ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ

ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ ও তার কুফল

ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের প্রধান কুফল হ’ল মানুষকে দুনিয়াসর্বস্ব স্বার্থপর জীবে পরিণত করা। এই মতবাদের মূল কথাটি নিম্নের বাক্যে নিহিত রয়েছে।-

Religion should not be allowed to come into politics. It is merely a matter between man and god. (‘ধর্মকে রাজনীতির অঙ্গনে প্রবেশাধিকার দেওয়া উচিত নয়। এটি মানুষ ও ঈশ্বরের মধ্যেকার একটি (আধ্যাত্মিক) বিষয় মাত্র’)।

বৃটিশ বেনিয়া দার্শনিকদের শিখানো ‘ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ’ নামক এই মতবাদটি সাফল্যজনক ভাবে চালু করার ফলেই সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজরা সদ্য শাসনহারা মুসলিম শক্তিকে হতোদ্যম করতে এবং ১৯০ বছর যাবৎ বাংলাদেশ সহ পুরা ভারতবর্ষকে সুদীর্ঘকাল যাবৎ শাসন করতে সক্ষম হয়েছিল। বর্তমানে উপমহাদেশে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ কয়েকটি স্বাধীন দেশ থাকা সত্ত্বেও সেখানে রাষ্ট্রীয়ভাবে ইসলামের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিকগুলি চালু না থাকার অন্যতম প্রধান কারণ হ’ল উপরোক্ত মতবাদ। ফলে মুসলিম দেশে বসবাস করেও আমরা অমুসলিম দেশ সমূহের মত অনৈসলামী আইনে শাসিত হচ্ছি।

পৃথিবীতে প্রত্যেকটি দেশ তাদের জনগণের লালিত আক্বীদা-বিশ্বাস এবং কৃষ্টি ও সংস্কৃতি মোতাবেক রাষ্ট্রীয় আইন ব্যবস্থা গড়ে তুলে ও সেই অনুযায়ী তা পরিচালিত হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্য মুসলিম দেশগুলির জন্য যে, এই দেশগুলির শাসন ব্যবস্থায় তাদের নিজস্ব তাহযীব ও তামাদ্দুনের প্রতিফলন নেই। বরং দেশের সংবিধানের প্রতিটি পৃষ্ঠায় ও ছত্রে অনৈসলামী শাসন দর্শনের গোলামীর চেহারা প্রকটভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। জাহেলী আরবের কাফেররাও যেখানে আল্লাহর নামে শপথ নিত, সেখানে আমাদের দেশের মুসলিম এম.পি-মন্ত্রীরাও আল্লাহর নামে শপথ নেন না।[1] তথাকথিত উদারতাবাদের দোহাই পেড়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে ‘ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ’ নামক উক্ত মতবাদটির প্রচলন ঘটানো হয়েছে। যার মূল কথাই হ’ল রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে কোন ধর্মীয় আইন চলবে না, বরং পার্লামেন্টের গুটিকয়েক গুণী বা নির্গুণ সদস্য কিংবা সামরিক ডিক্টেটর প্রেসিডেন্ট নিজের খেয়াল-খুশীমত যা আইন করে দেবেন, সেটাই দেশের আইন বলে মেনে নিতে হবে। পৃথিবীতে ইসলাম ব্যতীত অন্য যতগুলি ধর্ম রয়েছে, কারু নিকটে আল্লাহ প্রেরিত অভ্রান্ত রাষ্ট্রদর্শন বা অর্থনৈতিক হেদায়াত মওজুদ নেই। তাই একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’র উক্ত মতবাদটি মূলতঃ ইসলামকেই মুসলমানের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জীবন থেকে বের করে দিয়ে আন্তর্জাতিক কুফরী চক্রের গোলামীর জিঞ্জীরে আবদ্ধ করার জন্য ফাঁদস্বরূপ তৈরী করা হয়েছে।

এই দর্শনের মারাত্মক কুফল হিসাবে মুসলমান তার আধ্যাত্মিক জীবনে আল্লাহর আইন ও বৈষয়িক জীবনে মানব রচিত আইন তথা নিজেদের জ্ঞান ও প্রবৃত্তিকে ইলাহ-এর আসনে বসিয়েছে। এই দর্শনের ফলশ্রুতি হিসাবে আমাদের নেতারা রাজনীতির মঞ্চে দাঁড়িয়ে সোচ্চার গলায় শিরকী কালাম উচ্চারণ করে বলেন, ‘জনগণই সার্বভৌম ক্ষমতার উৎস’, ‘অধিকাংশের রায়ই চূড়ান্ত’। একই কারণে সূদভিত্তিক হারামী অর্থনীতি রাষ্ট্রীয়ভাবে চালু করতে এবং দেশবাসীকে ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় হারামখোর বানাতেও আমাদের মুসলিম নেতাদের অন্তর আল্লাহর গযবের ভয়ে প্রকম্পিত হয় না, যেহেতু এগুলি বৈষয়িক ব্যাপার।

পক্ষান্তরে যারা দেশের রাজনৈতিক ও বৈষয়িক ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামান না বরং সারা বছর বিদ‘আতী দাওয়াতে ঘুরে বেড়ান ও বছরে একদিন ‘আখেরী মুনাজাতে’ লাখো মানুষের ঢল নামান,[2] কিংবা আলীশান খানক্বাহে বসে মা‘রেফাতের সবক দেন, কিংবা বার্ষিক ওরস-ঈছালে ছওয়াব ও প্রাত্যহিক নযর-নেয়াযের দৈনিক ব্যালান্স হিসাব করায় সদা ব্যস্ত থাকেন, তাঁরাই এদেশে ‘দ্বীনদার’ বলে খ্যাত। জানিনা এঁরা শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) ও তাঁর মহান খলীফাগণকে ‘দ্বীনদার’ বলবেন না ‘দুনিয়াদার’ বলবেন।


[1]. প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, প্রধান বিচারপতি ও সংসদ সদস্যসহ সকলের ক্ষেত্রে সংবিধানে একই ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে যে, ‘আমি সশ্রদ্ধচিত্তে শপথ (বা দৃঢ়ভাবে ঘোষণা) করিতেছি যে, ...’। কিন্তু কার নামে শপথ করছি, সেকথা বলা হয়নি। দ্রঃ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান, তৃতীয় তফসিল, ১৪৮ অনুচ্ছেদ, শপথ ও ঘোষণা পৃঃ ১৪৬।

[2]. ‘আখেরী মুনাজাত’ নামে পরিচিত দলবদ্ধ মুনাজাত একটি বিদ‘আতী প্রথা মাত্র। মক্কার মাসজিদুল হারামে, মদীনার মসজিদে নববীতে বা হজ্জের ময়দানে কোথাও এর কোন অস্তিত্ব নেই। এই ধরনের মুনাজাতে আত্ম নিবেদনের চাইতে ‘রিয়া’ থাকে বেশী। হাদীছে একাকী মুনাজাতের কথা এসেছে, দলবদ্ধ মুনাজাত নয়। অতএব এ থেকে বিরত থাকা কর্তব্য।