তাক্বলীদের পরিণতি (ثمرة التقليد)
অন্ধ তাক্বলীদ ও রসম পূজার শেষ পরিণতি সম্পর্কে চিন্তা করলেও গা শিউরে ওঠে। একদিকে থাকেন ভ্রান্তির আশংকাযুক্ত অনুসরণীয় ইমাম অথবা পীর। অন্যদিক থাকেন দোজাহানের অভ্রান্ত ইমাম, ইমামুল মুত্তাক্বীন ও ইমামুল মুরসালীন শেষনবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লা-হু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)। একদিকে থাকে ধর্মের নামে প্রচলিত রসম-রেওয়াজ, অন্যদিকে থাকে শেষনবীর পবিত্র হেদায়াতসমূহ। আল্লাহ না করুন এটিই যদি কারো প্রকৃত অবস্থা হয়ে থাকে, তবে কোন্ আকাশ তাকে ছায়া দিবে, কোন্ যমীন তাকে আশ্রয় দিবে, কোন্ নবীর শাফা‘আত সে কামনা করবে?
তাক্বলীদের মায়াবন্ধনে পড়ে মানুষ ছহীহ হাদীছের নিরপেক্ষ অনুসরণ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। কে কত বড় ইমাম বা কে কত বড় দলের অনুসারী, সেটাই এখন প্রধান বিচার্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। মাযহাবী তাক্বলীদের বাড়াবাড়ির পরিণামে হানাফী-শাফেঈ দ্বন্দ্বে ও শী‘আ মন্ত্রীর ষড়যন্ত্রে ৬৫৬ হিজরী মোতাবেক ১২৫৮ খৃষ্টাব্দে হালাকু খাঁর আক্রমণে বাগদাদের আববাসীয় খেলাফত ধ্বংস হয়েছে। পরবর্তীতে মিসরের বাহরী মামলূক সুলতান রুকনুদ্দীন বায়বারাসের আমলে (৬৫৮-৬৭৬/১২৬০-১২৭৭ খৃঃ) মিসরীয় রাজধানীতে সর্বপ্রথম চার মাযহাবের লোকদের জন্য পৃথক পৃথক ক্বাযী নিয়োগ করা হয়, যা ৬৬৪ হিজরী থেকে ইসলাম জগতের সর্বত্র চালু হয়ে যায়... এবং চার মাযহাবের বহির্ভূত কোন উক্তি বা সিদ্ধান্ত কুরআন ও ছহীহ হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত হ’লেও তা অনুসরণ করা নিষিদ্ধ বলে গণ্য হয়’। বুরজী মামলূক সুলতান ফারজ বিন বারকূক-এর আমলে (৭৯১-৮১৫ হিঃ) ৮০১ হিজরী সনে মুক্বাল্লিদ আলেম ও জনগণকে সন্তুষ্ট করতে গিয়ে মুসিলম ঐক্যের প্রাণকেন্দ্র কা‘বা গৃহের চারপাশে চার মাযহাবের জন্য পৃথক পৃথক চার মুছাল্লা কায়েম করা হয়। এইভাবে তাক্বলীদের কু-প্রভাবে মুসলিম উম্মাহর বিভক্তি স্থায়ী রূপ ধারণ করে। ১৩৪৩ হিজরীতে বর্তমান সঊদী শাসক পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা বাদশাহ আব্দুল আযীয আলে-সঊদ উক্ত চার মুছাল্লা উৎখাত করেন। ফলে সকল মুসলমান বর্তমানে কুরআন-হাদীছের বিধান অনুযায়ী একই ইবরাহীমী মুছাল্লায় এক ইমামের পিছনে এক সাথে ছালাত আদায় করার সৌভাগ্য অর্জন করেছে (থিসিস পৃঃ ৮৯)। ফালিল্লাহিল হামদ্।
জাতীয় তথা ধর্মীয় তাক্বলীদের দুনিয়াবী পরিণতি হিসাবে বিভিন্ন মাযহাব ও তরীক্বার নামে আমরা ভাই ভাইয়ে দলে দলে বিভক্ত হয়েছি। বিজাতীয় তাক্বলীদের ফলে আমরা প্রগতির নামে ইহুদী-খৃষ্টান ও অনৈসলামী জোটের চালু করা ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ, জাতীয়তাবাদ, পুঁজিবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র প্রভৃতি কুফরী মতবাদের অন্ধ অনুসারী হয়েছি। ভাষা ও অঞ্চলভিত্তিক জাতীয়তাবাদের পূজা করতে গিয়ে একক ‘ইসলামী খেলাফত’ ভেঙ্গে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ৫৬টি দুর্বল মুসলিম রাষ্ট্রে বিভক্ত হয়েছি। বহু দলীয় গণতন্ত্রের ধুয়া তুলে একটি দেশকে ভিতর থেকে অনৈক্যে ও বিশৃংখলায় স্থায়ীভাবে দুর্বল করে রাখার অনৈসলামী ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করা