সমাজ দর্শন[1]
মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কের দর্শনই হ’ল ‘সমাজ দর্শন’। মানুষ মূলতঃ সামাজিক জীব। সমাজ চেতনা তার মধ্যে জন্মগত। আদম ও হাওয়া দু’জনের মাধ্যমেই পৃথিবীতে প্রথম মানুষের সামাজিক জীবনের সূচনা। অতঃপর তাদের বংশধরগণের মাধ্যমে সারা পৃথিবীতে মানুষের আবাদ হয়। নূহের প্লাবনে নৌকায় উঠে বেঁচে যাওয়া মুষ্টিমেয় ঈমানদার মানুষের বংশধর আজকের পৃথিবীর সকল মানুষ। কেবল মানুষই নয়, আজকের গবাদিপশুও সেদিনের নূহের নৌকার সওয়ারী ভাগ্যবান গবাদিপশুগুলির বংশধর।
মানুষ ও পশু-পক্ষী সবাই সমাজ চেতনা সম্পন্ন। সবারই প্রথম ইউনিট একজোড়া নর ও মাদী। অতঃপর পরিবার, অতঃপর গোত্র, অতঃপর বৃহত্তর সমাজ। কিন্তু মানুষ ও পশু-পক্ষীর সমাজ চেতনার মধ্যে পার্থক্য এই যে, মানুষের মধ্যে জৈবিক চেতনার সাথে সাথে নৈতিক ও আধ্যাত্মিক চেতনা যুক্ত থাকে। ফলে তার সমাজ জীবনের বন্ধন হয় দৃঢ় ও দ্যোতনাময় এবং সর্বব্যাপী। অবশেষে বিশ্বব্যাপী। কিন্তু পশু-পক্ষীর চেতনা হয় স্রেফ জৈবিক ও রৈপিক। যার স্থায়িত্ব হয় সাময়িক। সেখানে কোন নৈতিক চেতনা থাকে না। কিন্তু আত্মরক্ষার স্বার্থে তাদের মধ্যে এক ধরনের ঐক্য চেতনা কাজ করে। সেজন্য প্রত্যেক পশু-পক্ষী স্ব স্ব জাতি ও গোত্রের সাথে বাস করে। হরিণ হরিণের সাথে, বাঘ বাঘের সাথে, মাছ মাছের সাথে, গরু-ছাগল, উট, ঘোড়া, ভেড়া সবাই স্ব স্ব গোত্রের সাথে বসবাস করে। পাখি আকাশে ওড়ে সুশৃংখলভাবে একজন নেতাকে সামনে রেখে। পিঁপড়া মাটিতে চলে সুবিন্যস্ত ধারায় তাদের একজন নেতাকে সামনে রেখে। মৌমাছি মধু সঞ্চয় করে তাদের রাণী মাছিকে ঘিরে। একটা মৌমাছি, বোলতা বা ভিমরুলকে কেউ আঘাত করলে হাযারটা এসে শত্রুকে দংশন করে। এভাবে সর্বত্র রয়েছে এক ধরনের সমাজ চেতনা। মানুষ হ’ল সৃষ্টিকুলের সেরা। তাই মানুষের মধ্যে সমাজ চেতনা সর্বাধিক এবং মানুষের বাঁচার জন্য ও পৃথিবীকে আবাদ করার জন্য মানুষের পারস্পরিক সহযোগিতার প্রয়োজনও সবচাইতে বেশী।
আল্লাহ বলেন, হে মানবজাতি! আমরা তোমাদের সৃষ্টি করেছি একজোড়া পুরুষ ও নারী থেকে এবং আমরা তোমাদেরকে বিভিন্ন সম্প্রদায় ও গোত্রে বিভক্ত করেছি যাতে তোমরা পরস্পরে পরিচিত হ’তে পারো। নিশ্চয়ই তোমাদের মধ্যে সর্বাধিক সম্মানিত সেই ব্যক্তি, যিনি সর্বাধিক আল্লাহভীরু। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের সকল বিষয়ে জ্ঞাত এবং গোপন বিষয়ে অবগত’ (হুজুরাত ৪৯/১৩)। অত্র আয়াতে মানুষের মৌলিক সমাজ দর্শন বিধৃত হয়েছে। বলে দেয়া হয়েছে যে, প্রথমেই দু’জন নারী-পুরুষের মাধ্যমে মানব সমাজের ভিত্তি তৈরী হয়েছে। বানর-হনুমান দ্বারা নয়। অতঃপর আদমের সন্তানাদি ও বংশধরগণের মাধ্যমে বিভিন্ন পরিবার, গোত্র ও সম্প্রদায়ের সৃষ্টি হয়। অতঃপর বিক্ষিপ্ত পরিবার ও বংশধরগণকে