবস্থিত এই শহরকে এখন ‘মাদায়েনে ছালেহ’ (مدائن صالح) বলা হয় (তানতাভী)। সুলায়মান নাদভী ‘আরযুল কুরআনে’ বলেন যে, তাদের স্থাপত্যের নিদর্শনসমূহ আজও বিদ্যমান রয়েছে। এগুলোর গায়ে ইরামী ও ছামূদী বর্ণমালার শিলালিপি রয়েছে।[6]

তাবূক যুদ্ধে যাবার পথে মুসলিম বাহিনী যখন ‘হিজর’ এলাকা অতিক্রম করে, যা ছিল খায়বরের অদূরে ‘ওয়াদিল ক্বোরা’ (وادى القرى) এলাকায় অবস্থিত এবং এটাই ছিল ছামূদ জাতির গযবের এলাকা- তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, তোমরা গযবপ্রাপ্ত ছামূদ জাতির বাড়ী-ঘরে প্রবেশ করবে না। এখানকার কোন কূয়ার পানি পান করবে না। তোমরা কাঁদতে কাঁদতে মাথা নীচু করে দ্রুত এই স্থান ত্যাগ কর’ (সংক্ষেপায়িত : বুখারী হা/৪৩৩, ৪৪১৯)

(১০) وَفِرْعَوْنَ ذِي الْأَوْتَادِ ‘এবং ফেরাঊনের সাথে, যে ছিল বহু কীলকের অধিপতি’।

‘আওফী হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) হ’তে বর্ণনা করেন যে, এখানে ‘বহু কীলক’ অর্থ ‘বহু সৈন্য-সামন্ত’ যাদের মাধ্যমে ফেরাঊন তার শাসনকে মযবুত করেছিল (ইবনু কাছীর)। তবে শাব্দিক অর্থেও এটা হ’তে পারে। কেননা বলা হয়ে থাকে যে, ফেরাঊন মানুষের হাতে ও পায়ে লোহার কীলক মেরে নির্যাতন করত। ছাবেত আল-বুনানী হযরত আবু রাফে‘ হ’তে বর্ণনা করেন যে, ফেরাঊনকে ‘কীলকওয়ালা’ বলা হয় এ কারণে যে, সে তার স্ত্রী আসিয়ার হাতে-পায়ে চারটি কীলক মেরে তার পিঠের উপর দিয়ে বিশাল এক লোহার চাকি গড়িয়ে দেয়। যাতে তাঁর মৃত্যু হয় (ইবনু কাছীর)। উল্লেখ্য যে, হযরত মূসা (আঃ)-এর দাওয়াত কবুল করে আল্লাহর উপরে ঈমান আনার অপরাধে (?) ফেরাঊন তার স্ত্রী আসিয়া ও (পালিত) কন্যা মাশেত্বাহকে এভাবে নিষ্ঠুর পন্থায় হত্যা করেছিল (কুরতুবী)

(১১) الَّذِيْنَ طَغَوْا فِي الْبِلاَدِ ‘যারা দেশে সীমালংঘন করেছিল’। অর্থাৎ আদ, ছামূদ, ফেরাঊন এরা সবাই স্ব স্ব অঞ্চলের লোকদের উপরে যুলুম ও অত্যাচারে সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল।

(১২) فَأَكْثَرُوْا فِيْهَا الْفَسَادَ ‘অতঃপর সেখানে তারা বহু অনাচার করেছিল’। অর্থাৎ আদ, ছামূদ ও ফেরাঊন স্ব স্ব অঞ্চলে সীমাহীন অত্যাচার ও নির্যাতনের মাধ্যমে ব্যাপকভাবে সামাজিক অশান্তি ও বিশৃংখলা সৃষ্টি করেছিল।

(১৩) فَصَبَّ عَلَيْهِمْ رَبُّكَ سَوْطَ عَذَابٍ ‘ফলে তোমার পালনকর্তা তাদের উপরে শাস্তির কশাঘাত হানেন’।

صَبَّ অর্থ اَلْقَى ‘নিক্ষেপ করা’। سَاطَ يَسُوطُ سَوْطًا অর্থ ضرب بسوطه ‘চাবুক দিয়ে মারা’। কুরতুবী বলেন, سَوْطَ عَذَابٍ অর্থ نصيب عذاب ‘শাস্তির অংশ’। এর দ্বারা   শাস্তির কঠোরতা বুঝানো হয়েছে। কেননা السوط শব্দ দ্বারা আরবদের নিকটে কঠোরতম শাস্তিকে বুঝানো হয়। ফার্রা বলেন, আরবরা একথাটি সকল প্রকার কঠোরতম শাস্তির ক্ষেত্রে ব্যবহার করে থাকে। ক্বাতাদাহ বলেন, আল্লাহ প্রেরিত প্রতিটি শাস্তিই سوط عذاب বা শাস্তির কশাঘাত (কুরতুবী)

উক্ত তিনটি সম্প্রদায়ের উপরে ইতিহাসের কঠোরতম শাস্তিই নাযিল হয়েছিল। ‘আদ ও ছামূদ জাতি যেমন প্রবল ঝঞ্ঝাবায়ু এবং প্রচন্ড নিনাদসহ ভূমিকম্পে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল। ফেরাঊন তেমনি তার সৈন্য-সামন্ত ও লোক-লশকরসহ চোখের নিমিষে সাগরে ডুবে ধ্বংস হয়েছিল। অন্যদিকে মযলূম বনু ইসরাঈলগণ মূসা (আঃ)-এর নেতৃত্বে মুক্তি পেয়েছিল (বাক্বারাহ ২/৪৯-৫০; ইউনুস ১০/৯০-৯২)

আল্লাহ বলেন, أَفَلَمْ يَسِيرُوا فِي الْأَرْضِ فَيَنْظُرُوا كَيْفَ كَانَ عَاقِبَةُ الَّذِينَ مِنْ قَبْلِهِمْ دَمَّرَ اللهُ عَلَيْهِمْ وَلِلْكَافِرِينَ أَمْثَالُهَا- ذَلِكَ بِأَنَّ اللهَ مَوْلَى الَّذِينَ آمَنُوا وَأَنَّ الْكَافِرِينَ لاَ مَوْلَى لَهُمْ ‘তারা কি যমীনে ভ্রমণ করেনি এবং দেখেনি তাদের পূর্ববর্তীদের পরিণাম কি হয়েছিল? আল্লাহ তাদেরকে ধ্বংস করেছেন এবং অবিশ্বাসীদের জন্য রয়েছে অনুরূপ পরিণাম’। ‘এটা এজন্য যে, আল্লাহ বিশ্বাসীদের অভিভাবক। আর অবিশ্বাসীদের কোন অভিভাবক নেই’ (মুহাম্মাদ ৪৭/১০-১১)

(১৪) إِنَّ رَبَّكَ لَبِالْمِرْصَادِ ‘নিশ্চয় তোমার পালনকর্তা ঘাঁটিতে সদা সতর্ক থাকেন’। رَصَد يَرْصُد رَصَدًا ওঁৎ পেতে থাকা’। সেখান থেকে مَرصد مِرصاد অর্থ সদা সতর্ক দৃষ্টি রাখার ঘাঁটি যা সাধারণতঃ কোন উঁচু স্থানে স্থাপিত হয়ে থাকে’। আল্লাহপাক নিজেকে সেই ঘাঁটিতে অবস্থানকারী বলেছেন। এর দ্বারা তিনি বান্দাকে সাবধান করেছেন। হাসান বাছরী ও ইকরিমা বলেন, এর অর্থ يرصُدُ عَملَ كلِّ إنسان حتى يجازيه به ‘তিনি প্রতিটি মানুষের কাজের প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখেন, যাতে তাকে যথার্থ প্রতিদান ও প্রতিফল দিতে পারেন’ (কুরতুবী)

ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, এর অর্থ يَسْمَعُ وَيَرَى ‘তিনি শোনেন ও দেখেন’। অর্থাৎ আল্লাহ বান্দার সকল গোপন ও প্রকাশ্য কথা ও কাজ দেখেন ও শোনেন ও সে হিসাবে তার প্রতিফল দিয়ে থাকেন। ইমাম কুরতুবী জনৈক আরব থেকে বর্ণনা করেন, একবার তাকে বলা হ’ল أين ربك ‘তোমার প্রভু কোথায়?’ জওয়াবে তিনি বলেন,  لبالمرصاد ‘ঘাঁটিতে’। আমর ইবনু ওবায়েদ হ’তে বর্ণিত হয়েছে যে, একবার তিনি এই সূরাটি আববাসীয় খলীফা আবু জা‘ফর মানছূরের (১৩৬-১৫৭হিঃ/৭৫৪-৭৭৫ খৃঃ) সামনে পাঠ করেন। যখন তিনি এই আয়াতটি পাঠ করেন, তখন মানছূর বলে ওঠেন يا ابا جعفر ‘হে আবু জাফর’! যামাখশারী বলেন, মানছূরের এই চিৎকার ধ্বনির মধ্যে তীব্র ভয় প্রকাশ পায়। কেননা এর মধ্যে অহংকারী শাসকদের জন্য দারুণ ধমকি রয়েছে (কুরতুবী)। এযুগের শাসকরা কি এতে ভয় পাবেন?

