তাফসীরুল কুরআন - (৩০তম পারা)

সূরা বালাদ

(নগরী)

সূরা ক্বাফ-এর পরে মক্কায় অবতীর্ণ।

সূরা ৯০, আয়াত ২০, শব্দ ৮২, বর্ণ ৩৩৫।

بِسْمِ اللہِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِیْمِ

পরম করুণাময় অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে (শুরু করছি)।

(১) আমি শপথ করছি এই নগরীর;
لَا أُقْسِمُ بِهَذَا الْبَلَدِ
(২) এমতাবস্থায় যে তুমি এই নগরীতে অবস্থানকারী।
وَأَنْتَ حِلٌّ بِهَذَا الْبَلَدِ
(৩) শপথ জনকের ও যা সে জন্ম দেয়।
وَوَالِدٍ وَمَا وَلَدَ
(৪) নিশ্চয়ই আমরা সৃষ্টি করেছি মানুষকে শ্রমনির্ভর রূপে।
لَقَدْ خَلَقْنَا الْإِنْسَانَ فِي كَبَدٍ
(৫) সে কি মনে করে যে, তার উপরে কেউ কখনো ক্ষমতাবান হবে না?
أَيَحْسَبُ أَنْ لَنْ يَقْدِرَ عَلَيْهِ أَحَدٌ
(৬) সে বলে যে, আমি প্রচুর ধন-সম্পদ ব্যয় করেছি।
يَقُولُ أَهْلَكْتُ مَالًا لُبَدًا
(৭) সে কি মনে করে যে, তাকে কেউ দেখেনি?
أَيَحْسَبُ أَنْ لَمْ يَرَهُ أَحَدٌ
(৮) আমরা কি দেইনি তাকে দু’টি চোখ?
أَلَمْ نَجْعَلْ لَهُ عَيْنَيْنِ
(৯) এবং জিহবা ও দু’টি ঠোঁট?
وَلِسَانًا وَشَفَتَيْنِ
(১০) আর আমরা তাকে দেখিয়েছি দু’টি পথ ।
وَهَدَيْنَاهُ النَّجْدَيْنِ
(১১) কিন্তু সে তো গিরিসংকটে প্রবেশ করেনি।
فَلَا اقْتَحَمَ الْعَقَبَةَ
(১২) তুমি কি জানো গিরিসংকট কি?
وَمَا أَدْرَاكَ مَا الْعَقَبَةُ
(১৩) তা হ’ল দাসমুক্তি।
فَكُّ رَقَبَةٍ
(১৪) অথবা ক্ষুধার দিনে অন্নদান করা
أَوْ إِطْعَامٌ فِي يَوْمٍ ذِي مَسْغَبَةٍ
(১৫) ইয়াতীম নিকটাত্মীয়কে।
يَتِيمًا ذَا مَقْرَبَةٍ
(১৬) অথবা ভূলুণ্ঠিত অভাবগ্রস্তকে।
أَوْ مِسْكِينًا ذَا مَتْرَبَةٍ
(১৭) অতঃপর তাদের অন্তর্ভুক্ত হওয়া, যারা বিশ্বাস স্থাপন করে এবং পরস্পরকে ছবরের উপদেশ দেয় ও পরস্পরের প্রতি দয়ার উপদেশ দেয়।
ثُمَّ كَانَ مِنَ الَّذِينَ آمَنُوا وَتَوَاصَوْا بِالصَّبْرِ وَتَوَاصَوْا بِالْمَرْحَمَةِ
(১৮) এরাই হ’ল ডান সারির মানুষ।
أُولَئِكَ أَصْحَابُ الْمَيْمَنَةِ
(১৯) আর যারা আমাদের আয়াতসমূহকে অস্বীকার করে, তারা হ’ল বাম সারির লোক।
وَالَّذِينَ كَفَرُوا بِآيَاتِنَا هُمْ أَصْحَابُ الْمَشْأَمَةِ
(২০) তাদের উপরে থাকবে পরিবেষ্টিত অগ্নি।
عَلَيْهِمْ نَارٌ مُؤْصَدَةٌ

বিষয়বস্ত্ত :

সূরাটিতে প্রধানতঃ দু’টি বিষয় আলোচিত হয়েছে।-

১- তিনটি বিষয়ে শপথ করে আল্লাহ বলছেন যে, মানুষকে অবশ্যই শ্রমনির্ভর প্রাণী হিসাবে সৃষ্টি করা হয়েছে। অতএব তাকে কষ্ট করে জীবনের ঘাঁটিসমূহ অতিক্রম করতে হবে (১-১৬ আয়াত)

২- কষ্টের ফলাফল হিসাবে হয় সে সৌভাগ্যবান হবে, নয় হতভাগ্য হবে (১৭-২০ আয়াত)

তাফসীর :

(১) لاَ أُقْسِمُ بِهَذَا الْبَلَدِ ‘আমি শপথ করছি এই নগরীর’। অর্থ أنا أقسم بهذا البلد ‘আমি এই নগরীর শপথ করে বলছি’।

বাক্যের শুরুতে لاَ ‘না’ বোধক নয়। বরং ‘অতিরিক্ত’ হিসাবে আনা হয়েছে তম্বীহ ও তাকীদের জন্য এবং প্রতিপক্ষের ভ্রান্ত ধারণা খন্ডন করার জন্য। অর্থাৎ তোমরা যা বলছ, তা ঠিক নয়। বরং আমি শপথ করে যা বলছি, সেটাই ঠিক। শপথের সাথে لاَ -এর ব্যবহার আরবী বাকরীতিতে খুবই প্রসিদ্ধ।

‘এই নগরী’ বলতে মক্কা নগরীকে বুঝানো হয়েছে। যেমন অন্যত্র আল্লাহ বলেছেন, وَهَذَا الْبَلَدِ الْأَمِيْنِ ‘শপথ এই নিরাপদ নগরীর’ (তীন ৯৫/৩)। অন্যত্র এই শহরকে সরাসরি ‘মক্কা’ বলা হয়েছে। যেমন আল্লাহ বলেন, إِنَّ أَوَّلَ بَيْتٍ وُضِعَ لِلنَّاسِ لَلَّذِي بِبَكَّةَ مُبَارَكًا وَهُدًى لِلْعَالَمِيْنَ ‘নিশ্চয়ই প্রথম গৃহ যা মানবজাতির জন্য প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, তা হ’ল ঐ গৃহ যা মক্কায় অবস্থিত। যা বরকতময় ও বিশ্ববাসীর জন্য পথপ্রদর্শক’ (আলে ইমরান ৩/৯৬)। প্রথম গৃহ বলতে কা‘বা গৃহকে বুঝানো হয়েছে।[1] ‘বাক্কা’ মক্কার প্রসিদ্ধ নামসমূহের অন্যতম। لأنها تَبُكُّ أعناق الجبابرة ‘কেননা এই গৃহ অত্যাচারীদের ঘাড় মটকায়, মানুষ এখানে মুখাপেক্ষী হয়, ক্রন্দন করে, ভিড় করে (ইবনু কাছীর)। অন্য আয়াতে মক্কাকে ‘উম্মুল ক্বোরা’ বা সকল নগরীর উৎস বলা হয়েছে। যেমন আল্লাহ বলেন, وَكَذَلِكَ أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ قُرْآنًا عَرَبِيًّا لِتُنْذِرَ أُمَّ الْقُرَى وَمَنْ حَوْلَهَا ‘এভাবে আমরা তোমার প্রতি আরবী ভাষায় কুরআন নাযিল করেছি। যাতে তুমি মক্কা ও তার চতুষ্পার্শ্বের লোকদের সতর্ক করতে পারো... (শূরা ৪২/৭; আন‘আম ৬/৯২)। এই শপথের দ্বারা পৃথিবীর নাভীমূল হিসাবে মক্কা নগরীর উচ্চমর্যাদাকে আরও সমুন্নত করা হয়েছে। কেননা শপথকারীর নিকট শপথকৃত বস্ত্তর মর্যাদা অবশ্যই উন্নত থাকে।

(২) وَأَنْتَ حِلٌّ بِهَذَا الْبَلَدِ ‘এমতাবস্থায় যে তুমি এই নগরীতে অবস্থানকারী’। অর্থাৎ আমি এই মহান নগরীর শপথ করছি যার হুরমত ও উচ্চমর্যাদা সম্পর্কে তুমি অবগত। সেই সাথে তুমি এখানকার বাসিন্দা হওয়ায় এর সম্মান আরও বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়েছে। পূর্ববর্তী আয়াতের শপথকে অত্র আয়াতের সাথে সংযুক্ত করার মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর উচ্চ মর্যাদাকে আরও উন্নত করা হয়েছে। যেন তাঁর জন্যই শপথ করা হয়েছে। এর মধ্যে কুরায়েশ নেতাদের মূর্খতার প্রতি ইঙ্গিত রয়েছে যে, তারা রাসূল (ছাঃ)-এর মহান মর্যাদাকে বুঝতে পারেনি। বরং তারা উল্টা তাঁকে বহিষ্কার করার ষড়যন্ত্র করছে। অথচ তিনিই এ নগরীতে বসবাসের সবচেয়ে যোগ্য ব্যক্তি এবং তাঁর মাধ্যমেই এ নগরীর মর্যাদা পূর্ণতা পেয়েছে’ (ক্বাসেমী)

