তিনটি মতবাদ

بسم الله الرحمن الرحيم

نحمده ونصلى على رسوله الكريم أما بعد:

তিনটি মতবাদ

[বিগত ২২শে অক্টোবর ’৮৬ সকাল ৮-টায় রাজশাহী মহানগরীর রাণীবাজার আহলেহাদীছ জামে মসজিদে অনুষ্ঠিত ‘বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘে’র তিনদিন ব্যাপী কেন্দ্রীয় কাউন্সিল সম্মেলনের প্রথম দিনে ছাত্র-শিক্ষক-ওলামায়ে কেরাম ও সুধী সমাবেশে সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা-সভাপতি অধ্যাপক মুহাম্মাদ আসাদুল্ল­াহ আল-গালিব যে উদ্বোধনী ভাষণ পেশ করেন, তার প্রশ্নোত্তর পর্বটি ‘পরিশিষ্ট’ অংশ হিসাবে নিম্নে প্রদত্ত হ’ল। উল্লেখ্য যে, মূল ভাষণটি ‘সমাজ বিপ্ল­বের ধারা’ নামে ইতিপূর্বে প্রকাশ করতে পারায় আমরা আল্ল­াহর শুকরিয়া আদায় করছি। -প্রকাশক]

ইসলামী সমাজ বিপ্ল­বের পূর্বোক্ত[1] তিন দফা কর্মপন্থা বাস্তবায়নের পূর্বে আমাদেরকে অবশ্যই পুরাতন ও আধুনিক কয়েকটি মতবাদ সম্পর্কে হুঁশিয়ার থাকতে হবে। দ্বাদশ শতাব্দী হিজরীর আরবীয় সংস্কারক ইমাম মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহ্হাব (১১১৫-১২০৬ হি:/১৭০৩-১৭৯০খৃ:) রাসূলুল্ল­াহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)-এর আগমনের প্রাক্কালে আরবে প্রচলিত একশত প্রকার জাহেলিয়াতের কথা উল্লে­খ করেছেন। আমরা সেখান থেকে মাত্র একটি এবং আধুনিক কালের দু’টি পরস্পর বিরোধী চরমপন্থী মতবাদের উল্লেখ করব।

১ম মতবাদ : তাক্বলীদ

(النظرية الأولى : التقليد)

নির্ভেজাল ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সবচাইতে বড় বাধা হ’ল তাক্বলীদে শাখছী বা অন্ধ ব্যক্তিপূজা। এর ফলে মানুষ আর একজন মানুষের অন্ধ অনুসারী হয়ে পড়ে। অনুসরণীয় ব্যক্তির ভুল-শুদ্ধ সব কিছুকেই সে সঠিক মনে করে। এমনকি তার যে কোন ভুল হ’তে পারে এই ধারণাটুকুও অনেক সময় ভক্তের মধ্যে লোপ পায়। মানুষ যুগে যুগে কখনো তার বাপ-দাদার আমল থেকে চলে আসা রসম-রেওয়াজের অনুসারী হয়েছে, কখনো কোন সাধু ব্যক্তি অথবা ধর্মনেতার অনুসারী হয়েছে। ফলে নবীদের মাধ্যমে আল্ল­াহ প্রেরিত ঐশী সত্যকে সত্য বলে স্বীকার করেও অনেকে তা মানতে ব্যর্থ হয়েছে শুধুমাত্র তাক্বলীদী গোঁড়ামীর কারণে। বলা বাহুল্য প্রত্যেক নবীকেই স্ব স্ব সমাজের প্রচলিত আচার-অনুষ্ঠানের মুকাবিলা করতে হয়েছে। আল্ল­াহ প্রেরিত ‘অহি’র সত্যকে প্রচার করতে গিয়ে সমাজের লালিত সত্যের (?) বিরোধিতা করতে হয়েছে। ফলে কখনো তাঁদের মার খেতে হয়েছে, কখনো অগ্নি পরীক্ষা দিতে হয়েছে, কখনো দেশ ছাড়তে হয়েছে, কখনো জীবন দিতে হয়েছে। পবিত্র কুরআনে এই মর্মে বহু আয়াত বর্ণিত হয়েছে। যেমন হযরত নূহ (আলাইহিস সালাম) যখন তাঁর কওমকে আল্ল­াহর ইবাদত ও নবীর এত্বা‘আত বা অনুসরণের আহবান জানালেন, তখন তারা তা মানতে অস্বীকার করল এবং যাতে তারা তাদের অনুসরণীয় ধর্মনেতা অদ, সুওয়া‘, ইয়াগূছ, ইয়া‘ঊক্ব, নাস্র প্রমুখের অনুসরণ থেকে বিরত না হয়, তজ্জন্য যিদ করল (নূহ ৭১/২৩)। সুদীর্ঘ সাড়ে নয়শত বছর পরম ধৈর্যের সঙ্গে দাওয়াত দিয়ে (অনধিক মাত্র চল্লি­শ বা আশি জনের) মুষ্টিমেয় কয়েকজন ভাগ্যবান ব্যক্তি নবীর আহবানে সাড়া দেন। বাকী সবাই প্রচলিত তাক্বলীদী কুসংস্কারের জালে আবদ্ধ থাকে। অবশেষে আল্ল­াহর পক্ষ হ’তে পাঠানো এক ব্যাপক গযবে দুনিয়া গারত হয়ে যায়।

