আহলেহাদীছ আন্দোলন কি ও কেন?

তাক্বলীদে শাখ্ছী (التقليد الشخصى)

তাক্বলীদ (اَلتَّقْلِيْدُ) ‘ক্বালাদাহ’ (القَلاَدَةُ) হ’তে গৃহীত। যার অর্থ ‘গলাবন্ধ’। তাক্বলীদ-এর আভিধানিক অর্থ : গলায় রশি বাঁধা। পারিভাষিক অর্থ :  قُبُوْلُ قَوْلِ  الْغَيْرِ مِنْ غَيْرِ دَلِيْلٍ ‘শারঈ বিষয়ে কারু কোন কথা বিনা দলীলে মেনে নেওয়া’। পক্ষান্তরে ‘ইত্তেবা’র আভিধানিক অর্থ : পদাংক অনুসরণ করা। পারিভাষিক অর্থ : قُُبُوْلُ قَوْلِ الْغَيْرِ مَعَ دَلِيْلٍ ‘শারঈ বিষয়ে কারু কোন কথা দলীল সহ মেনে নেওয়া’। তাক্বলীদ হ’ল রায়-এর অনুরসণ এবং ইত্তেবা হ’ল দলীলের অনুসরণ। উল্লেখ্য যে, কোন আলেমের ছহীহ দলীল ভিত্তিক কোন কথাকে মেনে নেওয়ার নাম ‘তাক্বলীদ’ নয়, বরং তা হ’ল ‘ইত্তেবা’। অনুরূপভাবে কোন আলেমের দেওয়া ফৎওয়ার বিপরীতে কোন ছহীহ দলীল পাওয়া গেলে উক্ত ফৎওয়া পরিত্যাগ করে ছহীহ দলীলের অনুসরণ করাকে বলা হয় ‘ইত্তেবা’। ছাহাবায়ে কেরাম ও তাবেঈনে ইযামের যুগে তাক্বলীদের কোনরূপ নামগন্ধ ছিল না। বরং তাঁদের দলীল ভিত্তিক কথার অনুসরণকে অনেকে ‘তাক্বলীদ’ বলে ভুল বুঝিয়েছেন।

আহলেহাদীছ আন্দোলন ও অন্যান্য ইসলামী আন্দোলনের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য হ’ল ‘তাক্বলীদে শাখ্ছী’ বা অন্ধ ব্যক্তিপূজা। ২য় শতাব্দী হিজরীর পরে প্রচলিত তাক্বলীদের আবির্ভাব ঘটে। অতঃপর ৪র্থ শতাব্দী হিজরীতে বিভিন্ন ইমামের নামে বিভিন্ন তাক্বলীদী মাযহাবের প্রচলন হয়। শাহ অলিউল্লাহ দেহলভী (রহঃ) বলেন, إِعْلَمْ أَنَّ النَّاسَ كَانُوْا قَبْلَ الْمِائَةِ الرَّابِعَةِ غَيْرَ مُجْمَعِيْنَ عَلَى التَّقْلِيْدِ الْخَالِصِ لِمَذْهَبٍ وَّاحِدٍ بِعَيْنِهِ ، ‘জেনে রাখ হে পাঠক! ৪র্থ শতাব্দী হিজরীর পূর্বে কোন মুসলমান নির্দিষ্টভাবে কোন একজন বিদ্বানের মাযহাবের তাক্বলীদের উপরে সংঘবদ্ধ ছিল না’। .. কোন সমস্যা সৃষ্টি হ’লে লোকেরা যেকোন আলেমের নিকট থেকে ফৎওয়া জেনে নিত। এ ব্যাপারে কারু মাযহাব যাচাই করা হ’ত না।[1]

হাফেয শামসুদ্দীন যাহাবী (৬৭৩-৭৪৮ হিঃ) তৃতীয় শতাব্দী হিজরীর শেষদিকের অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, ‘এই সময় ‘আহলুর রায়’ (হানাফী) ফক্বীহদের নেতৃস্থানীয় অনেক আলেম, মু‘তাযিলা, শী‘আ ও কালাম শাস্ত্রবিদ (দার্শনিক) গণের স্তম্ভ বিশেষ বহু পন্ডিত বর্তমান ছিলেন, যারা যুক্তিবাদের উপরে ভিত্তি করে চলতেন এবং নবীর হাদীছকে কঠিনভাবে অাঁকড়ে থাকায় সালাফে ছালেহীনের তরীক্বা এড়িয়ে চলতেন। এই সময় ফক্বীহদের মধ্যে তাক্বলীদ আত্মপ্রকাশ করে ও ইজতিহাদের অবক্ষয় শুরু হয়’।[2]

