আল্লামা যহীরের জীবনের ছিটেফোঁটা
দুরন্ত সাহস
আল্লামা ইহসান ইলাহী যহীর প্রচন্ড সাহসী ছিলেন। মক্কার হারামের ইমাম ও সঊদী সর্বোচ্চ ওলামা পরিষদ সদস্য শায়খ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহ আস-সুবাইল বলেন, إنه كان شجاعا، وجريئا، وصريحا، ولا يكتم ما في نفسه ولا تأخذه في الله لومة لائم. ‘তিনি বীর, দুঃসাহসী ও স্পষ্টবাদী ছিলেন। তিনি মনের কথা গোপন রাখতেন না এবং আল্লাহর পথে কোন নিন্দুকের নিন্দা তাকে গ্রাস করত না’।[1] তিনি যেটাকে হক মনে করতেন সেটা প্রকাশে কোন দ্বিধা-সংকোচ বা ভয় কখনো তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি। নিম্নে তাঁর সাহসিকতার কিছু দৃষ্টান্ত পেশ করা হল-
১. আল্লামা যহীর যখন কোন বাতিল ফিরকা সম্পর্কে কোন বই লিখতেন, তখন প্রসিদ্ধ ওলামায়ে কেরামকে তার কপি পাঠাতেন। এমনকি শী‘আ ও অন্যান্য ভ্রান্ত ফিরকার লোকদের কাছেও নাম-ঠিকানা ও টেলিফোন নম্বর সহ বইপত্র পাঠাতেন। পক্ষান্তরে শী‘আরা তাঁর বিরুদ্ধে বই লিখত। কিন্তু কখনো তার কাছে সেসবের কপি পাঠাত না। উপরন্তু ঐসব বইয়ে লেখকের ছদ্মনাম ব্যবহার করত। যেমন- আল্লামা যহীরের ‘আশ-শী‘আ ওয়াস সুন্নাহ’ বইটি প্রকাশিত হলে শী‘আদের গুমর ফাঁস হয়ে যাওয়ার কারণে শী‘আ মহলে রীতিমতো ভূমিকম্প শুরু হয়ে যায়। জনৈক শী‘আ এর উত্তরে ‘আশ-শী‘আ ওয়াস সুন্নাহ ফিল মীযান’ নামে একটি বই লিখে ‘সীন-খা’ ছদ্মনাম ব্যবহার করে।[2] নিঃসন্দেহে এটি আল্লামা যহীরের সাহসিকতা ও শী‘আদের ভীরুতা-কাপুরুষতার দলীল বৈ-কি!
২. মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র থাকাকালীন নূরুদ্দীন ‘ইতর নামে একজন কট্টর হানাফী শিক্ষক ‘মুছতালাহুল হাদীছ’ (হাদীছের পরিভাষা) পড়াতেন। তিনি এ বিষয়টি পড়ানোর সময় তাতে মাতুরীদী আক্বীদা ঢুকিয়ে দিতেন। আল্লামা যহীর আদব ও সম্মান বজায় রেখে তাঁর যুক্তি খন্ডন করতেন। পরীক্ষায় কম নম্বর পাওয়ার ভয় কখনো তাঁকে পেয়ে বসেনি। বরং এক্ষেত্রে তিনি যেটাকে সঠিক মনে করতেন তা দ্ব্যর্থহীনভাবে ঐ শিক্ষকের সামনে পেশ করতেন।[3]
৩. ভারতের সাবেক প্রেসিডেন্ট ড. যাকির হুসাইন মদীনা মুনাউওয়ারায় গেলে তাঁকে মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শনের আমন্ত্রণ জানানো হয়। আল্লামা যহীর তখন ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সেক্রেটারী শায়খ নাছের আল-উবূদীকে এসে বললেন, আপনি জানেন যে, ইনি ভারতের প্রেসিডেন্ট। যে দেশটি মুসলমানদের উপর