আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ-এর কেন্দ্রীয় প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মাদ নযরুল ইসলাম-এর সাক্ষাৎকার


যশোর এম এম কলেজের সাবেক ভাইস প্রিন্সিপ্যাল এবং আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ-এর কেন্দ্রীয় প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মাদ নযরুল ইসলাম-এর

সাক্ষাৎকার

(১) আহলেহাদীছ যুবসংঘ : আপনার বর্ণাঢ্য জীবনে কয়েকটি অধ্যায় অতিবাহিত করেছেন। ছাত্র জীবন, অধ্যাপনা জীবন, রাজনীতি এবং সবশেষে এখন সমাজ সংস্কার আন্দোলন আহলেহাদীছ আন্দোলনে শ্রম ব্যয় করছেন। আপনার কাছে কোন্ জীবন অধিক কল্যাণকর মনে হয়েছে?

প্রফেসর নযরুল ইসলাম : সকল প্রশাংসা আল্লাহর জন্য এবং দরূদ ও সালাম বর্ষিত হোক মানবজাতির শ্রেষ্ঠ রাহবার মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর প্রতি। হে প্রিয় বৎসরা! তোমরা আমার মত একজন তুচ্ছ ও নগণ্য ব্যক্তির সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করেছ তার জন্য তোমাদেরকে আন্তরিক, অকৃত্রিম ও অকুণ্ঠ ধন্যবাদ জানাচ্ছি। তোমাদের প্রথম প্রশ্নের জবাব লম্বা করেই দেব। কারণ এর মধ্যেই আমার মানসিক অবস্থা এবং অন্যান্য আনুসঙ্গিক প্রশ্নের জবাব পেয়ে যাবে। তোমরা আমার স্বল্পমূল্যের জীবনের পাঁচটি অধ্যায় উল্লেখ করে তার মধ্যে কোন্টি আমার নিকট অধিক কল্যাণকর বিবেচিত হয়েছে তা জানতে চেয়েছ। কোন প্রকার দ্বিধা-সংকোচ ছাড়াই আমি বলব যে, আমার জীবনের বর্তমান অধ্যায়টিই দুনিয়া ও আখেরাতের যিন্দেগীর জন্য অধিকতর কল্যাণকর। আর তোমাদের সাংগঠনিক কর্মতৎপরতাই আমাকে আহলেহাদীছ আন্দোলনের সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যুক্ত করেছে। 

বৎসরা! আমি কোন খানকাচারী দুনিয়া বিমুখ জীব নই। আমি মানব জাতির সাথে বিজড়িত একজন মানুষ। মানব যিন্দেগীর প্রতিটি তরঙ্গ প্রবাহের উত্থান পতনের সাথে আমার জীবনের প্রতিটি শ্বাস-প্রশ্বাস জড়িত। তোমরাও একটি আদর্শ কাফেলার সর্বাপেক্ষা উন্নততর সদস্য; যারা আরোও বেশী আন্দোলিত ও আলোড়িত। বয়ঃধর্মীতার উত্তেজনা, দৃষ্টিভঙ্গির একমুখী বৃত্ত ছিন্ন করে দুনিয়ার দিকে তাকিয়ে দেখ। জড়বাদী অপসভ্যতা আজ যেভাবে সমগ্র জাতির টুটি চেপে ধরে তাদের অস্তিত্ব বিনাশে উদ্যত হয়েছে, তা অতীতের সকল প্রকার অত্যাচার অনাচার ও নিগ্রহের বীভৎসতাকে হার মানিয়েছে। বিশেষ করে মুসলিম অধ্যুষিত দেশগুলোতে এদের হিংস্রতা ও বর্বরতার ভয়াবহ তান্ডব কি দেখতে পাচ্ছো না? জাগতিক শিক্ষার আলো, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উৎকর্ষতা এদের পশ্বাচারকে নিবৃত্ত করেনি; বরং অধিকতর শানিত করে তুলেছে। কোটি কোটি আদম সন্তান ও তাদের সম্পদ প্রতিনিয়ত এদের হাতে বিনষ্ঠ হয়ে যাচ্ছে। এটা হচ্ছে শয়তানী জড়বাদী অসভ্যতার বাইরের চরিত্র। এদের প্রকৃত বর্বরতার মূল প্রতিপাদ্য ওদের গৃহীত জীবন দর্শন ও নৈতিকতার মধ্যেই রয়েছে। এটা বিশ্ব ব্যবস্থাপনাকে স্রষ্টা বিহীন মনে করার বিষময় ফল। যেমন মানব জীবন প্রাকৃতিক বিবর্তনের মাধ্যমে উদ্ভূত। মানুষ যমীনে বিচরণশীল বহীন পশু, আত্মাহীন দেহসর্বস্ব জীব। জৈবিক ভোগাকাঙ্খা পূরণ করা ছাড়া জীবনের অন্য কোন উদ্দেশ্য নেই। পার্থিব জীবনের বাইরে অন্য কোন জীবন নেই। জবাবদিহিতার প্রশ্ন অলীক ধারণা মাত্র। বেঁচে থাকাটাই ধর্ম। এগুলোই হল, জড়বাদী সভ্যতার নোংরা চিত্র।

বর্তমান পৃথিবীর অধিকাংশ রাষ্ট্র ব্যবস্থা এই ভ্রান্ত দর্শন ও নীতির উপর দাঁড়িয়ে আছে। ধর্মহীন পুঁজিবাদী গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদী সমাজতন্ত্র, ধর্ম ও ভাষা ভিত্তিক সংকীর্ণ রাষ্ট্রচিন্তা সবই অন্ধ জাহেলিয়াতের উপর ভিত্তিশীল। বিশ্ব মানবতার জন্য দুর্ভাগ্য হল, এই সব বিকৃত ধর্ম ও দর্শনগুলো এখন অপসভ্যতার ব্যাধিগ্রস্ত দেহে রক্ত সঞ্চালনকারীর ভূমিকা পালন করেছে।

