হিংসা ও অহংকার

بسم الله الرحمن الرحيم

الحمد لله وحده والصلاة والسلام على من لا نبي بعده وعلى آله

وصحبه ومن تبعهم بإحسان إلي يوم الدين وبعد : 

প্রথম ভাগ

হিংসা

মানব মনের রোগসমূহের মধ্যে একটি কঠিন রোগের নাম হ’ল ‘হিংসা’। যা মানুষকে পশুর চাইতে নীচে নামিয়ে দেয়। হিংসার পারিভাষিক অর্থ تَمَنَّى زَوَالَ نِعْمَةِ الْمَحْسُوْدِ ‘হিংসাকৃত ব্যক্তির নে‘মতের ধ্বংস কামনা করা’। আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, لاَ حَسَدَ إِلاَّ فِى اثْنَتَيْنِ رَجُلٌ آتَاهُ اللهُ مَالاً فَسُلِّطَ عَلَى هَلَكَتِهِ فِى الْحَقِّ ، وَرَجُلٌ آتَاهُ اللهُ الْحِكْمَةَ ، فَهْوَ يَقْضِى بِهَا وَيُعَلِّمُهَا ‘দু’টি বস্ত্ত ভিন্ন অন্য কিছুতে হিংসা সিদ্ধ নয়। ১. আল্লাহ যাকে মাল দিয়েছেন। অতঃপর সে তা হক-এর পথে ব্যয় করে। ২. আল্লাহ যাকে প্রজ্ঞা দান করেছেন। সে তা দ্বারা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং শিক্ষা দেয়’।[1] এটিকে মূলতঃ হিংসা বলা হয় না, বরং ঈর্ষা বলা হয়। ইমাম রাযী বলেন, যখন আল্লাহ তোমার কোন ভাইকে কোন নে‘মত দান করেন, আর তুমি যদি তার উক্ত নে‘মতের ধ্বংস কামনা কর, তাহ’লে সেটি হ’ল হিংসা (الْحَسَدُ )। আর যদি তুমি নিজের জন্য অনুরূপ নে‘মত কামনা কর, তাহ’লে সেটি হ’ল ঈর্ষা (الْغِبْطَةُ )। হিংসা নিষিদ্ধ এবং ঈর্ষা সিদ্ধ, বরং আকাংখিত। উক্ত হাদীছে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সেটাই বলতে চেয়েছেন। ইমাম নববী বলেন, হিংসা দু’প্রকারের: প্রকৃত (حقيقي ) ও রূপক (مجازي )। প্রকৃত হিংসা হল, تمنى زوال النعمة عن صاحبها ‘ব্যক্তির নে‘মত দূর হয়ে যাওয়ার কামনা করা’। এটি সর্বসম্মতভাবে হারাম। পক্ষান্তরে রূপক হ’ল ঈর্ষা (الغبطة )। যা অন্যের অনুরূপ নে‘মত কামনা করে, তার নে‘মত দূর হওয়ার কামনা ছাড়াই। এরূপ ঈর্ষা করা দুনিয়াবী ব্যাপারে ‘মুবাহ’ এবং দ্বীনী ব্যাপারে ‘মুস্তাহাব’। যেমন ইবাদতে রাত্রি জাগরণে প্রতিযোগিতা করা, দান-ছাদাক্বায় প্রতিযোগিতা করা ইত্যাদি।[2]

উদাহরণ স্বরূপ তাবুকের যুদ্ধে গমনের সময় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যখন সকলের নিকট দান চাইলেন, তখন ওমর ফারূক (রাঃ) বলেন যে, আমি আমার অর্ধেক মাল-সম্পদ নিয়ে হাযির হ’লাম। আর মনে মনে ভাবলাম, আজ আমি আবুবকরকে ছাড়িয়ে যাব। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাকে বললেন, مَا أَبْقَيْتَ لأَهْلِكَ؟ ‘তুমি তোমার পরিবারের জন্য কি রেখে এসেছ? বললাম, অতটা। এরপর আবুবকর এলেন তার সব মাল-সম্পদ নিয়ে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে একই কথা জিজ্ঞেস করলেন। জবাবে তিনি বললেন, أَبْقَيْتُ لَهُمُ اللهَ وَرَسُولَهُ ‘আমি তাদের জন্য আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে রেখে এসেছি’। তখন আমি বললাম, لاَ أُسَابِقُكَ إِلَى شَىْءٍ أَبَدًا ‘কোন ব্যাপারেই আমি কখনো আপনার সাথে পেরে উঠিনি’।[3]

