তাফসীরুল কুরআন - (৩০তম পারা)

সূরা আ‘লা

(সর্বোচ্চ)

সূরা তাকভীরের পরে মক্কায় অবতীর্ণ।

সূরা ৮৭, আয়াত ১৯, শব্দ ৭২, বর্ণ ২৯৩।

بِسْمِ اللہِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِیْمِ

পরম করুণাময় অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে (শুরু করছি)।

(১) তুমি তোমার সর্বোচ্চ প্রতিপালকের নামের পবিত্রতা বর্ণনা কর।
سَبِّحِ اسْمَ رَبِّكَ الْأَعْلَى
(২) যিনি সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর বিন্যস্ত করেছেন।
الَّذِي خَلَقَ فَسَوَّى
(৩) যিনি পরিমিত করেছেন। অতঃপর পথ প্রদর্শন করেছেন।
وَالَّذِي قَدَّرَ فَهَدَى
(৪) যিনি তৃণাদি উৎপন্ন করেন।
وَالَّذِي أَخْرَجَ الْمَرْعَى
(৫) অতঃপর তাকে শুষ্ক-কালো বর্জ্যে পরিণত করেন।
فَجَعَلَهُ غُثَاءً أَحْوَى
(৬) সত্বর আমরা তোমাকে পাঠ করাবো (কুরআন)। অতঃপর তুমি তা ভুলবে না।
سَنُقْرِئُكَ فَلَا تَنْسَى
(৭) তবে আল্লাহ যা ইচ্ছা করেন তা ব্যতীত। নিশ্চয়ই তিনি জানেন প্রকাশ্য ও গোপন সকল বিষয়।
إِلَّا مَا شَاءَ اللَّهُ إِنَّهُ يَعْلَمُ الْجَهْرَ وَمَا يَخْفَى
(৮) আর আমরা তোমাকে সরল পথের জন্য সহজ করে দেব।
وَنُيَسِّرُكَ لِلْيُسْرَى
(৯) অতএব তুমি উপদেশ দাও যদি উপদেশ ফলপ্রসূ হয়।
فَذَكِّرْ إِنْ نَفَعَتِ الذِّكْرَى
(১০) সত্বর উপদেশ গ্রহণ করবে, যে ব্যক্তি ভয় করে।
سَيَذَّكَّرُ مَنْ يَخْشَى
(১১) আর তা উপেক্ষা করবে যে নিতান্ত হতভাগা।
وَيَتَجَنَّبُهَا الْأَشْقَى
(১২) যে প্রবেশ করবে মহা অগ্নিতে।
الَّذِي يَصْلَى النَّارَ الْكُبْرَى
(১৩) অতঃপর সেখানে সে মরবেও না, বাঁচবেও না।
ثُمَّ لَا يَمُوتُ فِيهَا وَلَا يَحْيَى
(১৪) নিশ্চয়ই সফল হয় সেই ব্যক্তি, যে পরিশুদ্ধ হয়।
قَدْ أَفْلَحَ مَنْ تَزَكَّى
(১৫) এবং তার প্রভুর নাম স্মরণ করে। অতঃপর ছালাত আদায় করে।
وَذَكَرَ اسْمَ رَبِّهِ فَصَلَّى
(১৬) বস্ত্ততঃ তোমরা দুনিয়াবী জীবনকে অগ্রাধিকার দিয়ে থাক।
بَلْ تُؤْثِرُونَ الْحَيَاةَ الدُّنْيَا
(১৭) অথচ আখেরাত হ’ল উত্তম ও চিরস্থায়ী।
وَالْآخِرَةُ خَيْرٌ وَأَبْقَى
(১৮) নিশ্চয়ই এটা লিপিবদ্ধ ছিল পূর্ববর্তী কিতাব সমূহে-
إِنَّ هَذَا لَفِي الصُّحُفِ الْأُولَى
(১৯) ইবরাহীম ও মূসার কিতাবসমূহে।
صُحُفِ إِبْرَاهِيمَ وَمُوسَى

 

গুরুত্ব :

(১) হযরত নু‘মান বিন বাশীর (রাঃ) বলেন যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) দুই ঈদ ও জুম‘আর ছালাতে সূরা আ‘লা ও গাশিয়াহ পাঠ করতেন। এমনকি জুম‘আ ও ঈদ একদিনে হ’লেও তিনি উক্ত দু’টি সূরাই পড়তেন’।[1]

(২) একবার রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মু‘আয বিন জাবালকে বলেন, ‘তুমি সূরা আ‘লা, ফজর, শাম্স, লায়েল, যোহা পাঠ কর না কেন’? [2]

(৩) বারা বিন আযেব (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ)-এর ছাহাবীগণের মধ্যে মদীনায় প্রথম আসেন মুছ‘আব বিন ওমায়ের ও আব্দুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতূম। তারা আমাদেরকে কুরআন পড়াতে থাকেন। অতঃপর আসেন ‘আম্মার, বেলাল ও সা‘দ ইবনু আবী ওয়াকক্বাছ। তারপর বিশ জনের একটি দল নিয়ে আসেন ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব। অতঃপর আসেন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নিজে। আমি মদীনাবাসীকে কখনো এত খুশী হ’তে দেখিনি যত খুশী তাঁর আগমনে হ’তে দেখেছি। এমনকি ছোট্ট শিশু-কিশোররা বলতে থাকে, هَذَا رَسُوْلُ اللهِ قَدْ جَاءَ ‘এই যে আল্লাহর রাসূল এসে গেছেন’। তিনি আসা পর্যন্ত আমি পাঠ করতাম সূরা আ‘লা এবং অনুরূপ সূরা সমূহ’।[3]

(৪) আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তিন রাক‘আত বিতর ছালাতে সূরা আ‘লা, কাফেরূন ও সূরা ইখলাছ পাঠ করতেন’। তবে আয়েশা (রাঃ)-এর বর্ণনায় এসেছে যে, তিনি শেষ রাকআতে সূরা ইখলাছ এবং ফালাক্ব ও নাস পাঠ করতেন’।[4]

উবাই ইবনু কা‘ব (রাঃ)-এর বর্ণনায় এসেছে যে, وَلاَ يُسَلِّمُ إِلاَّ فِى آخِرِهِنَّ ‘এ সময় তিনি শেষ রাক‘আতে ব্যতীত সালাম ফিরাতেন না’।[5] আয়েশা (রাঃ)-এর বর্ণনায় এসেছে لاَ يَقْعُدُ إِلاَّ فِى آخِرِهِنَّ ‘শেষ রাক‘আতে ব্যতীত বসতেন না’।[6] আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেছেন, তোমরা মাগরিবের ছালাতের ন্যায় (মাঝখানে বৈঠক করে) বিতর ছালাত আদায় করো না’।[7]

(৫) আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সাবিবহিসমা রবিবকাল আ‘লা পাঠ করার পর বলতেন, সুবহা-না রবিবয়াল আ‘লা (মহাপবিত্র আমার প্রতিপালক, যিনি সর্বোচ্চ)।[8] এটি ছালাতের মধ্যে ও ছালাতের বাইরে সর্বাবস্থায় পাঠক ও শ্রোতা সকলের জন্য পড়া মুস্তাহাব।[9]

বিষয়বস্ত্ত :

অত্র সূরাতে আল্লাহর সর্বোচ্চ সত্তা হওয়া এবং এজন্য তাঁর পবিত্রতা বর্ণনা করা, মানুষের সৃষ্টি ও তার পথ প্রদর্শন, তাকে স্মৃতিশক্তির নে‘মত প্রদান, বিশুদ্ধ অন্তরের লোকদের জন্য ইসলাম সহজতর হওয়া, দুনিয়াবী জীবনের চাইতে আখেরাতের জীবন উত্তম ও চিরস্থায়ী হওয়া এবং কুরআনের এইসব বক্তব্য যে বিগত ইলাহী কিতাবসমূহের সারনির্যাস- সেসব বিষয়ে বর্ণিত হয়েছে।

তাফসীর :

(১) سَبِّحِ اسْمَ رَبِّكَ الْأَعْلَى ‘তুমি তোমার সর্বোচ্চ প্রতিপালকের নামের পবিত্রতা বর্ণনা কর’।

অর্থ نزه ربك من كل ما لا يليق بجلاله وعظمته ‘তোমার প্রতিপালকের পবিত্রতা ঘোষণা কর ঐ সকল বস্ত্ত হ’তে যা তাঁর পরাক্রম ও মহত্ত্বের উপযুক্ত নয়’। এখানে আল্লাহর নামের পবিত্রতা অর্থ আল্লাহর সত্তার পবিত্রতা বর্ণনা করা যবান দিয়ে ও হৃদয় দিয়ে। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন,معنى سَبِّحِ اسْمَ رَبِّكَ الْأَعْلَى أَىْ عَظِّمْ رَبَّكَ الْأَعْلَى ‘তোমার মহান পালনকর্তার নামের পবিত্রতা বর্ণনা কর’ অর্থ ‘তোমার মহান পালনকর্তার বড়ত্ব ঘোষণা কর’ (কুরতুবী)। অন্যত্র এসেছে فَسَبِّحْ بِاسْمِ رَبِّكَ الْعَظِيْمِ ‘অতএব তুমি তোমার প্রতিপালকের নামের পবিত্রতা বর্ণনা কর’ (ওয়াক্বি‘আহ ৫৬/৯৬)। অর্থ سبح تسبيحًا مقرونًا باسم الله ‘আল্লাহর নামসহ তাসবীহ পাঠ কর’। কেননা নাম ব্যতীত আল্লাহর নিকট দো‘আ করা বা তাঁর তাসবীহ পাঠ করা সম্ভব নয়। কারণ কাফেররা মুখে আল্লাহকে স্বীকার করলেও অন্তরে স্বীকার করত না। যেমন আল্লাহ বলেন, وَلَئِنْ سَأَلْتَهُمْ مَنْ خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ لَيَقُولُنَّ اللهُ قُلِ الْحَمْدُ لِلَّهِ بَلْ أَكْثَرُهُمْ لاَ يَعْلَمُونَ ‘যদি তুমি ওদের জিজ্ঞেস কর কে নভোমন্ডল ও ভূমন্ডল সৃষ্টি করেছেন? ওরা বলবে, আল্লাহ। তুমি বল সকল প্রশংসা আল্লাহর। কিন্তু ওদের অধিকাংশ এবিষয়ে অজ্ঞ’ (লোকমান ৩১/২৫)। বস্ত্ততঃ আল্লাহর নাম ও নামীয় সত্তা (الاسم والمسمى) পৃথক নয়। যেটা মু‘তাযিলাগণ ধারণা করে থাকেন। অতএব এখানে অর্থ হ’ল نزه ربك من كل عيب ونقص ‘তোমার পালনকর্তার পবিত্রতা ঘোষণা কর যাবতীয় দোষ ও ত্রুটি হ’তে’। আর এই তাসবীহ কেবল অন্তরে নয়, বরং হৃদয় ও যবান দু’টি দিয়ে করবে।

سَبِّحِ বলে রাসূল (ছাঃ)-কে উদ্দেশ্য করে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কুরআনে এধরনের আদেশ তিন অর্থে এসেছে। ১. রাসূল (ছাঃ)-এর জন্য খাছ। যা পূর্বাপর বিষয়াদির মাধ্যমে প্রমাণিত হয়। যেমন أَلَمْ نَشْرَحْ لَكَ صَدْرَكَ، وَوَضَعْنَا عَنْكَ وِزْرَكَ (ইনশিরাহ ৯৪/১-২)وَمَا أَرْسَلْنَاكَ إِلاَّ كَافَّةً لِلنَّاسِ بَشِيرًا وَنَذِيرًا وَلَكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لاَ يَعْلَمُونَ (সাবা ৩৪/২৮) ইত্যাদি। ২. রাসূল (ছাঃ) ও সকলের জন্য ‘আম। যা পূর্বাপর বিষয়াদির মাধ্যমে প্রতীয়মান হয়। যেমন يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ إِذَا طَلَّقْتُمُ النِّسَاءَ فَطَلِّقُوهُنَّ لِعِدَّتِهِنَّ وَأَحْصُوا الْعِدَّةَ وَاتَّقُوا اللهَ رَبَّكُمْ  (তালাক ৬৫/১)। এখানে নবী (ছাঃ)-কে আহবান করা সত্ত্বেও বহুবচনের ক্রিয়া ব্যবহার করা হয়েছে। কারণ তালাক দানের বিধানটি তাঁর ও অন্য সকলের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। ৩. শাব্দিকভাবে রাসূল (ছাঃ)-কে বলা হ’লেও মর্মগতভাবে সকলের উদ্দেশ্যে বলা হয়েছে। এর উদাহরণ অসংখ্য। যেমন আলোচ্য আয়াত- سَبِّحِ اسْمَ رَبِّكَ الْأَعْلَى (আ‘লা ৮৭/১)كُلُّ مَنْ عَلَيْهَا فَانٍ- وَيَبْقَى وَجْهُ رَبِّكَ ذُو الْجَلاَلِ وَالْإِكْرَامِ (রহমান ৫৫/২৬) ইত্যাদি।