الحِلُّ শব্দটি صفت অথবা مصدر যার অর্থ الْحَالُّ ‘অবস্থানকারী’। এর দ্বারা রাসূল (ছাঃ)-কে বুঝানো হয়েছে। কুরতুবী ও ইবনু কাছীর সহ অনেক বিদ্বান حِلٌّ অর্থ مُحِلٌّ ‘হালালকারী’ বলেছেন। তখন এর ব্যাখ্যা হবে محل فى المستقبل ‘তুমি ভবিষ্যতে হালালকারী হবে’। যেমন বলা হয়েছে, إِنَّكَ مَيِّتٌ وَإِنَّهُمْ مَيِّتُوْنَ ‘নিশ্চয়ই তুমি মৃত্যুবরণ করবে। যেমন তারাও মৃত্যুবরণ করেছে’ (যুমার ৩৯/৩০)। এক্ষণে অর্থ হবে ভবিষ্যতে[2] মক্কা বিজয়ের দিন কয়েকজন কাফেরের রক্তপাত তোমার জন্য কিছুসময়ের জন্য হালাল করা হবে। যেমন রাসূল (ছাঃ) ঐদিন বলেছিলেন, অতঃপর ক্বিয়ামত পর্যন্ত এই নগরীতে সকল প্রকার রক্তপাত, বৃক্ষকর্তন, পশু শিকার ইত্যাদি হারাম করা হ’ল।[3] এর মাধ্যমে রাসূল (ছাঃ)-কে আগাম মক্কা বিজয়ের সুসংবাদ দেওয়া হয়েছে এবং তাঁকে সান্ত্বনা দেওয়া হয়েছে। তবে প্রথম ব্যাখ্যাটিই অধিকতর সামঞ্জস্যপূর্ণ। কেননা এর মধ্যে রাসূল (ছাঃ)-এর উচ্চ মর্যাদা নিহিত রয়েছে। দ্বিতীয় ব্যাখ্যাটি দূরবর্তী। যেদিকে চিন্তা দ্রুত ধাবিত হয় না (ক্বাসেমী)

(৩) وَوَالِدٍ وَّمَا وَلَدَ ‘শপথ জনকের ও যা সে জন্ম দেয়’।

এখানে পিতা ও সন্তান বলতে আদম ও বনু আদমকে বুঝানো হতে পারে। যেমন প্রথমে সকল নগরীর উৎস বা উম্মুল ক্বোরা হিসাবে মক্কা নগরীর শপথ করা হয়েছে। তেমনি মানবজাতির উৎস বা আদি পিতা হিসাবে আদম (আঃ)-এর শপথ করা হয়েছে। অতঃপর বিগত ও অনাগত সকল আদম সন্তানের শপথ করা হয়েছে। অথবা সকল যুগের পিতা ও সন্তানদের শপথ করে বলা হচ্ছে-

(৪) لَقَدْ خَلَقْنَا الْإِنسَانَ فِيْ كَبَدٍ ‘নিশ্চয়ই আমরা সৃষ্টি করেছি মানুষকে শ্রমনির্ভর রূপে’।

এটি পূর্বোক্ত আয়াতসমূহের জওয়াব। আল্লাহ তাঁর যেকোন সৃষ্টির শপথ করে থাকেন। আর এর দ্বারা উক্ত সৃষ্টির মর্যাদা বৃদ্ধি উদ্দেশ্য হয়ে থাকে। সূরার শুরুতে মক্কা নগরী, অতঃপর আদম ও বনু আদম বা পিতা ও সন্তানদের শপথ করে, অতঃপর لَ قَدْ সহ মোট তিনটি তাকীদ সহযোগে আল্লাহ বলছেন যে, আমরা অবশ্যই মানুষকে ক্লেশনির্ভর প্রাণীরূপে সৃষ্টি করেছি।

كَبَدٍ অর্থ نصب ومشقة ‘কষ্ট ও ক্লেশ’। মানুষ তার মায়ের গর্ভ থেকেই নানাবিধ কষ্ট ও রোগ-পীড়ার সম্মুখীন হয়। ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত নানারূপ বিপদাপদ ও কায়-ক্লেশের মধ্য দিয়ে তাকে জীবন অতিবাহিত করতে হয়। যদিও দৈহিক কষ্ট-দুঃখ অন্য প্রাণীর জীবনেও হয়ে থাকে। তথাপি মানুষের বিষয়টি নির্দিষ্টভাবে বলার কারণ হ’ল সম্ভবতঃ এই যে, (১) মানুষ হ’ল সবচেয়ে বিস্ময়কর সৃষ্টি। যাকে কথা বলার ও ব্যবস্থাপনার ক্ষমতা দান করা হয়েছে। (২) মানুষ একমাত্র প্রাণী যাকে জ্ঞান সম্পদ দান করা হয়েছে। সেকারণ তাকে তার প্রতিটি কথা ও কাজের জন্য জবাবদিহি করতে হয়। (৩) মানুষের উপলব্ধি ও চেতনাবোধ অন্য সকল প্রাণীর চাইতে বেশী। তাছাড়া যার জ্ঞান ও বিবেকশক্তি যত প্রখর তার চেতনা ও দূরদৃষ্টি তত প্রখর। ফলে পরিশ্রমের কষ্ট চেতনাভেদে কম-বেশী হয়ে থাকে। (৪) মানুষকে তার সারা জীবনের কর্মের হিসাব ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহর নিকটে দিতে হয়। যা অন্য প্রাণীকে দিতে হয় না। (৫) মানুষের জন্য তার পার্থিব জীবনটা হ’ল পরীক্ষাগার। প্রতি পদে পদে তাকে পরীক্ষা দিয়ে চলতে হয়। তাই মানুষের স্বাতন্ত্র্য ও শ্রেষ্ঠত্বকে এবং তার দায়িত্ববোধকে স্মরণ করিয়ে দেবার জন্যই এখানে মানুষকে মূল আলোচ্য বিষয় হিসাবে পেশ করা হয়েছে।

হাসান বাছরী অত্র আয়াতটি পাঠ করে বলেন, يكابد مصائب الدنيا وشدائد الآخرة ‘মানুষ দুনিয়াবী মুছীবত সহ্য করে এবং আখেরাতের কষ্ট সমূহের সম্মুখীন হয়’। তিনি একথাও বলেন যে, আনন্দে শুকরিয়া আদায় করা ও বিপদে ধৈর্য ধারণ করা- এ দু’টি পরীক্ষার কোন একটি থেকে সে কখনো মুক্ত থাকে না (কুরতুবী)। পরিশ্রমের বিষয়টি যদি মানুষের এখতিয়ারে থাকত, তাহ’লে সে কখনোই সেটা চাইত না। এতে বুঝা যায় যে, তার একজন সৃষ্টিকর্তা আছেন, যিনি সবকিছু নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করে থাকেন। যার নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাবার ক্ষমতা মানুষের নেই।

(৫) أَيَحْسَبُ أَنْ لَّنْ يَّقْدِرَ عَلَيْهِ أَحَدٌ ‘সে কি মনে করে যে, তার উপরে কেউ কখনো ক্ষমতাবান হবে না’?

