সূরা শামস
(সূর্য)
সূরা ক্বদর-এর পরে মক্কায় অবতীর্ণ।
সূরা ৯১, আয়াত ১৫, শব্দ ৫৪, বর্ণ ২৪৯।
بِسْمِ اللہِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِیْمِ
পরম করুণাময় অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে (শুরু করছি)।
(১) শপথ সূর্যের ও তার কিরণের | وَالشَّمْسِ وَضُحَاهَا |
(২) শপথ চন্দ্রের যখন তা সূর্যের পশ্চাতে আসে | وَالْقَمَرِ إِذَا تَلَاهَا |
(৩) শপথ দিবসের যখন তা সূর্যকে প্রকাশ করে দেয় | وَالنَّهَارِ إِذَا جَلَّاهَا |
(৪) শপথ রাত্রির যখন তা সূর্যকে ঢেকে দেয়, | وَاللَّيْلِ إِذَا يَغْشَاهَا |
(৫) শপথ আকাশের ও তার নির্মাণের | وَالسَّمَاءِ وَمَا بَنَاهَا |
(৬) শপথ পৃথিবীর ও তার বিস্তৃতির | وَالْأَرْضِ وَمَا طَحَاهَا |
(৭) শপথ মানুষের ও তার বিন্যস্ত করণের, | وَنَفْسٍ وَمَا سَوَّاهَا |
(৮) অতঃপর তার মধ্যে তিনি দুষ্কৃতির ও সুকৃতির প্রেরণা নিক্ষেপ করেছেন। | فَأَلْهَمَهَا فُجُورَهَا وَتَقْوَاهَا |
(৯) সফল হয় সেই ব্যক্তি, যে তার নফসকে পরিশুদ্ধ করে। | قَدْ أَفْلَحَ مَنْ زَكَّاهَا |
(১০) এবং ব্যর্থ হয় সেই ব্যক্তি, যে তার নফসকে কলুষিত করে। | وَقَدْ خَابَ مَنْ دَسَّاهَا |
(১১) ছামূদ জাতি মিথ্যারোপ করেছিল অবাধ্যতা বশে | كَذَّبَتْ ثَمُودُ بِطَغْوَاهَا |
(১২) যখন তাদের সর্বাধিক দুরাচার ব্যক্তিটি তৎপর হয়ে উঠেছিল। | إِذِ انْبَعَثَ أَشْقَاهَا |
(১৩) অতঃপর তাদেরকে আল্লাহর রাসূল বলেছিল, আল্লাহর উষ্ট্রী ও তার পানি পান করার ব্যাপারে সাবধান হও! | فَقَالَ لَهُمْ رَسُولُ اللَّهِ نَاقَةَ اللَّهِ وَسُقْيَاهَا |
(১৪) কিন্তু তারা তাঁকে মিথ্যা সাব্যস্ত করেছিল। অতঃপর উষ্ট্রীর পা কর্তন করেছিল। ফলে তাদের পাপের কারণে তাদের পালনকর্তা তাদের সমূলে ধ্বংস করে জনপদকে একাকার করে দিলেন। | فَكَذَّبُوهُ فَعَقَرُوهَا فَدَمْدَمَ عَلَيْهِمْ رَبُّهُمْ بِذَنْبِهِمْ فَسَوَّاهَا |
(১৫) আর তিনি এর মন্দ পরিণতিকে ভয় করেন না। | وَلَا يَخَافُ عُقْبَاهَا |
বিষয়বস্ত্ত :
সূরাটির আলোচ্য বিষয় হ’ল দু’টি : এক- বড় বড় আটটি সৃষ্টবস্ত্তর শপথ করে আল্লাহ বলেছেন, যে ব্যক্তি তার নফসকে পবিত্র করেছে এবং সর্বোত্তম চরিত্রমাধুর্য দ্বারা তাকে পরিচ্ছন্ন করেছে, সে ব্যক্তি সফলকাম হয়েছে। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি স্বীয় নফসকে অপবিত্র করেছে এবং মূর্খতা ও নিকৃষ্ট কর্মসমূহের মাধ্যমে তাকে কলুষিত করেছে, সে ব্যক্তি ব্যর্থকাম হয়েছে (১-১০ আয়াত)।
দুই- ব্যর্থকাম লোকদের উদাহরণ দিতে দিয়ে বিগত দিনে ছামূদ জাতির ধ্বংসের ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে (১১-১৫ আয়াত)।
গুরুত্ব :
হযরত জাবের (রাঃ) বলেন, মু‘আয বিন জাবাল (রাঃ) রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে এশার ছালাত আদায়ের পর নিজ মহল্লায় (বনু সালেমাহ) এসে পুনরায় এশার জামা‘আতে ইমামতি করার সময় সূরা বাক্বারাহ দিয়ে ক্বিরাআত শুরু করেন। এতে জনৈক রাখাল ব্যক্তি জামা‘আত ছেড়ে পৃথকভাবে ছালাত আদায় করে চলে যায়। একথা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে জানানো হ’লে তিনি মু‘আযকে ডেকে বলেন, أَفَتَّانٌ أَنْتَ يَا مُعَاذُ؟ ‘মু‘আয তুমি কি ফিৎনাকারী? তুমি কি সূরা আ‘লা, ফজর, শাম্স, লায়েল, যোহা পড়তে পারো না’?[1]
তাফসীর :
(১) وَالشَّمْسِ وَضُحَاهَا ‘শপথ সূর্যের ও তার কিরণের’। অর্থ أقسم بالشمس وإشراقها ‘আমি শপথ করছি সূর্যের ও তার প্রভাতরশ্মির। এখানে দু’টি শপথ একসাথে করা হয়েছে। সূর্যের শপথ এজন্য যে, এটি একটি বিশাল সৃষ্টি, যা তাপ ও আলোর উৎস। অতঃপর তার কিরণের শপথ করা হয়েছে। কেননা তা জীবন ও জাগরণের উৎস। এর আগমনে মানুষ ও সৃষ্টিজগত ঘুম থেকে জেগে উঠে যার যার কাজে আত্মনিয়োগ করে। এর উদয়, উত্থান ও অস্তের সাথে দিবসে কর্মের সূচনা, ব্যস্ততা ও সমাপ্তির সম্পর্ক রয়েছে। তাই সৃষ্টিজগতের কর্মচাঞ্চল্যে সূর্যকিরণের অবদান সবচেয়ে বেশী। সেটির গুরুত্ব বুঝানোর জন্যই আল্লাহ এখানে পৃথকভাবে ‘কিরণে’র শপথ করেছেন। যেদিন সূর্য আলোহীন হবে, সেদিন কিয়ামত হবে।