তাসবীহ পাঠ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘আল্লাহর নিকট সর্বাধিক প্রিয় বাক্য হ’ল চারটি : সুবহানাল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, আল্লাহু আকবর’[10] তিনি বলেন, ‘যে ব্যক্তি দৈনিক ১০০ বার সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহী পাঠ করে, তার সকল (ছগীরা) গোনাহ মাফ করা হয়, যদিও তা সাগরের ফেনা সমতুল্য হয়’।[11] তিনি বলেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ’ মীযানের পাল্লা ভরে দেয়। সুবহানাল্লাহআলহামদুলিল্লাহ আকাশসমূহ ও পৃথিবীর মধ্যবর্তী স্থানকে নেকী দিয়ে পূর্ণ করে দেয়’।[12] অন্য বর্ণনায় এসেছে, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহআল্লাহু আকবর...[13]

অত্র আয়াত দ্বারা ‘আল্লাহ, আল্লাহ’ যিকর করার বৈধতা প্রমাণিত হয় না। কেননা ঐরূপ যিকরের কোন প্রমাণ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও ছাহাবায়ে কেরাম থেকে পাওয়া যায় না। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, لاَ تَقُوْمُ السَّاعَةُ حَتَّى لاَ يُقَالَ فِى الأَرْضِ اللهُ اللهُ ‘ক্বিয়ামত হবে না যতদিন পৃথিবীতে কেউ বলবে আল্লাহ আল্লাহ।[14] এর ব্যাখ্যা একই রাবী আনাস (রাঃ) কর্তৃক অন্য বর্ণনায় এসেছে, لاَ إِلَهَ اِلاَّ اللهُ (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ)[15] অর্থাৎ যতদিন পৃথিবীতে একজন প্রকৃত তাওহীদবাদী মুসলিম বেঁচে থাকবে ততদিন ক্বিয়ামত হবে না। এর দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, একজন তাওহীদবাদী মুমিনের গুরুত্ব আল্লাহর নিকটে বিশ্বের সকল মানুষের চাইতে অধিক।

سَبِّحْ আদেশসূচক ক্রিয়া। এর মাছদার হ’ল تسبيح যার অর্থ تنزيه الشيئ عن السوء ‘মন্দ থেকে কোন বস্ত্তকে উত্তমভাবে পবিত্র করা’ বা কারু পবিত্রতা বর্ণনা করা। তানতাভী বলেন, আয়াতের অর্থ হল نزِّه ذاته عما لا يليق به ‘তাঁর সত্তা যার উপযুক্ত নয়, তা থেকে তাঁকে পবিত্র কর’। অর্থাৎ আল্লাহর সত্তাকে তুমি যাবতীয় শিরকের কালিমা হ’তে পবিত্র কর। রাসূল (ছাঃ)-এর বাপ-দাদাদের মধ্যে শিরকের রেওয়াজ ছিল। তারা আল্লাহকে মানতেন। কিন্তু তাদের দৃষ্টিতে বিভিন্ন নেককার মৃত ব্যক্তিদের অসীলায় তারা আল্লাহর কাছে পানাহ চাইতেন (যুমার ৩৯/৩)। ঐ মৃত ব্যক্তির প্রতীক হিসাবে তারা তার মূর্তি বানিয়ে সামনে রাখতেন ও তাকে আল্লাহর নিকট সুফারিশকারী ধারণা করতেন (ইউনুস ১০/১৮)। মুশরিকরা ফেরেশতাদেরকে আল্লাহর কন্যা বলত (ইসরা ১৭/৪০)। তারা আল্লাহর স্ত্রী সন্তান আছে বলত (জিন ৭২/৩)। এতদ্ব্যতীত চন্দ্র-সূর্য ও অন্যান্য বস্ত্তকে এবং অলি-আউলিয়া ও মৃত নেককার ব্যক্তিদেরকে আল্লাহর শরীক কল্পনা করত (হামীম সাজদাহ ৪১/৩৭; তওবাহ ৯/৩০-৩১ প্রভৃতি)। আল্লাহ এখানে তাঁর রাসূলকে সর্বপ্রথম এসব মিথ্যা ধারণা-কল্পনা থেকে যে আল্লাহ পবিত্র, সেকথা ঘোষণা করার নির্দেশ দিয়েছেন। যেমন অন্যত্র আল্লাহ বলেন, سُبْحَانَ رَبِّكَ رَبِّ الْعِزَّةِ عَمَّا يَصِفُوْنَ ‘তারা আল্লাহ সম্পর্কে যেসব কথা বলে, সেসব থেকে তোমার প্রতিপালক পবিত্র। যিনি সকল সম্মানের অধিকারী’ (ছাফফাত ৩৭/১৮০)

الْأَعْلَى অর্থ الأرفع সর্বোচ্চ। অর্থাৎ الأَرْفَعُ من كل شيئ قدرةً ومُلْكًا وسلطانًا ‘শক্তি, রাজত্ব ও পরাক্রম সকল দিক দিয়ে তিনি সকল বস্ত্তর উপরে’ (ক্বাসেমী)। আর এই সর্বোচ্চ তিনি স্বীয় সত্তা ও গুণাবলী উভয় দিক দিয়ে। ‘রহমান’ ব্যতীত রব, রহীম, রঊফ, হাই, প্রভৃতি গুণাবলী বান্দার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হয়। কিন্তু যখন এগুলি আল্লাহর জন্য বলা হয়, তখন তার অর্থ হয় সর্বোচ্চ ও পূর্ণাঙ্গ, যাতে কোনরূপ কমতি ও ত্রুটি নেই। যেমন ‘হাই’ কোন জীবিত বান্দার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু বান্দা মরণশীল। অথচ আল্লাহর ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হ’লে এর অর্থ হবে চিরঞ্জীব। আল্লাহ বলেন, وَلَهُ الْمَثَلُ الْأَعْلَى فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَهُوَ الْعَزِيْزُ الْحَكِيْمُ ‘তাঁর জন্যই সর্বোচ্চ উপমা নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলে এবং তিনিই মহাপরাক্রান্ত ও প্রজ্ঞাময়’ (রূম ৩০/২৭; নাহল ১৬/৬০)

এখানে আল্লাহর বিশেষণ হিসাবে তাঁর গুণবাচক নামসমূহের মধ্য হ’তে الأَعْلَى বা ‘সর্বোচ্চ’ নামটি কেন আনা হ’ল? কেননা এর দ্বারা বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, জ্ঞান, শক্তি, ক্ষমতা, পরিকল্পনা, ব্যবস্থাপনা সবদিক দিয়ে তিনি সর্বোচ্চ। ভূমন্ডল ও নভোমন্ডলের সবকিছু তাঁর সৃষ্ট, অনুগত ও অধীনস্ত। সবাই তার হুকুম পালনে সদা তৎপর ও সদা প্রস্ত্তত। মানুষের পক্ষে দৃশ্যমান ও অদৃশ্য বা অনুভবযোগ্য অথবা তাদের অনুভবের বাইরে সকল শক্তি, ক্ষমতা ও জ্ঞান সম্ভারের সবকিছুর সর্বশেষ ও সর্বোচ্চ কেন্দ্রবিন্দু হ’লেন সর্বশক্তিমান আল্লাহ। যেমন অন্যত্র বলা হয়েছে, وَأَنَّ إِلَى رَبِّكَ الْمُنتَهَى ‘আর তোমার পালনকর্তার নিকটেই রয়েছে সবকিছুর সমাপ্তি’ (নাজম ৫৩/৪২)

এখানে الأَعْلَى শব্দের প্রকাশ্য অর্থ দ্বারা সালাফে ছালেহীন আল্লাহর ‘উচ্চতার’ (فى إثبات العلوّ) প্রমাণ গ্রহণ করেছেন কোনরূপ প্রকৃতি ও আকৃতি (بلا تكييف ولا تمثيل) কল্পনা ছাড়াই। তিনি (সাত আসমানের উপরে) আরশে সমুন্নীত (ত্বোয়াহা ২০/৫)। মু‘আবিয়া ইবনুল হাকাম (রাঃ) বলেন, আমার একটা দাসী ছিল যে ওহোদ ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় আমার দুম্বা চরাতো। একদিন খোঁজ নিয়ে দেখি একটা দুম্বা নেই। সে বলল, নেকড়ে নিয়ে গেছে। তখন রাগে আমি তাকে একটা চড় মারলাম। অতঃপর রাসূল (ছাঃ)-এর কাছে এসে বললে তিনি এটাকে গুরুতর অন্যায় মনে করলেন। তখন আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমার উপর (যেহারের) একটি গোলাম আযাদ করা বাকী আছে। আমি দাসীটিকে মুক্ত করে দেব? তখন তিনি বললেন, ওকে ডেকে আনো। আমি তাকে নিয়ে আসলে তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেন, أَيْنَ اللهُ؟ আল্লাহ কোথায়? সে বলল, فِى السَّمَاءِ ‘আসমানে’। অতঃপর তিনি জিজ্ঞেস করলেন, مَنْ أَنَا আমি কে? সে বলল, أَنْتَ رَسُوْلُ اللهِ আপনি আল্লাহর রাসূল’। তখন তিনি বললেন, ওকে মুক্ত করে দাও। কেননা সে মুমিন নারী’।[16]

অতএব আল্লাহ ‘মুমিনের কলবে’ আছেন, ‘যত কল্লা তত আল্লাহ’ তিনি সর্বত্র বিরাজমান, তিনি নিরাকার ও শূন্য সত্তা’ ‘স্রষ্টা ও সৃষ্টিতে কোন পার্থক্য নেই’ ইত্যাদি ধারণা সম্পূর্ণ অবাস্তব।

এখানে الأَعْلَى (আ‘লা) বা ‘সর্বোচ্চ’ গুণবাচক নামটি আনার মাধ্যমে এ বিষয়েও ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, নাম ও গুণাবলীতে আল্লাহ যেমন সর্বোচ্চ, সৃষ্টি হিসাবে মানুষ তেমনি সেরা সৃষ্টি। আর সৃষ্টিজগতে মানুষ সর্বোচ্চ মর্যাদায় আসীন হ’তে পারবে যদি নাকি সে আল্লাহর আনুগত্য করে ও তাঁর বিধানসমূহ মেনে চলে। যদি নাকি সে আল্লাহর সৃষ্টিতত্ত্ব বিষয়ে চিন্তা-গবেষণা করে ও সৃষ্টিনিচয়কে মানবতার কল্যাণে ব্যবহার করে। পরবর্তী আয়াতসমূহে আল্লাহর সৃষ্টিকৌশল সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে, যাতে মানুষ বুঝতে পারে যে, কেন আল্লাহ সর্বোচ্চ এবং কেন তাঁর সত্তার পবিত্রতা বর্ণনা করতে হবে।

উপরোক্ত আয়াতটির নিগূঢ় তত্ত্বের কারণেই সম্ভবতঃ আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) এটাকে সিজদায় গিয়ে দো‘আ রূপে পাঠ করার নির্দেশ দিয়েছেন।[17] কেননা সিজদা অবস্থায় মুছল্লী তার প্রভুর সর্বাপেক্ষা নিকটে পৌঁছে যায়।[18] ফলে আয়াতটি পরোক্ষভাবে সিজদার দো‘আ হিসাবে দৈনিক কোটি কোটি মুসলিম নর-নারী পাঠ করে থাকে।

এক্ষণে যখনই সুবহানা রবিবয়াল আ‘লা বলা হবে, তখনই ধারণা করতে হবে যে, আমার প্রতিপালক আল্লাহ সকল কিছুর উপরে এবং সর্বপ্রকার গুণাবলীতে শ্রেষ্ঠ ও পূর্ণাঙ্গ।

দো‘আ হ’ল ইবাদত’।[19] আর ইবাদত হ’ল জ্ঞান ও সূক্ষ্মদৃষ্টি অর্জনের দরজা বিশেষ। পূর্ণ বুঝ ও অনুভূতি সহকারে মানুষ যত বেশী আল্লাহর ইবাদত করবে ও তাসবীহ পাঠ করবে এবং তাঁর পবিত্রতা বর্ণনা করবে, সে তত বেশী আল্লাহর নিকটবর্তী হবে ও তার অন্তরচক্ষু খুলে যাবে। রুকূতে সুবহানা রাবিবয়াল ‘আযীম এবং সিজদাতে সুবহানা রাবিবয়াল আ‘লা বলার নির্দেশ দানের[20]মধ্যে এই সূক্ষ্ম ইঙ্গিত রয়েছে যে, মানুষ যত বেশী আল্লাহর অনুগত হবে, দুনিয়া ও আখেরাতে তার মর্যাদা তত বেশী উন্নত হবে।

(২-৩) الَّذِيْ خَلَقَ فَسَوَّى، وَالَّذِيْ قَدَّرَ فَهَدَى ‘যিনি সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর বিন্যস্ত করেছেন’ ‘যিনি পরিমিত করেছেন। অতঃপর পথ প্রদর্শন করেছেন’।

এখানে خَلَقَ অর্থ أوجد من العدم ‘যিনি অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্বে এনেছেন, যার কোন পূর্ব নমুনা ছিল না’। যা করতে মানুষ একেবারেই অক্ষম। এর তুলনা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে আল্লাহ বলেন, يَا أَيُّهَا النَّاسُ ضُرِبَ مَثَلٌ فَاسْتَمِعُوا لَهُ إِنَّ الَّذِينَ تَدْعُونَ مِنْ دُونِ اللهِ لَنْ يَخْلُقُوا ذُبَابًا وَلَوِ اجْتَمَعُوا لَهُ وَإِنْ يَسْلُبْهُمُ الذُّبَابُ شَيْئًا لاَ يَسْتَنْقِذُوهُ مِنْهُ ضَعُفَ الطَّالِبُ وَالْمَطْلُوبُ- مَا قَدَرُوا اللهَ حَقَّ قَدْرِهِ إِنَّ اللهَ لَقَوِيٌّ عَزِيْزٌ ‘হে মানুষ! একটি উপমা দেয়া হচ্ছে, মনোযোগ দিয়ে শোন। তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যাদেরকে আহবান কর, তারা কখনো একটি মাছিও সৃষ্টি করতে পারে না, উক্ত উদ্দেশ্যে সকলে একত্রিত হ’লেও। মাছি যদি তাদের নিকট থেকে কিছু ছিনিয়ে নিয়ে যায়, সেটাও তারা তার কাছ থেকে উদ্ধার করতে পারে না। পূজারী ও দেবতা কতই না দুর্বল’। ‘তারা আল্লাহর যথার্থ মর্যাদা উপলব্ধি করে না। নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমতাবান ও পরাক্রমশালী’ (হজ্জ ২২/৭৩-৭৪)

সকল প্রাণী সৃষ্টির মূল উপাদান হ’ল প্রোটোপ্লাজম (Protoplasm)। আর এটাই হ’ল জীবনের প্রথম একক (Unit)। জনৈক বিজ্ঞানী ১৫ বছর ধরে চেষ্টা করেও এই প্রোটোপ্লাজম তৈরী করতে ব্যর্থ হন। ফলে আধুনিক বিজ্ঞান এ বিষয়ে দীর্ঘ গবেষণার পর সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে যে, উক্ত জীবন কণা সৃষ্টি করা মানুষের পক্ষে সম্ভব নয় (স্রষ্টা ও সৃষ্টিতত্ত্ব ৪০৮ পৃঃ)

অত্র আয়াতদ্বয়ে চারটি বিষয় বর্ণিত হয়েছে। সৃষ্টি করা, বিন্যস্ত করা, পরিমিত করা এবং পথ প্রদর্শন করা। মানুষসহ প্রাণীকুলের সৃষ্টির মধ্যে এ চারটি বিষয় মওজুদ রয়েছে। অর্থাৎ প্রত্যেক প্রাণীর দৈহিক গঠন, আকার-আকৃতি ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মধ্যে বিশেষ মিল ও সামঞ্জস্য বিধান করে আল্লাহ তাকে অস্তিত্ব দান করেছেন। সাথে সাথে যাকে যে কাজের জন্য সৃষ্টি করেছেন তাকে পরিমাণ মত সে কাজের যোগ্যতা দান করেছেন ও সেই কাজের জন্য পথ প্রদর্শন করেছেন। তিনি প্রত্যেক সৃষ্টিকে এক ধরনের বুদ্ধি ও চেতনা দান করেছেন (ত্বোয়াহা ২০/৫০)। যদিও তা মানুষের বুদ্ধি ও চেতনা হ’তে অনেক নিম্নস্তরের।

আল্লাহ এক এক প্রাণীকে এক একভাবে সৃষ্টি করেছেন। কেউ ভূগর্ভে বসবাস করে। যেমন কেঁচো ও পোকা-মাকড়। কেউ মাটির উপরে চলাফেরা করে। তবে তার মধ্যেও রয়েছে শ্রেণীভেদ। যেমন কেউ বুকে চলে। যেমন সাপ ও সরীসৃপ জাতীয় প্রাণী। কেউ দু’পায়ে চলে, যেমন মানুষ ও হাঁস-মুরগী। কেউ চারপায়ে চলে। যেমন গরু, ছাগল, হরিণ ইত্যাদি চতুষ্পদ পশু (নূর ২৪/৪৫)। কেউ আকাশে উড়ে চলে। যেমন পাখি, মশা-মাছি ইত্যাদি। কেউ পানিতে বাস করে। যেমন মাছ, কুমীর ইত্যাদি। প্রত্যেক প্রাণী স্ব স্ব অবয়বে সুন্দর ও সুবিন্যস্ত এবং স্বভাবে স্বতন্ত্র। প্রত্যেকের রুচি ও আচরণ, খাদ্যাভ্যাস ও চাল-চলন পৃথক বৈশিষ্ট্যমন্ডিত। যাকে যেকাজে যেভাবে পথ প্রদর্শন করা হয়েছে, সে প্রাণী সেভাবেই সেকাজ করে। গরু সবুজ ঘাস ও শুকনো বিচালী চিবিয়ে খায়। অথচ মানুষ ধানের খোসা ছাড়িয়ে চাউল বের করে রান্না করে খায়। মাছ পানির নীচে বেঁচে থাকে ও খেলে বেড়ায়। মানুষ ভূপৃষ্ঠে বেঁচে থাকে ও পানিতে ডুবলে মরে যায়। পাখি সকালে ক্ষুধার্ত অবস্থায় বের হয় ও সন্ধ্যায় পেট ভরে বাসায় ফেরে। অথচ বৃক্ষ সারা জীবন একস্থানে দাঁড়িয়ে থাকে ও সেখানেই আল্লাহ তার রূযী পৌঁছে দেন। এভাবে প্রতিটি প্রাণীর সৃষ্টিকৌশল, তার বিন্যস্তকরণ, পরিমিতকরণ, পথপ্রদর্শন সবই স্বতন্ত্র ধারায় রচিত ও পূর্বনির্ধারিত। রাসূল (ছাঃ) বলেন, كَتَبَ اللهُ مَقَادِيرَ الْخَلاَئِقِ قَبْلَ أَنْ يَخْلُقَ السَّمَوَاتِ وَالْأَرْضَ بِخَمْسِيْنَ أَلْفَ سَنَةٍ- ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ আসমান ও যমীন সৃষ্টির পঞ্চাশ হাযার বছর পূর্বে সৃষ্টিকুলের তাক্বদীর নির্ধারণ করেছেন’।[21]

প্রত্যেক প্রাণী আল্লাহ প্রদত্ত হেদায়াত তথা স্বভাবধর্ম অনুযায়ী চলে। মানুষও সেভাবে চলে। কিন্তু অন্য সৃষ্টিকে যে বিশেষ নে‘মতটি দেওয়া হয়নি, সেই অমূল্য নে‘মত তথা জ্ঞান সম্পদ আল্লাহ কেবল মানুষকে দান করেছেন। যা দিয়ে সে স্বাধীনভাবে সঠিক পথ ও ভুল পথ বেছে চলতে পারে (দাহর ৭৬/৩) এবং সৃষ্টিকুলের উপরে নিজের প্রাধান্য   বিস্তার করতে পারে (বনী ইসরাঈল ১৭/৭০; লোকমান ৩১/২০)। অতঃপর স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে আল্লাহর ইবাদত করতে পারে (যারিয়াত ৫১/৫৬)

হেদায়াত-এর অর্থ : ‘হেদায়াত’ শব্দটি পবিত্র কুরআনে মোটামুটি চারটি অর্থে এসেছে। যেমন-

(১) সাধারণভাবে পথ প্রদর্শন। যা সকল সৃষ্টি জগতকে দেওয়া হয়েছে। যার মধ্যে জিন, ইনসান, উদ্ভিদ, প্রাণীজগত, সৌরজগত সবই শামিল রয়েছে। যেমন আল্লাহ আলোচ্য সূরার বর্তমান আয়াতে বলেছেন। তাছাড়া অন্যত্র বলেছেন الَّذِيْ أَعْطَى كُلَّ شَيْءٍ خَلْقَهُ ثُمَّ هَدَى- ‘যিনি প্রত্যেক বস্ত্তকে তার যোগ্য আকৃতি দান করেছেন, অতঃপর তাকে পথ প্রদর্শন করেছেন’ (ত্বোয়াহা ২০/৫০)। সেজন্যই দেখা যায়, প্রত্যেক প্রাণী ও প্রতিটি বস্ত্ত স্ব স্ব দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। নাক, কান, চোখ তথা দেহের প্রত্যেকটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ এমনকি প্রত্যেকটি অণু-পরমাণু আল্লাহর হেদায়াত মোতাবেক স্ব স্ব কাজ করে যাচ্ছে। আকাশের সূর্য, চন্দ্র, মেঘমালা ও বায়ুমন্ডল একই হেদায়াত মতে চলছে। হেদায়াতের এ স্তরটি সাধারণ ও ব্যাপক।

(২) প্রকাশিত হওয়া। যেমন আল্লাহ বলেন, أَوَلَمْ يَهْدِ لِلَّذِيْنَ يَرِثُوْنَ الْأَرْضَ مِنْ بَعْدِ أَهْلِهَا أَنْ لَّوْ نَشَاءُ أَصَبْنَاهُمْ بِذُنُوْبِهِمْ- ‘তাদের নিকটে কি প্রকাশিত হয়নি যারা পূর্বের লোকদের পরে যমীনের উত্তরাধিকারী হয়েছে একথা যে, আমরা ইচ্ছা করলে তাদেরকে তাদের পাপের কারণে পাকড়াও করে ফেলতাম’? (আ‘রাফ ৭/১০০)। তিনি বলেন, وَأَمَّا ثَمُوْدُ فَهَدَيْنَاهُمْ فَاسْتَحَبُّوا الْعَمَى عَلَى الْهُدَى فَأَخَذَتْهُمْ صَاعِقَةُ الْعَذَابِ الْهُونِ بِمَا كَانُوا يَكْسِبُوْنَ ‘অতঃপর ছামূদ জাতি। তাদেরকে আমরা পথ প্রদর্শন করেছিলাম। কিন্তু তারা সৎপথের বিপরীতে ভ্রান্তপথ অবলম্বন করল। ফলে তাদের কৃতকর্মের ফলস্বরূপ লাঞ্ছনাকর শাস্তি তাদের গ্রেফতার করে’ (হা-মীম সাজদাহ ৪১/১৭)। হেদায়াতের এ স্তরটি অবাধ্য ও হঠকারী মানুষের জন্য।

(৩) মানুষকে সরল পথ প্রদর্শন করা। যেমন আল্লাহ বলেন, إِنَّا هَدَيْنَاهُ السَّبِيْلَ إِمَّا شَاكِراً وَّإِمَّا كَفُوْرا-ً ‘আমরা মানুষকে পথ প্রদর্শন করেছি। এখন সে হয় কৃতজ্ঞ হৌক, না হয় অকৃতজ্ঞ হৌক’ (দাহর ৭৬/৩)। এখানে বর্ণিত হেদায়াতটি সকল মানুষের জন্য, যারা জ্ঞান সম্পদের অধিকারী।

