লোভী বণিক
বাদশাহ হারূণুর রশীদ নগর ভ্রমণে বেরিয়েছেন। এক অন্ধ ফকীর তাঁর কাছে ভিক্ষা চাইল। তিনি ফকীরকে ভিক্ষা দিলেন। ফকীর ভিক্ষা পাবার পর স্বীয় কপালে সজোরে আঘাত করতে বলল। বাদশাহ আঘাত করতে ইতস্ততঃ করলে ফকীর বলল, কপালে আঘাত না করলে দান ফিরিয়ে নিন। বাদশাহ অগত্যা তার কপালে মৃদু আঘাত করলেন। বাদশাহ বুঝলেন, এ ফকীরের নিশ্চয়ই কিছু জীবনেতিহাস আছে। তাই তিনি দরবারে এসে ফকীরকে ডাকলেন এবং জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি ভিক্ষা পাবার পর কপালে আঘাত করতে বললে কেন?’
ফকীর তখন তার জীবনের ঘটনা বলতে শুরু করল। ফকীর বলল, ‘আমি এই বাগদাদ শহরের একজন বড় ব্যবসায়ী ছিলাম। ব্যবসা পরিচালনার জন্য আমার ৪০টি উট ছিল। একদিন আমি ৪০টি উটে মাল বোঝাই করে দূরের এক শহরে মাল বিক্রি করে ফিরছিলাম। দেখলাম, পথে একটি গাছের ছায়ায় একজন ফকীর বসে আছে। আমিও খাবার জন্য ঐ গাছের নীচে বসলাম। আমরা দু’জনে মিলে খাওয়া-দাওয়া করলাম। ফকীরের সাথে আমার কিছুটা হৃদ্যতা সৃষ্টি হল। ফকীর বলল, সামনের ঐ পাহাড়ের অভ্যন্তরে প্রচুর গুপ্তধন রয়েছে। আমি ছাড়া আর কোন ব্যক্তি এর সন্ধান জানে না। ফকীরের সাথে চুক্তি হ’ল যে, সে ২০টি উটে মাল বোঝাই করবে আর আমি ২০টি উটে মাল বোঝাই করব। অতঃপর আমরা দু’জনে উটগুলি নিয়ে পাহাড়ের কাছে পৌঁছলাম এবং সুড়ঙ্গ পথে উটগুলি প্রবেশ করিয়ে কিছুদূর অগ্রসর হলাম। ইত্যবসরে সেখানে এত সম্পদ স্তূপীকৃত অবস্থায় দেখতে পেলাম যে, ২০টি কেন ১০০টি উটও তা বহন করে নিয়ে যেতে পারবে না।
অতঃপর আমি ২০টি উটে মাল বোঝাই করলাম। ফকীরও ২০টি উটে মাল বোঝাই করল। হঠাৎ দেখলাম, ফকীর কৌটার মত কি যেন একটা কুড়িয়ে নিল। আমরা বের হয়ে এলাম। পথ চলতে চলতে আমার মনে হ’তে লাগল, এ ভাগ ঠিক হয়নি। তাই আমি ফকীরকে বললাম, তুমি ফকীর মানুষ, এত সম্পদ দিয়ে তুমি কি করবে? আমাকে ১০টি উট ফিরিয়ে দাও। ফকীর তৎক্ষণাৎ ১০টি উট দিল। একটু পরে আবার আমার মনে হ’তে লাগল, ফকীরের অর্থের কি প্রয়োজন আছে? তাই পুনরায় তাকে বললাম, তুমি সংসারত্যাগী ফকীর। তোমার অর্থের কি দরকার? অবশিষ্ট ১০টি উট আমাকে দিয়ে দাও। ফকীর মোটেও আপত্তি করল না। আমি ৪০টি উট নিয়ে পথ চলতে লাগলাম। কিছুদূর অগ্রসর হয়ে আমার মনে সন্দেহ দেখা দিল। ফকীর এত সহজেই আমাকে সবগুলি উট ফিরিয়ে দিল কেন? আমার মনে হ’ল, ফকীর যে কৌটাটা কুড়িয়ে পেয়েছে নিশ্চয়ই এর কিছু তাৎপর্য আছে। আমি ঐ কৌটার বিষয় জানতে ফকীরের নিকট ফিরে আসলাম এবং এ বিষয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলাম। ফকীর বলল, এই কৌটায় এক প্রকার মলম রয়েছে। যা ডান চোখে লাগালে মাটির অভ্যন্তরে কোথায় কি সম্পদ লুক্কায়িত আছে তা স্পষ্ট দেখা যাবে। আবার বাম চোখে লাগালে সাথে সাথে দুই চোখ অন্ধ হয়ে যাবে। কোন কিছুতেই তাকে আর ভাল করা যাবে না।
পরীক্ষা স্বরূপ আমি ফকীরকে আমার ডান চোখে মলম লাগিয়ে দিতে বললাম। মলম লাগানোর পর মাটির অভ্যন্তরে লুক্কায়িত সম্পদ আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম। এখন আমার মনে হ’ল, বাম চোখে মলম লাগালে ফল আরো ভাল হবে। তাই আমি আমার বাম চোখেও মলম লাগাতে বললাম। ফকীর রাযী হচ্ছিল না। কিন্তু কেন যেন আমার যিদ চেপে বসল। আমার পীড়াপীড়িতে ফকীর বাম চোখে মলম লাগিয়ে দিল। সাথে সাথে আমি দুই চোখের দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেললাম। আমি অন্ধ হয়ে পথে বসে রইলাম। এদিকে ফকীর আমার সব উট নিয়ে চলে গেল। এই বাগদাদেরই কতিপয় বণিক ঐ পথে ফিরছিল। আমার এই অবস্থার কারণ জানতে পেরে তারা আমাকে শহরে পৌঁছে দিল।
অতঃপর আমার জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা এল। কিন্তু আত্মহত্যা করতেও পারলাম না। আমার এই পরিণতির জন্য নিজকে ধিক্কার দিতে লাগলাম। নিজ কৃতকর্মের শাস্তি হিসাবে কপালে আঘাত গ্রহণ সাব্যস্ত করলাম। আঘাত না করলে কারো দান আমি গ্রহণ না করতে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ হ’লাম।
শিক্ষা : লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু।