একত্রিত তিন তালাক
কুরআনী নীতি অনুযায়ী তিন তুহরে তালাক না দিয়ে যদি কেউ অন্যায়ভাবে একই সাথে তিন তালাক দেয়, তবে সে তালাক বর্তাবে কি-না, এ বিষয়ে বিদ্বানগণের মতভেদকে চারভাগে বিভক্ত করা যায়। একদল বিদ্বান বলেন, এর দ্বারা কিছুই বর্তাবে না। ২য় দল বলেন, তিন তালাক পতিত হবে। কিন্তু ঐ ব্যক্তি গোনাহগার হবে। ৩য় দল বলেন, সহবাসকৃত নারীর উপরে তিন তালাক বর্তাবে ও সহবাসহীন নারীর উপরে এক তালাক বর্তাবে। ৪র্থ দল বলেন, এক তালাক রাজ‘ঈ হবে। নিম্নে চার দলের বক্তব্য সমূহ সংক্ষেপে আলোচিত হ’ল।-
১ম দলের দলীল সমূহ : তাঁদের মূল দলীল (ক) সূরায়ে বাক্বারাহ ২২৮-২৯ ও সূরায়ে তালাক ১ম ও ২য় আয়াত। অতঃপর (খ) হাদীছের দলীল হ’ল-
عَنِ ابْنِ عُمَرَ أَنَّهُ طَلَّقَ امْرَآَتَهُ وَهِىَ حَائِضٌ فِى عَهْدِ رَسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَسَأَلَ عُمَرُ رَسُوْلَ للهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَنْ ذَلِكَ، فَقَالَ: مُرْهُ فَلْيُرَاجِعْهَا، ثُمَّ لِيُمْسِكْهَا حَتَّى تَطْهُرَ، ثُمَّ تَحِيْضَ ثُمَّ تَطْهُرَ ثُمَّ إِنْ شَاءَ أَمْسَكَ بَعْدُ وَإِنْ طَلَّقَ قَبْلَ أنْ يَمَسَّ، فِتِلْكَ الْعِدَّةُ الَّتِىْ أَمَرَ اللهُ أَنْ تُطَلَّقَ لَهَا النِّسَاءُ، متفق عليه-
وفى روايةٍ اللبخارى: وَحُسِبَتْ تَطْلِيْقَةٌ، وفىِ رواية لمسلم: قَال عَبْدُ اللهِ بْنُ عُمَرَ: فَرَدَّهَا عَلىَّ وَلَمْ يَرَهَا شَيْئاً، وَقَالَ: إِذاَ طَهُرَتْ فَلْيُطَلِّقْ أَوْ لِيُمْسِكْ-
‘আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর যামানায় স্বীয় স্ত্রীকে ঋতুকালীন সময়ে তালাক দেন। তখন ওমর (রাঃ) উক্ত বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে জিজ্ঞেস করেন। তিনি ওমর (রাঃ)-কে বলেন, আপনি আব্দুল্লাহ্কে বলুন যেন সে তার স্ত্রীকে ফিরিয়ে নেয় ও ঘরে রাখে পরবর্তী তুহর পর্যন্ত। অতঃপর সে পুনরায় ঋতুবর্তী হবে ও ঋতুমুক্ত হবে। তখন ইচ্ছা করলে সে তাকে রেখে দিবে অথবা সহবাসের পূর্বেই তালাক দিবে। এটাই হ’ল ইদ্দত তালাকপ্রাপ্তা নারীদের জন্য, যা আল্লাহ নির্ধারণ করেছেন’ (বুখারী ও মুসলিম)। বুখারীর অপর বর্ণনায় এসেছে ‘ঋতুকালীন অবস্থার উক্ত তালাককে এক তালাক গণ্য করা হয়’। মুসলিম-এর অন্য বর্ণনায় এসেছে, আবদুল্লাহ ইবনে ওমর বলেন, অতঃপর আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) স্ত্রীকে আমার নিকটে ফিরিয়ে দিলেন এবং ‘তিনি এটাকে কিছুই গণ্য করলেন না’ এবং বললেন, যখন সে ঋতুমুক্ত হবে, তখন তাকে তালাক দাও অথবা রেখে দাও’।[1]