স্নেহের ছেলেরা! মানবজাতির এই জাহেলী ব্যাধি নিরাময়ের সঞ্জীবনী নিয়ে এসেছিলেন আম্বিয়ায়ে কেরাম (আঃ)। সেই ধারার পূর্ণতা নিয়ে এসেছিলেন মুহাম্মাদ (ছাঃ)। মানবজাতি কয়েক শতাব্দী উক্ত ধারায় সিক্ত ও পরিতৃপ্ত হয়েছিল। কিন্তু মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর সার্থক অনুসারীদের পরবর্তী উত্তরসূরীরা তাদের কর্তব্য সম্পর্কে গাফেল হয়ে গেল। নিজেরা মরলো, পৃথিবীকেও মারলো। শাসকগণ হলেন অজ্ঞ বিলাসী আর আলিমগণ হলেন মাযহাবী কোন্দলে জর্জরিত। ফল যা হবার তাই হল। জনসংখ্যার বিপুলতা, রাষ্ট্র সংখ্যার আধিক্য, সম্পদের অঢেল প্রাচুর্য সব আছে। কিন্তু খুইয়েছে সেই সঞ্জীবনী আদর্শ। অথচ তা অবিকল ও অবিকৃত অবস্থায় সুরক্ষিত আছে মহা গ্রন্থ আল-কুরআনে, বিশুদ্ধ হাদীছের মধ্যে। আজ অধঃপতিত মানবজাতির মুক্তির জন্য প্রয়োজন শুধু একদল দুঃসাহসী মানুষের, যারা যুগের গতি পরিবর্তনের সংগ্রামে জীবন বাজি রেখে এগিয়ে আসবে। আল্লাহ হাত গুটিয়ে বসে নেই। তাঁর মোবারক হাত এখনো প্রসারিতই আছে। কিন্তু সে সাহায্য নেয়ার মত বান্দা কই?

পিয়ারা যুবকরা! সব সভ্যতার আজল নির্ধারিত। এই মুদ্দত অতিক্রম করার কারো সাধ্য নেই। উক্ত মুদ্দত শেষ করে এখন এরা ওদের মৃত লাশ বয়ে বেড়াচ্ছে। এরা আর কোন প্রচ্ছন্ন যোগ্যতা দেখাতে পারবে না, যাতে আল্লাহ তাদেরকে আরো কিছুদিন পৃথিবীর রঙ্গমঞ্চে ভোজবাজির নৈপুন্য দেখাবার সুযোগ দিবেন। অপেক্ষা শুধু একটি সত্যনিষ্ঠ দলের, যারা এদেরকে ক্ষমতার মঞ্চ থেকে ধাক্কা দিয়ে পুরীষবাহী নর্দমায় এদের ফেলে দেবে। রকমারি ইসলামী লেবেল পরা দলগুলো সম্পর্কে আমি জানি, তারা পাশ্চাত্যের বিষাক্ত মতবাদ অনুসরণের মাধ্যমে ইসলাম প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখে। তাছাড়া মাযহাবী বিভক্তির খিলকা যাদের অঙ্গভূষণ তাদের কাছ থেকে দুনিয়াবাসী কোনদিন নাজাতের পথ পাবে কি?

আমি তোমাদের গঠনতন্ত্রের দিকে তাকাই আর তোমাদের কর্মপদ্ধতির রোখ্ দেখি আর ব্যাকুলতা নিয়ে হাত উঠাই- হে পরোয়ার দিগারে আলম! এই ক্ষুদ্র কাফেলা কি সেই কাফেলা? যাদের জন্য নির্যাতিত মানবতা প্রহর গুণছে আর ফরিয়াদ করছে- ‘ওয়াজ‘আল লানা মিল্লাদুনকা অলিইঅাঁও ওয়াজ‘আল লানা মিল্লাদুনকা নাছীরা’- অর্থাৎ ‘আর আপনার পক্ষ থেকে আমাদের জন্য একজন অভিভাবক ও একজন সাহায্যকারী নির্ধারণ করুন’ (নিসা ৭৫)। এমন একটি দলের সঙ্গে থাকা কতটা কল্যাণকর তা সহজেই অনুমান করা যায়।

(২) আহলেহাদীছ যুবসংঘ : ১৯৮৯ সালে ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব আহলেহাদীছদের মাঝে ফাটল সৃষ্টি করেছেন বলে ‘জনশ্রুতি’ আছে। এ ব্যাপারে আপনার বক্তব্য কী?

প্রফেসর নযরুল ইসলাম : প্রিয় বৎসরা! তোমরা এই প্রশ্নের ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে যে সাবধানতা ও উদার, মার্জিত ইসলামী রুচিবোধের পরিচয় দিয়েছ তার জন্য আমি তোমাদেরকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। সম্পূর্ণ ঈর্ষা, বিদ্বেষ ও পরশ্রীকাতর মনোভাবের অধিকারী ব্যক্তিরা যখন অন্যের স্বার্থ রক্ষার জন্য ভিত্তিহীন মিথ্যচার করে, তখন কি তাকে ‘জনশ্রুতি’ বলা যায়? ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে এই সতর্ক সংযমী নীতি আমাকে স্মরণ করিয়ে দেয় পবিত্র কুরআনে বর্ণিত সেই সমস্ত আবেদ বান্দার কথা, যারা জাহেলদের সম্মুখীন হলে তাদেরকেও সালাম জানায় (ফুরক্বান ৬৩)

উক্ত প্রশ্ন সম্পর্কে আমার বক্তব্য হল, ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব বা ‘যুবসংঘ’ আহলেহাদীছের মাঝে ফাটল সৃষ্টি করেছে- এই মিথ্যা অপবাদ গল্পে বর্ণিত নেকড়ে বাঘ আর মেষ রাখালের কাহিনীর মত হল না কি? আমার জানা মতে ‘জমঈয়ত’ ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিবকে সংগঠনের সকল দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয় এবং ‘আহলেহাদীছ যুবসংঘে’র সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে। এক যুগের প্রতিষ্ঠিত সংগঠনের সাথে ‘জমঈয়ত’ ‘সম্পর্কহীনতা’ ঘোষণা করে এবং ‘শুববান’ গঠন করে যে জ্ঞানহীন নীতি অবলম্বন করেছিল সেটিই আহলেহাদীছ সমাজের ফাটল সৃষ্টির একমাত্র কারণ।

(৩) আহলেহাদীছ যুবসংঘ : জমঈয়ত সভাপতি ড. আব্দুল বারী যুবসংঘের কেন্দ্রীয় কাউন্সিল সদস্য সম্মেলনে প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত থেকেছেন। তাদের শপথ নিয়েছেন এবং তাঁর পক্ষ থেকে যুবসংঘের গঠনতন্ত্রও ছাপানো হয়েছিল। কিন্তু ‘জমঈয়ত’ ‘আহলেহাদীছ যুবসংঘে’র সাথে ‘সম্পর্কহীনতা’ ঘোষণা করল কেন? 