واو এখানে শপথসূচক অব্যয় হয়েছে। সূরার শুরুতে পরপর আটটি বড় বড় সৃষ্টবস্ত্তর শপথের মধ্যে প্রথম দু’টি হ’ল সূর্য ও তার কিরণের শপথ। এই শপথের মাধ্যমে সূর্য ও সূর্যরশ্মির গুরুত্ব ও মানবকল্যাণে তার অনন্য অবদানের প্রতি চিন্তাশীল মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে।
ضُحَى বলতে ‘চাশত’ বা সূর্যোদয়ের পরবর্তী অবস্থাকে বুঝানো হয়েছে। কুরতুবী বলেন, والمعروف عند العرب أن الضحى إذا طلعت الشمس وبُعَيْدَ ذلك قليلاً ‘আরবদের নিকটে প্রসিদ্ধ হ’ল এই যে ‘যোহা’ অর্থ যখন সূর্য উদিত হয় এবং তার অত্যল্প পরের সময়কাল’। একারণেই ঈদুল আযহার ছালাত সূর্যোদয়ের পরপরই পড়া সুন্নাত, কখনোই বেলা ১০/১১টায় নয়। যা এখন বড় বড় শহরে প্রায়শঃ দেখা যাচ্ছে। অনেকে ضحي থেকে পূরা দিন অর্থ নিয়েছেন সূর্যের অবস্থিতির কারণে (কুরতুবী)। মূলতঃ সূর্যকিরণ সর্বদা একইরূপ থাকে। কিন্তু রাত্রি শেষে পৃথিবীতে সূর্যোদয়ের সূচনাপর্বকে ‘যোহা’ বা প্রভাতরশ্মি বলা হয়। যা সাধারণতঃ এক বর্শা পরিমাণ বা সাড়ে ছয় হাত উদয়কালকে বুঝানো হয়। এখানে সূর্যের শপথ করা হয়েছে দিবসের নিদর্শন হিসাবে।
(২) وَالْقَمَرِ إِذَا تَلاَهَا ‘শপথ চন্দ্রের যখন তা সূর্যের পশ্চাতে আসে’।
تَلاَ অর্থ تَبِعَ ‘পিছে পিছে আসা’। ফার্রা বলেন, এর অর্থ أخذ منها ‘সূর্য থেকে আলো নেওয়া’ (কুরতুবী)। সূর্য ডোবার সাথে সাথে চন্দ্র তার জ্যোতি নিয়ে বেরিয়ে আসে। বিশেষ করে শুক্লপক্ষে যা স্পষ্ট দেখা যায়।
‘সূর্যের পশ্চাতে আসে’ বলার মধ্যে বিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎসের সন্ধান দেওয়া হয়েছে যে, চন্দ্রের নিজস্ব কোন আলো নেই। বরং সূর্য যখন পৃথিবীর আড়ালে চলে যায়, তখন তার কিরণ চন্দ্রের উপর প্রতিফলিত হয় বলেই তাকে আলোকিত দেখা যায়। আর তাই সূর্য কিরণের জ্বালা চন্দ্রের আলোয় থাকে না। সূর্য কিরণে প্রাণীদেহ ও বৃক্ষকুল শক্ত-সমর্থ হয়। পক্ষান্তরে চন্দ্রের প্রভাবে সাগর ও নদীতে জোয়ার-ভাটা হয়। সূর্য ও চন্দ্র তাই প্রাণী ও উদ্ভিদ জগতের সবচেয়ে বড় বন্ধু। এখানে চন্দ্রের শপথ করা হয়েছে রাত্রির নিদর্শন হিসাবে।
(৩) وَالنَّهَارِ إِذَا جَلاَّهَا ‘শপথ দিবসের, যখন তা সূর্যকে প্রকাশ করে দেয়’।
جَلَّى অর্থ كشف الظلمة ‘অন্ধকার দূরীভূত করা’। অর্থাৎ মেঘমুক্ত আকাশে সূর্য যখন স্পষ্টভাবে প্রকাশিত হয়। আর সূর্য স্পষ্টভাবে প্রকাশিত হ’লে তার খরতাপ বৃদ্ধি পায়, যা দেহে জ্বালা ধরিয়ে দেয়। এই শপথের মাধ্যমে সূর্য যে অফুরন্ত জ্বালানীর উৎস, সেদিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে।
(৪) وَاللَّيْلِ إِذَا يَغْشَاهَا ‘শপথ রাত্রির যখন তা সূর্যকে ঢেকে দেয়’।
সদা চলমান ও ঘূর্ণায়মান পৃথিবীর যে অংশ যখন সূর্যের দিকে থাকে, তখন সে অংশে দিন হয় এবং অপর অংশে রাত হয়। ‘সূর্যকে ঢেকে দেয়’ অর্থ সূর্য থেকে পৃথিবী আড়ালে চলে যায়। সূর্য ওঠা, সূর্য ডোবা, সূর্য মাথার উপরে আসা প্রভৃতি কথার মধ্যে সূর্য ও পৃথিবী উভয়ে যে নিজ নিজ কক্ষপথে সদা চলমান, তার প্রমাণ বহন করে। বলা বাহুল্য, বিজ্ঞানের এই গুরুত্বপূর্ণ উৎসের সন্ধান রয়েছে এই আয়াতে এবং অন্য আয়াতসমূহে। সূর্যের আসা-যাওয়া ও উত্তাপের কমবেশী হওয়া এবং রাত্রিতে হারিয়ে যাওয়ার মধ্যে রয়েছে আল্লাহর এক অপূর্ব পালন কৌশল। সূর্যতাপ সর্বদা একইরূপ থাকলে এবং দিবারাত্রির আগমন-নির্গমন না থাকলে পৃথিবী প্রাণীকুলের বসবাসের অযোগ্য হয়ে যেত।
বস্ত্ততঃ পৃথিবী অন্ধকারের চাদরে ঢেকে যাওয়ার এই সুন্দর দৃশ্য দেখা যায় চলমান বিমান থেকে। কেননা বিমান তখন সূর্য্যের আলোর মধ্যে থাকে। আর পৃথিবী থাকে অন্ধকারের পর্দার মধ্যে।
