তিনটি মতবাদ

স্বর্ণযুগে মুসলমানদের অবস্থা ও বর্তমান যুগ

(حكاية حال المسلم فى العصر الذهبى وفى العصر الحاضر)

চতুর্থ শতাব্দী হিজরীতে বিভিন্ন মাযহাবী দলের উদ্ভবের আগে মুসলমানগণ কিভাবে চলতেন? তাদের ধর্মীয়, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিষয়ে কিভাবে সমাধান হ’ত? প্রশ্নটি বর্তমানে মাযহাবী পরিবেশে আমাদের মনে জাগ্রত হওয়া স্বাভাবিক। এ প্রসঙ্গে শাহ অলিউল্লাহ (১১১৪-১১৭৬ হি:) ও ইমাম গাযযালী (৪৫০-৫০৫ হি:)-এর বক্তব্যের সার সংক্ষেপ নিম্নে প্রদত্ত হ’ল-

‘চতুর্থ শতাব্দী হিজরীর পূর্ববর্তী ও পরবর্তী লোকদের অবস্থা’ (باب حكاية حال الناس قبل المائة الرابعة و بعدها) এই শিরোনামে শাহ অলিউল্লাহ দেহলভী (রহঃ) বলেন, ‘তৎকালীন সময়ে কোন মুসলমান কোন তাক্বলীদী মাযহাবের উপরে সংঘবদ্ধ ছিলেন না। তাদের মধ্যে আলেম যেমন ছিলেন, সাধারণ লোকও তেমনি ছিল। সাধারণ লোকেরা তাদের পিতামাতা বা স্থানীয় আলেমগণের নিকট হ’তে ধর্মীয় বিষয়াদি জেনে নিত। যে কোন আলেম হৌক তাঁর কাছ থেকে ফৎওয়া জিজ্ঞেস করত। এ ব্যাপারে কারও মাযহাব যাচাই করা হ’ত না। আলেমগণের অবস্থা ছিল এই যে, যখন কোন বিষয়ে তাঁরা ছহীহ হাদীছ বা আছারে ছাহাবা পেয়ে যেতেন, শর্তহীনভাবে তার উপরে আমল করতেন। দেখতেন না যে, এই হাদীছটি কোন আলেম বা কতজন আলেম গ্রহণ করেছেন। যখন কোন ব্যাপারে তাদের নিকট দলীল স্পষ্ট হ’ত না, তখন বিগত কোন বিদ্বানের ফৎওয়া তালাশ করতেন। যখন কোন ব্যাপারে দুই ধরনের উক্তি পেয়ে যেতেন, তখন অধিকতর নির্ভরযোগ্য উক্তিটি গ্রহণ করতেন।

কিন্তু এই সুন্দর নিরপেক্ষ যুগ শেষ হয়ে যাবার পরে লোকেরা ডাইনে বামে চলে গেল। তারা ফিক্ব্হ সংক্রান্ত বিষয়ে ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত হ’ল। যার বিবরণ ইমাম গাযযালী (রহঃ) দিয়েছেন এভাবে-