প্রফেসর নযরুল ইসলাম : এগুলো তো সত্য কথা, যার মুদ্রিত দলীলও মওজুদ রয়েছে। কিন্তু এরপরও ‘জমঈয়ত’ আহলেহাদীছ যুবসংঘের সাথে ‘সম্পর্কহীনতা’ ঘোষণা করে এবং ‘শুববান’ গঠন করে স্থায়ী বিভক্তির ব্যবস্থা করে। আমি সরাসরি এ প্রশ্ন তাঁর কাছেই উপস্থাপন করেছি। কিন্তু কোন সদুত্তর পাইনি। পরিশেষে জমঈয়তের একটি সম্মেলনে এই রেকর্ডগুলো তুলে ধরে প্রশ্ন করার কারণে প্রচন্ড ধমক খেয়েছি এবং চাকরী থেকে বদলির হুমকিও শুনেছি। এ পন্থা তিনি কেন বেছে নিয়েছিলেন তা আল্লাহই ভাল জানেন। কারণ যুক্তি দিয়েও এর উত্তর মিলাতে পারিনি। আমি মনে করি, এসব অতীতের তিক্ত স্মৃতি নিয়ে অযথা হয়রান হওয়ার প্রয়োজন নেই। আলোচনা-সমালোচনা করারও সময় এখন আর নেই। যার যার পথ তার তার সামনে প্রসারিত, উন্মুক্ত। কোন্ পথ সঠিক তা স্বয়ং আল্লাহই নির্ধারণ করে দিবেন। কাজ করে যাও। বিশাল কর্মক্ষেত্র তোমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। আল্লাহ তোমাদের সহায় হৌন!

দেখ বৎসরা! রাজনৈতিক হোক কিংবা ধর্মীয় হোক যেকোন সংগঠনের পনেরো আনা ঢাকা থাকে কালো পর্দার আড়ালে। সাধারণ মানুষ এই পর্দা ভেদ করে আড়ালের কর্মকান্ড দেখতে পায় না। জমঈয়তের শীর্ষ নেতার সাক্ষাতে সরাসরি এই প্রশ্নটি উত্থাপন করেছি। কিন্তু জমঈয়ত সভাপতির অনিন্দ্য সুন্দর মুখে শুধু হতাশার ছাপ ফুটে উঠতে দেখেছি। তাছাড়া উত্তর দেয়ার কিছু ছিল না। আমার স্থির ধারণা হয়েছিল যে তাকে কোন অদৃশ্য শক্তি বিভ্রান্ত করে ‘সম্পর্কহীনতা’র সিদ্ধান্ত নিতে প্ররোচিত করেছে। আর জমঈয়তের সদস্য তালিকায় এমন অনেক ব্যক্তি ছিলেন যারা এই দুরভিসন্ধিতে জড়িত ছিলেন, আজও আছেন। 

(৪) আহলেহাদীছ যুবসংঘ : সম্পর্কহীনতার দীর্ঘদিন পর ১৯৯৪ সালে ২৩ সেপ্টেম্বর ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’ নামে মরুববী সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়। দীর্ঘ বিরতির কারণ কী ছিল? ঐক্যের প্রচেষ্টা, না প্লাটফরম শক্তিশালী করা?

প্রফেসর নযরুল ইসলাম : ১৯৮৯ সালের ২১জুলাই ‘জমঈয়ত’ ‘আহলেহাদীছ যুবসংঘে’র সাথে ‘সম্পর্কহীনতা’ ঘোষণা করে। এরপর থেকে বিভিন্নভাবে ঐক্যের প্রচেষ্টা অব্যাহত ছিল। এমন কি যুবসংঘের নেতৃবৃন্দ ৭ বার ঐক্যের উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল। কিন্তু জমঈয়ত ঐ সালের ২৮ ডিসেম্বর ‘জমঈয়তে শুববানে আহলেহাদীছ’ নামে নতুন সংগঠন কায়েম করে সকল প্রচেষ্টাকে স্তব্ধ করে দেয় এবং বিভক্তিকে চূড়ান্ত রূপ দেয়। এর ফলে ঐক্য প্রচেষ্টা কার্যত অসাধ্য হলেও আশাহীন আশার পেছনে ছোটার মতো বিচ্ছিন্ন প্রচেষ্টা ক্ষীণভাবে চলছিল। এই দূরাশার পিছনে ছুটে ছুটে সম্ভাবনার ক্ষীণ আশাটুকুও যখন আর দেখা গেল না, তখন দীর্ঘ সোয়া পাঁচ বছর অপেক্ষার পর ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’ নামে মুরববী সংগঠন প্রতিষ্ঠা করা হয়। কারণ দীর্ঘ এক যুগ ধরে গড়ে ওঠা একটি অনন্য সংগঠনকে মুষ্টিবিহীন রাখার অর্থই হল সংগঠনটিকে অনিবার্যভাবে ধ্বংস করে ফেলা। তাই নিরুপায় অবস্থার ঘের থেকে উদ্ধার করাই ছিল মুরববী সংগঠন প্রতিষ্ঠার মৌলিক উদ্দেশ্য।

(৫) আহলেহাদীছ যুবসংঘ : অনেকে ঐক্য প্রচেষ্টার ব্যাপারে নীতিকথা শুনান। কিন্তু গোড়ায় সম্পর্কহীনতা কেন করা হল সে বিষয়ে নিশ্চুপ থাকেন। এর কারণ কী বলে আপনি মনে করেন? উভয় সংগঠনের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠায় আপনার কোন ভূমিকা ছিল কি?

প্রফেসর নযরুল ইসলাম : আমি ঐ ধরনের ব্যক্তিদেরকে দুই শ্রেণীতে ভাগ করি। প্রথম শ্রেণীতে যারা আছেন, তারা অতীতের তিক্ততাকে জিইয়ে রেখে জনগণের বিভাজনকে বজায় রাখতে চান না। এরা জাতির মঙ্গলকামী। অন্য পক্ষ যারা আছেন তারা চান না যে বিভক্তি ছেড়ে তারা ঐক্যবদ্ধ হোক। তারা অতীতে যে বিভাজন রেখাটি সৃষ্টি করেছিল সেই অপকীর্তিকে আড়াল করে রাখতে চায়। আর এর দায়টাকে চাপাতে চায় ‘আহলেহাদীছ যুবসংঘে’র উপর। এভাবে ঐ বসংবদরা মিথ্যাচার করে অন্যের দালালীপোনা ও লেজুড় বৃত্তিকে টিকিয়ে রাখতে চায়। অথচ তাদের এই অপকর্ম তাদের জন্য আত্মঘাতির নামান্তর। কারণ লোকেরা যখন দলীল ভিত্তিক প্রকৃত ইতিহাস অবগত হয় তখন এদেরকে কপট এবং অদূরদর্শী হিসাবেই চিহ্নিত করে এবং সত্যকে স্বাদরে গ্রহণ করে নেয়। আর এভাবেই তারা জনসাধারণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে ও নিজেরা নিজেদের গন্ডিকে সংকীর্ণ করে ফেলছে। অন্যদিকে সত্যের আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠছে ‘আহলেহাদীছ যুবসংঘ’ ও ‘আহলেহাদীছ আন্দোলনের’ চেহারা। ফালিল্লা-হিল হামদ