(৪) সত্য গ্রহণ ও তা অনুসরণের ক্ষমতা। যেমন আল্লাহ বলেন, إِنَّكَ لاَ تَهْدِيْ مَنْ أَحْبَبْتَ وَلَكِنَّ اللهَ يَهْدِيْ مَنْ يَّشَآءُ وَهُوَ أَعْلَمُ بِالْمُهْتَدِيْنَ- ‘তুমি যাকে পসন্দ কর তাকে সৎপথে আনতে পারবে না। বরং আল্লাহ যাকে ইচ্ছা করেন তাকে সৎপথে আনেন। কে সৎপথ প্রাপ্ত হবে, সেবিষয়ে তিনিই সর্বাধিক অবগত’ (ক্বাছাছ ২৮/৫৬)। হেদায়াতের এ  স্তরটি জিন-ইনসান, নবী-অলী ও ছোট-বড় সকল স্তরের নর-নারীর জন্য উন্মুক্ত। এটি হেদায়াতের সর্বোচ্চ স্তর। এখানে যিনি যত চেষ্টা করবেন, তিনি তত হেদায়াতপ্রাপ্ত হবেন। সেকারণ নবীদেরকেও আমল করতে হয় ও আল্লাহর নিকট হেদায়াত প্রার্থনা করা করতে হয়। আল্লাহ বলেন, وَالَّذِيْنَ جَاهَدُوْا فِيْنَا لَنَهْدِيَنَّهُمْ سُبُلَنَا وَإِنَّ اللهَ لَمَعَ الْمُحْسِنِيْنَ ‘যারা আমার পথে প্রচেষ্টা চালায়, আমরা তাদেরকে আমাদের পথসমূহ প্রদর্শন করে থাকি। নিশ্চয়ই আল্লাহ সৎকর্মশীলদের সঙ্গে থাকেন’ (আনকাবূত ২৯/৬৯)

হেদায়াতের এই তাওফীক প্রার্থনার জন্য সূরা ফাতিহায় সকল মুমিনের প্রতি নির্দেশ এসেছে, اهْدِنَا الصِّرَاطَ الْمُستَقِيْمَ ‘তুমি আমাদেরকে সরল পথ প্রদর্শন কর’ (ফাতিহা ৫)। সম্ভবতঃ একারণেই ইমাম-মুক্তাদী সকল মুছল্লীর জন্য সর্বাবস্থায় সূরায়ে ফাতিহা পাঠ ফরয করে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) বলেন, لاَ صَلاَةَ لِمَن لَّمْ يَقْرَأْ بِفَاتِحَةِ الْكِتَابِ ‘যে ব্যক্তি সূরা ফাতেহা পাঠ করে না, তার ছালাত সিদ্ধ হয় না’।[22]

(৪-৫) وَالَّذِيْ أَخْرَجَ الْمَرْعَى، فَجَعَلَهُ غُثَاءً أَحْوَى ‘যিনি তৃণাদি উৎপন্ন করেন’। ‘অতঃপর তাকে শুষ্ক-কালো বর্জ্যে পরিণত করেন’ ।

الْمَرْعَى অর্থ النبات والكلأ الأخضر উদ্ভিদ ও সবুজ ঘাস (কুরতুবী)غُثآء অর্থ ما يقذف به السيل على جوانب الوادى من الحشيش والنبات والقُماش ‘পানির স্রোত যেসব ঘাসপাতা, উদ্ভিদ ও ময়লা-আবর্জনা কিনারায় নিক্ষেপ করে- অর্থাৎ বর্জ্য। الأَحْوَى অর্থ الأسود أى النبات يضرب إلى السواد من شدة اليبس أو الاحتراق- ‘অতীব শুষ্ক হওয়ায় বা পুড়ে যাওয়ার কারণে সবুজ ঘাসপাতা যখন কৃষ্ণাভ রং ধারণ করে’ (কুরতুবী)

এখানে আল্লাহ তৃণাদি বলে সকল প্রকারের উদ্ভিদ ও শস্যাদি বুঝিয়েছেন। অতঃপর সেই সবুজ উদ্ভিদ ক্রমে হলুদ অতঃপর এক সময় শুকিয়ে কৃষ্ণাভ হয়ে আবর্জনার রূপ ধারণ করে। এর মাধ্যমে মানুষকে তার ভবিষ্যৎ করুণ পরিণতির ব্যাপারে সতর্ক করা হয়েছে যে, তার যৌবনের সৌন্দর্য ও সজীবতা, স্ফূর্তি ও চটুলতা আল্লাহর এক বিশেষ দান। এগুলি সব এক সময় নিঃশেষ হয়ে যাবে। মূল্যহীন আবর্জনা যেমন ঘরের বাইরে ফেলে দেওয়া হয়, তাকেও তার মৃত্যুর পরে তার সন্তান ও নিকটত্মীয়েরা অতি সাধের ঘর হ’তে কবরে ফেলে আসবে। যে মহান সত্তার অমোঘ নির্দেশে মানুষের জীবনে এই উত্থান-পতন ঘটে, হে মানুষ সেই সর্বশক্তিমান আল্লাহর বড়ত্ব ও পবিত্রতা ঘোষণা কর- সুবহানা রাবিবয়াল আ‘লা

(৬-৭) سَنُقْرِؤُكَ فَلاَ تَنْسَى، إِلاَّ مَا شَآءَ اللهُ إِنَّهُ يَعْلَمُ الْجَهْرَ وَمَا يَخْفَى ‘সত্বর আমরা তোমাকে পাঠ করাবো (কুরআন)। অতঃপর তুমি তা আর ভুলবে না’। ‘তবে আল্লাহ যা ইচ্ছা করেন তা ব্যতীত। নিশ্চয় তিনি জানেন প্রকাশ্য ও গোপন সকল বিষয়’।

অত্র আয়াতে ভবিষ্যদ্বাণী রয়েছে যে, আল্লাহপাক স্বীয় রাসূলকে কুরআন মুখস্থ করানোর গুরুদায়িত্ব নিজে গ্রহণ করেছেন এবং ওয়াদা করেছেন যে, তিনি এটা ভুলবেন না। এর মাধ্যমে তিনি রাসূল (ছাঃ)-কে আশ্বস্ত করেছেন। কেননা মানুষের স্বাভাবিক প্রবণতা হ’ল ভুলে যাওয়া। কিন্তু কুরআন এমন গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ, যা বর্তমান ও অনাগত মানবজাতির জন্য সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর পক্ষ হ’তে নাযিল হয়েছে। যার একমাত্র মাধ্যম হ’লেন শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)। অতএব উক্ত গ্রন্থের একটি বাক্য, শব্দ বা বর্ণ ভুলে যাবার উপায় নেই। তাই জিব্রীল (আঃ) চলে যাবার পর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বারবার আয়াতগুলি পাঠ করতেন। তখন তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে অত্র আয়াত নাযিল হয় (কুরতুবী)। নিঃসন্দেহে এটি ছিল তাঁর জন্য অন্যতম প্রধান মু‘জেযা।

অনুরূপ সান্ত্বনাসূচক আয়াত সূরা ক্বিয়ামাহ-তেও নাযিল হয়েছে। যেখানে বলা হয়েছে, لاَ تُحَرِّكْ بِهِ لِسَانَكَ لِتَعْجَلَ بِهِ،إِنَّ عَلَيْنَا جَمْعَهُ وَقُرْآنَهُ، فَإِذَا قَرَأْنَاهُ فَاتَّبِعْ قُرْآنَهُ- ‘তুমি তোমার জিহবাকে সঞ্চালিত করবে না দ্রুত অহী মুখস্থ করার জন্য’। ‘নিশ্চয় এর সংরক্ষণ ও পাঠ আমাদেরই দায়িত্বে’। ‘অতএব যখন আমরা তা পাঠ করি, তখন তুমি তার অনুসরণ কর’ (ক্বিয়ামাহ ৭৫/১৬-১৮)। সেযুগে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া ছিল না। তাই অহীর সংরক্ষণ করা হয়েছিল রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর এবং পরে ছাহাবায়ে কেরামের স্মৃতিতে। বিস্ময়কর স্মৃতিধর এই মহান ব্যক্তিগণের মাধ্যমেই জগদ্বাসী কুরআন ও হাদীছের অমূল্য ভান্ডার লাভে ধন্য হয়েছে।

ইমাম রাযী (রহঃ) বলেন, অত্র আয়াতে দু’টি মু‘জেযা রয়েছে। (১) রাসূল (ছাঃ) উম্মী ছিলেন। তিনি পড়তে বা লিখতে জানতেন না। অথচ কুরআন তিনি মুখস্ত রাখতেন কোনরূপ লিখন ও পঠন-পাঠন ছাড়াই। তিনি ভুলতেন না। (২) সূরাটি মাক্কী জীবনের প্রথম দিককার সূরা। অথচ অত্র আয়াতের মধ্যে গায়েবী খবর ও ভবিষ্যদ্বাণী রয়েছে, যা পরে বাস্তবায়িত হয়েছে (তাফসীর ক্বাসেমী)

আল্লাহ বলেন, إلاَّ ماَ شَاءَ اللهُ অর্থাৎ যেটুকু আল্লাহ উঠিয়ে নিতে চান বা স্মৃতি থেকে মুছে দিতে চান, সেটুকু ব্যতীত। যেমন কোন আদেশ রহিত করে নতুন আদেশ নাযিল হওয়া এবং এজন্য সংশ্লিষ্ট আয়াতটি রহিত করা ও রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর স্মৃতি হ’তে সেটা মুছে দেওয়া। এ বিষয়ে অন্যত্র আল্লাহ বলেন, مَا نَنْسَخْ مِنْ آيَةٍ أَوْ نُنْسِهَا نَأْتِ بِخَيْرٍ مِّنْهَا أَوْ مِثْلِهَا- ‘আমরা যখন কোন আয়াত রহিত করি অথবা তোমার স্মৃতি থেকে মুছে দেই, তখন তার চেয়ে উত্তম কিংবা তার অনুরূপ আয়াত আনয়ন করি’ (বাক্বারাহ ২/১০৬)

অবশ্য সাময়িকভাবে কোন আয়াত হঠাৎ বিস্মৃত হওয়া উক্ত প্রতিশ্রুতির পরিপন্থী নয়। যেমন আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, رَحِمَهُ اللهُ، لَقَدْ أَذْكَرَنِىْ كَذَا وَكَذَا آيَةً، كُنْتُ أَسْقَطْتُهُنَّ ‘অমুক ব্যক্তির উপর আল্লাহ রহম করুন! সে আমাকে অমুক অমুক আয়াত স্মরণ করিয়ে দিয়েছে, যা আমি ভুলে বাদ দিয়ে গিয়েছিলাম’।[23] ইবনু মাসঊদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,إِنَّمَا أَنَا بَشَرٌ مِثْلُكُمْ، أَنْسَىْ كَمَا تَنْسَوْنَ، فَإِذَا نَسِيْتُ فَذَكِّرُوْنِىْ  ‘নিশ্চয়ই আমি তোমাদেরই মত একজন মানুষ। আমি ভুলে যাই যেমন তোমরা ভুলে যাও। অতএব যখন আমি ভুলে যাই, তোমরা আমাকে স্মরণ করিয়ে দিয়ো’।[24]

আয়াতে বর্ণিত فَلاَ تَنْسَى -এর لاَ নিষেধাজ্ঞাসূচক নয়, বরং ‘খবর’ অর্থে এসেছে। অর্থাৎ তুমি আর ভুলবে না। তোমার হেফয অক্ষুন্ন থাকবে। বলা বাহুল্য, এটি ছিল রাসূল (ছাঃ)-এর উপরে তথা মানবজাতির উপরে আল্লাহর অপার অনুগ্রহ ও অসীম দয়ার এক অনন্য নিদর্শন। কেননা কুরআন ভুলে না যাওয়ার বিষয়টিতে রাসূল (ছাঃ)-এর নিজস্ব কোন ক্ষমতা ছিল না। বরং এটি ছিল আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ। যেমন তিনি বলেন, وَلَئِنْ شِئْنَا لَنَذْهَبَنَّ بِالَّذِيْ أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ ثُمَّ لاَ تَجِدُ لَكَ بِهِ عَلَيْنَا وَكِيْلاً ‘আমরা চাইলে তোমার প্রতি আমরা যা কিছু প্রত্যাদেশ করেছি, সব প্রত্যাহার করে নিতাম। আর তখন তুমি এ বিষয়ে আমাদের বিরুদ্ধে কোন তত্ত্বাবধায়ক পেতে না’ (ইসরা ১৭/৮৬)