(৫) وَالسَّمَآءِ وَمَا بَنَاهَا ‘শপথ আকাশের ও তার নির্মাণের’।
এখানে ما مصدرية وموصولة দু’টিই হ’তে পারে। ما مصدرية হ’লে অর্থ হবে وَالسَّمَآءِ وَبِنَاءِهَا ‘শপথ আকাশের ও তার নির্মাণের’। আর ما موصولة হ’লে অর্থ হবে وَالسَّمَآءِ وَمَنْ بَنَاهَا ‘শপথ আকাশের ও তার নির্মাতার’। দু’টি অর্থই পরস্পরের পরিপূরক। পূর্বাপর বিবেচনায় আমরা প্রথম অর্থকে অগ্রাধিকার দিয়েছি। কেননা ‘নির্মাতা’ বলতে আল্লাহকে বুঝায়। অথচ আল্লাহ সাধারণতঃ সৃষ্টির কসম করে থাকেন। এখানেও আল্লাহ নিজের কসম না করে সৃষ্টির অর্থাৎ ‘নির্মাণের’ কসম করেছেন।
এই শপথের মাধ্যমে আকাশের বিশালত্ব ও তার অপূর্ব নির্মাণশৈলীর প্রতি চিন্তাশীল মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। সাথে সাথে বিজ্ঞানী বান্দাদের প্রতি মহাকাশ গবেষণায় নিয়োজিত হওয়ার ইঙ্গিত করা হয়েছে। আকাশ সৃষ্টির গুরুত্ব বুঝানোর জন্য আল্লাহ অন্যত্র বলেন, وَالسَّمَآءَ بَنَيْنَاهَا بِأَيْدٍ وَّإِنَّا لَمُوْسِعُوْنَ ‘আর আসমানকে আমরা সৃষ্টি করেছি নিজ হাতে এবং আমরা অবশ্যই একে প্রশস্তকারী’ (যারিয়াত ৫১/৪৭)। আল্লাহ নিজ ক্ষমতাবলে সবই সৃষ্টি করেছেন। তা সত্ত্বেও আসমান সৃষ্টির বেলায় ‘নিজ হাতে’ বিশেষভাবে বলার মধ্যে ইঙ্গিত রয়েছে যে, আকাশ একটি বিরাট সৃষ্টি। لَمُوْسِعُوْنَ বলার মধ্যে নভোমন্ডল যে কত বড় ও বিস্তৃত এবং এটি যে সদা প্রসারমান, সেই বৈজ্ঞানিক তথ্য প্রদান করা হয়েছে। তবে সবকিছু রয়েছে সুনিয়ন্ত্রিত। যেমন আল্লাহ বলেন, وَكُلُّ شَيْءٍ عِنْدَهُ بِمِقْدَارٍ ‘তাঁর নিকটে প্রত্যেক বস্ত্তরই একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ আছে’ (রা‘দ ১৩/৮)। আর এর সৃষ্টি ও ব্যবস্থাপনায় কোন খুঁত নেই। আল্লাহ বলেন, الَّذِي خَلَقَ سَبْعَ سَمَاوَاتٍ طِبَاقًا مَا تَرَى فِي خَلْقِ الرَّحْمَنِ مِنْ تَفَاوُتٍ فَارْجِعِ الْبَصَرَ هَلْ تَرَى مِنْ فُطُورٍ- ثُمَّ ارْجِعِ الْبَصَرَ كَرَّتَيْنِ يَنْقَلِبْ إِلَيْكَ الْبَصَرُ خَاسِئًا وَهُوَ حَسِيْرٌ- ‘তিনি সৃষ্টি করেছেন স্তরে স্তরে সাতটি আকাশ। দয়াময়ের সৃষ্টিতে তুমি কোন খুঁত দেখতে পাবে না। তুমি আবার তাকিয়ে দেখ, কোন খুঁত দেখতে পাও কি’? ‘অতঃপর তুমি দু’বার করে দৃষ্টি ফিরাও। সেই দৃষ্টি ব্যর্থ ও ক্লান্ত হয়ে তোমার দিকে ফিরে আসবে’ (মুল্ক ৬৭/৩-৪)। সৌরলোকের প্রতি উৎসাহিত করে আল্লাহ মানুষকে ডেকে বলেন, أَفَلَمْ يَنْظُرُوْا إِلَى السَّمَاءِ فَوْقَهُمْ كَيْفَ بَنَيْنَاهَا وَزَيَّنَّاهَا وَمَا لَهَا مِنْ فُرُوْجٍ ‘তারা কি তাদের উপরে অবস্থিত আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখে না, কিভাবে আমরা তা নির্মাণ করেছি ও সুশোভিত করেছি এবং তাতে কোনরূপ ফাঁক-ফোকর নেই’ (ক্বাফ ৫০/৬)। অন্যত্র আল্লাহ হঠকারী মানুষকে লক্ষ্য করে বলছেন,أَأَنْتُمْ أَشَدُّ خَلْقاً أَمِ السَّمَآءُ؟ بَنَاهَا- رَفَعَ سَمْكَهَا فَسَوَّاهَا- ‘তোমাদের সৃষ্টি অধিক কঠিন না আকাশের সৃষ্টি? যা তিনি নির্মাণ করেছেন’। ‘তিনি একে উচ্চ করেছেন, অতঃপর তাকে সুবিন্যস্ত করেছেন’ (নাযে‘আত ৭৯/২৭-২৮)। আকাশকে তিনি সাতটি স্তরে বিভক্ত করেছেন (নূহ ৭১/১৫)। প্রতি আসমানে দরজা সন্নিবেশ করেছেন (নাবা ৭৮/১৫) ও সেখানে দাররক্ষী ফেরেশতা নিযুক্ত করেছেন। আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) মে‘রাজে যাওয়ার সময় প্রত্যেক দাররক্ষী ফেরেশতা প্রথমে তাঁর পরিচয় জেনে অতঃপর সাদর সম্ভাষণের মাধ্যমে দরজা খুলে দিয়েছিল।[2]
পৃথিবীর উপরে আকাশকে নির্মাণ করেছেন ‘সুরক্ষিত ছাদ হিসাবে’ (আম্বিয়া ২১/৩২)। প্রতিটি ছাদের মধ্যকার দূরত্ব কল্পনার অতীত। নিম্ন আকাশকে সাজিয়েছেন নক্ষত্ররাজি দ্বারা (মুল্ক ৬৭/৫)। যা অন্ধকার পৃথিবীকে আলোকিত করে এবং তা দেখে মানুষ অন্ধকারে পথ খুঁজে পায় (নাহল ১৬/১৬)।
