চিল্লা প্রথা (بدعة الأربعين)
চল্লিশ দিনের জন্য নিজস্ব খরচে তাবলীগে বের হওয়াকে ‘চিল্লা’ বলে। চিল্লা হ’ল তাবলীগীদের ভিত্তিমূলক রুকন (الركن الأساسى)। যে ব্যক্তি চিল্লায় বের হয়, তাকে তারা মহববত করে, সম্মান করে ও তার অপরাধসমূহ ক্ষমা করে। আর যারা এর বিরোধিতা করে, তারা তাকে গ্রহণ করে না, যদিও সে ইসলামের ফরয-ওয়াজিবসমূহ পালন করে। প্রচলিত বিদ‘আতী তাবলীগকে শরী‘আত সিদ্ধ প্রমাণ করার জন্য তারা সূরা আলে ইমরানের ১১০ নং আয়াতে বর্ণিত أُخْرِجَتْ لِلنَّاسِ -এর অপব্যাখ্যা করে এটাকেই ‘চিল্লার পক্ষে কুরআনী নির্দেশ’ বলতে চেয়েছেন এবং এই মর্মে তাবলীগের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা ইলিয়াস নাকি স্বপ্নে আদিষ্ট হয়েছেন এই মর্মে যে, إِنَّكَ أُخْرِجْتَ لِلنَّاسِ مِثْلَ الْأَنْبِيَاءِ ‘নিশ্চয়ই তুমি মানুষের জন্য আবির্ভূত হয়েছ নবীগণের ন্যায়।’ যদিও তিনি নিজে চিল্লায় যেতেন না। বরং অধিকাংশ সময় আব্দুল কুদ্দূস গাঙ্গোহীর কবরের পিছনে বসে থাকতেন এবং নূর সাঈদ বাদায়ূনীর কবরের নিকটে নিরালায় জামা‘আতে ছালাত আদায় করতেন।[1] অথচ কবরে ছালাত আদায় করা শরী‘আতে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। শায়খ তাক্বিউদ্দীন হেলালী বলেন, ‘চিল্লা তাদের দ্বীনের সারমর্ম’ (خلاصة دينهم)। এর ভিত্তিতেই তারা পরস্পরে ভালবাসে অথবা শত্রুতা করে। অথচ এর মাধ্যমে তারা ধর্মীয় ও বৈষয়িক জীবনে বড় ধরনের বিপর্যয় ডেকে আনে। যেমন, (১) এর মাধ্যমে তারা দ্বীনের মধ্যে বিদ‘আত সৃষ্টি করে এবং সুন্নাতে রাসূলের বিরোধিতা করে (২) তারা স্ত্রী-সন্তানাদি ও পিতা-মাতার হক নষ্ট করে (৩) ছাত্রদেরকে তাদের দ্বীনী ইল্ম শিক্ষা করা থেকে বিরত রাখে (৪) তারা ব্যবসায়ীদের ব্যবসা থেকে দূরে রাখে এবং তাদের মাধ্যমে যারা যাকাত ও ছাদাক্বা লাভ করত, তাদেরকে বঞ্চিত করে। এভাবে বহু বঞ্চিত মানুষের অভিযোগ তাদের বিরুদ্ধে আল্লাহর কাছে ও মানুষের কাছে জমা হয়’। তিনি বলেন, ‘ইসলাম আসার আগে ব্রাহ্মণ ও বৌদ্ধ ভিক্ষুরা ঘরবাড়ি ছেড়ে পায়ে হেটে বহু দূরে চলে যেত। বাধ্য না হলে তারা কোন কিছুতে সওয়ার হতো না। অতঃপর জঙ্গলে বা অন্য কোথাও নিরালায় বসে ক্ষুৎ-পিপাসায় কাতর হয়ে ঈশ্বর বন্দনায় লিপ্ত হতো। এভাবে তারা দিনের পর দিন কাটিয়ে দিত’। তিনি বলেন, ‘হে তাবলীগীরা! তোমাদের এই ঘরবাড়ি ছেড়ে চিল্লায় যাওয়ার প্রথা যদি ব্রাহ্মণদের ধর্ম থেকে না নেওয়াও হয়, তথাপি এটি হ’ল নিকৃষ্টতম বিদ‘আত ও নিকৃষ্টতম ভ্রষ্টতা। যা ভারতীয় মূর্তিপূজারীদের হুবহু অনুকরণ, যা তোমরা পুরোপুরিভাবে ইসলামের মধ্যে প্রবেশ করিয়েছ। অথচ তোমাদের এই জোশ ও পারস্পরিক সহযোগিতা ব্যয় করা ওয়াজিব ছিল রাসূল (ছাঃ)-এর সুন্নাতের দিকে মানুষকে আহবানের কাজে’। তিনি বলেন, ‘তাবলীগীদের মাদরাসাগুলি মানুষের রায়-ক্বিয়াসের ভিত্তিতে পরিচালিত হয় ও সেখানে রাসূল (ছাঃ)-এর সুন্নাতকে সংকুচিত করা হয়’। তিনি বলেন, ‘তাবলীগীরা বলে, তাদের চিল্লার মাধ্যমে বহু অমুসলিম মুসলমান হয়’। উত্তরে একথা বলা যায় যে, ‘এতে শুরুটা ভাল হলেও পরিণামে মন্দ হয়। কেননা সে ছাহাবা, তাবেঈন ও সালাফে ছালেহীনের তরীকায় গড়ে ওঠে না। বরং তাবলীগীদের বিদ‘আতী ও ভ্রান্ত রীতিতে গড়ে ওঠে। ফলে যে ব্যক্তি এভাবে তৈরী হয়, সে ব্যক্তির ইসলাম কবুলে খুশী হবার কিছু নেই। কেননা সে ৭২ ফের্কার অন্তর্ভুক্ত হয়, যাদের সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) জাহান্নামের দুঃসংবাদ দিয়েছেন’।[2]
চিল্লায় গিয়ে মানুষকে ছয় উছূল (কালেমা, ছালাত, ইলম ও যিকর, ইকরামুল মুসলিমীন, তাছহীহে নিয়ত, তাবলীগ) শিখানো হয়। ফলে ইসলামের ৫টি বুনিয়াদ শিক্ষা (ঈমান, ছালাত, যাকাত, ছিয়াম, হজ্জ) গৌণ হয়ে যায়। অমনিভাবে ৪ মাযহাব ফরয সহ ১৩০ ফরয মুখস্ত করানো হয়। এছাড়া নানা দায়েমী ফরয, দায়েমী সুন্নাত, খানাপিনা-পেশাব-পায়খানা সহ নানাবিধ আদব, ফরয-ওয়াজিব ও সুন্নাতের বিরাট তালিকা মুখস্ত করানো, গাশত-তা‘লীম, সফর-মোশাওয়ারা, অতঃপর ফাযায়েলের বায়ান ইত্যাদির মধ্যে একজন মানুষকে সর্বদা ব্যস্ত রাখা হয়।[3] অথচ তাদেরকে কুরআন ও হাদীছ শিখানো হয় না। তাওহীদ ও শিরক, সুন্নাত ও বিদ‘আত বুঝানো হয় না। যেগুলি ইসলামের মৌলিক বিষয়।
[1]. আল-ক্বাওলুল বালীগ পৃঃ ২১৫, ১৬, ২৬।
[2]. আল-ক্বাওলুল বালীগ পৃঃ ২২২, ২২৩।
[3]. এক মোবাল্লেগের পয়লা নোট বই, ইঞ্জিনিয়ার মুহাম্মাদ জুলফিকার আহমদ মজুমদার (ঢাকা : ১৯৭৮)।