শক্তিগর্বে স্ফীত অহংকারী মানুষকে উদ্দেশ্য করে আল্লাহ ধমকের সুরে কথাগুলি বলেছেন। যেমন বিগত যুগে ‘আদ জাতি বলেছিল, مَنْ أَشَدُّ مِنَّا قُوَّةً ‘কে আছে আমাদের চাইতে অধিক শক্তিশালী’? (হা-মীম সাজদাহ ৪১/১৫)। অর্থাৎ সেকি ভেবেছে তাকে দমন করার কেউ নেই? অথবা সেকি ভেবেছে ক্বিয়ামত হবে না এবং তার অত্যাচারের বদলা নেওয়া হবে না? কালবী বলেন, বনু জুমাহ (بنو جُمَح) গোত্রের আবুল আশাদ্দায়েন (ابو الأشدين) নামে খ্যাত জনৈক ব্যক্তি দৈহিকভাবে দারুণ শক্তিশালী ছিল। সে একাই দশজনের সমান শক্তি রাখতো। সে ছিল রাসূল (ছাঃ)-এর ঘোরতর শত্রু। ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, وكان من أشد رجال قريش ‘ঐ লোকটি ছিল কুরায়েশদের সেরা শক্তিশালী পুরুষদের অন্যতম’। এতদ্ব্যতীত আরও একজন শক্তিশালী পুরুষ ছিলেন রাসূল (ছাঃ)-এর চাচাতো ভাই রুকানা বিন হাশেম বিন আব্দুল মুত্ত্বালিব। وكان مثلا فى البأس والشدة ‘যিনি শক্তি ও কঠোরতায় দৃষ্টান্ত স্বরূপ ছিলেন’ (কুরতুবী)। অনেকে ধনশালী অলীদ বিন মুগীরাহ প্রমুখের নামও বলেছেন (তানতাভী)। যারা নিজেদের শক্তির বড়াই ও ক্ষমতার অহংকারে অন্ধ ছিল এবং রাসূল (ছাঃ)-কে বেতোয়াক্কা করত। এদের সম্পর্কে আয়াতটি নাযিল হ’লেও আয়াতের বক্তব্য সকল যুগের সকল শক্তি মদমত্ত অহংকারী মানুষের জন্য প্রযোজ্য।

আয়াতের সারকথা এই যে, বনু আদম কি ভেবেছে যে, তার যুলুম প্রতিরোধের কেউ নেই? সেকি ভেবেছে যে, আল্লাহ তাকে শাস্তি দিবেন না? যদিও তার নিজের মধ্যকার কষ্ট ও তা থেকে বাঁচতে না পারার দুর্বলতাই তাকে এবিষয়ে হুঁশিয়ার করার জন্য যথেষ্ট।

(৬) يَقُوْلُ أَهْلَكْتُ مَالاً لُّبَداً  ‘সে বলে যে, আমি প্রচুর ধন-সম্পদ ব্যয় করেছি’।

لُبَداً অর্থ كثيرًا ‘বহু’। تَلَبَّدَ الشَّيْئُ অর্থ اجتمع ‘জমা হওয়া’। এখানে অর্থ, ‘যখন সে ব্যয় করে গর্ব, অহংকার ও লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে’ (ক্বাসেমী)। এই ব্যয় ইহকাল ও পরকালে তার কোন কাজে আসে না। এটি স্রেফ অপচয় মাত্র। সেকারণ أَهْلَكْتُ  শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। যার অর্থ ‘আমি ধ্বংস করেছি’। কেননা এই ব্যয় সম্পূর্ণটাই তার বৃথা গেছে। কারণ নিকৃষ্ট উদ্দেশ্যে ব্যয় আল্লাহর নিকটে উৎকৃষ্ট দান হিসাবে গৃহীত হয় না।

সাধারণতঃ ধনিক শ্রেণীর মধ্যে যারা কৃপণ ও অহংকারী স্বভাবের, তারা যৎকিঞ্চিত খরচ করে বড়াই করে বলে যে, বহু ধন-সম্পদ ব্যয় করলাম। লোক দেখানো ও লোককে শুনানোর উদ্দেশ্যে ব্যয়কৃত এইসব দান আল্লাহর নিকটে গৃহীত হয় না। বরং হাদীছে বলা হয়েছে যে, এইসব লোক দেখানো দানশীল ব্যক্তিদের উপুড় করে ফেলে মাটি ঘেঁষে পা ধরে টানতে টানতে জাহান্নামে ছুঁড়ে ফেলা হবে।[4] কেননা তারা আল্লাহর ওয়াস্তে দান করেনি। বরং দুনিয়াবী স্বার্থে দান করেছিল।

(৭) أَيَحْسَبُ أَن لَّمْ يَرَهُ أَحَدٌ  ‘সে কি মনে করে যে, তাকে কেউ দেখেনি?’

অর্থাৎ ধনশালী অহংকারী ব্যক্তিটি কত সম্পদ ব্যয় করেছে এবং কি উদ্দেশ্যে ব্যয় করেছে, সে কি ভেবেছে যে কেউ তা দেখেনি? অবশ্যই তা আল্লাহ দেখেছেন। তিনি তার ভিতর-বাহির সব খবর জানেন এবং সবকিছুর হিসাব তিনি নেবেন। তিনি বলেন, لِلَّهِ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ وَإِنْ تُبْدُواْ مَا فِيْ أَنْفُسِكُمْ أَوْ تُخْفُوْهُ يُحَاسِبْكُم بِهِ اللهُ، فَيَغْفِرُ لِمَنْ يَّشَاءُ وَيُعَذِّبُ مَنْ يَّشَاءُ وَاللهُ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيْرٌ- ‘আসমান ও যমীনে যা কিছু আছে, সবই আল্লাহর জন্য। তোমাদের মনের মধ্যে যা আছে, তা তোমরা প্রকাশ করো বা গোপন করো, তার হিসাব তোমাদের কাছ থেকে আল্লাহ নিবেন। অতঃপর তিনি যাকে ইচ্ছা মাফ করবেন ও যাকে ইচ্ছা শাস্তি দিবেন। আল্লাহ সকল বিষয়ে ক্ষমতাশালী’ (বাক্বারাহ ২/২৮৪)

ধন-সম্পদের মূল মালিক আল্লাহ। বান্দাকে তিনি দেন, তাকে পরীক্ষা করার জন্য। অতএব মালিকের নির্দেশমত আয়-ব্যয় না করলে সে খেয়ানতকারী হিসাবে উত্থিত হবে এবং যথাযথ শাস্তি ভোগ করবে।

(৮-৯) أَلَمْ نَجْعَل لَّهُ عَيْنَيْنِ، وَلِسَاناً وَّشَفَتَيْنِ ‘আমরা কি তাকে দেইনি দু’টি চোখ’? ‘এবং জিহবা ও দু’টি ঠোঁট’?

আল্লাহ এখানে মানুষকে দেওয়া তিনটি অত্যন্ত মূল্যবান নে‘মতের কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন, যা টাকা-পয়সা ও ধন-সম্পদের চাইতে বহু বহু গুণ মূল্যবান। আর তা হ’ল মানুষের ‘দু’টি চোখ’, যা দিয়ে সে দেখে ও সৌন্দর্য উপভোগ করে। অণুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে আল্লাহর সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম সৃষ্টিসমূহ সে পর্যবেক্ষণ করে। দূরবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে লক্ষ-কোটি মাইল দূরে লুক্কায়িত নক্ষত্ররাজি অবলোকন করে। সাগরগর্ভে লুক্কায়িত মণি-মুক্তা উত্তোলন করে। এভাবে সে তার দু’চোখের মাধ্যমে আকাশ ও পৃথিবীর অসংখ্য সৃষ্টিরাজি স্বচক্ষে দেখে সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর অস্তিত্ব ও তাঁর সৃষ্টিকৌশল সম্পর্কে বাস্তব জ্ঞান লাভ করে ও সেখান থেকে কল্যাণ আহরণ করে।

‘জিহবার’ সাহায্যে সে কথা বলে, খাদ্যের স্বাদ আস্বাদন করে এবং দুই মাড়ির দাঁতের মাঝে খাদ্য ঠেলে দেয়। যাতে তা ভালোভাবে চিবিয়ে হযম করা সহজ হয়। সর্বক্ষণ সরস জিহবার সাহায্যে মানুষ তার মনের কথা স্পষ্ট ভাষায় ব্যক্ত করতে পারে। এছাড়া জিহবার লালা তার খাদ্য হযমে সাহায্য করে এবং চর্মের উপরের ক্ষত ও বিষ নাশ করে।

‘দু’টি ঠোট’ মানুষের মুখগহবরের দু’টি কপাট হিসাবে ব্যবহৃত হয়। যা তার পর্দা করে ও চেহারার সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে। যা মুখের ভিতরে খাদ্যের সঞ্চালন করে এবং শব্দ ও বর্ণের যথাযথ উচ্চারণে সাহায্য করে। যদি ঠোট বা জিহবা ক্ষণিকের জন্য অসাড় হয়ে যায়, তাহ’লে সে বুঝতে পারে এ দু’টির মূল্য কত বেশী!

উক্ত নে‘মতগুলি দেওয়ার উদ্দেশ্য এটা পরীক্ষা করা যে, বান্দা এগুলিকে কল্যাণের পথে ব্যয় করে, না অকল্যাণের পথে ব্যয় করে। সে এগুলিকে আল্লাহর পথে পরিচালিত করে, না শয়তানের পথে পরিচালিত করে। এজন্যেই বলা হয়, একটা মানুষ পূর্ণ মুমিন হয় তখনই, যখন তার হাত-পা, চোখ-কান ইত্যাদি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পূর্ণভাবে মুসলমান হয়। অর্থাৎ ইসলামী শরী‘আতের অনুসারী হয়। ইঞ্জিন ভাল থাকলেও পার্টস খারাব হ’লে যেমন ইঞ্জিন চলে না, অনুরূপভাবে ঈমান যত মযবুত হৌক, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ যদি শয়তানের তাবেদার হয়, তাহ’লে হৃদয়ের ঐ ঈমানের জ্যোতিটুকুও এক সময় নিভে যাবে। অতএব চোখ কান ইত্যাদিকে কঠোরভাবে হেফাযত করতে হবে, যেন ঐ দু’টি খোলা জানালা দিয়ে কোন নাপাক চিন্তা ভিতরে প্রবেশ না করে এবং তা হৃদয়কে কলুষিত না করে। আল্লাহ বলেন, وَلاَ تَقْفُ مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ إِنَّ السَّمْعَ وَالْبَصَرَ وَالْفُؤَادَ كُلُّ أُوْلَـئِكَ كَانَ عَنْهُ مَسْؤُوْلاً- ‘যে বিষয়ে তোমার জ্ঞান নেই, তার পিছে পড়ো না। নিশ্চয় কান, চোখ ও অন্তঃকরণ এদের প্রত্যেকটিই জিজ্ঞাসিত হবে’ (বনু ইস্রাঈল ১৭/৩৬)

(১০) وَهَدَيْنَاهُ النَّجْدَيْنِ ‘আর আমরা তাকে দেখিয়েছি দু’টি পথ’।

এখানে দু’টি পথ বলতে ভাল ও মন্দের দু’টি পথ বুঝানো হয়েছে। النجد অর্থ العلو ‘উচ্চভূমি’। তেহামা অঞ্চলের চাইতে উঁচু এলাকা হওয়ার কারণে হেজাযের ‘নাজদ’ প্রদেশকে ‘নাজদ’ (النجد) বলা হয় (কুরতুবী)। অতএব النجدان অর্থ الطريقان العاليان ‘উঁচু দু’টি পথ’। অর্থাৎ ভাল ও মন্দের দু’টি পথই বান্দার সামনে উন্মুক্ত থাকে। কোনটাই গোপন নয়। সে যেটা ইচ্ছা অবলম্বন করতে পারে।

النَّجْدَيْنِ বলার মধ্যে ইঙ্গিত রয়েছে যে, ভাল ও মন্দ দু’টি পথেই কষ্ট ও মুছীবত রয়েছে। এটা নয় যে, মন্দ পথ ভাল পথের চাইতে সহজ। যেমনটি ধারণা করা হয়ে থাকে। দু’টি পথের মধ্যে উত্তমটি বেছে নেবার মত জ্ঞান-ক্ষমতা আল্লাহ মানুষের মধ্যে দিয়েছেন। আল্লাহ বলেন, إِنَّا هَدَيْنَاهُ السَّبِيْلَ إِمَّا شَاكِراً وَّإِمَّا كَفُوْرًا ‘আমরা মানুষকে রাস্তা বাৎলে দিয়েছি। এক্ষণে সে কৃতজ্ঞ বান্দা হ’তে পারে, অথবা অকৃতজ্ঞ হ’তে পারে’ (দাহর ৭৬/৩)

(১১) فَلاَ اقْتَحَمَ الْعَقَبَةَ ‘কিন্তু সে তো গিরিসংকটে প্রবেশ করেনি?’

الْعَقَبَةَ অর্থ الطريق الوعرة فى الجبل ‘দুর্গম পাহাড়ী রাস্তা’ (ক্বাসেমী)الاقتحام এসেছে القحمة থেকে। অর্থ الدخول والمجاوزة بشدة ومشقة ‘অনেক কষ্টে প্রবেশ করা ও অতিক্রম করা’ (তানতাভী)। আয়াতে اقةحام العقبة বা ‘গিরিসংকটে প্রবেশ করা’ কথাটি প্রবাদ (ضرب مَثَل) হিসাবে এসেছে। যার দ্বারা ‘মহৎ কর্ম’ বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ তারা কি মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর শত্রুতার পিছনে পয়সা ব্যয় না করে আল্লাহর পথে ব্যয় করার মহৎ কর্ম সম্পাদন করেছে? (কুরতুবী)। আর মহৎ কর্ম সবসময় কঠিন ও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে থাকে। সেকারণ আল্লাহ প্রতিটি সৎকর্মের নেকী ১০ গুণ থেকে ৭০০ গুণ পর্যন্ত বর্ধিত করেন।[5] এমনকি আল্লাহ যাকে খুশী অধিক অধিক বর্ধিত করে থাকেন (বাক্বারাহ ২/২৬১)

কাফের-ফাসেকরা নিজেদের বিলাস-ব্যসনে ও স্রেফ বাজে আমোদ-ফূর্তির পিছনে পানির মত অর্থ-সম্পদ ব্যয় করে থাকে। অথচ মানবকল্যাণে তারা ব্যয় করতে কার্পণ্য করে। যদি তারা মহৎ কর্ম সাধন করত, তাহ’লে নেক আমলের বিনিময়ে তারা জান্নাতের চিরস্থায়ী সুখ লাভে ধন্য হ’ত। সৎকর্ম সম্পাদন করাকে উঁচু পাহাড়ী পথ অতিক্রম করার সাথে তুলনা করে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, নেক আমল করা কষ্টসাধ্য। দ্বিতীয়তঃ ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, নেক আমলের ফলাফল সর্বদা ঊর্ধ্বমুখী হয়। এতে কেবল লাভ আর লাভ। লোকসানের কোন সুযোগ নেই। নেক আমল করতে গেলে নফসরূপী শয়তানের সঙ্গে রীতিমত যুদ্ধ করতে হয়। উঁচু পাহাড়ী পথ অতিক্রম করতে গেলেও তেমনি কঠোর অভিযান করতে হয়। কিন্তু কাফের ও দুনিয়াপূজারী লোকেরা এটা করতে চায় না। সেকারণ আল্লাহ বলেন, فَلاَ اقْتَحَمَ الْعَقَبَةَ ‘তারা তো গিরিসংকটে প্রবেশ করেনি’।

لاَ এখানে একবার এসেছে। অথচ فعل ماضى (অতীত ক্রিয়া)-এর পূর্বে বা এরূপ ক্ষেত্রে সাধারণতঃ পুনরায় আসে। যেমন فَلاَ صَدَّقَ وَلاَ صَلَّى (ক্বিয়ামাহ ৭৫/৩১), فَلاَ خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلاَ هُمْ يَحْزَنُوْنَ (বাক্বারাহ ২/৩৮) প্রভৃতি। তবে আরবরা একবার এনে থাকে সমার্থবোধক আরেকটি বাক্য বুঝানোর জন্য। অতএব পরবর্তী বাক্য এর ব্যাখ্যা হিসাবে এসেছে বলা যেতে পারে। তখন فَلاَ اقْتَحَمَ الْعَقَبَةَ অর্থ হবে, لاَ فَكَّ رَقَبَةً وَلاَ أَطْعَمَ مِسْكِيْنًا وَلاَ آمَنَ فَكَيْفَ يُجَاوِزُ الْعَقَبَةَ؟ ‘তারা দাস মুক্ত করেনি, মিসকীনকে খাওয়ায়নি বা ঈমান আনেনি, তাহ’লে কিভাবে তারা গিরিসংকট অতিক্রম করবে’? (কুরতুবী, ক্বাসেমী)

(১২) وَمَا أَدْرَاكَ مَا الْعَقَبَةُ ‘তুমি কি জানো গিরিসংকট কি?