এটা ছিল আখেরাতে নেকী অর্জনের প্রতিযোগিতা। তাই এটি প্রশংসনীয়। কিন্তু যখন এটি দুনিয়াবী সম্পদ অর্জনের প্রতিযোগিতা হবে। সেখানে প্রথমে হিংসা না থাকলেও পরে তা পারস্পরিক হিংসা ও বিদ্বেষে রূপ নেবে। যেমন আব্দুল্লাহ বিন আমর (রাঃ) বলেন, একদিন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাদের বললেন, إِذَا فُتِحَتْ عَلَيْكُمْ فَارِسُ وَالرُّومُ أَىُّ قَوْمٍ أَنْتُمْ যখন তোমরা পারস্য ও রোমক সাম্রাজ্য জয় করবে, তখন তোমরা কেমন হবে? আব্দুর রহমান বিন ‘আওফ বললেন, যেমন আল্লাহ আমাদের নির্দেশ দিয়েছেন। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেনأَوْ غَيْرَ ذَلِكَ، تَتَنَافَسُونَ ثُمَّ تَتَحَاسَدُونَ ثُمَّ تَتَدَابَرُونَ ثُمَّ تَتَبَاغَضُونَ أَوْ نَحْوَ ذَلِكَ বরং অন্য কিছু। তোমরা প্রতিযোগিতা করবে। অতঃপর পরস্পরে হিংসা করবে। অতঃপর পরস্পরকে পরিত্যাগ করবে। অতঃপর পরস্পরে বিদ্বেষ করবে বা অনুরূপ করবে’।[4] তিনি বলেন, فَوَاللهِ مَا الْفَقْرَ أَخْشَى عَلَيْكُمْ وَلَكِنِّى أَخْشَى أَنْ تُبْسَطَ الدُّنْيَا عَلَيْكُمْ كَمَا بُسِطَتْ عَلَى مَنْ قَبْلَكُمْ فَتَنَافَسُوهَا كَمَا تَنَافَسُوهَا فَتُهْلِكَكُمْ كَمَا أَهْلَكَتْهُمْ ‘আল্লাহর কসম! আমি তোমাদের দরিদ্রতাকে ভয় পাইনা। বরং আমি তোমাদের ব্যাপারে ভয় পাই যে, তোমাদের উপর দুনিয়াবী প্রাচুর্য আসবে, যেমন তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর এসেছিল। অতঃপর তোমরা প্রতিযোগিতা করবে। যেমন তারা করেছিল। অতঃপর প্রাচুর্যের প্রতিযোগিতা তোমাদেরকে ধ্বংস করে দিবে, যেমন তাদেরকে ধ্বংস করেছিল’।[5] অন্য বর্ণনায় এসেছে,وَتُلْهِيَكُمْ كَمَا أَلْهَتْهُمْ ‘তোমাদেরকে উদাসীন করে দিবে, যেমন তাদেরকে উদাসীন করেছিল’। [6]  

উক্ত হাদীছে যে আশংকা প্রকাশ করা হয়েছে, তার দু’টি দিক রয়েছে। এক- যদি উক্ত প্রাচুর্যকে ধ্বংস করার চিন্তা কারু মাথায় আসে, তবে সেটা হবে ‘হিংসা’। যা নিন্দনীয়। দুই- যদি তার হেদায়াত কামনা করে এবং নিজেও অনুরূপ প্রাচুর্যের কামনা করে, তবে সেটা হবে বৈধ ও প্রশংসনীয়। যাকে কুরআনে ও হাদীছে ‘তানাফুস’ (التنافس) বা প্রতিযোগিতা বলা হয়েছে।



[1]. বুখারী হা/৭৩; মিশকাত হা/২০২ ‘ইলম’ অধ্যায়।

[2]. মুসলিম শরহ নববী হা/৮১৬-এর ব্যাখ্যা দ্রঃ।

[3]. আবুদাঊদ হা/১৬৭৮; তিরমিযী হা/৩৬৭৫; মিশকাত হা/৬০২১।

[4]. মুসলিম হা/২৬৬২; ইবনু মাজাহ হা/৩৯৯৬।

[5]. তিরমিযী হা/২৪৬২, ইবনু মাজাহ হা/৩৯৯৭।

[6]. বুখারী হা/৬৪২৫; মুসলিম হা/২৯৬১; মিশকাত হা/৫১৬৩।