ফিরক্বা নাজিয়াহ

ইহূদী-মুসলিম সামঞ্জস্য

যেমন (১) ধর্মীয় ক্ষেত্রে : আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহে মুক্তি পাওয়া ইহূদী সম্প্রদায় স্বচক্ষে তাদের জানী দুশমন ফেরাঊনকে সদলবলে সাগরে ডুবে মরতে দেখার পরেও সিরিয়ার পথে কিছুদূর এসে এক স্থানে মূর্তিপূজারীদের জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠান দেখে নবী মূসা (আঃ)-এর কাছে তারা আবদার করল, اجْعَل لَّنَا إِلَـهاً كَمَا لَهُمْ آلِهَةٌ ‘আমাদের একজন উপাস্য ঠিক করে দিন, যেমন ওদের বহু উপাস্য রয়েছে’ (আ‘রাফ ৭/১৩৮; নবীদের কাহিনী ২/৭১)। একই অবস্থা আমরা দেখতে পাই মক্কা বিজয়ের মাত্র ১৯দিন পরে হোনায়েন যুদ্ধে যাওয়ার পথে যাতু আনওয়াত্ব (ذات أنواط) নামক বটবৃক্ষের ন্যায় একটি বিশাল বৃক্ষের পাশ দিয়ে রাসূল (ছাঃ) যখন অতিক্রম করেন। ঐ বৃক্ষে কাফেররা তরবারি ঝুলিয়ে রাখতো ও তার মাধ্যমে বরকত ও বিজয় কামনা করত। তারা বলল, হে আল্লাহর রাসূল! ওদের যেমন যাতু আনওয়াত্ব আছে আমাদের তেমনি একটি যাতু আনওয়াত্ব ঠিক করে দিন। তখন রাসূল (ছাঃ) বিস্মিত হয়ে বললেন, সুবহানাল্লাহ! এটাতো তেমন কথা হ’ল যেমন মূসার কওম তাঁকে বলেছিল, ‘আমাদের একজন উপাস্য ঠিক করে দিন, যেমন ওদের বহু উপাস্য রয়েছে’ (আ‘রাফ ৭/১৩৮)। শুনে রাখ, যার হাতে আমার জীবন নিহিত তার কসম করে বলছি, لَتَرْكَبُنَّ سُنَّةَ مَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ অবশ্যই তোমরা তোমাদের পূর্ববর্তীদের রীতিসমূহের অনুসরণ করবে’।[1]

এখানে ‘তারা বলল’ অর্থ, মক্কা বিজয়ের পর সদ্য নওমুসলিম কিছু লোক বলল। ‘পূর্ববর্তীদের’ বলতে পূর্ববর্তী কিতাবধারী উম্মত ইহূদী-নাছারাদের বুঝানো হয়েছে। বস্ত্ততঃ বিগত উম্মতের এই শিরকী আক্বীদা মুসলিম উম্মাহর মধ্যেও স্থানপূজা, কবরপূজা, ছবি ও প্রতিকৃতিপূজা প্রভৃতির আকারে চালু হয়েছে।

(২) রাজনৈতিক ক্ষেত্রে : ইহূদী-নাছারাদের চালু করা জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ, গণতন্ত্র ইত্যাদি বাতিল মতবাদ সমূহ মুসলমানরা খুশী মনে গ্রহণ করেছে। অথচ জাতীয়তাবাদ মানুষকে ভাষা, বর্ণ, অঞ্চল প্রভৃতি সংকীর্ণ গন্ডীতে বিভক্ত করে ও মানবজাতিকে ভাই ভাই হওয়ার বদলে পরস্পরে শত্রুতে পরিণত করে। তুর্কী ও আরব জাতীয়তাবাদের ছুরি চালিয়ে ইহূদীরা মুসলমানদের সর্বশেষ রাজনৈতিক ঐক্যের প্রতীক ওছমানীয় খেলাফতকে ধ্বংস করেছিল। বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের ছুরি চালিয়ে খুব সহজে অখন্ড পাকিস্তানকে দ্বিখন্ডিত করা হয়েছিল। এখন আবার পাহাড়ী জাতীয়তাবাদের ছুরি চালিয়ে বাংলাদেশের এক দশমাংশ পার্বত্য চট্টগ্রামকে বিচ্ছিন্ন করার ষড়যন্ত্র চলছে। অথচ ইসলামী জাতীয়তা হ’ল বিশ্বজনীন। সেখানে আল্লাহভীরু সৎ এবং আল্লাহদ্রোহী পাপিষ্ঠ ব্যতীত মানুষে মানুষে কোন ভেদাভেদ নেই। সেখানে ভাষা, বর্ণ ও অঞ্চলের পার্থক্যকে মর্যাদা দেওয়া হলেও তাকে বিচারের মানদন্ড হিসাবে গণ্য করা হয়নি। বরং সকল মানুষকে এক আদমের সন্তান হিসাবে ইসলামী খেলাফতের অধীনে সমঅধিকার প্রদান করা হয়েছে।

