প্রশ্ন-৩ : অনেকে বলেন, হাদীছ যখন কুরআনের কোন আয়াতের বিরোধী হবে, তখন সে হাদীছ অগ্রাহ্য হবে, যতই তা বিশুদ্ধ হৌক না কেন। যেমন একটি হাদীছে এসেছে, إنَّ الْمَيِّتَ لَيُعَذَّبُ بِبُكَاءِ أَهْلِهِ عَلَيْهِ ‘পরিবারবর্গের ক্রন্দনে কবরে মাইয়েতের উপরে আযাব হয়’।[1] হাদীছটির প্রতিবাদে হযরত আয়েশা (রাঃ) কুরআনের আয়াত পেশ করেছেন, وَلاَ تَزِرُ وَازِرَةٌ وِزْرَ أُخْرَى ‘একের বোঝা অন্যে বইবে না’।[2] এক্ষণে এর জওয়াবে কি বলা যাবে?
উত্তর : হাদীছটিকে রদ করা কুরআন দ্বারা সুন্নাহকে রদ করার সমপর্যায়ভুক্ত। যা এ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়ার শামিল। এক্ষণে হাদীছটির জওয়াবে আমি বিশেষ করে ঐসব লোকদের বলব, যারা ‘হাদীছে আয়েশা’ থেকে দলীল গ্রহণ করেছেন- তা হ’ল এই যে, প্রথমতঃ হাদীছের দিক দিয়ে একে রদ করার কোন সুযোগ নেই দু’টি কারণে।- এক. হাদীছটি ছহীহ সনদে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে।
দুই. ইবনে ওমর একা নন। বরং তাঁর পিতা ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব এবং হযরত মুগীরাহ বিন শো‘বা (রাঃ) থেকে ছহীহায়নে উক্ত তিনজন ছাহাবীর বর্ণনা এসেছে। অতএব কেবল কুরআনের সাথে বিরোধ হওয়ার দাবী করে এ হাদীছকে প্রত্যাখ্যান করার সুযোগ নেই।
দ্বিতীয়তঃ ব্যাখ্যাগত দিক দিয়ে, বিদ্বানগণ হাদীছটিকে দু’ভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। এক- এ হাদীছ ঐ মাইয়েতের উপরে প্রযোজ্য, যিনি তার জীবদ্দশায় জানতেন যে, তার মৃত্যুর পরে তার পরিবারের লোকেরা শরী‘আত বিরোধী কাজকর্ম করবে। অথচ তিনি তাদেরকে সেগুলি না করার উপদেশ দিয়ে যাননি। ফলে তাদের বেশরা কান্নাকাটি উক্ত মাইয়েতের জন্য আযাবের কারণ হবে।
الميت শব্দের প্রথমে ال বৃদ্ধি দ্বারা সাধারণভাবে সকল মাইয়েতকে বুঝানো হয়নি। বরং কেবল ঐসব মাইয়েতকে বুঝানো হয়েছে, যারা তাদের ওয়ারিছগণকে শরী‘আত বিরোধী কাজকর্ম করতে নিষেধ করে যায়নি। এখানে ال এসেছে عهدى অর্থাৎ ‘নির্দিষ্টবাচক’ হিসাবে, استغراقى অর্থাৎ ‘সমষ্টিবাচক’ হিসাবে নয়। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি মৃত্যুর পূর্বে অছিয়ত করে গেছে, যেন তার মৃত্যুর পরে উচ্চৈঃস্বরে কান্নাকাটি করা না হয় এবং এযুগে যেসব বেশরা ও বিদ‘আতী রসম-রেওয়াজ পালন করা হয়, তা যেন করা না হয়, তার কবরে আযাব হবে না। কিন্তু যদি উক্ত মর্মে অছিয়ত না করে যায় (এবং পরিবারের লোকেরা বেশরা কাজ করে), তবে উক্ত ব্যক্তির কবরে আযাব হবে।
পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি অছিয়ত করে গেছে যেন তার মৃত্যুতে উচ্চৈঃস্বরে কান্নাকাটি-আহাজারী না করা হয় এবং শরী‘আত বিরোধী কোন অনুষ্ঠানাদি না করা হয়, যা এযুগে করা হয়ে থাকে, তাহ’লে উক্ত ব্যক্তির কবরে আযাব হবে না। তবে যদি অছিয়ত না করে যায় বা উপদেশ না দিয়ে যায়, তাহ’লে আযাব হবে।
এ ব্যাখ্যা হ’ল ইমাম নবভী ও অন্যান্য প্রসিদ্ধ বিদ্বানগণের ব্যাখ্যার অনুরূপ। এই ব্যাখ্যা জানার পর এখন আর অত্র হাদীছের সঙ্গে কুরআনের আয়াত وَلاَ تَزِرُ وَازِرَةٌ وِزْرَأُخْرَى ‘একের পাপের বোঝা অন্যে বইবে না’-এর সাথে কোন বিরোধ রইল না। কেননা বিরোধ কেবল তখনই হবে, যখন হাদীছটির অর্থ সাধারণভাবে সকল মাইয়েতের জন্য প্রযোজ্য বলা হবে। অর্থাৎ প্রত্যেক মাইয়েতই আযাবপ্রাপ্ত হবে। কিন্তু যখন বিশেষ বিশেষ মাইয়েতের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে, অর্থাৎ শরী‘আত বিরোধী কাজকর্ম থেকে স্বীয় পরিবার ও দলের লোকদের নিষেধ করে যাবে না, কেবল তাদেরই কবরে আযাব হবে- এমত ক্ষেত্রে অত্র হাদীছের সঙ্গে কুরআনের উপরোক্ত আয়াতের মধ্যে আর কোন বিরোধ থাকবে না। মোটকথা উচ্চৈঃস্বরে কান্নাকাটি ইত্যাদি বেশরা কাজে নিষেধ না করে যাওয়াটাই তার কবর আযাবের কারণ হবে।
দ্বিতীয় ব্যাখ্যা হ’ল যা শায়খুল ইসলাম ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) তাঁর কোন কোন গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, এখানে আযাবের অর্থ কবরের আযাব বা আখেরাতের আযাব নয়। বরং এর অর্থ হ’ল ব্যথাহত হওয়া, মর্মাহত হওয়া। অর্থাৎ মাইয়েত তার পরিবারের লোকদের উচ্চৈঃস্বরে কান্নাকাটি ও আহাজারিতে দুঃখিত ও বেদনাহত হন। শায়খুল ইসলামের এই ব্যাখ্যা সঠিক হ’লে কুরআনের আয়াতের সঙ্গে অত্র হাদীছের বিরোধের সামান্য সন্দেহটুকুরও মূলোৎপাটন হয়ে যায়।
কিন্তু আমি বলব যে, এই ব্যাখ্যা দু’টি বাস্তব বিষয়ের পরিপন্থী। যার কারণে প্রথম ব্যাখ্যাটি গ্রহণ করা ব্যতীত আমাদের আর কোন পথ থাকে না। প্রথম বিষয়টি হ’লঃ হযরত মুগীরাহ বিন শো‘বা (রাঃ) বর্ণিত হাদীছটি, যা আমরা ইতিপূর্বে উদ্ধৃত করেছি। যা পরিষ্কারভাবে বলে দেয় যে, এই আযাবের অর্থ দুঃখবোধ নয়; বরং এর অর্থ জাহান্নামের আযাব। তবে যদি আল্লাহ তাকে মাফ করেন, সেকথা স্বতন্ত্র। কেননা তিনি বলেছেন- إِنَّ اللّهَ لاَ يَغْفِرُ أَنْ يُشْرَكَ بِهِ وَيَغْفِرُ مَا دُوْنَ ذَلِكَ لِمَنْ يَشَاءُ ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ শিরকের গোনাহ মাফ করেন না। এতদ্ব্যতীত সকল গোনাহ যাকে ইচ্ছা তিনি মাফ করে থাকেন’ (নিসা ৪/৪৮, ১১৬)।
