আন্দোলনের সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত
বন্ধুগণ!
হিন্দুস্থানে ইসলামের প্রথম আগমন ঘটেছে প্রধানতঃ দু’ভাবে। এক- আরব বণিক ও ওলামায়ে দ্বীনের দাওয়াতের মাধ্যমে এবং দুই- ছাহাবায়ে কেরাম ও তাবেঈনে এযামের নেতৃত্বে সশস্ত্র জিহাদের মাধ্যমে।
ভূমধ্যসাগর হ’তে আরব সাগর হয়ে বঙ্গোপসাগরের বুক চিরে আন্দামান দ্বীপপুঞ্জ অতিক্রম করে আরব বণিকগণ সুদূর চীনদেশে বাণিজ্য করতেন। ইসলাম গ্রহণের পর সর্বপ্রথম তাদের মাধ্যমে এই দীর্ঘ সমুদ্র পথের কুলে কুলে অবস্থিত বাণিজ্য কেন্দ্র সমূহে ইসলামের প্রচার ও প্রসার ঘটে। তাদের অনেকে এসব স্থানে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন এবং কেউ কেউ স্থায়ী বসতি স্থাপন করে জীবন অতিবাহিত করেন। ইন্দোনেশিয়ার মশলাকেন্দ্র মালাক্কা, সুমাত্রা, জাভা প্রভৃতি অঞ্চলে আরব বণিকদের যাতায়াত ছিল খুব বেশী। বলা চলে মালাক্কা কেন্দ্র থেকেই ইসলাম আরব বণিকদের মাধ্যমে সমস্ত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। অত্র অঞ্চলের বৌদ্ধরা ইসলামের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে দলে দলে মুসলমান হয়ে যায়। ফলে কোনরূপ সামরিক অভিযান ছাড়াই ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও ফিলিপাইনের মিন্দানাঁও প্রভৃতি এলাকায় ইসলাম বিজয় লাভ করে। বর্তমানে ইন্দোনেশিয়া পৃথিবীর সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্র। এ অঞ্চলের মুসলমানগণ ‘শাফেঈ’ বলে খ্যাত। তবে তাদেরকে ‘আহলেহাদীছ’ বলাই শ্রেয়। একই যাত্রাপথে আরব বণিকগণ মাঝে-মধ্যে চট্টগ্রাম বন্দরেও আসতেন। যা তখনকার দিনে তেমন কোন গুরুত্বপূর্ণ বন্দর ছিল না। জাহাজ ডুবির কারণে বা অন্যান্য কারণে তারা চট্টগ্রাম এলাকায় নিজেদের মধ্যকার নির্বাচিত সুলতানের দ্বারা স্বশাসিত কিছু এলাকাও সৃষ্টি করেছিলেন। এখনও চট্টগ্রাম অঞ্চলের বহু লোকের চেহারার সঙ্গে আরবদের চেহারার অনেক সাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয়। ঐ এলাকার লোকদের ভাষায় আরবী ফার্সী শব্দের আধিক্য, আলেম-ওলামার সংখ্যাধিক্য, নারীদের কড়া পর্দাপ্রথা ইত্যাদি তাদের প্রাচীন আরব রক্তের ছিটেফোঁটা স্বভাব হিসাবে ধরে নেওয়া যায়। মুস্তাদরাকে হাকেম হাদীছ গ্রন্থের[1] বর্ণনামতে হিন্দের (বাংলার) শাসক রাহ্মী বংশের জনৈক রাজা আরবদেশে শেষনবীর আগমনের সংবাদে খুশী হয়ে আরব বণিকদের মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর দরবারে এক কলস আদা (زنجبيل) উপঢৌকন হিসাবে পাঠিয়েছিলেন। আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) খুশী হয়ে তা নিজে খেয়েছিলেন এবং ছাহাবায়ে কেরামের মধ্যে টুকরা টুকরা করে বণ্টন করেছিলেন’। অনেক বিদ্বান বর্তমান কক্সবাজার জেলার রামু উপযেলাকে প্রাচীন রাহ্মী রাজাদের স্মৃতিবাহী এলাকা বলে সম্ভাবনা ব্যক্ত করে থাকেন।
পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশের রাজধানী করাচীকে যেমন আমরা উপমহাদেশীয় বিচারে ‘বাবুল ইসলাম’ বা ইসলামের দ্বার বলি। যেমনভাবে মক্কা থেকে মুহাদ্দিছগণের আগমন ও অবতরণস্থল হিসাবে দক্ষিণ ভারতের গুজরাটকে ‘বাব মক্কা’ বা মক্কার দ্বার বলা হয়, তেমনিভাবে আমরা বঙ্গোপসাগর তীরবর্তী চট্টগ্রাম বন্দরকে বাংলাদেশের জন্য ‘বাবুল ইসলাম’ বা ইসলামের দ্বার বলতে পারি।
বন্ধুগণ!
আরব বণিকদের মাধ্যমে ও তাঁদের সাথে বিভিন্ন সময়ে আগত ওলামায়ে দ্বীনের মাধ্যমে বাংলাদেশে প্রথম যে ইসলাম প্রচারিত হয়েছিল তা ছিল অবিমিশ্র ও নির্ভেজাল ইসলাম। সেখানে কোন শির্ক ও বিদ‘আত ছিল না, ছিল না বাতিল রায় ও ক্বিয়াসের ছড়াছড়ি, ছিল না কোনরূপ মাযহাবী দলাদলি, ছিল না কোন তরীক্বা ও পীর মুরীদীর ভাগাভাগি। প্রতিটি ধর্মীয় ব্যাপারেই তাঁরা সরাসরি হাদীছ থেকে সমাধান তালাশ করার চেষ্টা করতেন। যার প্রভাব আমরা আজও ভুলতে পারিনি। এখনও কোন বস্ত্তর সন্ধান না পেলে আমরা বলি ‘জিনিসটির হদিস পাওয়া গেল না’। সম্ভবতঃ প্রতিবেশী ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ার বৌদ্ধদের দলে দলে ইসলাম গ্রহণের প্রভাবে অথবা স্থানীয় হিন্দু ব্রাহ্মণদের নিষ্ঠুর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে এবং পাশাপাশি ইসলামের বিরল সাম্যের বাণী ও মুসলমানদের চরিত্র মাধুর্যে মুগ্ধ হয়ে বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধ জনসাধারণ দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করতে থাকেন। ফলে ইখতিয়ারুদ্দীন মুহাম্মাদ বিন বখতিয়ার খিলজী কর্তৃক ৬০২ হিজরী মোতাবেক ১২০৬ খৃষ্টাব্দে অত্যাচারী ব্রাহ্মণ রাজা লক্ষ্মণ সেনের কাছ থেকে রাজনৈতিক ক্ষমতা ছিনিয়ে নেওয়ার সময় বাংলাদেশে অগণিত মুসলমানদের বসবাস ছিল, ছিল ইসলামের পক্ষে ব্যাপক গণ সমর্থন।
এই সামরিক ও রাজনৈতিক বিজয়ের ফলে এতদঞ্চলে মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাক বা না পাক তাদের আক্বীদা ও আমলে ঘটতে শুরু করল এক ব্যাপক ও সুদূর প্রসারী বিপর্যয়, যা ইন্দোনেশিয়াতে ঘটেনি, ঘটেনি অসংখ্য মুহাদ্দিছের আগমনে ধন্য গুজরাট, মালাবার তথা দক্ষিণ ভারতের মুসলমানদের আক্বীদা ও আমলে। আমরা এক্ষণে সে বিষয়ে কিছুটা আলোকপাত করব।