দাওয়াত ও জিহাদ

উপসংহার

১৯৮৬ সালের ২২শে অক্টোবরে রাজশাহীতে অনুষ্ঠিত ‘আহলেহাদীছ যুবসংঘে’র তিনদিন ব্যাপী কেন্দ্রীয় কাউন্সিল সদস্য সম্মেলন উদ্বোধন করতে গিয়ে আমরা সমাজ বিপ্লবের তিনটি ধারার উপরে আলোচনার সাথে সাথে এ দেশে প্রচলিত তিনটি মতবাদ সম্পর্কে সকলকে হুঁশিয়ার করেছিলাম। জানিনা বিগত সোয়া চার বছরে আমরা এ ব্যাপারে কতটুকু এগোতে পেরেছি। তবে গত ১৯৮৯ ও ৯০-এর পৌনে দু’বছরে আমাদের উপর দিয়ে ঈমানের যে পরীক্ষা চলেছে, তাতে অনেক সামনের কর্মী পিছনে গিয়েছেন, অনেক পিছনের কর্মী সামনে এসেছেন। কেউবা ছিটকে পড়েছেন। সমাজ বিপ্লবের আদর্শে অনুপ্রাণিত কর্মীগণ এটিকে পরীক্ষার ক্রান্তি কাল হিসাবে গণ্য করেন এবং সমাজ পরিবর্তনের স্থির লক্ষ্যে চলার পথে এগুলিকে এক একটি বাধা বা পরীক্ষা বলে বিশ্বাস করেন। সমাজ বিপ্লবের জন্য আমরা সেদিন দু’টি বিষয়কে আবশ্যিক পূর্বশর্ত হিসাবে নির্ধারণ করেছিলাম।-

১- আক্বীদায় বিপ্লব আনা ২- নির্ভেজাল তাওহীদী আক্বীদায় বিশ্বাসী নিবেদিত প্রাণ বিপ্লবী কর্মীদের একটি জামা‘আত গঠন করা। প্রথমোক্ত বিষয়টির সহজ সরল ব্যাখ্যা হ’ল মুসলিম হিসাবে আমাদের জীবনের সকল দিক ও বিভাগ কেবলমাত্র আল্লাহর বিধান মোতাবেক হবে, ত্বাগূতের বিধান অনুযায়ী নয়, এ আক্বীদা দৃঢ়ভাবে পোষণ করা। জীবনের একটি দিক অহি-র বিধান মোতাবেক হবে, আরেকটি দিক ত্বাগূতী মতবাদ অনুযায়ী  হবে, এই দ্বিমুখী আক্বীদা ডাষ্টবিনে ছুঁড়ে ফেলতে হবে। এই নির্ভেজাল ঈমান ও আক্বীদাকে দুনিয়াবী স্বার্থের বিনিময়ে বিক্রি করা চলবে না। মসজিদে ছালাত আদায়ের সময়ে যেমন আমরা ছহীহ হাদীছের সঙ্গে কোন মাযহাবী ফিক্বহের আপোষ করি না, রাজনীতির ময়দানে তেমনি আমরা পাশ্চাত্যের শেরেকী গণতন্ত্র ও অন্যান্য মন্ত্রতন্ত্রের সঙ্গে আপোষ করতে পারি না। আপোষ করতে পারি না অর্থনীতির ময়দানে ধিকৃত পুঁজিবাদ ও সমাজবাদের সাথে। আমরা নির্ভেজাল ইসলামী রাজনীতি চাই, রাজনৈতিক ইসলাম নয়। আমরা কুরআন ও ছহীহ হাদীছের নির্ভেজাল ইসলাম চাই, মিশ্রিত ইসলাম নয়। বিভিন্ন শেরেকী ও বিদ‘আতী রসম-রেওয়াজে অভ্যস্ত বর্তমান মুসলিম সমাজ ও সরকার ইসলামের যে অংশটুকু পালনে বাধা দেয়, সেটুকু আমরা পালন করি না, কিংবা অজুহাত দিয়ে বাঁচবার চেষ্টা করি। অথচ ইসলামের দাবী ছিল সমাজ ও সরকারের নিকটে আমরা আমাদের ধর্মীয় বিশ্বাস ও আক্বীদাকে বিকিয়ে দেব না। আমরা আমাদের দ্বীনী ও দুনিয়াবী জীবনের জন্য দু’জন রাসূল দাবী করতে পারি না। বরং জীবনের সকল দিক ও বিভাগের জন্য মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কেই আমরা আমাদের একমাত্র নবী ও হা-দী হিসাবে বিশ্বাস করি। যে সমাজ বা সংগঠন বা সরকার আমাদের ইসলামী আক্বীদা অনুযায়ী আমল করতে বাধা দেয়, তার বিরুদ্ধে সর্বাত্মক জিহাদে জান-মাল উৎসর্গ করাই মুসলিম জীবনের চূড়ান্ত কর্তব্য বলে আমরা মনে করি।