(১৫-১৬) فَأَمَّا الْإِنْسَانُ إِذَا مَا ابْتَلاَهُ رَبُّهُ فَأَكْرَمَهُ وَنَعَّمَهُ فَيَقُوْلُ رَبِّيْ أَكْرَمَنِ، وَأَمَّا إِذَا مَا ابْتَلاَهُ فَقَدَرَ عَلَيْهِ رِزْقَهُ فَيَقُوْلُ رَبِّيْ أَهَانَنِ- ‘কিন্তু মানুষ এরূপ যে, যখন তার পালনকর্তা তাকে পরীক্ষা করেন, অতঃপর তাকে সম্মানিত করেন ও ধন-সম্পদ দান করেন, তখন সে বলে যে, আমার পালনকর্তা আমাকে সম্মানিত করেছেন’। ‘পক্ষান্তরে যখন তিনি তাকে পরীক্ষায় ফেলেন এবং তার উপরে তার রূযী সংকুচিত করেন, তখন সে বলে যে, আমার পালনকর্তা আমাকে হেয় করেছেন’।

পরপর বর্ণিত দু’টি আয়াতে একটি গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি বর্ণিত হয়েছে যে, দুনিয়াতে মানুষকে দেয়া সম্মান ও অসম্মান, সচ্ছলতা বা অসচ্ছলতা আল্লাহর নিকটে কারু প্রিয় বা অপ্রিয় হওয়ার নিদর্শন নয়। বরং সবকিছু হয়ে থাকে বান্দাকে পরীক্ষা করার জন্য আল্লাহর ফায়ছালা ও তাঁর পূর্ব নির্ধারণ (قضاء وقدر) অনুযায়ী। প্রকৃত মুমিন বান্দা সচ্ছল ও অসচ্ছল, কষ্ট ও আনন্দ উভয় অবস্থায় ছবর করে ও আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞ থাকে।

যেমন আল্লাহ বলেন, كُلُّ نَفْسٍ ذَائِقَةُ الْمَوْتِ وَنَبْلُوكُمْ بِالشَّرِّ وَالْخَيْرِ فِتْنَةً وَإِلَيْنَا تُرْجَعُوْنَ ‘প্রাণী মাত্রই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে। বস্ত্ততঃ আমরা তোমাদেরকে মন্দ ও ভাল দ্বারা বিশেষভাবে পরীক্ষা করে থাকি। আর আমাদের কাছেই তোমরা প্রত্যাবর্তিত হবে’ (আম্বিয়া ২১/৩৫)।  

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,عَجِبْتُ لِلْمُؤْمِنِ إِنْ أَصَابَهُ خَيْرٌ حَمِدَ اللهَ وَشَكَرَ وَإِنْ أَصَابَتْهُ مُصِيْبَةٌ حَمِدَ اللهَ وَصَبَرَ- ‘আমি আশ্চর্য হই মুমিনের উপর যখন তার কল্যাণ লাভ হয়, তখন সে আল্লাহর প্রশংসা করে ও শুকরিয়া আদায় করে। আবার যখন সে কষ্টে পতিত হয়, তখনও সে আল্লাহর প্রশংসা করে ও ছবর করে।[7] অন্য হাদীছে এসেছে, عَجَبًا لأَمْرِ الْمُؤْمِنِ إِنَّ أَمْرَهُ كُلَّهُ خَيْرٌ وَلَيْسَ ذَاكَ لأَحَدٍ إِلاَّ لِلْمُؤْمِنِ إِنْ أَصَابَتْهُ سَرَّاءُ شَكَرَ فَكَانَ خَيْرًا لَهُ وَإِنْ أَصَابَتْهُ ضَرَّاءُ صَبَرَ فَكَانَ خَيْرًا لَهُ- ‘মুমিনের ব্যাপারটাই আশ্চর্যজনক। তার সকল কাজই কল্যাণকর। মুমিন ছাড়া অন্যের ব্যাপারটা এরূপ নয়। তার জন্যে আননেদর কিছু ঘটলে সে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে। এতে তার মঙ্গল হয়। আবার ক্ষতিকর কিছু ঘটলে সে ধৈর্যধারণ করে। এটাও তার জন্য কল্যাণকর হয়’।[8] বরং এসবই আল্লাহর পরীক্ষা মাত্র। যেমন তিনি বলেন, الَّذِيْ خَلَقَ الْمَوْتَ وَالْحَيَاةَ لِيَبْلُوَكُمْ أَيُّكُمْ أَحْسَنُ عَمَلاً وَهُوَ الْعَزِيْزُ الْغَفُوْرُ- ‘তিনি সেই মহান সত্তা যিনি মরণ ও জীবন সৃষ্টি করেছেন কে তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম আমল করে সেটা পরীক্ষা করার জন্য। তিনি মহাপরাক্রান্ত ও ক্ষমাশীল’ (মুল্ক ৬৭/২)। অতএব ধনিক ও শাসকশ্রেণী যেন অহংকারে স্ফীত হয়ে একথা না ভাবে যে, এসবকিছুই তাদের প্রতি আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ মাত্র এবং তারা অবশ্যই আল্লাহর বিশেষ প্রিয়পাত্র। এদেরকে সাবধান করে আল্লাহ বলেন, أَيَحْسَبُوْنَ أَنَّمَا نُمِدُّهُم بِهِ مِن مَّالٍ وَبَنِيْنَ- نُسَارِعُ لَهُمْ فِي الْخَيْرَاتِ بَل لاَّ يَشْعُرُوْنَ- ‘তারা কি মনে করে যে, আমরা তাদেরকে ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি দিয়ে সাহায্য করছি’। ‘আর আমরা তাদের জন্য সর্বপ্রকার মঙ্গল ত্বরান্বিত করছি? বরং তারা (আসল তাৎপর্য) বুঝে না’ (মুমিনূন ২৩/৫৫-৫৬)

পক্ষান্তরে ঈমানদার বান্দাগণের উদ্দেশ্যে আল্লাহ বলেন, وَلَنَبْلُوَنَّكُمْ بِشَيْءٍ مِّنَ الْخَوفْ وَالْجُوْعِ وَنَقْصٍ مِّنَ الْأَمَوَالِ وَالْأَنْفُسِ وَالثَّمَرَاتِ وَبَشِّرِ الصَّابِرِيْنَ، الَّذِيْنَ إِذَا أَصَابَتْهُم مُّصِيْبَةٌ قَالُواْ إِنَّا ِللهِ وَإِنَّـا إِلَيْهِ رَاجِعوْنَ- ‘অবশ্যই আমরা তোমাদের পরীক্ষা করব কিছু কিছু ভয়, ক্ষুধা, মাল, জান ও ফল-ফসলের ক্ষতির মাধ্যমে। তবে তুমি সুসংবাদ দাও ধৈর্যশীলদের’। ‘যাদের উপর কোন বিপদ আপতিত হ’লে তারা বলে, নিশ্চয় আমরা সবাই আল্লাহর জন্য এবং আমরা সবাই তাঁরই নিকটে ফিরে যাব’ (বাক্বারাহ ২/১৫৫-৫৬)

অতএব দুনিয়াতে কাউকে সম্মানিত করার অর্থ আল্লাহর নিকটে তার সম্মানিত হওয়া নয় এবং দুনিয়ায় কাউকে অসম্মানিত করার অর্থ আল্লাহর নিকটে তার অসম্মানিত হওয়া নয়। বরং উভয় অবস্থায় আল্লাহর নিকটে সম্মানিত হওয়ার মানদন্ড হ’ল আল্লাহভীরুতা ও আল্লাহর প্রতি আনুগত্য (طاعة الله)। কখনো সম্মানিত কখনো অসম্মানিত করে, কখনো সচ্ছল কখনো অসচ্ছল করে আল্লাহ তার বান্দাকে পরীক্ষা করেন, সে সর্বাবস্থায় আল্লাহর আনুগত্যের উপরে টিকে থাকে কি-না। এক্ষণে পরীক্ষায় ভীত হয়ে যদি সে শয়তানের ফাঁদে পা না দেয় এবং সর্বাবস্থায় আল্লাহর আনুগত্যের প্রতি দৃঢ় থাকে, তবে তার সম্পর্কে আল্লাহর সুসংবাদ হ’ল,أُولَئِكَ عَلَيْهِمْ صَلَوَاتٌ مِنْ رَبِّهِمْ وَرَحْمَةٌ وَأُوْلَئِكَ هُمُ الْمُهْتَدُوْنَ ‘তারা হ’ল ঐ সকল ব্যক্তি যাদের প্রতি আল্লাহর অফুরন্ত আশীষ ও অনুগ্রহ রয়েছে এবং এরাই হ’ল সুপথপ্রাপ্ত’ (বাক্বারাহ ২/১৫৭)

(১৭) كَلاَّ بَلْ لاَّ تُكْرِمُوْنَ الْيَتِيْمَ ‘কখনোই এরূপ নয়’। ‘বরং তোমরা ইয়াতীমকে সম্মান কর না’। كَلاَّ শব্দটি كلمة ردع ‘প্রত্যাখ্যানকারী অব্যয়’।

সম্মানিত ও সচ্ছল ব্যক্তির নিজেকে আল্লাহর প্রিয়পাত্র ভাবা এবং অসম্মানিত ও অসচ্ছল ব্যক্তির নিজেকে আল্লাহর অপ্রিয় ভাবার বিষয়টিকে পরোপুরি প্রত্যাখ্যান করে আল্লাহ বলেন, كَلاَّ ‘কখনোই এরূপ নয়’। দু’টি ভাবনার কোনটাই সঠিক নয়। বরং উভয় অবস্থায় সঠিক মানদন্ড হ’ল আল্লাহর প্রতি আনুগত্যশীল থাকা। অপ্রতিদ্বন্দ্বী শাসক ও অপরিমেয় সম্পদের মালিক হয়েও কেবল আল্লাহর আনুগত্যশীল না হওয়ার কারণে অহংকারী ফেরাঊনের মর্মান্তিক পরিণতি ঘটেছে এবং দুনিয়া ও আখেরাতে অভিশপ্ত হয়েছে। পক্ষান্তরে তারই স্ত্রী আসিয়া তার হাতে মর্মান্তিক নির্যাতনে মৃত্যুবরণ করেও এবং তারই ঘরে লালিত-পালিত মূসা তার কারণে দেশান্তরী হয়েও দুনিয়া ও আখেরাতে মহা সম্মানিত হয়েছেন। অতএব সম্মান ও অসম্মানের মাপকাঠি হ’ল আল্লাহর আনুগত্য। লোকেরা যা ভেবেছে, তা নয়।

হাদীছের প্রথমাংশ যঈফ (যঈফাহ হা/১৬৭৩)।

 
মানুষের উক্ত ভুল চিন্তাধারাকে প্রত্যাখ্যান করার পর এক্ষণে আল্লাহ অকৃতজ্ঞ লোকদের চারটি বদভ্যাসের কথা উল্লেখ করছেন। যার প্রথমটি হ’ল এই যে, তারা ইয়াতীমকে সম্মান করে না। পিতৃহীন অথবা পিতৃমাতৃহীন শিশুকে ‘ইয়াতীম’ বলা হয়। তাদেরকে সম্মান না করাটা হ’ল কাফের ও অকৃতজ্ঞ মানুষের লক্ষণ। এখানে ‘সম্মান করা’ কথাটি বলার মাধ্যমে ইয়াতীমের যথাযথ হক আদায় করা ও তার প্রাপ্য অধিকার বুঝে দেওয়ার প্রতি ইয়াতীমের অভিভাবক এবং সমাজের প্রতি যেমন নির্দেশ রয়েছে, তেমনি নিজের সন্তানের চাইতে ইয়াতীম সন্তানের প্রতি যেন কোনরূপ হীন আচরণ না করা হয়, তার প্রতিও কঠোর নির্দেশ রয়েছে। আল্লাহর প্রকৃত মুমিন বান্দা সর্বদা ইয়াতীমকে সম্মান ও মর্যাদা দিয়ে থাকে। বিশ্বের সেরা ইয়াতীম ও সেরা মানুষ, সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, خَيْرُ بَيْتٍ فِى الْمُسْلِمِينَ بَيْتٌ فِيهِ يَتِيمٌ يُحْسَنُ إِلَيْهِ وَشَرُّ بَيْتٍ فِى الْمُسْلِمِينَ بَيْتٌ فِيهِ يَتِيمٌ يُسَاءُ إِلَيْهِ، ثُمَّ قَالَ أَنَا وَكَافِلُ الْيَتِيْمِ كَهَاتَيْنِ فِى الْجَنَّةِ، وَقَرَنَ بَيْنَ إِصْبَعَيْهِ الْوُسْطَى وَالَّتِى تَلِى الإِبْهَامَ- ‘শ্রেষ্ঠ মুসলিম গৃহ হ’ল সেটি, যেখানে একজন ইয়াতীম রয়েছে এবং যার প্রতি সুন্দর ব্যবহার করা হয়। পক্ষান্তরে নিকৃষ্ট মুসলিম গৃহ সেটি, যেখানে একজন ইয়াতীম রয়েছে। কিন্তু তার প্রতি মন্দ আচরণ করা হয়। এরপর তিনি বলেন, আমি ও ইয়াতীমের অভিভাবক জান্নাতে এইরূপ পাশাপাশি থাকব’- একথা বলার সময় তিনি শাহাদাত ও মধ্যমা আঙ্গুলী দু’টি মিলিত করেন’।[9] মুক্বাতিল বলেন, আয়াতটি উমাইয়া বিন খালাফের কাছে পালিত ইয়াতীম শিশু কুদামা বিন মায‘ঊন সম্পর্কে নাযিল হয়’ (কুরতুবী)। তবে মর্মার্থ সকলের জন্য। অন্য বর্ণনায় এসেছে, রাসূল (ছাঃ) বলেন,أَنَا وَكَافِلُ الْيَتِيْمِ لَهُ وَلِغَيْرِهِ فِي الْجَنَّةِ كَهَاتَيْنِ وَأَشَارَ بِالسَّبَّابَةِ وَالْوُسْطَى ‘আমি ও ইয়াতীমের অভিভাবক, নিজের বা অন্যের, জান্নাতে এইরূপ একসাথে থাকব’ -একথা বলে তিনি মধ্যমা ও শাহাদাত অঙ্গুলী দু’টি দিয়ে ইশারা করেন’।[10]

(১৮) وَلاَ تَحَاضُّوْنَ عَلَى طَعَامِ الْمِسْكِيْنِ ‘এবং মিসকীনকে অন্নদানে পরস্পরকে উৎসাহিত করে না।’

এটা হ’ল কাফেরদের দ্বিতীয় বদভ্যাস। তারা নিজেরা তো মিসকীনদের খাদ্য দান করে না। এমনকি অন্যকেও এ ব্যাপারে উৎসাহিত করে না। এর মধ্যে ধনীদের প্রতি যেমন দান করার নির্দেশ রয়েছে, তেমনি যারা দান করার সামর্থ্য রাখে না তাদের প্রতিও নির্দেশ রয়েছে, যেন তারা সক্ষম ব্যক্তিদেরকে এব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করে।

(১৯) وَتَأْكُلُوْنَ التُّرَاثَ أَكْلاً لَّماًَّ ‘আর তোমরা মৃত ব্যক্তির পরিত্যক্ত সম্পদ যথেচ্ছভাবে ভক্ষণ করে থাক’।

التُّرَاثٌ অর্থ ما يورثه الله العبد من المال ‘আল্লাহ স্বীয় বান্দাকে যেসব ধন-সম্পদের অধিকারী করেন’। কুরতুবী এখানে تُرَاثٌ বলতে ميراث اليتامى ‘ইয়াতীমের মীরাছ’ বুঝিয়েছেন। تُرَاثٌ আসলে ছিল وُرَاثٌ। যেমন وَرِثَ يَرِثُ وَرْثًا وَتُرَاثًا। পরে واو -কে تاء দ্বারা বদল করা হয়েছে। যেমন ةجاه، ةقاة ইত্যাদি (কুরতুবী)। তবে আয়াতের বক্তব্য সকল প্রকার মীরাছকে শামিল করে। যা মানুষ প্রাপ্ত হয় মৃতের উত্তরাধিকার হিসাবে কিংবা নিজের ও অন্যের যেকোন উপার্জন হ’তে। মন্দ লোকেরা তাদের আয়-উপার্জনে হালাল-হারাম বিচার করে না। অত্র আয়াতে তাদের ধিক্কার দেওয়া হয়েছে।

এটি হ’ল কাফিরদের তৃতীয় বদভ্যাস। তারা তাদের বাপ-দাদাদের রেখে যাওয়া সম্পদ-সম্পত্তিতে হালাল-হারাম বাছ-বিচার না করে দু’হাতে ভোগদখল করে। দুর্বল ওয়ারিছদের তারা সাধ্যমত বঞ্চিত করে। ইবনু যায়েদ বলেন, আরবরা নারী ও শিশুদের সম্পত্তির উত্তরাধিকার দিত না (ক্বাসেমী)। কারণ তারা যুদ্ধ করতে পারত না এবং যুদ্ধে পরাজিত হ’লে তারা বিজয়ীদের দখলে চলে যেত।

বস্ত্ততঃ দুর্বল শরীককে ফাঁকি দেওয়ার এ বদভ্যাস কেবল সে যুগের কাফিরদের মধ্যে ছিল না, এযুগের কাফের ও মুসলমান ফাসেকদের মধ্যেও ব্যাপকভাবে দেখা যায়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, مَنْ أَخَذَ شِبْرًا مِنَ الأَرْضِ ظُلْمًا فَإِنَّهُ يُطَوَّقُهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ مِنْ سَبْعِ أَرَضِيْنَ ‘যে ব্যক্তি কারু এক বিঘত যমীন অন্যায়ভাবে ভোগ-দখল করে, ক্বিয়ামতের দিন তাকে সাত তবক যমীনের বেড়ী পরানো হবে’।[11]

অন্য বর্ণনায় এসেছে, مَنْ أَخَذَ أَرْضاً بِغَيْرِ حَقِّهَا كُلِّفَ أَنْ يَحْمِلَ تُرَابَهَا إِلَى الْمَحْشَرِ ‘যে ব্যক্তি অন্যায়ভাবে কোন জমি দখল করল, তাকে ক্বিয়ামতের দিন ঐ মাটির বোঝা বহন করে চলতে বাধ্য করা হবে’।[12] অতঃপর এই মীরাছ যদি ইয়াতীমের হয়, তাহ’লে তার অন্যায় ভোগ-দখল হবে আরো বেশী মারাত্মক।

أَكْلاً لَّمَّا অর্থ সুদ্দী বলেন, أكلاً شديدًا ‘দারুণভাবে ভোগ দখল করা’। ইবনু কাছীর বলেন, من أى جهة حصل لهم من حلال أو حرام. ‘হারাম-হালাল যেকোন পন্থায় হৌক হাছিল করা’। বকর বিন আব্দুল্লাহ বলেন, اللَّمُّ অর্থ الاعتداء فى الميراث ، يأكل ميراثه وميراث غيره ‘মীরাছ ভোগ-দখলে বাড়াবাড়ি করা। সে নিজের অংশটাও খায়, অন্যের অংশটাও খায়’ (ক্বাসেমী)। আসলে لَمَّ يَلُمُّ لَمًّا অর্থ جمع জমা করা। আরবদের পরিভাষায় لممتَ الطعامَ لَمًّا إذا اكلتَه جمعًا ‘তুমি খাদ্য পুরোপুরি খেয়েছ তখনই বলা হয়, যখন তুমি সবটুকু খেয়ে ফেল’ (কুরতুবী)। এখানে অর্থ, কোনরূপ বাছ-বিচার না করে দু’হাতে শরীকের মাল লোপাট করা।

(২০) وَتُحِبُّوْنَ الْمَالَ حُبًّا جَمًّا ‘এবং তোমরা ধন-সম্পদকে অত্যধিক ভালবাস’।

কাফেরদের ৪র্থ বদভ্যাস হ’ল সীমাহীন ধনলিপ্সা। তারা যত পায়, তত চায়। তাদের চাহিদার শেষ থাকে না। হাদীছে এসেছে, কাফের সাত পেটে খায়, মুমিন এক পেটে খায়।[13] এতে ইঙ্গিত রয়েছে তাদের অত্যধিক দুনিয়াপূজা ও ধনলিপ্সার প্রতি। অন্য হাদীছে এসেছে, لَوْ كَانَ لاِبْنِ آدَمَ وَادِيَانِ مِنْ مَالٍ لاَبْتَغَى ثَالِثًا، وَلاَ يَمْلأُ جَوْفَ ابْنِ آدَمَ إِلاَّ التُّرَابُ، وَيَتُوْبُ اللهُ عَلَى مَنْ تَابَ ‘আদম-সন্তান যদি দুই ময়দান ভর্তি সম্পদ পায়, সে তৃতীয় আরেক ময়দান চাইবে। মুখে মাটি ভরা (অর্থাৎ কবরে যাওয়া) ব্যতীত তার চাহিদা শেষ হবে না। আর আল্লাহ তাকে ক্ষমা করেন যে তওবা করে’।[14] বস্ত্ততঃ আখেরাতভোলা মানুষ যেই-ই হৌক না কেন ধনলিপ্সার আগুন তাকে জ্বালিয়ে নিঃশেষ করে দেবে। সে কিছুতেই শান্তি ও স্বস্তি পাবে না। কেবল আল্লাহভীতি ও আখেরাতে জবাবদিহিতার অনুভূতি এবং জান্নাত লাভের আকাংখা মানুষকে ধনলিপ্সার বাড়াবাড়ি থেকে মুক্তি দিতে পারে। অবিশ্বাসী ও বস্ত্তবাদীদের মধ্যে এই লিপ্সা সীমাহীন হওয়াটাই স্বাভাবিক।

