ইবাদত ও ইত্বা‘আত-এর পার্থক্য:
হাফেয ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) ইবাদতের ব্যাখ্যায় বলেন,العبادة هى غاية المحبة مع غاية الذل- অর্থাৎ ‘চরম ভক্তি চরম বিনয়ের মাধ্যমে প্রকাশ করাকে ইবাদত বলা হয়’। আর ইত্বা‘আত অর্থ আনুগত্য। ইত্বা‘আত ও ইবাদত-এর মধ্যে আম-খাছ সম্পর্ক। ইত্বা‘আত বা আনুগত্য ‘আম বা সাধারণ অর্থে ব্যবহৃত হয়, যা আল্লাহ ও বান্দা সকলের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। কিন্তু ইবাদত বা উপাসনা কেবলমাত্র আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট। সূরা মু’মিনূন ৪৭ আয়াতে হযরত মূসা ও হারূণ সম্পর্কে ফেরাউন ও তার পারিষদবর্গ যে وَقَوْمُهُمَا لَنَا عَابِدُوْنَ (তাদের কওম আমাদের দাসত্বকারী) বলা হয়েছে, সেখানে ‘ইবাদত’ মূল (হাক্বীক্বী) অর্থে ব্যবহৃত হয়নি, বরং ভাবার্থে (মাজাযী) ব্যবহৃত হয়েছে। হাদীছে ইহুদী-নাছারাদের তাদের পীর-পুরোহিতদের প্রতি অন্ধ তাক্বলীদ সম্পর্কে বলতে গিয়ে تلك عبادتهم (ওটাই তাদের ইবাদত হ’ল) বলে যা বলা হয়েছে, সেটাও ভাবার্থে। নইলে মানুষ যে কখনও আল্লাহর আসনে বসতে পারে না, সে কথা সবাই বলবেন। এক্ষণে পিতার আনুগত্য, নেতার আনুগত্য, শিক্ষকের আনুগত্য, সরকারের আনুগত্য, সব কিছুকে যদি আল্লাহর আনুগত্য বা ইবাদতের সঙ্গে এক করে দেখা হয়, তাহ’লে তো পরোক্ষভাবে আল্লাহর সঙ্গে অন্য সকলকেও মা‘বূদের আসনে বসানো হয়। যেমন বলা হয়েছে,
پرستش در اصل بندگى كى فرع ھے اور اپنى عين فطرت كے اقتضاء سـے اپنى اصل كے ساتهـ رهنا چاهتى ھے- جب انسان اپنى جھل اور بے خبرى كى بنا پر فرع كو اصل سے جدا كرتا ھے- بنذگى ايك كى كرتا هے اور پرستش دوسرى كى- تو يه تفريق سراسر فطرت كے خلاف واقع هوتى ھے-
উপাসনা বা ইবাদত আসলে আনুগত্য বা ইত্বা‘আতের শাখা মাত্র যা স্বাভাবিক তাকীদেই তার মূলের সঙ্গে মিলে থাকতে চায়। মানুষ যখন স্বীয় মূর্খতা ও উদাসীনতার কারণে শাখাকে মূল হ’তে পৃথক করে ফেলে- আনুগত্য একজনের করে, উপাসনা অন্যের করে, তখন এই পৃথকীকরণ সম্পূর্ণ স্বভাব বিরুদ্ধ প্রমাণিত হয়’।[1] মোটকথা উপাসনা ও আনুগত্য একই সত্তার নিকট নিবেদন করতে হবে।
উপরোক্ত ব্যাখ্যা গ্রহণের ফলে যে কোন গুনাহ্গার ব্যক্তিকে কাফির বা মুশরিক বলতে হয়। কেননা ঐ ব্যক্তি নিশ্চয়ই নিজের নফসের হুকুমে বা অন্য কারও হুকুমে গুনাহ করেছে। এতে করে সাময়িকভাবে হ’লেও সে ঐগুলিকে মা‘বূদের আসনে বসিয়েছে এবং তার ইবাদত করায় মুশরিক গণ্য হয়েছে। খারেজীদের মতে গুনাহে কবীরায় লিপ্ত ব্যক্তি তওবা না করে মরলে কাফির ও চিরস্থায়ী জাহান্নামী হবে।
রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে এই ব্যাখ্যার ফল দাঁড়াবে এই যে, ধর্মনিরপেক্ষ কোন শাসক বা সরকারের আনুগত্য নিষিদ্ধ গণ্য হবে। কেননা ঐ শাসক বা সরকার যদি মুসলিমও হয়, তথাপি তার রাজনৈতিক আনুগত্য যেহেতু আল্লাহর নিকটে থাকে না, সেহেতু ঐ সরকার মুশরিক গণ্য হবে। আর মুশরিক সরকারের আনুগত্য করলে যেহেতু তাকে অন্যতম মা‘বূদ-এর আসনে বসানো হবে, সেহেতু ঐ মা‘বূদকে উৎখাত করাই তখন মুমিন প্রজা সাধারণের সর্বাপেক্ষা বড় জিহাদ হিসাবে পরিগণিত হবে। ফলে সরকার ও জনগণের মধ্যে গৃহযুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়বে, যা রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে ছিন্ন ভিন্ন করে দেবে। ইসলাম নিশ্চয়ই তা চায় না।
পক্ষান্তরে ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলে সেই ইসলামী সরকারের বিরোধিতা করাও আরেক ধরনের শিরক হিসাবে গণ্য হবে। কেননা ইবাদত ও ইত্বা‘আত যখন একই অর্থে ব্যবহৃত হবে, তখন ইসলামী সরকারের আনুগত্য আল্লাহর আনুগত্য হিসাবে বিবেচিত হবে। ইসলামের নামে ইসলামী সরকারের যে কোন কাজই নির্বিবাদে মেনে নিতে হবে। টুঁ শব্দটি করলেই আনুগত্যহীনতার দায়ে কাফির বা মুশরিক সাব্যস্ত হয়ে মৃত্যুদন্ডের আসামীতে পরিণত হ’তে হবে। সেও অবশ্যম্ভাবীরূপে আরেক বিশৃংখলার জন্ম দিবে, যা কখনই ইসলামের কাম্য নয়। উমাইয়া, আববাসীয় ও তাদের পরবর্তী মুসলিম শাসকদের সময়ে হকপন্থী ওলামায়ে কেরামের উপরে নির্মম সরকারী নির্যাতন সমূহ আমাদেরকে বারবার উক্ত কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। এ ক্ষেত্রে আমরা যদি ইবাদতকে আল্লাহর জন্য এবং ইত্বা‘আতকে অন্যের জন্য গণ্য করি, তাহ’লে সরকারকে কাফির-মুশরিক না বলেও আমরা তার সমালোচনা করতে পারি।[2][1]. তাফহীমাত, ১/৬৩ পৃঃ।
[2]. দ্র: মুসলিম, মিশকাত হা/৩৬৭১ ‘নেতৃত্ব ও বিচার’ অধ্যায়, হাদীছ উম্মে সালামাহ (রাঃ) হ’তে।