ইহসান ইলাহী যহীর

রাজনীতিতে যোগ দেয়ার কারণ

আল্লামা ইহসান ইলাহী যহীর (রহঃ) নিছক ক্ষমতালিপ্সার বশবর্তী হয়ে রাজনীতিতে জড়াননি; বরং পাকিস্তানে ইসলামী শরী‘আহ বাস্তবায়নের জন্য এটিকে আল্লাহ্র পথে দাওয়াতের একটা ক্ষেত্র হিসাবে তিনি এটাকে বেছে নিয়েছিলেন। তিনি রাজনীতিতে জড়িত থাকা অবস্থায় আক্বীদার ব্যাপারে কখনো আপোষ করেননি। আহলেহাদীছ চিন্তাধারার প্রচার-প্রসারে ও নিজেকে আহলেহাদীছ বলে পরিচয় দিতে তিনি কখনো বিন্দুমাত্র কুণ্ঠিত হননি। রাজনৈতিক অঙ্গনে তাঁর উপস্থিতি সকল শ্রেণীর মানুষের কাছে আহলেহাদীছদেরকে পরিচিত করেছিল- এতে কোন সন্দেহ নেই।[1]

২. তিনি মনে করতেন যে, ইসলাম সকল যুগ-কাল ও জীবনের সর্বক্ষেত্রে প্রযোজ্য একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। রাষ্ট্রীয় অঙ্গন থেকে ধর্মকে বিদায় দিয়ে (فصل الدين عن الدولة) ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদ প্রতিষ্ঠা করার বিরুদ্ধে তিনি সর্বদা উচ্চকণ্ঠ ছিলেন। ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদকে তিনি ইসলামের বিরুদ্ধে সুগভীর ষড়যন্ত্র বলে মনে করতেন।[2]

 

৩. রাজনীতির ময়দানে সক্রিয় থাকাকালে তিনি কখনো সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ (الأمر بالمعروف والنهي عن المنكر) থেকে বিরত থাকেননি; বরং যখনই রাজনীতিবিদ ও রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে শরী‘আত বিরোধী কোন কাজ সংঘটিত হতে দেখেছেন তখনই নির্ভীকচিত্তে দৃপ্তকণ্ঠে তার প্রতিবাদ করেছেন।

যেমন- (ক) একবার এক স্থানে কয়েকজন মন্ত্রী একত্রিত হয়েছিলেন। পাকিস্তানের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রীও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। আললামা যহীর সেখানে শিরক ও ব্রেলভীদের সম্পর্কে বক্তব্য দেয়া শুরু করেন। অথচ উপস্থিতির মধ্যে অধিকাংশই ব্রেলভী ছিলেন এবং অনেক মন্ত্রীও ব্রেলভীদের দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। তিনি সেখানে বলেন, ‘ব্রেলভীরা মৃত ব্যক্তিদের নিকট সাহায্য চায় এবং এতদুদ্দেশ্যে তাদের কবর যিয়ারত করে। এটা প্রকাশ্য শিরক’। তাঁর বক্তব্য শুনে অনেকে বলা শুরু করে, যদি এটাই ওহাবীদের আক্বীদা হয়, তাহলে আমরাও ওহাবী। কারণ আমাদের অনেকেই মৃত ব্যক্তির নিকট সাহায্য চাওয়া এবং এজন্য তাদের কবর যিয়ারত করায় বিশ্বাস করে না। তাছাড়া ব্রেলভীদের বিরুদ্ধে ‘আল-ব্রেলভিয়া আক্বাইদ ওয়া তারীখ’ নামে তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ লিখেছিলেন। যদি ক্ষমতার প্রতি মোহাবিষ্ট হয়ে তিনি রাজনীতি করতেন, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে এ ধরনের বই লিখে তাদের ক্রোধের পাত্র হতেন না। কারণ সে সময় অনেক মন্ত্রী ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ছাড়াও সাধারণ অনেক মানুষ ব্রেলভী মতবাদে বিশ্বাসী ছিল।[3]

 

খ. একদিন পাঞ্জাবের জনৈক গভর্ণর (সম্ভবতঃ গোলাম মোস্তফা খার) আলেমদেরকে ডেকে তাদেরকে গালি-গালাজ করে শাসান এবং অসম্মান করেন। সেখানে যহীরও উপস্থিত ছিলেন। গভর্ণর তাঁর বক্তব্য শেষ করলে নির্ভীক আল্লামা যহীর তাঁর বক্তব্যের প্রতিবাদ করেন এবং আলেমদেরকে অসম্মান করার পরিণতি ভাল হবে না বলে উল্টো গভর্ণরকে হুঁশিয়ার করে দেন। তাঁর এই সাহসী ভূমিকার জন্য আলেমরা তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।[4]

