ইহসান ইলাহী যহীর

রক্তস্নাত লাহোর ট্র্যাজেডি

১৯৮৭ সালের ২৩শে মার্চ সোমবার লাহোরের কেল্লা লছমনসিং ফোয়ারা চক রাভী পার্কে ‘আহলেহাদীছ ইয়ুথ ফোর্স’ লছমনসিং এলাকার উদ্যোগে এক বিরাট ইসলামী জালসায় আল্লামা ইহসান ইলাহী যহীর তদানীন্তন পাকিস্তানের দুর্দশা ও তার প্রতিকার সম্পর্কে বক্তৃতা করছিলেন। হামদ ও ছানার পর তিনি তাঁর বক্তব্যের প্রথমদিকে বলেন, ‘আপনারা জানেন, আমাদের দেশ কঠিন দুঃসময় অতিক্রম করছে। একথা শুধু পাকিস্তানের বেলায়ই প্রযোজ্য নয়; বরং গোটা মুসলিম বিশ্ব বর্তমানে যে দুঃসন্ধিক্ষণের সম্মুখীন হয়েছে, তা কখনো মুসলিম বিশ্বে আপতিত হয়নি। বর্তমান বিশ্বে মুসলমানদের সংখ্যা অনেক। চৌদ্দশ বছরের মুসলিম ইতিহাসে বর্তমানের ন্যায় এতো জনসংখ্যা কখনো ছিল না। বর্তমানে মুসলিম জনসংখ্যা ১২০ কোটির বেশি। এখন পৃথিবীতে ৪৫টির বেশি মুসলিম রাষ্ট্র রয়েছে। এর পাশাপাশি বর্তমানে মুসলমানদের কাছে এত সম্পদ রয়েছে যার কল্পনাই করা যায় না। ... ধন-সম্পদ, জনসংখ্যা এবং রাষ্ট্র সত্ত্বেও মুসলমানদের উপর লাঞ্ছনা ও পরমুখাপেক্ষিতা চাপিয়ে দেয়া হয়েছে’ (বাক্বারাহ ৬১)। আজ মুসলমানরা যতটা লাঞ্ছিত-অপমানিত, কিংকর্তব্যবিমূঢ়, দুর্বল, অসহায়, পরাভূত-নির্যাতিত, ততটা বিশ্বের ইতিহাসে কখনো ছিল না। আমরা কখনো কি একথা চিন্তা করেছি যে, আমাদের সংখ্যা ও সম্পদ সবচেয়ে বেশি এবং রাষ্ট্র অসংখ্য হওয়া সত্ত্বেও আমরা কেন সীমাহীন লাঞ্ছনার শিকার। আসলে এর কারণ কি? কেন এমনটা হল’? এরপর তিনি তাঁর বক্তৃতায় জেনারেল যিয়াউল হকের কঠোর সমালোচনা করেন। কারণ তিনি ভারত সফরে গিয়ে সোনিয়া গান্ধীর সামনে মাথা ঝুঁকিয়ে করমর্দন করেছিলেন। এভাবে বক্তব্যের এক পর্যায়ে আল্লামা ইকবালের কবিতা-

 كافر ہے تو شمشير پہ كرتا ہے بهروسا

مؤمن ہے تو بے تيغ  بهى (لڑتا ہے سپاهى)

এ পর্যন্ত বলা মাত্রই রাত ১১-টা ২০ মিনিটের দিকে একটি শক্তিশালী টাইমবোমা বিস্ফোরিত হয়। তখন তিনি মাত্র ২০/২২ মিনিট বক্তৃতা করেছেন।[1]

বোমাটি স্টেজের নিচে পেতে রাখা ছিল। এর পূর্বে একটি ফুলদানি মঞ্চে রাখার জন্য জালসার পিছন থেকে পাঠানো হয়েছিল, যেটিতে শক্তিশালী রাসায়নিক দ্রব্য ছিল।

বোমা বিস্ফোরণের পর সেখানে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। লোকজনের আর্তচিৎকারে সেখানকার আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে উঠে। সবাই প্রাণভয়ে দিগ্বিদিক ছুটাছুটি করতে থাকে। ৯ জন ঘটনাস্থলেই শহীদ হয়েছিলেন এবং আহত হয়েছিলেন ১১৪ জন। আহত ও নিহতদের রক্তে ময়দান রঞ্জিত হয়ে গিয়েছিল। আশপাশের কয়েকটি বাড়ি ও বিল্ডিংও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। নিহতদের মধ্যে ছিলেন ‘জমঈয়তে আহলেহাদীছ পাকিস্তান’-এর ডেপুটি সেক্রেটারী জেনারেল মাওলানা হাবীবুর রহমান ইয়াযদানী (১৯৪৭-১৯৮৭), মাওলানা আব্দুল খালেক কুদ্দূসী (১৯৩৯-১৯৮৭), ‘আহলেহাদীছ ইয়ুথ ফোর্স’ প্রধান মাওলানা মুহাম্মাদ খান নাজীব, মাওলানা মুহাম্মাদ শফীক খান, জালসার সভাপতি ইহসানুল হক, নাঈম বাদশাহ, রানা যুবায়ের, ফারূক রানা, মুহাম্মাদ আসলাম, মুহাম্মাদ আলম, আব্দুস সালাম, সেলীম ফারূকী প্রমুখ। বোমা বিস্ফোরণের পর আল্লামা যহীর ২০/৩০ মিটার দূরে ছিটকে পড়েন। কিন্তু তখনও তিনি জ্ঞান হারাননি। তাঁকে মারাত্মক আহত অবস্থায় লাহোরের কেন্দ্রীয় মিউ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তিনি সেখানে পাঁচদিন ইন্টেনসিভ কেয়ারে (নিবিড় পর্যবেক্ষণে) চিকিৎসাধীন থাকেন।[2]



[1]. ‘শহীদে মিল্লাত কা আখেরী পয়গাম’, মুমতায ডাইজেস্ট, বিশেষ সংখ্যা-১, পৃঃ ৭০-৮১; বিশেষ সংখ্যা-২, পৃঃ ১১৩-১৪।

[2]. মুহাম্মাদ ছায়েম, শুহাদাউদ দাওয়াহ আল-ইসলামিয়াহ ফিল ক্বারনিল ইশরীন (কায়রো : দারুল ফাযীলাহ, ১৯৯২), পৃঃ ১৬৬-৬৭; মুহাম্মাদ বিন ইবরাহীম আশ-শায়বানী, ইহসান ইলাহী যহীর : আল-জিহাদু ওয়াল ইলমু মিনাল হায়াতি ইলাল মামাত (কুয়েত : ১৪০৭ হিঃ), পৃঃ ১৮-২০; ড. যাহরানী, প্রাগুক্ত, পৃঃ ৬৬; মুমতায ডাইজেস্ট, বিশেষ সংখ্যা-২, পৃঃ ১১৩-১৪; ‘আদ-দাওয়াহ’, সঊদী আরব, সংখ্যা ১১১৫, ৯ নভেম্বর ১৯৮৭, পৃঃ ৩১।