পরবর্তীকালে পিতা ইবরাহীম, মূসা, ঈসা ও আমাদের নবী মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) সকলকেই এই তাক্বলীদী গোঁড়ামীর মুকাবিলা করতে হয়েছে। প্রত্যেক নবীর কওম স্ব স্ব বাপ-দাদার দোহাই পেড়ে নবীর আনীত সত্যকে প্রত্যাখ্যান করেছে। যেমন আল্লাহ বলেন,

وَ اِذَا قِيْلَ لَهُمُ اتَّبِعُوْا مَآ اَنْزَلَ اللهُ قَالُوْا بَلْ نَتَّبِعُ مَا ألْفَيْنَا عَلَيْهِ آبَاءَنَا، أوَلَوْ كَانَ آبَاؤُهُمْ لاَ يَعْقِلُوْنَ شَيْئًا وَّلاَ يَهْتَدُوْنَ-

‘যখন তাদেরকে বলা হয়েছে আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তার অনুসরণ কর, তখন তারা বলেছে, বরং আমরা বাপ-দাদার আমল থেকে যা পেয়ে আসছি, তারই অনুসরণ করব। যদিও তাদের বাপ-দাদারা এসবের কিছুই জ্ঞান রাখত না বা হেদায়াতপ্রাপ্ত ছিল না’ (বাক্বারাহ ২/১৭০)

তাক্বলীদের সংজ্ঞা (معنى التقليد) :

তাক্বলীদ ‘ক্বালাদাতুন’ শব্দ থেকে ব্যুৎপত্তি লাভ করেছে। যার অর্থ কণ্ঠহার বা রশি। ‘ক্বাল্লাদাল বা‘ঈরা’ (قلد البعير)  ‘সে উটের গলায় রশি বেঁধেছে’। সেখান থেকে মুক্বাল্লিদ, যিনি নিজের গলায় কারো আনুগত্যের রশি বেঁধে নিয়েছেন। পারিভাষিক অর্থে ‘নবী ব্যতীত অন্য কোন ব্যক্তির কোন শারঈ সিদ্ধান্তকে বিনা দলীলে মেনে নেওয়াকে ‘তাক্বলীদ’ বলা হয়। মোল্লা আলী ক্বারী (রহঃ) বলেন, التقليد قبول قول الغير بلا دليل فكأنه لقبوله جعله قلادة فى عنقه ‘অন্যের কোন কথা বিনা দলীলে গ্রহণ করার নাম ‘তাক্বলীদ’। এইভাবে গ্রহণ করার ফলে ঐ ব্যক্তি যেন নিজের গলায় রশি পরিয়ে নিল’।[2]



১.  উক্ত তিন দফা কর্মপন্থা ‘সমাজ বিপ্ল­বের ধারা’ নামে প্রকাশিত বইয়ে দেখুন। -প্রকাশক।

২. মোল্লা আলী ক্বারী প্রণীত শরহ ক্বাছীদাহ আমালী-র বরাতে হাক্বীক্বাতুল ফিক্বহ (বোম্বাই : দাঊদ রায কর্তৃক সংশোধিত ও পরিবর্ধিত সংস্করণ, তাবি) পৃঃ ৪৪।