কতই না বিস্ময়কর এই আকাশ, যা অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ও ধূম্রকুঞ্জ বিশিষ্ট (রহমান ৫৫/৩৫) হওয়া সত্ত্বেও আমরা দেখতে পাই শান্ত স্নিগ্ধ অন্ততহীন এক নিঃসীম নীলিমা। যার প্রতিটি নক্ষত্র অফুরন্ত দাহিকাশক্তি সম্পন্ন হওয়া সত্ত্বেও এবং সেগুলি আলোর গতিতে তীব্রবেগে ঘূর্ণায়মান ও চলমান হওয়ার সত্ত্বেও কারু সঙ্গে কারু সংঘর্ষ হয় না। সদা চলন্ত হওয়া সত্ত্বেও (ইয়াসীন ৩৬/৪০) আমরা ওগুলোকে সদা স্থির ও সমতল ছাদরূপে দেখতে পাই। সদা জ্বলন্ত হওয়া সত্ত্বেও রাতের আকাশে ওদেরকে আমরা মিটিমিটি উজ্জ্বল দেখতে পাই, যা জ্বলে আর নিভে। যেন সর্বদা আমাদের সঙ্গে লুকোচুরি খেলে। পৃথিবীর চাইতে লক্ষ-কোটি গুণ বড় ঐসব গ্রহ-নক্ষত্রগুলিকে আমরা ছোট ছোট দেখি। কোটি কোটি মাইল দূরে অবস্থিত হওয়া সত্ত্বেও আমরা ওদেরকে খুবই নিকটে দেখি। অগণিত তারকাশোভিত এই সুন্দর আকাশ দেখে চিন্তাশীল মানুষ কি আপনা থেকেই বলে উঠবে না- অবশ্যই এর একজন সৃষ্টিকর্তা আছেন, যিনি কুশলী নির্মাতা ও দূরদর্শী ব্যবস্থাপক! হযরত ইউসুফ (আঃ)-এর মুখে অনেক আগেই আমরা শুনেছি, إِنَّ رَبِّيْ لَطِيْفٌ لِّمَا يَشَآءُ إِنَّهُ هُوَ الْعَلِيْمُ الْحَكِيْمُ ‘নিশ্চয়ই আমার পালনকর্তা যা চান অতীব সূক্ষ্ম কৌশলে তা করে থাকেন। নিশ্চয়ই তিনি বিজ্ঞ ও প্রজ্ঞাময়’ (ইউসুফ ১২/১০০)। কিন্তু অধিকাংশ মানুষই অসচেতন। যেমন আল্লাহ বলেন, وَكَأَيِّنْ مِنْ آيَةٍ فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ يَمُرُّوْنَ عَلَيْهَا وَهُمْ عَنْهَا مُعْرِضُوْنَ ‘আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীতে কত অগণিত নিদর্শন রয়েছে। তারা এসবের উপর দৃষ্টি ফেলে চলে যায়। কিন্তু তারা এগুলো থেকে বিমুখতা অবলম্বন করে (ইউসুফ ১২/১০৫)।
(৬) وَالْأَرْضِ وَمَا طَحَاهَا ‘শপথ পৃথিবীর ও তার বিস্তৃতির’।
অর্থাৎ পৃথিবীকে আল্লাহ বিস্তৃত করেছেন বান্দার বসবাসের জন্য। পৃথিবীকে আল্লাহ নরম কাদার মত করেননি। আবার শক্ত পাথরের মত করেননি। বরং মধ্যম মানের সমভূমি করে সৃষ্টি করেছেন। যাতে তা বান্দার কল্যাণে ব্যবহৃত হ’তে পারে। কোন কোন স্থান নরম ও শক্ত হ’লেও সেটা পৃথিবীর স্বাভাবিক গঠন নয়। উল্লেখ্য যে, এই আয়াত দিয়ে ‘পৃথিবী গোলাকার নয়’ প্রমাণের কোন অবকাশ নেই। পৃথিবী নিঃসন্দেহে গোলাকার। তবে তার বিস্তৃতি এমনভাবে ঘটানো হয়েছে যে, আকারে গোল হ’লেও ভূপৃষ্ঠের অধিবাসীরা কেউ পৃথিবী ছেড়ে ছিটকে পড়ে যায় না। গোলাকার হাড়ির গায়ে পিঁপড়া যেভাবে ছুটে বেড়ায়, গোলাকার ভূপৃষ্ঠে তেমনি মানুষ ও প্রাণীকুল স্বাচ্ছন্দ্যে বসবাস করে। পৃথিবী সর্বদা তার অধিবাসীদের নিজের দিকে আকৃষ্ট করে রাখে। তাই দেখা যায়, ঢিল উপরে ছুঁড়ে মারলেও পুনরায় তা মাটিতে এসে পড়ে। রকেট বায়ুমন্ডল ভেদ করে বহু ঊর্ধ্বে চলে গেলেও আবার ফিরে আসে তার আগের স্থানে। পৃথিবীর বিস্তৃতিকে অন্য আয়াতে (নাবা ৭৮/৬) বিছানার সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে আপেক্ষিক অর্থে, প্রকৃত অর্থে নয়। আমাদের জন্য পৃথিবী বিছানা সদৃশ সমতল ভূমি হ’লেও প্রকৃত অর্থে পৃথিবী গোলাকার। আলোচ্য আয়াতে পৃথিবীকে বিস্তৃত করা হয়েছে বলে তার দৃষ্টিগ্রাহ্য বাস্তব অবস্থাকে বুঝানো হয়েছে। অন্যত্র دَحَاهَا বলা হয়েছে (নাযে‘আত ৭৯/৩০)। অর্থ بسطها ‘তাকে বিস্তৃত করেছেন’। دَحَاهَا ও طَحَاهَا মূলতঃ একই অর্থ বহন করে (কুরতুবী)।
(৭) وَنَفْسٍ وَّمَا سَوَّاهَا ‘শপথ মানুষের ও তার বিন্যস্ত করণের’।
অর্থাৎ হাত-পা, চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, মস্তিষ্ক ইত্যাদিসহ সুন্দর অবয়ব দিয়ে বিন্যস্ত করে যে মানুষকে তিনি সৃষ্টি করেছেন, তার শপথ। এই শপথের মাধ্যমে আল্লাহ মানুষকে তার নিজের সৃষ্টিকৌশল সম্পর্কে চিন্তা করার প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। আল্লাহ অন্যত্র বলেন,
