ভূমিকা
মূর্তি পূজার সূচনাঃ মানবজাতির আদি পিতা আদম (আঃ) হ’তে দ্বিতীয় পিতা নূহ (আঃ)-এর মধ্যবর্তী সময়ে কিছু নেককার মানুষ খুবই জনপ্রিয়তা লাভ করেন। নূহ (আঃ)-এর সময়ে তাঁরা মৃত্যুবরণ করলে ইবলীস তাদের ভক্ত-অনুসারীদের প্ররোচনা দিল এই বলে যে, ঐসব নেককার লোকদের বসার স্থানে তোমরা তাদের মূর্তি স্থাপন কর এবং সেগুলিকে তাদের নামে নামকরণ কর। শয়তান তাদের যুক্তি দিল যে, যদি তোমরা মূর্তিগুলোকে সামনে রেখে ইবাদত কর, তাহ’লে তাদের স্মরণ করে আল্লাহর ইবাদতের প্রতি তোমাদের অধিক আগ্রহ সৃষ্টি হবে। তখন লোকেরা সেটা মেনে নিল। অতঃপর এই লোকেরা মৃত্যুবরণ করলে তাদের পরবর্তী বংশধরগণকে শয়তান কুমন্ত্রণা দিল এই বলে যে, তোমাদের বাপ-দাদারা এইসব মূর্তির পূজা করতেন এবং এদের অসীলায় বৃষ্টি প্রার্থনা করতেন ও তাতে বৃষ্টি হ’ত। একথা শুনে তারা আল্লাহকে বাদ দিয়ে সরাসরি মূর্তিপূজা শুরু করে দিল। অতঃপর এভাবেই মূর্তিপূজার সূচনা হয়। কুরআনে নূহের সময়কার ৫ জন পূজিত ব্যক্তির নাম এসেছে। যথাক্রমে অদ, সুওয়া‘, ইয়াগূছ, ইয়া‘ঊক্ব ও নাস্র (নূহ ৭১/২৩)। এদের মধ্যে ‘অদ’ ছিলেন পৃথিবীর প্রথম পূজিত ব্যক্তি যার মূর্তি বানানো হয় (ইবনু কাছীর) =(বুখারী হা/৪৯২০ ‘তাফসীর’ অধ্যায়; তাফসীর কুরতুবী, বাগাভী, ইবনু কাছীর, শাওকানী প্রভৃতি)।
অদৃশ্য বস্ত্তর চাইতে দৃশ্যমান বস্ত্ত মানব মনে দ্রুত প্রভাব বিস্তার করে। সেকারণ অদৃশ্য ব্যক্তি বা সত্তার কল্পনা থেকে মূর্তি ও ছবির প্রচলন ঘটেছে। অবশেষে মূর্তি বা ছবিই মূল হয়ে যায়। ব্যক্তি বা সত্তা অপাঙক্তেয় হয়। যার জন্য মূর্তিপূজায় মূর্তিই মুখ্য হয়, আল্লাহ গৌণ হয়ে যান। সেকারণ নূহ (আঃ) থেকে মুহাম্মাদ (ছাঃ) পর্যন্ত সকল নবী মূর্তি পূজাকে ‘শিরক’ বলেছেন এবং সর্বদা এর বিরুদ্ধে মানবজাতিকে সাবধান করেছেন। এমনকি নবীগণের পিতা ইবরাহীম (আঃ) তাঁর সন্তানদেরকে মূর্তিপূজা থেকে বাঁচানোর জন্য আল্লাহর নিকটে প্রার্থনা করে গেছেন (ইবরাহীম ১৪/৩৫)। কেননা ভক্তি ও ভালোবাসা হৃদয়ের বিষয়। বাহ্যিকতায় তা ক্ষুণ্ণ ও বিনষ্ট হয়। এক সময় মানুষ তার সৃষ্টিকর্তা আল্লাহকে ভুলে যায় ও তাঁর বিধানকে অগ্রাহ্য করে। আর মূর্তির পিছনে তার সময়, শ্রম ও অর্থ ব্যয় করে। অথচ সে ভাল করেই জানে যে, মূর্তির ভাল বা মন্দ কোন কিছুই করার ক্ষমতা নেই। কিন্তু শয়তানের ধোঁকায় পড়ে সে সর্বদা এর পিছেই লেগে থাকে।
পরবর্তীকালে মানুষ ছবি বানাতে শিখলে ছবি, প্রতিকৃতি, স্থিরচিত্র ইত্যাদি এখন মূর্তির স্থান দখল করেছে। মূল ব্যক্তির কল্পনায় এগুলি তৈরী করা হয়। একই নিয়তে সমাধি সৌধ, স্মৃতিসৌধ, মিনার, বেদী, স্তম্ভ ইত্যাদি নির্মাণ করা হয়। এগুলিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। এগুলির পূজা এবং কবরপূজা মূর্তিপূজারই নামান্তর। বিগত যুগের মুশরিকরা তাদের মূর্তিগুলি নিজ হাতে বানাতো, সেগুলিকে রক্ষা করত, লালন করত, সম্মান করত, সেখানে ফুল ও নৈবেদ্য পেশ করত, কেউ কেউ এর অসীলায় আল্লাহর নৈকট্য চাইত ও পরকালীন মুক্তি তালাশ করত। বর্তমান যুগের নামধারী মুসলমানরা সেকাজটিই করছে একইভাবে একই নিয়তে। ক্ষুধার্ত-জীবিত মানুষকে তারা কিছুই দিতে চায় না। অথচ মৃতের কবরে বিনা দ্বিধায় তারা হাযারো টাকা ঢালে। ভূমিহীন, বাস্ত্তভিটাহীন ছিন্নমূল মানুষ একটু মাথা গোঁজার ঠাঁই পায় না। অথচ এইসব মাযার, মিনার, স্মৃতিসৌধ ইত্যাদির নামে সারা দেশে শত শত একর জমি অধিগ্রহণ করে রাখা হয়েছে। যেগুলি স্রেফ অপচয় ও শিরকের আখড়া ব্যতীত কিছুই নয়। মূর্তিভাঙ্গা ইবরাহীমের গড়া কা‘বায় যেমন তার অনুসারী কুরায়েশরা যুগে যুগে মূর্তি দিয়ে ভরে ফেলেছিল, তেমনিভাবে সেখান থেকে মূর্তি ছাফকারী মুহাম্মাদের অনুসারীরা আজ ঘরে-বাইরে সর্বত্র বেনামীতে ছবি ও মূর্তিপূজা করে চলেছে। অথচ ‘ইসলাম’ এসেছিল এসব দূর করার জন্য। মানুষকে অসীলা পূজা থেকে মুক্ত করে সরাসরি আল্লাহর গোলামীর অধীনে স্বাধীন মানুষে পরিণত করার জন্য। ভারত বিজেতা সুলতান মাহমূদকে যখন সোমনাথ মন্দির ভাঙ্গার বিনিময়ে অঢেল অর্থ ও মণি-মুক্তা দিতে চাওয়া হয়, তখন তিনি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘হামলোগ বুত শেকোন হ্যাঁয়, বুত ফুরোশ নেহীঁ’। ‘আমরা মূর্তি ভাঙ্গা জাতি, মূর্তি বিক্রেতা নই’। অথচ আজ রাষ্ট্রীয় অর্থ ব্যয়ে এসব কাজ করছেন মুসলমানদের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা মুসলমানদের দেওয়া ট্যাক্সের পয়সা ব্যয় করে। আল্লাহর নিকটে এঁরা কি কৈফিয়ত দিবেন, তাঁরাই ভাল জানেন। তবে দেশের নাগরিক হিসাবে আমরা সংশ্লিষ্ট সকলকে অনুরোধ করব এসব থেকে বিরত থাকার জন্য এবং আল্লাহর গযব থেকে দেশ ও জাতিকে রক্ষা করার জন্য। কেননা আল্লাহ বান্দার সব গোনাহ মাফ করেন, কিন্তু শিরকের গোনাহ মাফ করেন না এবং পরকালে এসব লোকের জন্য জান্নাতকে আল্লাহ হারাম ঘোষণা করেছেন (নিসা ৪৮; মায়েদাহ ৭২)। অতএব হে জাতি! ছবি ও মূর্তি থেকে সাবধান হও!!