জমঈয়ত কর্তৃক ড. গালিবকে অব্যাহতি দান এবং যুবসংঘের সাথে সম্পর্কহীনতা ঘোষিত হওয়ার সংবাদ আমাকে বিচলিত করে তুলেছিল। কারণ এর আসন্ন পরিণাম কঠোর হতে পারে। এটা আমার ন্যায় স্বল্প বুঝের মানুষের পক্ষেও বুঝতে বেগ পেতে হয়নি। সে সময় আমি ছিলাম সাতক্ষীরা জেলা জমঈয়তের সহ-সভাপতি। এই অবাঞ্ছিত ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে জমঈয়তের মিটিং-এ মীমাংসার উদ্যোগ গ্রহণ করার অনুরোধ জানাই। এর ফলে জেলা জমঈয়তের পক্ষ থেকে একটি প্রতিনিধি দলকে জমঈয়ত সভাপতির নিকট পাঠানোর সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ঐ সিদ্ধান্ত মোতাবেক জেলা জমঈয়তের সভাপতি সহ পাঁচ সদস্যের একটি দল আমরা ঢাকায় গমন করি। জমঈয়ত সভাপতির নিকট আমরা দু’টি দাবী উপস্থাপন করেছিলাম। প্রথম দবীটি ছিল, ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্ল­াহ আল-গালিব যেহেতু আমাদের সকলকে চেনে এবং যথেষ্ট সম্মান করে, তাই আপনি যদি অনুমতি দেন তাহলে তাকে আপনার সামনে আনতে পারি। ফলে আপনারা বিশেষভাবে মীমাংসার আলোচনা করতে পারবেন। দ্বিতীয় দাবী ছিল, ‘যুবসংঘ’ একটি সংগঠন হিসাবে পরিচিতি লাভ করেছে। তার নামটি যদি অপসন্দ হয় তাহলে নামটি পাল্টে দিন। কিংবা উক্ত সংগঠনের কোন সদস্যের কার্যকলাপ যদি ক্ষতিকর হয় তাহলে তাকে বাদ দিন। অনুগ্রহ করে ‘সম্পর্কহীনতা’র ঘোষণা প্রত্যাহার করে নিন। এছাড়া অনুরোধের ভাষায় জানিয়েছিলাম, ‘সভাপতি’ শব্দটি তো বাংলা, বাংলাদেশের সকল দলের যুব সংগঠনের নামও তো বাংলায় রাখা হয়েছে। আমাদের অনুরোধে তিনি শুধু এতটুকু বলেছিলেন, আমি তো সিদ্ধান্তটি একা গ্রহণ করিনি। অন্য সদস্যদের সাথে আলোচনা করেন। তাঁর কথাটুকু আমার নিকট সংকট নিরসনের জন্য ইতিবাচক মনে হয়েছিল।

অতঃপর আমরা ঢাকা থেকে ফিরে আসি। কয়েকদিনের মধ্যেই জানতে পারলাম যে, সাতক্ষীরা যেলা জমঈয়ত কেন্দ্রীয় নেতাদের নিয়ে একতরফা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। তাদের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধাচারণ করার ফল দাঁড়ালো এই যে- একদিন যাকে জমঈয়তের সম্পদ বিবেচনা করে জমঈয়তের সদস্য মনোনীত করা হয়েছিল, তাকেই অযাচিতভাবে জমঈয়তের দায় গণ্য করে অগোচরেই অব্যাহতি দেওয়া হল। এরপরও তারা ক্ষান্ত হয়নি। জমঈয়ত সভাপতির নিকটে আমাকে চরম আপদ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। আর এভাবেই আমার ক্ষুদ্র উদ্যোগের পথটাকে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। কী লাভ তাদের হয়েছে? জমঈয়তেরই বা তারা কতটুকু উপকার করতে পেরেছে? 

(৬) আহলেহাদীছ যুবসংঘ : অন্য দলের সেবাদাস এমন কিছু ব্যক্তির মুখে দরদভরা কণ্ঠে শোনা যায়, ড. আব্দুল বারী এবং ড. গালিব একসঙ্গে থাকলে আহলেহাদীছ সমাজের কতই না উন্নতি হ’ত। আপনার কী মনে হয়? তারা একসঙ্গে যখন ছিলেন তখন কাজের গতি কেমন ছিল?

প্রফেসর নযরুল ইসলাম : এ এক অতীতের পীড়াদায়ক অধ্যায়। রোমন্থন করা রুচিকর নয়। তবুও আমি বলবো, মূলতঃ জমঈয়তের গঠনতন্ত্রেই অপূর্ণতা ছিল। আর যতটুকু ছিল সেটুকু অনুসরণ করা হয়নি; বরং স্বপ্রণোদিত নীতি প্রয়োগ করা হয়েছে। এ ধরনের অপূর্ণ গঠনতন্ত্র ও পরিকল্পনাহীন কর্মপন্থা দ্বারা পরিচালিত একটি দল অন্যদলের সাহায্যকারী হতে পারলেও নিজে কখনও আদর্শ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অগ্রগামী হতে পারে না। বড়জোর সেটি সমাজের একটি দিকের সংস্কারকামী হতে পারে। কিন্তু জীবনের সকল দিক ও বিভাগে যুগ যুগ সঞ্চিত সমস্যা নিরসন করে পূণাঙ্গ আদর্শ কখনোই প্রতিষ্ঠা করতে পারে না। এই অসঙ্গতি ও অপূর্ণতার কারণে আজও জমঈয়ত পুরনো চেহারা পাল্টাতে পারেনি। এছাড়া গঠনতান্ত্রিক নীতি লঙ্ঘন করে দলটি হয়ে উঠেছিল সকল দল ও মতের জগাখিচুড়ী। তাই উক্ত সংগঠনের সদস্য তালিকায় দেখেছি, বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদী, বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদী, সমাজতন্ত্রী, এমনকি জামায়াতীদের নামও।

অতএব বলব, কোন আদর্শবাদী ‘আহলেহাদীছ’-এর জন্য এমতাবস্থায় স্বাচ্ছন্দে কাজ করা সম্ভব ছিল না। ফলে যা হবার তা-ই হয়েছে। আদর্শপরতা ও আদর্শহীনতা একসাথে চলতে পারে না।

(৭) আহলেহাদীছ যুবসংঘ : ড. গালিব স্যার কারারুদ্ধ থাকাকালীন রাজনৈতিক দল খোলার অনুমতি দিয়েছিলেন বলে সে সময় কর্মীদের মাঝে প্রচার করা হয়েছিল। এ বিষয়ে সংগঠনের মাঝে বিভক্তিও দেখা দেয়। এ ব্যাপারে কিছু বলবেন কি? তাঁর গ্রেফতারের পিছনে মূল কারণ কী ছিল?