ইমাম গাযালী (৪৫০-৫০৫ হিঃ) বলেন, ‘খুলাফায়ে রাশেদীনের যুগ শেষ হবার পরে ইসলামী খেলাফত এমন সব লোকদের কুক্ষিগত হয়ে পড়ে, যারা শারঈ বিধানে ছিলেন অনভিজ্ঞ। ফলে তারা সকল বিষয়ে ফক্বীহদের উপরে নির্ভরশীল হয়ে পড়েন এবং তাদেরকে বিভিন্ন সরকারী  পদে তলব করা হ’তে থাকে। ফলে তখন লোকেরা ইল্ম শিখতে লাগল সম্মান ও প্রতিপত্তি হাছিলের মাধ্যম হিসাবে। মুসলিম পন্ডিতগণের কেউ কেউ কালাম শাস্ত্রের উপরে গ্রন্থ রচনা শুরু করেন। সেখানে বহু কূটতর্কের অবতারণা করা হ’ল। এই সময় শাসকগণ হানাফী ও শাফেঈ ফিক্বহের পারস্পরিক শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের উদ্দেশ্যে বিতর্ক অনুষ্ঠানের প্রতি আগ্রহী হ’লেন। ফলে বিদ্বানগণ উক্ত দুই মাযহাবের মধ্যকার বিতর্কিত বিষয়সমূহের পক্ষে ও বিপক্ষে যুক্তিসমূহের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েন এবং বহু ঝগড়া ও অসংখ্য বই-পুস্তকাদি প্রণয়ন করেন। এইভাবে স্ব স্ব মাযহাবের পক্ষে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম তাৎপর্যসমূহ উদ্ধার করাকেই তারা তাদের মৌল উদ্দেশ্য হিসাবে গণ্য করেন। এই অবস্থা এখনও চলছে। আমরা জানি না ভবিষ্যতের লিখন কী আছে? (সংক্ষেপায়িত)[3]

অতঃপর শাহ অলিউল্লাহ দেহলভী বলেন, ‘(হে পাঠক!) বর্তমান সময়ে বিশ্বের  প্রায় সকল অঞ্চলে তুমি মুসলমানদের দেখবে যে, তারা বিগত কোন একজন মুজতাহিদ বিদ্বানের মাযহাবের অনুসরণ করে থাকে। তারা মনে করে যে, একটি মাসআলাতেও যদি ঐ বিদ্বানের তাক্বলীদ হ’তে সে বেরিয়ে আসে, তাহ’লে হয়তবা সে মুসলিম মিল্লাত থেকেই খারিজ হয়ে যাবে। ঐ বিদ্বান যেন একজন নবী, যাকে তার কাছে প্রেরণ করা হয়েছে (كَأَنَّهُ نَبِىٌّ بُعِثَ إِلَيْهِ) এবং যার অনুসরণ তার উপরে ফরয করা হয়েছে। অথচ ৪র্থ শতাব্দী হিজরীর পূর্বে কোন মুসলমান কোন একটি নির্দিষ্ট মাযহাবের অনুসারী ছিলেন না।[4]



[1]. শাহ অলিউল্লাহ, হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ ১/১৫২-৫৩ ‘চতুর্থ শতাব্দী ও তার পরের লোকদের অবস্থা বর্ণনা’ অনুচ্ছেদ।

[2]. যাহাবী, তাযকেরাতুল হুফফায (বৈরূত : ছাপা, তাবি) ২/২৬৭পৃঃ।

[3]. শাহ অলিউল্লাহ, হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ ১/১৫৩ পৃঃ।

[4]. শাহ অলিউল্লাহ, তাফহীমাতে ইলাহিয়াহ (ইউ,পি, বিজনৌর ১৩৫৫/১৯৩৬) ১/১৫১ পৃঃ।