جَمَّ يَجُمُّ جُمُوْماً وجَمًّا অর্থ সঞ্চিত হওয়া, বৃদ্ধি পাওয়া। এখানে অর্থ চূড়ান্ত কৃপণ ও ধনলিপ্সু হওয়া।

(২১) كَلاَّ إِذَا دُكَّتِ الْأَرْضُ دَكًّا دَكًّا ‘কখনই না। যেদিন পৃথিবী চূর্ণ-বিচূর্ণ হবে’।

পূর্বে বর্ণিত চারটি মন্দ অভ্যাসের নিন্দা করে বলা হয়েছে যে, এগুলি কখনই ঠিক নয়। কেননা ইয়াতীমকে সম্মান না করা, মিসকীনকে অন্নদান না করা, অন্যের হক না দিয়ে ওয়ারিছী সম্পত্তি যথেচ্ছভাবে ভক্ষণ করা ও অত্যধিক ধনলিপ্সার লজ্জাকর পরিণতি হবে সেদিন, যেদিন পৃথিবী চূর্ণ-বিচূর্ণ হবে। অর্থাৎ যেদিন ক্বিয়ামত সংঘটিত হবে।

دَكَّ يَدُكُّ دَكًّا অর্থ চূর্ণ-বিচূর্ণ হওয়া, ভেঙ্গে-চুরে সমান হওয়া। دُكَّ الشيئُ إِذَا هُدِمَ ‘বিধ্বস্ত হওয়া’ (কুরতুবী)। ইবনু কাছীর বলেন, ঘর-বাড়ি-পাহাড় ভেঙ্গে-চুরে একাকার হয়ে পৃথিবী সমতল হয়ে যাবে এবং প্রাণীকুল সব স্ব স্ব কবর থেকে উঠে স্বীয় পালনকর্তার দিকে সমবেত হবে’। যেমন অন্য আয়াতে বর্ণিত হয়েছে, يَوْمَ تُبَدَّلُ الْأَرْضُ غَيْرَ الْأَرْضِ وَالسَّمَاوَاتُ وَبَرَزُوا لِلَّهِ الْوَاحِدِ الْقَهَّارِ ‘যেদিন এই পৃথিবী পরিবর্তিত হয়ে অন্য পৃথিবী হয়ে যাবে এবং আকাশমন্ডলীও। আর সকলে উপস্থিত হবে আল্লাহর সম্মুখে, যিনি এক ও পরাক্রান্ত’ (ইবরাহীম ১৪/৪৮)

কুরতুবী বলেন,دَكًّا دَكًّا  অর্থ مرة بعد مرة ‘একের পর এক কম্পন আসা ও সবকিছু সমান করে ফেলা’। دكًا بعد دكٍ حتى عادت هباءً منثورًا ‘এক ধাক্কার পর আরেক ধাক্কা। অতঃপর তা বিক্ষিপ্ত ধূলি-কণায় পরিণত হবে’ (ক্বাসেমী)। বাংলায় যে আমরা ‘ধাক্কা’ বলি, তারও উৎস এখানে। অতএব যখনই আমরা কাউকে অন্যায়ভাবে দেহে ধাক্কা মারি বা অন্তরে আঘাত দেই, তখন যেন ক্বিয়ামতের দিনের চূড়ান্ত ধাক্কার কথা স্মরণ করি।

(২২) وَجَآءَ رَبُّكَ وَالْمَلَكُ صَفاًّ صَفاًّ ‘এবং তোমার পালনকর্তা আসবেন ও ফেরেশতামন্ডলী সারিবদ্ধভাবে থাকবে’।  

ইবনু কাছীর বলেন, মানবজাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান হযরত মুহাম্মাদ (ছাঃ) কর্তৃক মাক্বামে মাহমূদে প্রথম শাফা‘আত (الشفاعة العظمى) কবুল হবার পর সৃষ্টিকুলের ব্যাপারে চূড়ান্ত বিচার ও ফায়ছালা দেওয়ার জন্য আল্লাহপাক যেভাবে ইচ্ছা আগমন করবেন। এসময় ফেরেশতাকুল সারিবদ্ধভাবে দন্ডায়মান থাকবে’ (ইবনু কাছীর)

‘আল্লাহ কিভাবে আগমন করবেন, তার প্রকৃতি কেমন হবে। এজন্য আরশ খালি হয়ে যাবে কি-না ইত্যাদি বিষয় তিনি ব্যতীত কেউ জানে না’। কেননা لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ وَهُوَ السَّمِيْعُ الْبَصِيْرُ ‘তাঁর তুলনীয় কিছুই নেই, তিনি সবকিছু শোনেন ও দেখেন’ (শূরা ৪২/১১)। বস্ত্ততঃ আল্লাহর আগমন, প্রতি রাতের তৃতীয় প্রহরে নিম্ন আকাশে অবতরণ[15] ইত্যাদি সেভাবেই হবে, যেভাবে তিনি চান এবং যা তাঁর মর্যাদার উপযুক্ত (ما يليق بشأنه)। ইবনু আববাস, আবু হুরায়রা (রাঃ), যাহহাক প্রমুখ হ’তে এরূপ ব্যাখ্যা এসেছে। যারা এতে অবিশ্বাস করে, তাদের উদ্দেশ্যে আল্লাহ বলেন, هَلْ يَنْظُرُوْنَ إِلاَّ أَنْ يَأْتِيَهُمُ اللهُ فِيْ ظُلَلٍ مِنَ الْغَمَامِ وَالْمَلاَئِكَةُ وَقُضِيَ الْأَمْرُ وَإِلَى اللهِ تُرْجَعُ الْأُمُوْرُ ‘তারা কি কেবল (সেদিনের) অপেক্ষাই করছে যে, আল্লাহ সাদা মেঘমালার ছায়াতলে তাদের নিকট আগমন করবেন, আর ফেরেশতারাও আসবে এবং সমস্ত কাজের নিষ্পত্তি করা হবে। বস্ত্ততঃ আল্লাহর নিকটেই সমস্ত কার্য প্রত্যাবর্তিত হয়ে থাকে’ (বাক্বারাহ ২/২১০; ক্বাসেমী)

উক্ত বিষয়ে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত আহলেহাদীছের স্পষ্ট আক্বীদা এই যে, এ সকল গায়েবী বিষয়ের খবর পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছসমূহে যেভাবে বর্ণিত হয়েছে, সেভাবেই প্রকাশ্য অর্থে গ্রহণ করতে হবে ও সেভাবেই বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে। এসব ব্যাপারে কোনরূপ কল্পনার আশ্রয় নেওয়া যাবে না। এগুলি হবে সেভাবে যা তাঁর মর্যাদার উপযুক্ত। যা কোন সৃষ্টির সাথে তুলনীয় নয় এবং যা মানুষের লৌকিক জ্ঞানের অতীত।

নির্গুণবাদী মু‘তাযেলী মুফাসসিরগণ ও তাদের অনুসারীগণ এসব আয়াতের ব্যাখ্যায় দূরবর্তী কল্পনার আশ্রয় নিয়েছেন। যেমন অত্র আয়াতের তাফসীরে তাদের কেউ বলেছেন, أى جاء أمره وقضاؤه ‘আল্লাহ আসবেন’ অর্থ ‘তাঁর হুকুম ও ফায়ছালা আসবে’। কেউ বলেছেন, ظهرت قدرته واستولَّت ‘তাঁর শক্তি প্রকাশিত হবে এবং তা সবকিছু অধিকার করে নেবে’। কেউ অর্থ করেছেন, وجاء ربك أى زالت الشُّبَهُ ذلك اليوم ‘ঐদিন আল্লাহ সম্পর্কে সকল সন্দেহ দূরীভূত হবে’ (কুরতুবী)। এধরনের নানা ব্যাখ্যা তারা দিয়েছেন। কিন্তু কোন ব্যাখ্যায় তারা একমত হ’তে পারেননি। কুরতুবী অত্র আয়াতের তাফসীরে এসব উদ্ধৃত করেছেন। অথচ এর বিপরীতে কিছু না বলায় মনে হয় তিনি নিজেও মু‘তাযেলী যুক্তিবাদের বেড়াজালে আটকে গিয়েছেন। যেমন সূরা মুত্বাফফেফীন ১৫ আয়াতের ব্যাখ্যায় তিনি ভ্রান্তিতে পতিত হয়েছেন।[16] অথচ নিয়ম (قاعدة) হ’ল এই যে, كل ما أسنده الله الى نفسه فهو له لا لغيره ‘যে বিষয়টি আল্লাহ নিজের দিকে সম্বন্ধ করেন, সেটি কেবল তাঁরই, অন্যের জন্য নয়’। অত্র আয়াতে ‘আগমন’-এর বিয়ষটি আল্লাহ নিজের দিকে সম্বন্ধ করেছেন। অতএব তিনি কিভাবে আসবেন, সেটা একান্তই তাঁর ব্যাপার। এখানে কল্পনার কোন অবকাশ নেই। অথচ উক্ত মুফাসসিরগণ বিনা দলীলে প্রকাশ্য অর্থ থেকে বেরিয়ে গিয়েছেন ও কল্পনার ফাঁদে আটকে গিয়েছেন। তিনি সেদিন কিভাবে আসবেন, এধরনের প্রশ্ন করাটাও বিদ‘আত ও আল্লাহর প্রতি আদবের খেলাফ।

(২৩) وَجِيءَ يَوْمَئِذٍ بِجَهَنَّمَ يَوْمَئِذٍ يَّتَذَكَّرُ الْإِنْسَانُ وَأَنَّى لَهُ الذِّكْرَى ‘এবং যেদিন জাহান্নামকে আনা হবে, সেদিন মানুষ (তার কৃতকর্ম) স্মরণ করবে। কিন্তু তখন এই স্মৃতিচারণ তার কি কাজে আসবে’?

