জিহাদ ও কিতাল

ইসলামে জিহাদ বিধান

মাক্কী জীবনে : দীর্ঘ ২৩ বছরের নবুঅতী জীবনের প্রথম ১৩ বছর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মক্কায় অবস্থান করেন। এই সময় তাঁকে সশস্ত্র জিহাদের নির্দেশ দেওয়া হয়নি। বরং তাঁকে প্রতিকূল পরিবেশে প্রজ্ঞা ও সুন্দর উপদেশের মাধ্যমে মানুষকে আল্লাহর দ্বীনের পথে আহবানের নির্দেশ দেওয়া হয়। তাঁর সম্প্রদায় যখন তাঁর আহবানের মধ্যে বাপ-দাদার আমল থেকে চলে আসা রীতি ও সংস্কৃতির বিরোধী বক্তব্য দেখতে পেল, তখন তাঁর বিরুদ্ধে তারা খড়গহস্ত হয়ে উঠলো এবং তাঁর উপরে নানাবিধ নির্যাতন শুরু করে দিল।

এই সময় রাসূল (ছাঃ)-কে বলা হয়, اُدْعُ اِلىَ سَبِيْلِ رَبِّكَ بِالْحِكْمَةِ وَالْمَوْعِظَةِ الْحَسَنَةِ وَجَادِلْهُمْ بِالَّتِى هِىَ اَحْسَنُ ‘তুমি আহবান কর মানুষকে তোমার প্রভুর পথে প্রজ্ঞার সাথে ও সুন্দর উপদেশের মাধ্যমে এবং তাদের সাথে বিতর্ক কর সর্বাধিক সুন্দর পন্থায়’ (নাহ্ল ১৬/১২৫)। বলা হয়, اِدْفَعْ بِالَّتِىْ هِىَ اَحْسَنُ السَيِّئَةَ نَحْنُ أَعْلَمُ بِمَا يَصِفُوْنَ ‘তুমি মন্দকে ভাল দ্বারা প্রতিরোধ কর। তারা যা বলে আমরা সে বিষয়ে ভালভাবে অবগত’ (মুমিনূন ২৩/৯৬)। বলা হ’ল, فَاِذَا الَّذِىْ بَيْنَكَ وَبَيْنَهُ عَدَاوَةٌ كَأَنَّهُ وَلِىٌّ حَمِيْمٌ ‘তাহ’লে তোমার শত্রুর অবস্থা এমন দাঁড়াবে, যেন সে তোমার অন্তরঙ্গ বন্ধু’ (হা-মীম সাজদাহ ৪১/৩৪)

মাক্কী জীবনে মন্দকে মন্দ দ্বারা বা অস্ত্রকে অস্ত্র দ্বারা মুকাবিলা করার নির্দেশ আল্লাহপাক স্বীয় রাসূলকে দেননি। এই সময় তাঁকে কুরআন ও সুন্নাহ দ্বারা ও প্রজ্ঞাপূর্ণ উপদেশ দ্বারা বাতিলপন্থী মন্দশক্তিকে মুকাবিলা করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। যেমন আল্লাহ স্বীয় রাসূলকে বলেন, نَحْنُ أَعْلَمُ بِمَا يَقُوْلُوْنَ وَمَا أَنْتَ عَلَيْهِمْ بِجَبَّارٍ فَذَكِّرْ بِالْقُرْآنِ مَنْ يَخَافُ وَعِيْدِ ‘আমরা ভালভাবে অবগত আছি যা তারা বলে। কিন্তু তুমি তাদের উপর যবরদস্তিকারী নও। অতএব তুমি কুরআন দ্বারা উপদেশ দাও যে ব্যক্তি আমার  শাস্তিকে ভয় করে’ (ক্বাফ ৫০/৪৫)। অতঃপর এটাকেই ‘বড় জিহাদ’ হিসাবে উল্লেখ করে বলা হ’ল, فَلاَ تُطِعِ الْكَافِرِيْنَ وَجَاهِدْ هُمْ بِهِ جِهَادًا كَبِيْرًا ‘তুমি কাফিরদের আনুগত্য করো না। বরং তাদের বিরুদ্ধে কুরআন দ্বারা বড় জিহাদে অবতীর্ণ হও’ (ফুরক্বান ২৫/৫২)

