সূরা তাকভীর
(আলোহীন করা)
সূরা লাহাবের পরে মক্কায় অবতীর্ণ।
সূরা ৮১, আয়াত ২৯, শব্দ ১০৪, বর্ণ ৪২৫।
بِسْمِ اللہِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِیْمِ
পরম করুণাময় অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে (শুরু করছি)।
(১) যেদিন সূর্যকে আলোহীন করা হবে | إِذَا الشَّمْسُ كُوِّرَتْ |
(২) যেদিন নক্ষত্র সমূহ খসে পড়বে | وَإِذَا النُّجُومُ انْكَدَرَتْ |
(৩) যেদিন পাহাড়সমূহ উড়তে থাকবে | وَإِذَا الْجِبَالُ سُيِّرَتْ |
(৪) যেদিন দশ মাসের গাভিন উষ্ট্রীগুলো উপেক্ষিত হবে | وَإِذَا الْعِشَارُ عُطِّلَتْ |
(৫) যেদিন বন্যপশুদের একত্রিত করা হবে | وَإِذَا الْوُحُوشُ حُشِرَتْ |
(৬) যেদিন সমুদ্রগুলিকে অগ্নিময় করা হবে | وَإِذَا الْبِحَارُ سُجِّرَتْ |
(৭) যেদিন আত্মাসমূহকে মিলিত করা হবে | وَإِذَا النُّفُوسُ زُوِّجَتْ |
(৮) যেদিন জীবন্ত প্রোথিত কন্যা জিজ্ঞাসিত হবে | وَإِذَا الْمَوْءُودَةُ سُئِلَتْ |
(৯) কি অপরাধে সে নিহত হ’ল? | بِأَيِّ ذَنْبٍ قُتِلَتْ |
(১০) যেদিন আমলনামা সমূহ খুলে দেওয়া হবে। | وَإِذَا الصُّحُفُ نُشِرَتْ |
(১১) যেদিন আকাশকে আবরণমুক্ত করা হবে। | وَإِذَا السَّمَاءُ كُشِطَتْ |
(১২) যেদিন জাহান্নামকে উত্তপ্ত করা হবে। | وَإِذَا الْجَحِيمُ سُعِّرَتْ |
(১৩) যেদিন জান্নাতকে নিকটবর্তী করা হবে। | وَإِذَا الْجَنَّةُ أُزْلِفَتْ |
(১৪) সেদিন প্রত্যেকে জানবে সে কি হাযির করেছে। | عَلِمَتْ نَفْسٌ مَا أَحْضَرَتْ |
(১৫) আমি শপথ করছি ঐসব নক্ষত্রের, যা (দিবসে) হারিয়ে যায় ও (রাতে) প্রকাশিত হয়। | فَلَا أُقْسِمُ بِالْخُنَّسِ |
(১৬) যা চলমান হয় ও অদৃশ্য হয়। | الْجَوَارِ الْكُنَّسِ |
(১৭) শপথ রাত্রির যখন তা নিষ্ক্রান্ত হয়। | وَاللَّيْلِ إِذَا عَسْعَسَ |
(১৮) শপথ প্রভাতকালের যখন তা প্রকাশিত হয়। | وَالصُّبْحِ إِذَا تَنَفَّسَ |
(১৯) নিশ্চয় এই কুরআন সম্মানিত বাহকের (জিব্রীলের) আনীত বাণী। | إِنَّهُ لَقَوْلُ رَسُولٍ كَرِيمٍ |
(২০) যিনি শক্তিশালী এবং আরশের অধিপতির নিকটে মর্যাদাবান। | ذِي قُوَّةٍ عِنْدَ ذِي الْعَرْشِ مَكِينٍ |
(২১) যিনি সকলের মান্যবর ও সেখানকার বিশ্বাসভাজন। | مُطَاعٍ ثَمَّ أَمِينٍ |
(২২) তোমাদের সাথী (মুহাম্মাদ) পাগল নন। | وَمَا صَاحِبُكُمْ بِمَجْنُونٍ |
(২৩) তিনি অবশ্যই তাকে (জিব্রীলকে) দেখেছেন প্রকাশ্য দিগন্তে। | وَلَقَدْ رَآهُ بِالْأُفُقِ الْمُبِينِ |
(২৪) তিনি অদৃশ্য বিষয় (অহি) বর্ণনা করতে কৃপণ নন। | وَمَا هُوَ عَلَى الْغَيْبِ بِضَنِينٍ |
(২৫) এটা (কুরআন) বিতাড়িত শয়তানের উক্তি নয়। | وَمَا هُوَ بِقَوْلِ شَيْطَانٍ رَجِيمٍ |
(২৬) অতএব তোমরা কোথায় যাচ্ছ? | فَأَيْنَ تَذْهَبُونَ |
(২৭) এটা তো বিশ্ববাসীদের জন্য উপদেশ মাত্র। | إِنْ هُوَ إِلَّا ذِكْرٌ لِلْعَالَمِينَ |
(২৮) সেই ব্যক্তির জন্য, যে তোমাদের মধ্যে সরল পথে চলতে চায়। | لِمَنْ شَاءَ مِنْكُمْ أَنْ يَسْتَقِيمَ |
(২৯) আর তোমরা ইচ্ছা করতে পারো না কেবল অতটুকু ব্যতীত যা আল্লাহ ইচ্ছা করেন। যিনি বিশ্বচরাচরের পালনকর্তা। | وَمَا تَشَاءُونَ إِلَّا أَنْ يَشَاءَ اللَّهُ رَبُّ الْعَالَمِينَ |
গুরুত্ব :
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেছেন,مَنْ سَرَّهُ أَنْ يَّنْظُرَ إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ كَأنَّهُ رَأْىُ عَيْنٍ فَلْيَقْرَأْ إِذَا الشَّمْسُ كُوِّرَتْ، إِذَا السَّمَاءُ انْفَطَرَتْ، إِذَا السَّمَاءُ انْشَقَّتْ- ‘যে ব্যক্তি চোখের সামনে ক্বিয়ামতের দৃশ্য দেখতে চায়, সে যেন إِذَا الشَّمْسُ كُوِّرَتْ ও إِذَا السَّمَاءَ انْفَطَرَت এবং إِذَا السَّمَاءَ انْشَقَّتْ সূরাগুলি পাঠ করে।[1]
বিষয়বস্ত্ত :
১- ক্বিয়ামতের ভয়ংকর অবস্থা বর্ণনা (১-১৪ আয়াত)। ২- কুরআন যে জিব্রীল ফেরেশতার মাধ্যমে প্রেরিত সত্যগ্রন্থ এবং নবী যে সত্য, সেকথা শপথ করে বর্ণনা (১৫-২৯ আয়াত)।
ব্যাখ্যা : এখানে ক্বিয়ামত সংঘটন কালের ১২টি অবস্থা বর্ণনা করা হয়েছে। যার মধ্যে ৬টি হবে দুনিয়াতে এবং ৬টি হবে আখেরাতে। দুনিয়ার ছয়টি অবস্থা বর্ণিত হয়েছে ১ হ’তে ৬ আয়াতে। হযরত উবাই বিন কা‘ব (রাঃ) বলেন, (১) মানুষ বাজার-ঘাটে মশগুল থাকবে। এমতাবস্থায় হঠাৎ সূর্যের আলো নিভে যাবে। (২) নক্ষত্রসমূহ খসে পড়বে। (৩) পাহাড়সমূহ মাটির উপর ভেঙ্গে পড়বে ও সারা পৃথিবী কম্পিত ও আন্দোলিত হবে। (৪) এ সময় জিন-ইনসান সব ভয়ে ছুটাছুটি করতে থাকবে। (৫) পশু-পক্ষী সব ভীত-চকিত হয়ে একত্রিত হয়ে যাবে। (৬) সমুদ্র সব অগ্নিময় হয়ে একাকার হয়ে যাবে। এরপর একটি বায়ুপ্রবাহ আসবে। যাতে সবাই মারা পড়বে’ (সংক্ষেপায়িত; ইবনু জারীর, কুরতুবী, ইবনু কাছীর)। অতঃপর আখেরাতের ছয়টি অবস্থা বর্ণিত হয়েছে ৭ হ’তে ১৪ আয়াতে। যার শুরু হয়েছে এই বলে, وَإِذَا النُّفُوْسُ زُوِّجَتْ ‘যেদিন আত্মাসমূহকে মিলিত করা হবে’। এবং শেষ হয়েছে وَإِذَا الْجَنَّةُ أُزْلِفَتْ ‘যেদিন জান্নাতকে নিকটবর্তী করা হবে’। অতঃপর ‘প্রত্যেকে জানবে সে কি হাযির করেছে’।
তাফসীর (১-১৪ আয়াত) :
অত্র আয়াতগুলিতে ক্বিয়ামতকালের ভয়ংকর অবস্থা বর্ণিত হয়েছে।-
(১) إِذَا الشَّمْسُ كُوِّرَتْ ‘যেদিন সূর্যকে আলোহীন করা হবে’।
অর্থাৎ সৌরজগতের মূল কেন্দ্রবিন্দু সূর্যকে যখন গুটিয়ে নেয়া হবে, তখন তার গ্রহ-উপগ্রহ সবকিছুই বিচ্ছিন্ন হবে এবং আলোহীন হয়ে যাবে। চোখের পলকে সবকিছু ওলট-পালট হয়ে যাবে।
শুধু তাই নয়, সূর্য-চন্দ্র ও অন্য যেসব বস্ত্তকে লোকেরা পূজা করত, সবগুলিকে আল্লাহ ঐদিন জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন। যেমন তিনি বলেন, إِنَّكُمْ وَمَا تَعْبُدُوْنَ مِنْ دُوْنِ اللهِ حَصَبُ جَهَنَّمَ أَنْتُمْ لَهَا وَارِدُوْنَ ‘তোমরা এবং আল্লাহর পরিবর্তে যাদের তোমরা ইবাদত কর, সবই জাহান্নামের ইন্ধন। তোমরা সবাই তাতে প্রবেশ করবে’ (আম্বিয়া ২১/৯৮)। আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, الشَّمْسُ وَالْقَمَرُ ثَوْرَانِ مُكَوَّرَانِ فِى النَّارِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ ‘সূর্য ও চন্দ্র ক্বিয়ামতের দিন দু’টি ষাঁড়ের আকৃতিতে জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে’।[2] আলবানী বলেন, এটি তাদের শাস্তিদানের উদ্দেশ্যে নয়। বরং যারা তাদের পূজা করত, তাদের ধিক্কার দানের উদ্দেশ্যে হবে’।[3]
كَارَ يَكُوْرُ كَوْرًا অর্থ كُوِّرَ অন্ধকার হওয়া, অথবা رُمِىَ ‘নিক্ষিপ্ত হওয়া’ অথবা سُقِطَ ‘পতিত হওয়া’। সেখান থেকে كُوِّرَتْ -এর মাছদার التكوير অর্থ গুটিয়ে নেয়া (কুরতুবী)। যেমন গায়ে চাদর জড়িয়ে নেয়া হয় বা মাথায় পাগড়ী গুটিয়ে বাঁধা হয়। সূর্যকে গুটিয়ে নিলে তার আসল গ্যাসীয় রূপ বিনষ্ট হয়ে যাবে। ফলে তাতে আর কিরণ উৎপন্ন হবে না। সেজন্য হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ) كُوِّرَتْ অর্থ করেছেন أُظْلِمَتْ ‘অন্ধকারময় করা হবে’ (ইবনু কাছীর)।
كُوِّرَتْ শব্দটির মধ্যে বিজ্ঞানের একটি বিরাট উৎস বর্ণিত হয়েছে। যেকালে মানুষ সূর্যকে দেবতা জ্ঞানে পূজা করত, সেই যুগে কুরআন জানিয়ে দিয়েছে যে, সূর্য একদিন নিঃশেষ হবে। অতএব সে কখনো উপাস্য হতে পারে না। জানিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, সূর্য হ’ল উত্তাপ ও শক্তির উৎস। যা মানুষ ও জীবজগতের কল্যাণে আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু নির্ধারিত মেয়াদ শেষে সূর্য একসময় দীপ্তিহীন হয়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। আর সেটাই হ’ল ক্বিয়ামতের দিন। যদিও বিজ্ঞানীরা অনুমান করেন যে, আগামী ৫০০ কোটি বছর পর সূর্য দীপ্তিহীন হয়ে যাবে এবং পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে (দ্রঃ পৃঃ ৫৩)।
(২) وَإِذَا النُّجُوْمُ انْكَدَرَتْ ‘যেদিন নক্ষত্র সমূহ খসে পড়বে’।
اِنْكَدَرَتْ অর্থ اِنْتَثَرَتْ ‘বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে পড়বে’ বা اِنْقَضَّتْ ‘খসে পড়বে’। তার ফলে নক্ষত্র সব আলোহীন হয়ে যাবে। اِنْكَدَرَتْ -এর মাদ্দাহ হ’ল الكُدُوْرَةُ ‘ময়লা বা মলিন হওয়া’।
আকাশের নীচে ঝুলন্ত এই বিদ্যুৎ বাল্বগুলো রাতের পৃথিবীর ছাদের অপূর্ব শোভা হিসাবে আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন (মুল্ক ৬৭/৫)। কিন্তু এগুলোকে যখন সূর্যের আকর্ষণ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হবে, তখন সমস্ত শৃংখলা ভেঙ্গে পড়বে এবং সেগুলি সাথে সাথে বিদ্যুৎহীন বাল্বের মত মলিন অবস্থায় আকাশ থেকে ঝরে পড়বে। আমাদের ঘরের বিদ্যুৎ চলে গেলে বা বাল্ব কেটে গেলে বা মেইন সুইচ অফ করে দিলে যে অবস্থার সৃষ্টি হয়, ক্বিয়ামতের দিনের অবস্থা তার সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। মানুষ যদি মেইন সুইচ অফ করে দিয়ে গোটা শহর এমনকি গোটা দেশ অন্ধকার করে ফেলতে পারে, তাহ’লে আকাশের অসংখ্য গ্রহ-নক্ষত্রের মেইন সুইচ যাঁর হাতে, সেই মহান আল্লাহ যখনই ইচ্ছা করবেন, তখনই সবকিছুই অফ হয়ে যাবে ও সবকিছু ঘোর অন্ধকারে ডুবে যাবে। এটা তাঁর জন্য খুবই সহজ বিষয়। ‘নক্ষত্ররাজি ঝরে পড়বে’ বলে আল্লাহ পৃথিবী ধ্বংসের ইঙ্গিত দিয়েছেন। কেননা পৃথিবী নিজেই একটি নক্ষত্র।
