ফিরক্বা নাজিয়াহ

ফের্কাবন্দীর কারণ

(وَإِنَّهُ سَيَخْرُجُ فِيْ أُمَّتِيْ أَقْوَامٌ تَتَجَارَى بِهِمْ تِلْكَ الْأَهْوَاءُ كَمَا يَتَجَارَى الْكَلْبُ بِصَاحِبِهِ لاَ يَبْقَى مِنْهُ عِرْقٌ وَلاَ مَفْصِلٌ إِلاَّ دَخَلَهُ) ‘আর আমার উম্মতের মধ্যে সত্বর এমন একদল লোক বের হবে, যাদের মধ্যে প্রবৃত্তি পরায়ণতা এমনভাবে প্রবহমাণ হবে, যেভাবে কুকুরের বিষ আক্রান্ত ব্যক্তির সারা দেহে সঞ্চারিত হয়। কোন একটি শিরা বা জোড়া বাকী থাকে না, যেখানে উক্ত বিষ প্রবেশ করে না’।

এখানে افةراق الأمة বা উম্মতের বিভক্তির সর্বপ্রধান কারণ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে প্রবৃত্তিপরায়ণতাকে এবং তাকে কুকুরের বিষের সাথে তুলনা করা হয়েছে। لأن هوى الرجل هو الذي يحمله على الابتداع في العقيدة والقول والعمل ‘কেননা প্রবৃত্তিপরায়ণতা মানুষকে বিশ্বাস, কথা ও কর্মের মধ্যে বিদ‘আত সৃষ্টিতে প্ররোচনা দিয়ে থাকে’।

অত্র হাদীছে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন যে, সত্বর একদল লোক বের হবে, যারা হীন প্রবৃত্তি দ্বারা তাড়িত হবে এবং তারাই মানুষকে পথভ্রষ্ট করবে। এই লোকগুলি নিঃসন্দেহে ধর্মনেতা বা সমাজনেতা হবেন। যাদের কথা মানুষ শোনে ও যাদেরকে মানুষ অনুসরণ করে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর জীবদ্দশাতেই ভন্ডনবী[1] এবং তাঁর মৃত্যুর কিছুকালের মধ্যেই মুরতাদ ও যাকাত অস্বীকারকারীদের ফিৎনা শুরু হয় ধর্মনেতা ও সমাজনেতাদের মাধ্যমে। অতঃপর খারেজী, শী‘আ, মুরজিয়া, ক্বাদারিয়া, জাবরিয়া, মু‘তাযিলা প্রভৃতি বিদ‘আতী ও ভ্রান্ত দলসমূহের উদ্ভব ঘটে বড় বড় ধর্মনেতাদের মাধ্যমে। পরবর্তীতে মু‘তাযিলা মতবাদ আববাসীয় খলীফা মামূন, মু‘তাছিম ও ওয়াছিক বিল্লাহ প্রমুখ খলীফাদের (১৯৮-২৩২ হিঃ) স্কন্ধে সওয়ার হয়ে ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (১৬৪-২৪১ হিঃ) প্রমুখ আহলেহাদীছ বিদ্বানগণের উপরে অত্যাচারের বিভীষিকা চালায়। তবুও শুরু থেকেই ছাহাবা, তাবেঈন এবং আহলেহাদীছ বিদ্বানগণের দৃঢ় ভূমিকার ফলে ভ্রান্ত দলসমূহের অপতৎপরতায় ভাটা পড়ে। যদিও তাদের মতবাদের বিষাক্ত ধারা এখনো অনেক মুসলিম ও সুন্নী বিদ্বানের মধ্যে দেখতে পাওয়া যায়। যা সাধারণ মানুষকে অনেক সময় বিভ্রান্ত করে।

কুরআন ও সুন্নাহর উপরে নিজের জ্ঞান ও যুক্তিবাদকে অগ্রাধিকার দেওয়াকেই বলা হয় প্রবৃত্তিপরায়ণতা (تحكيم العقل علي النصوص)। যেমন আল্লাহ স্বীয় রাসূলকে বলেন, أَرَأَيْتَ مَنِ اتَّخَذَ إِلَهَهُ هَوَاهُ أَفَأَنْتَ تَكُوْنُ عَلَيْهِ وَكِيْلاً ‘তুমি কি দেখেছ ঐ ব্যক্তিকে, যে তার প্রবৃত্তিকে তার উপাস্য রূপে গ্রহণ করেছে? তুমি কি তার যিম্মাদার হবে? (ফুরক্বান ২৫/৪৩; জাছিয়াহ ৪৫/২৩)। যখন তাদের সামনে কুরআন-হাদীছের বিধান শুনানো হয়, তখন তারা দম্ভভরে মুখ ফিরিয়ে নেয় ও নিজের প্রবৃত্তির উপরে যিদ করে। যেমন আল্লাহ বলেন, وَإِذَا تُتْلَى عَلَيْهِ آيَاتُنَا وَلَّى مُسْتَكْبِرًا كَأَنْ لَمْ يَسْمَعْهَا كَأَنَّ فِي أُذُنَيْهِ وَقْرًا فَبَشِّرْهُ بِعَذَابٍ أَلِيْمٍ ‘যখন তার সামনে আমাদের আয়াত সমূহ পাঠ করা হয়, তখন সে দম্ভের সাথে এমনভাবে মুখ ফিরিয়ে নেয়, যেন সে তা শুনতেই পায়নি, যেন ওর দু’কান বধির। অতএব ওকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির সুসংবাদ দাও’ (লোকমান ৩১/৭)।

কেবল মুসলমানদের নয়, বরং মানবজাতির দলে দলে বিভক্তির কারণ হিসাবে আল্লাহর বিধানের বিরুদ্ধে মানুষের হঠকারিতাকেই দায়ী করা হয়েছে (বাক্বারাহ ২/২১৩)


[1]. ১০ম হিজরীতে ইয়ামামাহর নেতা মুসায়লামা কাযযাব এবং ইয়ামনের নেতা আসওয়াদ ‘আনাসী নবুঅতের দাবী করে। শেষোক্ত ব্যক্তি রাসূল (ছাঃ)-এর ওফাতের একদিন পূর্বে নিহত হয় এবং প্রথমোক্ত ব্যক্তি আবুবকর (রাঃ)-এর খেলাফতকালে ১২ হিজরীর রবীউল আউয়াল মাসে সংঘটিত ইয়ামামাহর যুদ্ধে নিহত হয় (আর-রাহীক্ব পৃঃ ৪৫২-৫৩)