প্রফেসর নযরুল ইসলাম : নিজেদের কর্মের দায় যারা স্বীকার করে তারা মহাজন। কিন্তু যারা জেনে বুঝে দায়টা অন্যের উপর চাপাতে চায় তারা অভাজন। আসাদুল্লাহ কারারুদ্ধ থাকা অবস্থায় আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ যে বৈঠকে রাজনৈতিক দল খোলার সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছিলেন, সে বৈঠকে তারা আমাকে ডেকেছিলেন এবং এ বিষয়ে আমার মতামত জানতে চেয়েছিলেন। আমি দু’টি শর্তে রাজনৈতিক দল খোলা যায় বলে মত দিয়েছিলাম। প্রথমটি ছিল, দল খোলার পক্ষে আমীরে জামা‘আতের অনুমোদন নিতে হবে। দ্বিতীয়টি ছিল, নির্বাচনমুখী গণতান্ত্রিক দল খোলার অনুমতি ইসলাম দেয় কি-না সে ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ আলেমদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। পরবর্তীতে ১৭ নভেম্বর ’০৬ ঢাকায়  ইঞ্জিনিয়ার্স ইনষ্টিটিউশন মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত যুবসংঘের ‘কর্মী সম্মেলনে’ উপস্থিত বিশেষজ্ঞ আলেমগণ দল খোলার ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্ত দিতে পারেননি।

আল্লাহর অশেষ মেহেরবানীতে ২০০৮ সালের ২৮ আগস্ট আমীরে জামা‘আত কারামুক্ত হন। অতঃপর প্রথম বৈঠকেই জানা যায় আন্দোলনের অন্তবর্তীকালীন নেতৃবৃন্দ রাজনৈতিক দল খোলার ব্যপারে আমীরে জামা‘আতের অনুমোদন আছে বলে যে গুজব ছড়িয়েছিলেন, তা সত্য ছিল না। আমীরে জামা‘আত কারাগার থেকে যে পাঁচটি চিঠি লিখে নেতৃবৃন্দকে দল খুলতে নিষেধ করেছিলেন, সে চিঠিগুলো তিনি সবাইকে দেখান। এরপরও কেউ কেউ উক্ত বিষয়ে বিতন্ডা সৃষ্টি করলে রাজনৈতিক দল খোলা যাবে কি-না সে বিষয়ে লিখিত মতামত জানানোর জন্য তিন সদস্যের একটি সাব-কমিটি গঠন করা হয়। আমাকে ঐ কমিটির আহবায়ক করা হয়। ড. মুহাম্মাদ মুছলেহুদ্দীন এবং শেখ মুহাম্মাদ রফিকুল ইসলামকে সদস্য মনোনীত করা হয়। নির্ধারিত সময়ে আমি এবং শেখ রফিক আমাদের লিখিত মতামত জানিয়েছিলাম। কিন্তু অনুরোধ সত্ত্বেও ড. মুছলেহুদ্দীন কোন মতামত দেননি। আন্দোলনের পরবর্তী মিটিংয়ে বিষয়টি নিয়ে আবার বিতর্ক শুরু হলে আমীরে জামা’আত উপস্থিত সকল সদস্যকে একটি রেজিষ্টার খাতায় স্বাক্ষর সহ মতামত জানানোর ব্যবস্থা করেন। সেখানেও ড. মুছলেহুদ্দীন কোন মতামত দেননি। আব্দুছ ছামাদ সালাফী মতামত দিয়েছিলেন এভাবে- ‘প্রয়োজন দেখা গেলে দল খোলা যাবে। তবে এ মুহূর্তে দল খোলার প্রয়োজন নেই’। ঐ মিটিংয়ে বেশির ভাগ সদস্য দল খোলার বিপক্ষে মতামত দিয়ে স্বাক্ষর করেন। ফলে সেদিনই দল খোলার বিষয়টি বাতিল হয়ে যায়। বিষয়টির লিখিত দলীল থাকা সত্ত্বেও বিভক্তি দেখা দেবার যুক্তি সঙ্গত কারণ আমি দেখি না।

আমি আগে একবার বলেছি, সকল রাজনৈতিক দলের কর্মকান্ডের পনেরো আনা ঢাকা থাকে কালো পর্দার অন্তরালে। বাহির থেকে দেখা যায় না। ড. গালিবের গ্রেফতারের রহস্য অনেকটাই অন্ধকারে ঢাকা ছিল। আমি যতটুকু জানতে পেরেছি তা হল- আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতার কাঙ্গাল এবং বিদেশী প্রভুদের করুণার ভিখারী। পাশ্চাত্যের প্রভুরা ইসলামের বিজয়ী আদর্শকে যমদূতের মত ভয় পায়। তাই কোন মুসলিম দেশে যেন নির্ভেজাল আদর্শে বলিয়ান কোন ইসলামী দল ক্ষমতায় না আসে, সে জন্য চাতুর্যপূর্ণ পরিকল্পনা করে। তারই অংশ হিসাবে বাংলাদেশে তারা একদল লোককে জঙ্গী সাজায়। অতঃপর জঙ্গী নির্মূল করার নামে পুতুল শাসকদের দ্বারা প্রকৃত আদর্শের অনুসারীদের উৎখাত করে। আর পাশ্চাত্যের মুরীদ শাসকগণও নিজেদের অস্তিত্বের জন্য প্রকৃত ইসলামী দলকে ভয় পায়। এর সাথে রয়েছে দলছুটদের চক্রান্ত। এই ত্রিমুখী শক্তির সমন্বয়ে উত্তম মওকা সৃষ্টি করেছিল, উন্মাদ আব্দুর রহমান ও বাংলা ভাইদের সর্বনাশা কর্মকান্ড। ঐ ত্রিমুখী শক্তি ‘সর্বহারা’ দমনের অজুহাতে এই দানবদের সৃষ্টি করেছিল। সাময়িক স্বার্থের জন্য এই দানবদেরকে আড়াল করতেই প্রকৃত আদর্শের শক্তি ড. গালিবকে তারা কারারুদ্ধ করে। ঐ ত্রিমুখী চক্র আব্দুর রহমান ও তার দলবলকে তাদের প্রয়োজনে সৃষ্টি করেছিল, প্রয়োজন মেটার সাথে সাথে নির্মূলও করে ফেলেছিল। আল্লাহ পাকের গায়েবী মদদ ছিল ড. গালিবের উপর। তাই এতগুলো মামলা সাজিয়েও তাকে ফাঁসানো যায়নি। সব মামলা মিথ্যা প্রমাণিত হয়ে তিনি কারামুক্ত হন। ফালিল্লাহিল হামদ।

(৮) আহলেহাদীছ যুবসংঘ :আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ-এর সমাজ কল্যাণ সংস্থা ‘তাওহীদ ট্রাস্টের’ সদস্যরা ড. গালিব স্যারের সাথে কেন বিদ্রোহ করল? ট্রাস্ট প্রতিষ্ঠার উদ্যোক্তা কে ছিলেন?

প্রফেসর নযরুল ইসলাম : এক অস্বাভাবিক অবস্থার মধ্য দিয়ে সংগঠন গড়ে তুলতে হয়েছিল। প্রাথমিক পর্যায়ে সাংগঠনিক মানে উন্নীত বা পরীক্ষিত নেতৃস্থানীয় লোকের স্বল্পতা ছিল। ফলে সামাজিক মর্যাদার ভিত্তিতে দায়িত্বশীল নির্বাচন করে সংগঠন গড়তে হয়েছিল। আর তখন যে ট্রাষ্ট গঠিত হয়েছিল সেখানেও ঐ মানের লোক বসেছিল। এছাড়া অন্য দলের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কিছু ধূর্ত ব্যক্তি কেন্দ্রীয় কমিটিতে এবং ট্রাষ্টের গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হয়েছিল। ট্রাষ্টের অর্থ-সম্পদ যে পবিত্র আমানত এবং সংগঠনের জন্যই যে তা ব্যবহৃত হবে, এমন উন্নত মানসিকতা, নীতিবোধ ও আমানতদারী তাদের মধ্যে ছিল না। ব্যক্তিস্বার্থই তাদের উপর প্রাধান্য লাভ করেছিল। ফলে স্বার্থ সিদ্ধির উদ্দেশ্যেই তারা বিদ্রোহ করেছিল। ট্রাষ্ট তাদের করতলগত হওয়ার পর তাদের কর্মকান্ড দেখে আমার এই ধারণা সৃষ্টি হয়েছে। ট্রাষ্ট প্রতিষ্ঠার উদ্যোক্তা ড. গালিব ছাড়া আবার কে? ড. গালিবই ট্রাষ্টের প্রতিষ্ঠাতা ও পরিকল্পক। 

(৯) আহলেহাদীছ যুবসংঘ :বিভক্ত আহলেহাদীছ সমাজের ঐক্য নিয়ে আপনার কোন প্রস্তাবনা আছে কি?

প্রফেসর নযরুল ইসলাম : বৎসরা! জমঈয়ত ও আন্দোলনের বিভক্তির সময়কাল প্রায় দুই যুগ অতিক্রম করে যাচ্ছে। এই সময়ের মধ্যে পদ্মা, মেঘনা, যমুনা দিয়ে বহু পানি গড়িয়ে গেছে। ব্যবধান রেখা বহু বিস্তৃত হয়েছে। এ সময় আমার মত নগণ্য ব্যক্তির প্রস্তাবনা কয়জন ব্যক্তিকে প্রভাবিত করবে? তোমরা তরুণ। সব ব্যাপারে আশাবাদী হওয়া তোমাদের ধর্ম। আমি মনে করি, তোমাদের সংগঠনের শিক্ষাই তোমাদেরকে সমাজের জন্য কল্যাণমুখী বানিয়েছে। আমার চিন্তা কাউকে প্রভাবিত করবে কি-না জানি না। তবে তোমাদেরকে বিবেচনা করতে বলছি। আহলেহাদীছ সমাজকে ঐক্যবদ্ধ করতে হলে একদল বিচক্ষণ ব্যক্তিকে প্রথমে উদ্যোগী হতে হবে। তারা দুই পক্ষকে ঐক্যের জন্য রাযী করাবেন। দুই পক্ষ যদি রাযী হয়ে যায় তাহলে তারা উভয় পক্ষ থেকে সমান সংখ্যক মীমাংসাকারী নিয়ে একটি নিষ্পত্তিকারী বোর্ড গঠন করবেন। তাদেরকে হতে হবে মুত্তাক্বী। শরী‘আত ও বৈষয়িক জ্ঞানে হতে হবে পারদর্শী এবং নিরপেক্ষ মেজাজের অধিকারী। অতঃপর এই বোর্ড উভয় সংগঠনের গঠনতন্ত্র বিশ্লেষণ করে একটি গঠনতন্ত্র প্রণয়ন করবে। উক্ত গঠনতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য হবে জাতীয় জীবনের সমস্যা সমাধানকল্পে নির্ভেজাল ইসলামের পথ নির্দেশ করা।

অতঃপর তারই আলোকে একটি একক সংগঠন কায়েম করবে। উক্ত বোর্ড সূক্ষ্ম অনুসন্ধানের মাধ্যমে একজন নেতা মনোনীত করবেন। যিনি হবেন শারঈ ও বৈষয়িক জ্ঞানে অধিক পারদর্শী। সংগঠন পরিচালনায় হবেন সর্বাধিক দক্ষ। নেতৃত্বের কঠিন দায়িত্ব পালনে হবেন অভিজ্ঞ ও পরীক্ষিত। কার মধ্যে সাংগঠনিক প্রজ্ঞার বিকাশ ঘটেছে, কার মাঝে কর্মতৎপরতা, লেখনী, বাগ্মিতার শক্তি বেশি পরিলক্ষিত হয়েছে এবং দেশে-বিদেশে কার স্বীকৃতি বেশি অর্জিত হয়েছে বোর্ড সে দিকে সূক্ষ্ম দৃষ্টি রাখবে। সর্বোপরি দেখতে হবে কে সর্বাধিক তাক্বওয়াশীল। যদি অতীতের সকল তিক্ততা, ঈর্ষা, বিদ্বেষ ভুলে এ ধরনের কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়, তাহলে আশা করা যায় ঐক্য সম্ভব হবে। আল্লাহ আমাদেরকে সাহায্য করুন।

(১০) আহলেহাদীছ যুবসংঘ : বর্তমানে মুসলিম উম্মাহর ক্রান্তিকাল চলছে। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের একমাত্র উপায় কী বলে আপনি মনে করেন?