اَلَّذِيْ أَحْسَنَ كُلَّ شَيْءٍ خَلَقَهُ وَبَدَأَ خَلْقَ الْإِنْسَانِ مِنْ طِيْنٍ، ثُمَّ جَعَلَ نَسْلَهُ مِنْ سُلاَلَةٍ مِّنْ مَّاءِ مَّهِيْنٍ، ثُمَّ سَوَّاهُ وَنَفَخَ فِيْهِ مِنْ رُّوْحِهِ وَجَعَلَ لَكُمُ السَّمْعَ وَالْأَبْصَارَ وَالْأَفْئِدَةَ قَلِيْلاً مَّا تَشْكُرُوْنَ-
‘(তিনিই সেই সত্তা) যিনি তাঁর প্রত্যেক সৃষ্টিকে সুন্দর করেছেন এবং কাদামাটি থেকে মানব সৃষ্টির সূচনা করেছেন’। ‘অতঃপর তিনি তার বংশধর সৃষ্টি করেন তুচ্ছ পানির নির্যাস থেকে’। ‘অতঃপর তিনি তাকে সুষম করেন, তাতে রূহ সঞ্চার করেন এবং তোমাদেরকে দেন চক্ষু, কর্ণ ও অন্তঃকরণ। (অথচ) তোমরা সামান্যই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে থাক’ (সাজদাহ ৩২/৭-৯)। বস্ত্ততঃ এই অপূর্ব সৃষ্টি কৌশলের মধ্যেই সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বের প্রমাণ নিহিত রয়েছে। ফেরাঊন যখন বলেছিল فَمَنْ رَبُّكُمَا يَا مُوْسَى ‘হে মূসা! তোমাদের প্রতিপালক কে’? জবাবে মূসা বলেছিলেন, رَبُّنَا الَّذِي أَعْطَى كُلَّ شَيْءٍ خَلْقَهُ ثُمَّ هَدَى ‘আমাদের প্রতিপালক তিনি যিনি প্রত্যেক বস্ত্তকে তার যোগ্য আকৃতি দান করেছেন, অতঃপর তাকে পথপ্রদর্শন করেছেন’ (ত্বোয়াহা ২০/৪৯-৫০)। এই পথপ্রদর্শন দু’ভাবে হ’তে পারে। এক- প্রত্যেকের পৃথক পৃথক আকৃতি এবং তার কর্ম ও আচরণ। যেমন মানুষ ও অন্য প্রাণীর আচরণ। দুই- নৈতিক পথপ্রদর্শন যা নবী-রাসূলগণের মাধ্যমে আল্লাহ প্রেরণ করেছেন। আলোচ্য আয়াতে প্রথমটির অর্থ অধিকতর স্পষ্ট।
(৮) فَأَلْهَمَهَا فُجُوْرَهَا وَتَقْوَاهَا ‘অতঃপর তার মধ্যে তিনি দুষ্কৃতি ও সুকৃতির প্রেরণা নিক্ষেপ করেছেন’।
অর্থাৎ আল্লাহ মানুষকে ভাল-মন্দ পথ চিনিয়ে দিয়েছেন। অত্র আয়াতে আল্লাহ মানুষের নৈতিক হেদায়াতের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। যেমন অন্যত্র আল্লাহ বলেন, إِنَّا هَدَيْنَاهُ السَّبِيْلَ إِمَّا شَاكِراً وَّإِمَّا كَفُوْراً ‘আমরা তাদেরকে পথ প্রদর্শন করেছি। এক্ষণে সে কৃতজ্ঞ বান্দা হ’তে পারে কিংবা অকৃতজ্ঞ হ’তে পারে’ (দাহর ৭৬/৩)। তিনি বলেন, وَهَدَيْنَاهُ النَّجْدَيْنِ ‘আর আমরা তাকে দু’টি পথ দেখিয়েছি’ (বালাদ ৯০/১০)। বস্ত্ততঃ এ দু’টি পরস্পর বিরোধী প্রেরণা সৃষ্টি করার উদ্দেশ্য হ’ল মানুষকে পরীক্ষা করা। সে মন্দ প্রেরণাকে দমন করে যদি তার সৎ প্রেরণাকে ঊর্ধ্বে রাখতে পারে, তাহ’লেই সে সফলকাম হবে। আল্লাহ প্রেরিত হেদায়াত তথা ইসলামী শরী‘আত মানুষকে তার অন্তরজগতে লালিত সৎ প্রেরণাকে যথার্থ পথে পরিচালিত করার পথ প্রদর্শন করে থাকে। অত্র আয়াতে فُجُوْرٌ ও تَقْوَى -কে সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী অর্থে আনা হয়েছে।
(৯) قَدْ أَفْلَحَ مَنْ زَكَّاهَا ‘সফলকাম হয় সেই ব্যক্তি, যে তার নফসকে পরিশুদ্ধ করে’।
পূর্বে বর্ণিত আটটি শপথের জওয়াব হিসাবে এ আয়াতটি নাযিল হয়েছে। অর্থাৎ لقد أفلح من زكي نفسه ‘অবশ্যই সে ব্যক্তি সফলকাম হয়, যে ব্যক্তি তার আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে।
অত্র আয়াতে বর্ণিত الةزكية অর্থ التزكية من الشرك وشوائب المعاصى ‘শিরক ও পাপের কালিমা সমূহ হ’তে পবিত্র হওয়া’। এর অর্থ ঐ ‘তাযকিয়া’ (الةزكية) নয়, যার অর্থ নিজেই নিজের ছাফাই গাওয়া। যা আল্লাহ নিষেধ করেছেন। যেমন তিনি বলেন, فَلاَ تُزَكُّوا أَنْفُسَكُمْ هُوَ أَعْلَمُ بِمَنِ اتَّقَى ‘অতএব তোমরা নিজেদের ছাফাই গেয়ো না। কেননা তিনিই ভাল জানেন কে প্রকৃত আল্লাহভীরু’ (নাজম ৫৩/৩২)। অর্থাৎ যে ব্যক্তি নীচুতা, অসততা ও সকল প্রকার অন্যায় ও অসৎকর্ম হ’তে বিরত থাকে এবং আল্লাহর আনুগত্যের মাধ্যমে নিজের নফসকে পবিত্র রাখে, সে ব্যক্তি ইহকালে ও পরকালে সফলকাম হয়। যেমন অন্যত্র আল্লাহ বলেন, قَدْ أَفْلَحَ مَنْ تَزَكَّى ‘সফলকাম হ’ল সেই ব্যক্তি, যে আত্মশুদ্ধি অর্জন করল’ (আ‘লা ৮৭/১৪)। অর্থাৎ যথাযোগ্য ইল্ম ও আমলের মাধ্যমে বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীণ শুদ্ধিতা হাছিল করল।