কুরআন ও কুরআনের বাহক রাসূল ও তাঁর অনুসারীদেরকে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করে কাফেররা মানসিক পীড়ন করতে থাকলে  আল্লাহ বলেন, وَإِذَا رَأَيْتَ الَّذِينَ يَخُوضُونَ فِي آيَاتِنَا فَأَعْرِضْ عَنْهُمْ حَتَّى يَخُوضُوا فِي حَدِيثٍ غَيْرِهِ ‘যখন তুমি তাদেরকে আমাদের আয়াত সমূহে ত্রুটি সন্ধানে লিপ্ত দেখবে, তখন তুমি তাদের থেকে সরে যাবে। যে পর্যন্ত না তারা অন্য কথায় লিপ্ত হয়’ (আন‘আম ৬/৬৮)। আরও বলা হয়েছে, فَذَرْهُمْ يَخُوضُوا وَيَلْعَبُوا حَتَّى يُلاَقُوا يَوْمَهُمُ الَّذِي يُوعَدُونَ ‘তাদেরকে ছিদ্রান্বেষণ ও খেল-তামাশায় ছেড়ে দাও সেই দিবসের (ক্বিয়ামতের) সম্মুখীন হওয়া পর্যন্ত, যে দিবসের ওয়াদা তাদেরকে করা হয়েছে’ (যুখরুফ ৪৩/৮৩, মা‘আরিজ ৭০/৪২)। বলা হয়, فَاصْدَعْ بِمَا تُؤْمَرُ وَأَعْرِضْ عَنِ الْمُشْرِكِينَ- إِنَّا كَفَيْنَاكَ الْمُسْتَهْزِئِينَ ‘তুমি যে বিষয়ে আদিষ্ট হয়েছ, তা প্রকাশ্যে প্রচার কর এবং মুশরিকদের উপেক্ষা কর’। ‘বিদ্রুপকারীদের বিরুদ্ধে তোমার জন্য আমরাই যথেষ্ট’ (হিজর ১৫/৯৪-৯৫)

মাক্কী যিন্দেগীতে সাধারণ মুসলমানদের সামাজিক জীবন ও চলাফেরা সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, وَعِبَادُ الرَّحْمَنِ الَّذِينَ يَمْشُونَ عَلَى الْأَرْضِ هَوْنًا وَإِذَا خَاطَبَهُمُ الْجَاهِلُونَ قَالُوا سَلاَمًا ‘দয়াময় আল্লাহর সত্যিকারের বান্দা তারাই যারা ভূপৃষ্ঠে বিনম্রভাবে চলাফেরা করে এবং মূর্খরা যখন তাদের লক্ষ্য করে বিভিন্ন কথা বলতে থাকে, তখন তারা বলে ‘সালাম’ (ফুরক্বান ২৫/৬৩)। এই সময় কাফেরদের ক্ষমা করার উপদেশ দিয়ে আল্লাহ স্বীয় রাসূলকে বলেন, فَاصْفَحِ الصَّفْحَ الْجَمِيلَ ‘তুমি তাদেরকে সুন্দরভাবে ক্ষমা করে দাও’ (হিজর ১৫/৮৫)। সাধারণ মুসলমানদেরও একইরূপ পরামর্শ দিয়ে বলা হয়,قُلْ لِلَّذِينَ آمَنُوا يَغْفِرُوا لِلَّذِينَ لاَ يَرْجُونَ أَيَّامَ اللهِ ‘তুমি মুমিনদের বল, তারা যেন ঐসব লোকদের ক্ষমা করে দেয়, যারা আল্লাহর দিবস সমূহ (অর্থাৎ তাঁর শাস্তি বা অনুগ্রহ কোনটাই) কামনা করে না’ (জাছিয়াহ ৪৫/১৪)।  উপরে বর্ণিত আয়াতগুলির সবই মাক্কী। এইভাবে সূরা হজ্জ ৩৯ আয়াত নাযিলের পূর্ব পর্যন্ত ৭০-এর অধিক আয়াতে মাক্কী জীবনে যুদ্ধকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল’।[1]


[1]. মুফতী মুহাম্মাদ শাফী, তাফসীর মা‘আরেফুল কুরআন (সংক্ষেপায়িত), বঙ্গানুবাদ : মহিউদ্দীন খান (মদীনা : ১৪১৩/১৯৯৩) পৃঃ ৯০৩।