অর্থাৎ ইবনু ওমর (রাঃ) ঋতুকালীন সময়ে স্ত্রীকে তালাক দিলে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) তাকে ফিরিয়ে নিতে বলেন এবং ‘তিনি এটাকে কিছুই গণ্য করেননি’ (আহমাদ, আবু দাঊদ, নাসাঈ)। কেননা এটি নিয়ম বহির্ভূত ছিল। নিয়ম হ’ল স্ত্রীকে তার পবিত্রতার শুরুতে সহবাসহীন অবস্থায় তালাক প্রদান করা। [2] অনুরূপভাবে সুন্নাতী তরীকার বাইরে একত্রিতভাবে তিন তালাক দিলে তাকে কিছুই গণ্য করা হবে না।
উল্লেখ্য যে, ইবনু ওমর (রাঃ)-এর নিজস্ব রায় একত্রিত তিন তালাককে তিন তালাক গণ্য করার পক্ষে ছিল বলে কেউ কেউ মন্তব্য করেছেন। কিন্তু এটাও বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি পরে তার উক্ত রায় হ’তে প্রত্যাবর্তন করেন এবং তিন তালাককে এক তালাক গণ্য করেন’ (যেমন উপরে উল্লেখিত বুখারীর অপর বর্ণনায় ঋতুকালীন তালাককে এক তালাক গণ্য করার কথা এসেছে)।[3] তাছাড়া ‘ছাহাবীর মরফূ রেওয়ায়াত তার নিজস্ব মতামতের বিপরীতে গ্রহণীয় হয়ে থাকে’।[4]
(গ) এটা বিদ‘আত বলে গণ্য হবে, আর বিদ‘আত সর্বদা প্রত্যাখ্যাত। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, مَنْ عَمِلَ عَمَلاً لَيْسَ عَلَيْهِ أَمْرُنَا فَهُوَ رَدٌّ، ‘যে ব্যক্তি এমন কাজ করল, যে বিষয়ে আমাদের কোন নির্দেশ নেই, তা প্রত্যাখ্যাত’।[5] তাছাড়া وَكُلُّ بِدْعَةٍ ضَلاَلَةٌ وَكُلُّ ضَلاَلَةٍ فِىْ النَّارِ- ‘বিদ‘আতের একমাত্র পরিণাম হ’ল ভ্রষ্টতা। আর ভ্রষ্টতার পরিণাম জাহান্নাম’।[6]
মন্তব্য: যেহেতু একত্রিত তিন তালাক পবিত্র কুরআন ও রাসূলুল্লাহ (ছা:)-এর সুন্নাত বহির্ভূত সেহেতু তা বিদ‘আত ও প্রত্যাখ্যাত।
‘কিছুই গণ্য করেননি’ অর্থ বিচ্ছিন্নকারী তালাক গণ্য করেননি। বরং এক তালাকে রাজ‘ঈ গণ্য করেছেন, যা বুখারীর অপর বর্ণনায় এসেছে এবং যা উপরে বর্ণিত হয়েছে। ইবনু তায়মিয়াহ বলেন, هذا قول مبتدع لايعرف لقائله سلف من الصحابة والتابعين لهم باحسان، ‘এটি সম্পূর্ণ নতুন কথা। ছাহাবা ও তাবেঈনের কারু নিকট থেকে এরূপ কথা শোনা যায়নি’।[7]
[1]. বুলূগুল মারাম হা/১০০৬।
[2]. ফিক্বহুস সুন্নাহ ২/২৯৬।
[3]. হাশিয়া মুহাল্লা ৯/৩৯৪।
[4]. ফিক্বহুস সুন্নাহ ২/২৯৬।
[5]. বুখারী ও মুসলিম, মিশকাত হা/১৪০।
[6]. নাসাঈ হা/১৫৭৯ ‘ঈদায়েনের খুৎবা কিভাবে দিতে হবে’ অনুচ্ছেদ।
[7]. মাজমূ‘আ ফাতাওয়া ইবনে তায়মিয়াহ ৩৩/৮২।