গল্পের মাধ্যমে জ্ঞান

সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস, অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ

এক গ্রামে ত্বাইয়েব ও তাহের নামে দুই বন্ধু ছিল। তাদের মধ্যে ছিল দারুণ বন্ধুত্ব। যাকে বলে গলায় গলায় ভাব। এদের মধ্যে ত্বাইয়েব এলাকায় ভাল ছেলে হিসাবে পরিচিত ছিল। লেখা-পড়া, চাল-চলন, আচার-আচরণে আর পাঁচটা ছেলের চেয়ে ছিল সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। পক্ষান্তরে তাহের ছিল দুষ্ট প্রকৃতির। দুষ্টুমিতে তার কোন জুড়ি ছিল না। গ্রামে কারো গাছের পেয়ারা, কারো পেঁপে, কারো তাল, কারো নারিকেল চুরি করে খাওয়াই ছিল তার নিত্যদিনের অভ্যাস। কাউকে গালি দেওয়া, কাউকে অযথা চড়-থাপ্পড় মারা ছিল তার মজ্জাগত দোষ। গ্রামের প্রভাবশালী মোড়লের ছেলে বলে তার গায়ে কেউ হাত তোলার সাহস পেত না। কিন্তু গ্রামবাসী তাকে কখনো ভাল চোখে দেখত না। কোন লোক তার ছেলে বা ভাই-ভাতিজাকে তাহেরের সঙ্গে মিশতে দিত না।

একদিন স্কুলে যাওয়ার পথে ত্বাইয়েব দুর্ঘটনায় পতিত হয়। ত্বাইয়েবের এ বিপদ মুহূর্তে তাহের এগিয়ে আসে। তাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়, তাদের বাড়িতে খবর দেয়। এজন্য কৃতজ্ঞতা জানাতে ত্বাইয়েব তাহেরের বাড়িতে যায়। এ থেকে দু’জন দু’জনের বাড়িতে আসা-যাওয়া শুরু করে। ফলে তাদের মধ্যে সখ্যতা আরো বাড়ে। কালক্রমে তাহেরের দুষ্ট চরিত্রের অসৎ গুণাবলী ত্বাইয়েবের মাঝে সঞ্চারিত হয়। সেও লিপ্ত হয় নানা গর্হিত কাজে। ফলে তার লেখাপড়ায় দুর্বলতা চলে আসে। বন্ধুরা তার ধারে কাছে ঘেঁষে না, শিক্ষকরাও তাকে আর ভাল চোখে দেখেন না। গ্রামের লোকেরা পরস্পর বলাবলি করতে থাকে, দুষ্ট তাহেরের খপ্পরে পড়ে সোনার টুকরা ত্বাইয়েব ছেলেটাও দিন দিন গোল্লায় যেতে বসেছে।

একদিন ত্বাইয়েবের কানেও এসব কথা চলে আসে। তখন সে ভাবতে থাকে, তার এই অধঃপতনের মূল কারণ কি? সে চিন্তা করতে থাকে এক সময় আমি ক্লাসে প্রথম হ’তাম, এখন আমার রোল নম্বর দশের নীচে। এক সময় ক্লাসের ছেলেরা আমার পিছে পিছে ঘুরত অংক, ইংরেজী বুঝে নেওয়ার জন্য। অথচ আজ আমি সবার চোখে খারাপ হয়ে গেছি। অন্তরঙ্গ বন্ধু আব্দুল্লাহও আমার কাছ থেকে দূরে চলে গেছে। লেখাপড়ায় সে ব্যাপক উন্নতি ও ঈর্ষণীয় সাফল্য লাভ করেছে। চরিত্র-মাধুর্যেও সে সকলের প্রশংসা কুড়িয়েছে। আজ সে গ্রামের ভাল ছেলে বলে পরিচিত। এর মূল কারণ খুঁজতে গিয়ে সে রহস্য উদঘাটন করে যে, স্কুলের ধর্মীয় শিক্ষক বিশিষ্ট আলেমে দ্বীন মাওলানা আব্দুর রহমান স্যারের সাথে আব্দুল্লাহর সম্পর্ক। তাঁর কথামত সে চলে। পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত আদায় করে। নিয়মিত পড়াশুনা করে। খারাপ ছেলেদের সাথে মিশে না। পড়ালেখার ফাঁকে অবসর সময়ে ধর্মীয় বই-পুস্তক পড়ে এবং কুরআন-হাদীছ অধ্যয়ন করেই তার সময় কাটে। তাই তার এত সুনাম, লোকের মুখে মুখে তার প্রশংসা। ত্বাইয়েব মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে, তাকেও আব্দুল্লাহর মত হ’তে হবে। ত্বাইয়েব তার প্রতিজ্ঞা অনুযায়ী মাওলানা আব্দুর রহমান ছাহেবের নিকট গিয়ে বলল, স্যার! আমি খারাপ হয়ে গেছি, শেষ হয়ে গেছে আমার ক্যারিয়ার। এ থেকে উত্তরণের উপায় কি? কিভাবে আমি ভাল হ’তে পারি স্যার? মাওলানা আব্দুর রহমান বললেন, তুমি আগে এরূপ ছিলে না। সঙ্গদোষে তোমার এ অবস্থা? তোমাকে আমি একটি হাদীছ শুনাব,