নির্যাতন-নিপীড়ন চালিয়েছে এবং তাদের কাছ থেকে কাশ্মীরকে কেড়ে নেয়ার জন্য যবরদস্তি করছে। অথচ তারা জানে যে, কাশ্মীরীরা ভারতের সাথে একীভূত হতে চায় না। একথা শুনে শায়খ উবূদী বললেন, তুমি কি করতে চাচ্ছ? তখন তিনি বলেন, আমরা একটি প্রতিনিধি দল গিয়ে তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করে তাঁর সমালোচনা করব এবং হিন্দুরা মুসলমানদের উপর কি নির্যাতন চালিয়েছে তা বিবৃত করব। শায়খ উবূদী তাঁর আবেগ ও আগ্রহের জন্য তাঁকে ধন্যবাদ জানান এবং বলেন যে, উনাকে আমাদের সম্মান করা উচিত। কারণ আমরা জানি, তাঁর এ পদ সম্মানসূচক; নির্বাহী নয়। রাজনৈতিক নির্বাহী ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর হাতে। কিন্তু যহীর যেন কিছুতেই শান্ত হচ্ছিলেন না। কারণ তিনি প্রচন্ড আবেগ নিয়ে শায়খ উবূদীর কাছে এসেছিলেন। দ্বীনের প্রতি তাঁর আগ্রহ, মুসলমানদের সমস্যা নিয়ে তাঁর চিন্তা-ভাবনা ও সাহসিকতার জ্বলন্ত সাক্ষী এ ঘটনাটি।[4]
৪. আল্লামা যহীর বাতিল ফিরক্বাগুলোর কেন্দ্রে ও তাদের মাহফিলে গিয়ে মুনাযারা করতেন নির্ভয়ে-নিঃশঙ্কচিত্তে। ১৯৬৫ সালে ইরাকের সামার্রায় এক রেফাঈ ছূফী নেতার সাথে তাঁর মুনাযারা হয়। ঐ ছূফী নেতার দাবী ছিল, সে কারামতের অধিকারী। অস্ত্র তার কোন ক্ষতি করতে পারে না। আল্লামা যহীর এর উত্তরে বিতর্কসভায় বলেছিলেন, যদি অস্ত্র, বর্শা ও চাকু আপনাদের কোন ক্ষতি করতে না পারে, তাহলে আপনারা কেন যুদ্ধের ময়দানে অবতীর্ণ হন না? গুলী ও অন্যান্য জিনিস যাদের কোন ক্ষতি করতে পারে না, সেসব লোকের ইরাকের বড্ড প্রয়োজন। তিনি সেখানে ঐ রেফাঈ ছূফী নেতাকে দ্ব্যর্থহীনকণ্ঠে বলেছিলেন, আপনি আমার হাতে একটা রিভলভার দিন। আমি গুলী ছুঁড়ে দেখিয়ে দিচ্ছি, ওটা আপনার কোন ক্ষতি করতে পারে কি-না। একথা বলার পর ঐ ভন্ড ছূফী পালাতে দিশা পায়নি।[5] একইভাবে তিনি ইরাকের কাযেমিয়াতে গিয়েও শী‘আদের সাথে বিতর্ক করেন।[6]
৫. পাকিস্তানে বাতিল ফিরকাগুলো কর্তৃক আহলেহাদীছদের নিকট থেকে অপদখলকৃত মসজিদগুলো তিনি পুনরুদ্ধার করতেন।[7]
[1]. ঐ, পৃঃ ৫০।
[2]. আশ-শী‘আ ওয়া আহলুল বায়েত, পৃঃ ৪; ড. যাহরানী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ৫৩।
[3]. ড. যাহরানী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ৫৮।
[4]. ঐ, পৃঃ ৫৮-৫৯।
[5]. দিরাসাত ফিত-তাছাউওফ, পৃঃ ২৩২।
[6]. ড. যাহরানী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ২১৮।
[7]. ঐ, পৃঃ ৫৮