وَمَا أَدْرَاكَ অর্থ وَمَا أَعْلَمَكَ ‘কোন্ বস্ত্ত তোমাকে জানাবে’?। এর মাধ্যমে দ্বীনী আমলের উচ্চ মর্যাদা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। مَا الْعَقَبَةُ অর্থ مَا اقْتَحَامُ الْعَقَبَةِ؟ ‘গিরিসংকটে প্রবেশ করাটা কী?’ প্রশ্নের আকারে বলার উদ্দেশ্য হ’ল আল্লাহর নিকট সৎকর্মের উচ্চ মর্যাদার বিষয়টি শ্রোতার হৃদয়ে প্রোথিত করে দেওয়া (ক্বাসেমী)। সুফিয়ান বিন ওয়ায়না বলেন, ‘যখন কোন বিষয়ে আল্লাহ বলেন, وَمَا أَدْرَاكَ তখন তিনি সে বিষয়টি জানিয়ে দেন। আর যখন বলেন, وَمَا يُدْرِيْكَ তখন সে বিষয়টি জানিয়ে দেন না’ (কুরতুবী)। যেমন এখানে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সূরা ‘আবাসা ৩ আয়াতে জানিয়ে দেননি।

অতঃপর উদাহরণ স্বরূপ এখানে পরপর তিনটি ঘাঁটি তথা নেক আমলের কথা বলা হয়েছে, যা আল্লাহর নিকট খুবই মর্যাদাপূর্ণ। যেমন-

(১৩) فَكُّ رَقَبَةٍ ‘তা হ’ল দাসমুক্তি’।

অর্থ هِىَ فَكُّ رَقَبَةٍ ‘তা হ’ল দাসমুক্তি’। এখানে هِىَ ‘মুবতাদা’ উহ্য রয়েছে। ‘দাসমুক্তি’ দু’ধরনের হ’তে পারে। এক- ক্রীতদাসমুক্তি। দুই- কয়েদীমুক্তি। যেমন আল্লাহ সৎকর্মশীলদের গুণাবলী বর্ণনা করে বলেন, وَيُطْعِمُوْنَ الطَّعَامَ عَلَى حُبِّهِ مِسْكِينًا وَيَتِيْمًا وَأَسِيْرًا ‘তারা আল্লাহর মহববতে অভাবগ্রস্ত, ইয়াতীম ও কয়েদীদের আহার্য প্রদান করে’ (দাহর ৭৬/৮)

আলোচ্য আয়াতে উদাহরণ স্বরূপ প্রথম ঘাঁটির কথা বলা হয়েছে। আর তা হ’ল ‘দাসমুক্তি’। জাহেলী আরবে দাস-দাসী ক্রয়-বিক্রয় হ’ত। এতে তাদের স্বাধীন সত্তা বিলীন হয়ে যেত। সারা জীবন তাদের ও তাদের সন্তানাদিকে দাসত্বের শৃংখলে আবদ্ধ থাকতে হ’ত। এই অবস্থা তৎকালীন বিশ্বে প্রায় সর্বত্র চালু ছিল। ইসলাম এটাকে সেযুগে মানবতার বিরুদ্ধে এক নম্বরের অপরাধ বলে চিহ্নিত করেছে এবং এটিকে সমাজ থেকে উৎখাতের চেষ্টা করেছে। যুগ যুগ ধরে প্রচলিত এই নিবর্তনমূলক সমাজ ব্যবস্থাকে এক হুকুমে উঠিয়ে দেওয়া সম্ভব ছিল না। তাই ইসলাম একে সুকৌশলে উঠিয়ে দেবার চেষ্টা করেছে এবং দাস-দাসী মুক্ত করাকে সর্বাধিক পুণ্যের কাজ হিসাবে ঘোষণা করেছে। ফলে ইসলাম কবুলকারীদের পরিবারসমূহ যেমন দাস-দাসী থেকে মুক্ত হয়ে যায়, তেমনি হযরত আবুবকর, হযরত ওছমান প্রমুখ সচ্ছল ছাহাবায়ে কেরাম কাফেরদের ঘরে নির্যাতিত বহু দাস-দাসীকে অর্থের বিনিময়ে খরিদ করে নিঃস্বার্থভাবে স্রেফ আল্লাহর ওয়াস্তে মুক্ত করে দেন। এটি যেহেতু অতীব গুরুত্বপূর্ণ ও আয়াসসাধ্য নেক আমল, তাই এটাকেই পাহাড়ের প্রথম উঁচু ঘাঁটি হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে, যার সোপান বেয়ে মুমিন নর-নারী জান্নাতে প্রবেশ করবে।

আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, مَنْ أَعْتَقَ رَقَبَةً مُسْلِمَةً، أَعْتَقَ اللهُ بِكُلِّ عُضْوٍ مِنْهُ عُضْوًا مِنَ النَّارِ، حَتَّى فَرْجَهُ بِفَرْجِهِ- ‘যে ব্যক্তি একজন গোলামকে মুক্ত করল, আল্লাহ তাকে তার প্রতিটি অঙ্গের বিনিময়ে একটি অঙ্গকে, এমনকি তার গুপ্তাঙ্গের বিনিময়ে গুপ্তাঙ্গকে জাহান্নাম থেকে মুক্ত করবেন’।[6] বারা বিন আযেব (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, এক বেদুঈন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট এসে বলল عَلِّمْنِى عَمَلاً يُدْخِلُنِى الْجَنَّةَ، فَقَالَ: لَئِنْ كُنْتَ أَقْصَرْتَ الْخُطْبَةَ لَقَدْ أَعْرَضْتَ الْمَسْأَلَةَ، أَعْتِقِ النَّسَمَةَ وَفُكَّ الرَّقَبَةَ ‘আমাকে এমন একটি আমল শিখিয়ে দিন যা আমাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবে। তিনি বললেন, যদি তুমি কথা সংক্ষেপ কর, তাহ’লে প্রশ্নবাণে জর্জরিত হওয়া থেকে বেঁচে যাবে। তুমি একটি দাস মুক্ত কর’।[7]

কোন কোন দেশে আজও দাসপ্রথা চালু আছে। অন্যত্র প্রকাশ্যভাবে চালু না থাকলেও বেনামীতে চালু আছে। তাছাড়া বিদেশে যেসব নারী গৃহকর্মী হিসাবে চাকুরী নিয়ে যায়, তাদের অধিকাংশ ক্রীতদাসীর মত ব্যবহৃত হয় বলে জানা যায়। স্বদেশেই কত গৃহকর্মী এভাবে নির্যাতিতা হচ্ছে, তার খবর কে রাখে?

দাসপ্রথা হারাম করা হয়নি কেন?

ইসলাম দাসপ্রথা কেন এক কথায় হারাম ঘোষণা করেনি? তার জবাব এই যে, প্রথমতঃ সে যুগে এটা ছিল গোটা দুনিয়ার স্বীকৃত সামাজিক ও অর্থনৈতিক রীতি। এটাকে কেউ অবাঞ্ছিত বলে ধারণা করত না। যুদ্ধ ও হানাহানির কারণে সবলদের হাতে দুর্বলরা সর্বদা নির্যাতিত ও গৃহহারা হ’ত। মরু অঞ্চলে সহজে আশ্রয় ও রূযি পাওয়া দুষ্কর ছিল। তাই গোলামীকেই তারা নিরাপদ মনে করত। প্রধানতঃ পশু পালনে ও ফসল উৎপাদনে তারা ব্যবহৃত হ’ত। ফলে ধনী ও দরিদ্র উভয়ের স্বার্থ এখানে যুক্ত ছিল। তাই মদ নিষিদ্ধের চাইতে দীর্ঘ সময় প্রয়োজন ছিল এটা নিষিদ্ধের জন্য। সেকারণ ইসলাম এমন মূলনীতি নির্ধারণ করে দিয়েছে, যাতে স্বেচ্ছাপ্রণোদিত কিংবা মুক্তিপণ ব্যবস্থার মাধ্যমে অদূর ভবিষ্যতে সব দাসই মুক্ত হয়ে যায় এবং পৃথিবীর এই প্রাচীনতম সমস্যাটি মানব সমাজ থেকে কোনরূপ যবরদস্তি ছাড়াই চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে যায়। দ্বিতীয়তঃ ইসলাম দাস ও মনিবে যে সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক স্থাপন করে দিয়েছে, তাতে মানবিক ও সামাজিক উভয় দিক দিয়ে দাসমুক্তির স্থায়ী ভিত রচিত হয়েছে। এভাবে ইসলাম কার্যতঃ খৃষ্টীয় সপ্তম শতকে দাসপ্রথা বিলুপ্তির সূচনা করেছে স্রেফ মানবিক তাকীদে। অথচ এর ১১শ’ বছর পরে ১৮শ’ শতকে ভূমি দাসপ্রথার পূর্ণ বিলুপ্তির পর ইউরোপে তা অনুসৃত হয় কোন মানবিক কারণে নয়, বরং অর্থনৈতিক ও সামাজিক কারণে। কেননা দাসদের মাধ্যমে মনিবরা যা আয় করত, তার চেয়ে বেশী খরচ হ’ত তাদের ভরণ-পোষণে। তাছাড়া দাসেরা যতদিন বিদ্রোহ-বিপ্লব করে ইউরোপকে বাধ্য না করেছে, ততদিন কর্মক্ষম দাসদের মুক্তি হয়নি। অথচ ইসলাম এটি করেছে মানুষের মানবাধিকার সমুন্নত করার স্বার্থে পরকালীন মুক্তির অনুভূতি জাগিয়ে তোলার মাধ্যমে। আলোচ্য আয়াত ও বর্ণিত হাদীছ সমূহ তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ।