হয়েছে। সরকারী ও বিরোধী দলীয় রাজনৈতিক সমাজ ব্যবস্থার ফলে বঙ্গভবন থেকে বস্তিঘর পর্যন্ত অনৈক্য ও অশান্তির আগুনে জ্বলছে। আমাদের জাতীয় ঐক্য ছিন্নভিন্ন হয়েছে। বিশ্বব্যাপী ঐক্যবদ্ধ ‘ইসলামী খেলাফাত’ তথা মুসলমানদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শক্তি বিধ্বস্ত হয়েছে। মুসলিম রাষ্ট্রসমূহ এখন ইহুদী-খৃষ্টান-অমুসলিম অক্ষশক্তির গোলামে পরিণত হয়েছে। এককালের উমাইয়া খেলাফতের (৪১-১৩২হিঃ/৬৬১-৭৫০খৃঃ=৯০বৎসর) রাজধানী দামেশক, আববাসীয় খেলাফতের (১৩২-৬৫৬হিঃ/৭৫০-১২৫৮খৃঃ=৫০৯বৎসর) রাজধানী বাগদাদ, স্পেনীয় উমাইয়া খেলাফতের (৯২-৮৯৭হিঃ/৭১১-১৪৯২খৃঃ=৭৮১বৎসর) রাজধানী গ্রানাডা, তৎকালীন পৃথিবীর সর্বোচ্চ শিক্ষাকেন্দ্র ও ‘বিশ্বের বিস্ময়’ কর্ডোভা, সেভিল আজ ইতিহাসের বিষয়বস্ত্ত, ভারতবর্ষের মুসলিম শাসনের (৩৫১-১২৭৩ হিঃ/৯৬২-১৮৫৭ খৃঃ= ৮৯৫বৎসর) কেন্দ্রস্থল গযনী (কাবুল ) ও দিল্লী আজ ইতিহাসের হারানো অধ্যায়। সর্বশেষ উছমানীয় খেলাফতের (৭০০-১৩৪২ হিঃ/১৩০০-১৯২৪খৃঃ=৬২৪বৎসর) রাজধানী ইস্তাম্বুল বা কনষ্টান্টিনোপল ও তুরস্ক আজ ‘ইউরোপের রুগ্ন ব্যক্তি’ বলে ইহুদী-খৃষ্টান জগতের হাসি-ঠাট্টার বস্ত্ততে পরিণত হয়েছে। ক্রুসেড বিজেতা সেনাপতি ছালাহুদ্দীন আইয়ূবী (৫৬৪-৫৮৯ হিঃ/১১৬৯-১১৯৩ খৃঃ)-এর শাসিত মিসর এখন ইহুদী রাষ্ট্র ইসরাঈলের বন্ধু!
শান্তির ধর্ম ইসলামের অনুসারী মুসলমান আজ অশান্তির দাবানলে জ্বলছে। কিন্তু কেন? কে এজন্য দায়ী? ইসলাম না মুসলমান? ঔষধ না রোগী? নিশ্চয়ই দোষ ঔষধের নয়। কেননা এ ঔষধ বহু পরীক্ষিত। তাছাড়া ইসলামের যথার্থতার প্রশংসায় তো অমুসলমানেরাই বেশী সোচ্চার। অতএব সে দোষ নিশ্চয়ই রোগীর যারা এর ব্যবহার জানে না। আমরা যারা ঔষধ তাকে রেখে কেবল ঔষধ ঔষধ তাসবীহ জপেছি, কিন্তু সেবন করে দেখিনি। অথবা সঠিক ব্যবহারবিধি শিখিনি। কিংবা অল্প শিখে বাকীটা অনুমান করে নিয়েছি কিংবা অন্য কিছু মিশিয়ে মনের মত করে ‘মিকশ্চার’ বানিয়েছি।
মোটকথা মুসলমানদের বর্তমান এই করুণ পরিণতি হেদায়াতের মূল উৎস পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের মহান শিক্ষা হ’তে দূরে থাকারই ফল। আর একারণেই শাশ্বত জীবন বিধান পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের যুগোপযোগী সমাধান পেতে ব্যর্থ হয়ে আধুনিক শিক্ষিত যুবকেরা আজ ক্রমেই বিভিন্ন বস্ত্তবাদী দর্শনের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। ইসলামের মধ্যে বিভিন্ন মাযহাব ও তরীক্বার বিভিন্ন চেহারা দেখে তারা মূল ইসলামকেই সন্দেহ করছে। দরগাহ, খানক্বাহ ও হালক্বায়ে যিকরের জৌলুস দেখে অথবা বিলাসী রাজনীতির জাঁকজমকপূর্ণ মঞ্চে ও মিছিলে ইসলামের তেজিয়ান শ্লোগান শুনে তারা ইসলামকে ভুল বুঝছে। তাকে পুঁজিবাদের সমর্থক অথবা শোষণের হাতিয়ার ভাবছে। অথচ মানবতার মুক্তিদূত মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লা-হু আলাইহি ওয়া সাল্লাম), আবু বকর (রাঃ), ওমর (রাঃ), ওছমান (রাঃ) ও আলী (রাঃ)-এর রেখে যাওয়া ইসলাম কি এই? নিশ্চয়ই নয়। তা পেতে গেলে আমাদেরকে অবশ্যই ছেড়ে দিতে হবে বিজাতীয় মতবাদসমূহ এবং অবশ্যই ফিরে যেতে হবে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের মূল শিক্ষার মর্মকেন্দ্রে। কিন্তু প্রশ্ন হ’ল, আন্তরিকভাবে আমরা তা পেতে চাই কি?