গ. পাঞ্জাবের আরেকজন গভর্ণর ছূফী মতবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি ৫ম শতকের লাহোরের খ্যাতিমান ছূফী আলী হুজূরী লাহোরীর (মৃঃ ৪৬৫ হিঃ) কবরে গিয়ে বরকত হাছিল করতেন এবং গোলাপপানি দিয়ে তার কবর ধুয়ে দিতেন। আল্লামা যহীর তাকে এ শিরকী ও শরী‘আত বিরোধী কাজ থেকে বিরত থাকতে বলেন।[5]

৪. যুলফিকার আলী ভুট্টো তাঁকে তাঁর পসন্দমত যেকোন আরব রাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত হওয়ার এবং জেনারেল যিয়াউল হক ধর্মমন্ত্রী করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন।[6] এসব প্রস্তাবকে পাকিস্তানে ইসলামী শরী‘আহ বাস্তবায়নের আন্দোলন এবং সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ থেকে বিরত রাখার একটা সস্তা মূল্য ও অপকৌশল মনে করে তিনি এ দু’টি প্রস্তাবই ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। যদি তিনি ক্ষমতাগৃধুণ হতেন তাহলে এসব লোভনীয় প্রস্তাব কখনই ফিরিয়ে দিতেন না।

৫. জেনারেল যিয়াউল হক তাঁকে ওলামা এডভাইজারী কাউন্সিলের সদস্য করেছিলেন। তিনি পাকিস্তানে ইসলামী শরী‘আহ বাস্তবায়নে আন্তরিক ভেবেই আল্লামা যহীর এই কাউন্সিলে যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর ভাষায় ‘যখন আমার এই দৃঢ় প্রত্যয় জন্মালো যে, জেনারেল মুহাম্মাদ যিয়াউল হক ইসলামী শরী‘আহ বাস্তবায়নে আন্তরিক নন, তখন আমি এডভাইজারী কাউন্সিলের সদস্যপদ থেকে ইস্তেফা দিয়েছিলাম। (১০/১২ জন আলেমের মধ্যে) আমিই একমাত্র সদস্য ছিলাম, যে নিজেই এডভাইজারী কাউন্সিলকে ত্যাগ করেছিল। আমার সাথে অন্য যে ব্যক্তিরা সেই কাউন্সিলে ছিল তাদেরকে এডভাইজারী কাউন্সিলই পরিত্যাগ করেছিল। তারা শেষাবধি ওটাকে আঁকড়ে ধরেছিল’।[7]

এডভাইজারী কাউন্সিল ত্যাগের পর তিনি যিয়াউল হকের তীব্র বিরোধিতা শুরু করেন। তিনি তাঁকে বলতেন, ‘যদি আপনি কথায় নয় বাস্তবে ইসলামী শরী‘আহ বাস্তবায়ন করেন, তাহলে আমি কস্মিনকালেও আপনার বিরোধিতা করব না’।[8]

মোটকথা, পাকিস্তানে ইসলামী শরী‘আহ বাস্তবায়নের ঈপ্সিত লক্ষ্যকে সামনে রেখেই তিনি রাজনীতিতে পদার্পণ করেছিলেন, কিন্তু তাঁর সেই উদ্দেশ্য সফল হয়নি। বরং  এতে আহলেহাদীছ আন্দোলন কিছুটা হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।[9]


[1]. The life of Shaykh Ihsan Ilahi Zahir, P. 77.

[2]. ‘আল-ইস্তিজাবা’, সংখ্যা ১২, যুলহিজ্জাহ ১৪০৭ হিঃ, পৃঃ ৩৫।

[3]. ড. যাহরানী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ২২৭-২৮।

[4]. ঐ, পৃঃ ৫২-৫৩।

[5]. ঐ, পৃঃ ৫৩।

[6]. The life of Shaykh Ihsan Ilahi Zahir, p. 78.

[7]. মুমতায ডাইজেস্ট, বিশেষ সংখ্যা-১, পৃঃ ৫৭।

[8]. ড. যাহরানী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ৫১।

[9]. রাজনীতিতে যোগদান করাই ছিল তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল।- সম্পাদক।