(৭) إِنَّهُ يَعْلَمُ الْجَهْرَ وَمَا يَخْفَى অর্থাৎ প্রকাশ্য কুরআনের যা কিছু তোমার বুকে সংরক্ষিত রয়েছে এবং যা গোপনে সেখান থেকে মুছে যায় বা স্মৃতি বিভ্রম ঘটে, সবই আল্লাহ জানেন। এটাকে جملة معةرضة বা অপ্রাসঙ্গিক বাক্য হিসাবেও ব্যাখ্যা করা যায় মানুষের প্রতি হুঁশিয়ারী হিসাবে। অর্থাৎ তিনি মানুষের প্রকাশ্য ও গোপন সকল কথা ও কর্ম সম্পর্কে অবহিত। মানুষের প্রয়োজনীয় সবকিছু তিনি আগে থেকে জানেন এবং সেভাবেই অহী নাযিল হয় ও সংরক্ষিত হয়। অতঃপর তাকে তিনি অন্ধকার থেকে আলোর পথে নিয়ে আসেন।

(৮) وَنُيَسِّرُكَ لِلْيُسْرَى অর্থ نُوَفِّقُكَ لِلطَّرِيقَةِ الْيُسْرَى ‘আমরা তোমাকে সরল পথে চলার তাওফীক দান করব’ (ক্বাসেমী)। অর্থাৎ আমরা তোমার মন-মানসিকতাকে ইসলামী শরী‘আত প্রতিপালনের জন্য অনুগত করে দেব। উত্তম কথা ও কাজ তোমার স্বভাবে পরিণত হবে। নিঃসন্দেহে এটি ছিল রাসূল (ছাঃ)-এর প্রতি আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ। অত্র আয়াতে যার নিশ্চয়তা দান করা হয়েছে। এতে আরেকটি বিষয় প্রমাণিত হয় যে, ইসলামী বিধান সকল মানুষের জন্য সহজে পালনযোগ্য। ইসলামের পথ হ’ল সরল পথ। এ পথে কোন কাঠিন্য ও বক্রতা নেই। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, إِنَّ الدِّينَ يُسْرٌ، وَلَنْ يُشَادَّ الدِّينَ أَحَدٌ إِلاَّ غَلَبَهُ، فَسَدِّدُوا وَقَارِبُوا وَأَبْشِرُوا ‘নিশ্চয়ই এ দ্বীন সহজ। যে ব্যক্তি এতে কঠোরতা করবে, এটি তাকে পরাভূত করবে। অতএব তোমরা দৃঢ়ভাবে সৎকর্ম কর, মধ্যপন্থা অবলম্বন কর ও মানুষকে সুসংবাদ প্রদান কর’।[25] তিনি বলেন, بَشِّرُوْا وَلاَ تُنَفِّرُوْا وَيَسِّرُوْا وَلاَ تُعَسِّرُوْا ‘তোমরা মানুষকে সুসংবাদ শুনাও, তাড়িয়ে দিয়ো না। সহজ কর, কঠিন করো না’।[26] অন্য হাদীছে এসেছে, يَسِّرُوْا وَلاَ تُعَسِّرُوْا وَسَكِّنُوْا وَلاَ تُنَفِّرُوْا ‘তোমরা সহজ কর, কঠিন করো না। শান্ত কর, তাড়িয়ে দিও না’।[27]

আল্লাহ তাঁর এই অনুগ্রহ কেবল তাঁর রাসূল (ছাঃ)-এর জন্য খাছ করেননি; বরং অন্যান্য নেককার বান্দার জন্যও উন্মুক্ত করেছেন। যেমন আল্লাহ বলেন,فَأَمَّا مَنْ أَعْطَى وَاتَّقَى، وَصَدَّقَ بِالْحُسْنَى، فَسَنُيَسِّرُهُ لِلْيُسْرَى- ‘অতঃপর যে ব্যক্তি দান করে এবং আল্লাহভীরু হয় ও উত্তম কালেমাকে সত্য মনে করে, সত্বর তাকে আমরা সরল পথের জন্য সহজ করে দেব’ (লায়েল ৯২/৫-৭)। অর্থাৎ যে ব্যক্তি কালেমা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ পাঠ করবে, তথা খাঁটি তাওহীদে বিশ্বাসী হবে ও নেক আমল করবে, আমরা তার জন্য ইসলামের সরল পথ সহজ করে দেব।

এখানে সকল তাওহীদবাদী মুসলমানের জন্য আল্লাহর বিশেষ রহমতকে উদার করে দেয়া হয়েছে। আর একারণেই দেখা যায় আরবের অন্ধকার যুগের লোকেরা স্বচ্ছ হৃদয়ে কালেমা পাঠ করার সাথে সাথে তাদের জীবনের মোড় ঘুরে গেছে। অন্ধকারের মানুষগুলি কেবল আলোর পথে আসেনি, বরং বিশ্বসেরা মানুষে পরিণত হয়েছে। আল্লাহর এই রহমত সকল যুগে তাঁর নেককার বান্দাদের জন্য উন্মুক্ত থাকবে ইনশাআল্লাহ। অন্য হাদীছে এসেছে, اِعْمَلُوا فَكُلٌّ مُيَسَّرٌ لِمَا خُلِقَ لَهُ ‘তোমরা কাজ করে যাও। কেননা প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য ঐ কাজ সহজ হবে, যে জন্য তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে’।[28] এতে বুঝা যায় যে, জান্নাতের জন্য সৃষ্ট বান্দারা ঐকাজ সহজে করবে, যে কাজে জান্নাত পাওয়া যাবে। পক্ষান্তরে জাহান্নামের জন্য সৃষ্ট লোকেরা এর বিপরীত আচরণ করবে।

অত্র আয়াতে রাসূল (ছাঃ)-কে আশ্বস্ত করা হয়েছে যে, ইসলামী শরী‘আত তোমার জন্য সহজ করা হবে, যা তোমার স্বভাবধর্মে পরিণত হবে। ইসলাম বিরোধী কোন কথা বা কাজ তোমার দ্বারা সম্পাদিত হবে না। এক সময় হাদীছ লেখক তরুণ ছাহাবী হযরত আব্দুল্লাহ বিন আমর ইবনুল আছ (রাঃ)-কে কুরায়েশ নেতাদের কেউ কেউ বলেন যে, রাসূল (ছাঃ) অনেক সময় রাগে বা আবেগে অনেক কথা বলেন। অতএব তুমি তাঁর সব কথা লিখো না। বরং ঠান্ডা মাথায় যখন কথা বলেন, তখন সেটা লিখো’। তখন তিনি রাসূল (ছাঃ)-কে বিষয়টি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে রাসূল (ছাঃ) বললেন, أُكْتُبْ وَالَّذِى نَفْسِى بِيَدِهِ مَا خَرَجَ مِنِّى إِلاَّ حَقٌّ وَأَشَارَ إِلَى فَمِهِ ‘তুমি লেখ। যার হাতে আমার জীবন তার কসম করে বলছি, আমার থেকে সত্য ব্যতীত কিছুই বের হয় না’- এ সময় তিনি নিজের মুখের দিকে আঙ্গুলের ইশারা করেন’।[29]

বস্ত্ততঃ রাসূল (ছাঃ)-এর ব্যক্তিসত্তাকে হক কবুলের জন্য সহজ করে দেওয়া হয়েছে এবং হক-এর জন্য প্রস্ত্তত করা হয়েছে। আর এজন্যেই তিনি হ’তে পেরেছেন পৃথিবীব্যাপী সকল আল্লাহভীরু মানুষের জন্য উত্তম নমুনা। আল্লাহ বলেন,لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِيْ رَسُوْلِ اللهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ لِّمَنْ كَانَ يَرْجُوْ اللهَ وَالْيَوْمَ الْآخِرَ وَذَكَرَ اللهَ كَثِيْراً- ‘যারা আল্লাহ ও আখেরাতকে কামনা করে এবং আল্লাহকে অধিকহারে স্মরণ করে, তাদের জন্য আল্লাহর রাসূলের মধ্যে রয়েছে উত্তম নমুনা’ (আহযাব ৩২/২১)

(৯) فَذَكِّرْ إِن نَّفَعَتِ الذِّكْرَى ‘অতএব তুমি উপদেশ দাও যদি উপদেশ ফলপ্রসূ হয়’।

পূর্ববর্তী আয়াতসমূহে নবুঅতের গুরুদায়িত্ব পালনে আল্লাহ প্রদত্ত সুবিধাদি বর্ণনা করার পর অত্র আয়াতে রাসূল (ছাঃ)-কে নবুঅতের প্রধান কর্তব্য জনগণের প্রতি উপদেশ প্রদানের আদেশ দিয়ে আল্লাহ বলেন, فَذَكِّرْ ‘অতএব তুমি উপদেশ দাও’। إِنْ نَّفَعَتِ الذِّكْرَى ‘যদি উপদেশ ফলপ্রসূ হয়’। إِنْ এসেছে قَدْ অর্থে, شرطية অর্থে নয়। অর্থাৎ এখানে কথাটি শর্ত হিসাবে বলা হয়নি। বরং আদেশকে যোরদার করার উদ্দেশ্যে বলা হয়েছে। যেমন বলা হয়, যদি তুমি মানুষ হও, তবে একাজ তোমাকে করতে হবে। অর্থাৎ একাজ তোমাকে করতেই হবে। অনুরূপভাবে এখানে বলা হয়েছে, তোমাকে উপদেশ দিতেই হবে এবং তা নিশ্চিতভাবে ফলপ্রসূ হবে। যেমন অন্যত্র আল্লাহ বলেন, وَذَكِّرْ فَإِنَّ الذِّكْرَى تَنْفَعُ الْمُؤْمِنِيْنَ ‘তুমি উপদেশ দাও। কেননা উপদেশ মুমিনদের উপকার করে’ (যারিয়াত ৫১/৫৫)। বস্ত্ততঃ রাসূল (ছাঃ)-এর দাওয়াতেই মক্কা-মদীনার লোকেরা ইসলাম কবুল করেছিলেন এবং পরবর্তীতে ইসলামের জন্য জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। যারা মনে করেন, তরবাবির জোরে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং এযুগে একমাত্র অস্ত্রের জোরে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হবে, তারা আয়াতটি অনুধাবন করুন!

 إِنْযদি شرطية ধরা হয়, তাহ’লে ঐসব লোকদের নিন্দা করা বুঝাবে, যারা দাওয়াত থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। অর্থাৎ বলা হচ্ছে যে, কাফের-মুনাফিক ও ফাসিক নেতাদের প্রতি উপদেশ ফলপ্রসূ হবেনা। সেক্ষেত্রে তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার হুকুম রয়েছে। যেমন আল্লাহ বলেন, وَإِذَا رَأَيْتَ الَّذِيْنَ يَخُوْضُوْنَ فِيْ آيَاتِنَا فَأَعْرِضْ عَنْهُمْ حَتَّى يَخُوْضُواْ فِيْ حَدِيْثٍ غَيْرِهِ وَإِمَّا يُنْسِيَنَّكَ الشَّيْطَانُ فَلاَ تَقْعُدْ بَعْدَ الذِّكْرَى مَعَ الْقَوْمِ الظَّالِمِيْنَ،... وَذَرِ الَّذِيْنَ اتَّخَذُواْ دِيْنَهُمْ لَعِباً وَّلَهْواً وَغَرَّتْهُمُ الْحَيَاةُ الدُّنْيَا.. (الأنعام ৬৮، ৭০)-

‘আর যখন তুমি দেখ যে, তারা আমাদের আয়াতসমূহে ছিদ্রান্বেষণ করছে, তখন তাদের কাছ থেকে সরে যাও, যে পর্যন্ত না তারা অন্য কথায় প্রবৃত্ত হয়। আর যদি শয়তান তোমাকে ভুলিয়ে দেয়, তবে স্মরণ হওয়ার পর যালেমদের সাথে আর বসবে না’। ... ‘আর তুমি তাদেরকে পরিত্যাগ কর যারা নিজেদের ধর্মকে খেল-তামাশা মনে করেছে এবং পার্থিব জীবন তাদেরকে ধোঁকায় ফেলে রেখেছে’.. (আন‘আম ৬/৬৮,৭০)

এতে বুঝা যায় যে, স্থান-কাল-পাত্র ভেদে উপদেশ দান কখনো ফরয, কখনো মুস্তাহাব ও কখনো হারাম হয়। তবে সাধারণ নির্দেশ হ’ল সকলকে উপদেশ দেওয়া। কেননা রাসূল (ছাঃ) বলেন, الدِّينُ النَّصِيحَةُ ‘দ্বীন হ’ল নছীহত’।[30] এক্ষণে উপদেশ-পরবর্তী লোকদের আল্লাহ দু’ভাগে ভাগ করে বলেন,

