ঈমানদার যুবক ও আছহাবুল উখদূদের কাহিনী
বহুকাল পূর্বে একজন রাজা ছিলেন। সেই রাজার ছিল একজন যাদুকর। ঐ যাদুকর বৃদ্ধ হ’লে একদিন সে রাজাকে বলল, ‘আমি তো বৃদ্ধ হয়ে গেছি। সুতরাং আমার নিকট একটি ছেলে পাঠান, যাকে আমি যাদুবিদ্যা শিক্ষা দিব’। বাদশাহ তার নিকট একটি বালককে পাঠিয়ে দিলেন। তিনি তাকে যাদুবিদ্যা শিক্ষা দিতে লাগলেন। বালকটি যাদুকরের নিকট যে পথ দিয়ে যাতায়াত করত, সে পথে ছিল এক সন্ন্যাসীর আস্তানা। বালকটি তার নিকট বসল এবং তার কথা শুনে মুগ্ধ হ’ল। বালকটি যাদুকরের নিকট যাওয়ার সময় ঐ সন্ন্যাসীর নিকট বসে তাঁর কথা শুনত। ফলে যাদুকরের নিকট পৌঁছতে বালকটির দেরী হ’ত বলে যাদুকর তাকে প্রহার করত। বালকটি সন্ন্যাসীর নিকট এ কথা জানালে তিনি বালককে শিখিয়ে দেন যে, তুমি যদি যাদুকরকে ভয় কর তাহ’লে বলবে, বাড়ীর লোকজন আমাকে পাঠাতে বিলম্ব করেছে এবং বাড়ীর লোকজনকে ভয় পেলে বলবে, যাদুকরই আমাকে ছুটি দিতে বিলম্ব করেছে।
বালকটি এভাবে যাতায়াত করতে থাকে। একদিন পথে সে দেখল, একটি বৃহদাকার প্রাণী মানুষের চলাচলের পথ রোধ করে বসে আছে। বালকটি ভাবল, আজ পরীক্ষা করে দেখব যে, যাদুকর শ্রেষ্ঠ, না সন্ন্যাসী শ্রেষ্ঠ? অতঃপর সে একটি প্রস্তরখন্ড নিয়ে বলল, ‘হে আল্লাহ্! যাদুকরের কার্যকলাপ অপেক্ষা সন্ন্যাসীর কার্যকলাপ যদি তোমার নিকট অধিকতর প্রিয় হয়, তবে এই প্রাণীটিকে এই প্রস্তরাঘাতে মেরে ফেল। যেন লোকজন যাতায়াত করতে পারে’। এই বলে প্রাণীটিকে লক্ষ্য করে সে প্রস্তরখন্ডটি ছুঁড়ে মারল। প্রাণীটি ঐ প্রস্তরাঘাতে মারা গেল এবং লোক চলাচল শুরু হ’ল।
এরপর বালকটি সন্ন্যাসীর নিকট গিয়ে তাকে ঘটনাটি জানালে তিনি তাকে বললেন, ‘বৎস! তুমি এখনই আমার চেয়ে শ্রেষ্ঠ হয়ে উঠেছ। তোমার প্রকৃত স্বরূপ আমি বুঝতে পারছি। শীঘ্রই তোমাকে পরীক্ষার সম্মুখীন হ’তে হবে। যদি তুমি পরীক্ষার সম্মুখীন হও তাহ’লে যেন আমার কথা প্রকাশ করে দিও না’। বালকটির দো‘আয় জন্মান্ধ ব্যক্তি চক্ষুষ্মান হ’তে লাগল, কুষ্ঠ ব্যাধিগ্রস্ত ব্যক্তি নিরাময় হ’তে লাগল এবং লোকজন অন্যান্য রোগ হ’তেও আরোগ্য লাভ করতে লাগল।
এদিকে রাজার একজন সহচর অন্ধ হয়েছিল। সে বহু উপঢৌকনসহ বালকটির নিকট গিয়ে বলল, ‘তুমি যদি আমাকে চক্ষুষ্মান করে দাও, তাহ’লে এ সবই তোমার’। বালকটি বলল, ‘আমিতো কাউকে আরোগ্য করতে পারি না । বরং রোগ ভাল করেন আল্লাহ। অতএব আপনি যদি আল্লাহর প্রতি ঈমান আনেন, তাহ’লে আমি আপনার রোগ মুক্তির জন্য আল্লাহর নিকটে দো‘আ করতে পারি। তাতে তিনি হয়ত আপনাকে আরোগ্য দান করতে পারেন’। ফলে লোকটি আল্লাহর প্রতি ঈমান আনল। আল্লাহ তাকে আরোগ্য দান করলেন।
পূর্বের ন্যায় তিনি রাজার নিকটে গিয়ে বসলে রাজা তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কে তোমাকে দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিল’? সে বলল, ‘আমার রব’। রাজা বললেন, আমি ছাড়া তোমার রব আছে কি’? সে বলল, ‘আমার ও আপনার উভয়ের রব আল্লাহ’। এতে রাজা তাকে ধরে তার উপর নির্যাতন চালাতে থাকে। অবশেষে সে বালকটির নাম প্রকাশ করে দিল।
