জিহাদ ও কিতাল

সার-সংক্ষেপ

উপরের আলোচনা সমূহের সার-সংক্ষেপ নিম্নরূপ।-

(১) জিহাদ নিরস্ত্র ও সশস্ত্র দু’ভাবে হ’তে পারে। প্রজ্ঞাপূর্ণ দাওয়াতের মাধ্যমে নিরস্ত্র জিহাদ সর্বাবস্থায় ফরয। কিন্তু সশস্ত্র ক্বিতাল মুসলমানদের রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ ব্যতীত অন্যের জন্য বৈধ নয়।

(২) যুদ্ধকালীন অবস্থায় আক্রান্ত এলাকার সকল মুসলমানের উপরে জিহাদ ‘ফরযে আয়েন’। কেউ সরাসরি যুদ্ধে রত হবে। কেউ যুদ্ধে বিভিন্নভাবে সাহায্য করবে। আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় কোন মুসলিম রাষ্ট্র কোন অমুসলিম রাষ্ট্র কর্তৃক আক্রান্ত হ’লে আক্রান্ত রাষ্ট্রের সকল মুসলিম নাগরিকের উপরে জিহাদ ‘ফরযে আয়েন’ হবে। অন্য রাষ্ট্রের মুসলমানদের উপরে সেটা ‘ফরযে কেফায়াহ’। তারা আক্রান্ত মুসলিম রাষ্ট্রকে সম্ভাব্য সকল প্রকার সহযোগিতা দেবে।

(৩) শান্তির অবস্থায় কুরআন, হাদীছ, বিজ্ঞান, যুক্তি-প্রমাণ ও প্রজ্ঞাপূর্ণ পন্থায় ইসলামকে অন্যান্য দ্বীনের উপরে বিজয়ী করার সংগ্রামকে বলা হবে ‘জিহাদ’। যাকে এযুগে ‘চিন্তার যুদ্ধ’ (الْغَزْوُ الْفِكْرِيُّ) বলা হয়। এই জিহাদে দৃঢ় ও আপোষহীন থাকা এবং জান-মাল ব্যয় করা নিঃসন্দেহে জান্নাত লাভের উত্তম অসীলা হবে।[1]

(৪) মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রে বসবাস করেও যারা অনৈসলামী আইনে শাসিত হচ্ছেন, তারা নিজ রাষ্ট্রে ইসলামী আইন ও শাসন জারির পক্ষে জনমত গঠন করবেন এবং তা পরিবর্তনের জন্য ইসলামী পন্থায় সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাবেন। আর যারা অমুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রে বসবাস করেন, তারা নিজেরা খাঁটি মুসলিম হবেন এবং ইসলামের সুমহান আদর্শ প্রচার করবেন। সাথে সাথে সেদেশে নিজেদের ইসলামী অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য বৈধভাবে প্রচেষ্টা চালাবেন এবং বাতিলের বিরুদ্ধে সাধ্যমত আপোষহীন থাকবেন। যেভাবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মাক্কী জীবনে বাস করেছিলেন। 

কিন্তু ‘অনৈসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা চূর্ণ করে ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করাই হচ্ছে ইসলামী জিহাদের মূল উদ্দেশ্য’[2] জিহাদের এই ধরনের ব্যাখ্যার পিছনে কুরআন, হাদীছ ও রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর জীবন থেকে সরাসরি কোন সমর্থন পাওয়া যায় না। যদিও ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা ব্যতিত ইসলামী বিধানসমূহ পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়।

অনুরূপভাবে ‘কবীরা গোনাহগার’ মুসলমানদের খতম করে সমাজকে ভেজালমুক্ত করার হঠকারী তৎপরতা কোন ‘জিহাদ’ নয়, ক্বিতালও নয়। আবুবকর ছিদ্দীক (রাঃ) যাকাত অস্বীকারকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন খলীফা হিসাবে। সাধারণ নাগরিক হিসাবে এই অধিকার কারু নেই। দ্বিতীয়তঃ যাকাত সহ যেকোন ফরযকে অস্বীকার করলে সে ‘কাফির’ হয়ে যায়। সে হিসাবে অনুরূপ কোন নামধারী ব্যক্তির বিরুদ্ধে কোন মুসলিম সরকার আজও কঠোর দন্ড দিতে পারেন। কিন্তু কোন সাধারণ নাগরিক ঐ দন্ড প্রদানের ক্ষমতা রাখেন না।

(৫) দুনিয়ার এ ক্ষণস্থায়ী জীবনকে জিহাদের ময়দানে শাহাদাত পিয়াসী সৈনিকের মত কুফর, শিরক ও যাবতীয় বাতিল প্রতিরোধে সদা তৎপর রাখতে হবে। অমনিভাবে রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য মুমিন-ফাসিক সকল ধরনের শাসকের নির্দেশ মতে[3] প্রয়োজনে সশস্ত্র যুদ্ধে অংশ গ্রহণের জন্য প্রস্ত্তত থাকতে হবে।

(৬) আল্লাহ মুসলিম উম্মাহকে মধ্যপন্থী উম্মত হিসাবে ঘোষণা করেছেন। যাতে তারা মানবজাতির উপর সাক্ষ্যদাতা হ’তে পারে (বাক্বারাহ ২/১৪৩)। রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, নিশ্চয়ই দ্বীন সহজ। যে ব্যক্তি তা কঠোর করতে যাবে, তার পক্ষে তা কঠোর হয়ে পড়বে। অতএব তোমরা সৎকর্ম কর ও  মধ্যপন্থা অবলম্বন কর।[4] তিনি বলেন, তোমরা সহজ কর, কঠিন করো না। সুসংবাদ দাও, তাড়িয়ে দিয়ো না।[5] অতএব আমাদেরকে যাবতীয় শৈথিল্যবাদী ও চরমপন্থী চিন্তা-চেতনা পরিহার করে সর্বদা মধ্যপন্থী নীতি অবলম্বন করতে হবে।


[1]. আলে ইমরান ১৪২, তওবাহ ১৬, ছফ ১১।

[2]. সাইয়িদ আবুল আ‘লা মওদূদী, আল্লাহর পথে জিহাদ (অনুবাদ: মাওলানা আব্দুর রহীম, ঢাকা : মার্চ ১৯৭০) পৃঃ ৩৫।

[3]. ফাৎহুল বারী ‘জিহাদ’ অধ্যায় ‘ভাল ও মন্দ সবধরনের শাসকের অধীনে জিহাদ’ অনুচ্ছেদ-৪৪।

[4]. বুখারী, মিশকাত হা/১২৪৬।

[5]. বুখারী হা/৬৯, মুসলিম হা/১৭৩৪।