সূদের সংজ্ঞা
আল্লাহ রাববুল আলামীন দ্ব্যর্থহীন ভাষায় মহাগ্রন্থ আল-কুরআনে সূদকে সর্বৈব নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন। তিনি বলেন, اَحَلَّ اللّهُ الْبَيْعَ وَحَرَّمَ الرِّبَا ‘আল্লাহ ব্যবসাকে করেছেন হালাল ও সূদকে করেছেন হারাম’ (বাক্বারাহ ২/২৭৫)।
কেন এই ঘোষণা? রিবা (الربوا) বা সূদকে কেন হারাম বা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হ’ল? এজন্য প্রথমেই জানা প্রয়োজন রিবা বা সূদ কি? রিবা কাকে বলে? আরবী ‘রিবা’ শব্দের আভিধানিক অর্থ হ’ল বৃদ্ধি, অতিরিক্ত, প্রবৃদ্ধি ইত্যাদি। অবশ্য এর অর্থ এই নয় যে, ইসলামে সব ধরনের বৃদ্ধি বা প্রবৃদ্ধিকে হারাম বা নিষিদ্ধ গণ্য করা হয়েছে। প্রখ্যাত ইসলামী অর্থনীতিবিদ ও দার্শনিক উমর চাপড়ার মতে- শরী‘আতে রিবা বলতে ঐ অর্থকে বোঝায়, যা ঋণের শর্ত হিসাবে মেয়াদ শেষে ঋণগ্রহীতা মূল অর্থসহ অতিরিক্ত অর্থ ঋণদাতাকে পরিশোধ করতে বাধ্য হয়।
ইমাম ফখরুদ্দীন রাযী বলেন, জাহেলী যুগে আরববাসী সকলেরই রিবা সম্বন্ধে জানা ছিল এবং তাদের মধ্যে এটি বহুল প্রচলিতও ছিল। সে যুগেও তারা প্রথাসিদ্ধভাবে ঋণ দিত এবং শর্ত অনুসারে তার উপর মাসে মাসে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ আদায় করত, কিন্তু আসলের পরিমাণ থাকত অপরিবর্তিত। যখন ঋণের মেয়াদ শেষ হ’ত এবং ঋণগ্রহীতা ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হ’ত তখন সূদ বাড়িয়ে দেওয়ার শর্তে পরিশোধের সময়ও বাড়িয়ে দেওয়া হ’ত (তাফসীরুল কাবীর)।
ইবনু হাজার আসক্বালানী (রহঃ) বলেন, পণ্য বা অর্থের বিনিময়ে প্রদেয় অতিরিক্ত পণ্য বা অর্থই হ’ল রিবা। ইমাম আবুবকর আল-জাসসাস ‘আহকামুল কুরআন’ গ্রন্থে বলেন, রিবা দু’রকম। একটি ক্রয়-বিক্রয়ের মধ্যে, অপরটি ক্রয়-বিক্রয় ছাড়া। দ্বিতীয় প্রকারই জাহেলী যুগের রিবা। তিনি আরও বলেন, জাহেলী যুগে ঋণ গ্রহণের সময়ে ঋণদাতা ও ঋণগ্রহীতার মধ্যে একটি চুক্তি হ’ত। তাতে স্বীকার করে নেওয়া হ’ত নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে মূলধনের উপর একটি নির্ধারিত পরিমাণ অতিরিক্তসহ আসল মূলধন ঋণগ্রহীতাকে আদায় করতে হবে।
প্রখ্যাত তাফসীরবিদ ইবনু জারীর (রহঃ) বলেন, ‘জাহিলী যুগে প্রচলিত ও কুরআনে নিষিদ্ধ রিবা হ’ল কাউকে নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য ঋণ দিয়ে মূলধনের অতিরিক্ত নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ গ্রহণ করা’। আরবরা তাই-ই করত এবং নির্দিষ্ট মেয়াদে ঋণ পরিশোধ করতে না পারলে সূদ বাড়িয়ে দেওয়ার শর্তে পরিশোধের মেয়াদ বাড়িয়ে দিত (তাফসীর ইবনে জারীর)।
এখানে একটি ভুল বোঝাবুঝির নিরসন হওয়া প্রয়োজন। অনেকে কুরআন ও হাদীছে যে রিবার উল্লেখ রয়েছে তার অর্থ করেন ব্যক্তিগত পর্যায়ে পারিবারিক প্রয়োজন পূরণের জন্য দেওয়া ঋণের বিনিময়ে আদায়কৃত অতিরিক্ত অর্থ বা Usury। এদের মতে, ব্যবসায়িক কাজে লগ্নিকৃত অর্থের জন্য নির্দিষ্ট হারে প্রদেয় বাড়তি অর্থ বা Interest এ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। এদের মতে Usury বা চক্রবৃদ্ধি হারে সূদ আদায় নিন্দনীয় ও পরিত্যাজ্য হ’তে পারে। কারণ এতে শোষণ ও পীড়নের সুযোগ বা আলামত রয়েছে। কিন্তু ব্যবসায়ে লগ্নিকৃত অর্থ বা আজকের দিনে বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহ কর্তৃক আদায়কৃত সূদ বা Interest নির্দোষ। কেননা এখানে কারো উপর জোর করে কিছু চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে না। বরং ব্যবসায়িক লেনদেনের মতোই উভয়ের সম্মতিক্রমেই সূদের হার স্থিরীকৃত হচ্ছে। এই সূদও সরল সূদ এবং হারও যথেষ্ট কম, সাধারণত ৮%-১৮%। উপরন্তু এই ঋণে উৎপাদন ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পায়, অর্থনীতির চাকা গতিশীল হয়। ফলে ঋণগ্রহীতার আয়ও বৃদ্ধি পায়। তার পক্ষে তাই ‘মূলধনের সময়ের প্রাপ্য’ পরিশোধ করাই যুক্তিযুক্ত। তাদের দৃষ্টিতে এখানে কোন যবরদস্তি বা যুলুমের উপাদান বিদ্যমান নেই। বরং মুদ্রাস্ফীতির কারণে অর্থের যে ক্রয়ক্ষমতা হরাস পায় সূদ গ্রহণের ফলেই তা পূরণ হয়। ফলে মূলধন অবিকৃত থাকে।
তিনটি কারণে এই ব্যাখ্যা আদৌ গ্রহণযোগ্য নয়।
প্রথমতঃ সমগ্র আরব দেশে আরবী ‘রিবা’ (الربوا) শব্দের অর্থ সূদই করা হয়েছে। এক্ষেত্রে আর কোন বিশ্লেষণ, ব্যাখ্যা বা ভিন্ন কোন অর্থ প্রযুক্ত হয়নি। তাই সূদের ভিন্নতা বা প্রকারভেদ বোঝার জন্য ইংরেজী, বাংলা বা অন্য কোন ভাষার শব্দ ব্যবহার করে অযৌক্তিক ধুম্রজাল সৃষ্টির কোন সুযোগ নেই। উদাহরণতঃ ইসলামে সূদ যেমন হারাম, মদও তেমনি হারাম। তাই একটা গ্লাসের পুরোটাই রঙিন মদে ভর্তি ও আরেকটা গ্লাসের তলায় রাখা ও সাদা রঙের কিঞ্চিৎ মদের মধ্যে আসলেই প্রকৃতিগত বা বস্ত্তগত কোন পার্থক্য নেই। পার্থক্য রঙের ও পরিমাণের। Interest ও Usury এর পার্থক্যও তাই মাত্রাগত, গুণগত নয়।
দ্বিতীয়তঃ জাহেলী যুগে ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য রীতিমত পুঁজি লগ্নী করা হ’ত এবং সেজন্য সূদ আদায় করা হ’ত। সে সময়ে অনেকেই আজকের মত ফার্ম খুলে এজেন্ট নিয়োগ করে সূদে পুঁজি খাটাত। এদের মধ্যে রাসূল (ছাঃ)-এর চাচা আববাস ইবনু আব্দিল মুত্তালিব ও বনু মুগীরার বিশেষ প্রসিদ্ধি ছিল। তাদের আদায়কৃত সূদকে আরবীতে রিবা-ই বলা হ’ত। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাঁর চাচার সূদী কারবার বন্ধ করে দিয়েছিলেন এবং খাতকের কাছে প্রাপ্য বকেয়া সূদ রহিত করে দিয়েছিলেন।[1]
তৃতীয়তঃ যারা ‘মূলধনের সময়ের প্রাপ্য’ পরিশোধ করতে বলেন তাদের আচরণ গল্পের সেই একচোখা হরিণের মতই। মূলধনের সময়ের প্রাপ্য যদি ঋণদানকারীর ক্ষেত্রে স্বীকৃত হয় তাহ’লে ঋণ গ্রহণকারীর ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য হবে না কেন? তার তো বরং সময়, মেধা ও শ্রম সবই একই সময়ে ঐ অর্থের পেছনে খাটছে। এছাড়া যারা বলেন, অর্থের ক্রয়ক্ষমতা অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য সূদ নেওয়া প্রয়োজন, তারা ভুলে যান যে শুধুমাত্র সূদ আদায় করেই অর্থের ক্রয়ক্ষমতা স্থির রাখা যায় না। এজন্য আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ যরূরী। তাই যারা Interest ও Usury-কে ভিন্ন বিষয় হিসাবে দেখতে চান তারা আসলে বিশেষ মতলব হাছিলের উদ্দেশ্য নিয়ে কথা বলেন।
এ বিষয়ে পুঁজিবাদী অর্থনীতিবিদদের অধিকাংশের মধ্যে কোন মতদ্বৈততা নেই। বিশেষতঃ রাসূলপূর্ব জাহেলী যুগে এবং আরবী ভাষায় যে অর্থে রিবার ব্যবহার হ’ত তা Interest ও Usury উভয় ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য ছিল। এ ব্যাপারে
সকলেই ঐক্যমতে পৌঁছেছেন।[2]
বস্ত্ততঃ ইসলামে যে সূদ হারাম বলে গণ্য সে সূদ যত রকম নামেই পরিচিত হোক না কেন এবং তা প্রাপ্তির জন্য যে পথ বা উপায়ই অবলম্বন করা হোক না কেন তা সবই হারাম।
মনে রাখা দরকার, যে সময়ে রিবা নিষিদ্ধ হওয়ার আয়াত নাযিল হয়েছিল সে সময়ে আরব সমাজে একদিকে যেমন ব্যক্তিগত প্রয়োজনে প্রদত্ত ঋণের উপর সূদ আদায় করা হ’ত, তেমনি ব্যবসায়ে লগ্নিকৃত মূলধনের উপরও সূদ গ্রহণের রীতি প্রচলিত ছিল। এই উভয় প্রকার সূদকেই তখন আরবী ভাষায় ‘রিবা’ বলা হ’ত এবং কুরআনে এই রিবাকেই হারাম ঘোষণা করা হয়েছে।[1]. আবুদাঊদ হা/১৯০৫।
[2]. T.B. Hughes, A Dictionary of Islam, (Premier Book House, 1985), p. 544; Adam Kupar & Jessica Kupar, The Social Sciences Encyclepaedia, (Routledge & Kegan paul, 1985), p. 405-406; Encyclopaedia Judiace, (Jerusalem, 1972), Vol. 16. p. 28; Raymond De Rover, International Encyclopaedia of the Social Sciences, London, vol. 4, p. 434; Henry, W. Spigel, A Dictionary of Economics, (Macmillan, 1987), Vol. IV, p. 769.