ফের্কাবন্দীর অর্থ
ফের্কাবন্দীর অর্থ ‘আক্বীদাগত বিভক্তির কারণে সৃষ্ট দলাদলি’ (افتراق الأمة بافتراق العقائد)। আলোচ্য হাদীছে افةراق الأمة বা উম্মতের ফের্কাবন্দী বলতে ছাহাবা, তাবেঈন ও আয়েম্মায়ে মুজতাহেদীনের সুধারণা প্রসূত ব্যাখ্যাগত মতপার্থক্য কিংবা শরী‘আতের ব্যবহারিক শাখা-প্রশাখাগত বিষয়ে পার্থক্যকে বুঝানো হয়নি। অথবা দুনিয়াবী কোন বিষয়ে বিরোধ ও বিভক্তিকে বুঝানো হয়নি। বরং বিভিন্ন শিরকী ও বিদ‘আতী আক্বীদা ও আমলের উদ্ভব ঘটিয়ে তার ভিত্তিতে সৃষ্ট দলসমূহকে বুঝানো হয়েছে। যারা প্রত্যেকে নিজেকে সঠিক বলে দাবী করে ও অন্যকে কাফির-ফাসিক ইত্যাদি বলে আখ্যায়িত করে। যাদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কহীনতা, শত্রুতা এমনকি হানাহানির অবস্থা বিরাজ করে। ৩৭ হিজরীর পর থেকে যার উদ্ভব ঘটে খারেজী ও শী‘আ নামে এবং প্রথম শতাব্দী হিজরীর শেষ দিকে উদ্ভব হয় ক্বাদারিয়া, জাবরিয়া, মুরজিয়া, অতঃপর মু‘তাযিলা প্রভৃতি ভ্রান্ত দলসমূহের। এই সংখ্যা ক্রমেই বাড়তে থাকে।
(১) আল্লাহর উপরে (২) তাঁর ফিরিশতাগণের উপরে (৩) আল্লাহ প্রেরিত কিতাব সমূহের উপরে (৪) রাসূলগণের উপরে (৫) বিচার দিবসের উপরে এবং (৬) তাক্বদীরের ভাল-মন্দের উপরে বিশ্বাস স্থাপন করা (মুসলিম, মিশকাত হা/২)।
উল্লেখ্য যে, দুনিয়াবী বিষয়ে পারস্পরিক মতপার্থক্য ও বিভক্তি তখনই গোনাহের চূড়ান্ত পর্যায়ে উপনীত হবে, যখন তা আক্বীদাগত ও দ্বীনী বিভ্রান্তি সৃষ্টি করবে। যেমন হযরত আলী ও মু‘আবিয়া (রাঃ)-এর মধ্যকার পারস্পরিক রাজনৈতিক মতবিরোধ ও পরিণামে যুদ্ধ-বিগ্রহ-কে কেন্দ্র করে পরবর্তীতে সৃষ্টি হয় চরমপন্থী খারেজী ও শী‘আ মতবাদ, যা একেবারেই ভ্রান্ত।
বস্ত্ততঃ বৈষয়িক মতভেদের কারণে দ্বীনী বিভক্তি সৃষ্টি করা ইহূদী-নাছারাদের স্বভাব। যা মুসলমানদের মধ্যে প্রবেশ করেছে। তাই দেখা যায়, বৈষয়িক বিবাদ বা রাজনৈতিক মতভেদকে কেন্দ্র করে মুসলমানেরা নানা দলে ও মযহাবে বিভক্ত হচ্ছে এবং মসজিদ-ঈদগাহ পৃথক করছে। যা আল্লাহর কাছে আদৌ গৃহীত হবে না। প্রকৃত মুমিন যারা, তারা এসব থেকে দূরে থাকবে। আল্লাহ বলেন, كَانَ النَّاسُ أُمَّةً وَاحِدَةً فَبَعَثَ اللهُ النَّبِيِّينَ مُبَشِّرِينَ وَمُنْذِرِيْنَ وَأَنْزَلَ مَعَهُمُ الْكِتَابَ بِالْحَقِّ لِيَحْكُمَ بَيْنَ النَّاسِ فِيْمَا اخْتَلَفُوْا فِيْهِ وَمَا اخْتَلَفَ فِيْهِ إِلاَّ الَّذِيْنَ أُوْتُوْهُ مِنْ بَعْدِ مَا جَاءَتْهُمُ الْبَيِّنَاتُ بَغْيًا بَيْنَهُمْ فَهَدَى اللهُ الَّذِيْنَ آمَنُوْا لِمَا اخْتَلَفُوْا فِيْهِ مِنَ الْحَقِّ بِإِذْنِهِ وَاللهُ يَهْدِي مَنْ يَشَاءُ إِلَى صِرَاطٍ مُسْتَقِيْمٍ. ‘মানবজাতি সকলে একই সম্প্রদায়ভুক্ত ছিল। অতঃপর আল্লাহ নবীগণকে প্রেরণ করলেন জান্নাতের সুসংবাদ দাতা ও জাহান্নামের ভয় প্রদর্শনকারী রূপে। আর তিনি তাদের সাথে সত্যসহ কিতাব নাযিল করলেন, যাতে তা তাদের মতভেদের বিষয়গুলি সমাধান করে দেয়। অথচ যারা কিতাব প্রাপ্ত হয়েছিল, তাদের নিকট স্পষ্ট নিদর্শন সমূহ এসে যাওয়ার পরেও তারা আল্লাহর কিতাবে মতভেদ ঘটালো পরস্পরে হঠকারিতা বশতঃ। অতঃপর আল্লাহ স্বীয় অনুগ্রহে ঈমানদারগণকে এ ব্যাপারে সত্যের দিকে পথপ্রদর্শন করলেন। বস্ত্ততঃ আল্লাহ যাকে ইচ্ছা সরল পথ প্রদর্শন করে থাকেন’ (বাক্বারাহ ২/২১৩)।
এতে দেখা যাচ্ছে যে, পারস্পরিক হিংসা-অহংকার এবং যিদ ও হঠকারিতাই হ’ল ফের্কাবন্দীর মূল কারণ। অহংকার কাকে বলে সে বিষয়ে রাসূল (ছাঃ) বলেন, الْكِبْرُ بَطَرُ الْحَقِّ وَغَمْطُ النَّاسِ ‘অহংকার হ’ল সত্যকে দম্ভের সাথে পরিত্যাগ করা ও মানুষকে হেয় এবং তুচ্ছ জ্ঞান করা’।[1] বস্ত্ততঃ ইহূদী-নাছারারা শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে সত্য জেনেও তাঁকে মানেনি (বাক্বারাহ ২/১৪৬) কেবল বিদ্বেষ বশতঃ। কিন্তু আল্লাহ তাদের মধ্য থেকে ঈমানদার একটি দলকে ইসলামের প্রতি হেদায়াত দান করেছিলেন এবং তারা ইসলাম কবুল করে ধন্য হয়েছিল। যেমন আব্দুল্লাহ বিন সালাম, আদী বিন হাতেম, বাদশাহ নাজাশী প্রমুখ বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গ ও তাঁদের অনুসারীগণ। এরাই ছিলেন আহলে কিতাবদের মধ্যে নাজী ফের্কা।
নেককার মানুষ কখনোই বিভক্তি চায় না। দুষ্টু নেতারাই সমাজে বিভক্তি সৃষ্টি করে যিদ ও অহংকার বশে। অথচ দোষ চাপায় হকপন্থী সৎলোকদের উপরে। এমতাবস্থায় নাজী ফের্কার লোকেরা হক-এর উপর দৃঢ় থাকে এবং অন্যদের বিষয়টি আল্লাহর উপর ছেড়ে দেয়। যেমন আল্লাহ বলেন, فَإِنْ آمَنُوا بِمِثْلِ مَا آمَنْتُمْ بِهِ فَقَدِ اهْتَدَوْا وَإِنْ تَوَلَّوْا فَإِنَّمَا هُمْ فِي شِقَاقٍ فَسَيَكْفِيكَهُمُ اللهُ وَهُوَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ ‘অনন্তর যদি তারা বিশ্বাস স্থাপন করে যেরূপ তোমরা বিশ্বাস স্থাপন করেছ, তাহ’লে তারা সুপথপ্রাপ্ত হবে। আর যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তাহ’লে তারা যিদ-এর মধ্যে রয়েছে। অতএব তাদের ব্যাপারে তোমার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট। তিনি সবকিছু শোনেন ও জানেন’ (বাক্বারাহ ২/১৩৭)। এতে পরিষ্কার যে, নাজী ফের্কা কখনো বাতিলের মধ্যে মিশে একাকার হয়ে যাবে না। তারা সর্বদা নিজ আক্বীদা ও বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল থাকবে।