অতঃপর বালকটিকে রাজদরবারে আনা হ’ল। রাজা তাকে বললেন, ‘বৎস! আমি জানতে পারলাম যে, তুমি তোমার যাদুর গুণে জন্মান্ধ ও কুষ্ঠব্যাধিগ্রস্ত লোকদের রোগ নিরাময় করছ এবং অন্যান্য কঠিন রোগও নিরাময় করে চলেছ। বালকটি বলল, আমি কাউকে রোগ মুক্ত করি না। রোগ মুক্ত করেন আল্লাহ’। তখন রাজা তাকে পাকড়াও করে তার উপর উৎপীড়ন চালাতে থাকেন। এক পর্যায়ে সে সন্ন্যাসীর কথা প্রকাশ করে দিল। তখন সন্ন্যাসীকে ধরে আনা হ’ল এবং তাঁকে বলা হ’ল, তুমি তোমার ধর্ম পরিত্যাগ কর। কিন্তু সে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করল। তখন রাজার আদেশক্রমে করাত নিয়ে আসা হ’লে তিনি তা তার মাথার মাঝখানে বসালেন এবং তাঁর মাথা ও শরীর চিরে দ্বিখন্ডিত করে ফেললেন। তারপর রাজার সহচরকে আনা হ’ল এবং তাকেও তার ধর্ম ত্যাগ করতে বলা হ’ল। কিন্তু সেও অস্বীকৃতি জানালে তাকেও করাত দিয়ে চিরে দ্বিখন্ডিত করা হ’ল।
তারপর বালকটিকে হাযির করে তার ধর্ম পরিত্যাগ করতে বলা হ’ল। বালকটিও নিজ ধর্ম পরিত্যাগ করতে অস্বীকার করল। তখন রাজা তাকে তার লোকজনের নিকট দিয়ে বললেন, ‘তোমরা একে অমুক পাহাড়ে নিয়ে যাও এবং তাকে সঙ্গে করে পাহাড়ে আরোহণ করতে থাক। যখন তোমরা পাহাড়ের উচ্চশৃঙ্গে পৌঁছবে, তখন তাকে তার ধর্ম পরিত্যাগ করতে বলবে। সে যদি অস্বীকার করে, তাহ’লে তোমরা তাকে সেখান থেকে নীচে ছুঁড়ে ফেলে দিবে’। তারা বালকটিকে নিয়ে পাহাড়ের উপরে উঠলে বালকটি দো‘আ করল, ‘হে আল্লাহ! তোমার যেভাবে ইচ্ছা হয়, সেভাবে তুমি আমাকে এদের কাছ থেকে রক্ষা কর’। তৎক্ষণাৎ পাহাড়টি কম্পিত হয়ে উঠল এবং তারা নীচে পড়ে মারা গেল। আর বালকটি (সুস্থ দেহে) রাজার নিকট এসে উপস্থিত হ’ল। রাজা তখন তাকে বললেন, ‘তোমার সঙ্গীদের কি হ’ল’? তখন সে বলল, আল্লাহই আমাকে তাদের হাত থেকে বাঁচিয়েছেন।
তারপর রাজা তাকে তার একদল লোকের নিকট সোপর্দ করে আদেশ দিলেন, ‘একে একটি বড় নৌকায় উঠিয়ে নদীর মাঝখানে নিয়ে যাও। যদি সে নিজ ধর্ম পরিত্যাগ করে, তো ভাল। নচেৎ তাকে নদীতে নিক্ষেপ কর’। তারা বালকটিকে নিয়ে মাঝ নদীতে পৌঁছলে বালকটি পূর্বের ন্যায় দো‘আ করল, ‘হে আল্লাহ! তোমার যেভাবে ইচ্ছা হয়, সেভাবে তুমি আমাকে এদের হাত থেকে রক্ষা কর’। এতে নৌকা ভীষণভাবে কাত হয়ে পড়ল। ফলে রাজার লোকজন নদীতে ডুবে মারা গেল। আর বালকটি (সুস্থ দেহে) রাজার নিকটে আসলে রাজা তাকে বললেন, তোমার সঙ্গীদের কি অবস্থা? সে বলল, আল্লাহই আমাকে তাদের হাত থেকে রক্ষা করেছেন। এরপর সে রাজাকে বলল, ‘আপনি যতই চেষ্টা করুন না কেন আমাকে কোনভাবেই হত্যা করতে পারবেন না। যতক্ষণ না আমি যা বলব, আপনি তা করবেন। রাজা বললেন, ‘সেটা কি’? বালকটি বলল, ‘আপনি একটি বিস্তীর্ণ মাঠে সকল লোককে হাযির করুন এবং সেই মাঠে খেজুরের একটি গুঁড়ি পুঁতে তার উপরিভাগে আমাকে বেঁধে রাখুন। তারপর আমার তূনীর হ’তে একটি তীর নিয়ে ধনুকে সংযোজিত করুন। তারপর بِسْمِ اللهِ ربِّ الْغُلاَمِ (বালকটির রব আল্লাহর নামে) বলে আমার দিকে তীরটি নিক্ষেপ করুন। আপনি যদি এ পন্থা অবলম্বন করেন, তবেই আমাকে হত্যা করতে পারবেন’।
