বাগে আনতে শী‘আদের নানান প্রচেষ্টা
১. ইসমাঈলী শী‘আদের নেতা করীম আগা খান (জন্ম : ১৯৩৬) আল্লামা যহীরকে ব্রিটেন সফরের আমন্ত্রণ জানান এবং সেখানে তাঁকে নিয়ে যাওয়ার জন্য স্বীয় প্রতিনিধিকে প্রাইভেট বিমানসহ করাচীতে পাঠান। উদ্দেশ্য ছিল যহীরের সাথে সাক্ষাত করে ইসমাঈলীদের সম্পর্কে বই না লেখার জন্য তাঁকে রাযী করানো। কিন্তু তিনি সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। অগত্যা আগা খান আল্লামা যহীরকে প্রেরিত এক পত্রে বলেন, ‘মুসলমানদেরকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য আপনার লেখালেখি করা উচিত; তাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির জন্য নয়’। জবাবে আল্লামা যহীর তাকে লেখেন, ‘হ্যাঁ, শুধুমাত্র আল্লাহ ও তাঁর রাসূল এবং তাঁদের শিক্ষার প্রতি ঈমান আনয়নকারী মুসলমানদেরকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য। খতমে নবুঅতকে অস্বীকারকারী কাফের এবং রিসালাতে মুহাম্মাদীকে অস্বীকারকারীদের সাথে মুসলমানদের ঐক্যের জন্য নয়’।[1]
২. একবার একজন বড় শী‘আ আলেম ইমাম খোমেনীর (১৩১৮-১৪০৯ হিঃ) প্রতিনিধি হিসাবে আল্লামা যহীরের সাথে তাঁর বাড়িতে দেখা করে তাঁর ‘আল-বাবিয়া’ ও ‘আল-বাহাইয়া’ বই দু’টি সম্পর্কে ইমাম খোমেনীর মুগ্ধতার বিষয়টি উল্লেখ করে তাঁকে ইরান সফরের আমন্ত্রণ জানান। আল্লামা যহীর এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বলেন, ‘আমার জীবনের নিরাপত্তার গ্যারান্টি কে দিবে’? তখন সেই শী‘আ আলেম তাঁকে বলেন, আমি আপনার জীবনের নিরাপত্তার গ্যারান্টি প্রদান করব এবং আপনি পাকিস্তানে ফিরে না আসা পর্যন্ত আমি এখানে আপনার অনুসারীদের কাছে অবস্থান করব। আল্লামা যহীর তখন বলেন, ‘কে জানে যে, হয়ত আপনি খোমেনীর ক্রোধভাজন’। অতঃপর আল্লামা যহীর তাকে প্রশ্ন করেন, ‘আপনাদের কোন বই-ই ছাহাবীগণকে গালি দেয়া থেকে মুক্ত নয় কেন’? এ প্রশ্ন করে তিনি খোমেনীর প্রতিনিধিকে হতচকিত করে দিয়ে ‘অছূলুল আখয়ার ইলা উছূলিল আখবার’ গ্রন্থটি হাতে নেন। ঐ শী‘আ আলেম তখন বলেন, এ বইয়ের কোথায় ছাহাবীগণকে গালি দেয়া হয়েছে দেখান? আল্লামা যহীর বইটির ১৬৮ পৃষ্ঠা খুলেন যেখানে লেখা ছিল, ‘আমরা (শী‘আরা) এদেরকে (ছাহাবীগণকে) গালিগালাজ করে ও তাদের সাথে এবং তাদেরকে যারা ভালবাসে তাদের সাথে শত্রুতা পোষণ করে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করি’। অতঃপর সেই শী‘আ আলেম তাঁকে খোমেনীর একটি পত্র হস্তান্তর করেন এবং সাক্ষাৎ শেষ হওয়ার ও যহীর পত্রটি পড়ে দেখার পূর্বেই জিজ্ঞেস করেন, খোমেনীর ব্যাপারে আপনার মতামত কি? জবাবে আল্লামা যহীর বলেন, আল্লাহর কাছে দো‘আ করছি তিনি যেন তাকে দীর্ঘজীবি করেন। তাঁর কথা শেষ না হতেই ঐ শী‘আ আলেম বললেন, আপনি আমাদের ব্যাপারে সুস্পষ্ট মতামত ব্যক্ত করুন। তখন তিনি বললেন, আমাকে কথা শেষ করতে দিন। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছি তিনি তাকে দীর্ঘজীবি করুন এবং যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা দিন। যতক্ষণ না তিনি ধ্বংস হন এবং মুসলমানদেরকে তার অনিষ্ট থেকে রক্ষা করেন। একথা শুনে ঐ শী‘আ আলেম বলেন, এ কেমন শত্রুতা! অতঃপর মিটিং সমাপ্ত হয়।[2]
৩. একদা ওমানের মিড্ল ইস্ট ব্যাংকের প্রধান আল্লামা যহীরের সাথে সাক্ষাৎ করে তাঁকে বলেন, শী‘আদের সম্পর্কে লেখালেখি ছেড়ে দিন, আমি আপনার জন্য দুই মিলিয়ন (২০ লাখ) রিয়াল ব্যয়ে আহলেহাদীছের জন্য একটি মারকায বা কেন্দ্র নির্মাণ করে দিব।[3]