যায়েদ বিন আরক্বাম (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন যে, রাসূলুললাহ (ছাঃ) নিম্নোক্ত দো‘আটি পড়তেন। তিনি আমাদেরকে শিখিয়েছেন, আমরাও তোমাদেরকে শিখাচ্ছি। সেটি এই যে,
اَللَّهُمَّ إِنِّيْ أَعُوْذُ بِكَ مِنْ الْعَجْزِ وَالْكَسَلِ وَالْجُبْنِ وَالْبُخْلِ وَالْهَرَمِ وَعَذَابِ الْقَبْرِ اَللَّهُمَّ آتِ نَفْسِيْ تَقْوَاهَا وَزَكِّهَا أَنْتَ خَيْرُ مَنْ زَكَّاهَا أَنْتَ وَلِيُّهَا وَمَوْلاَهَا، اَللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوْذُ بِكَ مِنْ عِلْمٍ لاَ يَنْفَعُ وَمِنْ قَلْبٍ لاَ يَخْشَعُ وَمِنْ نَفْسٍ لاَ تَشْبَعُ وَمِنْ دَعْوَةٍ لاَ يُسْتَجَابُ لَهَا-
‘হে আল্লাহ! আমি তোমার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি অক্ষমতা, অলসতা, কাপুরুষতা, কৃপণতা, অতি বার্ধক্য ও কবরের আযাব হ’তে। হে আল্লাহ! তুমি আমার নফসকে আল্লাহভীতি দান কর এবং তাকে পরিশুদ্ধ কর। কেননা তুমিই শ্রেষ্ঠ সত্তা, যে তাকে পরিশুদ্ধ করতে পারে। তুমিই তার অভিভাবক ও প্রতিপালক। হে আল্লাহ! আমি তোমার নিকটে আশ্রয় প্রার্থনা করছি এমন ইলম হ’তে, যা কোন ফায়েদা দেয় না। এমন অন্তর হ’তে, যা ভীত হয় না। এমন নফস হ’তে যা পরিতৃপ্ত হয় না এবং এমন দো‘আ হ’তে যা কবুল হয় না’।[3]
রাসূল (ছাঃ) আরো বলতেন, اَللَّهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ الْهُدَى وَالتُّقَى وَالْعَفَافَ وَالْغِنَى ‘হে আল্লাহ! আমি তোমার নিকটে সুপথের নির্দেশনা, পরহেযগারিতা, পবিত্রতা ও সচ্ছলতা প্রার্থনা করছি’।[4]
(১০) وَقَدْ خَابَ مَنْ دَسَّاهَا ‘এবং ব্যর্থ হয় সেই ব্যক্তি, যে তার নফসকে কলুষিত করে’।
ক্বাতাদাহ ও অন্যান্য বিদ্বানগণ বলেন, وخاب من دس نفسه في المعاصى ‘ঐ ব্যক্তি নিরাশ হয়েছে, যার নফস পাপে ডুবে গেছে’ (কুরতুবী)। التدسيس অর্থ إخفاء الشئ في الشئ ‘কোন বস্ত্তর মধ্যে কোন বস্ত্তর লুকানো’ (কুরতুবী)। যেমন আল্লাহ বলেন, أَمْ يَدُسُّهُ فِي التُّرَابِ ‘(কন্যা সন্তান জন্ম নিলে তার পিতা ভাবত যে, অপমান সহ্য করে তাকে বাঁচিয়ে রাখবে,) না তাকে মাটিতে পুঁতে ফেলবে’ (নাহল ১৬/৫৯)। ইবনু কাছীর বলেন, এর অর্থ, যে ব্যক্তি হেদায়াত বঞ্চিত হয়েছে, পাপে লিপ্ত হয়েছে এবং আল্লাহর আনুগত্য পরিত্যাগ করেছে’। যেমন অন্যত্র আল্লাহ বলেন, بَلَى مَنْ كَسَبَ سَيِّئَةً وَّأَحَاطَتْ بِهِ خَطِيْئَتُهُ فَأُوْلَئِكَ أَصْحَابُ النَّارِ هُمْ فِيْهَا خَالِدُوْنَ- ‘হ্যাঁ যে ব্যক্তি পাপ অর্জন করেছে এবং সে পাপ তাকে বেষ্টন করে নিয়েছে, তারাই জাহান্নামের অধিবাসী। তারা সেখানে চিরকাল থাকবে’ (বাক্বারাহ ২/৮১)।
আর নফসকে কলুষমুক্ত করার একমাত্র পথ হ’ল, আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করা ও তাঁর আদেশ-নিষেধের প্রতি অনুগত থাকা। কেননা আল্লাহ বলেন, وَإِذَا سَأَلَكَ عِبَادِي عَنِّي فَإِنِّي قَرِيبٌ أُجِيْبُ دَعْوَةَ الدَّاعِ إِذَا دَعَانِ فَلْيَسْتَجِيْبُوْا لِيْ وَلْيُؤْمِنُوْا بِيْ لَعَلَّهُمْ يَرْشُدُوْنَ ‘যখন আমার বান্দারা আমার সম্পর্কে তোমাকে জিজ্ঞেস করে, তখন তাদের বলে দাও যে, আমি অতীব নিকটবর্তী। আহবানকারী যখনই আমাকে আহবান করে, তখনই আমি তার আহবানে সাড়া দেই। অতএব তারা যেন আমাকে ডাকে এবং আমার উপরে বিশ্বাস রাখে। তাহ’লে তারা সঠিক পথ পাবে’ (বাক্বারাহ ২/১৮৬)।
(১১) كَذَّبَتْ ثَمُوْدُ بِطَغْوَاهَا ‘ছামূদ জাতি মিথ্যারোপ করেছিল অবাধ্যতা বশে’।
এখানে بِطَغْوَاهَا -এর باء ‘কারণসূচক’ (سببية) হয়েছে। অর্থাৎ بسبب كونها طاغية ‘তারা অবাধ্য হওয়ার কারণে’।