খুলাফায়ে রাশেদীনের যুগ শেষ হবার পরে ইসলামী খেলাফতের শাসনক্ষমতা এমন লোকদের কুক্ষিগত হয়ে পড়ে, যারা শরী‘আত সংক্রান্ত বিষয়ে ছিলেন অনভিজ্ঞ। ফলে তারা সকল ব্যাপারে আলেমদের উপরে নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। তখনও আলেমদের মধ্যে এমন কিছু আলেম ছিলেন, যাঁরা স্বর্ণযুগের বিদ্বানদের ন্যায় জ্ঞানী ও গুণী ছিলেন। তাঁরা বিদ্যা, প্রজ্ঞা ও সরলতার মূর্ত প্রতীক ছিলেন। কোন সরকারী পদে তলব করা হ’লে তাঁরা পালিয়ে যেতেন বা প্রত্যাখ্যান করতেন। ফলে সব ধরনের মানুষের শ্রদ্ধা কুড়াতে তাঁরা সক্ষম হয়েছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য হ’লেও সত্য যে, সে সময়েও এমন অনেক আলেম ছিলেন, যারা তাদের ইল্মকে দুনিয়াবী ইয্যত ও পদমর্যাদা হাছিলের মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার করেন। ফলে তারা সমাজের শ্রদ্ধা হারালেন। এভাবে একদিন যারা আহুত হ’তেন, এখন তারা আহবানকারী হয়ে গেলেন (فأصبح الفقهاءُ بعد أن كانوا مطلوبين طالبين)। সরকারী পদ এড়িয়ে চলার ফলে তারা যে মর্যাদা হাছিল করেছিলেন, তা গ্রহণের ফলে তারা তদোধিক মর্যাদাহীন হয়ে পড়লেন।

ইতিপূর্বেই (গ্রীকদের অনুকরণে) মুসলিম পন্ডিতগণ কালাম শাস্ত্রের কুটতর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন। আর এভাবেই আলেমদের মধ্যে ঝগড়ার সূত্রপাত ঘটে। (এই সুযোগে) খলীফাগণ বিশেষ করে হানাফী-শাফেঈ বিতর্কে ইন্ধন যোগাতে শুরু করেন। উভয়পক্ষে বহু ঝগড়া-বিবাদ ও লেখনী পরিচালিত হ’ল। এ অবস্থা এখনও চলছে। আল্লাহ জানেন ভবিষ্যতের লিখন কি আছে’।[1]

অতঃপর শাহ অলিউল্লাহ দেহলভী বলেন, আলেমদের এই ফের্কাবন্দীর ফলে সাধারণ মুসলমান যেকোন আলেমের নিকট হ’তে কুরআন ও সুন্নাহর ফায়ছালা তলব করার চিরন্তন রীতি পরিত্যাগ করতে বাধ্য হয় এবং যে কোন একটি মাযহাবের তাক্বলীদ করেই নিশ্চিন্ত হ’তে চেষ্টা করে। লোকদের অন্তরে তাক্বলীদ এখন এমনভাবে আসন গেড়েছে, যেমনভাবে পিঁপড়া সবার অলক্ষ্যে দেহে ঢুকে কামড়ে পড়ে থাকে’।[2]

শাহ অলিউল্লাহ (রহঃ) ও ইমাম গাযযালী (রহঃ) তাক্বলীদী বিদ‘আত আবিষ্কারের পূর্বে মুসলমানদের ধর্মীয় ও সামাজিক অবস্থার যে বাণীচিত্র অংকন করেছেন, তাতে আশা করি যে কোন নিরপেক্ষ জ্ঞানী ব্যক্তির জন্য চিন্তার যথেষ্ট খোরাক আছে।