(১৪) أَوْ إِطْعَامٌ فِيْ يَوْمٍ ذِيْ مَسْغَبَةٍ ‘অথবা ক্ষুধার দিনে অন্নদান করা’।

জান্নাতে প্রবেশের জন্য দ্বিতীয় ঘাঁটি হ’ল ক্ষুধার্তকে অন্ন দান করা। বিশেষ করে যখন খাদ্য-শস্য দুষ্প্রাপ্য ও দুর্মূল্য হয় এবং দেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। مَسْغَبَةٍ অর্থ مجاعة ক্ষুধা। السَغَب والساغب অর্থ ক্ষুধা ও ক্ষুধার্ত (কুরতুবী)। ইবরাহীম নাখঈ বলেন, فى يومٍ الطعامُ فيه عزيزٌ ‘এমন দিনে যখন খাদ্য থাকে আক্রা বা দুষ্প্রাপ্য’ (ইবনু কাছীর)। যেকোন সময়ে ক্ষুধার্তকে অন্নদান অত্যন্ত নেকীর কাজ। কিন্তু মঙ্গার সময় এটা আরও অধিক নেকীর কারণ হয়। হাদীছে ক্ষুধার্তকে অন্নদান করাকে জান্নাতে প্রবেশের মাধ্যম বলা হয়েছে।[8]

(১৫) يَتِيْماً ذَا مَقْرَبَةٍ ‘ইয়াতীম নিকটাত্মীয়কে’। অর্থ يتيما ذا قرابة من مات أبوه من قبل أن يبلغ ‘ঐ নিকটাত্মীয় শিশু সন্তান, সাবালক হওয়ার আগেই যার পিতা মারা গেছে’।

সাধারণভাবে ইয়াতীমকে অন্নদান করা ও তার প্রতিপালন করা অত্যন্ত ছওয়াবের কাজ। কিন্তু যখন সে ইয়াতীমটি অসহায় ও নিকটাত্মীয় হয় এবং সময়টি দুর্ভিক্ষের হয়, তখন তার ছওয়াব হয় বর্ণনাতীত। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, الصَّدَقَةَ عَلَى الْمِسْكِيْنِ صَدَقَةٌ وَعَلَى ذِى الرَّحِمِ اثْنَتَانِ صَدَقَةٌ وَصِلَةٌ- ‘মিসকীনকে দান করায় ছাদাক্বার নেকী। আর নিকটাত্মীয় হ’লে দ্বিগুণ নেকী: ছাদাক্বার এবং আত্মীয়তার’।[9] তিনি বলেন,أَنَا وَكَافِلُ الْيَتِيْمِ لَهُ وَلِغَيْرِهِ فِي الْجَنَّةِ كَهَاتَيْنِ وَأَشَارَ بِالسَّبَّابَةِ وَالْوُسْطَى ‘আমি ও ইয়াতীমের অভিভাবক, নিজের বা অন্যের, জান্নাতে এইরূপ একসাথে থাকব’ -একথা বলে তিনি মধ্যমা ও শাহাদাত অঙ্গুলী দু’টি দিয়ে ইশারা করেন’।[10]

(১৬) أَوْ مِسْكِيْناً ذَا مَتْرَبَةٍ ‘অথবা ভূলুণ্ঠিত মিসকীনকে’।

المسكين هو الذي لا يجد قوته ولا قوتَ عِيَاله ‘মিসকীন ঐ ব্যক্তিকে বলে যে তার নিজের বা তার পরিবারের ভরণ-পোষণ করতে পারে না’। ذَا مَةْرَبَةٍ অর্থ ذا فقر شديد لاصق بالتراب ‘ধূলি ধুসরিত হত দরিদ্র’।

অর্থাৎ এমন অভাবগ্রস্ত যে, মাটিতেই তার বসবাস। ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, هو المطروح على الطريق الذى لا بيت له- ‘রাস্তায় পতিত ব্যক্তি, যার নিজস্ব কোন ঘর-বাড়ি নেই’ (কুরতুবী)। ইকরিমা বলেন, هو الفقير المديون المحتاج ‘সে হ’ল ঋণগ্রস্ত পরমুখাপেক্ষী ফকীর’। ক্বাতাদাহ বলেন, هو ذو العِيَال ‘বড় পরিবারওয়ালা অভাবগ্রস্ত ব্যক্তি’। ইবনু কাছীর বলেন, ‘সবগুলি অর্থই কাছাকাছি মর্মের’।

অর্থাৎ সর্বস্বান্ত, ছিন্নমূল, দিশেহারা ব্যক্তি ও পরিবারকে অন্নদান করা হ’ল জান্নাতে প্রবেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি, যা উত্তরণ করা খাঁটি মুমিনের অবশ্য কর্তব্য।

(১৭) ثُمَّ كَانَ مِنَ الَّذِيْنَ آمَنُوْا وَتَوَاصَوْا بِالصَّبْرِ وَتَوَاصَوْا بِالْمَرْحَمَةِ ‘অতঃপর তাদের অন্তর্ভুক্ত হওয়া, যারা বিশ্বাস স্থাপন করে এবং পরস্পরকে ছবরের উপদেশ দেয় ও পরস্পরের প্রতি দয়ার উপদেশ দেয়’।

অর্থাৎ দাসমুক্তির মাধ্যমে এবং দুর্ভিক্ষের সময় নিরন্নকে অন্নদানের মাধ্যমে কেউ ঘাঁটিতে প্রবেশ করতে পারবে না, যতক্ষণ না সে যথার্থ বিশ্বাসীদের অন্তর্ভুক্ত হবে। কেননা যেকোন সৎকর্ম আল্লাহর নিকটে কবুল হওয়ার পূর্বশর্ত হ’ল তাঁর উপরে বিশ্বাস স্থাপন করা। ঈমানহীন আমল বা আমলহীন ঈমান কোনটাই কাজে আসবে না। বরং ঈমান ও আমল একত্রিত হওয়া আবশ্যক। যেমন মুনাফিকদের সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, وَمَا مَنَعَهُمْ أَن تُقْبَلَ مِنْهُمْ نَفَقَاتُهُمْ إِلاَّ أَنَّهُمْ كَفَرُواْ بِاللهِ وَبِرَسُوْلِهِ وَلاَ يَأْتُوْنَ الصَّلاَةَ إِلاَّ وَهُمْ كُسَالَى وَلاَ يُنْفِقُوْنَ إِلاَّ وَهُمْ كَارِهُوْنَ- ‘তাদের অর্থব্যয় কবুল না হওয়ার এছাড়া আর কোন কারণ নেই যে, তারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি অবিশ্বাসী। তারা ছালাতে আসে অলসতার সাথে, আর ব্যয় করে অনিচ্ছুক মনে’ (তওবা ৯/৫৪)। অন্যত্র আল্লাহ বলেন, مَنْ عَمِلَ صَالِحاً مِّنْ ذَكَرٍ أَوْ أُنْثَى وَهُوَ مُؤْمِنٌ فَلَنُحْيِيَنَّهُ حَيَاةً طَيِّبَةً وَلَنَجْزِيَنَّهُمْ أَجْرَهُمْ بِأَحْسَنِ مَا كَانُواْ يَعْمَلُوْنَ ‘মুমিন অবস্থায় যে পুরুষ বা নারী সৎকর্ম সম্পাদন করে, আমরা তাকে অবশ্যই পবিত্র জীবন দান করব এবং তাদের কাজের সর্বোত্তম পুরস্কার দেব’ (নাহল (১৬/৯৭)। আল্লাহ আরও বলেন, وَمَنْ أَرَادَ الْآخِرَةَ وَسَعَى لَهَا سَعْيَهَا وَهُوَ مُؤْمِنٌ فَأُوْلَئِكَ كَانَ سَعْيُهُم مَّشْكُوْرًا- ‘যে ব্যক্তি আখেরাত কামনা করে এবং মুমিন অবস্থায় তার জন্য চেষ্টা-সাধনা করে, তাদের চেষ্টাসমূহ কবুল হয়ে থাকে’ (বনু ইস্রাঈল ১৭/১৯)

আলোচ্য আয়াতের অর্থ এটাও হ’তে পারে যে, মুমিন অবস্থায় দাসমুক্তি বা মিসকীনকে অন্নদান প্রভৃতি সৎকর্ম সম্পাদনের মাধ্যমে সে ঘাঁটিতে প্রবেশ করে। অতঃপর আজীবন সে তার ঈমান ও সদুপদেশ দান কার্যের উপরে অবিচল থাকে। যেমন আল্লাহ বলেন, وَإِنِّيْ لَغَفَّارٌ لِّمَنْ تَابَ وَآمَنَ وَعَمِلَ صَالِحاً ثُمَّ اهْتَدَى ‘আর আমি অবশ্যই ক্ষমাশীল ঐ ব্যক্তির জন্য, যে ব্যক্তি তওবা করে ও বিশ্বাস স্থাপন করে এবং সৎকর্ম সম্পাদন করে। অতঃপর সৎপথে অটল থাকে’ (ত্বোয়াহা ২০/৮২)