(৩) وَإِذَا الْجِبَالُ سُيِّرَتْ ‘যেদিন পাহাড়সমূহ উড়তে থাকবে’।
سُيِّرَتْ অর্থ قُلِعَتْ مِنَ الْأَرْضِ وَسُيِّرَتْ فِى الْهَوَاءِ ‘পৃথিবী থেকে উৎপাটিত হবে এবং বাতাসে উড়তে থাকবে’। যেমন আল্লাহ অন্যত্র বলেন, وَيَوْمَ نُسَيِّرُ الْجِبَالَ وَتَرَى الْأَرْضَ بَارِزَةً ‘যেদিন আমরা পাহাড়সমূহকে পরিচালিত করব এবং তুমি পৃথিবীকে দেখবে উন্মুক্ত...’ (কাহফ ১৮/৪৭)।
ক্বিয়ামতের দিন পাহাড়ের অবস্থা কেমন হবে, সে বিষয়ে কুরআনের বিভিন্নস্থানে বিভিন্নভাবে বলা হয়েছে। যেমন (ক) َفقُلْ يَنْسِفُهَا رَبِّيْ نَسْفاً ‘তুমি বল আমার পালনকর্তা পাহাড় সমূহকে উৎপাটিত করে বিক্ষিপ্ত করে দিবেন’। ‘অতঃপর পৃথিবীকে করবেন قَاعًا صَفْصَفًا মসৃণ সমতলভূমি’ (ত্বোয়াহা ২০/১০৫-১০৬)। (খ) وَبُسَّتِ الْجِبَالُ بَسًّا، فَكَانَتْ هَبَاءً مُّنْبَثًّا ‘এবং পাহাড়সমূহ ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাবে’। ‘অতঃপর তা হয়ে যাবে উৎক্ষিপ্ত ধূলিকণা’ (ওয়াক্বি‘আহ ৫৬/৫-৬)। (গ) وَكَانَتِ الْجِبَالُ كَثِيْباً مَّهِيْلاً ‘পাহাড়সমূহ হবে বালুকাসূতপ’ (মুযযাম্মিল ৭৩/১৪)। (ঘ) وَسُيِّرَتِ الْجِبَالُ فَكَانَتْ سَرَاباً ‘পাহাড়সমূহ চালিত হয়ে মরীচিকা হয়ে যাবে’ (নাবা ৭৮/২০)। (ঙ) وَتَكُوْنُ الْجِبَالُ كَالْعِهْنِ الْمَنْفُوْشِ ‘এবং পাহাড়সমূহ হয়ে যাবে ধূনিত তুলার ন্যায়’ (ক্বারে‘আহ ১০১/৫) ইত্যাদি। এক কথায় বলা যায়, ক্বিয়ামতের পর ভূপৃষ্ঠে পাহাড়ের কোন চিহ্ন থাকবে না। কেননা ঐ সময় পাহাড়ের আর কোন প্রয়োজন থাকবে না।
(৪) وَإِذَا الْعِشَارُ عُطِّلَتْ ‘যেদিন দশমাসের গাভিন উষ্ট্রীগুলো উপেক্ষিত হবে’।
আরবদের নিকটে গাভিন উষ্ট্রী অত্যন্ত মূল্যবান বস্ত্ত। তারা একে সব সময় আগলে রাখে। কখনোই ছেড়ে রাখে না। কিন্তু ক্বিয়ামতের ভয়ংকর সময়ে তারা তাদের ঐ মূল্যবান উষ্ট্রীর কথা ভুলে যাবে। তাকে ছেড়ে দেয়া হবে। মূলতঃ এটি আরবদের বুঝানোর জন্য দৃষ্টান্ত হিসাবে বর্ণিত হয়েছে। عُطِّلَتْ অর্থ أهملت من أهلها لاشتغالهم بأنفسهم ‘উষ্ট্রীর মালিকের পক্ষ হ’তে উপেক্ষা করা হবে তাদের নিজেদের চিন্তায় বিভোর থাকার কারণে’। আল্লাহ বলেন, ‘যেদিন মানুষ পালাবে তার ভাইয়ের কাছ থেকে এবং তার মা-বাপ, স্ত্রী ও সন্তানদের কাছ থেকে। প্রত্যেক মানুষের সেদিন এমন অবস্থা হবে যে, সে নিজেকে নিয়েই বিভোর থাকবে’ (আবাসা ৮০/৩৪-৩৭)।
(৫) وَإِذَا الْوُحُوْشُ حُشِرَتْ ‘যেদিন বন্যপশুদের একত্রিত করা হবে’।
ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, ক্বিয়ামতের দিন পশু-পক্ষী এমনকি পিঁপড়াও পুনর্জীবিত হবে। অতঃপর শিংওয়ালাদের কাছ থেকে অত্যাচারিত শিংহীনদের বদলা নেওয়া হবে (حَتَّى يُقَادَ لِلشَّاةِ الْجَلْحَاءِ مِنَ الشَّاةِ الْقَرْنَاءِ)। এরপর বলা হবে তোমরা সব মাটি হয়ে যাও। ফলে সব মরে মাটি হয়ে যাবে। বাকী থাকবে কেবল জিন ও ইনসান শেষ বিচারের জন্য’।[4] একই মর্মে বর্ণনা করেছেন হযরত উবাই ইবনে কা‘ব (রাঃ)। অত্যাচারী পশুর কাছ থেকে যখন বদলা নেয়া হবে, তখন অত্যাচারী বনু আদমের অবস্থা কেমন হবে সহজেই বুঝা যায় (কুরতুবী)। আল্লাহ বলেন,
وَمَا مِنْ دَآبَّةٍ فِي الْأَرْضِ وَلاَ طَائِرٍ يَّطِيْرُ بِجَنَاحَيْهِ إِلاَّ أُمَمٌ أَمْثَالُكُمْ مَّا فَرَّطْنَا فِي الْكِتَابِ مِنْ شَيْءٍ ثُمَّ إِلَى رَبِّهِمْ يُحْشَرُوْنَ- (الأنعام ৩৮)-
‘যত প্রকার প্রাণী পৃথিবীতে বিচরণশীল রয়েছে এবং যত প্রকার পাখি দু’ডানায় ভর করে উড়ে বেড়ায়, তারা সবাই তোমাদের মত একেকটি সৃষ্টি মাত্র। আমরা এই কিতাবে (দ্বীন-দুনিয়ার) কোন কিছুই (লিখতে) ছাড়িনি। অতঃপর তারা সবাই তাদের পালনকর্তার নিকটে সমবেত হবে’ (আন‘আম ৬/৩৮)।
পশু-পক্ষীর বিচারের বিষয়টি কাফেরদের ভয় দেখানোর উদ্দেশ্যে প্রতীকী বিচার হতে পারে। কেননা জিন ও ইনসান ব্যতীত অন্য কারু জন্য শারঈ বিধান মান্য করার বাধ্যবাধ্যকতা নেই।
(৬) وَإِذَا الْبِحَارُ سُجِّرَتْ ‘যেদিন সমুদ্রগুলিকে অগ্নিময় করা হবে’।
سُجِّرَتْ দু’টি অর্থ হ’তে পারে। ১. مُلِئَتْ مِنَ الْمَاءِ ‘পানিতে ভরপুর হওয়া ও পানি উদ্বেলিত হওয়া’ (কুরতুবী)। ২. اُوْقِدَتْ ‘অগ্নিময় হওয়া’। ইবনু আববাস, মুজাহিদ প্রমুখ বিদ্বানগণ এই অর্থকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন (ইবনু কাছীর)।
শতকরা ১১.১ ভাগ হাইড্রোজেন ও ৮৮.৯ ভাগ অক্সিজেন গ্যাস মিলিত হয়ে পানি সৃষ্টি হয়। ক্বিয়ামতের দিন যখন আল্লাহর হুকুমে সেই পারস্পরিক মিশ্রণ ও আকর্ষণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে, তখন এ দু’টি স্ব স্ব অবস্থায় ফিরে যাবে এবং পানিভরা সমুদ্র সব গ্যাসভর্তি আগুনে পূর্ণ হয়ে যাবে।
এখানে سُجِّرَتْ শব্দ প্রয়োগের মাধ্যমে আল্লাহ পানি সৃষ্টির উৎসের সন্ধান দিয়েছেন যে, এটি কেবল ঠান্ডা পানীয় নয়। বরং ওটা আসলে দু’টি গ্যাসের মিলিত রূপ। বান্দা এখন এই সূত্র ধরে বের করবে যে, এর মধ্যে কি কি গ্যাস আছে এবং কয়ভাগ করে আছে। এই গবেষণার মাধ্যমেই বান্দা জানতে পারবে কে এই দু’টি গ্যাসকে একত্রিত করে সুপেয় পানিতে পরিণত করল? ল্যাবরেটরী পরীক্ষায় যখন সে সবকিছু জানবে, তখন সে বিস্মিত হয়ে বলে উঠবে- ‘আল্লাহ’। তিনি ব্যতীত এই ক্ষমতা কারু নেই’। জ্ঞানী বান্দা এক গ্লাস পানি বা পানীয় পান করার সময় যখন জানবে যে, জীবন হরণকারী এক গ্লাস আগুনকে তার জন্য জীবনদায়িনী এক গ্লাস পানিতে পরিণত করা হয়েছে, তখন তার দেহ-মন স্বতঃস্ফূর্তভাবে বলে উঠবে- আলহামদুলিল্লাহ ‘সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য’।
কিন্তু দুর্ভাগ্য এই যে, বিজ্ঞানীদের এই মূলব্যান আবিষ্কারকে মানুষ ব্যবহার করছে মানুষের ধ্বংসের কাজে। তারা হাইড্রোজেন দিয়ে বোমা বানাচ্ছে। অথচ সুপেয় পানির অভাবে প্রতি বছর লাখ লাখ বনু আদম অসহায়ভাবে মারা যাচ্ছে।
ক্বিয়ামতের দিন ভূগর্ভে গ্যাসীয় আগুন এবং ভূপৃষ্ঠের সমুদ্রের আগুন মিলিত হয়ে সমস্ত পৃথিবী জ্বলে-পুড়ে একাকার হয়ে নতুন জগত সৃষ্টি হবে এবং সবকিছুই ঘটে যাবে আল্লাহর হুকুমে চোখের পলকে বা তার চাইতে কম সময়ে (ইবরাহীম ১৪/৪৮; লোকমান ৩১/২৮; নাহল ১৬/৭৭)। ক্বিয়ামতের প্রাক্কালে সংঘটিতব্য ৬টি বিষয় বর্ণনা শেষে এবার ক্বিয়ামতের পরে আখেরাতে সংঘটিতব্য ৬টি বিষয় বর্ণিত হচ্ছে। যেমন আল্লাহ বলেন,
(৭) وَإِذَا النُّفُوْسُ زُوِّجَتْ ‘যেদিন আত্মাসমূহকে মিলিত করা হবে’। অর্থ جمع كل شكل الي نظيره ‘প্রত্যেকে তার সমশ্রেণীর সাথে মিলিত হবে’ (ইবনু কাছীর)।
উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় হযরত ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) এক খুৎবায় জনগণের উদ্দেশ্যে বলেন, يُقْرَنُ الْفَاجِرُ مَعَ الفَاجِرِ وَيُقْرَنُ الصَّالِحُ مَعَ الصَّالِحِ ‘অসৎ লোককে অসৎ লোকের সাথে এবং সৎ লোককে সৎ লোকের সাথে মিলিয়ে দেয়া হবে’ (ইবনু কাছীর)।[5] ক্বিয়ামতের দিন মানুষকে তিনটি দলে ভাগ করা হবে। অগ্রবর্তীদের দল, ডান সারির দল এবং বাম সারির দল। আল্লাহ বলেন, وَكُنْتُمْ أَزْوَاجاً ثَلاَثَةً ‘তোমরা হবে তিন দলে বিভক্ত’। ‘ডান সারির দল। কতই না ভাগ্যবান ডান সারির দল’। ‘এবং বাম সারির দল। কতই না হতভাগা বাম সারির দল’। ‘আর অগ্রবর্তী দলই অগ্রবর্তী’। ‘তারাই হ’ল (আল্লাহর) নৈকট্যশীল’ (ওয়াক্বি‘আহ ৫৬/৭-১১)। প্রথম দু’টি দল হবে জান্নাতী ও বাম দলটি হবে জাহান্নামী (ঐ, ৫৬/২৭-৪০, ৪১-৫৬; বালাদ ৯০/১৭-১৮, ১৯-২০)। যালেম-মুশরিকদের সম্পর্কে খাছ করে আল্লাহ বলেন, أُحْشُرُوا الَّذِيْنَ ظَلَمُوْا وَأَزْوَاجَهُمْ وَمَا كَانُوْا يَعْبُدُوْنَ- ‘একত্রিত করো যালেমদের ও তাদের দোসরদের এবং যাদের তারা উপাসনা করতো তাদের’ (ছাফফাত ৩৭/২২)।
এখানে َأَزْوَاجَهُمْ অর্থ أشكالهم ‘তাদের সমমনাদের’। একথাটাই রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন এভাবে, ألْمَرْءُ مَعَ مَنْ أَحَبَّ ‘ক্বিয়ামতের দিন মানুষ তার সাথে থাকবে, যাকে সে দুনিয়ায় ভালবাসতো’।[6]অন্য বর্ণনায় এসেছে, أَنْتَ مَعَ مَنْ أَحْبَبْتَ ‘তুমি তার সাথে থাকবে, যাকে তুমি ভালবাসতে’।[7] আর এটি হ’ল আক্বীদাগত ভালোবাসা। নু‘মান বিন বাশীর (রাঃ) বলেন, النُّفُوْسُ অর্থ الضرباء ‘সমমনা বা সমশ্রেণী’। মুজাহিদ বলেন, النُّفُوْسُ অর্থ الأمثال من الناس جمع بينهم ‘সমশ্রেণীভুক্ত লোকেরা, যারা পরস্পরে মিলিত হবে’। ইবনু জারীর ও ইবনু কাছীর এটাকেই সঠিক বলেছেন।
ইকরিমা, শা‘বী, হাসান বাছরী প্রমুখ বিদ্বান এর ব্যাখ্যা করেছেন, زوجت بالأبدان ‘রূহগুলিকে স্ব স্ব দেহের সাথে মিলিয়ে দেওয়া হবে’ (কুরতুবী, ইবনু কাছীর)। এ মর্মটিও গ্রহণযোগ্য। তবে কুরআন, হাদীছ ও খলীফা ওমর (রাঃ)-এর ব্যাখ্যই সর্বাগ্রগণ্য।
(৮-৯) وَإِذَا الْمَوْؤُوْدَةُ سُئِلَتْ، بِأَيِّ ذَنْبٍ قُتِلَتْ ‘যেদিন জীবন্ত প্রোথিত কন্যা জিজ্ঞাসিত হবে’। ‘কি অপরাধে সে নিহত হ’ল’?