পূর্বের আয়াতে ব্যর্থ মনোরথ এবং পাপে ডুবে যাওয়া লোকদের দৃষ্টান্ত বর্ণনা করতে গিয়ে আল্লাহ এখানে বিগত দিনের দুর্ধর্ষ ও ক্ষমতাশালী জাতি ছামূদ সম্প্রদায়ের কথা উল্লেখ করেছেন। ক্ষমতা ও শক্তিগর্বে স্ফীত হয়ে তারা আল্লাহর উপরে মিথ্যারোপ করেছিল এবং তাদের নবী ছালেহ (আঃ)-এর অবাধ্যতা করেছিল। ফলে এর শাস্তিস্বরূপ তাদের উপরে নেমে আসে কঠিন আযাব। যাতে তারা সবাই নিমেষে ধ্বংস হয়ে যায়। কারণ আকণ্ঠ পাপে নিমজ্জিত হওয়ার ফলে তাদের অন্তরসমূহ কলুষিত হয়ে গিয়েছিল।
(১২) إِذِ انْبَعَثَ أَشْقَاهَا ‘যখন তাদের সর্বাধিক দুরাচার ব্যক্তিটি তৎপর হয়ে উঠেছিল’।
অর্থাৎ দুষ্ট যুবকটি নবীর নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে আল্লাহ প্রেরিত উষ্ট্রীর পা কেটে দিয়েছিল। অবাধ্য কওমের দাবী অনুযায়ী নবী ছালেহ (আঃ)-এর প্রার্থনা মতে আল্লাহ স্বীয় নিদর্শন হিসাবে বড় একটি উষ্ট্রী পাঠিয়েছিলেন, যে একদিন কূয়ার সব পানি খেয়ে নিত ও একদিন তাদের দুধ দিত। যা তাদের সকলের চাহিদা মিটাতো। কিন্তু দুষ্টু নেতারা চক্রান্ত করে উষ্ট্রীর পা কেটে হত্যা করে ফেলে।
ইমাম বুখারী (রহঃ) হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে যাম‘আহ (রাঃ) হ’তে বর্ণনা করেন যে, একদিন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) খুৎবার মধ্যে অত্র আয়াতটি পাঠ করেন এবং বলেন যে, হত্যাকারী ঐ লোকটি তার সম্প্রদায়ের একজন পরাক্রমশালী সর্দার ছিল আবু যাম‘আহর ন্যায়’।[5] অন্য বর্ণনায় এসেছে, আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) বলেন, ঐ লোকটি ছিল কঠোর হৃদয় ও দুশ্চরিত্র (رَجُلٌ عَزِيزٌ عَارِمٌ)।[6] ইবনু কাছীর ঐ ব্যক্তির নাম বলেছেন, কুদার বিন সালেফ (قُدار بن سالف) (কুরতুবী, ইবনু কাছীর)।
(১৩) فَقَالَ لَهُمْ رَسُوْلُ اللهِ نَاقَةَ اللهِ وَسُقْيَاهَا ‘অতঃপর তাদেরকে আল্লাহর রাসূল বলেছিলেন, আল্লাহর উষ্ট্রী ও তার পানি পান করার ব্যাপারে সাবধান হও’।
অর্থ ذروا ناقة الله حرية ‘ছাড় আল্লাহর উষ্ট্রীকে স্বাধীনভাবে’। যেমন অন্যত্র আল্লাহ বলেছেন, فَذَرُوهَا تَأْكُلْ فِي أَرْضِ اللهِ ‘ছেড়ে দাও ওকে, আল্লাহর যমীনে খেয়ে বেড়াক’ (আ‘রাফ ৭/৭৩)। অথবা نَاقَةَ اللهِ অর্থ احذروا ناقة الله ‘আল্লাহর উষ্ট্রী সম্পর্কে সাবধান হও’। অর্থাৎ তাকে যবেহ করো না বা তার পানি পান করায় বাধা দিয়ো না। তার জন্য নির্ধারিত পানি পানের দিনে তোমরা কোনরূপ প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করো না। এখানে ‘আল্লাহর রাসূল’ অর্থ হযরত ছালেহ (আঃ)। উল্লেখ্য যে, সম্প্রদায়ের লোকদের উটগুলোর জন্য এবং আল্লাহর উষ্ট্রীর জন্য একদিন অন্তর একদিন পালাক্রমে পানি পানের বিষয়টি আল্লাহর পক্ষ থেকেই নির্ধারিত ছিল (শো‘আরা ২৬/১৫৫; ক্বামার ৫৪/২৮)। আরো উল্লেখ্য যে, কওমের লোকদের দাবী অনুযায়ী নবীর দো‘আয় পাহাড়ের বুক ফেটে এই উষ্ট্রীর আবির্ভাব ঘটে। যা ছিল নবী ছালেহ (আঃ)-এর একটি জীবন্ত মু‘জেযা। উষ্ট্রী যেদিন পানি পান করত, সেদিন কূয়ার পানি নিঃশেষে পান করে ফেলত। অবশ্য ঐদিন লোকেরা উষ্ট্রীর দুধ পান করত এবং বাকী দুধ দ্বারা তাদের সব পাত্র ভরে নিত। কিন্তু এই হতভাগাদের কপালে এত সুখ সহ্য হ’ল না। তারা একদিন পানি না পাওয়াকে অজুহাত হিসাবে খাড়া করে উষ্ট্রীকে হত্যা করল (কুরতুবী)। মূলতঃ এটি ছিল তাদের জন্য পরীক্ষা স্বরূপ। যাতে তারা সফল হয়নি।
(১৪) فَكَذَّبُوْهُ فَعَقَرُوْهَا فَدَمْدَمَ عَلَيْهِمْ رَبُّهُم بِذَنْبِهِمْ فَسَوَّاهَا ‘কিন্তু তারা তাঁকে মিথ্যা সাব্যস্ত করেছিল, অতঃপর উষ্ট্রীর পা কর্তন করেছিল। ফলে তাদের পাপের কারণে তাদের পালনকর্তা তাদের সমূলে ধ্বংস করে জনপদকে একাকার করে দিলেন’।
এখানে بِذَنْبِهِمْ -এর باء ‘কারণ সূচক অব্যয়’ (سببية) হয়েছে। অর্থাৎ ‘তাদের পাপের কারণে’।
