ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ

আহলুল হাদীছ ও আহলুর রায়-এর রাজনৈতিক দর্শন

বাংলাদেশের মুসলমানগণ দু’টি দর্শনে বিভক্ত। (১) পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের আলোকে যারা জীবন পরিচালনা করেন, তারা ‘আহলুল হাদীছ’ বা ‘আহলেহাদীছ’ নামে পরিচিত। (২) পূর্বসুরী কোন বিদ্বানের রচিত ফিক্বহী উছূল বা ব্যবহারিক আইনসূত্রের আলোকে যারা জীবন পরিচালনা করেন, তারা ‘আহলুর রায়’ বা ‘হানাফী’ নামে পরিচিত।

উভয় দর্শনই ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের বিরোধী। কিন্তু উভয়ের মধ্যে রয়েছে মৌলিক দর্শনগত পার্থক্য। আহলেহাদীছগণ সকল বিষয়ে অহি-র বিধানকে চূড়ান্ত বলে বিশ্বাস করেন এবং মানবীয় জ্ঞানকে তার ব্যাখ্যাকারী ও সহযোগী মনে করেন। ব্যবহারিক ক্ষেত্রে তাঁরা তাক্বলীদপন্থী ফক্বীহ ও কট্টরপন্থী যাহেরী (LITERALIST) উভয়ের মধ্যবর্তী পথ অবলম্বন করেন।

পক্ষান্তরে আহলুর রায়গণ সকল ক্ষেত্রে মাযহাবী আক্বায়েদ ও ফিক্বহের তাক্বলীদ করেন এবং ব্যবহারিক ও আইন রচনার ক্ষেত্রে তাদের পূর্বসুরীদের রচিত উছূলে ফিক্বহের অনুসরণ করেন। উদাহরণ স্বরূপ : (১) বাংলাদেশের আহলুর রায় হানাফী মাযহাবের অধিকাংশ আলেমের নিকটে ‘আল্লাহ নিরাকার’ এবং শেষনবী ‘মুহাম্মাদ (ছাঃ) নূরের তৈরী’। (২) তারা তাদের অনুসৃত মাযহাবী ফিক্বহের প্রতি এবং নিজ মাযহাবের ইমাম ও তরীক্বার পীরের প্রতি অন্ধ তাক্বলীদ লালন করেন ও মাযহাব মান্য করাকে ‘ফরয’ বা অপরিহার্য বলেন। ফলে নিরপেক্ষভাবে ছহীহ হাদীছের বিধান মানতে তারা অনেক ক্ষেত্রে ব্যর্থ হন। (৩) মাযহাবী আনুগত্যের কারণে তারা ছহীহ হাদীছ মোতাবেক ছালাতও আদায় করতে পারেন না। এমনকি কুরআনী বিধানও মানতে পারেন না। যেমন (ক) ১৯৬১ সালে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ূব খান এক মজলিসে তিন তালাককে তিন তালাক বায়েন গণ্য করার বিদ‘আতী তালাকের বদলে তিন তালাককে তিন মাসে দেওয়ার কুরআনী বিধান জারি করেন। আহলেহাদীছগণ উক্ত আইন সমর্থন করেন। কিন্তু হানাফী রাজনৈতিক ও ধর্মীয় দলগুলি এর বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন করে। যদিও আইয়ূব খান তা মানেননি এবং আজও তাদের বিরোধিতা সত্ত্বেও বাংলাদেশে উক্ত পারিবারিক আইন চালু আছে।

(খ) ২০০১ সালের ১লা জানুয়ারী বাংলাদেশের হাইকোর্ট হানাফী সমাজে প্রচলিত ‘হিল্লা’ বিবাহকে অবৈধ ঘোষণা করেন এবং ঐ সাথে সকল প্রকার ফৎওয়া প্রদানকে বে-আইনী ঘোষণা করেন। ফলে হানাফী মাযহাবভুক্ত সকল ইসলামী দল এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হন। যদিও এক মজলিসে তিন তালাককে তিন তালাক গণ্য করা কুরআনী নির্দেশ (বাক্বারাহ ২/২২৯; তালাক ৬৫/১)-এর বিরোধী এবং তার পরিণতিতে ‘হিল্লা’ বিবাহের নামে জাহেলী যুগের নোংরা প্রথাকে সিদ্ধ করা স্পষ্টভাবেই ছহীহ হাদীছের বিরোধী।[1] ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’ হিল্লা বিবাহের বিরুদ্ধে হাইকোর্টের দেওয়া রায়কে সমর্থন করে। কিন্তু একে অজুহাত করে সকল প্রকার ফৎওয়া প্রদানকে বে-আইনী ঘোষণার প্রতিবাদ করে।[2]