الْمَوْؤُوْدَةُ অর্থ اَلْمَدْفُوْنَةُ حَيَّةً ‘জীবন্ত প্রোথিত কন্যা’। اَلْمَقْتُوْلَةُ صَغِيْرَةٌ ‘শিশু অবস্থায় নিহত কন্যা’। নিরপরাধ মযলূম মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করার অর্থ হ’ল যালেম পিতা-মাতাকে তার সামনে ধিক্কার দেওয়া। অথবা হত্যাকারীকে মেয়েটির সামনে ডেকে এনে ধমক দিয়ে বলা হবে, তুমি বলো, কেন মেয়েটি নিহত হ’ল? (ক্বাসেমী)।
জাহেলী আরবদের কিছু লোকের মধ্যে এ কুসংস্কার ছিল মূলতঃ তিনটি কারণে। ১. ধর্মীয় বিশ্বাসগত কারণে। ২. অর্থনৈতিক কারণে এবং ৩. সামাজিক কারণে। প্রথমোক্ত কারণটি ছিল এই যে, তারা বলত, মেয়েরা সব আল্লাহর কন্যা। তাই কন্যা সন্তান দাফন করে তাকে তারা আল্লাহর সাথে মিলিয়ে দিত। যেমন ভারতের হিন্দুরা সদ্য বিধবা জীবন্ত নারীকে তার মৃত স্বামীর চিতায় জোর করে তুলে দিয়ে পুড়িয়ে হত্যা করে স্বর্গে পাঠিয়ে দিত। একে বলা হ’ত ‘সতীদাহ প্রথা’।
দ্বিতীয়টি ছিল দরিদ্রতার কারণে এবং কন্যা সন্তান মানুষ করা ও তাকে বিয়ে দেয়ার বোঝা বহনে অক্ষমতা। বর্তমানে ভারতে দরিদ্রতার কারণে প্রতি বছর হাযার হাযার কন্যা সন্তানের ভ্রুণ হত্যা করা হচ্ছে। তৃতীয় কারণ ছিল, যুদ্ধ-বিগ্রহের সময় মেয়েদের বন্দী করে নিয়ে যাওয়া ও দাসীবৃত্তি করানোর লজ্জা থেকে বাঁচা। শেষোক্তটি মর্যাদাগত কারণে ও লোকলজ্জার ভয়ে অনেকে করত। সাধারণতঃ একাজ মায়েরাই করত। ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, প্রসবের প্রাক্কালে তারা ঘরের মধ্যে গর্ত খুঁুড়ে রাখত। মেয়ে হ’লে সাথে সাথে গর্তে মাটি চাপা দিয়ে মেরে ফেলত। আল্লাহ বলেন, وَيَجْعَلُوْنَ لِلَّهِ الْبَنَاتِ سُبْحَانَهُ وَلَهُمْ مَا يَشْتَهُوْنَ- وَإِذَا بُشِّرَ أَحَدُهُمْ بِالْأُنْثَى ظَلَّ وَجْهُهُ مُسْوَدًّا وَهُوَ كَظِيمٌ- يَتَوَارَى مِنَ الْقَوْمِ مِنْ سُوءِ مَا بُشِّرَ بِهِ أَيُمْسِكُهُ عَلَى هُونٍ أَمْ يَدُسُّهُ فِي التُّرَابِ أَ لاَ سَاءَ مَا يَحْكُمُوْنَ- ‘তারা আল্লাহর জন্য কন্যা সন্তান নির্ধারণ করত। অথচ তিনি (এসব থেকে) পবিত্র। আর তাদের জন্য ওটাই (অর্থাৎ পুত্র সন্তান) যা তারা কামনা করত’। ‘যখন তাদের কাউকে কন্যা সন্তানের সুসংবাদ দেওয়া হ’ত, তখন তাদের চেহারা মলিন হয়ে যেত। আর সে ক্রোধে ক্লিষ্ট হ’ত’। ‘তাকে শুনানো সুসংবাদের (?) গ্লানিতে সে সম্প্রদায়ের লোকদের থেকে মুখ লুকিয়ে রাখত। সে ভাবত যে, গ্লানি সহ্য করেও মেয়েটিকে বাঁচিয়ে রাখবে, না মাটিতে পুঁতে ফেলবে। সাবধান! এর মাধ্যমে তারা কতই না নিকৃষ্ট সিদ্ধান্ত নিত’ (নাহল ১৬/৫৭-৫৯)। আল্লাহ আরও বলেন, قَدْ خَسِرَ الَّذِينَ قَتَلُوا أَوْلاَدَهُمْ سَفَهًا بِغَيْرِ عِلْمٍ ‘নিশ্চয়ই তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যারা বোকামি ও অজ্ঞতা বশে নিজ সন্তানদের হত্যা করেছে’... (আন‘আম ৬/১৪০)।
জাহেলী আরবরা বিভিন্নভাবে সন্তান হত্যা করত। যেমন (১) প্রসবের পূর্বক্ষণে ঘরের মধ্যে গর্ত খুঁড়ে রাখত। অতঃপর মেয়ে হলে তাকে সাথে সাথে গর্তে পুঁতে মেরে ফেলত। (২) মেয়ে একটু বড় হলে বাপ তাকে নিয়ে কোন কূয়ায় নিক্ষেপ করত। মুসনাদে দারেমীর শুরুতে ২ নং হাদীছে নবুঅতপূর্ব যুগে আরবদের মধ্যে প্রচলিত জাহেলিয়াত সম্পর্কে একটি ঘটনা বর্ণিত হয়েছে যে, জনৈক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর দরবারে এসে বলল, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আমরা মুর্খতা যুগের অধিবাসী ছিলাম এবং মূর্তি পূজারী ছিলাম। তখন আমরা সন্তানদের হত্যা করতাম। আমার একটি মেয়ে ছিল। যখন সে বড় হ’ল। তখন সে আমার ডাকে খুশী হয়ে দৌড়ে আসত। একদিন আমি তাকে ডাকলাম। সে আমার কাছে চলে আসল। তারপর আমি তাকে নিয়ে আমাদের পরিবারের নিকটবর্তী একটি কুয়ার নিকটে গেলাম এবং তার হাত ধরে তাকে কুয়ার মধ্যে ফেলে দিলাম। তখন ‘আমার প্রতি তার শেষ বাক্য ছিল, وَكَانَ آخِرَ عَهْدِى بِهَا أَنْ تَقُولَ: يَا أَبَتَاهُ يَا أَبَتَاهُ হে আববা! হে আববা’! তার এই মর্মান্তিক ঘটনা শুনে রাসূল (ছাঃ)-এর দুই চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরতে লাগল। তখন একজন বলল, হে অমুক! তুমি রাসূল (ছাঃ)-কে দুঃখ দিলে? তখন রাসূল (ছাঃ) তাকে নিষেধ করে বললেন, ওকে বলতে দাও। কেননা সে তার কঠিন পরিণতি সম্পর্কে জানতে এসেছে। অতঃপর তিনি তাকে ঘটনাটি পুনরায় বলতে বললেন। লোকটি পুনরায় একই কথা বলল। এতে রাসূল (ছাঃ)-এর অশ্রুধারা তাঁর দাড়ি মোবারক ভিজিয়ে দিল। অতঃপর তিনি তাকে বললেন, إِنَّ اللهَ قَدْ وَضَعَ عَنِ الْجَاهِلِيَّةِ مَا عَمِلُوا، فَاسْتَأْنِفْ عَمَلَكَ ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ জাহেলী যুগে কৃত তাদের সকল কর্ম বিনষ্ট করে দিয়েছেন। অতএব তুমি নতুনভাবে তোমার সৎকর্ম শুরু কর’।[8]
একইভাবে সুনান দারেমীর ১ম হাদীছে এসেছে যে, জনৈক ব্যক্তি রাসূল (ছাঃ)-কে জিজ্ঞেস করল, জাহেলী যুগে কোন ব্যক্তি অন্যায় করলে সেজন্য তাকে পাকড়াও করা হবে কি? জবাবে রাসূল (ছাঃ) বলেন,مَنْ أَحْسَنَ فِى الإِسْلاَمِ لَمْ يُؤَاخَذْ بِمَا كَانَ عَمِلَ فِى الْجَاهِلِيَّةِ، وَمَنْ أَسَاءَ فِى الإِسْلاَمِ أُخِذَ بِالأَوَّلِ وَالآخِرِ ‘যে ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণের পর সুন্দর আমল করে, জাহেলী যুগের আমলের জন্য তাকে পাকড়াও করা হবে না। কিন্তু যে ব্যক্তি ইসলামে এসে অসৎকর্ম করল, তাকে পিছনের ও এখনকার উভয় পাপের জন্য পাকড়াও করা হবে’।[9]
উপরে বর্ণিত ঘটনাবলীতে প্রমাণিত হয় যে, কোনরূপ দরিদ্রতা বা সঙ্গত কারণ ছাড়াই জাহেলী যুগের মানুষ কত নিষ্ঠুরভাবে নিরপরাধ শিশু সন্তানদের হত্যা করত। ঐ মানুষটিই যখন ইসলাম কবুল করেছে, তখন তার জীবনে আমূল পরিবর্তন এসেছে। এভাবে ইসলাম বিশ্বমানবতার জন্য সবচেয়ে বড় রহমত হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে। হাযার হাযার কন্যাশিশু অন্যায়ভাবে নিহত হওয়া থেকে বেঁচে গেছে। ফালিল্লাহিল হামদ।
(৩) কন্যার বয়স ৬/৭ বছর হলে পিতা সন্তানের মাকে বলত, মেয়েকে ভালভাবে সাজিয়ে দাও ও সুগন্ধি মাখিয়ে দাও। ওকে ওর নানার বাড়ী থেকে বেড়িয়ে নিয়ে আসি। আগেই সে মরুভূমিতে গর্ত খুঁড়ে আসত। তারপর মেয়েকে তার ধারে নিয়ে বলত, ভিতরে তাকিয়ে দেখ। অতঃপর মেয়েটি নীচের দিকে ঝুঁকে পড়তেই তাকে ঠেলে গর্তে ফেলে দিত ও দ্রুত মাটি চাপা দিয়ে সমান করে দিত।
অবশ্য এর বিপরীত চিত্রও ছিল। সম্ভ্রান্ত আরবরা এটাতো করতই না, বরং বাধা দিত এবং অনেকে ঐসব কন্যাসন্তান খরিদ করে নিয়ে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাতো। যেমন উমাইয়া যুগের বিখ্যাত কবি ফারাযদাক্ব (২০-১১০ হিঃ/৬৪১-৭২৮ খ্রিঃ) এ বিষয়ে নিজ বংশের গৌরব-গাথা লিখে কবিতা রচনা করেছেন। কেননা তার দাদা ছা‘ছা‘আহ বিন নাজিয়াহ তামীমী (صعصعة بن ناجية بن عِقَال) মুসলমান হওয়ার আগে ৭০টি মতান্তরে ৯২, ৩০০, ৪০০, ১০০০ ঐরূপ শিশুকন্যাকে তাদের পিতা-মাতাদের কাছ থেকে খরিদ করে বাঁচিয়েছিলেন। ফারাযদাক্ব খলীফা সুলায়মান বিন আব্দুল মালেকের (৯৬-৯৯ হিঃ/৭১৫-৭১৭) দরবারে গর্ব করে বলেছিলেন, اَنَا اِبْنُ مُحْىِ الْمَوْتَى ‘আমি মৃতদের জীবিতকারীর সন্তান’। একথায় বিস্মিত খলীফার কাছে তিনি নিম্নোক্ত আয়াতটি পেশ করেন, وَمَنْ أَحْيَاهَا فَكَأَنَّمَا أَحْيَا النَّاسَ جَمِيْعًا ‘যে ব্যক্তি একটি প্রাণ বাঁচালো, সে যেন সমগ্র মানবজাতিকে বাঁচালো’ (মায়েদাহ ৫/৩২; কুরতুবী, ক্বাসেমী, তানতাভী)।
হাসান বাছরী বলেন, বর্ণিত আয়াতে জীবন্ত প্রোথিত কন্যা শিশুকে হত্যার কারণ জিজ্ঞেস করার অর্থ হ’ল হত্যাকারীকে ধমকানো। কেননা শিশুটিকে বিনা দোষে হত্যা করা হয়েছে। বস্ত্ততঃ এটাই হলো হত্যাকারীকে ধমকানোর সর্বোত্তম পন্থা। ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, ক্বিয়ামতের দিন ঐ মেয়েটি তার বাপকে ধরে বলবে- بِأَيِّ ذَنْبٍ قَتَلْتَنِىْ ‘কি অপরাধে আপনি আমাকে হত্যা করেছিলেন’? সেদিন পিতা কোন জবাব দিতে পারবে না। কোন কোন বর্ণনায় এসেছে, মেয়ে তার মাকে ধরে এনে বলবে, يَا رَبِّ هَذَهِ أُمِّىْ وَهَذِهِ قَتَلَتْنِىْ ‘হে আমার রব! এই আমার মা। ইনি আমাকে হত্যা করেছিলেন’ (কুরতুবী)। ইবনু কাছীর বলেন, فَإِذَا سُئِلَ الْمَظْلُوْمُ فَمَا ظَنُّ الظَالمِ إِذًا؟ ‘মযলূম কন্যা সন্তানকেই যখন এভাবে জিজ্ঞেস করা হবে, তখন যালেম পিতা-মাতাকে কেমন অবস্থা করা হবে? (ইবনু কাছীর)। এযুগে যেসব নিষ্ঠুর মায়েরা তাদের সন্তানদের জীবন্ত ফেলে দিচ্ছে, তারা সাবধান হবে কি?
আলোচ্য আয়াতটিতে বর্ণিত প্রশ্ন ক্বিয়ামতের দিন ঈসা (আঃ)-কে প্রশ্ন করার ন্যায়। যেমন নাছারাদের কৃত শিরকের ব্যাপারে ধমক দিয়ে আল্লাহ ঈসা (আঃ)-কে প্রশ্ন করবেন, أَأَنْتَ قُلْتَ لِلنَّاسِ اتَّخِذُوْنِيْ وَأُمِّيَ إِلَهَيْنِ مِنْ دُوْنِ اللهِ ‘তুমি কি লোকদের বলেছিলে যে, তোমরা আল্লাহ ছাড়া আমাকে ও আমার মাকে উপাস্য সাব্যস্ত করে নাও?’ (মায়েদাহ ৫/১১৬)।
وَإِذَا الْمَوْؤُوْدَةُ سُئِلَتْ -এর ব্যাখ্যায় হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, এর অর্থ, سَأْلَتْ অর্থাৎ মেয়েটি তার রক্তের বদলা দাবী করবে (طلبت بدمها)। আবুয যুহা, সুদ্দী, ক্বাতাদাহ সকলে অনুরূপ বলেন (ইবনু কাছীর)।
‘জীবন্ত প্রোথিত সন্তান’ বিষয়ে বেশ কিছু হাদীছ এসেছে, যা থেকে নিম্নোক্ত বিষয়সমূহে নির্দেশনা পাওয়া যায়। যেমন-
(১) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কে ‘আযল’ (العزل) বা ‘জন্ম নিয়ন্ত্রণ’ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হ’লে তিনি বলেন, ذَلِكَ الْوَأْدُ الخَفِىُّ وَهُوَ الْمَوْؤُوْدَةُ سُئلَتْ- ‘এটি হ’ল গুপ্তভাবে সন্তান হত্যা এবং এটাই হ’ল কুরআনে বর্ণিত আয়াতের মর্মার্থ ‘যেদিন জীবন্ত প্রোথিত কন্যাশিশু জিজ্ঞাসিত হবে’।[10]
(২) অন্য একজনের একই ধরনের প্রশ্নের জবাবে রাসূল (ছাঃ) বলেন, مَا مِنْ كُلِّ الْمَاءِ يَكُونُ الْوَلَدُ وَإِذَا أَرَادَ اللهُ خَلْقَ شَىْءٍ لَمْ يَمْنَعْهُ شَىْءٌ ‘প্রত্যেক পানিতে সন্তান হয় না। আল্লাহ যখন কিছু সৃষ্টি করতে চান, তখন তাকে কোন কিছুই রোধ করতে পারে না’।[11]
(৩) দরিদ্রতার কারণে বিবাহে ব্যর্থ জনৈক ছাহাবী এসে রাসূল (ছাঃ)-এর নিকটে খাসী (ভেসেকটমি) হওয়ার অনুমতি চাইলে রাসূল (ছাঃ) তাকে নিষেধ করেন এবং নফল ছিয়াম পালনের নির্দেশ দেন।[12]
(৪) কুরআন যে ১০টি বিষয়কে একই স্থানে হারাম ঘোষণা করেছে, তার একটি হ’ল খাদ্য সংকটের ভয়ে সন্তান হত্যা করা (আন‘আম ৬/১৫১; বনু ইস্রাঈল ১৭/৩১)।
উপরোক্ত বিষয়গুলি একত্রিত করলে নিম্নোক্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায়।-
(১) মাতৃগর্ভে চারমাস বয়সে সন্তান জীবন লাভ করে। অতএব সেখানে জীবন্ত ভ্রুণ হত্যা করলে সেটা আয়াতে বর্ণিত ‘জীবন্ত সন্তান হত্যা করার’ শামিল হবে। অতএব এটা নিষিদ্ধ।
(২) খাদ্যাভাবের আশংকায় ‘আযল’ বা জন্মনিয়ন্ত্রণ নিষিদ্ধ। তবে স্ত্রীর স্বাস্থ্যগত কারণে সেটা করা যেতে পারে। কিন্তু এ বিশ্বাস অটুট রাখতে হবে যে, যে সন্তান আসার তা আসবেই। তাক্বদীরকে খন্ডনের ক্ষমতা কারু নেই। অর্থাৎ জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার করা সত্ত্বেও সন্তান এসে গেলে তাকে আল্লাহর বিশেষ দান হিসাবে স্বাগত জানাতে হবে। জঞ্জাল ভেবে গর্ভপাত বা ভ্রুণ হত্যা বা ডাস্টবিনে নিক্ষেপ করা যাবে না।
(৩) স্থায়ী জন্মনিরোধ বা লাইগেশন সর্বাবস্থায় নিষিদ্ধ।
(৪) খাদ্যাভাবের ভয় দেখিয়ে মানুষকে জন্মনিয়ন্ত্রণে ও জন্মনিরোধে প্ররোচিত করা নিষিদ্ধ। বরং তার বিপরীতে আল্লাহ বান্দার একমাত্র রূযিদাতা (যারিয়াত ৫১/৫৮) এবং তিনি সন্তান দানসহ পৃথিবীতে সবকিছু পরিমাণমত সৃষ্টি করেন (রা‘দ ১৩/৮; ক্বামার ৫৪/৪৯) এই প্রচারণা চালাতে হবে। যাতে মানুষ তার অনাগত সন্তানকে সম্পদ মনে করে এবং কোন অবস্থায় তাকে শত্রু বা জঞ্জাল না ভাবে।
আল্লাহ বলেন, لِلَّهِ مُلْكُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ يَخْلُقُ مَا يَشَاءُ يَهَبُ لِمَنْ يَشَاءُ إِنَاثًا وَيَهَبُ لِمَنْ يَشَاءُ الذُّكُورَ- أَوْ يُزَوِّجُهُمْ ذُكْرَانًا وَإِنَاثًا وَيَجْعَلُ مَنْ يَشَاءُ عَقِيمًا إِنَّهُ عَلِيمٌ قَدِيرٌ ‘নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের রাজত্ব কেবলমাত্র আল্লাহরই। তিনি যা ইচ্ছা সৃষ্টি করেন। তিনি যাকে ইচ্ছা কন্যা সন্তান দান করেন,যাকে ইচ্ছা পুত্র সন্তান দান করেন’। ‘অথবা তাদের (কাউকে) পুত্র ও কন্যা উভয় সন্তান দান করেন এবং যাকে ইচ্ছা বন্ধ্যা করে দেন। নিশ্চয়ই তিনি সর্বজ্ঞ ও সর্বশক্তিমান’ (শূরা ৪২/৪৯-৫০)।
অত্র আয়াতে সন্তানকে আল্লাহ ‘দান’ বা ‘অনুগ্রহ’ হিসাবে বর্ণনা করেছেন। তন্মধ্যে কন্যা সন্তানকে প্রথমে এনেছেন তার প্রতি বিশেষ স্নেহ প্রদর্শন করে। অতএব আল্লাহ প্রেরিত দানকে স্বাগত জানানোই বান্দার প্রধান কর্তব্য। কন্যার প্রতি বিশেষ মর্যাদা একারণে যে, কন্যা সন্তানের মাধ্যমেই মানব বংশ রক্ষা হয়। তাছাড়া সকল নবী-রাসূল ও শ্রেষ্ঠ মানুষ মায়ের গর্ভ থেকেই দুনিয়ায় এসেছেন।
অত্র আয়াতদ্বয়ে চার ধরনের পিতামাতার কথা এসেছে। ১- যারা কেবল কন্যা সন্তান লাভ করেছেন। যেমন হযরত লূত (আঃ)। ২- যারা কেবল পুত্র সন্তান লাভ করেছেন। যেমন ইবরাহীম (আঃ)। ৩- যারা পুত্র ও কন্যা উভয় সন্তান লাভ করেছেন। যেমন মুহাম্মাদ (ছাঃ)। ৪- যারা কোন সন্তান পাননি। যেমন ইয়াহইয়া ও ঈসা (আঃ)। সবকিছুই আল্লাহর ইচ্ছায় হয়ে থাকে। তিনি সর্বশক্তিমান।
অতঃপর ‘জীবন্ত প্রোথিত শিশু সন্তান’ জান্নাতী হবে না জাহান্নামী হবে, এ বিষয়ে হাদীছের বক্তব্য সমূহ নিম্নরূপ :
১-اَلْوَائِدَةُ وَالْمَوْؤُوْدَةُ فِى النَّارِ ‘সন্তান হত্যাকারিণী মা ও নিহত সন্তান উভয়ে জাহান্নামী হবে’।[13] কেননা সন্তান সাধারণতঃ পিতা-মাতার অনুগামী হয়ে থাকে।
২- اَلنَّبِىُّ فِى الْجَنَّةِ وَالشَّهِيْدُ فِى الْجَنَّةِ وَالْمَوْلُوْدُ فِى الْجَنَّةِ وَالْوَئِيْدُ فىِ الْجَنَّةِ ‘নবী জান্নাতী, শহীদ জান্নাতী, সদ্য প্রসূত সন্তান জান্নাতী, জীবন্ত প্রোথিত শিশু সন্তান জান্নাতী’।[14]
প্রথমোক্ত হাদীছটি হত্যাকারিণী মায়ের প্রতি ধমকি হিসাবে হতে পারে কিংবা সেটি দ্বিতীয় হাদীছটি দ্বারা মানসূখ বা হুকুম রহিত হতে পারে। কেননা অন্য হাদীছে এসেছে যে, ঘুমন্ত ব্যক্তি, শিশু ও পাগল দোষী সাব্যস্ত হয় না।[15] তাছাড়া সাবালক পুরুষ ও নারীর উপরেই শরী‘আতের হুকুম প্রযোজ্য হয়, নাবালক শিশুর উপরে নয়। এদ্বারা বুঝা যায়, যেকোন মৃত শিশু সন্তান জান্নাতী হাবে। তবে সবকিছুর মালিক আল্লাহ। তিনি একদলকে জান্নাতের জন্য ও একদলকে জাহান্নামের জন্য সৃষ্টি করেছেন (শূরা ৪২/৭)। ইমাম কুরতুবী সূরা মায়েদাহ ১১৬ এবং আহযাব ১৫ আয়াত দু’টি পেশ করে বলেন, এর মধ্যে সন্তানকে নয় বরং হত্যাকারী পিতা-মাতাকে ধমকানো হয়েছে। কারণ তারাই এজন্য দায়ী। অতঃপর তিনি বলেন,وفيه دليل بين على ان أطفال المشركين لايُعذَّبون وعلى أن التعذيب لا يُستَحق إلا بذنب- ‘এতে স্পষ্ট দলীল রয়েছে যে, মুশরিকদের মৃত শিশু সন্তান শাস্তিপ্রাপ্ত হবে না। তাছাড়া কোন অপরাধ ব্যতীত শাস্তি প্রযোজ্য হয় না (অথচ ঐসব শিশু কোন অপরাধ করেনি)’।[16]
(১০) وَإِذَا الصُّحُفُ نُشِرَتْ ‘যেদিন আমলনামা সমূহ খুলে দেওয়া হবে’।
نُشِرَتْ অর্থ فةحة بعد أن كانة مطوية ‘বন্ধ করার পর যা খোলা হয়’। যে সকল ফেরেশতা মানুষের ভাল-মন্দ কার্যসমূহ লিপিবদ্ধ করার দায়িত্বে নিযুক্ত থাকেন, মানুষের মৃত্যুর সাথে সাথে উক্ত আমলনামা তারা বন্ধ করে দেন। ক্বিয়ামতের দিন সেটাই তার সম্মুখে খুলে দেওয়া হবে। তখন সেই আমলনামা দেখে মানুষ বলে উঠবে- مَالِ هَذَا الْكِتَابِ لاَ يُغَادِرُ صَغِيْرَةً وَّلاَ كَبِيْرَةً إِلاَّ أَحْصَاهَا ‘হায় আফসোস! এ কেমন আমলনামা যে ছোট-বড় কোন কিছুই লিখতে বাদ রাখেনি’ (কাহফ ১৮/৪৯)।
এ বিষয়ে সূরা হা-ক্কাহ ১৮ হ’তে ২৯ আয়াত পর্যন্ত ক্বিয়ামতের দিন মুমিন ও কাফিরের আনন্দ ও বিষাদময় বর্ণনা সমূহ উল্লেখিত হয়েছে। আল্লাহ বলেন, وَكُلَّ إِنْسَانٍ أَلْزَمْنَاهُ طَآئِرَهُ فِيْ عُنُقِهِ وَنُخْرِجُ لَهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ كِتَاباً يَّلْقَاهُ مَنْشُوْراً- اقْرَأْ كَتَابَكَ كَفَى بِنَفْسِكَ الْيَوْمَ عَلَيْكَ حَسِيْباً- ‘আমরা প্রত্যেক মানুষের কর্মকে তার গ্রীবালগ্ন করে রেখেছি এবং ক্বিয়ামতের দিন তাকে বের করে দেখাব একটি কিতাব, যা সে খোলা অবস্থায় পাবে’। ‘(অতঃপর বলা হবে) পাঠ কর তুমি তোমার আমলনামা। আজ তোমার হিসাবের জন্য তুমিই যথেষ্ট’ (বনু ইস্রাঈল ১৭/১৩-১৪)।
(১১) وَإِذَا السَّمَاءُ كُشِطَتْ ‘যেদিন আকাশকে আবরণমুক্ত করা হবে’।
كُشِطَتْ অর্থ قلعت وأزيلت كما يكشط الإهاب عن الذبيحة ‘উৎপাটন করা হয়েছে, বিদূরিত করা হয়েছে। যেমন যবহকৃত পশুর চামড়া খুলে নেয়া হয়’। ক্বিয়ামতের দিন আকাশকে তার স্থান থেকে সরিয়ে নেয়া হবে, যেমন কোন কিছুর উপর থেকে আবরণ সরিয়ে নেয়া হয়। আকাশকে অতঃপর ভাজ করা হবে। যেভাবে কাগজ ভাজ করা হয়। যেমন আল্লাহ বলেন, وَالسَّمَاوَاتُ مَطْوِيَّاتٌ بِيَمِيْنِهِ ‘আকাশসমূহ তাঁর ডান হাতে ভাজ করা অবস্থায় থাকবে’ (যুমার ৩৯/৬৭)। তিনি বলেন, يَوْمَ نَطْوِي السَّمَاءَ كَطَيِّ السِّجِلِّ لِلْكُتُبِ كَمَا بَدَأْنَا أَوَّلَ خَلْقٍ نُّعِيْدُهُ وَعْداً عَلَيْنَا إِنَّا كُنَّا فَاعِلِيْنَ- ‘যেদিন আমরা আকাশকে ভাজ করে নেব, যেমন ভাজ করা হয় লিখিত কাগজপত্র। যেভাবে আমরা প্রথমবার সৃষ্টি করেছিলাম, সেভাবে পুনরায় সৃষ্টি করব। আমাদের ওয়াদা সুনিশ্চিত। আমরা তা পূর্ণ করবই’ (আম্বিয়া ২১/১০৪)। আল্লাহ বলেন, فَإِذَا انْشَقَّتِ السَّمَاءُ فَكَانَتْ وَرْدَةً كَالدِّهَانِ- ‘যেদিন আকাশ বিদীর্ণ হবে এবং তা রক্তরঞ্জিত চামড়ার রূপ ধারণ করবে’ (রহমান ৫৫/৩৭)। এসময় কেবল আল্লাহর আরশ বাকী থাকবে। যেমন তিনি বলেন, وَيَحْمِلُ عَرْشَ رَبِّكَ فَوْقَهُمْ يَوْمَئِذٍ ثَمَانِيَةٌ ‘সেদিন তাদের উপরে তোমার পালনকর্তার আরশ বহন করবে আটজন ফেরেশতা’ (হা-ক্কাহ ৬৯/১৭)। তিনি পৃথিবীকেও কব্জায় নিবেন আর বলবেন, أَنَا الْمَلِكُ أَيْنَ مُلُوكُ الأَرْضِ؟ ‘আমিই বাদশাহ। পৃথিবীর রাজা-বাদশাহরা কোথায়’?[17]
(১২-১৩) وَإِذَا الْجَحِيْمُ سُعِّرَتْ، وَإِذَا الْجَنَّةُ أُزْلِفَتْ ‘যেদিন জাহান্নামকে উত্তপ্ত করা হবে’। ‘যেদিন জান্নাতকে নিকটবর্তী করা হবে’।
জান্নাত ও জাহান্নাম উভয়টি সৃষ্ট অবস্থায় আছে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মি‘রাজ রজনীতে তা স্বচক্ষে দেখেছেন। জাহান্নাম তো সর্বদাই উত্তপ্ত। তাহ’লে ক্বিয়ামতের দিন উত্তপ্ত করা হবে অর্থ কি? আল্লাহ বলেন, وَقُوْدُهَا النَّاسُ وَالْحِجَارَةُ ‘(সেদিন) এর ইন্ধন হবে মানুষ ও পাথর’ (তাহরীম ৬৬/৬)। অর্থাৎ কাফের ও জ্বলন্ত পাথর দিয়ে জাহান্নামকে ঐদিন আরও উত্তপ্ত করা হবে। এক্ষণে বর্ণিত আয়াতে سُعِّرَتْ অর্থ হবে أُحْمِيَتْ وَزِيْدَ فِىْ إحْمَائِهاَ ‘উত্তপ্ত করা হবে এবং তার উত্তাপ অধিক বৃদ্ধি করা হবে’। ইবনু যায়েদ বলেন, ‘জাহীম’ হ’ল জাহান্নামের নাম সমূহের অন্যতম’ (ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা নাযে‘আত ১০ আয়াত)।
أُزْلِفَتْ অর্থ قربت إلى أهلها ‘জান্নাতকে জান্নাতবাসীর নিকটবর্তী করা হবে’। যেমন অন্যত্র বলা হয়েছে, وَأُزْلِفَتِ الْجَنَّةُ لِلْمُتَّقِيْنَ ‘জান্নাতকে মুক্তাক্বীদের নিকটবর্তী করা হবে’ (শো‘আরা ২৬/৯০)। হাসান বাছরী বলেন, এর অর্থ হ’ল মুত্তাক্বীদেরকে জান্নাতের নিকটে নেয়া হবে। এটা নয় যে, জান্নাত তার স্থান থেকে সরে আসবে’ (কুরতুবী)।
৭ আয়াত হতে ১৩ আয়াত পর্যন্ত ক্বিয়ামতের দিন সংঘটিতব্য আখেরাতের ৬টি বিষয় বর্ণিত হ’ল। এভাবে ১ হ’তে ১৩ আয়াত পর্যন্ত ক্বিয়ামতের আগের ও পরের ৬+৬ মোট ১২টি বিষয় শর্তাকারে বর্ণিত হ’ল। অতঃপর এগুলির জওয়াবে আল্লাহ বলেন,
(১৪) عَلِمَتْ نَفْسٌ مَّا أَحْضَرَتْ ‘সেদিন প্রত্যেকে জানবে সে কি হাযির করেছে’।
পূর্ববর্তী শর্তগুলির জওয়াব হ’ল অত্র আয়াতটি। ক্বিয়ামতের আগে-পিছে ১২টি বিষয় উপস্থাপনের উদ্দেশ্য হ’ল বান্দাকে এটা বিশ্বাস করানো যে, তাকে অবশ্যই আল্লাহর নিকটে তার জীবনের সকল কাজের হিসাব দিতে হবে। যেমন অন্যত্র আল্লাহ বলেন, َويَوْمَ تَجِدُ كُلُّ نَفْسٍ مَّا عَمِلَتْ مِنْ خَيْرٍ مُّحْضَراً وَّمَا عَمِلَتْ مِن سُوْءٍ تَوَدُّ لَوْ أَنَّ بَيْنَهَا وَبَيْنَهُ أَمَداً بَعِيْداً ‘যেদিন প্রত্যেকে চোখের সামনে উপস্থিত দেখতে পাবে যেসব ভাল কাজ সে করেছিল এবং যা কিছু মন্দ কাজ সে করেছিল। সেদিন সে কামনা করবে, যদি এইসব কর্মের ও তার মধ্যকার ব্যবধান অনেক দূরের হতো’ (আলে ইমরান ৩/৩০)। অন্যত্র বর্ণিত হয়েছে, يُنَبَّأُ الْإِنسَانُ يَوْمَئِذٍ بِمَا قَدَّمَ وَأَخَّرَ ‘মানুষকে সেদিন অবহিত করা হবে যা সে আগে ও পিছে প্রেরণ করেছে’ (ক্বিয়ামাহ ৭৫/১৩)।