অন্যত্র আল্লাহ বলেন, وَبُرِّزَتِ الْجَحِيمُ لِمَن يَّرَى ‘জাহান্নামকে সেদিন দর্শকদের জন্য উন্মুক্ত করা হবে’ (নাযে‘আত ৭৯/৩৬)। বস্ত্ততঃ জাহান্নামকে সবাই দেখবে এবং জাহান্নাম পেরিয়েই জান্নাতে যেতে হবে। আল্লাহ বলেন, وَإِنْ مِنْكُمْ إِلاَّ وَارِدُهَا كَانَ عَلَى رَبِّكَ حَتْمًا مَقْضِيًّا ‘তোমাদের প্রত্যেকেই ওটা (পুলছিরাত) অতিক্রম করবে। এটা তোমার প্রতিপালকের অমোঘ সিদ্ধান্ত’ (মারিয়াম ১৯/৭১)। জানণাতীরা চোখের পলকে পার হয়ে যাবে। কিন্তু জাহান্নামীরা পড়ে যাবে।

ক্বিয়ামতের দিন জাহান্নামের ভয়ংকর রূপ দেখে পাপীদের অন্তরাত্মা কেঁপে উঠবে এবং তারা তাদের বিগত জীবনের পাপসমূহের কথা স্মরণ করবে ও হায় হায় করতে থাকবে। কিন্তু তখন এই বিলাপে কোন কাজ হবে না। আগামীতে যেটা হবে, সেটা আগেই আল্লাহ জানিয়ে দিচ্ছেন, যাতে পাপীরা মৃত্যুর আগেই পাপ থেকে ফিরে আসে ও তওবা করে আল্লাহর নিকটে ক্ষমা চায়।

جِيْءَ মাজহূলের ছীগাহ আনা হয়েছে। যার অর্থ ‘আনা হবে’। এতে বুঝা যায়, জাহান্নাম আগে থেকেই সৃষ্ট ছিল এবং সেদিন তার সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর হুকুমেই তাকে আনা হবে। সে নিজে আসবে না এবং সে ক্ষমতাও তার হবে না। এক্ষণে কিভাবে ঐদিন জাহান্নামকে আনা হবে, সে বিষয়ে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বর্ণিত হাদীছে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন,يُؤْتَى بِجَهَنَّمَ يَوْمَئِذٍ لَهَا سَبْعُوْنَ أَلْفَ زِمَامٍ مَعَ كُلِّ زِمَامٍ سَبْعُوْنَ أَلْفَ مَلَكٍ يَجُرُّوْنَهَا- ‘জাহান্নামকে সত্তর হাযার লাগামে বেঁধে আনা হবে। প্রতিটি লাগামে সত্তর হাযার ফেরেশতা থাকবে। যারা ওটাকে টেনে আনবে’।[17]

এই ফেরেশতারা কেমন হবে? আল্লাহ বলেন, عَلَيْهَا مَلاَئِكَةٌ غِلاَظٌ شِدَادٌ لاَ يَعْصُونَ اللهَ مَا أَمَرَهُمْ وَيَفْعَلُونَ مَا يُؤْمَرُونَ ‘যাতে নিয়োজিত আছে নির্মম হৃদয় ও কঠোর স্বভাবের ফেরেশতাগণ, যারা অমান্য করে না আল্লাহ যা তাদের আদেশ করেন এবং তারা তাই করে যা করতে তারা আদিষ্ট হয়’ (তাহরীম ৬৬/৬)

এক্ষণে এই টেনে আনার প্রকৃতি কেমন হবে, সে বিষয়ে মাথা ঘামাবার কোন প্রয়োজন আমাদের নেই। যদি বলা হয়, কোটি কোটি টন বজ্র-বিদ্যুৎ আর লক্ষ কোটি গ্যালন পানিভরা মেঘ কে কিভাবে লাগাম ধরে টেনে এনে আপনার ফসলের ক্ষেতে বর্ষণ করে? এর জওয়াব দিতে পারবেন কি? দুনিয়াতেই আমাদের চোখের সামনে প্রতিনিয়ত যদি এটা সম্ভব হয়, তাহ’লে আখেরাতে এটা কি আরও সহজ নয়? মহাশক্তিধর আল্লাহর জন্য সবই করা সম্ভব। অতএব আল্লাহ ও রাসূলের দেওয়া এসব গায়েবী খবরে কেবল বিশ্বাস করে যেতে হবে। সবকিছু চর্মচক্ষুতে দেখে বিশ্বাস করার হঠকারী দাবী অভিশপ্ত ইহুদীদের স্বভাব। কেননা তারা আল্লাহকে সশরীরে প্রকাশ্যে সামনে দেখতে চেয়ে গযবপ্রাপ্ত হয়েছিল (বাক্বারাহ ২/৫৫)। অথচ মুত্তাক্বীদের ৬টি গুণের প্রধান গুণ হ’ল, গায়েবে বিশ্বাস (বাক্বারাহ ২/৩)

يَوْمَئِذٍ يَّتَذَكَّرُ الْاِنْسَانُ অর্থাৎ যেদিন অবিশ্বাসী মানুষ তার ফেলে আসা জীবনের কৃতকর্ম সমূহ স্মরণ করবে এবং স্বীয় অবিশ্বাস ও পাপকর্মের জন্য অনুশোচনা করবে।

وَأَنَّى لَهُ الذِكْرَى অর্থাৎ তাদের এই স্মৃতিচারণ কিভাবে তাদের উপকারে আসবে? কেননা কর্মক্ষেত্র ছিল দুনিয়ায়। আর আখেরাত তো কর্মফল লাভের ক্ষেত্র। অতএব সেখানে অনুতাপ-অনুশোচনায় কোন কাজ হবে না।

আল্লাহ বলেন, قُلْ يَوْمَ الْفَتْحِ لاَ يَنْفَعُ الَّذِينَ كَفَرُوا إِيْمَانُهُمْ وَلاَ هُمْ يُنْظَرُونَ ‘তুমি বল, বিচার দিবসে অবিশ্বাসীদের বিশ্বাস আনয়ন তাদের কোন কাজে আসবে না এবং তাদের কোন অবকাশ দেয়া হবে না’ (সাজদাহ ৩২/২৯)

আরবদের লিখনরীতি :

(১) আয়াতের শুরুতে جِآىءَ (জীআ) যেভাবে লিখিত হয়েছে, তাতে হরকত না থাকলে ‘জাআ’ পড়াটাই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু এটাই রীতি হয়ে আছে।

(২) যেমন সূরা নমলের ২১ আয়াতটির একটি শব্দ লিখিত হয়েছে أَوْ لَأَاذْبَحَنَّهُ ‘অথবা আমি তাকে অবশ্যই যবহ করব’ (নমল ২৭/২১)। এখানে ‘হামযাহ’ ও ‘যাল’-এর মাঝখানে একটি ‘আলিফ’ রয়েছে। যেটি অতিরিক্ত। সাধারণভাবে পড়লে لا أذبحنه পড়তে হয়। যার অর্থ হবে ‘আমি তাকে যবহ করব না’। ফলে অর্থ সম্পূর্ণ বিপরীত হয়ে যাবে। অথচ এভাবে লেখাই রীতি।

(৩) সূরা কাহফের ৯৭ আয়াতে এসেছে, فَمَا اسْطَاعُوْا أَنْ يَظْهَرُوْهُ وَمَا اسْتَطَاعُوْا لَهُ نَقْبًا ‘ফলে ইয়াজূজ-মাজূজ তা অতিক্রম করতে পারল না এবং ভেদ করতেও সক্ষম হলো না’ (কাহফ ১৮/৯৭)। এখানে প্রথমটি فَمَا اسْطَاعُوْا লেখা হয়েছে। অথচ ছরফের নিয়মানুযায়ী হওয়া উচিৎ ছিল فَمَا اسْتَطَاعُوْا কিন্তু সেটা হয়নি। অতএব এখানে এটাই রীতি।

(৪) অমনিভাবে اَكْرَمَنِ وَأَهَانَنِ -এর (ফজর ১৫, ১৬) শেষে نِىْ -এর বদলে نِ লেখাই রীতি। অতএব কুরআনের ব্যাখ্যা জানার আগে আরবদের লিখন রীতি ও উচ্চারণ পদ্ধতির জ্ঞান অর্জন করা আবশ্যক। ইমাম কুরতুবী বলেন, والسنة ألا يخالف خط المصحف لأنه إجماع الصحابة ‘সুনণাত হ’ল কুরআনের লিখন রীতির কোনরূপ পরিবর্তন না করা। কেননা এটা হ’ল ছাহাবায়ে কেরামের ইজমা অর্থাৎ সর্বসম্মত রীতি’ (কুরতুবী, তাফসীর সূরা ফজর ১৫-১৬)

(২৪) يَقُوْلُ يَا لَيْتَنِيْ قَدَّمْتُ لِحَيَاتِيْ ‘সেদিন মানুষ বলবে, হায়! যদি আমার এই জীবনের জন্য অগ্রিম কিছু (নেক আমল) পাঠিয়ে দিতাম’!

এই সময় কাফের ও পাপী মানুষ কেবলই অনুতাপ করবে, আর বলবে হায়! দুনিয়ায় থাকতে যদি দৃঢ় বিশ্বাস করতাম ও সে অনুযায়ী নেক আমল করতাম, তাহ’লে আজ তার সুফল পেতাম। উল্লেখ্য যে, অবিশ্বাসী কাফেরও দুনিয়াতে অনেক সময় সৎকর্ম করে থাকে। কিন্তু তা আল্লাহর কাছে গৃহীত হবে না। কারণ সে তো আল্লাহকেই বিশ্বাস করত না। তাঁর রাসূলকে বিশ্বাস করতো না। তাঁর প্রেরিত ইসলাম অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করত না। অতএব সে কিভাবে আল্লাহর রহমত পেতে পারে? ফলে অবিশ্বাসী হওয়ার কারণে তার কোন সৎকর্ম ঐদিন কবুল করা হবে না’ (তওবা ৯/১৭; কাহফ ১৮/১০৩-১০৫)। যেমন পিতাকে অস্বীকারকারী পুত্রের কোন সৎকর্ম পিতার নিকটে গৃহীত হয় না।

(২৫) فَيَوْمَئِذٍ لاَّ يُعَذِّبُ عَذَابَهُ أَحَدٌ ‘অতঃপর সেদিন আল্লাহর শাস্তির ন্যায় শাস্তি কেউ দিবে না’। অর্থাৎ ক্বিয়ামতের দিন অবাধ্যদের শাস্তি আল্লাহ যেভাবে দিবেন, তার চাইতে কঠিনভাবে শাস্তি দেওয়ার ক্ষমতা কারু নেই। কেননা দুনিয়ার যেকোন কঠোরতম শাস্তি আখেরাতের শাস্তির তুলনায় কিছুই নয়। এখানে عذاب অর্থ تعذيب ‘কঠিনভাবে শাস্তি দেওয়া’। যেমন আল্লাহ অন্যত্র বলেন, نَبِّئْ عِبَادِي أَنِّي أَنَا الْغَفُوْرُ الرَّحِيْمُ، وَأَنَّ عَذَابِيْ هُوَ الْعَذَابُ الْأَلِيْمُ ‘আমার বান্দাদের সংবাদ দাও যে, নিশ্চয়ই আমি ক্ষমাশীল ও দয়াবান’। ‘এবং আমার শাস্তিও অতীব যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি’ (হিজর ১৫/৪৯-৫০)

(২৬) وَلاَ يُوْثِقُ وَثَاقَهُ أَحَدٌ ‘এবং তাঁর বাঁধনের চাইতে শক্ত বাঁধন কেউ দিবে না’। অর্থাৎ কাফের, ফাসেক, অত্যাচারী ও পাপীদের লৌহ-শৃংখলে কঠিনভাবে বেঁধে যে শাস্তি দেওয়া হবে, অতঃপর জাহান্নামের অগ্নিকুন্ডে নিক্ষেপ করা হবে, সে শাস্তির কোন তুলনা নেই। দুনিয়ার কঠিন বাঁধন ক্বিয়ামতের দিনের ঐ শক্ত বাঁধনের শাস্তির তুলনায় কিছুই নয়। এখানে وَثَاقٌ অর্থ إِيْثَاقٌ ‘কঠিনভাবে বাঁধা’।

(২৭) يَا أَيَّتُهَا النَّفْسُ الْمُطْمَئِنَّةُ ‘হে প্রশান্ত আত্মা’।

الْمُطْمَئِنَّةُ অর্থ الآمنة ‘শান্ত’। যে অন্তর কোন ভীতি বা দুঃখে দিশাহারা হয় না। বরং আল্লাহকে স্মরণ করে সর্বদা স্থির, প্রশান্ত ও দৃঢ়চিত্ত থাকে।

পূর্বের আয়াতগুলিতে (২৩-২৬) অবিশ্বাসী কাফের-মুনাফিকদের কঠিন শাস্তির বর্ণনা শেষে এবার (২৭-৩০ আয়াতে) প্রকৃত বিশ্বাসী মুমিন নর-নারীদের অবস্থা সম্পর্কে বলা হয়েছে। এখানে মুমিনদের হৃদয়কে ‘নফ্সে মুত্বমাইন্নাহ’ বা প্রশান্ত আত্মা বলে সম্বোধন করা হয়েছে। কারণ অবিশ্বাসীরা যতই দুনিয়াবী ভোগ-বিলাস ও বিত্ত-বৈভবের মধ্যে জীবন যাপন করুক না কেন, তারা হৃদয়ের প্রশান্তি হ’তে বঞ্চিত থাকে। পক্ষান্তরে প্রকৃত ঈমানদার ব্যক্তি সুখে-দুখে সর্বদা আল্লাহর উপরে ভরসা করেন এবং সর্বাবস্থায় আল্লাহর ফায়ছালায় সন্তুষ্ট থাকেন। এই সকল ঈমানদারগণের আলোকিত হৃদয়কে উদ্দেশ্য করেই আল্লাহ এখানে ‘প্রশান্ত আত্মা’ বলে সম্বোধন করেছেন। যা ঈমানদার নর-নারীর জন্য সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর পক্ষ হ’তে এক অতীব স্নেহময় আহবান। এর চাইতে মূল্যবান উপঢৌকন মুমিনের জন্য আর কি হ’তে পারে?

বস্ত্ততঃ দুনিয়াপ্রেমের শয়তানী ধোঁকার অন্ধকার কেটে গিয়ে আল্লাহপ্রেমের জ্যোতি যখন হৃদয়ে বিচ্ছুরিত হয়, তখন ঈমানের দ্যুতিতে মুমিন এতই শক্তি লাভ করে যে, জীবনকে সে তুচ্ছ মনে করে। প্রেমাস্পদ আল্লাহর সাথে মিলনের জন্য সে ব্যাকুল হয়ে ওঠে। ফেরাঊনের কঠোরতম শাস্তিকে তাই তুচ্ছ জ্ঞান করে তার সতীসাধ্বী স্ত্রী আসিয়া মৃত্যুর আগে আকুল কণ্ঠে আল্লাহর নিকটে প্রার্থনা করেছিলেন, رَبِّ ابْنِ لِيْ عِندَكَ بَيْتاً فِي الْجَنَّةِ وَنَجِّنِيْ مِنْ فِرْعَوْنَ وَعَمَلِهِ وَنَجِّنِيْ مِنَ الْقَوْمِ الظَّالِمِيْنَ- ‘হে আমার পালনকর্তা! আমার জন্য তোমার নিকটে জান্নাতে একটি গৃহ নির্মাণ কর এবং আমাকে ফেরাঊন ও তার দুষ্কর্ম হ’তে এবং এই যালেম কওমের হাত থেকে মুক্তি দান কর’ (তাহরীম ৬৬/১১)

আল্লাহর ভালোবাসার নিকটে স্বামীর ভালোবাসা ও তার বিশাল বিত্ত-বৈভব ও প্রাসাদসমূহ আসিয়ার নিকটে তুচ্ছ মনে হয়েছিল। তাই উপুড় করে শুইয়ে চার হাত-পায়ে মোটা মোটা লোহার পেরেক মেরে পিঠের উপর বিশালকায় ভারি লোহার চাকি গড়িয়ে দিয়ে নিঃশেষ করে দেয়ার মত নিষ্ঠুরতম শাস্তিকে তিনি হাসিমুখে বরণ করে নেন। কেননা এই শাস্তি তো কয়েক মিনিটের জন্য। তারপরেই তো জান্নাতের চিরস্থায়ী শান্তি আর শান্তি।

একই ধরনের উক্তি দেখতে পাওয়া যায় ফেরাঊনের জাদুকরদের মুখে। যখন মূসা (আঃ)-এর মু‘জেযার কাছে জাদুবিদ্যা পরাস্ত হয় এবং তারা আল্লাহর উপরে ঈমান আনে। অতঃপর ফেরাঊন তাদেরকে কঠোর হুমকি দিয়ে বলেন, لَأُقَطِّعَنَّ أَيْدِيَكُمْ وَأَرْجُلَكُم مِّنْ خِلاَفٍ ثُمَّ لَأُصَلِّبَنَّكُمْ أَجْمَعِيْنَ- ‘আমি অবশ্যই তোমাদের হাত ও পা বিপরীত দিক থেকে কেটে ফেলব টুকরা টুকরা করে। অতঃপর তোমাদের সবাইকে শূলীতে চড়িয়ে হত্যা করব’ (আ‘রাফ ৭/১২৪)। জওয়াবে সদ্য মুমিন জাদুকরগণ বলে ওঠেন, قَالُوْا لاَ ضَيْرَ إِنَّا إِلَى رَبِّنَا مُنْقَلِبُوْنَ ‘কোন ক্ষতি নেই। আমরা তো আমাদের প্রতিপালকের নিকটেই ফিরে যাচ্ছি’ (শো‘আরা ২৬/৫০)। তারা সাথে সাথে আল্লাহর নিকটে প্রার্থনা করলেন, رَبَّنَا أَفْرِغْ عَلَيْنَا صَبْراً وَّتَوَفَّنَا مُسْلِمِيْنَ ‘হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে ধৈর্য দান কর এবং আমাদেরকে তোমার নিকটে আত্মসমর্পণকারী (মুসলিম) হিসাবে মৃত্যু দান কর’ (আ‘রাফ ৭/১২৬)

কিছুক্ষণ আগেও যারা ফেরাঊনকে ‘রব’ বলতো, তারাই এখন ফেরাঊনকে তুচ্ছ জ্ঞান করে প্রকৃত ‘রব’ আল্লাহর নিকটে আত্মসমর্পণ করল। এটাই হ’ল মা‘রেফাত বা      অন্তর্দৃষ্টি। যা তারা অর্জন করেছিল মূসা (আঃ)-এর প্রদর্শিত মু‘জেযার মাধ্যমে ও আল্লাহর বিশেষ রহমতে। একইভাবে যা দেখতে পেয়েছিলেন ফেরাঊনের স্ত্রী আসিয়া। জাদুকরদের প্রতি ফেরাঊনের কঠোর শাস্তিদানের কথা শোনার পরপরই ঈমানী তেজে তেজিয়ান এই মহীয়সী মহিলা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় আল্লাহর উপরে তাঁর ঈমান ঘোষণা করেন। ফলে তাঁর উপরে নেমে আসে ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম শাস্তি, যাতে তিনি শাহাদত বরণ করেন। অতঃপর তাঁর পালিত কন্যা মাশেত্বাকেও একই অপরাধে একই শাস্তি বরণ করতে হয় (কুরতুবী)

শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর ছাহাবী ইয়াসির ও তাঁর স্ত্রী সুমাইয়া, খোবায়েব ও আছেমসহ যুগে যুগে বহু ঈমানদার মহান ব্যক্তির মর্মান্তিক শাহাদত বরণের মধ্যে আমরা এই অতুলনীয় ঈমান ও মা‘রেফাতের দৃষ্টান্ত খুঁজে পাই। যেকারণে তাঁরা আল্লাহর শাস্তির মোকাবেলায় দুনিয়ার শাস্তিকে তুচ্ছ জ্ঞান করেছিলেন। হে আল্লাহ! তুমি আমাদেরকে শক্তি ও সাহস দাও এবং তোমার জন্য আমাদেরকে কবুল করে নাও-আমীন!