উষ্ট্রীর পা কেটেছিল একজনের নেতৃত্বে মোট দু’জন। কওমের বাকীরা কেউ বাধা না দেওয়ায় একাজে তাদের সম্মতি ধরে নেয়া হয়। সেজন্য এখানে বহুবচনের ক্রিয়াপদ ব্যবহার করা হয়েছে। নবী ছালেহ (আঃ) তাদের বলেছিলেন, আল্লাহর এই উষ্ট্রীর ক্ষতি করলে তোমাদের উপরে নির্ঘাত আল্লাহর গযব নেমে আসবে। কিন্তু তারা বিশ্বাস করেনি। বরং গযব ডেকে আনার ব্যাপারে নবীকে চ্যালেঞ্জ করতে থাকে এবং এক পর্যায়ে তারা উটকে যবেহ করে ফেলে। তখন তাদের উপরে বজ্রধ্বনির গযব নেমে আসে ও তারা সবাই একত্রে ধ্বংস হয়ে যায়।
আল্লাহ বলেন, ظَهَرَ الْفَسَادُ فِي الْبَرِّ وَالْبَحْرِ بِمَا كَسَبَتْ أَيْدِي النَّاسِ لِيُذِيقَهُمْ بَعْضَ الَّذِي عَمِلُوا لَعَلَّهُمْ يَرْجِعُونَ ‘পানিতে ও ভূমিতে বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়ে মানুষের কৃতকর্মের ফলে। এজন্য যে, তিনি তাদের কিছু কর্মের স্বাদ আস্বাদন করাতে চান। যাতে তারা ফিরে আসে’ (রূম ৩০/৪১)। আর এই বিপর্যয় সৃষ্টিতে নেতৃত্ব দেয় সমাজনেতারা। যেমন আল্লাহ বলেন, وَإِذَا أَرَدْنَا أَنْ نُهْلِكَ قَرْيَةً أَمَرْنَا مُتْرَفِيهَا فَفَسَقُوا فِيهَا فَحَقَّ عَلَيْهَا الْقَوْلُ فَدَمَّرْنَاهَا تَدْمِيرًا ‘যখন আমরা কোন জনপদকে ধ্বংস করার ইচ্ছা করি, তখন আমরা তাদের নেতৃবর্গকে আদেশ করি। অতঃপর তারা সেখানে পাপাচার করে। তখন তাদের উপর আমাদের শাস্তি অবধারিত হয়ে যায়। অতঃপর আমরা সেটিকে সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত করে দিই’ (ইসরা ১৭/১৬)। এইসব নেতৃবর্গকে অন্যত্র أَكَابِرَ مُجْرِمِيهَا ‘শীর্ষ পাপী’ (আন‘আম ৬/১২৩) বলা হয়েছে। আর সৎকর্মশীল জাতিকে আল্লাহ শাস্তি দেন না। যেমন তিনি বলেন, وَمَا كَانَ رَبُّكَ لِيُهْلِكَ الْقُرَى بِظُلْمٍ وَأَهْلُهَا مُصْلِحُونَ ‘তোমার প্রতিপালক এমন নন যে, তিনি অন্যায়ভাবে কোন জনপদকে ধ্বংস করবেন, এমতাবস্থায় যে তার অধিবাসীরা সৎকর্মশীল’ (হূদ ১১/১১৭)।
ইবনু কাছীর বলেন, دَمْدَمَ عَلَيْهِمْ অর্থ غضب عليهم فدمَّر عليهم ‘তাদের উপরে আল্লাহ ক্রুদ্ধ হন, অতঃপর তাদেরকে ধ্বংস করে দেন’। বস্ত্ততঃ কঠোরতম শাস্তির ক্ষেত্রে এ জাতীয় শব্দ ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এখান থেকেই আমরা কামান-বন্দুকের আওয়াজকে দুম-দ্রুম ইত্যাদি বলি। কুরতুবী বলেন, فَسَوَّاهَا অর্থ سوَّى عليهم الارض ‘তাদের উপরে যমীন সমান হয়ে যাওয়া’ অর্থাৎ সবকিছু নিশ্চিহ্ন হয়ে একাকার হয়ে যাওয়া।
(১৫) وَلاَ يَخَافُ عُقْبَاهَا ‘আর তিনি এর মন্দ পরিণতিকে ভয় করেন না’।
অর্থাৎ যালেমদের ধ্বংস করার পর তাদের পক্ষ হ’তে কোনরূপ প্রতিরোধের ভয় তিনি করেন না। কেননা তাঁর ক্ষমতার সামনে অন্যের ক্ষমতা নিতান্তই তুচ্ছ। ইবনু আববাস, ক্বাতাদাহ, হাসান বাছরী, মুজাহিদ প্রমুখ বিদ্বান একথা বলেন (কুরতুবী, ইবনু কাছীর)। তিনি فَعَّالٌ لِّمَا يُرِيْدُ ‘যা চান তাই করেন’ (বুরূজ ৮৫/১৬)। لاَ يُسْأَلُ عَمَّا يَفْعَلُ وَهُمْ يُسْأَلُوْنَ ‘তিনি যা করেন তাতে প্রশ্ন তোলার কেউ নেই। বরং তারাই জিজ্ঞাসিত হবে’ (আম্বিয়া ২১/২৩)। একথার মাধ্যমে হঠকারী ব্যক্তিদের প্রচন্ডভাবে ধমক দেওয়া হয়েছে।
সারকথা :
পবিত্র হৃদয়ের মানুষ সর্বদা কৃতকার্য হয় এবং কলুষিত হৃদয়ের মানুষ সর্বদা পর্যুদস্ত হয়।[1]. নাসাঈ হা/৯৮৪, বুখারী হা/৭০৫; মুসলিম হা/৪৬৫; মিশকাত হা/৮৩৩; বিস্তারিত আলোচনা দ্রষ্টব্য : সূরা ফজর।
[2]. বুখারী হা/৩৮৮৭, মুসলিম হা/১৬৪, মিশকাত হা/৫৮৬২।
[3]. আহমাদ হা/১৯৩২৭; মুসলিম হা/২৭২২; মিশকাত হা/২৪৬০ ‘দো‘আ সমূহ’ অধ্যায়-৯, ‘আল্লাহর কাছে পানাহ চাওয়া’ অনুচ্ছেদ-৮।
[4]. মুসলিম হা/২৭২১, মিশকাত হা/২৪৮৪ ‘দো‘আ সমূহ’ অধ্যায়-৯, ‘সারগর্ভ দো‘আ’ অনুচ্ছেদ-৯।
[5]. বুখারী হা/৪৯৪২, মুসলিম, তিরমিযী হা/৩৩৪৩।
[6]. মুসলিম হা/২৮৫৫।