এ পর্যন্ত প্রথম বিষয়বস্ত্ত ক্বিয়ামতের বর্ণনা শেষ হ’ল। এক্ষণে দ্বিতীয় বিষয়বস্ত্ত কুরআনের বর্ণনা শুরু হ’ল।-
(১৫-১৮) فَلاَ أُقْسِمُ بِالْخُنَّسِ، الْجَوَارِ الْكُنَّسِ، وَاللَّيْلِ إِذَا عَسْعَسَ، وَالصُّبْحِ إِذَا تَنَفَّسَ ‘আমি শপথ করছি ঐসব নক্ষত্রের, যা (দিবসে) হারিয়ে যায় ও (রাতে) প্রকাশিত হয়’। ‘যা চলমান হয় ও অদৃশ্য হয়’। ‘শপথ রাত্রির যখন তা নিষ্ক্রান্ত হয়’। ‘শপথ প্রভাতকালের যখন তা প্রকাশিত হয়’।
فَلاَ أُقْسِمُ অর্থ أُقْسِمُ ‘আমি শপথ করছি’। এখানে لاَ অব্যয়টি অতিরিক্ত। যা আনা হয়েছে বাক্যে তাকীদ সৃষ্টির জন্য।
الْخُنَّسِ একবচনে خَانِسٌ وَخَانِسَةٌ অর্থ خَنَّسَ إذَا تَأَخَّرَ ‘যখন পিছিয়ে গেল, হারিয়ে গেল’। الْجَوَارِ আসলে ছিল الْجَوَارِى একবচনে جَارِيَةٌ অর্থ সন্তরণশীল। الْكُنَّسِ অর্থ الغُيَّبُ ‘গুপ্ত’। একবচনে كَانِسٌ وَكَانِسَةٌ অর্থ ঝোপ। كَنَسَ الْوَحْشُ اِذْ دَخَلَ كِنَاسَهُ ‘পশু লুকিয়ে গেল যখন সে তার ঝোপে প্রবেশ করল’ (তানতাভী)। আলী (রাঃ) বলেন, وَالْخُنَّسُ هِىَ النُّجُوْمُ تَخْنِسُ بِالنَّهَارِ وَتَظْهَرُ بِاللَّيْلِ এগুলি হ’ল ঐসব তারকা, যা দিনের বেলায় লুকিয়ে থাকে ও রাতের বেলায় প্রকাশিত হয়’ (কুরতুবী)। অতঃপর দ্বিতীয় আয়াতে ঐসব নক্ষত্রকে বুঝানো হয়েছে, যা দ্রুত সন্তরণশীল এবং দিনে ও রাতে সর্বদা লুকিয়ে থাকে। এখানে আল্লাহপাক দ্রুত সন্তরণশীল ও বাহ্যতঃ ধীরে গমনকারী সকল প্রকার নক্ষত্রের শপথ করেছেন (سيارت كانت أو ثوابت) (তানতাভী)।
এর মধ্যে সৌরবিজ্ঞানের একটি বড় উৎসের দুয়ার খুলে দেওয়া হয়েছে যে, ঝলমলে রাতের আকাশে যে অসংখ্য তারার মেলা আমাদের দৃষ্টিগোচর হয় এবং আমরা তাদেরকে দিনের বেলায় সূর্যের আলোয় হারিয়ে গিয়ে রাতের বেলায় উঠতে দেখি। এদের বাইরে বহু নক্ষত্র রয়েছে, যাদের আমরা দিনে বা রাতে কখনোই দেখতে পাই না। যাদের আলো পৃথিবীতে পৌঁছতে এখনও বহু আলোকবর্ষ প্রয়োজন হবে। তাদেরকে বাহ্যিক দৃষ্টিতে ছোট ও ধীরগতির নক্ষত্র মনে করা হ’লেও তারা আসলে অনেক বড় এবং অনেক দ্রুতগতির। কিন্তু পৃথিবী থেকে বহু দূরে অবস্থান করায় এরূপ মনে হয়। এমনকি আকাশের একটি উজ্জ্বলতম জোড়া নক্ষত্র যা ‘লুব্ধক’ নামে খ্যাত, সেটি আমাদের সৌরজগৎ থেকে সাড়ে আট আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত। আলোর গতি প্রতি সেকেন্ডে ১ লক্ষ ৮৬ হাযার মাইল বা ৩ লক্ষ কিঃ মিঃ গতিবেগকে এক বছরের হিসাবে এক ‘আলোকবর্ষ’ বলা হয়। সে হিসাবে লুব্ধক কত দূরে তা চিন্তা করা আবশ্যক। অথচ তা কাছেই চকচকে দেখা যায়। এতেই বুঝা যায় নক্ষত্রটি কত বড়। আল্লাহ তাঁর শপথের মাধ্যমে বান্দাকে বুঝিয়ে দিলেন যে, তোমাদের দৃষ্টিসীমা ও জ্ঞানসীমার বাইরে তোমাদের ও তোমাদের পৃথিবীর চাইতে বহু গুণ বড় সৃষ্টি আমার রয়েছে। অতএব তোমাদের কোন অহংকার মানায় না।
নক্ষত্ররাজির হারিয়ে যাওয়া ও অদৃশ্য হয়ে যাওয়া বলার মধ্যে তাদের সন্তরণশীল হওয়ার ইঙ্গিত যেমন রয়েছে, তেমনি একথার ইঙ্গিত রয়েছে যে, প্রত্যেকটি নক্ষত্র দ্রুত হৌক বা বিলম্বে হৌক সেখানেই ফিরে আসবে, যেখান থেকে তার উদয় হয়েছিল। এর মধ্যে তাদের নিজ নিজ কক্ষপথে এবং নিজ অক্ষের উপরে আবর্তনশীল হওয়ার দলীল পাওয়া যায়। গতিশীল এইসব তারকা যে মহান সত্তার হুকুমে সৃষ্টি হয়েছে ও গতিপ্রাপ্ত হয়েছে, তার হুকুমেই একদিন সব গতিহীন হবে ও বিলুপ্ত হবে। প্রত্যেক সৃষ্টিরই লয় আছে। এ পৃথিবীরও একদিন লয় হবে। বাকী রইবেন কেবল আল্লাহ। যেমন তিনি বলেন, كُلُّ مَنْ عَلَيْهَا فَانٍ، وَيَبْقَى وَجْهُ رَبِّكَ ذُو الْجَلاَلِ وَالْإِكْرَامِ ‘পৃথিবীতে যা কিছু আছে সবই ধ্বংস হবে’। ‘বাকী থাকবে কেবল তোমার পালনকর্তার চেহারা, যিনি মহাপরাক্রান্ত ও মহামহিম (রহমান ৫৫/২৬-২৭)। তিনি আরও বলেন, كُلُّ شَيْءٍ هَالِكٌ إِلاَّ وَجْهَهُ لَهُ الْحُكْمُ وَإِلَيْهِ تُرْجَعُوْنَ ‘সবকিছুই ধ্বংস হবে কেবল তাঁর চেহারা ব্যতীত। তাঁর জন্যই সকল রাজত্ব। আর তাঁর দিকেই তোমরা প্রত্যাবর্তিত হবে’ (ক্বাছাছ ২৮/৮৮)।
(১৭-১৮) وَاللَّيْلِ إِذَا عَسْعَسَ، وَالصُّبْحِ إِذَا تَنَفَّسَ ‘শপথ রাত্রির যখন তা নিষ্ক্রান্ত হয়’। ‘এবং শপথ প্রভাতকালের যখন তা প্রকাশিত হয়’।
عَسْعَسَ শব্দটি أَقْبَلَ وَأَدْبَرَ আগমন ও নিষ্ক্রমণ দুই অর্থে ব্যবহৃত হয়। অর্থাৎ إقْباَلُ الْظُّلاَمِ فِىْ أَوَّلِ اللَّيْلِ وَإدْباَرُهُ فِىْ آخِرِهِ- ‘রাত্রির শুরুতে অন্ধকারের আগমন এবং শেষে তার নিষ্ক্রমণ’। এখানে দু’টি অর্থই প্রযোজ্য। তবে ইবনু কাছীর প্রথমটিকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন এবং ইবনু জারীর দ্বিতীয়টিকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। কেননা এর পরেই আল্লাহ প্রভাতকালের শপথ করেছেন। যা রাত্রিকাল নিষ্ক্রান্ত হওয়ার পরেই এসে থাকে।
تَنَفَّسَ অর্থ طَلَعَ وَأَضَاءَ ‘উদিত হওয়া ও উজ্জ্বল হওয়া’। অর্থাৎ প্রভাতকালে সূর্যের উদয় হওয়া ও চারিদিকে পরিষ্কার হওয়া। تَنَفَّسَ -এর আসল অর্থ خُرُوْجُ النَّسِيْمِ مِنَ الْجَوْفِ ‘পেট থেকে শ্বাস বের হওয়া’ (কুরতুবী)। অন্য অর্থে اِنْشَقَّ وَانْفَلَقَ ‘ফেটে যাওয়া, বিভক্ত হওয়া’।
রাত্রির অন্ধকার ভেদ করে সূর্যের আলো বেরিয়ে আসে- এই মর্মটি ফুটিয়ে তোলার জন্যেই এখানে طَلَعَ না বলে تَنَفَّسَ বলা হয়েছে। যাতে বান্দার জন্য ইঙ্গিত রয়েছে পৃথিবীর ঘূর্ণায়মান হওয়ার প্রতি এবং এর আহ্নিক গতির প্রতি, যা ২৪ ঘণ্টায় একবার নিজ অক্ষকেন্দ্রে আবর্তন করে থাকে এবং যার ফলে দিবস ও রাত্রির আগমন ও নির্গমন ঘটে। মাত্র একটি (تَنَفَّسَ ) শব্দে বিজ্ঞানের একটি বিরাট উৎসের সন্ধান দেওয়া হয়েছে এই আয়াতে। অথচ নিরক্ষর নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) কখনোই কোন বৈজ্ঞানিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন না। কুরআন যে স্রেফ আল্লাহর কালাম- এতে যে নবী বা ফেরেশতার বক্তব্যের কোন মিশ্রণ নেই, এ সকল বৈজ্ঞানিক আয়াত তার অন্যতম প্রকৃষ্ট প্রমাণ।
এর মাধ্যমে তিনি জানিয়ে দিয়েছেন যে, আল্লাহ ব্যতীত আর কে আছে যে রাত্রিকে সরিয়ে দিবসকে বের করে আনতে পারে? এটা কেবল আল্লাহরই একক ক্ষমতা। যেমন তিনি বলেন,
قُلْ أَرَأَيْتُمْ إِنْ جَعَلَ اللهُ عَلَيْكُمُ اللَّيْلَ سَرْمَدًا إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ مَنْ إِلَهٌ غَيْرُ اللهِ يَأْتِيْكُمْ بِضِيَاءٍ أَفَلاَ تَسْمَعُوْنَ- قُلْ أَرَأَيْتُمْ إِنْ جَعَلَ اللهُ عَلَيْكُمُ النَّهَارَ سَرْمَدًا إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ مَنْ إِلَهٌ غَيْرُ اللهِ يَأْتِيْكُمْ بِلَيْلٍ تَسْكُنُوْنَ فِيْهِ أَفَلاَ تُبْصِرُوْنَ-
‘তুমি বলে দাও, তোমরা ভেবে দেখেছ কি? যদি আল্লাহ রাত্রিকে তোমাদের উপর ক্বিয়ামত পর্যন্ত স্থায়ী করে দেন, তবে আল্লাহ ব্যতীত তোমাদের এমন কোন উপাস্য আছে, যে তোমাদের নিকট সূর্যকিরণ এনে দেবে? তবুও কি তোমরা কথা শুনবে না’? ‘তুমি বল, তোমরা ভেবে দেখেছ কি? যদি আল্লাহ দিবসকে তোমাদের উপর ক্বিয়ামত পর্যন্ত স্থায়ী করে দেন, তবে আল্লাহ ব্যতীত তোমাদের এমন কোন উপাস্য আছে, যে তোমাদের নিকট রাত্রি এনে দিবে, যাতে তোমরা বিশ্রাম নিতে পারবে? তবুও কি তোমরা ভেবে দেখবে না’? (ক্বাছাছ ২৮/৭১-৭২)।
(১৯) إِنَّهُ لَقَوْلُ رَسُوْلٍ كَرِيْمٍ ‘নিশ্চয় এই কুরআন সম্মানিত বাহকের (জিব্রীলের) আনীত বাণী’।
অর্থাৎ পূর্বে বর্ণিত বড় বড় সৃষ্টির শপথ করে আল্লাহ বলছেন যে, কুরআন কারু বানোয়াট কালাম নয়। বরং সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর কালাম, যা স্বীয় দূত জিব্রীলের মাধ্যমে শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর নিকটে প্রেরিত হয়েছে। ১৫ থেকে ১৮ পর্যন্ত চারটি আয়াতে আল্লাহপাক যে শপথগুলি করেছেন, এ আয়াতটি হ’ল তার জওয়াব।
এখানে رَسُوْلٌ তার আভিধানিক অর্থে এসেছে। অর্থাৎ দূত বা সংবাদবাহক। তিনি জিব্রীল (আঃ) ব্যতীত আর কেউ নন। কেননা জিব্রীল হ’লেন একমাত্র অহিবাহক ফেরেশতা এবং তিনিই হ’লেন ফেরেশতাদের সরদার। যেমন আল্লাহ বলেন, نَزَلَ بِهِ الرُّوْحُ الْأَمِيْنُ ‘রূহুল আমীন (জিব্রীল) এটা নিয়ে অবতরণ করে’ (শো‘আরা ২৬/১৯৩)। অন্যত্র আল্লাহ বলেছেন, قُلْ مَنْ كَانَ عَدُوًّا لِّجِبْرِيْلَ فَإِنَّهُ نَزَّلَهُ عَلَى قَلْبِكَ بِإِذْنِ اللهِ مُصَدِّقاً لِّمَا بَيْنَ يَدَيْهِ وَهُدًى وَّبُشْرَى لِلْمُؤْمِنِيْنَ- ‘তুমি বলে দাও ঐ লোকদের যারা জিব্রীলের শত্রু, তিনি আল্লাহর হুকুমে এ কালাম তোমার অন্তরে নাযিল করেন। যা পূর্বের কিতাব সমূহের সত্যায়নকারী এবং মুমিনদের জন্য পথপ্রদর্শক ও সুসংবাদদাতা’ (বাক্বারাহ ২/৯৭)।
كَرِيْمٌ অর্থ كَرِيْمٌ عَلَى اللهِ ‘আল্লাহর নিকটে সম্মানিত’। ইবনু আববাস, ক্বাতাদাহ, শা‘বী, হাসান বাছরী প্রমুখ বলেন, هو جبريل عليه السلام ‘তিনি হলেন জিব্রীল আলাইহিস সালাম’। ইবনু কাছীর বলেন, إن هذا القران لتبليغ رسول كريم ‘নিশ্চয়ই এই কুরআন অবশ্যই ঐ মহান দূতের পৌঁছানো কালাম’ (ইবনু কাছীর)।
(২০-২১) ذِيْ قُوَّةٍ عِنْدَ ذِي الْعَرْشِ مَكِيْنٍ، مُطَاعٍ ثَمَّ أَمِيْنٍ ‘যিনি শক্তিশালী এবং আরশের অধিপতির নিকটে মর্যাদাবান’। ‘যিনি সকলের মান্যবর ও সেখানকার বিশ্বাসভাজন’।
অত্র আয়াত দু’টিতে জিব্রীলের চারটি গুণ বর্ণনা করা হয়েছে। প্রথম গুণ তিনি হলেন ذِيْ قُوَّةٍ ‘শক্তিশালী’। অন্যত্র বর্ণিত হয়েছে, عَلَّمَهُ شَدِيْدُ الْقُوَى، ذُوْ مِرَّةٍ فَاسْتَوَى، وَهُوَ بِالْأُفُقِ الْأَعْلَى- ‘তাকে শিক্ষা দান করেন এক শক্তিশালী ফেরেশতা’। ‘যিনি সহজাত শক্তিসম্পন্ন। যিনি নিজ আকৃতিতে প্রকাশ পেলেন’। ‘যখন তিনি ছিলেন ঊর্ধ্ব দিগন্তে’ (নাজম ৫৩/৫-৭)। বস্ত্ততঃ জিব্রীলের সহজাত শক্তির আধিক্য বর্ণনার জন্য অত্র আয়াতে ذُو مِرَّةٍ বিশেষণটি ব্যবহৃত হয়েছে। যাতে করে এই ধারণার অবকাশ না থাকে যে, অহী নিয়ে আগমনকারী ফেরেশতার কাজে কোন শয়তান প্রভাব খাটাতে পারে। কেননা জিব্রীল (আঃ) এতই শক্তিশালী যে শয়তান তার কাছেও ঘেঁষতে পারে না। তাছাড়া তিনি আল্লাহর যেকোন হুকুম পালনে সক্ষম। বস্ত্ততঃ জিব্রীলের শক্তিমত্তার বহু প্রমাণ দুনিয়াতেই রয়েছে। যেমন লূত (আঃ)-এর কওমকে ভূমি ও নগরীসহ চোখের পলকে উৎপাটিত করে ফের উপুড় করে ফেলে ধ্বংস করে দেওয়া। ৮১০ কি.মি. (৫৫×১৮ কি.মি.×৩৭৭ মি.) ব্যাপী জর্ডানের যে স্থানটি আজও মৃত সাগর বা লূত সাগর নামে প্রসিদ্ধ হয়ে রয়েছে (উইকিপিডিয়া)। এছাড়াও রয়েছে আদ, ছামূদ, শু‘আয়েব প্রমুখ নবীদের শক্তিশালী জাতিগুলিকে নিমিষে নিশ্চিহ্ন করার ইতিহাস। এর দ্বারা বুঝানো হয়েছে যে, জিব্রীলকে প্রকৃতিগতভাবেই আল্লাহ মহাশক্তিশালী করে সৃষ্টি করেছেন।