উল্লেখ্য যে, ‘নফস’ তিন প্রকার। এক- নফসে মুত্বমাইন্নাহ- প্রশান্ত হৃদয়। দুই- নফসে লাউয়ামাহ- তিরষ্কারকারী আত্মা অর্থাৎ বিবেক এবং তিন- নফসে আম্মারাহ অর্থাৎ অন্যায় কাজে প্ররোচনা দানকারী অন্তর। শেষোক্ত অন্তরটি সর্বদা শয়তানের তাবেদারী করে। এর সঙ্গে সর্বদা লড়াই করেই টিকে থাকতে হয়। বান্দাকে তাই সর্বদা এমন পরিবেশে থাকতে হয় যাতে নফসে আম্মারাহ উত্তপ্ত হ’তে না পারে। সরকার ও সমাজনেতাদের পক্ষ থেকে এরূপ শান্ত সামাজিক পরিবেশ তৈরী করতে হয়, যাতে রিপুর তাড়নে মানুষ বিপথে না যায়।

বস্ত্ততঃ রিপুকে দাবিয়ে রাখাই হ’ল নফসের বিরুদ্ধে জিহাদ। এই জিহাদে জিততে পারলেই বান্দা দুনিয়া ও আখেরাতে সম্মানিত হয়। আর শয়তানকে দাবিয়ে রাখার সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হ’ল আল্লাহকে স্মরণ করা। কেননা আল্লাহকে স্মরণ করলেই শয়তান পালিয়ে যায় এবং আত্মা প্রশান্তি লাভ করে। যেমন আল্লাহ বলেন, اَلَّذِيْنَ آمَنُوْاْ وَتَطْمَئِنُّ قُلُوْبُهُم بِذِكْرِ اللهِ أَلاَ بِذِكْرِ اللهِ تَطْمَئِنُّ الْقُلُوْبُ- ‘যারা বিশ্বাস স্থাপন করে এবং যাদের অন্তরসমূহ আল্লাহর স্মরণ দ্বারা শান্তি লাভ করে। জেনে রাখো কেবল আল্লাহর স্মরণ দ্বারাই অন্তরসমূহ প্রশান্তি লাভ করে থাকে’ (রা‘দ ১৩/২৮)

(২৮) اِرْجِعِيْ إِلَى رَبِّكِ رَاضِيَةً مَّرْضِيَّةً ‘ফিরে চলো তোমার প্রভুর পানে সন্তুষ্টচিত্তে ও  সন্তোষভাজন অবস্থায়’। অর্থাৎ যেখান থেকে হে আত্মা! তুমি এসেছিলে, সেখানেই ফিরে চল প্রশান্তচিত্তে। এটি নেককার ব্যক্তির মৃত্যুকালে বলা হবে।

رَاضِيَةً مَّرْضِيَّةً অর্থ راضية بما أوتيت ‘যা তাকে দেওয়া হয়েছে, তাতে সে সন্তুষ্ট’। مرضية عند ربها ‘তার প্রভুর নিকটে সে সন্তোষভাজন বা প্রিয়পাত্র’ (ক্বাসেমী)। 

ইবনু যায়েদ বলেন, প্রশান্ত হৃদয় এজন্য বলা হয়েছে যে, তা জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত হয় মৃত্যুকালে, পুনরুত্থানকালে এবং হাশরের দিবসে’(কুরতুবী)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, মুমিন ব্যক্তি যখন মৃত্যুবরণ করে, তখন তার নিকটে রহমতের ফেরেশতারা আসে। যাদের সঙ্গে জান্নাতের কাফন ও সুগন্ধি থাকে। তারা এসে মুমিনের রূহকে বলেন, اُخْرُجِى أَيَّتُهَا النَّفْسُ الطَّيِّبَةُ رَاضِيَةً مَّرْضِيَّةً ‘বেরিয়ে এসো হে পবিত্র আত্মা! সন্তুষ্টচিত্তে ও সন্তোষভাজন অবস্থায়’। তখন রূহ বেরিয়ে আসে মিশকে আম্বরের সুগন্ধিযুক্ত সাদা রেশমের রুমালে নেওয়া অবস্থায়। এমতাবস্থায় আসমানের দরজায় পৌঁছলে সেখানকার ফেরেশতারা তাকে অতি আনন্দের সাথে সম্ভাষণ জানায় ও দরজা খুলে দেয়। পক্ষান্তরে কাফির-মুনাফিকের রূহ বের করার জন্য আল্লাহ দু’জন আযাবের ফেরেশতাকে পাঠিয়ে দেন। তারা শক্ত চট দিয়ে তার দুর্গন্ধযুক্ত রূহ টেনে বের করে এবং বলে, তুমি বেরিয়ে এসো অসন্তুষ্ট ও অসন্তোষভাজন (ساخطة مسخوطة) অবস্থায় আল্লাহর আযাবের দিকে। অতঃপর তাকে যমীনের দরজার দিকে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে বলা হয়, কি বিশ্রী দুর্গন্ধ এটি! অতঃপর তা কাফিরদের রূহের মধ্যে নেওয়া হয় (সিজ্জীনে)।[18]

ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, আয়াত দু’টি যখন নাযিল হয়, তখন আবুবকর (রাঃ) সেখানে বসা ছিলেন। তিনি বলে ওঠেন, ما أحْسَنَ هذا يا رسولَ الله! ‘হে আল্লাহর রাসূল! এটি কতই না সুন্দর কথা’। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, إِنَّ الْمَلِك سَيَقُولُ لَكَ هَذَا عِندَ الْمَوْتِ ‘ফেরেশতা সত্বর এটা তোমাকে বলবেন মৃত্যুকালে হে আবুবকর’! ইবনু কাছীর বর্ণনাটিকে ‘মুরসাল হাসান’ বলেছেন।

اِرْجِعِيْ إِلَى رَبِّكِ ‘ফিরে চলো তোমার প্রভুর পানে’ বাক্যের দ্বারা বুঝা যায় যে, রূহটি তার সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর নিকট থেকে এসেছিল এবং তার কাছেই তাকে ফিরে যেতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

প্রকৃত প্রস্তাবে নফস বা রূহ হ’ল ভিডিও ক্যামেরার মত। যা আল্লাহ মানবদেহের  অভ্যন্তরে ফিট করে দিয়েছেন। যতক্ষণ মানুষ জেগে থাকে, ততক্ষণ তার ভিতর-বাহির সকল কর্মের ছবি ঐ সিসিটিভি ক্যামেরায় ধরা পড়ে যায়। যদি বান্দা খালেছ অন্তরে তওবা করে, তাহ’লে আল্লাহ ঐ পাপের রেকর্ডটুকু মুছে দেন। নইলে ওটা থেকে যায়। অতঃপর যখন আল্লাহর হুকুমে রূহ মানুষের দেহ পিঞ্জর ছেড়ে ইল্লিয়ীন অথবা সিজ্জীনে ফিরে যায়, তখন পচনশীল দেহটা দুনিয়ায় পড়ে থাকে। কিন্তু তার সারা জীবনের কর্মের রেকর্ড তার রূহের সাথে আল্লাহর নিকটে ফিরে যায়। যেমন বিমান ধ্বংস হয়ে গেলেও তার ব্ল্যাক বক্স (Black Box) থেকে তার সব রেকর্ড পাওয়া যায়। রূহের কোন মৃত্যু নেই। ক্বিয়ামতের দিন নেককার রূহগুলি নেককার বান্দাদের মধ্যে প্রবেশ করে জান্নাতে স্থায়ী হয়ে যাবে।

رَاضِيَةً مَّرْضِيَّةً অর্থাৎ বান্দা আল্লাহর উপরে সন্তুষ্ট এবং আল্লাহর নিকটে বান্দা         সন্তোষভাজন। যেমন বলা হয়েছে, رَضِيَ اللهُ عَنْهُمْ وَرَضُوْا عَنْهُ ذَلِكَ لِمَنْ خَشِيَ رَبَّهُ ‘আল্লাহ তাদের উপরে সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং তারাও আল্লাহর উপরে সন্তুষ্ট হয়েছে। এই সন্তুষ্টি কেবল তার জন্য যে তার পালনকর্তাকে ভয় করেছে’ (বাইয়েনাহ ৯৮/৮)

(২৯-৩০) فَادْخُلِيْ فِيْ عِبَادِيْ، وَادْخُلِيْ جَنَّتِيْ ‘অতঃপর (সেখানে গিয়ে) প্রবেশ কর আমার বান্দাদের মধ্যে’। ‘এবং প্রবেশ কর আমার জান্নাতে’। এটি ক্বিয়ামতের দিন বিচার শেষে বলা হবে।

فِيْ عِبَادِيْ ‘আমার বান্দাদের মধ্যে’ অর্থ فى الصالحين من عبادى ‘আমার নেককার বান্দাগণের মধ্যে’ (কুরতুবী)। যেমন আল্লাহ অন্যত্র বলেন,وَالَّذِيْنَ آمَنُوْا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ لَنُدْخِلَنَّهُمْ فِي الصَّالِحِيْنَ- ‘আর যারা বিশ্বাস স্থাপন করে ও সৎকর্ম করে, অবশ্যই আমরা তাদের প্রবেশ করাবো সৎকর্মশীলদের মধ্যে’ (আনকাবূত ২৯/৯)

বিগত নবীগণের অনেকে এজন্য দো‘আ করে গেছেন। যেমন হযরত ইবরাহীম (আঃ) বলেন, رَبِّ هَبْ لِيْ حُكْماً وَّأَلْحِقْنِيْ بِالصَّالِحِيْنَ ‘হে প্রভু! আমাকে প্রজ্ঞা দান কর এবং আমাকে সৎকর্মশীলদের অন্তর্ভুক্ত কর’ (শো‘আরা ২৬/৮৩)। একই দো‘আ হযরত ইউসুফ (আঃ) করেছিলেন, تَوَفَّنِيْ مُسْلِماً وَّأَلْحِقْنِيْ بِالصَّالِحِيْنَ ‘আমাকে মুসলিম হিসাবে মৃত্যু দান কর এবং আমাকে সৎকর্মশীলদের অন্তর্ভুক্ত কর’ (ইউসুফ ১২/১০১)। অনুরূপ দো‘আ হযরত সুলায়মান (আঃ) করেছেন, وَأَدْخِلْنِيْ بِرَحْمَتِكَ فِيْ عِبَادِكَ الصَّالِحِيْنَ ‘এবং আমাকে স্বীয় অনুগ্রহে তোমার সৎকর্মশীল বান্দাগণের অন্তর্ভুক্ত কর’ (নমল ২৭/১৯)

এতে বুঝা যায় যে, সৎসঙ্গ একটি বিরাট নে‘মত, যা নবীগণও কামনা করেছেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, اَلْمَرْءُ مَعَ مَنْ أَحَبَّ ‘ক্বিয়ামতের দিন ব্যক্তি তার সঙ্গেই থাকবে, যাকে সে দুনিয়াতে ভালবাসতো’।[19] কবি শেখ সা‘দী বলেন,

صحبت صالح ترا صالح كند  +   صحبت طالح ترا طالح كند

‘সসঙ্গ তোমাকে সৎ বানাবে। আর অসৎ সঙ্গ তোমাকে অসৎ বানাবে’।

অতএব এখানে فَادْخُلِيْ فِيْ عِبَادِيْ বলে আল্লাহপাক ক্বিয়ামতের দিন পবিত্র আত্মাগুলিকে নেককার বান্দাদের মধ্যে প্রবেশ করতে বলবেন। অতঃপর বলবেন,

 وَادْخُلِيْ جَنَّتِيْ ‘তুমি আমার জান্নাতে প্রবেশ কর’। অর্থাৎ নেককার বান্দাগণের সাথে তুমি জান্নাতে প্রবেশ কর (কুরতুবী)। এখানে ‘আমার জান্নাত’ বলা হয়েছে জান্নাতের বিশেষ মর্যাদা প্রকাশ করার জন্য। কেননা এটা কেবল একটি শান্তির বাগিচা নয়, বরং আল্লাহর সন্তুষ্টির স্থল।

ইবনু কাছীর বলেন, একথাগুলি ফেরেশতাগণ বলবেন নেককার বান্দার মৃত্যুকালে, পুনরুত্থানকালে এবং ক্বিয়ামতের পর জান্নাতে প্রবেশকালে’ (ইবনু কাছীর)। ‘আল্লাহ তুমি আমাদেরকে তাদের অন্তর্ভুক্ত কর’- আমীন!

আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূল (ছাঃ) বলেন, আল্লাহ বলেছেন, أَعْدَدْتُ لِعِبَادِى الصَّالِحِيْنَ مَا لاَ عَيْنَ رَأَتْ وَلاَ أُذُنَ سَمِعَتْ وَلاَ خَطَرَ عَلَى قَلْبِ بَشَرٍ فَاقْرَءُوا إِنْ شِئْتُمْ ‘আমি আমার সৎকর্মশীল বান্দাদের জন্য এমনসব বস্ত্ত প্রস্ত্তত করে রেখেছি, যা কোন চোখ কখনো দেখেনি, কান কখনো শোনেনি এবং মানুষের হৃদয় কখনো কল্পনা করেনি। যদি তোমরা চাও তবে পাঠ কর, فَلاَ تَعْلَمُ نَفْسٌ مَا أُخْفِىَ لَهُمْ مِنْ قُرَّةِ أَعْيُنٍ ‘কেউ জানেনা তাদের কৃতকর্মের পুরস্কার স্বরূপ চক্ষু শীতলকারী কত বস্ত্ত তাদের জন্য লুক্কায়িত আছে’।[20] আল্লাহ বলেন, فَمَنْ زُحْزِحَ عَنِ النَّارِ وَأُدْخِلَ الْجَنَّةَ فَقَدْ فَازَ ‘যাকে জাহান্নাম থেকে দূরে রাখা হ’ল এবং জান্নাতে প্রবেশ করানো হ’ল, সে সফলকাম হ’ল’ (আলে ইমরান ৩/১৮৫)

সারকথা :

পার্থিব জীবনের বিত্ত-বৈভব, ক্ষমতা ও পদমর্যাদা মানুষকে প্রকৃত শান্তি দিতে পারে না। প্রকৃত সুখী কেবল তিনি, যিনি সুখে-দুখে সর্বাবস্থায় আল্লাহর উপরে সন্তুষ্ট থাকেন এবং আল্লাহ তাকে সর্বদা সন্তুষ্ট রাখেন।


[1]. নাসাঈ হা/৯৮৪, বুখারী হা/৭০৫; মুসলিম হা/৪৬৫ ‘এশার ছালাত’ অনুচ্ছেদ; মিশকাত হা/৮৩৩। এখানে ‘সূরা বাক্বারাহ দিয়ে ক্বিরাআত শুরু করেন’ অর্থ সূরা ফাতিহার পরে বাক্বারাহর কিছু অংশ পাঠ করেন। কিন্তু উক্ত মুক্তাদী ভেবেছিল ইমাম পুরাটা পাঠ করবেন। সেই ভয়ে সে জামা‘আত ছেড়ে দেয়। কেননা সে দিনের বেলায় উট চরাতো। ফলে সে ছিল ক্লান্ত। দীর্ঘ ক্বিরাআতকেই এখানে ফিৎনা বলা হয়েছে। জামা‘আতে যা করতে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) নিষেধ করেছেন। উল্লেখ্য যে, মু‘আয বিন জাবাল (রাঃ) এশার ছালাত রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে আদায়ের পর নিয়মিতভাবে নিজ মহল্লা বনু সালেমাহর মসজিদে গিয়ে পুনরায় এশার ছালাতে ইমামতি করতেন। এটা তাঁর জন্য নফল হ’ত। ছহীহ মুসলিম-এর বর্ণনায় পরিষ্কারভাবে এশার ছালাতের (عشاء الآخرة) কথা এসেছে। এক্ষণে নাসাঈ-র বর্ণনায় যে মাগরিবের ছালাতের কথা এসেছে, সেটা ভাবার্থে এশা হবে (مجازًا)। কেননা বুখারী-মুসলিমের বর্ণনা সর্বাধিক বিশুদ্ধ এবং মু‘আয-এর এই অভ্যাসটি ছিল এশার ছালাতে (মির‘আত হা/৮৩৯-এর ব্যাখ্যা ৪/১৩৮-১৩৯)। এতদ্ব্যতীত মাগরিবের ছালাতে সূরা বাক্বারাহ বা সূরা নিসা সবটা পড়বেন, এরূপ ধারণা কোন মুক্তাদী করতে পারে না।

[2]. বুখারী হা/৯৬৯; ইবনু আববাস (রাঃ) হ’তে ‘ঈদায়েন’ অধ্যায়, তাশরীক্বের দিনগুলিতে আমলের ফযীলত’ অনুচ্ছেদ; তিরমিযী হা/৭৫৭; ইবনু মাজাহ হা/১৭২৭; মিশকাত হা/১৪৬০ ‘ছালাত’ অধ্যায়, ‘কুরবানী’ অনুচ্ছেদ।

[3]. মুসলিম হা/১১৬২, মিশকাত হা/২০৪৪ ‘নফল ছিয়াম’ অনুচ্ছেদ।

[4]. নাসাঈ হা/১৬৯৩, ইবনু ওমর (রাঃ) হ’তে; সনদ ছহীহ।

[5]. বুখারী হা/৬৪১০; মুসলিম হা/২৬৭৭; তিরমিযী হা/৪৫৩, আবুদাঊদ, নাসাঈ, মিশকাত হা/১২৬৬।

[6]. বঙ্গানুবাদ তাফসীর মা‘আরেফুল কুরআন, পৃঃ ৪৫৬; আ‘রাফ ৭৩ আয়াতের ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য।

[7]. আহমাদ হা/১৪৯২, মিশকাত হা/১৭৩৩; সনদ ছহীহ।

[8]. মুসলিম হা/২৯৯৯, মিশকাত হা/৫২৯৭।

[9]. আবুদাঊদ হা/৫১৫০; তিরমিযী হা/১৯১৮; বুখারী হা/৫৩০৪; তিরমিযী বলেন, হাদীছটি হাসান ছহীহ; মিশকাত হা/৪৯৫২, ৪৯৭৩ ‘শিষ্টাচার’ অধ্যায়, ১৫ অনুচ্ছেদ।

[10]. বুখারী হা/৬০০৫, মিশকাত হা/৪৯৫২।

[11]. বুখারী হা/৩১৯৮, মুসলিম হা/১৬১০, মিশকাত হা/২৯৩৮।

[12]. আহমাদ হা/১৭৫৯৪, ১৭৬০৫; মিশকাত হা/২৯৫৯ ‘ক্রয়-বিক্রয়’ অধ্যায়; ছহীহাহ হা/২৪২।

[13]. বুখারী হা/৫৩৯৩, মুসলিম হা/২০৬১; মিশকাত হা/৪১৭৩।

[14]. বুখারী হা/৬৪৩৬, মুসলিম হা/১০৪৮; মিশকাত হা/৫২৭৩ ‘রিক্বাক্ব’ অধ্যায়।

[15]. বুখারী হা/১১৪৫, মুসলিম হা/৭৫৮; মিশকাত হা/১২২৩ ।

[16]. সেখানে ‘অবিশ্বাসীরা আল্লাহর দর্শন লাভে বঞ্চিত হবে’-এর ব্যাখ্যায় তিনি বলেছেন, عن كرامته ورحمته ممنوعون ‘তাঁর দয়া ও অনুগ্রহ হ’তে তারা বঞ্চিত হবে’। অথচ এই ব্যাখ্যা আহলে সুন্নাত-এর আক্বীদার বিপরীত এবং মু‘তাযেলী আক্বীদার অনুরূপ। (১) আলোচ্য সূরার ২২ আয়াতের ব্যাখ্যায় যামাখশারী (মৃ: ৫৩৮ হিঃ) বলেছেন جاء آثار قهره وسلطانه ‘তাঁর প্রতাপ ও রাজত্বের নিদর্শনসমূহ উপস্থিত হবে’ (২) বায়যাভী (মৃ: ৬৯১ হিঃ) ও আবুস সঊদ (মৃ: ৯৮৩ হিঃ) একই ধরনের ব্যাখ্যা করেছেন (৩) জালালায়েন (মাহাল্লী মৃ: ৮৬৪ হিঃ) ব্যাখ্যা করেছেন جاء امره ‘তাঁর নির্দেশ আসবে’ (৪) সাইয়িদ কুতুব (মৃ: ১৯৬৬ খৃঃ) প্রথমে গায়েবী বিষয় স্বীকার করে নিয়েও শেষে বলেছেন بالجلال والهول ‘আসবে তাঁর মহিমা ও ভয়ংকরতা’ (৫) মাওলানা মওদূদী (মৃ: ১৯৭৯ খৃঃ) সঠিক শাব্দিক অনুবাদ করার পরে ব্যাখ্যায় গিয়ে রূপক অর্থ করে পূর্ববর্তী মু‘তাযেলী পন্ডিতদের অনুসারী হয়েছেন।

[17]. মুসলিম হা/২৮৪২; মিশকাত হা/৫৬৬৬।

[18]. আহমাদ, নাসাঈ হা/১৮৩৩, মিশকাত হা/১৬২৯ ‘জানায়েয’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৩।

[19]. বুখারী হা/৬১৬৯, মুসলিম হা/২৬৪০; মিশকাত হা/৫০০৮।

[20]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৫৬১২; সাজদাহ ৩২/১৭।