এক্ষণে হযরত মুগীরা বিন শো‘বা (রাঃ)-এর রেওয়ায়াতে এসেছে, إنَّ الْمَيِّتَ لَيُعَذَّبُ بِبُكَاءِ أَهْلِهِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ ‘নিশ্চয়ই মাইয়েত তার পরিবারের কান্নাকাটির কারণে ক্বিয়ামতের দিন আযাবপ্রাপ্ত হবে’। এ হাদীছ স্পষ্ট বলে দিচ্ছে যে, ঐ ব্যক্তি তার পরিবারের কান্নাকাটির কারণে ক্বিয়ামতের দিন আযাব প্রাপ্ত হবে, কবরে নয়। যেটাকে ইবনু তায়মিয়াহ ব্যাখ্যা করেছেন ‘দুঃখ ও বেদনা’ রূপে।
দ্বিতীয় বিষয়টি হ’লঃ মৃত্যুর পরে মাইয়েত তার আশপাশে ভাল-মন্দ কি হচ্ছে কিছুই অনুভব করতে পারে না। যেমন এ বিষয়ে কুরআন ও সুন্নাহতে বর্ণিত হয়েছে। তবে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্র ব্যতীত, যেমন কোন কোন হাদীছে বলা হয়েছে। আল্লাহ ইচ্ছা করলে সকল মাইয়েতকে বা কোন কোন মাইয়েতকে কোন কোন বিষয় শুনিয়ে থাকেন, যা তাদের কষ্ট দেয়। যেমন প্রথমটির ব্যাপারে ছহীহ বুখারীতে হযরত আনাস ইবনে মালেক (রাঃ) হ’তে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, إِنَّ الْعَبْدَ إِذَا وُضِعَ فِى قَبْرِهِ وَتَوَلَّى عَنْهُ أَصْحَابُهُ... حَتَّى إَنَّهُ سَمِعَ قَرْعَ نِعَالِهِمْ... أَتَاهُ مَلَكَانِ- ‘যখন মাইয়েতকে কবরে রাখা হয় এবং তার লোকেরা চলে যায়- এমনকি তিনি তখনও তাদের জুতার আওয়ায শুনতে পান ... এমন সময় দু’জন ফেরেশতা এসে হাযির হন...’।[3] অত্র ছহীহ হাদীছে বিশেষভাবে শ্রবণের প্রমাণ রয়েছে দাফনের সময় ও লোকদের চলে আসার সময়। অর্থাৎ যখন দু’জন ফেরেশতা এসে তাকে বসান, তখন তার দেহে রূহ ফিরিয়ে দেওয়া হয় এবং তখনই তিনি শুনতে পান। অতএব এই হাদীছ স্পষ্টভাবে এই অর্থ বুঝায় না যে, এই মাইয়েত বা সকল মাইয়েতের নিকটে রূহ ফেরত আসবে এবং তারা ক্বিয়ামত পর্যন্ত কবরের পাশ দিয়ে যাতায়াতকারীদের জুতার আওয়ায শুনতে পাবে। - না।
এটা হ’ল মাইয়েতের জন্য বিশেষ অবস্থা ও বিশেষ শ্রবণ। কেননা তখন রূহ তার মধ্যে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। এ সময় যদি আমরা ইমাম ইবনে তায়মিয়াহর ব্যাখ্যা গ্রহণ করি, তাহ’লে মাইয়েতের অনুভূতির গন্ডীসীমা মাইয়েতের আশপাশে বিস্তৃত ধরে নিতে পারি। চাই তা দাফনের পূর্বে লাশের নিকটে হৌক বা লাশ কবরে রাখার পরে হৌক। অর্থাৎ মাইয়েত জীবিতদের কান্না শুনতে পায়। তবে এজন্য দলীল প্রয়োজন। কিন্তু তা নেই। এটাই হ’ল প্রথম কথা।