দ্বিতীয় গুণ হল مَكِيْنٍ বা মর্যাদাবান। অর্থ صاحب شرف ومكانة عند الله ومنزلة رفيعة لديه ‘আল্লাহর নিকটে রয়েছে তাঁর বিশেষ স্থান ও উচ্চ মর্যাদা’।
তৃতীয় গুণ হ’ল مُطَاعٍ ثَمَّ ‘সেখানে মান্যবর’ অর্থাৎ مسموع القول فى الملأ الأعلى ‘উচ্চতম স্থানের ফেরেশতাগণ তার কথার অনুবর্তী’। তিনি সাধারণ ফেরেশতা নন; বরং ফেরেশতাগণের সর্দার। আর সেজন্যই তাঁকে আল্লাহ ও রাসূলের মাঝে অহী প্রেরণের মহান দূতিয়ালীর জন্য নির্বাচন করা হয়েছে।
চতুর্থ গুণ হ’ল أَمِيْنٍ অর্থ أمين على وحيه تعالى ورسالته ‘আল্লাহ প্রদত্ত অহি ও রিসালাত পৌঁছানোর ব্যাপারে তিনি বিশ্বস্ত ও আমানতদার’। এটাই হ’ল তাঁর জন্য সবচেয়ে বড় বিশেষণ যে, স্বয়ং আল্লাহ তাঁকে ‘আমীন’ বা আমানতদার বলে ঘোষণা করেছেন। তাই এটা নিশ্চিত বিশ্বাস রাখতে হবে যে, কুরআন ও হাদীছের যেটুকু অহী আল্লাহ তাঁর নবীর কাছে প্রেরণ করেন, জিব্রীল (আঃ) সেটুকু হুবহু যথাযথভাবে পৌঁছে দিয়েছেন। একটি শব্দ বা বর্ণ সেখান থেকে খেয়ানত হয়নি। ফালিল্লাহিল হাম্দ।
(২২) وَمَا صَاحِبُكُم بِمَجْنُوْنٍ ‘তোমাদের সাথী (মুহাম্মাদ) পাগল নন’।
এখানে ‘তোমাদের সাথী’ বলে মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে বুঝানো হয়েছে। জিব্রীলকে দেখা ও তার মাধ্যমে অহী নাযিলের বিষয়কে মুশরিক নেতারা বিশ্বাস করত না। তাই তারা রাসূল (ছাঃ)-কে ‘পাগল’ বলত। আবার কখনো ‘ভূতে ধরা রোগী’ (رَجُلاً مَّسْحُوْرًا) বলত (ইসরা ১৭/৪৭)। এখানে সেকথারই জওয়াব দেওয়া হয়েছে। ১৯ নং আয়াতের ন্যায় এ আয়াতটিও جواب القسم বা পূর্ববর্তী শপথসমূহের জওয়াব হিসাবে এসেছে। অর্থাৎ আমি শপথ করে বলছি যে, মুহাম্মাদ পাগল নন। কিংবা তিনি জিনে ধরা রোগীর মত কোন কথা বলেন না বা জ্ঞান লোপ পাওয়া ব্যক্তির মত প্রলাপ বকেন না। আল্লাহ বলেন, بَلْ جَاءَ بِالْحَقِّ وَصَدَّقَ الْمُرْسَلِيْنَ ‘বরং তিনি এসেছেন সত্য সহকারে এবং তিনি বিগত রাসূলগণের সত্যায়ন করেন’ (ছাফফাত ৩৭/৩৭)।
(২৩) وَلَقَدْ رَآهُ بِالْأُفُقِ الْمُبِيْنِ ‘তিনি অবশ্যই তাকে (জিব্রীলকে) দেখেছেন প্রকাশ্য দিগন্তে’ অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) জিব্রীলকে তার নিজস্ব রূপে দেখেছেন। অতএব উক্ত ফেরেশতা তাঁর নিকটে অপরিচিত নন। তিনিই তার নিকটে অহী নিয়ে আগমন করে থাকেন।
উল্লেখ্য যে, জিব্রীলকে তার স্বরূপে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) দু’বার দেখেছেন। প্রথমবার মি‘রাজের পূর্বে ও দ্বিতীয়বার মি‘রাজের সময় সিদরাতুল মুনতাহায়। প্রথম দেখেন মক্কার বাত্বহা (بطحاء) উপত্যকায় ৬০০ ডানা বিশিষ্ট বিশাল অবয়বে। যাতে আসমান যমীনের মধ্যবর্তী দিগন্ত বেষ্টিত হয়ে পড়ে।[18] আয়েশা (রাঃ) বলেন, সাধারণতঃ জিব্রীল রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট আসতেন একজন পুরুষ মানুষের বেশ ধারণ করে। কিন্তু এবার তিনি আসেন নিজস্ব রূপে। যাতে দিগন্তরেখা বন্ধ হয়ে যায়’। ‘ইবনু মাসঊদ (রাঃ)-এর বর্ণনায় এসেছে, এসময় তাঁর ৬০০ ডানা ছিল’।[19] যা বর্তমান সূরায় এবং সূরা নজম ৫ হ’তে ১০ আয়াতে বর্ণিত হয়েছে।[20] দ্বিতীয়বার দেখেন মে‘রাজ রজনীতে, যা বর্ণিত হয়েছে সূরা নজম ১৩ হ’তে ১৬ আয়াতে।[21] আর এটা স্পষ্ট (আল্লাহ সর্বাধিক অবগত) যে, বর্তমান সূরাটি মে‘রাজের রাত্রির আগে নাযিল হয়েছে। কেননা এখানে মাত্র একটি দর্শনের কথা বলা হয়েছে, যেটি প্রথম দর্শন। আর দ্বিতীয়বার দর্শনটি বলা হয়েছে সূরা নজম ১৩ আয়াতে’ (ইবনু কাছীর)। বস্ত্ততঃ জিব্রীলকে স্বরূপে দেখানোর উদ্দেশ্য হ’ল রাসূল (ছাঃ)-এর বিশ্বাসকে আরও মযবুত করা এবং এটা নিশ্চিত করা যে, তাঁর আনীত ইসলামী শরী‘আত স্পষ্ট ও দিব্যজ্ঞানের উপর ভিত্তিশীল। কোনরূপ ধারণা ও কল্পনার উপরে নয় (ক্বাসেমী)।
উল্লেখ্য যে, ফেরেশতাগণ আল্লাহর এক অনন্য সৃষ্টি। যারা নূরের তৈরী। সেকারণ মানুষের চর্মচক্ষু দিয়ে তাদের দেখা সম্ভব নয়। চোখের পলকের চেয়ে তারা দ্রুতগতিসম্পন্ন। আল্লাহর হুকুম পাওয়া মাত্র তারা তা বাস্তবায়ন করেন (নাহল ১৬/৫০)। কল্পনা জগতে যেমন দ্রুততার সাথে আমরা বিচরণ করি। ফেরেশতাগণ তার চাইতে দ্রুততায় আসমান ও যমীনের মাঝে যাতায়াত করে থাকেন। আমাদের স্বপ্ন ও কল্পনাজগতে যা কিছু দৃশ্যমান হয়, আমরা তা ভাবে ও ভাষায়, কথায় ও কলমে প্রকাশ করি। স্বপ্ন ও কল্পনার জগতকে আমরা না দেখে বিশ্বাস করি। বরং বলা চলে, স্বপ্ন নিয়েই মানুষ বেঁচে থাকে ও সম্মুখে এগিয়ে চলে। স্বপ্ন ছাড়া মানুষ মৃত লাশের শামিল। আমরা ফেরেশতাগণকে দেখিনা। কিন্তু তাদের অবস্থান অনুভব করি।
পাশ্চাত্যে এখন স্বপ্নজগত নিয়ে ব্যাপক গবেষণা চলছে। স্বপ্নকে আমরা বাহ্যিকভাবে দেখতে পাই না, ধরতে পারি না। অন্তরজগতে দেখি ও তা বাস্তব বলে বিশ্বাস করি। ফেরেশতাগণের অস্তিত্ব অনুরূপভাবে বাস্তব। তবে পার্থক্য এই যে, মানুষের স্বপ্ন বাস্তবে কোন রূপ ধারণ করতে পারে না। কিন্তু ফেরেশতাগণ প্রয়োজনবোধে বিভিন্ন রূপ ধারণ করতে পারেন। যেমন ছাহাবী দেহিয়াতুল কালবীর রূপ ধারণ করে একবার জিব্রীল (আঃ) স্বয়ং রাসূল (ছাঃ) ও ছাহাবীগণের মজলিসে হাযির হয়ে ইসলাম, ঈমান, ইহসান, ক্বিয়ামত ও ক্বিয়ামতের আলামত বিষয়ে রাসূল (ছাঃ)-কে প্রশ্ন করে ছাহাবীগণকে দ্বীন শিক্ষা দিয়েছিলেন। মিশকাতের শুরুতেই হাদীছটি বর্ণিত হয়েছে। যা ‘হাদীছে জিব্রীল’ নামে খ্যাত। ফেরেশতাগণকে মানুষ তার চর্মচক্ষুতে দেখতে পায় না। তবে অবিশ্বাসীদের জবাব দেবার জন্যই সম্ভবতঃ শেষনবী (ছাঃ)-কে আল্লাহ দেখিয়েছিলেন তাঁর বিশেষ অনুগ্রহে। যেভাবে তাঁকে পার্থিব জগত থেকে বের করে পারলৌকিক জগতে মে‘রাজে নিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর বিশেষ অনুগ্রহে। যদি ফেরেশতা ও রাসূলের মধ্যে কোন সম্পর্ক না থাকতো, তাহ’লে অহী বা রিসালাত কোনটাই পাওয়া সম্ভব হতো না।
উল্লেখ্য যে, আল্লাহ জিব্রীলকেও ‘রাসূল’ বলেছেন (তাকভীর ৮১/১৯), মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কেও ‘রাসূল’ বলেছেন (হা-ক্কাহ ৬৯/৪০)। প্রথমজন হ’লেন ‘ফেরেশতা রাসূল’ (رسول ملكى) এবং দ্বিতীয়জন হ’লেন ‘মানুষ রাসূল’ (رسول بشرى)। আল্লাহ কুরআনকে উক্ত দুই রাসূলের কালাম হিসাবে অভিহিত করেছেন। এর অর্থ হ’ল, ‘ফেরেশতা রাসূল’ ওটাকে আল্লাহর নিকট থেকে ‘মানুষ রাসূল’-এর নিকটে পৌঁছে দিয়েছেন। অতঃপর তিনি সেটা স্বীয় উম্মতের নিকট পৌঁছে দিয়েছেন। মূল কথক হ’লেন আল্লাহ। আর কুরআন হ’ল আল্লাহর বাণী। অতঃপর উক্ত বাণীবাহক হ’লেন জিব্রীল, অতঃপর রাসূল মুহাম্মাদ (ছাঃ)। বাস্তবিকপক্ষে ফেরেশতাগণের উপর ঈমান না থাকলে ইসলামের পুরা প্রাসাদটিই ভেঙ্গে পড়বে। আর ফেরেশতা যে সত্য, তারা যে বিশ্বস্ত, তাদের মধ্যেমে প্রেরিত কুরআন যে সত্য এবং কুরআনের বাহক রাসূল মুহাম্মাদ (ছাঃ) যে সত্য, সে কথা নিশ্চিতভাবে বুঝিয়ে দেয়ার জন্য আল্লাহপাক এখানে নক্ষত্ররাজি এবং রাত্রি ও প্রভাতকালের শপথ করেছেন।
(২৪) وَمَا هُوَ عَلَى الْغَيْبِ بِضَنِيْنٍ ‘তিনি অদৃশ্য বিষয় (অহি) প্রকাশ করতে কৃপণ নন’।
অর্থাৎ মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর নিকটে যা কিছু নাযিল হয়, তা প্রকাশ করতে এবং বিশ্ববাসীকে জানাতে তিনি কৃপণতা করেন না। বরং তা সকলকে পৌঁছে দিয়ে থাকেন। এখানে عَلَى الْغَيْبِ অর্থ على الوحى ‘অহীর বিষয়ে’। অর্থাৎ أنه صادق فيما يخبر به من الوحى المتلو وغير المتلو ‘অহিয়ে মাতলু (কুরআন) ও গায়ের মাতলু (হাদীছ)-এর যে সব বিষয়ে তাকে খবর দেওয়া হয়, সব ব্যাপারে তিনি সত্যবাদী’। যেমন রোম সম্রাট হেরাক্লিয়াস তার দরবারে আবু সুফিয়ানকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, فَهَلْ كُنْتُمْ تَتَّهِمُونَهُ بِالْكَذِبِ قَبْلَ أَنْ يَقُولَ مَا قَالَ؟ قُلْتُ: لاَ ‘অহি-র দাওয়াত দেওয়ার পূর্বে কি তোমরা কখনো তাকে মিথ্যাবাদিতার তোহমত দিয়েছিলে? আবু সুফিয়ান বললেন, না। তখন সম্রাট বললেন, أَنَّهُ لَمْ يَكُنْ لِيَدَعَ الْكَذِبَ على الناس ثم يذهب فيكذِبَ على الله ‘যিনি মানুষের উপর মিথ্যারোপ করেন না, তিনি আল্লাহর উপর মিথ্যারোপ করতে পারেন না’।[22]
ইবনু জারীর بِضَنِيْنٍ পড়েছেন, যার অর্থ ‘কৃপণ’ এবং আবু ওবায়দাহ ও ইবনু কাছীর পড়েছেন, بِظَنِيْنٍ যার অর্থ ‘অপবাদগ্রস্ত’ (مُتَّهَم)। দু’টোর অর্থ কাছাকাছি। অর্থাৎ আল্লাহর অহীসমূহ প্রকাশ ও প্রচার করায় যেমন রাসূল কৃপণ নন, তেমনি প্রকাশ না করার বিষয়ে তিনি অপবাদগ্রস্ত নন। ইবনু কাছীর বলেন, দু’টি ক্বিরাআতই ‘মুতাওয়াতির’ এবং দু’টিরই অর্থ সঠিক (ইবনু কাছীর, ক্বাসেমী)। কাফেররা রাসূল (ছাঃ)-কে গণৎকার (كاهن) বলেছিল। এখানে তারই জবাব দেওয়া হয়েছে যে, কিছু পাওয়ার আশায় গণৎকার যেমন অনেক কথা লুকিয়ে রাখে, রাসূল (ছাঃ) তা নন। বরং তিনি সবকিছু প্রকাশ করে দেন (ক্বাসেমী)।
অত্র আয়াতে এ বিষয়ে ইঙ্গিত রয়েছে যে, মানবতার কল্যাণে সবচেয়ে বড় খিদমত হ’ল অহীর ইলমের প্রচার ও প্রসার ঘটানো। যে কাজ ফেরেশতা ও নবীগণ করে গেছেন। প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার মালিক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীগণ বিষয়টি যথার্থভাবে উপলব্ধি করলে জাতির কল্যাণ ত্বরান্বিত হবে।
(২৫) وَمَا هُوَ بِقَوْلِ شَيْطَانٍ رَّجِيْمٍ ‘এটা (কুরআন) বিতাড়িত শয়তানের উক্তি নয়’।
অর্থাৎ এই কুরআন বিতাড়িত ও অভিশপ্ত শয়তানের উক্তি নয়। এটি মহান সৃষ্টিকর্তা ও পালনকর্তা আল্লাহর বাণী মাত্র। কুরায়েশরা ‘রাজীম’ অর্থ বুঝতো مرجوم و ملعون ‘বিতাড়িত ও অভিশপ্ত’ (কুরতুবী)। বস্ত্তত কুরআন নাযিল করা শয়তানের জন্য কখনোই সম্ভব নয় এবং তার সাধ্যের মধ্যেও নয়। যেমন আল্লাহ অন্যত্র বলেন,وَمَا تَنَزَّلَتْ بِهِ الشَّيَاطِيْنُ، وَمَا يَنْبَغِيْ لَهُمْ وَمَا يَسْتَطِيعُوْنَ، إِنَّهُمْ عَنِ السَّمْعِ لَمَعْزُوْلُوْنَ- ‘এই কুরআন নিয়ে শয়তানেরা অবতরণ করেনি’। ‘তারা এ কাজের উপযু্ক্ত নয় এবং তারা এর ক্ষমতা রাখে না’। ‘তাদেরকে তো (অহী) শ্রবণের স্থান থেকে দূরে রাখা হয়েছে’ (শো‘আরা ২৬/২১০-২১২)। এর মধ্যে রাসূল (ছাঃ)-এর উপরে আরোপিত গণৎকারের অপবাদ খন্ডন করা হয়েছে।
(২৬) فَأَيْنَ تَذْهَبُوْنَ ‘অতএব তোমরা কোথায় যাচ্ছ?’