(১০) سَيَذَّكَّرُ مَنْ يَّخْشَى ‘ সত্বর উপদেশ গ্রহণ করবে, যে ব্যক্তি ভয় করে’। অর্থাৎ প্রমাণ নাযিল হওয়ার পরে এবং দলীল প্রকাশিত হওয়ার পরে যারা তা অস্বীকার ও অগ্রাহ্য করার পরিণামে আল্লাহর শাস্তির ভয় করে, তারা সত্বর উপদেশ গ্রহণ করবে। এতে বুঝা যায় যে, আল্লাহভীরুতার গুণটি মানুষের ফিৎরাত বা স্বভাবজাত বিষয়। প্রতিটি মানুষের অবচেতন মনে আল্লাহকে স্বীকার করার ও তাঁর আদেশ পালন করার যোগ্যতা রয়েছে। যেমন অন্যত্র বলা হয়েছে, فِطْرَةَ اللهِ الَّتِيْ فَطَرَ النَّاسَ عَلَيْهَا لاَ تَبْدِيْلَ لِخَلْقِ اللهِ ‘আল্লাহ প্রদত্ত ফিৎরাত (বা যোগ্যতা) সেটাই, যার উপরে তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। যার কোন পরিবর্তন নেই’ (রূম ৩০/৩০)। হাদীছে এসেছে, كُلُّ مَوْلُوْدٍ يُولَدُ عَلَى الْفِطْرَةِ ، فَأَبَوَاهُ يُهَوِّدَانِهِ أَوْ يُنَصِّرَانِهِ أَوْ يُمَجِّسَانِهِ- ‘প্রত্যেক মানবশিশু ফিৎরাতের উপরে জন্মগ্রহণ করে। অতঃপর তার পিতা-মাতা তাকে ইহুদী, নাছারা বা মজূসী বানায়’।[31] অতঃপর প্রিয় বান্দাদের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করতে গিয়ে আল্লাহ বলেন, وَالَّذِينَ إِذَا ذُكِّرُوا بِآيَاتِ رَبِّهِمْ لَمْ يَخِرُّوا عَلَيْهَا صُمًّا وَعُمْيَانًا ‘যারা তাদের প্রতিপালকের আয়াতসমূহের মাধ্যমে উপদেশ দিলে অন্ধ ও বধির সদৃশ আচরণ করে না’ (ফুরক্বান ২৫/৭৩)। কিন্তু হতভাগ্য যারা তারা শয়তানের কুহকে পড়ে নিজের স্বভাবর্ধমের বিরুদ্ধে গিয়ে আল্লাহকে অস্বীকার করে ও তাঁর অবাধ্যতা করে। যেমন পরবর্তী আয়াতে আল্লাহ বলেন।-

(১১) وَيَتَجَنَّبُهَا الْأَشْقَى ‘আর তা উপেক্ষা করবে যে নিতান্ত হতভাগা’। বিষয়টি আল্লাহর ইলমের অন্তর্ভুক্ত। কেননা কে হতভাগ্য, আর কে সৌভাগ্যবান সেটা মানুষের পক্ষে বলা সম্ভব নয়। তবে এখানে হতভাগ্যদের লক্ষণ বলে দেওয়া হয়েছে যে, সে ব্যক্তি কুরআন ও হাদীছের উপদেশ উপেক্ষা করবে ও স্বেচ্ছাচারীসূলভ আচরণ করবে। আল্লাহ বলেন, فَأَمَّا الَّذِينَ شَقُوا فَفِي النَّارِ ‘অতঃপর যারা হতভাগ্য হবে, তারা জাহান্নামে থাকবে...’ (হূদ ১১/১০৬)وَأَمَّا الَّذِيْنَ سُعِدُوا فَفِي الْجَنَّةِ ‘পক্ষান্তরে যারা সৌভাগ্যবান হবে, তারা জান্নাতে থাকবে চিরকাল...’ (হূদ ১১/১০৮)

(১২) الَّذِيْ يَصْلَى النَّارَ الْكُبْرَى ‘যে প্রবেশ করবে মহা অগ্নিতে’ অর্থাৎ জাহান্নামের বিশাল অগ্নিকুন্ডে। হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেছেন, نَارُكُمْ جُزْءٌ مِنْ سَبْعِيْنَ جُزْءًا مِنْ نَارِ جَهَنَّمَ ‘তোমাদের এই আগুন জাহান্নামের আগুনের ৭০ ভাগের এক ভাগ মাত্র’।[32] অর্থাৎ দুনিয়ার আগুনের চাইতে ৬৯ গুণ বেশী উত্তাপের অধিকারী এবং সে কারণে এখানে জাহান্নামের আগুনকে (النار الكبرى) বা ‘মহা অগ্নি’ বলা হয়েছে। এখানে الْكُبْرَى অর্থ العُظْمَى أَلَمًا وَعَذَابًا ‘যন্ত্রণা ও শাস্তির দিক দিয়ে বড়’। হাসান বাছরী বলেন, النار الكبرى نار جهنم والصغرى نار الدنيا ‘মহা অগ্নি হ’ল জাহান্নামের আগুন এবং ছোট আগুন হ’ল দুনিয়ার আগুন’ (কুরতুবী)। নিঃসন্দেহে জাহান্নামের আগুনের তাপ দুনিয়ার আগুনের চাইতে বহুগুণ বেশী এবং জাহান্নামের শাস্তি দুনিয়ার সকল প্রকার শাস্তির চাইতে যন্ত্রণাদায়ক ও মর্মন্তুদ।

(১৩) ثُمَّ لاَ يَمُوْتُ فِيْهَا وَلاَ يَحْيَى ‘অতঃপর সেখানে সে মরবেও না, বাঁচবেও না’। অর্থ لا يهلك فيستريح، ولا يحيى حياة تنفعه ‘সে মরবে না যাতে স্বস্তি পায় এবং বাঁচবে না যাতে উপকৃত হয়’। বরং সেখানে তার জন্য কেবল কষ্ট আর কষ্ট। কঠিন বিপদাপন্ন ব্যক্তিকে আরবরা বলে থাকে لا هو حى ولا ميت ‘সে না জীবিত, না মৃত’। তাদের পরিচিত ভাষাতেই আল্লাহ এখানে জাহান্নামীদের শাস্তির বর্ণনা দিয়েছেন। আয়াতের শুরুতে ثم এসেছে শাস্তির তারতম্য বুঝানোর জন্য। যাতে বলে দেওয়া হয়েছে যে, জাহান্নামে প্রবেশের শাস্তির চাইতে সেখানে স্থায়ী হওয়ার শাস্তি আরও ভয়ংকর (ক্বাসেমী)। আল্লাহ বলেন, ‘সেদিন জাহান্নামীরা তাদের দাররক্ষী (خازن) ‘মালেক’ ফেরেশতাকে চিৎকার দিয়ে ডেকে বলবে,وَنَادَوْا يَا مَالِكُ لِيَقْضِ عَلَيْنَا رَبُّكَ قَالَ إِنَّكُمْ مَاكِثُونَ- لَقَدْ جِئْنَاكُمْ بِالْحَقِّ وَلَكِنَّ أَكْثَرَكُمْ لِلْحَقِّ كَارِهُونَ ‘হে মালেক! (এর চাইতে বরং) তোমার প্রতিপালক আমাদের মেরে ফেলে দিন। জবাবে সে বলবে, তোমরা তো এখানেই অবস্থান করবে’। ‘(আল্লাহ বলবেন,) আমরা তো তোমাদের নিকট সত্য পৌঁছে দিয়েছিলাম। কিন্তু তোমাদের অধিকাংশ ছিলে সত্যকে অপসন্দকারী’ (যুখরুফ ৪৩/৭৭-৭৮)। তাদের শাস্তি বিষয়ে আল্লাহ বলেন, كُلَّمَا نَضِجَتْ جُلُوْدُهُمْ بَدَّلْنَاهُمْ جُلُوْداً غَيْرَهَا لِيَذُوْقُوْا الْعَذَابَ ‘যখন তাদের চামড়াগুলো দগ্ধ হয়ে যাবে, তখন আমরা তা পাল্টে দেব অন্য চামড়া দিয়ে, যাতে তারা শাস্তির স্বাদ আস্বাদন করতে পারে’ (নিসা ৪/৫৬)। তিনি বলেন, لاَ يُقْضَى عَلَيْهِمْ فَيَمُوتُوْا وَلاَ يُخَفَّفُ عَنْهُم مِّنْ عَذَابِهَا كَذَلِكَ نَجْزِيْ كُلَّ كَفُوْرٍ ‘তাদেরকে মৃত্যুর আদেশ দেওয়া হবে না যে তারা মরে যাবে এবং তাদের থেকে শাস্তিও লাঘব করা হবে না। এভাবেই আমরা প্রত্যেক অকৃতজ্ঞকে শাস্তি দিয়ে থাকি’ (ফাত্বির ৩৫/৩৬)

তবে পাপের স্তরভেদের কারণে জাহান্নামে শাস্তির স্তরভেদ রয়েছে। আয়াতে বর্ণিত اَلْأَشْقَى অর্থাৎ ‘সর্বাধিক হতভাগা’ বলে সেদিকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে। তাদের জন্য রয়েছে মহাঅগ্নি। তাহ’লে কম পাপীদের জন্য রয়েছে কম অগ্নি। হাদীছেও এ বিষয়ে ইঙ্গিত রয়েছে। যেমন রাসূল (ছাঃ) বলেন, জাহান্নামীদের মধ্যে সবচাইতে হালকা আযাব হবে আবু তালিবের। তার দু’পায়ে দু’টি আগুনের জুতা পরানো হবে। তাতেই তার মাথার মগয ফুটতে থাকবে।[33] তিনি আরও বলেন, জাহান্নামীদের উপর আগুন কারু পায়ের টাখনু পর্যন্ত, কারু হাঁটু পর্যন্ত, কারু কোমর পর্যন্ত ও কারু কাঁধ পর্যন্ত পৌঁছবে’।[34] অতএব যার পাপ যত বেশী তার অগ্নি-উত্তাপ তত বেশী হবে। তাছাড়া অনেককে আল্লাহ শাস্তি শেষে জান্নাতে পাঠাবেন। যেমন আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,

وَإِنَّ أَهْلَ النَّارِ الَّذِينَ يُرِيدُ اللهُ عَزَّ وَجَلَّ إِخْرَاجَهُمْ يُمِيتُهُمْ فِيهَا إِمَاتَةً حَتَّى يَصِيرُوْا فَحْماً ثُمَّ يُخْرَجُوْنَ ضَبَائِرَ فَيُلْقَوْنَ عَلَى أَنْهَارِ الْجَنَّةِ أَوْ يُرَشُّ عَلَيْهِمْ مِنْ أَنْهَارِ الْجَنَّةِ فَيَنْبُتُوْنَ كَمَا تَنْبُتُ الْحِبَّةُ فِى حَمِيْلِ السَّيْلِ-

‘আল্লাহ যাদেরকে জাহান্নাম থেকে বের করে জান্নাতে নেবার ইচ্ছা করবেন, তাদেরকে সেখানে মৃত্যু দান করবেন এবং তারা পোড়া কয়লার মত হয়ে যাবে। (অতঃপর তাদের জন্য সুফারিশ করার অনুমতি দেওয়া হবে’ -মুসলিম)। অতঃপর তাদের বের করা হবে দলে দলে। অতঃপর তাদের জান্নাতের নদীতে ফেলে দেওয়া হবে। অথবা তাদের উপর উক্ত পানি ছিটিয়ে দেওয়া হবে। অতঃপর তারা শস্যদানা হ’তে উদ্গত অংকুরের মত সুন্দর দেহ প্রাপ্ত হবে। অতঃপর জান্নাতে প্রবেশ করবে’।[35]

(১৪) قَدْ أَفْلَحَ مَنْ تَزَكَّى ‘নিশ্চয়ই সফল হয় সেই ব্যক্তি, যে পরিশুদ্ধ হয়’। অর্থাৎ দুনিয়া ও আখেরাতে সফলকাম হয় সেই ব্যক্তি, যে দুনিয়াতে পরিশুদ্ধি অর্জন করে। এই শুদ্ধিতা হ’ল প্রথমে হৃদয়জগতকে আল্লাহর সঙ্গে অন্য কাউকে শরীক করা হ’তে পরিশুদ্ধ করা ও নিজের আমলকে বিদ‘আত হ’তে পবিত্র করা। সঙ্গে সঙ্গে হিংসা-বিদ্বেষ, রিয়া ও অহংকারের মত ধ্বংসকারী রোগসমূহ হ’তে হৃদয়কে পরিচ্ছন্ন করা এবং পাপ থেকে নিজেকে বিরত রাখা ও সর্বদা আল্লাহর হুকুম মান্য করা। আর্থিক শুদ্ধিতা অর্জনের জন্য আয়-উপার্জনকে হালাল করা ও যাবতীয় হারাম থেকে বেঁচে থাকা এবং যাকাত, ওশর, ছাদাক্বাতুল ফিৎর ও অন্যান্য নফল ছাদাক্বাসমূহ আদায়ের মাধ্যমে নিজেকে কৃপণতার কালিমা হ’তে পরিশুদ্ধ করা বুঝায়। অর্থাৎ বিশ্বাসে ও কর্মে, কথায় ও আচরণে শুদ্ধাচারী হওয়া।

