মানবজাতি দু’টি সম্প্রদায়ে বিভক্ত
পবিত্র কুরআনে মানবজাতিকে তার বিশ্বাস ও কর্মের হিসাব দু’টি সম্প্রদায়ে বিভক্ত করা হয়েছে- মুমিন ও কাফির (তাগাবুন ৬৪/২)। এতে বুঝা যায় যে, অন্যান্য উপাদান থাকলেও জাতি গঠনের মূল উপাদান হ’ল ‘ধর্ম’। আদিতে পৃথিবীর মানুষ একটি মাত্র ধর্মে বিশ্বাসী একক উম্মত ছিল। অতঃপর আল্লাহ তাদের পরিচালনা জন্য কিতাব সহকারে নবীগণকে প্রেরণ করেন। কিন্তু কিছু লোক নিজেদের যিদ ও হঠকারিতা বশতঃ অহি-র বিধানসমূহের ব্যাপারে মতভেদে লিপ্ত হয়েছিল এবং সঠিক রাস্তা থেকে বিচ্যুত ও বিভ্রান্ত হয়েছিল’ (বাক্বারাহ ২/২১৩)।
এতে প্রমাণিত হয় যে, যুগে যুগে নবীগণ মানবজাতিকে আল্লাহ্তে বিশ্বাসী একক জাতীয়তার দিকে আহবান জানিয়েছেন। কিন্তু হঠকারী লোকেরা সে আহবানে সাড়া না দিয়ে ভাষা, বর্ণ, অঞ্চল প্রভৃতির পার্থক্যের অজুহাতে বিভিন্ন জাতীয়তা সৃষ্টি করে মানবজাতিকে বিভক্ত করেছে ও নিজস্ব শাসনের নামে নিজস্ব শোষণ ও নির্যাতন ব্যবস্থা চালু করেছে। বর্তমানের বিভক্ত বিশ্ব তার জলজ্যান্ত প্রমাণ। মহাকবি ইকবাল অত্যন্ত সুন্দরভাবে বিষয়টি তুলে ধরেছেন তাঁর ‘জওয়াবে শিকওয়াহ্’র মধ্যে-
قوم مذهب سـﮯ هــﮯ مذهب جو نهيں تم بهى نهيں
جزب باهم جو نهيں محفل انجم بهى نهيں
‘ধর্মে হয় জাতি গঠন, ধর্ম নেই তো তুমি নেই
নেই যদি মধ্যাকর্ষণ, তারকারাজির সমাবেশ নেই’।
রাজনীতিবিদগণ মুখে স্বীকার করুন বা না করুন, বাস্তবে সেটাই হয়েছে এবং হচ্ছে।
বিগত শতাব্দীর মাঝামাঝিতে পৃথিবীর একমাত্র ইহুদী রাষ্ট্র (?) ইসরাঈলকে প্রতিষ্ঠা দানের জন্য ইঙ্গ-মার্কিন চক্রান্তের পিছনে প্রধানতঃ একটি বিষয়ই কাজ করেছিল- সেটি হ’ল, আহলে কিতাব হওয়ার দাবীদার হিসাবে ইহুদীদের সাথে তাদের ধর্মীয় ঐক্য এবং তাদের বিরোধী হিসাবে মুসলিম বিদ্বেষ। ফিলিস্তীনের হাযার বছরের স্থায়ী মুসলিম নাগরিকদেরকে নির্বিবাদে হত্যা, লুণ্ঠন ও বিতাড়িত করতে তাদের গণতন্ত্রে, ধর্মনিরপেক্ষতায় ও মানবাধিকারে মোটেই বাঁধেনি। একইভাবে প্রায় ৮০০ বছরের স্পেনীয় মুসলিম উমাইয়া খেলাফতকে তারা ধ্বংস করেছে ন্যাক্কারজনক প্রতারণার মাধ্যমে। ইউরোপের বুকে অবশিষ্ট একমাত্র মুসলিম রাষ্ট্র বসনিয়াকেও তারা কয়েক বছর আগে শেষ করে দিয়েছে। অতি সম্প্রতি তারা মিথ্যা অজুহাতে আফগানিস্তান ও ইরাককে কব্জা করে নিয়েছে।