দ্বিতীয় কথা হ’লঃ কুরআন ও ছহীহ হাদীছের কোন কোন দলীল দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, মৃতরা শুনতে পায় না। এটি একটি দীর্ঘ আলোচনা। কিন্তু আমি এখানে মাত্র একটি হাদীছ উল্লেখ করব এবং এর দ্বারা আমি আলোচ্য প্রশ্নের জওয়াব শেষ করব। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, إِنَّ لِلَّهِ تَعَالَى مَلاَئِكَةٌ سَيَّاحِيْنَ فِى الأَرْضِ يَبْلُغُوْنِىْ عَنْ أُمَّتِى السَّلاَمَ- ‘নিশ্চয়ই পৃথিবীতে আল্লাহর একদল ভ্রমণকারী ফেরেশতা রয়েছে, যারা আমার নিকটে আমার উম্মতের সালাম পৌঁছে দেয়’।[4] এখানে سَيَّاحِيْنَ অর্থ طَوَّافِيْنَ عَلَى الْمَجَالِسِ ‘মজলিস সমূহে ভ্রমণকারী’। যখনই কোন মুসলমান রাসূলের উপরে দরূদ পাঠ করে, সেখানেই একজন ফেরেশতা মওজুদ থাকেন, যিনি তা সাথে সাথে রাসূলের নিকট পৌঁছে দেন। এক্ষণে যদি মৃতরা শুনতে পেতেন, তাহ’লে সবার আগে আমাদের নবী করীম (ছাঃ) তা শোনার অধিক হকদার ছিলেন। কেননা আল্লাহ তাকে বিশেষ মর্যাদা দান করেছেন এবং সকল নবী-রাসূল ও দুনিয়াবাসীর উপরে নানাবিধ বৈশিষ্ট্যে সমৃদ্ধ করেছেন। অতএব যদি কেউ শুনতে পেত, তাহ’লে রাসূল (ছাঃ) আগে শুনতে পেতেন। আর যদি নবী করীম (ছাঃ) তাঁর মৃত্যুর পরে কিছু শুনতে পেতেন, তাহ’লে তিনি অবশ্যই স্বীয় উম্মতের দরূদ শুনতে পেতেন।
এখান থেকেই আপনারা ঐসব লোকের ভুল বরং পথভ্রষ্টতা বুঝতে পারবেন, যারা রাসূলের নিকটে নয়, বরং তাঁর চাইতে নিম্নস্তরের মানুষের কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করে থাকে- চাই সেই ব্যক্তি রাসূল হৌন, নবী হৌন বা কোন নেক বান্দা হৌন। কেননা তারা যদি রাসূলের নিকটে ফরিয়াদ পেশ করে, তাহ’লে তিনি তা অবশ্যই শুনতে পান না। যেমন পবিত্র কুরআনে স্পষ্ট বর্ণিত হয়েছে, إِنَّ الَّذِيْنَ تَدْعُوْنَ مَنْ دُوْنِ اللهِ عِبَادٌ اَمْثَالُكُمْ- ‘আল্লাহ ব্যতীত অন্য যাদেরকে তোমরা ডাকো, ওরা তোমাদেরই মত বান্দা’ (আ‘রাফ ৭/১৯৪)। وَإِنْ تَدْعُوْهُمْ لاَيَسْمَعُوْا دُعَائَكُمْ ‘আর যদি তোমরা ওদের ডাকো, ওরা তোমাদের ডাক শুনতে পাবে না’ (ফাত্বির ৩৫/১৪)।
এক্ষণে মোদ্দা কথা হ’ল, মৃত্যুর পরে কোন মাইয়েত শুনতে পায় না। কেবল বিশেষ ক্ষেত্রে যেখানে বিশেষ দলীল এসেছে। যেমন ইতিপূর্বে আমরা উল্লেখ করেছি মাইয়েতের লোকদের জুতার আওয়ায শোনা বিষয়ে। এখানেই আলোচ্য প্রশ্নের জওয়াব শেষ হ’ল।
[1]. ছহীহুল জামে‘ হা/১৯৭০; মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/১৭২৪, ‘জানাযা’ অধ্যায় ‘মৃতের উপর ক্রন্দন’ অনুচ্ছেদ।
[2]. ফাত্বির ৩৫/১৮; আন‘আম ৬/১৬৪।
[3]. বুখারী, মিশকাত হা/১২৬; ছহীহুল জামে‘ হা/১৬৭৫।
[4]. ছহীহুল জামে‘ হা/২১৭৪; নাসাঈ, দারেমী, মিশকাত হা/৯২৪ ‘ছালাত’ অধ্যায়, ‘নবীর উপর দরূদ’ অনুচ্ছেদ।