বালকের কথামত এক বিস্তীর্ণ মাঠে রাজা সকল লোককে সমবেত করলেন এবং বালকটিকে একটি খেজুর গাছের গুঁড়ির উপরে বাঁধলেন। তারপর রাজা বালকটির তূনীর হ’তে একটি তীর নিয়ে ধনুকের মধ্যভাগে সংযোজিত করলেন। তারপর بِسْمِ اللهِ ربِّ الْغُلاَمِ বলে বালকটির দিকে তীর নিক্ষেপ করলেন। তীরটি বালকের চোখ ও কানের মধ্যভাগে বিদ্ধ হ’ল। বালকটি এক হাতে তীরবিদ্ধ স্থানটি চেপে ধরল। অতঃপর সে মারা গেল।
এ দৃশ্য দেখে উপস্থিত জনগণ বলে উঠল, ‘আমরা বালকটির রবের প্রতি ঈমান আনলাম। আমরা বালকটির রবের প্রতি ঈমান আনলাম। আমরা বালকটির রবের প্রতি ঈমান আনলাম’।
তারপর রাজার লোকজন তাঁর নিকট গিয়ে বলল, ‘আপনি যা আশঙ্কা করছিলেন তাই শেষ পর্যন্ত ঘটে গেল। সব লোক বালকটির রবের প্রতি ঈমান আনল’। তখন রাজা রাস্তাগুলির চৌমাথায় প্রকান্ড গর্ত খনন করার নির্দেশ দিলেন। তার কথা মতো গর্ত খনন করে তাতে আগুন প্রজ্জ্বলিত করা হ’ল। তারপর রাজা হুকুম দিলেন, ‘যে ব্যক্তি বালকের ধর্ম পরিত্যাগ করবে না, তাকে ঐ আগুনের মধ্যে নিক্ষেপ করে পুড়িয়ে মার। অথবা তাকে বলবে, তুমি এই আগুনে ঝাঁপ দাও। রাজার লোকেরা তার হুকুম পালন করতে লাগল। ইতিমধ্যে একজন রমণীকে তার শিশুসন্তানসহ উপস্থিত করা হ’ল। রমণীটি আগুনে ঝাঁপ দিতে ইতস্ততঃ করতে থাকলে শিশুটি বলে উঠল, ‘মা ছবর অবলম্বন (করতঃ আগুনে প্রবেশ) করুন। কেননা আপনি হক পথে আছেন’।
পবিত্র কুরআনের সূরা বুরূজে এ ঘটনার দিকে ইঙ্গিত করে বলা হয়েছে, ‘ধ্বংস হয়েছিল গর্তওয়ালারা- ইন্ধনপূর্ণ যে গর্তে ছিল অগ্নি, যখন তারা তার পাশে উপবিষ্ট ছিল এবং তারা মুমিনদের সাথে যা করছিল তা প্রত্যক্ষ করছিল। তারা তাদেরকে নির্যাতন করেছিল শুধু একারণে যে, তারা বিশ্বাস করত পরাক্রমশালী ও প্রশংসার্হ আল্লাহে’ (বুরূজ ৪-৮)।
[ছহীহ মুসলিম হা/৩০০৫ ‘যুহদ ও রিক্বাক্ব’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-১৭, ছুহাইব বিন সিনান আর-রূমী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, আহমাদ হা/২৩৯৭৬]।
শিক্ষা :
১. প্রত্যেকটি আদম সন্তান স্বভাবধর্ম ইসলামের উপর জন্মগ্রহণ করে।
২. মুমিন বান্দা সর্বদা আল্লাহকে স্মরণ করবে ও কায়মনোবাক্যে তাঁর নিকট দো‘আ করবে।
৩.
রোগমুক্তির মালিক একমাত্র আল্লাহ; কোন পীর-ফকীর বা সাধু-সন্ন্যাসী নয়।
৪. আল্লাহর পথের নির্ভীক সৈনিকেরা বাতিলের সামনে কখনো মাথা নত করে না।
৫. মুমিন দুনিয়াবী জীবনে পদে পদে পরীক্ষার সম্মুখীন হবে। এর মাধ্যমে আল্লাহ তার ঈমানের মযবূতী পরখ করেন।
৬. হক্বের বিজয় অবশ্যম্ভাবী।