গত শতাব্দীর শেষ দিকে পৃথিবীর বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র ইন্দোনেশিয়া থেকে তার অবিচ্ছেদ্য অংশ ‘পূর্ব তিমুরকে’ বিচ্ছিন্ন করে নিয়েছে। কয়েক বছর ধরে সেখানে ত্রাণ সাহায্যের মুখোশে ধর্ম প্রচার করে খৃষ্টান সংখ্যাগরিষ্ঠ বানিয়ে তাদেরকে দিয়ে সেটিকে পৃথক রাষ্ট্র ঘোষণা দিল এবং সঙ্গে সঙ্গে স্বীকৃতি দিয়ে তাকে ইন্দোনেশিয়া থেকে ছিনিয়ে নিল ঐ ইঙ্গ-মার্কিন খৃষ্টান চক্র। একইভাবে পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্রের দেশ হিসাবে পরিচিত ভারত ১৯৪৮ সালে গৃহীত জাতিসংঘ প্রস্তাবকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম এলাকা কাষ্মীরকে কব্জা করে নিল তাদের মতের বিরুদ্ধে। আজও সেখানে লাখ লাখ সৈন্য মোতায়েন করে দৈনিক তাদের রক্ত ঝরানো হচ্ছে। ইঙ্গ-মার্কিন চক্র এক্ষেত্রে ভারতকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। সেই সাথে কম্যুনিষ্ট বিশ্বও। এসব করার জন্য তাদের বহু ঘোষিত গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ ও মানবাধিকারবাদ কোনরূপ বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি।
অতএব আল্লাহর কথাই ঠিক। বিশ্ব দু’ভাগে বিভক্ত মুসলিম ও কাফির। বিশ্ব মুসলিম যদি কখনো পূর্বের ন্যায় একই ইসলামী খেলাফতভুক্ত হয় এবং পূর্ণ ঈমানী শক্তি নিয়ে জেগে ওঠে, তাহ’লে সেই শক্তিই হবে বিশ্বের সেরা শক্তি। যে শক্তিকে ছলে-বলে কৌশলে ধ্বংস করেছে এই আন্তর্জাতিক খৃষ্টবাদী চক্র বিগত ১৯২৪ খৃষ্ঠাব্দে তুরষ্কের কামাল পাশাদের হাত দিয়ে তথাকথিত গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের সুঁড়সুঁড়ি দিয়ে।
প্রশ্ন হ’ল- আল্লাহর বিধান যখন সকলের কল্যাণের জন্য, তখন কাফেররা তার বিরোধিতা করে কেন? এর জবাব এই যে, কাফেররা তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করতে চায়। বিবেকের নিয়ন্ত্রণমুক্ত হয়ে তারা পৃথিবীতে শয়তানের রাজত্ব কায়েম করতে চায়। পক্ষান্তরে আল্লাহ চান তাঁর প্রেরিত অহি-র বিধান অনুসরণের মাধ্যমে সকল ভাষা ও বর্ণের মানুষ পৃথিবীতে সুখ-শান্তিতে বসবাস করুক। কাফেররা ও তাদের সমমনা ফাসিক্ব ও প্রবৃত্তি পূজারী লোকেরা যুগে যুগে আল্লাহ প্রেরিত কিতাব ও নবীদের বিরোধিতা করেছে। আজও করে চলেছে। নবী ও মুমিনগণ তাদের উপরে আপতিত কুফরী নির্যাতনকে ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার সাথে মুকাবেলা করেছেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে যুক্তিগ্রাহ্য নছীহতের মাধ্যমে, জান্নাতের সুসংবাদ ও জাহান্নামের ভয় প্রদর্শনের মাধ্যমে মানুষকে তাঁরা আল্লাহর পথে ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা করেছেন। কখনো কখনো আত্মরক্ষার স্বার্থে সশস্ত্র জিহাদের মাধ্যমে মুকাবেলা করেছেন। এভাবেই পৃথিবীতে আল্লাহর দ্বীনের প্রতিষ্ঠা লাভ ঘটেছে।