(১৫) وَذَكَرَ اسْمَ رَبِّهِ فَصَلَّى ‘এবং তার প্রভুর নাম স্মরণ করে, অতঃপর ছালাত আদায় করে’। অত্র আয়াত দ্বারা আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ), আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রাঃ) এবং আবুল ‘আলিয়াহ প্রমুখ প্রথমে ছাদাক্বাতুল ফিৎর আদায় করা, অতঃপর ঈদুল ফিৎরের ছালাত আদায় করার অর্থ নিয়েছেন। কোন কোন বিদ্বান এই আয়াত দ্বারা ছালাত শুরুর প্রাক্কালে তাকবীরে তাহরীমা ফরয হওয়ার দলীল নিয়েছেন (কুরতুবী)। খলীফা ওমর বিন আব্দুল আযীয জনগণকে ছাদাক্বাতুল ফিৎর আদায়ের নির্দেশ দিতেন এবং উপরোক্ত আয়াত দু’টি তেলাওয়াত করতেন (ইবনু কাছীর)

তবে এটা ঠিক যে, অত্র আয়াত ছাদাক্বাতুল ফিৎর ও ঈদুল ফিৎরের ছালাত বিষয়ে নাযিল হয়নি। কেননা এটি মাক্কী সূরা। আর মক্কাতে ঈদও ছিল না, ছাদাক্বাতুল ফিৎরও ছিল না। বরং রামাযানের ফরয ছিয়াম, যাকাত ও ঈদ মদীনাতে ২য় হিজরী সনে নির্দেশিত হয়। কুশায়রী বলেন, এটা মোটেই গৌণ নয় যে, এখানে ঐসব লোকদের আগাম প্রশংসা করা হয়েছে, যারা পরবর্তীতে যাকাতুল ফিৎর ও ঈদের ছালাত আদায় করবে। আবুল ‘আলিয়াহ বলেন, মদীনাবাসীগণ যাকাতুল ফিৎরকে সর্বোত্তম ছাদাক্বা মনে করতেন’ (কুরতুবী)। যদি বলা হয় যে, সাধারণভাবে কুরআনে সর্বত্র ছালাতকে যাকাতের আগে আনা হয়। যেমন وَأَقِيْمُوا الصَّلاَةَ وَآتُوا الزَّكَاةَ ‘তোমরা ছালাত কায়েম কর ও যাকাত আদায় কর’ (বাক্বারাহ ২/৪৩ প্রভৃতি)। কিন্তু এখানে যাকাতকে আগে আনা হ’ল কেন? জবাবে বলা চলে যে, এরূপ আগ-পিছ কোন দোষের নয়। এতদ্ব্যতীত এর মাধ্যমে যাকাত ও ছাদাক্বার গুরুত্ব বুঝানো হয়েছে। যেমন আল্লাহ অন্যত্র বলেছেন, وَأَنْفِقُوْا فِيْ سَبِيْلِ اللهِ وَلاَ تُلْقُوْا بِأَيْدِيْكُمْ إِلَى التَّهْلُكَةِ وَأَحْسِنُوْا إِنَّ اللهَ يُحِبُّ الْمُحْسِنِيْنَ ‘তোমরা আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় কর এবং নিজেদেরকে ধ্বংসে নিক্ষেপ করো না। আর তোমরা সৎকর্ম কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ সৎকর্মশীলদের ভালবাসেন’ (বাক্বারাহ ২/১৯৫)

মোদ্দাকথা আয়াত দু’টির প্রকাশ্য অর্থ এই যে, সেই ব্যক্তি সফলকাম হবে, যে ব্যক্তি পরিশুদ্ধি অর্জন করবে। যা শিরক ও নিফাক হ’তে আত্মার পরিশুদ্ধি এবং ফরয যাকাত ও নফল ছাদাক্বাসমূহ আদায়ের মাধ্যমে মালের পরিশুদ্ধি সবকিছুকে শামিল করে। অতঃপর বিশুদ্ধ অন্তরে আল্লাহর নাম স্মরণ করবে এবং ছালাত আদায় করবে। যেমন আল্লাহ বলেন, وَأَقِمِ الصَّلاَةَ لِذِكْرِيْ ‘তুমি ছালাত কায়েম কর আমাকে স্মরণ করার জন্য’ (ত্বোয়াহা ২০/১৪)। এই ছালাত ফরয, সুন্নাত, নফল সকল প্রকার ছালাতকে শামিল করে। যা স্রেফ আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে নিবেদিত হবে। কোনরূপ রিয়া বা শ্রুতির উদ্দেশ্যে নয়।

(১৬) بَلْ تُؤْثِرُوْنَ الْحَيَاةَ الدُّنْيَا ‘বস্ত্ততঃ তোমরা দুনিয়াবী জীবনকে অগ্রাধিকার দিয়ে থাক’। অর্থ بل ةقدمون الدنيا على أمر الآخرة ‘বরং তোমরা আখেরাতের কর্ম সমূহের উপর দুনিয়াকে অগ্রাধিকার দিয়ে থাক’। الدُّنْيَا অর্থ ‘বর্তমান জীবন’। মাদ্দাহ الدُّنُوُّ অর্থ ‘নিকটবর্তী’। الآخِرَةُ অর্থ ‘পরকালীন জগত’। মাদ্দাহ الآخِرُ ‘পশ্চাদ্বর্তী’। দুনিয়াটা মানুষের নাগালের মধ্যে। কিন্তু আখেরাত মানুষের নাগালের বাইরে, তার মৃত্যুর পরে চোখের অগোচরে। তাই মানুষ তাকে অনেক দূরের ভাবে। অথচ তা যে কোন সময়ে তার জীবনে এসে যেতে পারে। আল্লাহ বলেন, إِنَّهُمْ يَرَوْنَهُ بَعِيدًا، وَنَرَاهُ قَرِيبًا ‘তারা এটাকে দূরে মনে করে’। ‘কিন্তু আমরা একে নিকটে দেখি’ (মা‘আরিজ ৭০/৬-৭)। বস্ত্ততঃ জ্ঞানী ব্যক্তিগণ সর্বদা মৃত্যু ও আখেরাতকে সামনে রেখেই কাজ করে থাকে।

আলোচ্য আয়াতে আল্লাহ ইহকালীন জীবনের প্রতি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি আলোচনা করেছেন। আয়াতটি ধিক্কার ও তিরষ্কারমূলক। بَلْ এসেছে পূর্বের প্রসঙ্গ থেকে পরবর্তী প্রসঙ্গে যাওয়ার জন্য (للإضراب الانتقالى)। অর্থাৎ সফলকাম লোকদের প্রসঙ্গ ছেড়ে এবার হতভাগ্য লোকদের উদ্দেশ্যে আল্লাহ বলছেন, তোমাদের জাহান্নামী হবার কারণ এই যে, তোমরা দুনিয়াবী জীবনকে পরকালীন জীবনের উপরে অগ্রাধিকার দিয়েছ। আর সেকারণে তোমরা ক্ষণস্থায়ী দুনিয়াবী স্বার্থ হাছিলে মত্ত থাকো। অথচ আখেরাতের চিরস্থায়ী স্বার্থ উপেক্ষা কর।

ইবনু জারীর আরফাজা ছাক্বাফী হ’তে বর্ণনা করেন যে, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু মাসউদ (রাঃ) অত্র সূরাটির শুরু থেকে পাঠ করে এখানে এসে থেমে যান এবং বলেন, أتدرون لم آثرنا الحياة الدنيا على الآخرة؟ ‘তোমরা কি জানো কেন আমরা দুনিয়াবী জীবনকে আখেরাতের উপরে অগ্রাধিকার দিয়ে থাকি? কেননা দুনিয়া তার খাদ্য-পানীয় ও অন্যান্য লোভনীয় সম্পদরাজি নিয়ে আমাদের সামনে হাযির থাকে এবং যা আমরা দ্রুত হাতের নাগালের মধ্যে পাই। فأخذنا العاجل و تركنا الآجل ‘ফলে আমরা নগদটা গ্রহণ করি, আর বাকীটা পরিত্যাগ করি’।[36]

অনুরূপ এক বর্ণনায় হযরত আনাস (রাঃ) বলেন, আমরা একদা হযরত আবু মূসা আশ‘আরী (রাঃ)-এর সঙ্গে ছিলাম। তিনি সবাইকে বললেন, ةَعَالِ نذكر ربنا ساعة ‘এসো কিছুক্ষণ আমরা আমাদের পালনকর্তাকে স্মরণ করি’। অতঃপর তিনি বললেন, হে আনাস! তুমি কি জানো مَا ثَبَرَ النَّاسَ কোন বস্ত্ত মানুষকে (আখেরাত থেকে) আটকে রাখে? আমি বললাম, দুনিয়া, শয়তান ও প্রবৃত্তি। তিনি বললেন, না। বরং দুনিয়া নগদ পাওয়া যায় এবং আখেরাত অদৃশ্যে থাকে। أما والله لو عاينوها ماعَدَلوا ولا ميَّلوا ‘আল্লাহর কসম! যদি তারা আখেরাতকে চোখের সামনে দেখতে পেত, তাহ’লে তারা পিঠ ফিরাতো না বা ইতস্তত করত না (কুরতুবী) । বস্ত্ততঃ দুনিয়ায় যত অশান্তির মূল কারণ হ’ল দুনিয়াপূজা এবং আখেরাতকে ভুলে থাকা। আল্লাহ বলেন,

(১৭) وَالْآخِرَةُ خَيْرٌ وَّأَبْقَى ‘অথচ আখেরাত হ’ল উত্তম ও চিরস্থায়ী’। অর্থ ثوابُ الله في الدار الآخرة خير من الدنيا وأَبْقَى ‘আখেরাতে আল্লাহ প্রদত্ত ছওয়াব দুনিয়ার চাইতে উত্তম ও চিরস্থায়ী (ইবনু কাছীর)।

আল্লাহ বলেন, لاَ يَمَسُّهُمْ فِيْهَا نَصَبٌ وَمَا هُمْ مِنْهَا بِمُخْرَجِيْنَ ‘সেখানে তাদের কোনরূপ বিষণ্ণতা স্পর্শ করবে না এবং তারা সেখান থেকে বহিষ্কৃতও হবে না’ (হিজর ১৫/৪৮)