ব্যবহারিক শাখা-প্রশাখাগত বিষয়ে বিভিন্ন মাযহাবী পার্থক্য মূলতঃ দোষণীয় নয়। কিন্তু এটা দোষণীয় এবং কবীরা গোনাহের পর্যায়ে পৌঁছে যায় তখনই, যখন তার কারণে তাক্বলীদ[2] সৃষ্টি হয় এবং নিজের মাযহাবের বাইরের কোন ছহীহ হাদীছকে অগ্রাহ্য বা এড়িয়ে যাওয়া হয়। সাথে সাথে তার ভিত্তিতে উম্মত বিভক্ত হয় ও পারস্পরিক দলাদলি ও হিংসা-হানাহানিতে লিপ্ত হয়। নিঃসন্দেহে এটাও ফের্কাবন্দী, যা থেকে আল্লাহ নিষেধ করেছেন (আন‘আম ৬/১৫৯)।
(ثَلاَثٍ وَّسَبْعِيْنَ مِلَّةً) ‘৭৩ ফের্কা’। এর তাৎপর্য বিষয়ে বিদ্বানগণের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। এর সংখ্যা কি ৭৩-য়ে সীমায়িত, না কি এর অর্থ অগণিত? কেউ বলেছেন, এর অর্থ অগণিত। কেননা বিদ‘আতী দল ও উপদলের সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। ক্বিয়ামত পর্যন্ত তার সংখ্যা গণনা করাই কষ্টসাধ্য ব্যাপার হবে। কেউ বলেছেন যে, সংখ্যা যতই বৃদ্ধি পাক, তার সংখ্যা ৭৩-এর মধ্যেই সীমায়িত হ’তে হবে। এ বিষয়ে বিদ্বানগণ বিদ‘আতী ফের্কা সমূহের সংখ্যা গণনা করেছেন। যেমন কোন কোন বিদ্বান বলেছেন, উছূল বা মূলনীতির দিক দিয়ে সকল বিদ‘আতী ও ভ্রান্ত ফের্কা ৪টি মূল দলে বিভক্ত : খারেজী, শী‘আ, ক্বাদারিয়া ও মুর্জিয়া। প্রত্যেকটি দল ১৮টি করে উপদলে বিভক্ত হয়ে মোট ৭২টি দল হয়েছে। বাকী ১টি দল হ’ল নাজী ফের্কা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত’। আব্দুল করীম শাহরাস্তানীও অনুরূপ চারটি মূল দলে বিভক্ত করেছেন। কোন কোন বিদ্বান উপরোক্ত চারটি দলের সাথে আরও চারটি যোগ করে মোট ৮টি মূল দল বলেছেন। বাকী ৪টি হ’ল মু‘তাযিলা, মুশাবিবহা, জাবরিয়া ও নাজ্জারিয়া। কেউ বলেছেন, মূল দল হ’ল ৬টি : হারূরিয়া (খারেজী), ক্বাদারিয়া, জাহমিয়া, মুর্জিয়া, রাফেযাহ (শী‘আ), জাবরিয়া। তবে শেষের ৮টি ও ৬টি প্রথম ৪টির মতই। তাই উত্তম হবে ভ্রান্ত দল সমূহের সংখ্যা নির্দিষ্ট না করা। যার সবগুলি নাজী ফের্কার আক্বীদা ও আমলের বিরোধী। ভ্রান্ত ফের্কাগুলির বিস্তৃত আক্বীদা জানার জন্য ইবনু হযমের আল-ফিছাল, শাহরাস্তানীর আল-মিলাল, আব্দুল ক্বাহের বাগদাদীর উছূলুদ্দীন এবং আল-ফারকু বায়নাল ফিরাক্ব, আব্দুল কাদের জীলানীর কিতাবুল গুনিয়াহ, শাত্বেবীর আল-ই‘তিছাম প্রভৃতি গ্রন্থ দ্রষ্টব্য।