দ্বিতীয় বিষয়টি সম্পর্কে বলা চলে যে, চিরকাল অল্পসংখ্যক যোগ্য ও নিবেদিতপ্রাণ লোকের দ্বারাই অধিক সংখ্যক লোক পরিচালিত হয়েছে। ঐ নিবেদিতপ্রাণ লোকগুলি যখন বাতিলপন্থী হয়, তখন সমাজে বাতিল প্রতিষ্ঠিত হয়। বাকী ৯৫ শতাংশ লোক ইচ্ছায় অনিচ্ছায় তাদের অনুসারী হয়। আর যখন তারা হকপন্থী হয়, তখন সমাজে হক প্রতিষ্ঠিত হয়। বলা বাহুল্য ‘আহলেহাদীছ যুবসংঘ’ ও ‘আহলেহাদীছ মহিলাসংস্থা’ প্রতিষ্ঠার মূলে আমাদের মূল প্রেরণা ছিল এটাই। এর বাইরে আমরা তখন কিছু জানতাম না। আজও জানিনা। জানিনা বিগত কয়েক বৎসরের চেষ্টায় আমরা কতজন বিপ্লবী কর্মী সৃষ্টি করতে পেরেছি। তবে আমাদের আন্দোলন যে ইতিমধ্যে বাতিলের হৃদয়ে দুরু দুরু কম্পনের সৃষ্টি করেছে, তা বেশ স্পষ্ট হয়ে গেছে। এতদিন বাইরের হুমকি মুকাবিলা করছিলাম, এখন আভ্যন্তরীণ হিংসার মুকাবিলা করতে হচ্ছে। ১৯৪৯ সালে এই নওদাপাড়াতে অনুষ্ঠিত ‘নিখিল বঙ্গ ও আসাম জমঈয়তে আহলেহাদীছ’ কনফারেন্সে আহলেহাদীছ আন্দোলনের অকুতোভয় সেনানী মাওলানা আব্দুল্লাহেল কাফী (১৯০০-১৯৬০খৃঃ) তাঁর ভাষণে বলেছিলেন, ‘বর্তমানে আহলেহাদীছ আন্দোলন আন্দোলনের পরিবর্তে একটি ফির্কায় পরিণত হয়েছে। এই জামা‘আতের যে কিছু করণীয় আছে বা এর অস্তিত্বের যে কোন প্রয়োজন আছে, তা অনুমান করাও কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে’[1]। তিনি বলেন, ‘আহলেহাদীছ নামধারী আমাদের অনেক বন্ধুর এ আন্দোলন সম্বন্ধে ধারণা একান্ত অস্পষ্ট ও ধুম্রাচ্ছন্ন-তন্দ্রাবিজড়িতের স্বপ্নবৎ। কেউ কেউ এ আন্দোলনের মূলনীতিতেই বিশ্বাস করেন না। কেউ কেউ আমাদের পূর্বপুরুষদের রক্তসিঞ্চিত এই আমানতের নাম ভাঙিয়ে খাচ্ছেন। আমাদের মধ্যে কর্মবিমুখতা ও দায়িত্বহীনতার সঙ্গে তাক্বলীদ ও দলবন্দীর অভিশাপ প্রবেশ করেছে’।[2] মাওলানার অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ এই বাস্তব ও তিক্ত সত্য কথাগুলি অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করার জন্য আমরা সকল পর্যায়ের আহলেহাদীছগণের নিকটে আকুল আবেদন জানাচ্ছি।

পরিশেষে আমি বাংলাদেশে আহলেহাদীছ আন্দোলনের সার্বিক অগ্রগতি ও আজকের সম্মেলনের সার্বিক সফলতার জন্য আল্লাহর তাওফীক প্রার্থনা করে আল্লাহর নামে এই মহতী জাতীয় সম্মেলন’৯১ ও তাবলীগী ইজতেমার শুভ উদ্বোধন ঘোষণা করছি।


২৫ ও ২৬. আহলেহাদীস পরিচিতি (ঢাকা: ৯৮ নওয়াবপুর রোড, ২য় সংস্করণ ১৯৮৩ ইং), পৃঃ ৯৭ ও ১০৫।