প্রফেসর নযরুল ইসলাম : ক্রান্তিকাল বলতে অবস্থার পরিবর্তন কালকে বুঝায়। মুসলিম উম্মাহ বর্তমানে সত্যই ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। এক ভ্রান্ত অবস্থা থেকে বেরিয়ে অন্য ভ্রান্ত অবস্থার মধ্যে দিয়ে কি তারা সত্যিকারের নাজাতের পথ পাবে? আমি তোমাদের সামনে কয়েকটা দেশের বাস্তব অবস্থা দেখাব। এর দ্বারা তোমরা উত্তরণের উপায় হয়ত দেখতে পাবে। প্রথমে তোমরা ইরানের দিকে দেখ। এই দেশের ইসলামী বিপ্লব এখন শী‘আ বিপ্লবে পর্যবসিত হয়েছে। বিপ্লবোত্তর তুরস্কের দিকে দৃষ্টি দাও। ইখওয়ান নেতা রজব তাইয়েব এরদোগান এখন মডারেট মুসলিম নেতা হিসাবে গণদেবতার পূজারী। তিউনিসিয়ার বিপ্লবী নেতা রশীদ ঘানুসী এবং মিসরের মুহাম্মাদ মুরসি একই চরিত্রের। এসব ইখওয়ানী নেতাও গণদেবতার পায়ে তামা-তুলসি দিয়ে পূজা শুরু করেছেন। যাদের আক্বীদা ও আমলের কোন ভিত্তি নেই, তারা গণদেবতাকে কতদিন সন্তুষ্ট রাখতে পারবেন? এসব দেশগুলোর ক্রান্তিকালকে সামনে রাখ, আর আমাদের দেশের ইসলামী দলগুলোর ক্রান্তিদশা ও চরিত্রের প্রতিও লক্ষ্য কর। এরাও আপোষকামী, গণদেবতার পূজারী ও মাযহাবী শিকলে বন্দী। তাদের মাধ্যমে যারা উত্তরণের পথ দেখতে চায় তারা আলো নয়, অমাবস্যার অন্ধকার দেখবে। এই হল বাস্তব চিত্র। তবে হতাশার কিছু নেই। কারণ নির্ভেজাল ইসলামের রূপটা এমন এক সময় দেখা যাবে, যখন সংকল্পবদ্ধ একটি সত্যনিষ্ঠ কাফেলা কোন ভূখন্ডে সত্যিকারের রূপটি বাস্তবায়ন করে দেখাবে। আদর্শ যতই নির্ভুল হোক না কেন বাস্তবে তা প্রতিষ্ঠিত না হলে, সে তার সৌন্দর্য প্রকাশ করতে পারে না। এখন চাই একদল দুঃসাহসী অভিযাত্রী, যারা উত্তরণের ঐ পথটি উন্মুক্ত করে দিবে। আমার বিবেচনায় তোমাদের মাধ্যমেই আবির্ভাব ঘটতে পারে ঐ অভিযাত্রী দলের। তোমরা যদি সেই শূন্যতা উপলব্ধি না কর তবে আরও কিছুকাল মুসলিম উম্মাহকে অন্ধকারের মধ্যে থাকতে হবে।

(১১) আহলেহাদীছ যুবসংঘ :আপনার ছাত্র ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব এখন আন্তর্জাতিক ইসলামী ব্যক্তিত্ব এবং এক অনন্য প্রতিভা। আপনি আপনার জীবদ্দশায় তা অবলোকন করছেন। এ বিষয়ে আপনার অনুভূতির ঝুড়ি থেকে কিছু ব্যক্ত করবেন কি?

প্রফেসর নযরুল ইসলাম : প্রিয় বৎসরা! আমার ছাত্র ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব সত্যিই এখন আন্তর্জাতিক ইসলামী ব্যক্তিত্ব এবং অনন্য প্রতিভা। দেখ, স্নেহ-ভালবাসা ও প্রীতি সাধারণত অন্ধই হয়। অনেক সময় স্নেহান্ধগণ প্রীতিভাজনদের গুণই শুধু দেখে। দোষ দেখার ক্ষেত্রে তারা অন্ধ সাজেন। আমার ভয় হচ্ছে আমার অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে আমি অন্ধত্বের পরিচয় দিয়ে ফেলি কি-না। হে আমার সন্তানেরা! আমি আমার অনুভূতিকে পবিত্র কুরআনের দিশা অনুযায়ী রূপ দেয়ার চেষ্টা করব। প্রথমে একটু প্রাগোক্তি করে নেব। আমি সাহিত্যের ছাত্র ও অধ্যাপক। ‘অলংকার তত্ত্ব’ সাহিত্যের একটি প্রিয় বিষয়। এই অলংকার তত্ত্বে ‘চিত্রময় রীতি’ খুবই আকর্ষণীয়, যা বক্তার অনুভূতির বিমূর্ত বিষয়কে চিত্রের সাহায্যে মূর্ত করে তোলে। একে অরূপকে রূপ দান করা বলে। পবিত্র কুরআনের সাহিত্যিক মান সর্বকালের সকল সাহিত্যের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। সাধারণ সাহিত্যের চিত্র আমাদের জৈব প্রবৃত্তির উপাদেয়। কিন্তু কুরআনের চিত্র চিত্তাশ্রয়ী এবং  বাস্তব। এই চিত্রের অনন্যতা লক্ষ্য করো, এখানে অতীত ও ভবিষ্যতের ছবিকে বর্তমানের ক্যানভাসে অাঁকা হয়েছে। আমরা মানুষেরা দেশ এবং কালের আবর্তে আবদ্ধ। আল্লাহ তা‘আলা দেশ এবং কালের ঊর্ধ্বে। তাঁর কাছে কাল শুধু একটা। অতীতও নেই ভবিষ্যতও নেই, আছে শুধু বর্তমান। তাই তাঁর কালামের চিত্রগুলো সব বর্তমান কালের ছবি। এর অনন্য বৈশিষ্ট্য তোমরা বিশ্বের অন্য কোন সাহিত্যে দেখতে পাবে না। অনন্যতার এই ছবি দু’টি বৈশিষ্ট্য লাভ করেছে। এক- অনন্য সৌন্দর্য। দুই- চোখের সামনে দীপ্তিময় রূপে উদভাসিত, যেন একটি সোনার হারের লকেটের ওপর বসানো উজ্জ্বল হিরকখন্ড।

এবারে দূরবর্তীতে অনুষ্ঠিতব্য একটি চিত্র বর্তমানের ক্যামেরায় দেখ। ক্বিয়ামতের দিন বিচার শেষে একদল মানুষের ছবি কতটা উজ্জ্বলভাবে অাঁকা হচ্ছে। এই চিত্রে এমন এক দল মানুষকে দেখা যাচ্ছে যারা পৃথিবীতে নিজেদের নেক আমল দ্বারা বহু মানুষের আমলের শূন্য ভান্ডারকে পূর্ণ করে দিয়েছিল। এই আমলগুলো কালে কালে হয়েছিল প্রবাহমান ছাদাক্বা। এভাবে অগণিত মানুষের নেক আমলের সমপরিমাণ অংশ উপকারকারীর ভান্ডারে জমা হয়ে তার ভান্ডারকে পরিপূর্ণ করে ফেলেছে। পরের দৃশ্যে দেখা যাচ্ছে- একদল জান্নাতের প্রহরী মর্যাদা সহকারে তাদেরকে নিয়ে যাচ্ছে চির আকাঙ্খার স্থল জান্নাতের দিকে। শেষ দৃশ্যে দেখা যাচ্ছে, জান্নাতের দ্বাররক্ষীগণ তাদের জন্য জান্নাতের দরজা খুলে দিচ্ছে। সালাম জানিয়ে বলছে, ‘সালামুন আলাইকুম ত্বিবতুম ফাদ্খুলূহা খালিদীন’। অর্থাৎ ‘তোমাদের প্রতি সালাম। তোমরা সুখী হও এবং জান্নাতে প্রবেশ কর স্থায়ীভাবে অবস্থান করার জন্য’ (যুমার ৭৩)। আমি জানি না আসাদুল্লাহর মর্যাদা কী হবে? তবে তার দ্বীনি কার্যক্রমের কারণে বাহ্যিক দৃষ্টিতে আমি তাকে তাদেরই একজন মনে করি। পৃথিবীর কোন শক্তি নেই যে তাকে এই মর্যাদাহারা করতে পারে। পূর্বেই বলেছি স্নেহপ্রীতিই অন্ধত্ব। আমি তার দোষান্ধ। আমি তার স্বল্পকালের নগণ্য শিক্ষক। আমার স্নেহান্ধ চোখের সামনে আসাদুল্লাহকে ঐ অবস্থায় দেখি। 