‘আমি অজ্ঞ সে কারণে আমাকে যে কোন একটি মাযহাবের তাক্বলীদ করতেই হবে’ একথা বলে তাক্বলীদের পক্ষে যে যুক্তি পেশ করা হয়ে থাকে, তার উত্তরও উপরের আলোচনায় এসে গেছে। জেনে রাখা ভাল যে, জানা ও না জানার বিষয়টি একটি আপেক্ষিক ব্যাপার মাত্র। দু’জন বিজ্ঞ আলেমকেও দেখা যাবে যে, একই সময়ে একটি বিষয় একজনের জানা আছে, অপরজনের জানা নেই। ছাহাবায়ে কেরামের মধ্যেও এরূপ ছিল। এমনকি উম্মতের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব মহামতি চার খলীফা হযরত আবুবকর, ওমর, ওছমান এবং আলী (রাঃ) অনেক হাদীছ না জানার কারণে অন্যান্য ছাহাবীর নিকট থেকে জেনে নিয়ে ফায়ছালা দিতেন। হাদীছের পৃষ্ঠাসমূহে যার ভুরি ভুরি প্রমাণ মওজুদ রয়েছে।[3] এ যুগেও যদি আমাদের কোন বিষয়ে জানা না থাকে, তাহ’লে আমরাও কোন আলেমের নিকট থেকে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের ফায়ছালা জেনে নিব। কেবল একটি বিষয় লক্ষ্য রাখতে হবে যে, প্রশ্নকারী কেবল কুরআন ও ছহীহ হাদীছ থেকেই ফায়ছালা চাইবেন, কোন মাযহাবের বা কোন ব্যক্তির নিজস্ব সিদ্ধান্ত নয়। এমনিভাবে যিনি ফৎওয়া দিবেন, তিনিও কুরআন ও ছহীহ হাদীছ থেকেই ফৎওয়া দিবেন। না জানা থাকলে বলবেন, আমি জানি না। নিজের রায় অনুযায়ী ফৎওয়া দিলে সেটাও প্রশ্নকারীকে বলে দিবেন। মোটকথা আলেমের কর্তব্য এটাই হবে যে, প্রশ্নকারীকে কুরআন ও হাদীছ অনুযায়ী ফৎওয়া দিয়ে তাকে জান্নাতের পথ বাৎলে দেওয়া। এ ব্যাপারে যদি তাকে জান-মাল, ইযযত ও পদমর্যাদার ঝুঁকি নিতে হয়, তাও নিতে হবে। তথাপি সমাজের ভয়ে বা লৌকিকতার কারণে কুরআন ও ছহীহ হাদীছের সিদ্ধান্ত সমাজকে জানিয়ে দেওয়ার পবিত্র দায়িত্ব থেকে পিছিয়ে আসা চলবে না। এ ব্যাপারে নবী করীম (ছাঃ) ও ছাহাবায়ে কেরামের দৃষ্টান্ত সর্বদা সামনে রাখতে হবে। যেমন শাহ অলিউল্লাহ স্বীয় ‘ইনছাফ’ গ্রন্থে বলেন,

و قد تواتر عن الصحابة والتابعين أنهم كانوا إذا بلغهم الحديث يعملون به من غير أن يلاحظوا شرطا-

‘ছাহাবা ও তাবেঈন হ’তে অব্যাহত ধারায় বর্ণিত হয়েছে যে, তাঁদের নিকট হাদীছ পৌঁছে গেলে তাঁরা বিনা শর্তে তার উপরে আমল করতেন’।[4]



[1]. উল্লেখ্য যে, ইমাম গাযযালীর মৃত্যুর দেড় শতাধিক বৎসর পরে ৬৫৬ হিজরীতে এই হানাফী-শাফেঈ ও শী‘আ-সুন্নী দ্বন্দ্বের সুযোগে হালাকু খাঁ কর্তৃক বাগদাদের ইসলামী খেলাফত ধ্বংস হয়। -লেখক ।

[2] . হুজ্জাতুল্লাহ, মিসরী ছাপা ১/১২২-২৩ পৃঃ ।

[3]. দ্রঃ ইমাম ছালেহ ফুল্লানী (১১৬৬-১২১৮হিঃ) প্রণীত ‘ঈক্বাযু হিমাম’ (বৈরুত : দারুল মা‘রিফাহ, ১৩৯৮/১৯৭৮ খৃঃ) পৃঃ ৬-৯, ৮৭-৮৮; ইবনুল ক্বাইয়িম, ই‘লামুল মুওয়াক্ক্বি‘ঈন, ২য় খন্ড পৃঃ ২৭০-৭২।

[4]. শাহ অলিউল্লাহ, আল-ইনছাফ ফী বায়ানে আসবাবিল ইখতেলাফ (বৈরুত: দারুন নাফাইস, ১৯৭৭ খৃঃ) পৃঃ ৭০।