ইক্বামতে দ্বীন পথ ও পদ্ধতি

আক্বাবার ১ম বায়‘আত

১১ নববী বর্ষে ৬২০ খৃষ্টাব্দের জুলাই মাসে ইয়াছরিবের খাযরাজ গোত্রের ৬ জন সৌভাগ্যবান যুবক হজ্জে আগমন করেন, যাদের নেতা ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ তরুণ আস‘আদ বিন যুরারাহ। বাকী পাঁচ জন হলেন, ‘আওফ ইবনুল হারিছ, রাফে‘ বিন মালেক, কুৎবা বিন ‘আমের, ‘উক্ববাহ বিন ‘আমের ও জাবের বিন ‘আবদুল্লাহ। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আবুবকর ও আলী (রাঃ)-কে সাথে নিয়ে মিনায় তাঁবুতে তাঁবুতে দাওয়াত দেওয়ার এক পর্যায়ে তাদের নিকটে পৌঁছেন। তারা ইতিপূর্বে ইয়াছরিবের ইহুদীদের নিকটে আখেরী নবীর আগমন বার্তা শুনেছিল। ফলে রাসূলের দাওয়াত তারা দ্রুত কবুল করে নেন। তারা তাঁর আগমনের মাধ্যমে গৃহযুদ্ধে ক্ষত-বিক্ষত ইয়াছরিবে শান্তি স্থাপিত হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন এবং তাঁকে ইয়াছরিবে হিজরতের আমন্ত্রণ জানান।

বলা বাহুল্য, হজ্জ থেকে ফিরে গিয়ে উক্ত ছয় জনের ক্ষুদ্র দলটি ইয়াছরিবের ঘরে ঘরে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছে দেন এবং পরবর্তী বছরে ১২ নববী বর্ষের হজ্জ মওসুমে জাবের বিন আবদুল্লাহ ব্যতিরেকে পুরানো ৫ জন ও নতুন ৭ জন মোট ১২ জন এসে মিনাতে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকটে বায়‘আত করেন। এঁদের সবাই ছিলেন খাযরাজী ও ২ জন ছিলেন আউস গোত্রের। এটাই ছিল ‘আক্বাবার প্রথম বায়‘আত’ (بَيْعَةُ الْعَقَبَةِ الْأُوْلَى)

‘আক্বাবাহ’ অর্থ পাহাড়ী সুড়ঙ্গ পথ। এই পথেই মক্কা থেকে মিনায় আসতে হয়। এরই মাথায় মিনার পশ্চিম পার্শ্বে এই স্থানটি ছিল নির্জন। এখানে পাথর মেরে হাজী ছাহেবগণ পূর্ব প্রান্তে মিনার মসজিদে খায়েফের আশ-পাশে আশ্রয় নিয়ে রাত্রি যাপন করে থাকেন। এখানে ‘জামরায়ে কুবরা’ অবস্থিত। এখানেই ইসমাঈল (আঃ) ইবলীসকে প্রথম পাথর মেরেছিলেন। আর এখানেই ইসমাঈল বংশের শ্রেষ্ঠ সন্তান শেষনবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মানবরূপী শয়তানদের বিরুদ্ধে অহি-র বিধান কায়েমের জন্য ঐতিহাসিক ‘বায়‘আত’ গ্রহণ করেন। ঐদিনের ঐ আক্বীদার বিপ্লব পরবর্তীতে শুধু মক্কা-মদীনা নয়, বরং বিশ্ব রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি সবকিছুতে ব্যাপক পরিবর্তনের সূচনা করে ও অবশেষে তা সার্বিক সমাজ বিপ্লব সাধন করে। ১২ নববী বর্ষের হজ্জের মওসুমে ঐদিনকার বায়‘আতকারীদের মধ্যে নতুন আগত খ্যাতনামা ছাহাবী ‘উবাদাহ বিন ছামিত আনছারী (রাঃ) উক্ত বায়‘আতের বর্ণনা দিয়ে বলেন,

أَنَّ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ تَعَالَوْا بَايِعُونِى عَلَى أَنْ لاَ تُشْرِكُوا بِاللهِ شَيْئًا، وَلاَ تَسْرِقُوا، وَلاَ تَزْنُوا، وَلاَ تَقْتُلُوا أَوْلاَدَكُمْ، وَلاَ تَأْتُو بِبُهْتَانٍ تَفْتَرُونَهُ بَيْنَ أَيْدِيكُمْ وَأَرْجُلِكُمْ، وَلاَ تَعْصَوْا فِى مَعْرُوفٍ، فَمَنْ وَفَى مِنْكُمْ فَأَجْرُهُ عَلَى اللهِ، وَمَنْ أَصَابَ مِنْ ذَلِكَ شَيْئًا فَعُوقِبَ بِهِ فِى الدُّنْيَا فَهُوَ كَفَّارَةٌ لَهُ، وَمَنْ أَصَابَ مِنْ ذَلِكَ شَيْئًا فَسَتَرَهُ اللهُ عَلَيْهِ فِىْ الدُّنْيَا فَهُوَ إِلَى اللهِ، إِنْ شَاءَ عَفَا عَنْهُ، وَإِنْ شَاءَ عَاقَبَهُ، فَبَايَعْتُهُ عَلَى ذَلِكَ-

‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাদেরকে ডেকে বলেন, এসো! আমার নিকটে তোমরা একথার উপরে বায়‘আত করো যে, (১) আল্লাহর সাথে কোনকিছুকে শরীক করবে না, (২) চুরি করবে না, (৩) যেনা করবে না, (৪) তোমাদের সন্তানদের হত্যা করবে না, (৫) কারু প্রতি মিথ্যা অপবাদ দিবে না, (৬) শরী‘আতসম্মত কোন বিষয়ে অবাধ্যতা করবে না। যে ব্যক্তি উক্ত অঙ্গীকার পূর্ণ করবে, তার জন্য পুরস্কার রয়েছে আল্লাহর নিকটে। কিন্তু যে ব্যক্তি এসবের মধ্যে কোন একটি করবে, অতঃপর দুনিয়াতে তার (আইন সংগত) শাস্তি হয়ে যাবে, সেটি তার জন্য কাফফারা হবে (এজন্য আখেরাতে তার সাজা হবে না)। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি এসবের কোন একটি করে, অতঃপর আল্লাহ তা গোপন রাখেন (যে কারণে তার শাস্তি হ’তে পারেনি) তাহ’লে উক্ত শাস্তির বিষয়টি আল্লাহর মর্জির উপরে নির্ভর করে। তিনি ইচ্ছা করলে তাকে পরকালে শাস্তি দিতে পারেন, ইচ্ছা করলে মাফও করে দিতে পারেন’। রাবী ‘উবাদাহ বিন ছামেত বলেন, আমরা একথাগুলির উপরে তাঁর নিকটে বায়‘আত করলাম’।[1] বলা বাহুল্য যে, বায়‘আতের উক্ত ৬টি বিষয় তৎকালীন আরবীয় সমাজে প্রকটভাবে বিরাজমান ছিল। আজও বাংলাদেশে উক্ত বিষয়গুলি প্রকটভাবে বিরাজ করছে।


[1]. মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/১৮ ‘ঈমান’ অধ্যায়।