তবে আবু ইসহাক শাত্বেবী, আবুবকর তারতূশী, ছাহেবে মির‘আত ওবায়দুল্লাহ মুবারকপুরী প্রমুখের চিন্তাধারা এই যে, ফের্কায়ে নাজিয়াহর বিপরীতে ভ্রান্ত দল সমূহের এই সংখ্যাকে ৭২-এর মধ্যে সীমায়িত করা যুক্তিসংগত নয়। কেননা ক্বিয়ামত পর্যন্ত ভ্রান্ত দল ও উপদলের সংখ্যা বাড়তেই থাকবে। শাত্বেবী বলেন, ভ্রান্ত দলসমূহকে দু’ভাগে ভাগ করা যায়। এক- যাদের সম্পর্কে হাদীছে সাবধান করা হয়েছে। যেমন- খারেজী, মুর্জিয়া, ক্বাদারিয়া প্রভৃতি। দুই- যাদের সম্পর্কে হাদীছে নাম করে কিছু বলা হয়নি। অথচ এরাই হ’ল হাদীছের ভাষায় قُلُوبُهُمْ قُلُوبُ الشَّيَاطِينِ فِى جُثْمَانِ إِنْسٍ অর্থাৎ ‘মানবরূপী শয়তান’।[3] যারা বিভিন্ন যুক্তি ও জৌলুসের মাধ্যমে সরল-সিধা মুমিনকে পথভ্রষ্ট করে।
এদের কতগুলি নিদর্শন ও বৈশিষ্ট্য রয়েছে। যেগুলিকে দু’ভাগে ভাগ করা যায়। সংক্ষিপ্ত (إجمالي) ও বিস্তারিত (تفصيلي)। প্রথমটির মৌলিক নিদর্শন হ’ল তিনটি। যথা- (ক) বিভেদ সৃষ্টি করা (الفُرقة)। যার মাধ্যমে তারা পরস্পরে বিদ্বেষ, শত্রুতা ও ষড়যন্ত্রের সূত্রপাত করে, যা ধর্মীয় ও সামাজিক ঐক্য ধ্বংসের কারণ হয়। (খ) ‘মুহকাম’ (স্পষ্ট) আয়াত সমূহ বাদ দিয়ে কুরআনের ‘মুতাশাবিহ’ (অস্পষ্ট) আয়াত সমূহের পিছে পড়ে থাকা। (গ) প্রবৃত্তির অনুসরণ করা এবং নিজস্ব রায়কে শারঈ দলীল সমূহের উপরে অগ্রাধিকার দেয়া। অতঃপর প্রত্যেক ভ্রান্ত ব্যক্তি বা দলের বিস্তারিত নিদর্শন সমূহ (علاماة ةفصيلية) কুরআন ও সুন্নাহর দলীল সমূহের প্রতি দৃকপাত করলে যেকোন দূরদৃষ্টি সম্পন্ন আলেম তাদেরকে সহজে চিহ্নিত করতে পারবেন’।[4]
আমরা মনে করি যে, ৭১, ৭২ ও ৭৩ বলে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আরবীয় বাকরীতি অনুযায়ী ‘আধিক্য এবং আধিক্যের পরিমাণ’ বুঝাতে চেয়েছেন। তিনি এ বিষয়টি পরিষ্কার করতে চেয়েছেন যে, ক্বিয়ামত যতই ঘনিয়ে আসবে, উম্মতের ভাঙন, পদস্খলন ও ফের্কাবন্দী ততই বৃদ্ধি পাবে। অতএব অগ্রগামী উম্মত হিসাবে ইহূদীরা ৭১ দলে, পরবর্তী উম্মত হিসাবে নাছারাগণ ৭২ দলে এবং তার পরবর্তী ও সর্বশেষ উম্মত হিসাবে মুসলিম উম্মাহ ৭৩ দলে বিভক্ত হবে। অর্থাৎ তাদের ভাঙন ও অধঃপতন বিগত সকল উম্মতের চাইতে বেশী হবে। এভাবে সারা পৃথিবীতে যখন একজন তাওহীদপন্থী মুমিনও অবশিষ্ট থাকবে না, তখনই ক্বিয়ামত সংঘটিত হবে।[5]