ইহূদী-নাছারাদের চালান করা আরেকটি মারণাস্ত্র হ’ল ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ। যা প্রথমে মুসলমানকে ঈমানের গন্ডীমুক্ত করে। অতঃপর গণতন্ত্রের মাধ্যমে মানুষকে মানুষের দাসত্বে আবদ্ধ করে। সেই সাথে ক্ষমতাকেন্দ্রিক দলাদলি ও হানাহানিতে গণতান্ত্রিক সমাজ এখন জ্বলন্ত হুতাশনে পরিণত হয়েছে। অমনিভাবে ইহূদী-নাছারাদের চালু করা আইন ও দন্ডবিধিসমূহ মুসলিম দেশসমূহে ও তাদের আদালত সমূহে চালু রয়েছে এবং তার ভিত্তিতে মুসলমানের জেল-ফাঁস হচ্ছে। জনগণকে সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক ঘোষণা দিয়ে আল্লাহর সার্বভৌমত্বকে অস্বীকার করা হয়েছে। যা পরিষ্কার ভাবে শিরক। ‘অধিকাংশের রায়ই চূড়ান্ত’ এই বিধান চালু করে সংসদে সংখ্যাগরিষ্ট দলের মনগড়া আইনে দেশ শাসন করা হচ্ছে এবং আল্লাহর আইন তথা অহীর বিধানকে কার্যতঃ অস্বীকার করা হচ্ছে, যা স্পষ্ট শিরক।

(৩) অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে : বিশ্বসেরা কুসীদজীবী ইহূদীদের সূদ-ঘুষের পুঁজিবাদী অর্থনীতি মানবতার সবচেয়ে বড় অভিশাপ হিসাবে সকলের নিকট স্বীকৃত হলেও মুসলমান নেতাদের মাধ্যমেই  তা মুসলিম দেশসমূহে আইনসিদ্ধ রয়েছে। যা সমাজে গাছতলা ও পাঁচতলার অর্থনৈতিক বৈষম্য সৃষ্টি করেছে। আল্লাহ সূদকে হারাম করেছেন। কিন্তু মুসলিম নেতারা তা কার্যতঃ হালাল করেছেন। যা আল্লাহর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার শামিল (বাক্বারাহ ২/২৭৯)। অথচ ইসলামী অর্থনীতিতে হালাল-হারামের কঠোর অনুসৃতির ফলে সমাজে অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার কায়েম হয় এবং ধনী-গরীবের অমানবিক বৈষম্য দূরীভুত হয়।

(৪) শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে : সমাজ জীবনের অধিকাংশ ক্ষেত্রে এমনকি খাদ্যে-পোষাকে ও আচার-আচরণে, শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে আমরা ইহূদী-নাছারাদের অন্ধ অনুকরণ করে থাকি।

এমনিভাবে মুসলিম উম্মাহ প্রায় সর্বক্ষেত্রে ইহূদী-নাছারাদের অনুসারী হয়ে গেছে। যাকে অত্র হাদীছে ‘এক জোড়া জুতার পারস্পরিক সামঞ্জস্যের সাথে তুলনা করা হয়েছে।


[1]. তিরমিযী হা/২১৮০; মিশকাত হা/৫৪০৮ ‘ফিতান’ অধ্যায়।