মুহাম্মাদ (ছাঃ)-ই একমাত্র শাফা‘আতকারী
হযরত আনাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেছেন, ‘ক্বিয়ামতের দিন মুমিনগণকে (হাশরের ময়দানে স্ব স্ব অপরাধের কারণে) বন্দী রাখা হবে। তাতে তারা অত্যন্ত চিন্তিত ও অস্থির হয়ে পড়বে এবং বলবে, ‘যদি আমরা আমাদের প্রতিপালক আল্লাহ তা‘আলার নিকট কারো মাধ্যমে সুপারিশ কামনা করি, যিনি আমাদের বর্তমান অবস্থা থেকে স্বস্তি দিবেন’। সেই লক্ষ্যে তারা আদম (আঃ)-এর নিকট উপস্থিত হয়ে বলবে, ‘আপনি মানবজাতির পিতা আদম, আপনাকে আল্লাহ নিজ হাতে সৃষ্টি করেছেন, জান্নাতে বসবাস করিয়েছেন, ফেরেশতা মন্ডলীকে দিয়ে আপনাকে সিজদা করিয়েছিলেন এবং তিনিই যাবতীয় বস্ত্তর নাম আপনাকে শিক্ষা দিয়েছিলেন। আপনি আমাদের জন্য আপনার রবের নিকট সুপারিশ করুন, যেন তিনি আমাদেরকে এই কষ্টদায়ক স্থান হ’তে মুক্ত করে প্রশান্তি দান করেন’। তখন আদম (আঃ) বলবেন, ‘আমি তোমাদের এই কাজের মোটেই উপযুক্ত নই’।
নবী করীম (ছাঃ) বলেন, তখন তিনি গাছ হ’তে ফল খাওয়ার অপরাধের কথা স্মরণ করবেন, যা হ’তে তাঁকে নিষেধ করা হয়েছিল। [আদম (আঃ) বলবেন] ‘বরং তোমরা মানবজাতির জন্য আল্লাহ তা‘আলার প্রেরিত সর্বপ্রথম নবী নূহ (আঃ)-এর নিকট যাও’। তারা নূহ (আঃ)-এর কাছে গেলে তিনি তাদেরকে বলবেন, ‘আমি তোমাদের এ কাজের জন্য একেবারেই যোগ্য নই’। সাথে সাথে তিনি তাঁর ঐ অপরাধের কথা স্মরণ করবেন , যা অজ্ঞতাবশতঃ নিজের (অবাধ্য) ছেলেকে পানিতে না ডুবানোর জন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছিলেন। (তিনি বলবেন) ‘বরং তোমরা আল্লাহর খলীল হযরত ইবরাহীম (আঃ)-এর নিকটে যাও’।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, এবার তারা হযরত ইবরাহীম (আঃ)-এর নিকটে যাবে। তখন তিনি বলবেন , ‘আমি তোমাদের এ কাজের জন্য কিছুই করার ক্ষমতা রাখি না’। সাথে সাথে তাঁর তিনটি মিথ্যা উক্তির কথা স্মরণ করবেন এবং বলবেন, ‘বরং তোমরা মূসা (আঃ)-এর কাছে যাও। তিনি আল্লাহর এমন এক বান্দা, যাঁকে আল্লাহ তাওরাত দান করেছেন, তাঁর সাথে বাক্যালাপ করেছেন এবং গোপন কথাবার্তার মাধ্যমে তাঁকে নৈকট্য দান করেছেন’। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, তখন তারা সকলে হযরত মূসা (আঃ) এর নিকটে আসলে তিনি বলবেন, ‘আমি তোমাদের জন্য সুপারিশের ক্ষেত্রে অপারগ’। তখন তিনি সেই প্রাণনাশের অপরাধের কথা স্মরণ করবেন, যা তাঁর হাতে সংঘটিত হয়েছিল এবং বলবেন, ‘বরং তোমরা আল্লাহর বান্দা ও তাঁর মনোনীত রাসূল, তাঁর কালেমা ও রূহ হযরত ঈসা (আঃ)-এর কাছে যাও’।
নবী করীম (ছাঃ) বলেন, তখন তারা সবাই হযরত ঈসা (আঃ)-এর কাছে গেলে তিনি বলবেন, ‘আমি তোমাদের এ কাজের উপযুক্ত নই। বরং তোমরা মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর কাছে যাও। তিনি আল্লাহ তা‘আলার এমন এক বান্দা, যার আগের ও পরের সমস্ত গোনাহ আল্লাহ ক্ষমা করে দিয়েছেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘তারা আমার কাছে আসবে। আমি তখন আমার রবের কাছে তাঁর দরবারে উপস্থিত হওয়ার অনুমতি প্রার্থনা করব। অতঃপর আমাকে তাঁর নিকট যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হবে। আমি যখন তাঁকে দেখব, তখনই তাঁর উদ্দেশ্যে সিজদায় পড়ে যাব। আল্লাহ আমাকে যতক্ষণ চাইবেন সিজদা অবস্থায় রাখবেন’। অতঃপর বলবেন, ‘হে মুহাম্মাদ! মাথা উঠাও। আর যা বলার বল, তোমর কথা শুনা হবে। শাফা‘আত কর, কবুল করা হবে। তুমি চাও, তোমাকে দেওয়া হবে’।