সমাজবদ্ধ রাখার জন্য তাদেরকে বিভিন্ন নামে পরিচিত করা হয়েছে। এখানে পরিচিতিই মুখ্য। বংশীয় অহংকার ও আভিজাত্যের বড়াই মুখ্য নয়। কেননা সবাই এক আদমের সন্তান। অতঃপর সমমনা মানুষের সমবায়ে এক একটি সংগঠন সৃষ্টি হয়। যার মাধ্যমে মানুষ তার ইচ্ছার প্রতিফলন ও বাস্তবায়ন ঘটায় এবং আগ্রাসী মানুষদের হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করে।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘(আত্মার জগতে) রূহসমূহ সুসংবদ্ধ সেনাবাহিনীর ন্যায় ছিল। অতঃপর (দুনিয়াতে এসে) তারা (সেদিনের) সমমনাদের সাথে বন্ধুত্ব করে এবং অন্যদের সাথে মতভেদ করে (বুখারী হা/৩৩৩৬)। এ পর্যায়ে বিপরীতমুখী চেতনার কারণে মানুষের মধ্যে দ্বিমুখী ধারার সৃষ্টি হয়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, মানুষ দু’ধরনের (১) সৎ আল্লাহভীরু (بر تقىّ) এবং (২) অসভ্য হতভাগা (فاجر شقىّ) (তিরমিযী হা/৩৯৫৫)। দু’ধারার সংঘাতে অনেক সময় অসভ্য দুর্ধর্ষরা বিজয়ী হলেও আল্লাহভীরু ও সৎকর্মশীলগণ সর্বদা নৈতিকভাবে বিজয়ী হয়ে থাকেন। পৃথিবী চিরদিন তাদেরকেই স্মরণ করে ও তাদেরকেই অনুসরণ করে। এঁরাই হ’লেন মানুষের মধ্যে সেরা ও সর্বাধিক সম্মানিত। আল্লাহভীরু সৎব্যক্তি ও অসভ্য অসৎব্যক্তি উভয়ে একই মানব সমাজের অংশ। কিন্তু নৈতিক চেতনার পার্থক্যের কারণে উভয়ের মর্যাদা ভিন্ন হয়েছে। আমরা যদি মানব জাতিকে একটি ফলবান বৃক্ষের সাথে তুলনা করি, তাহ’লে বলা যাবে যে, কেউ উক্ত বৃক্ষের গুঁড়ি, কেউ শাখা, কেউ কাঁটা, কেউ ছাল, কেউ পাতা, কেউ ফুল, কেউ ফল ইত্যাদি। সবাই একই বৃক্ষমূলের অংশ। কারু উপরে কারু প্রাধান্য নেই, কেবল বিশেষ গুণ ব্যতীত, যা তাকে অন্যের থেকে পৃথক মর্যাদায় ভূষিত করে। ফলে যারা আল্লাহভীরু ও সৎকর্মশীল, তারা ঐ মানববৃক্ষের ফুল ও ফল হিসাবে বরিত হন। দুনিয়া ও আখেরাতে তারাই সম্মানিত ও মর্যাদামন্ডিত। আর দুষ্টগুলো হয় কাঁটার মত। ওদেরকে মাড়িয়েই গোলাপ আহরণ করতে হয়। এজন্যই সৃষ্টি হয় সমাজকে নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা, সংগঠন ও ব্যাপক অর্থে রাষ্ট্র। যা দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন করে থাকে।
সৎ হৌক আর অসৎ হৌক একটি মৌলিক দর্শনে সকলে এক। আর তা হ’ল সমাজ ব্যতীত মানুষ বাঁচতে পারে না। যেমন পানি ব্যতীত মাছ বাঁচতে পারে না। মানুষ প্রতি পদে পদে সমাজের মুখাপেক্ষী। এমনকি এক প্লেট ভাত খেতে গেলেও তার প্রয়োজন হয় বহু লোকের সহযোগিতা। চাউলের জন্য ধান উৎপাদন। সেজন্য ভূমি কর্ষণ, বীজ বপন ও ধান হওয়া পর্যন্ত জমির পরিচর্যা ও রক্ষণাবেক্ষণ, অতঃপর মাঠ থেকে বাড়ীতে এনে ধান মাড়াই, অতঃপর তা সিদ্ধ করা, শুকানো ও চাউল করা, অতঃপর বাজারে আনা, অতঃপর তা খরিদ করে বাড়ীতে আনা। অতঃপর পানি ও আগুনের সাহায্যে রান্না করা, এরপর তা প্লেটে আনা। এতগুলো পর্যায় অতিক্রম করে আসতে প্রতি ক্ষেত্রেই মানুষকে সাহায্য নিতে হয় স্ব স্ব ক্ষেত্রে দক্ষ ও অভিজ্ঞ অন্য মানুষের। আর আল্লাহ সবধরনের রুচি ও ক্ষমতার মানুষ এ পৃথিবীতে সৃষ্টি করেছেন, যাতে একে অপর থেকে কাজ নিতে পারে (যুখরুফ ৪৩/৩২)। এভাবেই মানুষ ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় পরস্পরে একটি সমাজগ্রন্থীতে পরিণত হয়। পুরা সমাজ দেহ উক্ত গ্রন্থীতে আবদ্ধ থাকে। কেউ নিঃসঙ্গ হ’তে চাইলে তা হয় সাময়িক বিশ্রামের মত। সেখানেও সে একাকী থাকতে পারে না, যদি না অপরের সাহায্য পায়। এই নিঃসঙ্গতা হয় সাধারণত দু’টি কারণে। (১) অন্যের ক্ষতির হাত থেকে বাঁচার জন্য আত্মগোপনের নিঃসঙ্গতা (২) সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর নিকট নিজেকে সঁপে দেবার জন্য ইবাদতে নিঃসঙ্গতা। উভয় ক্ষেত্রেই তাকে অপরের সাহায্য নিতে হয় এবং অবশেষে তাকে ফিরে আসতে হয় আনন্দ ও বেদনায় কোলাহল মুখর মানব সমাজে। এজন্যেই রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, যে মুসলমান মানুষের সঙ্গে মেশে ও তাদের দেওয়া কষ্টে ছবর করে, ঐ ব্যক্তি উত্তম সেই ব্যক্তির চাইতে, যে তাদের সঙ্গে মেশে না ও তাদের দেওয়া কষ্টে ছবর করে না’ (তিরমিযী, মিশকাত হা/৫০৮৭)।
এক্ষণে মানব সমাজের মৌলিক দর্শন হ’ল, সে বুদ্ধিমত্তার অধিকারী একটি সামাজিক জীব। সে নিজে নিজে সৃষ্টি হয়নি। বরং আল্লাহ তাকে বিশেষ গুণাবলী দিয়ে তাঁর দাসত্বের জন্য সৃষ্টি করেছেন। সে সর্বদা সংঘবদ্ধভাবে জীবন যাপনের মুখাপেক্ষী ও এর প্রতি আগ্রহী। সে একটি দূরদর্শী বিধানের মাধ্যমে পরিচালিত হতে চায় এবং সর্বদা একজন যোগ্য নেতা ও ক্ষমতাবান শাসকের অধীনে সুস্থ জীবন যাপন করতে চায়। আর এজন্যেই পৃথিবীর প্রথম মানুষকে আল্লাহ প্রথম নবী করে পাঠিয়েছেন। যার নেতৃত্বে আল্লাহর বিধান অনুযায়ী তখনকার মানুষ পরিচালিত হ’ত। যুগে যুগে এভাবে শেষনবীর আগমন পর্যন্ত এক লক্ষ চবিবশ হাযার নবী-রাসূল দুনিয়াতে এসেছেন ও মানুষকে সঠিক পথে পরিচালিত করে গেছেন। কিন্তু শয়তানের তাবেদার দুষ্ট লোকেরা চিরকাল নবীদের বিরোধিতা করে গেছে এবং মানব সমাজে অশান্তি ও বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে। যা এখনো অব্যাহত রয়েছে। সমাজে নবীগণের অনুসারী ও শয়তানের অনুসারীদের মধ্যে সংঘাত সর্বদা ছিল ও থাকবে। এভাবেই যাচাই হবে কে এ পার্থিব জীবনে সুন্দরতম আমলকারী হবে এবং যার বিনিময়ে সে পরকালে জান্নাতের অধিকারী হবে।