وَتَوَاصَوْا بِالصَّبْرِ ঈমানের পরে এখানে দু’টি গুরুত্বপূর্ণ আমলের কথা বর্ণনা করা হয়েছে। প্রথমটি হ’ল পরস্পরকে ছবর ও ধৈর্যের উপদেশ দেওয়া। ছবর তিন প্রকার। এক- বিপদে ধৈর্য ধারণ করা (الصبر فى المصيبة)। ঈমানদার ব্যক্তির উপরে নানাবিধ বিপদ এসে থাকে তাকে ঈমান থেকে ফিরিয়ে নেবার জন্য অথবা তার ঈমানের দৃঢ়তা পরীক্ষা করার জন্য। এমতাবস্থায় ঈমানদার নিজে যেমন ছবর করবে, অন্যকেও তেমনি ছবরের উপদেশ দিবে, যাতে সেও ঈমানের উপরে দৃঢ় থাকতে পারে। দুই- পাপ থেকে নিজেকে বিরত রাখা (الصبر عن المعصية)। পাপের সহজ সুযোগ এসে যাওয়া সত্ত্বেও মুমিনকে তার ঈমান ঐ পাপকর্ম থেকে বিরত রাখে। এটা হ’ল গুরুত্বপূর্ণ ছবর, যার পুরস্কার অনেক বেশী। তিন- আল্লাহর আনুগত্যের উপরে দৃঢ় থাকা (الصبر على الطاعة)। সাময়িকভাবে পাপ থেকে বিরত থাকা এবং আল্লাহর আনুগত্যে ফিরে আসা অনেক সময় সম্ভব হ’লেও স্থায়ীভাবে তার উপরে দৃঢ় থাকা নিঃসন্দেহে কঠিন এবং অবশ্যই তা সর্বোচ্চ ধৈর্য ধারণের অন্তর্ভুক্ত। যার পুরস্কারের কোন শেষ নেই। প্রথমটি সাধারণ, দ্বিতীয়টি ‘উত্তম’ (حسن) এবং শেষেরটি ‘সর্বোত্তম’ (أحسن)

আল্লাহ বলেন, إِنَّ اللهَ مَعَ الصَّابِرِيْنَ ‘নিশ্চয় আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সঙ্গে থাকেন’ (বাক্বারাহ ২/১৫৩)। তিনি বলেন, إِنَّمَا يُوَفَّى الصَّابِرُوْنَ أَجْرَهُمْ بِغَيْرِ حِسَابٍ ‘ধৈর্যশীলদের বেহিসাব পুরস্কার দান করা হবে’ (যুমার ৩৯/১০)। তিনি আরও বলেন, أُوْلَئِكَ يُجْزَوْنَ الْغُرْفَةَ بِمَا صَبَرُوْا وَيُلَقَّوْنَ فِيْهَا تَحِيَّةً وَّسَلاَماً ‘ছবরের বিনিময়ে তাদেরকে জান্নাতে বিশেষ কক্ষ দান করা হবে এবং তাদেরকে সেখানে মুবারকবাদ ও সালাম সহকারে অভ্যর্থনা জানানো হবে’ (ফুরক্বান ২৫/৭৫)। তিনি বলেন, وَجَزَاهُمْ بِمَا صَبَرُوا جَنَّةً وَحَرِيْرًا ‘ধৈর্যধারণের পুরস্কার স্বরূপ আল্লাহ তাদেরকে জান্নাত ও রেশমী পোষাক দান করবেন’ (দাহর ৭৬/১২)

জনৈক ব্যক্তি মারা গেলে একজন বলল, লোকটি খুবই সৌভাগ্যবান। কেননা তার বড় কোন রোগ-পীড়া হয়নি। একথা শুনে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে ধমক দিয়ে বললেন, একথা তুমি জানলে কিভাবে? যদি আল্লাহ তাকে কোন রোগ দ্বারা পরীক্ষা করতেন, তাহ’লে এর মাধ্যমে তিনি তার পাপ মোচন করতেন’।[11]

আনাস (রাঃ) বর্ণিত হাদীছে রাসূল (ছাঃ) বলেন, إِذَا أَرَادَ اللهُ بِعَبْدِهِ الْخَيْرَ عَجَّلَ لَهُ الْعُقُوبَةَ فِى الدُّنْيَا وَإِذَا أَرَادَ اللهُ بِعَبْدِهِ الشَّرَّ أَمْسَكَ عَنْهُ بِذَنْبِهِ حَتَّى يُوَفَّى بِهِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ ‘আল্লাহ যখন কোন বান্দার কল্যাণ চান, তাকে আগেভাগে দুনিয়ায় কষ্ট দান করেন। কিন্তু যখন কোন বান্দার অকল্যাণ চান, তার পাপের শাস্তি দানে বিরত থাকেন। অবশেষে ক্বিয়ামতের দিন তাকে পূর্ণ শাস্তি দিয়ে দেন’।[12]

আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, مَا يُصِيْبُ الْمُسْلِمَ مِنْ نَصَبٍ وَلاَ وَصَبٍ وَلاَ هَمٍّ وَلاَ حُزْنٍ وَلاَ أَذًى وَلاَ غَمٍّ حَتَّى الشَّوْكَةِ يُشَاكُهَا، إِلاَّ كَفَّرَ اللهُ بِهَا مِنْ خَطَايَاهُ ‘মুসলমান দুনিয়াতে যেসব বিপদ, রোগ, দুশ্চিন্তা, দুঃখ, কষ্ট বা মনোবেদনা ভোগ করে, এমনকি যদি তার শরীরে কোন কাঁটাও ফুটে, (আর সে যদি তাতে আল্লাহর উপরে সন্তুষ্ট থাকে), তাহ’লে এর দ্বারা তার পাপসমূহ মোচন করে দেন’।[13] অন্য হাদীছে এসেছে, حَتَّى يَلْقَى اللهَ وَمَا عَلَيْهِ خَطِيئَةٌ ‘অবশেষে সে আল্লাহর সাথে মুলাক্বাত করবে এমন অবস্থায় যে, তার কোন গোনাহ থাকবে না’।[14]

এতে বুঝা যায় যে, রোগ-শোক, বিপদাপদ মানব জীবনের স্থায়ী সাথী। এ থেকে মুক্তি পাওয়ার কোন উপায় নেই। যে মানুষ যত বেশী কষ্ট-মুছীবতের সম্মুখীন হয়, তার অভিজ্ঞতা ও ধৈর্যশক্তি তত বৃদ্ধি পায়। তার অন্তরজগত পরিশুদ্ধ হয়। আগুনে পোড়া ঝকঝকে স্বর্ণের ন্যায় ছবরের আগুনে পোড়া মুমিন এভাবে দুনিয়া থেকে নিষ্কলুষ হয়ে তার পালনকর্তা আল্লাহর নিকটে চলে যায়। -সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহী

وَتَوَاصَوْا بِالْمَرْحَمَةِ দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ সৎকর্মটি হ’ল পরস্পরকে দয়া ও অনুগ্রহের উপদেশ দান করা।

নিষ্ঠুর এই পৃথিবীতে দয়াগুণের চাইতে বড় গুণ আর নেই। ছবর ও দয়াগুণ মুমিনের সবচেয়ে বড় দু’টি গুণ হিসাবে অত্র আয়াতে উল্লেখ করার মাধ্যমে আল্লাহ অত্র গুণ দু’টির বড়ত্ব ও মর্যাদাকে আরো সমুন্নত করেছেন। ‘রহম’ বা দয়াগুণ হ’ল আল্লাহর সবচেয়ে বড় গুণ। তিনি বলেন, سَبَقَتْ رَحْمَتِى عَلَى غَضَبِى ‘আমার দয়া আমার ক্রোধের উপরে জয়লাভ করে’।[15] রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, الرَّاحِمُونَ يَرْحَمُهُمُ الرَّحْمَنُ ارْحَمُوْا مَنْ فِى الأَرْضِ يَرْحَمْكُمْ مَنْ فِى السَّمَاءِ ‘দয়াশীলদের উপরে দয়াময় আল্লাহ দয়া করে থাকেন। তোমরা যমীনবাসীদের উপরে দয়া কর, আসমানবাসী (আল্লাহ) তোমাদের উপরে দয়া করবেন’।[16] তিনি বলেন, لاَ يَرْحَمُ اللهُ مَنْ لاَ يَرْحَمُ النَّاسَ ‘আল্লাহ দয়া করেন না ঐ ব্যক্তির উপরে, যে মানুষকে দয়া করে না’।[17] অন্যত্র আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) বলেন, مَنْ لَمْ يَرْحَمْ صَغِيْرَنَا وَيَعْرِفْ حَقَّ كَبِيْرِنَا فَلَيْسَ مِنَّا- ‘যে ব্যক্তি আমাদের ছোটদের স্নেহ করে না এবং আমাদের বড়দের হক বুঝে না, সে ব্যক্তি আমাদের দলভুক্ত নয়’।[18] বস্ত্ততঃ পরস্পরকে দয়া করা এবং ছবর ও সৎকাজের উপদেশ দেয়া ঈমানের অন্যতম প্রধান দাবী। এর মাধ্যমে সমাজে সর্বদা মানবিক আবহ বিরাজ করে।