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘তখন আমি মাথা উঠাব এবং আমার রবের এমনভাবে প্রশংসা বর্ণনা করব, যা তিনি আমাকে শিখিয়ে দিবেন। অতঃপর আমি শাফা‘আত করব। তবে এ ব্যাপারে আমার জন্য একটি সীমা নির্ধারণ করে দেওয়া হবে। তখন আমি আল্লাহর দরবার হ’তে উঠে আসব এবং ঐ নির্ধারিত সীমার লোকদেরকে জাহান্নাম হ’তে বের করে জান্নাতে প্রবেশ করাব। তারপর আমি পুনরায় ফিরে এসে আমার প্রতিপালকের দরবারে হাযির হওয়ার জন্য আল্লাহর কাছে অনুমতি প্রার্থনা করব। আমাকে অনুমতি দেওয়া হবে। আমি যখন তাঁকে দেখব, তখনই তাঁর উদ্দেশ্যে সিজদায় পড়ে যাব এবং আল্লাহ যতক্ষণ চাইবেন আমাকে সিজদা অবস্থায় থাকতে দিবেন’। তারপর আল্লাহ বলবেন, ‘হে মুহাম্মাদ! মাথা উঠাও। আর যা বলার বল, তোমার কথা শুনা হবে, সুপারিশ কর, কবুল করা হবে। তুমি প্রার্থনা কর, যা প্রার্থনা করবে তা দেওয়া হবে’। রাসূল (ছাঃ) বলেন, তখন আমি মাথা উঠাব এবং আমার রবের এমনভাবে প্রশংসা ও গুণকীর্তন বর্ণনা করব, যা আমাকে শিখিয়ে দেওয়া হবে। এরপর আমি শাফা‘আত করব। তবে এ ব্যাপারে আমার জন্য একটি নির্দিষ্ট সীমা বেঁধে দেওয়া হবে। তখন আমি আমার রবের দরবার হ’তে উঠে আসব এবং ঐ নির্দিষ্ট লোকগুলিকে জাহান্নাম হ’তে বের করে জান্নাতে প্রবেশ করাব। অতঃপর তৃতীয়বার ফিরে আসব এবং আমার প্রতিপালক আল্লাহর দরবারে উপস্থিত হওয়ার অনুমতি প্রার্থনা করব। আমাকে তাঁর কাছে উপস্থিত হওয়ার অনুমতি দেওয়া হবে। আমি যখন তাঁকে দেখব, তখনই সিজদায় পড়ে যাব। আল্লাহ যতক্ষণ ইচ্ছা আমাকে সিজদা অবস্থায় রাখবেন’। তারপর বলবেন, ‘হে মুহাম্মাদ! মাথা উঠাও। তুমি যা বলবে তা শুনা হবে, সুপারিশ কর, কবুল করা হবে। প্রার্থনা কর, তা দেওয়া হবে’। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘তখন আমি মাথা উঠাব এবং আমার রবের এমন হামদ ও ছানা বর্ণনা করব, যা তিনি আমাকে শিখিয়ে দিবেন’। নবী করীম (ছাঃ) বলেন, ‘তারপর আমি শাফা‘আত করব। এ ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলা আমার জন্য একটি নির্দিষ্ট সীমা বেঁধে দিবেন। তখন আমি সেই দরবার থেকে বের হয়ে আসব এবং তাদেরকে জাহান্নাম হ’তে বের করে জান্নাতে প্রবেশ করাব’।
অবশেষে কুরআন যাদেরকে অাঁটকিয়ে রাখবে (অর্থাৎ যাদের জন্য কুরআনের ঘোষণা অনুযায়ী চিরস্থায়ী ঠিকানা জাহান্নামে নির্ধারিত হয়ে গেছে) তারা ব্যতীত আর কেউ জাহান্নামে অবশিষ্ট থাকবে না। বর্ণনাকারী ছাহাবী হযরত আনাস (রাঃ) বলেন, অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কুরআনের এই আয়াতটি عَسَى أَنْ يَّبْعَثَكَ رَبُّكَ مَقَامًا مَّحْمُوْدًا ‘আশা করা যায়, আপনার প্রতিপালক অচিরেই আপনাকে ‘মাক্বামে মাহমূদে’ পৌঁছিয়ে দেবেন’ (বনী ইসরাঈল ৭৯) তেলাওয়াত করলেন এবং বললেন, এটাই সেই ‘মাক্বামে মাহমূদ’ যার প্রতিশ্রুতি তোমাদের নবীকে দেওয়া হয়েছে (ছহীহ বুখারী হা/৭৪৪০ ‘তাওহীদ’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-২৪, মিশকাত হা/৫৫৭২ ‘ক্বিয়ামতের অবস্থা ও সৃষ্টির সূচনা’ অধ্যায়, ‘হাওযে কাওছার ও শাফা‘আত’ অনুচ্ছেদ)।
শিক্ষা :
১. সকল নবী-রাসূলের উপর মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর শ্রেষ্ঠত্ব।
২. রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর শাফা‘আতে পরকালে কিছু জাহান্নামীকে আল্লাহ জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। এজন্য রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘প্রত্যেক নবীর এমন একটি দো‘আ রয়েছে, যা (আল্লাহর নিকট) গৃহীত হয়, আর নবী সে দো‘আ করে থাকেন। আমার ইচ্ছা, আমি আমার সে দো‘আর অধিকার আখেরাতে আমার উম্মতের শাফা‘আতের জন্য মুলতবি রাখি’ (বুখারী হা/৬৩০৪, ‘দো‘আ সমূহ’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-১)।
৩. কোন পীর-ওলী পরকালে শাফা‘আতের অধিকার রাখবেন না।