ক্বাতাদাহ বলেন, এর অর্থ হ’ল-إلى أين تعدلون عن هذا القول وأين تذهبون عن كتابى هذا وطاعتى؟ ‘এই বাণী ছেড়ে তোমরা কোন দিকে ফিরে যাচ্ছ? আমার এই কিতাব ও আমার আনুগত্য ছেড়ে তোমরা কোথায় যাচ্ছ?’ যাজ্জাজ বলেন, أي طريق تسلكون أبين من الطريق الذي بينه الله لكم ‘আল্লাহ তোমাদের জন্য যে রাস্তা বাৎলে দিয়েছেন, তার চাইতে স্পষ্ট কোন্ রাস্তায় তোমরা চলেছ’? (কুরতুবী)। যেমন আবুবকর ছিদ্দীক (রাঃ) বলেছিলেন বনু হানীফা গোত্রের প্রতিনিধিদের উদ্দেশ্যে, যখন তারা রাসূল (ছাঃ)-এর দরবারে এসেছিল এবং ভন্ডনবী মুসায়লামার বানোয়াট কুরআনের কিছু অংশ পাঠ করে শুনিয়েছিল। যা ছিল চরম বাজে ও হাস্যকর বস্ত্ত। তিনি সেদিন বলেছিলেন,ويحكم، أين يُذهَبُ بعقولكم؟ والله إن هذا الكلام لم يخرج من إلٍّ : أى من إله- ‘তোমাদের ধ্বংস হৌক! তোমাদের জ্ঞান-বিবেক কোথায় গিয়েছে? আল্লাহর কসম এরূপ কথা কখনোই আল্লাহর নিকট থেকে বের হয়নি’ (ইবনু কাছীর)।
এজন্যেই আরবীতে প্রবাদ রয়েছে, كلام الملوك ملوك الكلام ‘রাজার কথা হয় কথার রাজা’। অর্থাৎ আল্লাহ যেমন সেরা, তাঁর বাণীও তেমনি সেরা। অন্যের কোন কথা তার তুলনীয় হ’তে পারে না।
(২৭) إِنْ هُوَ إِلاَّ ذِكْرٌ لِّلْعَالَمِيْنَ ‘এটা তো বিশ্ববাসীদের জন্য উপদেশ মাত্র’।
এখানে إِنْ অর্থ مَا। কেননা নিয়ম হ’ল এই যে, إِنْ -এর পরে إِلاَّ আসলে তার অর্থ হবে مَا অর্থাৎ ‘না’।
কুরআন হ’ল বিশ্ববাসীদের জন্য উপদেশ এবং অফুরন্ত কল্যাণের উৎস। যা থেকে মানুষ যুগ-জিজ্ঞাসার জবাব নেবে এবং মানসিক শান্তি ও দুনিয়া-আখেরাতের কল্যাণ লাভ করবে। অন্য আয়াতে কুরআনের বিশেষণে আল্লাহ বলেছেন, هَـذَا بَيَانٌ لِّلنَّاسِ وَهُدًى وَّمَوْعِظَةٌ لِّلْمُتَّقِيْنَ ‘এ কুরআন মানুষের জন্য বিস্তৃত ব্যাখ্যা, সুপথ প্রদর্শক এবং আল্লাহভীরুদের জন্য উপদেশবাণী’ (আলে ইমরান ৩/১৩৮)। অন্যত্র তিনি বলেন, هُدًى لِّلنَّاسِ وَبَيِّنَاتٍ مِّنَ الْهُدَى وَالْفُرْقَانِ ‘মানুষের জন্য হেদায়াত এবং হেদায়াতের সুস্পষ্ট ব্যাখ্যাবলী এবং সত্য ও মিথ্যার পার্থক্যকারী’ (বাক্বারাহ ২/১৮৫)। কুরআনের এ সত্য শাশ্বত ও চিরন্তন। যা যুগের পরিবর্তনের সাথে পরিবর্তনশীল নয়। বরং কুরআন হ’ল যুগ ও সমাজের পরিবর্তনকারী। যেমন আল্লাহ বলেন, وَتَمَّتْ كَلِمَتُ رَبِّكَ صِدْقاً وَّعَدْلاً لاَّ مُبَدِّلِ لِكَلِمَاتِهِ وَهُوَ السَّمِيْعُ الْعَلِيْمُ- ‘তোমার পালনকর্তার বাণী সত্য ও ন্যায় দ্বারা পূর্ণ। তাঁর বাণীসমূহের পরিবর্তনকারী কেউ নেই। (এর বিরুদ্ধে লোকেরা যা কিছু বলে, সে বিষয়ে তিনি) শ্রবণকারী ও সর্বজ্ঞ’ (আন‘আম ৬/১১৫)। অতএব তাদের শাস্তি ইহকালে ও পরকালে হবেই। পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ প্রবৃত্তির অনুসারী ও পথভ্রষ্ট। ফলে অধিকাংশের চাপে যাতে রাসূল (ছাঃ) ভীত না হন, সেজন্য এর পরের আয়াতেই বলা হয়েছে, وَإِنْ تُطِعْ أَكْثَرَ مَنْ فِي الْأَرْضِ يُضِلُّوْكَ عَنْ سَبِيْلِ اللهِ إِنْ يَّتَّبِعُوْنَ إِلاَّ الظَّنَّ وَإِنْ هُمْ إِلاَّ يَخْرُصُوْنَ- ‘যদি তুমি পৃথিবীর অধিকাংশ লোকের কথা মেনে চল, তবে তারা তোমাকে আল্লাহর পথ হ’তে বিচ্যুত করবে। তারা তো কেবল ধারণার অনুরসণ করে এবং তারা তো কেবল অনুমান ভিত্তিক কথা বলে’ (আন‘আম ৬/১১৬)।
অতএব কুরআনের সত্যতায় সন্দেহবাদ আরোপ করে অবিশ্বাসীরা যা খুশী বলুক, তুমি তাতে কর্ণপাত করবে না। বরং কুরআনের উপদেশবাণী সবাইকে উদারভাবে শুনিয়ে যাও। কেননা إِنَّ هَذِهِ تَذْكِرَةٌ فَمَنْ شَاءَ اتَّخَذَ إِلَى رَبِّهِ سَبِيْلاً ‘এই কুরআন হ’ল উপদেশগ্রন্থ। অতএব যে চায় সে তার প্রভুর রাস্তা অবলম্বন করুক’ (দাহর ৭৬/২৯)।
(২৮) لِمَنْ شَاءَ مِنْكُمْ أَنْ يَّسْتَقِيْمَ ‘সেই ব্যক্তির জন্য, যে ব্যক্তি তোমাদের মধ্যে সরল পথে চলতে চায়’।
অর্থ من شآء أن يتبع الحق ويقيم عليه ‘যে ব্যক্তি চায় হক-এর অনুসরণ করতে ও তার উপর দৃঢ় থাকতে’ (কুরতুবী)। এর মধ্যে অদৃষ্টবাদী (জাবরিয়া)-দের প্রতিবাদ রয়েছে।
অর্থাৎ কুরআন হ’ল উপদেশগ্রন্থ ঐ ব্যক্তির জন্য, যে ব্যক্তি শিরক বিমুক্ত নির্ভেজাল তাওহীদ বিশ্বাস ও ছহীহ সুন্নাহর উপরে দৃঢ় থাকতে চায়। কেননা প্রকৃত সত্যের সন্ধানী যারা, কুরআন হ’ল তাদের চূড়ান্ত পথ নির্দেশক। এ পথেই রয়েছে মুক্তি। আর অন্য পথে রয়েছে কেবলই ধ্বংস আর বিপত্তি। ইবনু কাছীর বলেন, من أراد الهداية فعليه بهذا القرآن فإنه منجاةٌ له وهداية ولا هداية فيما سواه- ‘যে ব্যক্তি সুপথ পেতে চায়, তার জন্য অপরিহার্য হ’ল এই কুরআন। কেননা এটিই হ’ল তার জন্য নাজাত ও হেদায়াতের পথ। এর বাইরে কোন সুপথ নেই’।
এখানে استقامت তথা দৃঢ় থাকার কথা বলা হয়েছে। কেননা যুক্তিবাদী দোদেল বান্দার কোন স্থান আল্লাহর কাছে নেই। আল্লাহ তার রাসূলকে এ বিষয়ে বিশেষভাবে নির্দেশ দিয়ে বলেন, فَاسْتَقِمْ كَمَا أُمِرْتَ وَمَنْ تَابَ مَعَكَ وَلاَ تَطْغَوْا إِنَّهُ بِمَا تَعْمَلُوْنَ بَصِيْرٌ- ‘তোমাকে যেভাবে নির্দেশ করা হয়েছে, সেভাবে দৃঢ় থাক এবং যারা তোমার সঙ্গে তওবা করেছে তারাও। (কোন অবস্থায়) সীমালংঘন করবে না। নিশ্চয়ই তিনি সবকিছু দেখেন যা তোমরা করো’ (হূদ ১১/১১২)। এ আয়াতে শুধু নবীকেই নয়, সকল ঈমানদার ও মুত্তাকী মুসলমানকে কঠোরভাবে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কেননা দুনিয়ার যত অশান্তির মূলে হ’ল বাতিলের সঙ্গে আপোষকামী দুর্বলচেতা লোকেরা। প্রকৃত ঈমানদার ব্যক্তি কখনই তাদের দলভুক্ত হবে না।
রাসূল (ছাঃ)-এর দাড়িতে তাড়াতাড়ি পাক ধরলে একদিন হযরত আবুবকর (রাঃ) রাসূল (ছাঃ)-কে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করলেন। তখন রাসূল (ছাঃ) বললেন, সূরা হূদ, ওয়াক্বি‘আহ, মুরসালাত, নাবা ও তাকভীর আমাকে বৃদ্ধ করে দিয়েছে’।[23]
কুরতুবী বলেন, বলা হয়ে থাকে যে, সূরা হূদের فَاسْتَقِمْ كَمَا أُمِرْتَ (১১/১১২) আয়াতটি রাসূল (ছাঃ)-কে বৃদ্ধ করে দিয়েছে।[24] কেননা শয়তানের জাঁকজমক ও বাতিলে ভরা এ দুনিয়ায় আল্লাহর পথে দৃঢ় থাকা খুবই কঠিন বিষয়। যারা সত্যের উপরে দৃঢ় থাকে, তাদের ইহকালীন ও পরকালীন পুরস্কার সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,
إِنَّ الَّذِيْنَ قَالُوْا رَبُّنَا اللهُ ثُمَّ اسْتَقَامُوْا تَتَنَزَّلُ عَلَيْهِمُ الْمَلاَئِكَةُ أَلاَّ تَخَافُوْا وَلاَ تَحْزَنُوْا وَأَبْشِرُوْا بِالْجَنَّةِ الَّتِيْ كُنتُمْ تُوْعَدُوْنَ- نَحْنُ أَوْلِيَاؤُكُمْ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَفِي الْآخِرَةِ وَلَكُمْ فِيْهَا مَا تَشْتَهِيْ أَنفُسُكُمْ وَلَكُمْ فِيْهَا مَا تَدَّعُوْنَ- نُزُلاً مِّنْ غَفُوْرٍ رَّحِيْمٍ-
‘নিশ্চয় যারা বলে আমাদের পালনকর্তা আল্লাহ। অতঃপর তার উপর অবিচল থাকে। তাদের উপরে ফেরেশতাগণ নাযিল হয় এবং বলে, তোমরা ভয় পেয়ো না, চিন্তা করো না, তোমরা তোমাদের প্রতিশ্রুত জান্নাতের সুসংবাদ গ্রহণ কর’। ‘ইহকালে ও পরকালে আমরা তোমাদের বন্ধু। যেখানে তোমাদের জন্য আছে, যা তোমাদের মন চাইবে এবং সেখানে তোমাদের জন্য প্রস্ত্তত রয়েছে যা তোমরা দাবী করবে’। ‘এটা হবে ক্ষমাশীল ও দয়াময়ের পক্ষ হ’তে বিশেষ আপ্যায়ন’ (হামীম সাজদাহ ৪১/৩০-৩২)।
(২৯) وَمَا تَشَاؤُوْنَ إِلاَّ أَنْ يَّشَاءَ اللهُ رَبُّ الْعَالَمِيْنَ ‘আর তোমরা ইচ্ছা করতে পারো না কেবল ঐটুকু ব্যতীত যা আল্লাহ ইচ্ছা করেন, যিনি বিশ্বচরাচরের পালনকর্তা’।
২৭ আয়াতে বর্ণিত ذِكْرٌ لِّلْعَالَمِيْنَ ও বর্তমান আয়াতে বর্ণিত رَبُّ الْعَالَمِيْنَ -এর মর্ম এক নয়। কেননা পূর্বের আয়াতে ‘জগদ্বাসী’কে বুঝানো হয়েছে এবং অত্র আয়াতে আল্লাহ ব্যতীত সকল সৃষ্টবস্ত্তকে বুঝানো হয়েছে। পূর্বের আয়াতের চাইতে বর্তমান আয়াতের অর্থ অতি ব্যাপক। মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাব (রহঃ) বলেন, كل ما سوى الله فهو عالم وانا واحد من ذلك العالم ‘আল্লাহ ব্যতীত সবকিছুই সৃষ্টবস্ত্ত (عالم) এবং আমিও তার অন্যতম’।
অর্থাৎ আল্লাহ বলছেন, তোমাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার উপরে সবকিছু নির্ভর করে না। তোমরা ইচ্ছা করলেই সত্যের উপর টিকে থাকবে, এটা তোমাদের সাধ্যায়ত্ত নয়। অতএব সর্বাবস্থায় আল্লাহর অনুগ্রহ কামনা করতে হবে। কারণ, وَاللهُ يَخْتَصُّ بِرَحْمَتِهِ مَنْ يَشَاءُ ‘আল্লাহ যাকে চান তাকে স্বীয় রহমতের জন্য খাছ করে নেন’ (বাক্বারাহ ২/১০৫)। يُدْخِلُ مَنْ يَّشَاءُ فِىْ رَحْمَتِهِ ‘তিনি যাকে ইচ্ছা করেন, নিজ অনুগ্রহের মধ্যে প্রবেশ করান’ (দাহর ৭৬/৩১)। তিনি আরও বলেন, وَمَا كَانَ لِنَفْسٍ أَنْ تُؤْمِنَ إِلاَّ بِإِذْنِ اللهِ ‘আল্লাহর হুকুম ব্যতীত কেউ ঈমান আনতে সক্ষম হয় না’ (ইউনুস ১০/১০০)। তিনি স্বীয় রাসূলকে বলেন, إِنَّكَ لاَ تَهْدِيْ مَنْ أَحْبَبْتَ وَلَكِنَّ اللهَ يَهْدِيْ مَنْ يَّشَاءُ- ‘তুমি যাকে চাও তাকে হেদায়াত করতে পারো না; বরং আল্লাহ যাকে ইচ্ছা হেদায়াত দান করে থাকেন’ (ক্বাছাছ ২৮/৫৬)।
আয়াতটি নাযিল হওয়ার কারণ এই যে, যখন পূর্বের ২৮ নং আয়াতটি নাযিল হয়, তখন আবু জাহল শুনে বলে ওঠে, الأمر إلينا، إن شئنا استقمنا وإن شئنا لم نستقم ‘এখন তো বিষয়টি আমাদের হাতে এসে গেল। আমরা ইচ্ছা করলে আল্লাহর উপরে অবিচল থাকব, নইলে থাকব না’। তখন তার জওয়াবে অত্র আয়াতটি নাযিল হয় (ইবনু জারীর, কুরতুবী, ইবনু কাছীর)।