অত্র আয়াতের শুরুতে ثُمَّ (অতঃপর) শব্দ আনার মাধ্যমে পূর্বের তিনটি বস্ত্তর উপর পরবর্তী বস্ত্তগুলির উচ্চতর মর্যাদা বুঝানো হয়েছে। যেখানে ঈমান, ছবর ও দয়াশীলতার কথা বর্ণিত হয়েছে। কেননা ঈমান হ’ল সবকিছুর মূল। ছবর হ’ল বীরত্ব ও ন্যায়নিষ্ঠার চূড়ান্ত রূপ। আর দয়াশীলতা হ’ল আল্লাহর বিশেষ গুণ, যা সবকিছুর উপরে। কারু মধ্যে যখন এই গুণগুলি অর্জিত ও বিকশিত হয়, তখন তিনি হন সত্যিকারের মানুষ বা ইনসানে কামেল।

(১৮) أُوْلَئِكَ أَصْحَابُ الْمَيْمَنَةِ ‘এরাই হ’ল ডান সারির মানুষ’।

أَصْحَابُ الْمَيْمَنَةِ অর্থ أصحابُ الْيُمْنِ أو جهة اليمين ‘সৌভাগ্যবান অথবা ডান দিকের লোকেরা, যারা ক্বিয়ামতের দিন ডান হাতে আমলনামা পাবেন’।

অর্থাৎ উপরে বর্ণিত গুণাবলীসম্পন্ন মানুষ ক্বিয়ামতের দিন সৌভাগ্যশালীদের জন্য নির্ধারিত ডান সারিতে স্থান পাবে। ক্বিয়ামতের দিন মানুষকে তিন সারিতে ভাগ করা হবে। একটি হবে অগ্রগামী দল, একটি হবে দক্ষিণ সারির দল এবং একটি হবে বাম সারির দল। প্রথম দু’টি দল জান্নাতী হবে এবং বাম সারির লোকেরা জাহান্নামী হবে (ওয়াক্বি‘আহ ৫৬/৭-১২)। জান্নাতীদের ডান হাতে আমলনামা দেওয়া হবে এবং তাদের সহজ হিসাব নেওয়া হবে (বনু ইস্রাঈল ১৭/৭১; ইনশিক্বা্ক্ব ৮৪/৭-৮)

(১৯) وَالَّذِيْنَ كَفَرُوْا بِآيَاتِنَا هُمْ أَصْحَابُ الْمَشْأَمَةِ ‘আর যারা আমাদের আয়াতসমূহকে অস্বীকার করে, তারা হ’ল বাম সারির লোক’।

أَصْحَابُ الْمَشْأَمَةِ অর্থ أصحابُ الشُؤْمِ أو جهة الشمال ‘হতভাগা অথবা বাম দিকের লোকেরা, যাদের বাম হাতে আমলনামা দেয়া হবে’।

পাপিষ্ঠ কাফের-ফাসেক-মুনাফিকদের ক্বিয়ামতের দিন বাম সারিতে দাঁড় করানো হবে (ওয়াক্বি‘আহ ৫৬/৯,৪১)। এদের পিঠের পিছন দিয়ে বাম হাতে আমলনামা দেয়া হবে (ইনশিক্বাক্ব ৮৪/১০)। ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, এরাও ডান হাত বাড়িয়ে দেবে। বাম হাত বাড়াতে চাইবে না। ফলে পিছন দিক দিয়ে বাম হাতে আমলনামা দেয়া হবে (কুরতুবী)

(২০) عَلَيْهِمْ نَارٌ مُّؤْصَدَةٌ ‘তাদের উপরে থাকবে পরিবেষ্টিত অগ্নি’।

অর্থাৎ আগুন তাদেরকে চারদিক থেকে বেষ্টন করবে। কোনদিক দিয়ে তারা পালাবার পথ পাবে না। الوِصاد أو الإصاد অর্থ ‘বন্ধ’ أوصدتُ البابَ أى أغلقته ‘আমি দরজা বন্ধ করে দিয়েছি’ (কুরতুবী)। অতএব مُّؤْصَدَةٌ অর্থ نار مغلقة চারদিক দিয়ে বন্ধ বা পরিবেষ্টিত। যেমন অন্যত্র আল্লাহ বলেন, إِنَّهَا عَلَيْهِمْ مُّؤْصَدَةٌ، فِيْ عَمَدٍ مُّمَدَّدَةٍ ‘প্রজ্বলিত অগ্নি তাদেরকে বেষ্টন করে রাখবে, উঁচু উঁচু স্তম্ভসমূহে’ (হুমাযাহ ১০৪/৮-৯)

أجارنا الله منها بفضله وكرمه (আল্লাহ স্বীয় অনুগ্রহে ও দয়ায় আমাদেরকে উক্ত শাস্তি থেকে রক্ষা করুন!)।

সারকথা :

মানুষের জীবন কষ্টের আধার। শত কষ্টেও আললাহর উপরে বিশ্বাস দৃঢ় রাখতে হবে। সর্বাবস্থায় ধৈর্য ধারণ করতে হবে এবং মানুষের প্রতি দয়াশীল থাকতে হবে। তারাই হবে সৌভাগ্যশালী বান্দা। এর বিপরীত যারা, তারা হবে হতভাগা।


[1]. আহমাদ হা/২১৩৭১, বুখারী হা/৩৩৬৬, মুসলিম হা/৫২০।

[2]. ৮ম হিজরীর ১৭ই রামাযান মোতাবেক ৬৩০ খ্রিষ্টাব্দের ১লা জানুয়ারী মঙ্গলবার সকালে।

[3]. বুখারী হা/১৮৩৪, মুসলিম হা/১৩৫৩, মিশকাত হা/২৭১৫ ‘মানাসিক’ অধ্যায়-১০, ‘মক্কার হারাম’ অনুচ্ছেদ-১৪।

[4]. মুসলিম হা/১৯০৫, মিশকাত হা/২০৫।

[5]. বুখারী হা/৫৯২৭, ইবনু মাজাহ হা/১৬৩৮; মিশকাত হা/১৯৫৯।

[6]. বুখারী হা/২৫১৭, ৬৭১৫, মুসলিম হা/১৫০৯; মিশকাত হা/৩৩৮২।

[7]. বায়হাক্বী-শো‘আব; মিশকাত হা/৩৩৮৪, সনদ ছহীহ।

[8]. فَإِنْ لَمْ تُطِقْ فَأَطْعِمِ الجَائعَ বায়হাক্বী-শো‘আব; মিশকাত হা/৩৩৮৪, সনদ ছহীহ।

[9]. আহমাদ, মিশকাত হা/১৯৩৯; তিরমিযী হা/৬৫৮; নাসাঈ হা/২৫৮১; ইবনু মাজাহ হা/১৮৪৪; সনদ ছহীহ ।

[10]. বুখারী হা/৬০০৫, মিশকাত হা/৪৯৫২।

[11]. মালেক হা/৩৪৬৮, মুরসাল ছহীহ; মিশকাত হা/১৫৭৮।

[12]. তিরমিযী হা/২৩৯৬; মিশকাত হা/১৫৬৫; ছহীহাহ হা/১২২০।

[13]. বুখারী হা/৫৬৪১, মুসলিম হা/২৫৭২, মিশকাত হা/১৫৩৭।

[14]. তিরমিযী হা/২৩৯৯; ছহীহাহ হা/২২৮০; মিশকাত হা/১৫৬৭।

[15]. বুখারী হা/৭৫৫৪, মুসলিম হা/২৭৫১; মিশকাত হা/৫৭০০।

[16]. আবুদাউদ হা/৪৯৪১; তিরমিযী হা/১৯২৪; হাদীছ হাসান ছহীহ, মিশকাত হা/৪৯৬৯।

[17]. বুখারী হা/৭৩৭৬; মুসলিম হা/৬৬ ‘ফাযায়েল’ অধ্যায় মিশকাত ৪৯৪৭।

[18]. আবুদাউদ হা/৪৯৪৩; তিরমিযী হা/১৯২০; আহমাদ হা/৬৭৩৩, সনদ ছহীহ।