(১২) আহলেহাদীছ যুবসংঘ : গত বছর ৮ ও ৯ ডিসেম্বর ’১১ তারিখে অনুষ্ঠিত কেন্দ্রীয় কাউন্সিল সদস্য সম্মেলন আপনার কাছে কেমন মনে হয়েছে?

প্রফেসর নযরুল ইসলাম : ‘কেন্দ্রীয় কাউন্সিল সদস্য সম্মেলনে’ উপস্থিত থেকে আমি তোমাদের সুশৃংখল কর্মকান্ড মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখছিলাম। আমি তোমাদের তারুণ্যদীপ্ত একঝাঁক মুখ দেখছিলাম। তোমাদের কর্মতৎপরতা দেখছিলাম আর উজ্জ্বল সম্ভাবনার এক আলোকিত ছবি অাঁকছিলাম। তোমাদের মুখের ছবিতে আমি অতীতের এক তরুণের প্রতিবিম্ব দেখতে পাচ্ছিলাম। ঐ তরুণের কাহিনী আগে শোনানো যাক। ঐ কাহিনীই আমাদের অনুভবের বর্ণনা দেবে। হিজরী ৯৩ সালের ঘটনা। সিন্ধুর রাজা দাহিরের কারাগারে বন্দী ছিল একদল আরব বণিকের পরিবারের কিছু সংখ্যক সদস্য। নারী, শিশু, বৃদ্ধ। এদের মধ্যে বন্দি ছিল সালমা নামে এক কিশোরী। এই মেয়ে রাজা দাহিরের কারাগারের কঠিন নির্যাতনের বর্ণনা দিয়ে ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফের নিকট গোপনে পত্র পাঠিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। পত্রবাহক হাজ্জাজের হাতে যখন ঐ পত্র তুলে দিচ্ছিল তখন সেখানে উপস্থিত ছিল সাতাশ বছরের যুবক সেনাপতি মুহাম্মাদ বিন কাসিম। হাজ্জাজ সালমার চিঠিটা মুহাম্মাদের হাতে দিয়েছিলেন এবং একদল সৈন্যের সেনাপতি হিসাবে মুহাম্মাদকে সিন্ধুতে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন (মূল ঘটনাটি হল-ইরাকের উমাইয়া গভর্ণর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ (৭৬-৯৬হিঃ)-এর জন্য মাকরান ও তৎসন্নিহিত এলাকায় তাঁর নিযুক্ত শাসক মুহাম্মাদ বিন হারূণ কর্তৃক উপঢৌকন হিসাবে প্রেরিত একটি জাহায সিন্ধু এলাকায় ডাকাতদল কর্তৃক আক্রান্ত হয়। যার মধ্যে শ্রীলংকায় জন্মগ্রহণকারী কিছু পিতৃহীন ইয়াতীম মুসলিম বালিকা ছিল। তাদের মধ্যকার বনু ইযারবূ‘ গোত্রের একটি মেয়ে ‘ইয়া হাজ্জাজ!’ বলে চিৎকার করে ডাক দেয়। এ খবর হাজ্জাজের নিকট পৌঁছে গেলে তিনি সাথে সাথে ‘লাববাইক’ বলে ওঠেন এবং সিন্ধুর রাজা দাহিরের নিকট মেয়েগুলোকে ছেড়ে দেবার জন্য পত্র প্রেরণ করেন। কিন্তু রাজা দাহির অপারগতা প্রকাশ করে বলেন, ‘ডাকাতরা তাদের নিয়ে গেছে। আমি তাদের উপর কোন ক্ষমতা রাখি না।’ তখন হাজ্জাজ দাহিরের বিরুদ্ধে পরপর দু’টি অভিযান প্রেরণ করেন। কিন্তু তারা ব্যর্থ হয়। তৃতীয়বারে মুহাম্মাদ বিন কাসিমকে প্রেরণ করেন এবং তিনি সিন্ধু বিজয়ে সফল হন (বালাযূরী, ফুতূহুল বুলদান, পৃ. ৪২৩-৪২৪)। সেসময় তাঁর বয়স ছিল ২৭ বছর)। তরুণ মুহাম্মাদ কী করেছিলেন সে ইতিহাস তোমাদের সবার জানা। তোমরা কি দেশী-বিদেশী দাহিরের কারাগারে লক্ষ লক্ষ মুসলিম নারী, শিশু, বৃদ্ধের কান্না শুনতে পাও? এরা তো সেই ভাষায় কাঁদে, ‘রববানা আখরিজনা মিন হা-যিহিল ক্বারিয়াতিয যা-লিমি আহলুহা, ‘ওয়াজ‘আল লানা মিল্লাদুনকা অলিইঅাঁও ওয়াজ‘আল লানা মিল্লাদুনকা নাছীরা’- অর্থাৎ ‘হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে অত্যাচারী এই জনপদ থেকে বের করুন এবং আপনার পক্ষ থেকে আমাদের জন্য একজন নেতা এবং একজন সাহায্যকারী নির্ধারণ করুন’ (নিসা ৭৫)। আমি তাদের অশ্রুকান্না শুনি আর তরুণ মুহাম্মাদকে খুঁজি। তোমাদের সম্মেলনে বসে তোমাদের তরুণ মুখে মুহাম্মাদের মুখের ছবি খুঁজছিলাম।

আহলেহাদীছ যুবসংঘ : দীর্ঘ সময় ও শ্রম ব্যয় করে মূল্যবান সাক্ষাৎকার প্রদানের জন্য আমরা আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি এবং দো‘আ করছি আল্লাহ যেন আপনার ইহকাল ও পরকাল মঙ্গলময় করেন-আমীন! 

***

আহলেহাদীছ যুবসংঘ স্মারকগ্রন্থ ২০১১-তে প্রকাশিত