ইবনু কাছীর বলেন, فَإِنَّ الدُّنْيَا دَنِيَّةٌ فَانِيَةٌ، وَالْآخِرَةَ شَرِيفَةٌ بَاقِيَةٌ، فَكَيْفَ يُؤْثِرُ عَاقِلٌ مَا يَفْنَى عَلَى مَا يَبْقَى ‘দুনিয়া হ’ল নিকৃষ্ট ও ধ্বংসশীল এবং আখেরাত হ’ল উৎকৃষ্ট ও চিরস্থায়ী। অতএব কিভাবে একজন জ্ঞানী মানুষ ধ্বংসশীল বস্ত্তকে চিরস্থায়ী বস্ত্তর উপর অগ্রাধিকার দিতে পারে’? কিভাবে ঐবস্ত্তকে গুরুত্ব দিতে পারে যা সত্বর বিলীন হয়ে যাবে। আর কিভাবে গুরুত্বহীন ভাবতে পারে চিরস্থায়ী নিবাসকে? (তাফসীর ইবনে কাছীর)। রাসূল (ছাঃ) বলেন,مَنْ طَلَبَ الدُّنْيَا أَضَرَّ بِالْآخِرَةِ، وَمَنْ طَلَبَ الْآخِرَةَ أَضَرَّ بِالدُّنْيَا، فَأَضِرُّوْا بِالْفَانِيْ لِلْبَاقِيْ ‘যে ব্যক্তি দুনিয়ার (ভোগ-বিলাস) অন্বেষণে লিপ্ত থাকে, আখেরাতকে সে ক্ষতিগ্রস্ত করে। আর যে ব্যক্তি আখেরাতের পাথেয় অন্বেষণে লিপ্ত থাকে, সে দুনিয়াকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। অতএব তোমরা চিরস্থায়ী আখেরাতের জন্য ক্ষণস্থায়ী দুনিয়াকে ক্ষতিগ্রস্ত কর।[37] আখেরাতের সুখ-সম্ভার দুনিয়ার চাইতে কত উত্তম সে বিষয়ে আল্লাহ বলেন, فَلاَ تَعْلَمُ نَفْسٌ مَّا أُخْفِيَ لَهُم مِّنْ قُرَّةِ أَعْيُنٍ جَزَاءً بِمَا كَانُوا يَعْمَلُوْنَ ‘কেউ জানে না তার কর্মের প্রতিদান হিসাবে কি কি চক্ষু শীতলকারী বস্ত্ত তাদের জন্য লুকিয়ে আছে’ (সাজদাহ ৩২/১৭)। রাসূল (ছাঃ) বলেন, আল্লাহ বলেন,أَعْدَدْتُ لِعِبَادِى الصَّالِحِيْنَ مَا لاَ عَيْنٌ رَأَتْ وَلاَ أُذُنٌ سَمِعَتْ وَلاَ خَطَرَ عَلَى قَلْبِ بَشَر ‘আমি আমার সৎকর্মশীল বান্দাদের জন্য এমন সুখ-সম্ভার প্রস্ত্তত করে রেখেছি, যা কোন চোখ কখনো দেখেনি, কোন কান কখনো শোনেনি এবং মানুষের অন্তর কখনো কল্পনা করেনি’।[38] রাসূল (ছাঃ) বলেন, مَوْضِعُ سَوْطٍ فِى الْجَنَّةِ خَيْرٌ مِنَ الدُّنْيَا وَمَا فِيْهَا ‘জান্নাতের একটি চাবুক রাখার স্থান দুনিয়া ও তার মধ্যেকার সবকিছু থেকে উত্তম’।[39] অতঃপর আখেরাতের দীর্ঘ ও চিরস্থায়ী জীবন দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী জীবনের তুলনায় কেমন, সে বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, مَا مَثَلُ الدُّنْيَا فِى الْآخِرَةِ إِلاَّ مَثَلُ مَا يَجْعَلُ أَحَدُكُمْ إِصْبَعَهُ فِى الْيَمِّ فَلْيَنْظُرْ بِمَ يَرْجِعُ- ‘আখেরাতের তুলনায় দুনিয়া অনুরূপ তুচ্ছ, যেরূপ তোমাদের কেউ সাগরে আঙ্গুল ডুবালে তাতে যৎসামান্য পানি উঠে আসে’।[40]

মালেক ইবনু দীনার বলেন, সোনার তৈরী দুনিয়া যদি ধ্বংসশীল হয়, আর ঝুপড়িসর্বস্ব আখেরাত যদি চিরস্থায়ী হয়, তাহ’লে ঐ ঝুপড়ীকে অগ্রাধিকার দেওয়াই ওয়াজিব হবে। পক্ষান্তরে যদি আখেরাত স্বর্ণ নির্মিত হয়, আর দুনিয়াটা ঝুপড়ি সদৃশ হয়, তখন কেমনটা হবে? (কুরতুবী)

মৃত্যুকে নিশ্চিত জেনেও মানুষ কিভাবে দুনিয়ার জন্য পাগলপরা হয়? কবর ও জাহান্নামের আযাবের কথা বিশ্বাস করেও মানুষ কিভাবে হাসি-খুশীতে মত্ত থাকে? বিলাসবহুল পাঁচতারা হোটেলের অস্থায়ী নিবাসের চাইতে কি নিজের মাটির ঘরের স্থায়ী নিবাস উত্তম ও অগ্রাধিকারযোগ্য নয়? অতএব দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী ঠিকানার উপরে পরকালের চিরস্থায়ী ঠিকানাকে অগ্রাধিকার দেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।

(১৮) إِنَّ هَذَا لَفِي الصُّحُفِ الْأُوْلَى ‘নিশ্চয় এটা লিপিবদ্ধ ছিল পূর্ববর্তী কিতাবসমূহে’। অর্থাৎ ثابت فيها معناه ‘সেখানে এর মর্মসমূহ মওজুদ রয়েছে’।

ইবনু কাছীর বলেন যে, قَدْ أَفْلَحَ مَنْ تَزَكَّى থেকে (১৪-১৭) বর্ণিত আয়াতসমূহের বক্তব্য হ’ল বিগত ইলাহী ধর্ম ও কিতাবসমূহের শিক্ষাসমূহের সারনির্যাস’। যা মানুষকে দুনিয়াবী লোভ-লালসার কলুষ-কালিমা হ’তে মুক্ত করে এবং আখেরাতের স্বচ্ছ গুণাবলীতে আলোকিত করে। অতঃপর তাকে দুনিয়া ও আখেরাতে সফলকাম ব্যক্তিত্বে পরিণত করে। আল্লাহ বলেন, এসব কথা ইবরাহীম ও মূসার কিতাব ও পুস্তিকাসমূহে পূর্বেই বর্ণিত হয়েছে।

(১৯) صُحُفِ إِبْرَاهِيْمَ وَمُوْسَى ‘ইবরাহীম ও মূসার কিতাবসমূহে’। বাক্যটি পূর্বের বাক্য হ’তে بدل হয়েছে। এর মাধ্যমে পূর্বের আয়াতের ব্যাখ্যা করা হয়েছে। সাথে সাথে ইবরাহীম ও মূসা (আঃ)-এর ছহীফার উচ্চ মর্যাদা তুলে ধরা হয়েছে’ (ক্বাসেমী)। এখানে الصُحُفُ বলতে الكةب السماوية الماضية ‘বিগত আসমানী কিতাবসমূহ’ বুঝানো হয়েছে। প্রসিদ্ধ চারটি কিতাবের বাইরেও পুস্তিকা সমূহ ছিল। সবগুলিকে এখানে الصُحُفُ অর্থাৎ ‘ছহীফাসমূহ’ বলা হয়েছে। ‘ছহীফা’ অর্থ, পুস্তিকা। সেইসব কিতাবে আলোচ্য সূরার মর্মসমূহ বর্ণিত হয়েছে, শব্দে শব্দে নয়। এখানে هَذَا -এর ‘উদ্দেশ্য’ (مرجع) কোন্টি, এবিষয়ে আবুল ‘আলিয়াহ বলেন, পুরা সূরাটি। ইবনু জারীর বলেন, قَدْ أَفْلَحَ থেকে শেষ পর্যন্ত। ইবনু কাছীর বলেন, এটাই সুন্দর ও শক্তিশালী (حسن قوى) (ইবনু কাছীর)

সারকথা :

আখেরাতের উপরে দুনিয়াকে অগ্রাধিকার দেওয়াই হ’ল পার্থিব জীবনে সকল অশান্তির মূল। বস্ত্ততঃ আল্লাহভীরু ও বিশুদ্ধ অন্তরের অধিকারী লোকেরাই কেবল দুনিয়া ও আখেরাতে সফলকাম হয়ে থাকে।


[1]. মুসলিম হা/৮৭৮; মিশকাত হা/৮৪০ ‘ছালাতে ক্বিরাআত’ অনুচ্ছেদ-১২।

[2]. বুখারী হা/৭০৫; মুসলিম হা/৪৬৫; বিস্তারিত আলোচনা দ্রষ্টব্য : সূরা ফজর, টীকা-২৫১।

[3]. বুখারী হা/৪৯৪১ ‘তাফসীর’ অধ্যায়।

[4]. তিরমিযী হা/৪৬২-৬৩; হাকেম ১/৩০৫; মিশকাত হা/১২৬৯ ‘বিতর’ অধ্যায়।

[5]. নাসাঈ হা/১৭০১, সনদ ছহীহ।

[6]. মুস্তাদরাক হাকেম ১/৩০৪ হা/১১৪০; বায়হাক্বী ৩/২৮।

[7]. দারাকুৎনী হা/১৬৩৪-৩৫, সনদ ছহীহ।

[8]. আহমাদ হা/২০৬৬; আবুদাঊদ হা/৮৮৩; মিশকাত হা/৮৫৯ ‘ছালাতে ক্বিরাআত’ অনুচ্ছেদ-১২।

[9]. আলোচনা দ্রষ্টব্য : ছালাতুর রাসূল (ছাঃ), ৪র্থ সংস্করণ পৃঃ ১৫১।

[10]. মুসলিম হা/২১৩৭; মিশকাত হা/২২৯৪ ‘দো‘আ সমূহ’ অধ্যায়, ৩ অনুচ্ছেদ।

[11]. বুখারী হা/৬৪০৫; মুসলিম হা/২৬৯১; মিশকাত হা/২২৯৬।

[12]. মুসলিম হা/২২৩, মিশকাত হা/২৮১।

[13]. দারেমী হা/৬৫৩ ‘তাহারৎ’ অধ্যায়, ২ অনুচ্ছেদ; আহমাদ হা/১৮৭৮১।

[14]. মুসলিম হা/১৪৮, মিশকাত হা/৫৫১৬; ঐ, শায়খ আলবানীর টীকা-১ দ্রষ্টব্য।

[15]. হাকেম, আহমাদ হা/১৩৮৬০, সনদ ছহীহ।

[16]. মুসলিম হা/৫৩৭ ‘মসজিদ সমূহ’ অধ্যায়; মালেক হা/২৮৭৫; আবুদাঊদ হা/৯৩০।

[17]. তিরমিযী, আবুদাঊদ, ইবনু মাজাহ হা/৮৮৮ মিশকাত হা/৮৮১ ‘রুকূ’ অনুচ্ছেদ।

[18]. মুসলিম হা/৪৮২, মিশকাত হা/৮৯৪,৮৭৩।

[19]. আহমাদ, তিরমিযী, আবুদাঊদ হা/১৪৭৯, নাসাঈ, ইবনু মাজাহ, মিশকাত হা/২২৩০।

[20]. তিরমিযী, আবুদাঊদ, মিশকাত হা/৮৮১।

[21]. মুসলিম হা/২৬৫৩, মিশকাত হা/৭৯।

[22]. বুখারী হা/৭৫৬, মুসলিম হা/৩৯৪, মিশকাত হা/৮২২।

[23]. বুখারী হা/২৬৫৫।

[24]. বুখারী হা/৪০১; মুসলিম হা/৫৭২।

[25]. বুখারী হা/৩৯, মিশকাত হা/১২৪৬ ‘কাজে মধ্যপন্থা অবলম্বন’ অনুচ্ছেদ।

[26]. বুখারী হা/৬৯, মুসলিম হা/১৭৩২; মিশকাত হা/৩৭২২ ‘নেতৃত্ব ও বিচার’ অধ্যায়।

[27]. বুখারী হা/৬১২৫, মুসলিম হা/১৭৩৪;, মিশকাত হা/৩৭২৩।

[28]. বুখারী হা/৪৯৪৯; মুসলিম হা/২৬৪৭; মিশকাত হা/৮৫।

[29]. মুস্তাদরাক হাকেম ১/১০৫-০৬, হা/৩৫৯, সনদ ছহীহ; আবুদাঊদ হা/৩৬৪৬; সিলসিলা ছহীহাহ হা/১৫৩২।

[30]. মুসলিম, মিশকাত হা/৪৯৬৬।

[31]. বুখারী হা/১৩৮৫; মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৯০।

[32]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৫৬৬৫ ‘জাহান্নাম ও তার অধিবাসীদের বর্ণনা’ অনুচ্ছেদ।

[33]. বুখারী হা/৬৫৬২; মিশকাত হা/৫৬৬৮।

[34]. মুসলিম হা/২৮৪৫; মিশকাত হা/৫৬৭১।

[35]. আহমাদ হা/১১১৬৭; মুসলিম হা/১৮৫ প্রভৃতি।

[36]. ত্বাবারাণী, মাজমা‘উয যাওয়ায়েদ হা/১৭৭৩৭, ইবনু জারীর ৩০/১০০; কুরতুবী, ইবনু কাছীর।

[37]. আহমাদ, মিশকাত হা/৫১৭৯; সিলসিলা ছহীহাহ হা/৩২৮৭।

[38]. বুখারী হা/৭৪৯৮, মুসলিম হা/২৮২৪ মিশকাত হা/৫৬১২ ‘জান্নাত ও জান্নাতবাসীদের বিবরণ’ অনুচ্ছেদ।

[39]. বুখারী হা/৩২৫০, মিশকাত হা/৫৬১৩।

[40]. মুসলিম হা/২৮৫৮, মিশকাত হা/৫১৫৬ ‘রিক্বাক্ব’ অধ্যায়।