মানুষের মন চায় শয়তানের তাবেদারী করতে, আর বিবেক চায় আল্লাহর আনুগত্য করতে। মন আর বিবেকের সংঘাত চিরন্তন। কিন্তু কেউই জানেনা তার ভবিষ্যৎ শান্তি ও কল্যাণ কিসে নিহিত। এজন্য মানুষ সর্বদা ‘শাশ্বত সত্যে’র মুখাপেক্ষী থাকে। সেটাই আল্লাহ পাঠিয়ে দেন নবীগণের মাধ্যমে। শান্তিকামী মানুষ তা গ্রহণ করে ধন্য হয়। কিন্তু শয়তানের তাবেদাররা সর্বদা তাতে বাধা সৃষ্টি করে ও সমাজে বিপর্যয় সৃষ্টিতে লিপ্ত থাকে। আখেরী যামানায় আখেরী নবীর মাধ্যমে আল্লাহ প্রেরিত সর্বশেষ ও পূর্ণাঙ্গ শরী‘আত হ’ল ‘ইসলাম’। যা সংকলিত আকারে মওজুদ রয়েছে কুরআন ও হাদীছের মধ্যে। মানুষ যদি সত্যিকারের মানবিক দর্শন অনুযায়ী চলতে চায় এবং সমাজ দর্শনের মূল দাবী অনুযায়ী সুস্থ সমাজ জীবনের অধিকারী হ’তে চায়, তাহ’লে তাকে সবদিক থেকে মুখ ফিরিয়ে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের মহাসত্যকে হাতে-দাঁতে অাঁকড়ে ধরতে হবে। যুগে যুগে ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন’ সে উদ্দেশ্যেই পরিচালিত হয়েছে। ঐ দুই সত্যকে এড়িয়ে অন্য কোন দর্শন দিয়ে পরিচালিত হ’লে মানুষের ইহকালীন ও পরকালীন জীবনে নেমে আসবে কেবলি ব্যর্থতার অমানিশা।
প্রশ্ন হ’ল, রহমানী ও শয়তানী দ্বিমুখী চেতনার সংঘাতে মানুষের পরস্পরের সম্পর্ক রক্ষার দর্শন কি হবে? জবাব এই যে, মানুষ হিসাবে সকলের প্রতি সাধারণ মানবিক শিষ্টাচার ও সদ্ব্যবহার বজায় রাখতে হবে। সকলের সাথে স্বাভাবিক সামাজিক সম্পর্ক রেখে চলতে হবে। মানুষের মধ্যেকার সুপ্ত ইলাহী চেতনাকে জাগিয়ে তুলতে হবে। এজন্য সর্বদা হাব্লুল্লাহকে (অর্থাৎ কুরআন ও ছহীহ হাদীছকে) দৃঢ়ভাবে ধারণ করবে। ভাল দিয়ে মন্দকে প্রতিরোধ করবে। সমমনা ঈমানদারগণের সাথে সীসাঢালা প্রাচীরের ন্যায় দৃঢ় সাংগঠনিক ঐক্য গড়ে তুলবে। কিন্তু কোন অবস্থায় মিথ্যা ও আল্লাহ বিরোধী তৎপরতাকে সমর্থন করা যাবে না বা তার সাথে আপোষ করা যাবে না। যেমন আল্লাহ তাঁর বিপদগ্রস্ত নবীকে বলেন, ‘তোমার জন্য ও তোমার অনুসারী মুমিনদের জন্য আল্লাহ যথেষ্ট’ (আনফাল ৮/৬৪)। আল্লাহর এ বাণীর মধ্যে একটি শাশ্বত সমাজ দর্শনের পথনির্দেশ পাওয়া যায়। তাহ’ল এই যে, সত্যনিষ্ঠ মানুষ কোন অবস্থায় মিথ্যার সাথে আপোষ করবে না। আল্লাহভীরু মানুষ কখনোই শয়তানকে ভয় পাবে না ও তার প্রলোভন ও প্রতারণায় আদর্শচ্যুত হবে না। আল্লাহ বলেন, ‘শয়তানের কৌশল সর্বদাই দুর্বল’ (নিসা ৪/৭৬)। অতএব আল্লাহর পথে দৃঢ় থেকে সকলের সাথে মানবিক সম্পর্ক বজায় রেখে চলাই হবে মুমিনের জন্য মৌলিক সমাজ দর্শন। আল্লাহ আমাদেরকে ইলাহী সমাজদর্শনের অনুসারী হওয়ার তাওফীক দিন- আমীন!
[রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের থেকে জাহেলী যুগের গোত্রীয় সংকীর্ণতা ও বাপ-দাদার অহমিকা দূর করে দিয়েছেন। মানুষ দুই ধরনের: মুমিন আল্লাহভীরু অথবা পাপাচারী হতভাগা। মানুষ সকলেই আদমের সন্তান। আর আদম হ’ল মাটির তৈরী’ (আবুদাঊদ হা/৫১১৬)।]
[1]. আত-তাহরীক ১৩তম বর্ষ ২য় সংখ্যা নভেম্বর ২০০৯।