একই ধরনের অজুহাত পূর্বের ও পরের সকল কাফির-মুশরিকরা পেশ করে থাকে। যেমন আল্লাহ বলেন, سَيَقُوْلُ الَّذِيْنَ أَشْرَكُوْا لَوْ شَاءَ اللهُ مَا أَشْرَكْنَا وَ لاَ آبَاؤُنَا وَ لاَ حَرَّمْنَا مِنْ شَيْءٍ كَذَلِكَ كَذَّبَ الَّذِيْنَ مِنْ قَبْلِهِمْ حَتَّى ذَاقُوْا بَأْسَنَا قُلْ هَلْ عِنْدَكُمْ مِنْ عِلْمٍ فَتُخْرِجُوْهُ لَنَا إِنْ تَتَّبِعُوْنَ إِلاَّ الظَّنَّ وَإِنْ أَنْتُمْ إِلاَّ تَخْرُصُوْنَ- ‘সত্বর মুশরিকরা বলবে, যদি আল্লাহ ইচ্ছা করতেন, তবে না আমরা শিরক করতাম, না আমাদের বাপ-দাদারা করত, না আমরা কোন বস্ত্তকে হারাম করতাম। এমনিভাবে তাদের পূর্ববর্তীরা মিথ্যারোপ করেছে। অবশেষে তারা আমাদের শাস্তি আস্বাদন করেছে। তুমি বল, তোমাদের কাছে (উক্ত দাবীর পক্ষে) কোন প্রমাণ আছে কি, যা আমাদের দেখাতে পার? বস্ত্ততঃ তোমরা কেবল ধারণার অনুসরণ কর এবং তোমরা কেবল অনুমানভিত্তিক কথা বল’ (আন‘আম ৬/১৪৮)।
ইমাম কুরতুবী বলেন, আবু জাহল হ’ল তাকদীর অস্বীকারকারীদের নেতা (رأس القدرية)। কেননা তাকদীরকে অস্বীকারকারী লোকেরা নিজেদেরকে অদৃষ্টের স্রষ্টা বলে থাকে। তারা মনে করে, মানুষ নিজেই নিজের ভাগ্যনিয়ন্তা। এইসব লোকের কণ্ঠে আবু জাহলের কণ্ঠস্বর শোনা যায়।
বস্ত্ততঃ ‘ভাগ্য’ হ’ল আল্লাহর ‘নির্ধারণ’ যা আসমান ও যমীন সৃষ্টির পঞ্চাশ হাযার বছর পূর্বেই তিনি নির্ধারণ করেছেন।[25] মায়ের গর্ভে রূহ প্রেরণের পর সেই পূর্ব নির্ধারিত তাকদীর অর্থাৎ মানব সন্তানের আয়ুষ্কাল, তার কর্মকান্ড, তার রিযিক ও সে ভাগ্যবান (জান্নাতী) হবে, না হতভাগা (জাহান্নামী) হবে- এ চারটি বিষয় তার কপালে লিখে দেওয়া হয়।[26] ঠিক যেমন ঔষধের আবিষ্কারক তার ঔষধের গুণাগুণ, কর্মক্ষমতা, মেয়াদকাল সব আগে থেকেই জানেন এবং তা পরে বাজারে ছাড়ার আগে প্যাকেটের উপরে লিখে দেন। আবিষ্কারক তা জানলেও ঔষধ নিজে তা জানে না। অমনিভাবে মানুষের সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ মানুষের সবকিছু আগে থেকে জানলেও মানুষ তা জানে না। তার নিজের ভাগ্য পরিবর্তনের ক্ষমতা তার নেই। যতক্ষণ না আল্লাহ তা পরিবর্তন করেন। এক্ষণে মানুষ যেহেতু তার ভাগ্য সম্পর্কে জানে না, তাই তাকে আল্লাহর উপরে ভরসা করে তার দেখানো পথে কাজ করে যেতে বলা হয়েছে। কাজ করা বা না করার ব্যাপারে এবং ভাল-মন্দ পথ বেছে নেবার ব্যাপারে আল্লাহ তাকে স্বাধীনতা দিয়েছেন তাকে পরীক্ষা করার জন্য (দাহর ৭৬/৩; মুল্ক ৬৭/২)। মানুষ তার শক্তি ও সাধ্যমত বৈধ পথে চেষ্টা করে যাবে এটাই তার দায়িত্ব। চেষ্টা না করলে সে কিছুই পাবে না (নাজম ৫৩/৩৯) এবং আল্লাহ তার অবস্থার পরিবর্তন ঘটাবেন না (রা‘দ ১৩/১১)। সফলতা ও ব্যর্থতা সবকিছুই আল্লাহর হাতে (রা‘দ ১৩/৩১)। এভাবে তার প্রচেষ্টা যেখানে শেষ হবে, তার তাকদীর সেখান থেকে শুরু হবে। যদিও তার প্রচেষ্টাও তাকদীরের অংশ। এভাবে বান্দার ইচ্ছা অবশেষে আল্লাহর ইচ্ছার কাছে গিয়ে আত্মসমর্পণ করে। আল্লাহ মানুষকে সীমাবদ্ধ জ্ঞান ও ক্ষমতা দান করেছেন। সেই ক্ষমতার শেষ সীমায় পৌঁছে গেলে নিজেকে ইচ্ছায় হৌক অনিচ্ছায় হৌক আল্লাহর পূর্ব নির্ধারণ অর্থাৎ তাকদীরের কাছে সমর্পণ করে দিতেই হয়। আর আল্লাহর ইচ্ছার মধ্যে সর্বদা বান্দার কল্যাণ নিহিত থাকে। যদিও অনেক সময় বান্দা আল্লাহর সেই হিকমত বুঝতে পারে না। আল্লাহ বলেন, وَعَسَى أَنْ تَكْرَهُوْا شَيْئاً وَّهُوَ خَيْرٌ لَّكُمْ وَعَسَى أَنْ تُحِبُّواْ شَيْئاً وَّهُوَ شَرٌّ لَّكُمْ وَاللهُ يَعْلَمُ وَأَنْتُمْ لاَ تَعْلَمُوْنَ- ‘তোমরা কোন বস্ত্ত অপসন্দ কর, অথচ তা তোমাদের জন্য মঙ্গলকর। আবার তোমরা কোন বস্ত্ত পসন্দ কর, অথচ তা তোমাদের জন্য ক্ষতিকর। বস্ত্ততঃ আল্লাহ (সকল বিষয়ে) জানেন। কিন্তু তোমরা জানো না’ (বাক্বারাহ ২/২১৬)।
উপরোক্ত আয়াতকে ভ্রান্ত ফের্কা জাবরিয়াগণ (অদৃষ্টবাদীগণ) নিজেদের পক্ষে দলীল হিসাবে পেশ করে বলেন যে, ‘মানুষের ইচ্ছা বলে কিছু নেই’। ‘কিছু হইতে কিছু হয় না। যা কিছু হয় আল্লাহ হইতে হয়’। অপরদিকে আরেক ভ্রান্ত ফের্কা মু‘তাযিলা যুক্তিবাদীগণ বলেন যে, শিরক কখনো আল্লাহর ইচ্ছায় হ’তে পারে না। অতএব বান্দা নিজ ইচ্ছায় স্বাধীন। তাকদীর বলে কিছু নেই। অথচ তাদের এই যুক্তি বাতিল। কেননা সূরা আন‘আম ১৪৮ আয়াতে আল্লাহ মুশরিকদের নিন্দা করেছেন এজন্য যে, তারা সত্যের সন্ধানে প্রচেষ্টা পরিত্যাগ করেছে।[27] আর তারা এসব কথা বলেছে ঠাট্টা ও বিদ্রুপচ্ছলে। যেমন তারা বলত,وَقَالُوْا لَوْ شَاءَ الرَّحْمَنُ مَا عَبَدْنَاهُمْ ‘দয়াময় (আল্লাহ) চাইলে আমরা ঐসব উপাস্যদের পূজা করতাম না’ (যুখরুফ ৪৩/২০)। যদি তারা একথা আল্লাহর প্রতি সম্মান ও মর্যাদাবোধ থেকে বলত, তাহ’লে আল্লাহ তাদেরকে দোষারোপ করতেন না। যেমন তিনি বলেছেন, وَلَوْ شَاءَ اللهُ مَا أَشْرَكُوْا ‘আল্লাহ চাইলে তারা শিরক করতো না’ (আন‘আম ৬/১০৭)। তারা ঈমান আনতে পারত না, যদি আল্লাহ না চাইতেন (আন‘আম ৬/১১১)। তিনি চাইলে সবাইকে হেদায়াত দান করতেন (নাহল ১৬/৯; সাজদাহ ৩২/১৩)। মুমিনগণ এসব কথা বলে থাকে আল্লাহর উপর বিশ্বাস থেকে (কুরতুবী)। কিন্তু অন্যেরা তা বলে অবিশ্বাস থেকে।
তাকদীরে বিশ্বাসের ফল এই দাঁড়ায় যে, বান্দা ব্যর্থতার গ্লানিতে হতাশাগ্রস্ত হয় না। বরং আল্লাহর ইচ্ছাকে মেনে নিয়ে তার উপরে ভরসা করে সে পুনরায় নতুন উদ্যমে এগিয়ে চলে। পক্ষান্তরে তাকদীরে অবিশ্বাসী ব্যক্তি কোন কাজে ব্যর্থ হ’লে হতাশার গ্লানিতে ভেঙ্গে পড়ে। এমনকি আত্মহত্যা করতেও পিছপা হয় না। এজন্যেই তো দেখা যায় জাপান সহ পৃথিবীর শিল্পোন্নত ও সচ্ছল দেশগুলিতেই আত্মহত্যাকারীর সংখ্যা বেশী। অথচ তাকদীরে বিশ্বাসী একজন সত্যিকারের মুসলমান শত বিপদেও ভেঙ্গে পড়ে না। সে একে আল্লাহর পরীক্ষা মনে করে এবং তা হাসিমুখে বরণ করে নেয়। অতঃপর আল্লাহর উপরে ভরসা রেখে এবং তারই সাহায্য প্রার্থনা করে তারই দেখানো পথ ধরে বিপদ উত্তরণের চেষ্টায় ব্রতী হয়। যেসব লোকেরা হরহামেশা জনগণের ভাগ্য পরিবর্তনের কথা বলেন, তারা নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনের ক্ষমতা রাখেন কি? এত বড় অহংকারী কথা আল্লাহ কখনোই বরদাশত করেন না।
সারকথা :
সূরাটিতে ক্বিয়ামতের বাস্তব বাণীচিত্র অংকন করা হয়েছে। এতে মানুষকে একথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, দুনিয়ার এ ভবলীলা একদিন সাঙ্গ হবেই এবং ক্বিয়ামত সংঘটিত হবেই। অতঃপর প্রত্যেক মানুষকে তার সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর নিকটে তার সারা জীবনের ভাল-মন্দ কর্মসমূহের হিসাব দিতে হবে। আর নিঃসন্দেহে কুরআন আল্লাহ প্রেরিত কিতাব। যা বিশ্ববাসীর জন্য উপদেশ স্বরূপ।[1]. তিরমিযী, আহমাদ, হাকেম হা/৩৩৩৩; আলবানী, ছহীহাহ হা/১০৮১।
[2]. বায়হাক্বী; ছহীহাহ হা/১২৪; বুখারী হা/৩২০০; মিশকাত হা/৫৬৯২, ৫৫২৬।
[3]. মিশকাত হা/৫৫২৬-এর টীকা দ্রষ্টব্য।
[4]. মুসলিম হা/২৫৮২, মিশকাত হা/৫১২৮ ‘যুলুম’ অনুচ্ছেদ; ইবনু জারীর, আহমাদ হা/৮৭৪১; সিলসিলা ছহীহাহ হা/১৯৬৬-৬৭।
[5]. মুস্তাদরাক হাকেম হা/৩৯০২, সনদ ছহীহ।
[6]. বুখারী হা/৬১৬৮, মুসলিম হা/২৬৪০; মিশকাত হা/৫০০৮, ‘শিষ্টাচার’ অধ্যায়।
[7]. বুখারী হা/৩৬৮৮, মুসলিম হা/২৬৩৯; মিশকাত হা/৫০০৯।
[8]. দারেমী হা/২; সিলসিলা ছহীহাহ হা/৩৩৮৯ আলোচনা দ্রষ্টব্য।
[9]. দারেমী হা/১; বুখারী হা/৬৯২১।
[10]. আহমাদ, মুসলিম হা/১৪৪২, ইবনু মাজাহ, প্রভৃতি; মিশকাত হা/৩১৮৯।
[11]. মুসলিম হা/১৪৩৮, মিশকাত হা/৩১৮৭।
[12]. বুখারী হা/৫০৭৩-৭৪।
[13]. আহমাদ হা/১৫৯৬৫; আবুদাঊদ হা/৪৭১৭ ‘মুশরিকদের মৃত শিশু সন্তান’ অনুচ্ছেদ; মিশকাত হা/১১২ ।
[14]. আবুদাঊদ হা/২৫২১; মিশকাত হা/৩৮৫৬, সনদ ছহীহ।
[15]. তিরমিযী হা/১৪২৩, আবুদাঊদ, মিশকাত হা/৩২৮৭, ‘বিবাহ’ অধ্যায়, ‘খোলা ও তালাক’ অনুচ্ছেদ।
[16]. তাফসীরে কুরতুবী, উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য।
[17]. বুখারী হা/৬৫১৯, মুসলিম হা/২৭৮৭, মিশকাত হা/৫৫২২।
[18]. তিরমিযী হা/৩২৭৮, ৩২৮৩; মিশকাত হা/৫৬৬১-৬২।
[19]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৫৬৬২।
[20]. عَلَّمَهُ شَدِيدُ الْقُوَى- ذُو مِرَّةٍ فَاسْتَوَى- وَهُوَ بِالْأُفُقِ الْأَعْلَى- ثُمَّ دَنَا فَتَدَلَّى- فَكَانَ قَابَ قَوْسَيْنِ أَوْ أَدْنَى- فَأَوْحَى إِلَى عَبْدِهِ مَا أَوْحَى =নাজম ৫৩/৫-১০।
[21]. وَلَقَدْ رَآهُ نَزْلَةً أُخْرَى- عِنْدَ سِدْرَةِ الْمُنْتَهَى- عِنْدَهَا جَنَّةُ الْمَأْوَى- إِذْ يَغْشَى السِّدْرَةَ مَا يَغْشَى =নাজম ৫৩/১৩-১৬।
[22]. বুখারী হা/২৯৪১, মুসলিম হা/১৭৭৩; মিশকাত হা/৫৮৬১।
[23]. তিরমিযী হা/৩২৯৭, হাকেম ২/৪৭৬; ছহীহাহ হা/৯৫৫।
[24]. কুরতুবী, সূরা হূদ-এর তাফসীরের ভূমিকা দ্রষ্টব্য।
[25]. মুসলিম হা/২৬৫৩; মিশকাত হা/৭৯।
[26]. বুখারী হা/৬৫৯৪; মুসলিম হা/২৬৪৩; মিশকাত হা/৮২।
[27]. سَيَقُولُ الَّذِينَ أَشْرَكُوا لَوْ شَاءَ اللهُ مَا أَشْرَكْنَا وَلاَ آبَاؤُنَا وَلَا حَرَّمْنَا مِنْ شَيْءٍ كَذَلِكَ كَذَّبَ الَّذِينَ مِنْ قَبْلِهِمْ حَتَّى ذَاقُوا بَأْسَنَا قُلْ هَلْ عِنْدَكُمْ مِنْ عِلْمٍ فَتُخْرِجُوهُ لَنَا إِنْ تَتَّبِعُونَ إِلاَّ الظَّنَّ وَإِنْ أَنْتُمْ إِلَّا تَخْرُصُونَ অনুবাদ : ‘সত্বর মুশরিকরা বলবে, যদি আল্লাহ চাইতেন, আমরা বা আমাদের বাপ-দাদারা শিরক করত না এবং আমরা কোন বস্ত্তকে হারাম করতাম না। বস্ত্ততঃ এভাবেই তাদের পূর্বেকার অবিশ্বাসীরা (স্ব স্ব রাসূলদেরকে) মিথ্যা সাব্যস্ত করেছিল। শেষ পর্যন্ত তারা আমাদের শাস্তির স্বাদ আস্বাদন করেছিল। বলুন! তোমাদের (এ দাবীর স্বপক্ষে) কোন প্রমাণ আছে কি? যা আমাদের কাছে পেশ করতে পারো? তোমরা তো কেবল ধারণার অনুসরণ কর। আর তোমরা তো কেবল অনুমান ভিত্তিক কথা বলছ’ (আন‘আম ৬/১৪৮)।