উল্লেখ্য, যে ওমর (রাঃ)-এর দোহাই দিয়ে এক মজলিসে তিন তালাককে তিন তালাক বায়েন গণ্য করা হয়েছে, তিনিই এজন্য লজ্জিত হয়ে দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন।[3] আর এর পরিণতিতে যাতে মুসলমানদের মধ্যে হিল্লার ন্যায় জাহেলী প্রথা ঢুকে না পড়ে, সেজন্য তিনি কঠোরভাবে হুমকি দিয়ে বলতেন, لاَ أُوتَى بِمُحِلٍّ وَلاَ مُحَلَّلٍ لَهُ إلاَّ رَجَمْتُهُمَا ‘আমার কাছে কোন হিল্লাকারী পুরুষ ও নারীকে আনা হ’লে আমি উভয়কে রজম করব (অর্থাৎ বুক পর্যন্ত মাটিতে পুঁতে পাথর মেরে মাথা ফাটিয়ে হত্যা করব)’। আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাঃ) বলতেন, ذَلِكَ السِّفَاحُ، لَوْ أَدْرَكَكُمْ عُمَرُ لَنَكَّلَكُمْ ‘হিল্লা করা ব্যভিচার। যদি তোমাদেরকে ওমর পেতেন, তাহ’লে রজমের শাস্তি দিতেন’।[4] তিনি বলতেন, كُنَّا نَعُدُّ هَذَا سِفَاحًا عَلَى عَهْدِ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ‘রাসূল (ছাঃ)-এর যামানায় আমরা হিল্লা করাকে ব্যভিচার গণ্য করতাম’।[5] এমনকি তারা এভাবে বিশ বছর একত্রে বসবাস করলেও।[6]

এছাড়াও উপমহাদেশে চালু রয়েছে পীরপূজা ও কবরপূজা সহ হাযারো রকমের শিরকী ও বিদ‘আতী রসম-রেওয়াজ। যার প্রায় সবগুলিই ধর্মের নামে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে থাকে এবং রাজনৈতিক দলগুলি এসবকে তাদের ভোটের পুঁজি হিসাবে ব্যবহার করে। অথচ ইসলামের সাথে এসবের দূরতম কোন সম্পর্ক নেই। ফলে দেশের আইন রচনা ও তা প্রয়োগের ক্ষেত্রে উভয় দর্শনের সংঘাত অবশ্যম্ভাবী।

এক্ষেত্রে মিলনের একটাই পথ খোলা রয়েছে। সেটা হ’ল, মাযহাবী তাক্বলীদ পরিত্যাগ করে সালাফে ছালেহীন ও মুহাদ্দেছীনের মাসলাক অনুসরণে কুরআন ও হাদীছের ব্যাখ্যা করা এবং সকল বিষয়ে কিতাব ও সুন্নাতের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারকে মেনে নেওয়া। আহলেহাদীছ আন্দোলন যুগ যুগ ধরে এ পথেই উম্মতকে আহবান জানিয়ে এসেছে এবং আজও সে আহবান অব্যাহত রেখেছে। তাদের রাজনৈতিক দর্শন হ’ল, সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর বিধান অনুযায়ী সৃষ্টিকে পরিচালিত করা’। তাদের লক্ষ্য হ’ল, প্রচলিত সকল ব্যবস্থার উৎসাদন এবং পবিত্র কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহর আলোকে সমাজ ও রাষ্ট্র গঠন ও পরিচালন।


[1]. দারেমী হা/২২৫৮; নাসাঈ হা/৩৪১৬; তিরমিযী হা/১১১৯-২০; ইবনু মাজাহ হা/১৯৩৪-৩৫; মিশকাত হা/৩২৯৬ ‘বিবাহ’ অধ্যায় ‘তিন তালাকপ্রাপ্তা’ অনুচ্ছেদ; বঙ্গানুবাদ হা/৪০৬২। এ বিষয়ে পাঠ করুন, ‘হাদীছ ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ’ প্রকাশিত মাননীয় লেখকের ‘তালাক ও তাহলীল’ বই। -প্রকাশক

[2]. দ্রঃ মাসিক আত-তাহরীক, রাজশাহী, ৪র্থ বর্ষ ৫ম সংখ্যা, ফেব্রুয়ারী ২০০১ পৃঃ ৪২; দৈনিক সংগ্রাম ও দৈনিক ইনকিলাব, ঢাকা ১৪, ১৫ই জানুয়ারী ২০০১।

[3]. ইবনুল ক্বাইয়িম, ইগাছাতুল লাহফান (কায়রো : দারুত তুরাছ ১৪০৩/১৯৮৩) ১/২৭৬ পৃঃ।

[4]. মুছান্নাফ ইবনু আবী শায়বাহ হা/১৭৩৬৩, ১৭৩৬৫, সদন ছহীহ; আলবানী, ইরওয়া ৬/৩১১; বায়হাক্বী ৭/২০৮।

[5]. হাকেম হা/২৮০৬, ২/১৯৯ পৃঃ, সনদ ছহীহ; ইরওয়া হা/১৮৯৮।

[6]. ইরওয়া হা/১৮৯৮-এর আলোচনা, ৬/৩১১ পৃঃ। দুঃখের বিষয় এর বিপরীতে বলা হয়েছে যে, ‘হ্যাঁ, শর্তে আবদ্ধ না হইয়া যদি কেহ প্রথম স্বামীর উপকারার্থে বিবাহ করে এবং পরে ছাড়িয়া দেয় তাহাতে সে পুণ্য লাভ করিবে। হাদীছ তাহার প্রতি প্রযোজ্য নহে’ (বঙ্গানুবাদ মেশকাত শরীফ হা/৪০৬২-এর ব্যাখ্যা, ৬/৩২৩ পৃঃ)। মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন।