ধারাগুলির ব্যাখ্যা
(تفصيل الطرائق)
আসুন! আমরা সমাজ বিপ্লবের উপরোক্ত তিনটি ধারার উপরে সংক্ষিপ্ত আলোচনা রাখি। প্রথম ধারাটি হ’ল তাওহীদের সঠিক উপলব্ধি।
তাওহীদে রুবূবিয়াত (পালনকর্তা হিসাবে আল্লাহর একত্ব), তাওহীদে আসমা ওয়া ছিফাত (আল্লাহর নাম ও গুণাবলীর একত্ব) এবং তাওহীদে উলূহিয়াত (ইবাদতে একত্ব) এই তিন প্রকারের তাওহীদের মধ্যে জাহেলী যুগের আরবরা কমবেশী প্রথম দু’প্রকারের তাওহীদে বিশ্বাসী ছিল। তারা আল্লাহকে ‘রব’ হিসাবে, ‘খালেক্ব’ ও ‘রাযযাক্ব’ হিসাবে বিশ্বাস করত। অনেকে আখেরাতে হিসাব-নিকাশে বিশ্বাসী ছিল। তারা নিজেদের নাম ‘আব্দুল্লাহ’ ‘আব্দুল মুত্ত্বালিব’ প্রভৃতি রাখত। এতদসত্তেবও তারা ‘মুসলিম’ ছিল না এই কারণে যে, তাদের মধ্যে ‘তাওহীদে উলূহিয়াত’ ছিল না। তারা ‘অসীলাপূজায়’ বিশ্বাসী ছিল। আল্লাহ্কে পাওয়ার জন্য বিভিন্ন মৃত সাধু ব্যক্তির মূর্তি তৈরী করে তাদের নিকট নযর- নেয়ায পেশ করত। আল্লাহর ঘর কা‘বা শরীফের বাইরে মানুষের ব্যক্তিগত, সামাজিক ও ব্যবহারিক বিষয়ে আল্লাহর কোন হেদায়াত থাকতে পারে, একথা তারা মানতে প্রস্ত্তত ছিল না। এরা তাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় ক্ষেত্রে এক একজন নেতাকে ‘ইলাহ’-এর মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছিল। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরই বিরুদ্ধে বৈপ্লবিক শ্লোগান উচ্চারণ করেন- ‘লা ইলা-হা ইল্লাল্লা-হ’। এখানে আল্লাহকে মানবার আগে ‘গায়রুল্লাহ’কে বর্জনের কথা বলা হয়েছে। আর এ কারণেই পূণ্য অর্জনের আবশ্যিক পূর্বশর্ত হ’ল পাপ বর্জন করা। দুর্ভাগ্য এই যে, জাহেলী আরবরা আল্লাহ্কে মানতে প্রস্ত্তত ছিল, কিন্তু গায়রুল্লাহকে ছাড়তে প্রস্ত্তত ছিল না। পূণ্য অর্জনের আকাংখা ছিল, কিন্তু পাপ বর্জনে তারা রাযী ছিল না।
‘তাওহীদ’ সম্পর্কে বাংলাদেশের বর্তমান মুসলমানদের অধিকাংশের ধারণা জাহেলী আরবদের আক্বীদার সঙ্গে যে অনেকাংশে মিল আছে, তা আশা করি কারও বুঝতে বাকী নেই। আমরা ‘বায়তুল মোকাররমে’ গিয়ে আল্লাহ্কে মানি। ‘সংসদ ভবনে’ গিয়ে জনগণকে সার্বভৌম ক্ষমতার উৎস বলি। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পুঁজিবাদী বা সমাজবাদী সাজি। ‘মাযারে’ গিয়ে অসীলাপূজারী হই। আমাদের নামও আব্দুল্লাহ-আব্দুল মুত্ত্বালিব। আরবের মুশরিকরা যে নিয়তে নিজেদের হাতে গড়া মূর্তির কাছে যেত, আমরাও একই নিয়তে নিজেদের হাতে গড়া মাযার ও খানক্বাহে যাই। তারা তাদের বৈষয়িক বিষয়সমূহে আল্লাহর কোন আইন আছে বলে মানতো না। আমরা আমাদের রাজনীতি-অর্থনীতি প্রভৃতি বৈষয়িক ব্যাপারে আল্লাহর কোন হেদায়াত আছে বলে মানতে চাই না। আমরা কালেমার যিকর করে বা মাঝে মধ্যে জুম‘আ-জামা‘আতে হাযির হয়ে ভেবে নিই জান্নাত পাব। অথচ ইসলামের সকল হুকুম মানা সত্বেও কেবলমাত্র যাকাত জমা দিতে অস্বীকার করায় আবুবকর ছিদ্দীক্ব (রাঃ) তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। কারণ ইসলামের অর্থনৈতিক বিষয়টিকে তারা অমান্য করেছিল। তাদের ছালাত-ছিয়াম কোন কাজে লাগেনি তাওহীদের মৌলিক বিশ্বাসে খুঁত থাকার কারণে।
আমাদের সমাজকে সর্বপ্রথমে তাই তাওহীদের শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে হবে এবং একথা বুঝিয়ে দিতে হবে যে, মুসলিম জীবনের সকল দিক ও বিভাগে কেবলমাত্র আল্লাহর নিকট থেকেই হেদায়াত নিতে হবে। আর সে হেদায়াত সঞ্চিত আছে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছ সমূহের মধ্যে- অন্য কোথাও নয়। আমাদেরকে সকল ব্যাপারে কেবলমাত্র ঐ দুই উৎস থেকেই আলো নিতে হবে।
প্রথম ধারাটি সম্পর্কে স্পষ্ট বুঝ হাছিল হয়ে গেলে দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধারাটি সম্পর্কে ব্যাখ্যা না দিলেও চলে। কারণ দুর্বল আক্বীদার লোক দ্বারা কখনও বিপ্লব হ’তে পারে না। আর বাতিলের সঙ্গে আপোষকামী ব্যক্তি কখনো হকপন্থী হ’তে পারে না।