৪. একবার ইরানের প্রেসিডেন্ট খামেনীর দূত আল্লামা যহীরের বাড়িতে এসে তাঁকে বলেন, শী‘আদের সম্পর্কে লেখালেখি বাদ দিন। জবাবে তিনি বলেন, আপনারা আপনাদের বইগুলো পুড়িয়ে ফেলুন, আমি আপনাদের সম্পর্কে লেখালেখি ছেড়ে দিব।[4]
৫. ১৯৮০ সালে আল্লামা যহীর হজ্জ করতে গেলে মক্কায় শী‘আদের কয়েকজন বড় মাপের আলেম তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করে বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে ‘আশ-শী‘আ ওয়াস সুন্নাহ’-এর মতো বই লেখা উচিত নয়। তখন তিনি তাদেরকে বলেন, ‘আপনারা ঠিকই বলেছেন। তবে আপনারা আমাকে বলুন, আমার বইয়ে এমন কোন কথা কি উল্লেখ করা হয়েছে যা আপনাদের বইয়ে নেই’? তখন তারা বলল, হ্যাঁ, সবই আমাদের বইয়ে আছে। তবে বিষয়গুলোকে এভাবে উত্থাপন করা ঠিক নয়। তখন তিনি বলেন, আপনারা কি বলতে চাচ্ছেন? আল্লামা যহীর তাদের কথা শুনার কারণে তারা আনন্দে বাগবাগ হয়ে বলল, উক্ত বইটি বাযেয়াফ্ত করে পুড়িয়ে ফেলুন। দ্বিতীয়বার তা প্রকাশ করবেন না। তিনি বললেন, ঠিক আছে তাই হবে। তবে একটি শর্তে? শর্তটি উল্লেখ করার পূর্বেই তারা আনন্দে বলা শুরু করল, যে কোন শর্তে আমরা রাযী আছি। এরপর আল্লামা যহীর বললেন, আপনাদের যেসকল বই থেকে আমি ঐসব অসত্য কল্পকাহিনী উল্লেখ করেছি সেগুলো সব বাযেয়াফ্ত করুন এবং জ্বালিয়ে দিন, যাতে বাস্তবিকই এর পরে মতদ্বৈততার আর কোন অবকাশ না থাকে এবং আমার পরে ঐসব বই থেকে আর কেউ উদ্ধৃতি দিতে না পারে। আমরা চিরতরে মতদ্বৈততার মূলোৎপাটন করতে চাই। এরপর তারা বলল, আপনি জানেন যে, ওগুলো বিভিন্ন বইয়ের পৃষ্ঠাসমূহে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল। সবার হাতের নাগালে ছিল না। কিন্তু আপনি ঐগুলো একটা বইয়ের মধ্যে জমা করেছেন এবং মুসলিম ঐক্য ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছেন। এর জবাবে আল্লামা যহীর দ্ব্যর্থহীনকণ্ঠে বলেন, হ্যাঁ, আমি গ্রন্থ রচনা করে এই সকল আক্বীদাকে সবার হাতের নাগালে নিয়ে এসেছি। অথচ ইতিপূর্বে একটি জাতিই (শী‘আ) সেগুলো অবগত ছিল, আর অন্যরা সে সম্পর্কে বেখবর ছিল। আমি এজন্য উক্ত গ্রন্থটি রচনা করেছি যেন উভয় পক্ষই সুস্পষ্ট দলীল ও সম্যক অবগতির উপর প্রতিষ্ঠিত থাকতে পারে এবং কোন এক পক্ষই যেন শুধু ধোঁকা না খায়। যাতে একদিক থেকে নয়; বরং উভয় দিক থেকেই প্রকৃত ঐক্য অর্জিত হয়। পক্ষান্তরে আমরা আপনাদেরকে ও আপনাদের বড় বড় নেতাদেরকে সম্মান করব আর আপনারা আমাদের সাথে এবং এই উম্মতের পূর্বসূরী, এর কল্যাণকামী, এর মর্যাদার রূপকার, এর কালেমাকে সমুন্নতকারী মর্দে মুজাহিদদের সাথে বিদ্বেষ পোষণ করবেন। অথবা আমরা আপনাদের কথা বিশ্বাস করব এবং আমাদের মনের কথা খুলে বলব আর আপনারা ‘তাক্বিয়া’ নীতি অবলম্বন করে যা প্রকাশ করবেন তার বিপরীত চিন্তা-চেতনা সংগোপনে লালন করবেন, তা কখনই হ’তে পারে না। তবে হ্যাঁ, যদি আমার ঐ বইয়ে এমন কিছু পাওয়া যায় যা আপনাদের বইয়ে নেই এবং আমি যদি এমন কোন কিছুকে আপনাদের দিকে সম্পর্কিত করে থাকি যা আপনাদের মধ্যে বিদ্যমান নেই, তাহলে এর জন্য আমি দায়বদ্ধ। আপনাদের ও অন্যদের মধ্যে এমন কেউ আছে কি, যিনি এটা প্রমাণ করতে পারবেন। আরব ও অনারবের কোন ব্যক্তিই এমনটি প্রমাণ করার দুঃসাহস দেখায়নি।[5]
[1]. The life of Shaykh Ihsan Ilahi Zaheer, p. 32.
[2]. Ibid, P. 32-33.
[3]. Ibid, P. 79.
[4]. Ibid.
[5]. আশ-শী‘আ ওয়া আহলুল বায়েত, পৃঃ ৫-৬।