عَنْ أَبِيْ مُوْسَى رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَثَلُ الْجَلِيْسِ الصَّالِحِ وَالسُّوْءِ كَحَامِلِ الْمِسْكِ وَنَافِخِ الْكِيْرِ، فَحَامِلُ الْمِسْكِ إِمَّا أَنْ يُّحْذِيَكَ وَإِمَّا أَنْ تَبْتَاعَ مِنْهُ وَ إِمَّا أَنْ تَجِدَ مِنْهُ رِيْحًا طَيِّبَةً، وَنَافِخُ الْكِيْرِ إِمَّا أَنْ يُّحْرِقَ ثِيَابَكَ وَإِمَّا أَنْ تَجِدَ مِنْهُ رِيْحًا خَبِيْثَةً-

আবূ মূসা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘সৎ সঙ্গী এবং অসৎ সঙ্গীর দৃষ্টান্ত হচ্ছে, মিশকে আম্বরওয়ালা ও হাপরওয়ালার ন্যায়। মিশকে আম্বরওয়ালা তোমাকে কিছু দান করবে কিংবা তুমি তার কাছ থেকে কিছু সুগন্ধি ক্রয় করবে অথবা তার নিকট থেকে তুমি সুগন্ধি লাভ করবে। আর হাপরওয়ালা তোমার জামা-কাপড় জ্বালিয়ে দেবে কিংবা তার নিকট থেকে তুমি দুর্গন্ধ পাবে’ (বুখারী হা/৫৫৩৪; মিশকাত হা/৫০১০)

এ হাদীছ থেকে আমাদের জন্য শিক্ষা হ’ল, চরিত্রবান, সৎ ও ভদ্র দেখে বন্ধু নির্বাচন করতে হবে। পাশাপাশি তোমাকে নিয়মিত ছালাত আদায়, অবসরে কুরআন-হাদীছ অধ্যয়ন এবং প্রতিদিন নিয়মিত ৫/৬ ঘণ্টা পড়ালেখা করতে হবে। খারাপ বন্ধুদের সঙ্গ পরিহার করে চলতে হবে। আড্ডা দেওয়া বন্ধ করতে হবে। এসব যদি মেনে চলতে পার, তাহ’লে অতি অল্প সময়ের মধ্যে তুমি সকলের প্রিয়পাত্রে পরিণত হ’তে পারবে।

অতঃপর ত্বাইয়েব তার শিক্ষকের পরামর্শমত চলতে শুরু করে। অল্পদিনের মধ্যে লেখাপড়ায় তার যথেষ্ট উন্নতি হয়। বিনা প্রয়োজনে সে বাড়ির বাইরে যায় না। খারাপ ছেলেদের সাথে মিশে না। অবসরে সাহিত্যচর্চা করে, ধর্মীয় বই পড়ে। এভাবে চলতে চলতে অল্পদিনের মধ্যেই ত্বাইয়েব সবার মন জয় করতে সক্ষম হয়। সবাই তাকে দেখলে পূর্বের মত আদর করে। বাবা-মা তাকে নিয়ে গর্ব করেন। সামনে তার ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা। শিক্ষক-অভিভাবক সবার প্রত্যাশা ত্বাইয়েব এবার আরো ভাল করবে।

শিক্ষা : সৎ ও উত্তম চরিত্রের অধিকারীদের সাথে বন্ধুত্ব করতে হবে। অসৎসঙ্গ সর্বদা পরিহার করতে হবে। ছেলে-মেয়ের বন্ধু-বান্ধব সম্পর্কে অভিভাবকদেরও সতর্ক থাকতে হবে। কোনক্রমেই যাতে চরিত্রহীনদের সাথে তাদের বন্ধুত্ব না হয়, সে বিষয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিতে হবে।