(كُلُّهُمْ فِي النَّارِ) ‘তাদের সবাই জাহান্নামে যাবে’। অর্থাৎ كلهم يستحقون الدخول في النار من أجل اختلاف العقائد ‘সবাই জাহান্নামে প্রবেশের হকদার হবে ভ্রান্ত আক্বীদা সম্পন্ন হওয়ার কারণে’। অতঃপর যাদের আক্বীদা কুফরীর পর্যায়ভুক্ত ছিল, তারা চিরস্থায়ীভাবে জাহান্নামী হবে (নিসা ৪/১৬৮-৬৯)। তাছাড়া ‘যে ব্যক্তি শিরক করে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাতকে হারাম করে দেন’ (মায়েদাহ ৫/৭২)। একইভাবে কপটবিশ্বাসী মুনাফিকরাও কাফিরদের সাথে চিরস্থায়ীভাবে জাহান্নামী হবে (তওবা ৯/৬৮)। পক্ষান্তরে যাদের আক্বীদা ঐরূপ নিম্নপর্যায়ভুক্ত ছিল না, তাদেরকে আল্লাহ ক্ষমা না করলে জাহান্নামে যাবে। আর ক্ষমা করলে মুক্তি পাবে। কেননা ‘আল্লাহ শিরক ব্যতীত অন্য সকল গোনাহ যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করতে পারেন’ (নিসা ৪/৪৮, ১১৬)। তবে শেষোক্ত পর্যায়ের জাহান্নামীরা তাদের খালেছ ঈমানের কারণে এবং রাসূল (ছাঃ)-এর শাফা‘আতের ফলে আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহে অবশেষে মুক্তি পাবে ও জান্নাতে যাবে।[6]
(إِلاَّ مِلَّةً وَاحِدَةً) ‘একটি দল ব্যতীত’। অর্থাৎ এরা শুরুতেই জান্নাতে যাবে। এখানে مِلَّةً -এর শেষ অক্ষরে দু’যবর হয়েছে দু’যের-এর স্থলে। যাকে منصوب بنزع خافض বলা হয়ে থাকে। কেননা এটি আসলে ছিল إِلاَّ أَهْلُ مِلَّةٍ وَاحِدَةٍ ‘একটি তরীকার অনুসারী দল ব্যতীত’। অর্থাৎ এই দলের লোকেরা ছহীহ আক্বীদার অনুসারী হবে। কেননা জান্নাত লাভের জন্য বিশুদ্ধ আক্বীদাই হ’ল প্রধানতম শর্ত।
শাত্বেবী বলেন, إِلاَّ مِلَّةً وَاحِدَةً বলার মাধ্যমে একটি বিষয় প্রতিভাত হয়েছে যে, إن الحق واحد لا يختلف ‘হক একটাই হয়। একাধিক নয়’। হাদীছে জাহান্নামী দলসমূহের বিপরীতে একটিমাত্র জান্নাতী দলের উল্লেখ করার মধ্যেই প্রমাণিত হয়েছে যে, হাযারো দাবী করলেও ভ্রান্ত দলগুলি কখনোই হকপন্থী নয়। হক মাত্র একটি দলের সাথেই রয়েছে। إِلاَّ مِلَّةً وَاحِدَةً বলার মাধ্যমে একথাও ফুটে উঠেছে যে, অন্যান্য দলের ভ্রান্ত আক্বীদা ও আমলের ফায়ছালাকারী হ’ল এই একটি দল। যেমন আল্লাহ বলেন, فَإِنْ تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللهِ وَالرَّسُوْلِ ‘যদি তোমরা কোন বিষয়ে ঝগড়া কর, তাহ’লে সে বিষয়টিকে ফিরিয়ে দাও আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দিকে’ (নিসা ৪/৫৯)। অতএব কুরআন ও সুন্নাহর (প্রকাশ্য অর্থের) অনুসারীদের জন্য কোনরূপ ফের্কা সৃষ্টির অবকাশ নেই’।
(قَالُوْا وَمَنْ هِيَ يَا رَسُوْلَ اللهِ؟) ‘তারা বললেন, সেই দল কোনটি হে আল্লাহর রাসূল?’ অর্থাৎ সেই মুক্তিপ্রাপ্ত দল কোনটি?
(قَالَ مَا أَنَا عَلَيْهِ وَأَصْحَابِيْ) ‘তিনি বললেন, আমি ও আমার ছাহাবীগণ যে তরীকার উপরে আছি, তার উপরে যারা দৃঢ় থাকবে’। হাকেম বর্ণিত ‘হাসান’ সনদে এসেছে, مَا أَنَا عَلَيْهِ الْيَوْمَ وَأَصْحَابِي ‘আজকের দিনে আমি ও আমার ছাহাবীগণ যার উপরে আছি’।[7] এর অর্থ, أهل تلك الملة الواحدة من كان على ما أنا عليه وأصحابي من الاعتقاد والقول والعمل- ‘উক্ত মুক্তিপ্রাপ্ত দলভুক্ত লোক তারাই হবে, যারা আমার ও আমার ছাহাবীগণের বিশ্বাস, কথা ও কর্মের উপরে দৃঢ় থাকবে’। এর দ্বারা প্রতিভাত হয় যে, রাসূল (ছাঃ)-এর সুন্নাত ও খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাত এবং ছাহাবায়ে কেরামের বুঝ অনুযায়ী কুরআন ও সুন্নাহর বুঝ হাছিল করা ও সেমতে জীবন পরিচালনা করাটাই নাজী ফের্কার লোকদের প্রধান বৈশিষ্ট্য। কেননা ছাহাবীগণ সরাসরি আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট থেকে দ্বীন শিখেছেন এবং দ্বীন সম্পর্কে তারাই স্থান-কাল-পাত্র বিবেচনায় চাক্ষুষ জ্ঞান লাভ করেছেন। হাদীছে দলের নাম করা হয়নি। বরং তাদের বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলী বর্ণিত হয়েছে। আর এটাই আরবদের বাকরীতি ছিল। কেননা আমলটাই বড় কথা, আমলকারী নয়।
এক্ষণে যে সকল মুমিন নর-নারী রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাত তথা কুরআন ও সুন্নাহ অনুযায়ী সার্বিক জীবন পরিচালনায় ব্রতী হবেন, তারাই হবেন মুক্তিপ্রাপ্ত দলের অন্তর্ভুক্ত। অর্থাৎ তারা আল্লাহর রহমতে শুরুতেই জান্নাতে যাবেন। কেননা কুরআন ও সুন্নাহ হ’ল সরল পথ। এতদ্ব্যতীত ইজমা-ক্বিয়াস ইত্যাদি সেখান থেকে নির্গত বিষয়। তা কখনোই মূল নয় বা ভ্রান্তির আশংকামুক্ত নয়। আর ‘ইজমা’ বলতে কেবল ছাহাবায়ে কেরামের ইজমা-কে বুঝায়। কেননা ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (রহঃ) বলেন, مَنِ ادَّعَي الْإِجْمَاعَ (بَعْدَ الصَّحَابَةِ) فَهُوَ كَاذِبٌ ‘(ছাহাবীগণের পরে) যে ব্যক্তি (উম্মতের) ইজমা-এর দাবী করে, সে মিথ্যাবাদী’।[8] নওয়াব ছিদ্দীক হাসান খান ভূপালী (রহঃ) মাযহাবী আলেমদের যত্রতত্র ইজমা-র দাবী সম্পর্কে তীব্র মন্তব্য করে বলেন, هذه مفسدة عظيمة ‘এটি ভয়ংকর ফাসাদ সৃষ্টিকারী বিষয়’।[9][1]. মুসলিম হা/৯১, মিশকাত হা/৫১০৮ ‘শিষ্টাচার সমূহ’ অধ্যায়-২৫, ‘ক্রোধ ও অহংকার’ অনুচ্ছেদ-২০।
[2]. শারঈ বিষয়ে বিনা দলীলে কারু কোন কথার অন্ধ অনুসরণকে তাক্বলীদ বলা হয়। পক্ষান্তরে দলীলের অনুসরণকে ইত্তেবা বলা হয়। ইসলামে তাক্বলীদ নিষিদ্ধ ও ইত্তেবা অপরিহার্য।
[3]. বুখারী, মুসলিম হা/১৮৪৭; মিশকাত হা/৫৩৮২।
[4]. মির‘আত ১/২৭৩।
[5]. মুসলিম হা/১৪৮; মিশকাত হা/৫৫১৬ ‘ফিতান’ অধ্যায়-২৭ অনুচ্ছেদ-৭; আহমাদ হা/১৩১৬০।
[6]. বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৫৫৭২-৮৭ ‘কিয়ামতের অবস্থা’ অধ্যায়-২৮ ‘হাউয ও শাফা‘আত’ অনুচ্ছেদ-৪।
[7]. হাকেম হা/৪৪৪, ১/১২৯ পৃঃ; ‘মতন নিরাপদ’ যঈফাহ হা/১০৩৫-এর আলোচনা দ্রষ্টব্য ৩/১২৬ পৃঃ; তিরমিযী হা/২৬৪১; মিশকাত হা/১৭১।
[8]. মির‘আত ১/২৭৯-৮০।
[9]. ছহীহ মুসলিম-এর ভাষ্যগ্রন্থ আস-সিরাজুল ওয়াহহাজ ১/৩ পৃঃ।