তালাক ও তাহলীল

৪র্থ দলের দলীল সমূহ

এই দল বলেন যে, একত্রিত তিন তালাক এক তালাকে রাজ‘ঈ হিসাবে গণ্য হবে। ইদ্দতকালের মধ্যে রাজ‘আতের মাধ্যমে এবং ইদ্দত শেষ হ’লে নতুন বিবাহের মাধ্যমে স্ত্রীকে ফেরত নিতে পারবে। তাঁদের দলীল :

(১) ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন,

كَانَ الطَّلاَقُ عَلَى عَهْدِ رَسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ اللهُ وَسَلَّمَ وَأَبِىْ بَكْرٍ وَسَنَتَيْنِ مِنْ خِلاَفَةِ عُمَرَ طَلاَّقُ الثَّلاَثِ وَاحِدَةً فَقَالَ عُمَرُ: إنْ النَّاسَ قَدِ اسْتَعْجَلُوْا فِىْ أَمْرٍ كَانَتْ لَهُمْ فِِيْهِ أَنَاةٌ فَلَوْ أمْضَيْنَاهُ عَلَيْهِمْ فَأمْضَاهُ عَلَيْهِمْ فَأمْضاَهُ عَلَيْهِمْ، رواه مسلم

‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর যামানায় এবং হযরত আবু বকর (রাঃ) ও হযরত ওমর (রাঃ)-এর খেলাফতের প্রথম দু’বছর একত্রিত তিন তালাককে এক তালাক গণ্য করা হ’ত। অতঃপর ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) বললেন, লোকেরা এমন এক বিষয়ে দ্রুততা দেখাচ্ছে, যে বিষয়ে তাদেরকে অবকাশ দেওয়া হয়েছিল। আমরা যদি এটা তাদের উপরে জারি করে দিতাম। অতঃপর তিনি এটা তাদের উপরে জারি করে দিলেন’।[1]

মন্তব্য : এ হাদীছে স্পষ্টভাবে এসেছে যে, একত্রিত তিন তালাক এক তালাক বলে গণ্য হ’ত রাসূল (ছাঃ)-এর যামানা থেকেই। উক্ত সরল বিধান-এর অপব্যবহার  দেখে ওমর ফারূক (রা:) কঠোরতা অবলম্বন করার মনস্থ করেন ও সে মতে আইন জারি করেন। রাষ্ট্রনেতা হিসাবে সামাজিক শৃংখলা ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য তিনি সাময়িকভাবে কঠোর ব্যবস্থা অবলম্বন করেছিলেন। তিনি এর দ্বারা আল্লাহর বিধানকে পরিবর্তন করেননি। বরং তালাক-এর বাড়াবাড়ি বন্ধ করতে চেয়েছিলেন।

দ্বিতীয়ত: এটিকে ইজমা হিসাবে গণ্য করা যাবে না। কেননা কুরআনী নির্দেশ ও সুন্নাতের স্পষ্ট প্রমাণাদি ও ছাহাবীদের সম্মিলিত আমল মওজূদ থাকতে তার বিরুদ্ধে ইজমা অনুষ্ঠিত হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। দাবী করলেও তা গ্রাহ্য হবে না।

(২) আবু ছাহবা একদা ইবনু আববাস (রাঃ)-কে প্রশ্ন করেন,

أَتَعْلَمُ اَنَّمَا كَانَتِ الثُّلاَثُ تُجْعَلُ وَاحَدِةً عَلَى عَهْدِ النَّبِىِّ صَلىَّ اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَأَبِىْ بَكْرٍ وَ ثَلاَثًا مِنْ إِمَارَةِ عُمَرَ فَقَالَ ابْنُ عَبَّاسٍ: نَعَمْ،

‘আপনি কি জানেন যে, রালূলুল্লাহ (ছাঃ), আবু বকর (রাঃ) ও ওমর (রাঃ)-এর খেলাফতের প্রথম দিকে তিন বছর একত্রিত তিন তালাককে এক তালাক গণ্য করা হ’ত? তিনি বললেন, হাঁ।[2]

(৩) মাহমূদ বিন লাবীদ বর্ণিত হাদীছ,

قل : أُخِبْرَ رَسُوْلُ اللهُ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَنْ رَجُلٍ طَلَّقَ اَمْرَأَتَهُ ثَلاَثَ تَطْليقاتٍ جميعًا، فَقَامَ غَضْبَانَ ثُمَّ قاَلَ : أَيُلْعَبُ بِكتابِ الله عَزَّ وَجَلَّ وَأَنَا بَيْنَ أَظْهُرِكُمْ ؟ " حَتىَّ قَامَ رَجُلٌ فَقَالَ : يَا رَسُوْلَ اللهِ ألاَ أقْتُلُهُ ؟ . رواه النسائي-

‘তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে জনৈক ব্যক্তি সম্পর্কে খবর দেওয়া হ’ল, যে তার স্ত্রীকে একত্রে তিন তালাক দিয়েছেন। একথা শুনে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ভীষণ ক্রুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে যান এবং বলেন, আল্লাহর কিতাব নিয়ে খেলা করা হবে? অথচ আমি তোমাদের মাঝে বেঁচে আছি। একজন দাঁড়িয়ে বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আমি কি ওকে কতল করে দেব না’? [3]

মন্তব্য : কনিষ্ঠ ছাহাবী মাহমূদ বিন লাবীদ-এর উক্ত রেওয়ায়াতকে অনেকে ‘মুরসাল’ বলতে চেয়েছেন। কিন্তু ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (রহঃ) দৃঢ়তার সাথে বলেন যে মাখরামাহ তার পিতা হ’তে শোনেন নি। তবে তিনি তার পিতার লিখিত কিতাব হ’তে বর্ণনা করেছেন। ইবনু মুঈনও অনুরূপ কথা বলেছেন। তাঁর থেকে ইমাম মুসলিম স্বীয় ছহীহ-তে কয়েকটি হাদীছ বর্ণনা করেছেন। অতএব অত্র হাদীছ ‘মুরসাল’ নয়; বরং ‘মুত্তাছিল’। হাফেয ইবনু হাজার আসক্বালানী স্বীয় ‘বুলূগুল মারামে’ অত্র হাদীছকে ‘ছহীহ’ বলেছেন। তিনি বলেন যে, এর বর্ণনাকারীগণ    বিশ্বস্ত।[4]

এক্ষেত্রে ঐ ব্যক্তি তালাকের শব্দ সংখ্যা ও পদ্ধতি নিয়ে খেলা করেছে। আল্লাহর ইচ্ছার বিরুদ্ধে সে নিজের ইচ্ছা প্রয়োগ করেছে। কেননা রাজ‘ঈ তালাক হিসাবে এক বা দুই তালাক দেওয়াই হ’ল আল্লাহ প্রদত্ত অহি-র বিধান। অথচ সে তা বাদ দিয়ে উক্ত বিধানকে হালকা করে দেখেছে। আর রাসূলের রাগের কারণ সেটাই। কিন্তু এর ফলে ‘তিন তালাকই প্রযোজ্য হয়েছিল’ এ দাবীর পক্ষে কোন দলীল নেই। কেননা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর যুগে একত্রিত তিন তালাককে এক তালাকে রাজ‘ঈ গণ্য করা হ’ত বলে ইবনু আববাস (রাঃ) বর্ণিত হাদীছে আমরা দেখে এসেছি।

(৪) কুরআনী আয়াত الطَّلاَقُ مَرَّتَانِ ‘তালাক দু’বার’ কথাটিই একত্রিত তিন তালাকের সরাসরি বিরোধী। কেননা এর অর্থ একটির পর একটি। শুধু মৌখিক শব্দে নয়; বরং পদ্ধতি ও প্রকৃতিতে। কেননা ‘মার্রাতা-ন’ অর্থ দু’বার। দু’বার অর্থ একবারের পর দ্বিতীয় বার। অর্থাৎ সহবাসহীন পবিত্র অবস্থার শুরুতে প্রথম তালাক দিবে। অতঃপর একইভাবে দ্বিতীয়বার পবিত্র হওয়ার শুরুতে দ্বিতীয় তালাক দিবে। এই দুই তালাক রাজ‘ঈ হবে। অর্থাৎ ইদ্দতকালের মধ্যে তাকে বিনা বিবাহে এবং ইদ্দতকাল শেষে হয়ে গেলে নতুন বিবাহের মাধ্যমে ফেরত নিতে পারবে। আয়াতের নির্গলিতার্থ এটাই। এর অর্থ কখনোই এটা নয় যে, একত্রে দুই তালাক বললেই দুই তালাক হয়ে গেল। যেমন কুরআনে অন্যত্র এসেছে ثُمَّ ارْجِعِ الْبَصَرَ كَرَّتَيْنِ ‘অতঃপর তুমি তোমার দৃষ্টিকে ফিরাও দ্বিতীয়বার’ ... (মুল্ক ৬৭/৪)। এর অর্থ প্রথমবারের পর  দ্বিতীয়বার। অমনিভাবে হাদীছে এসেছে, اَلْمَرْأةُ إِذَا صَلَّتْ خَمْسَهَا ‘যখন কোন মহিলা তার উপরে ফরযকৃত পাঁচ ছালাত আদায় করবে’...।[5] এর অর্থ পাঁচ ওয়াক্তে পাঁচ বার সুন্নাতী তরীকায় ছালাত আদায় করা। ছালাত ছালাত ছালাত পাঁচবার একত্রে বলা হয়। দ্বিতীয়তঃ সূরায়ে তালাক্ব-এর ১ম আয়াতে বলা হয়েছে, ‘তোমরা একত্রিত তিন তালাক দিলে ইদ্দত অনুযায়ী তালাক দেওয়ার সুযোগ থাকে না। এভাবে কুরআনী নির্দেশ লংঘন করে একত্রিত তিন তালাক দিলে তা কিভাবে তিন তালাক হিসাবে গণ্য করা হ’তে পারে?

(৫) ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, 

طَلَّقَ عَبْدُ يَزِيْدَ أبُوْ رُكَانَةَ أُمَّ رُكَانَةَ، فَقَالَ لَهُ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلِيْهِ وَسَلَّمَ: رَاجِعِ امْرأَتَكَ أُمَّ رُكَانَةَ وَإخْوَتَهُ فَقَالَ: إِنِّىْ طَلَّقْتُهَا ثَلاَثاً ياَ رَسُوْلَ اللهِ، قَالَ قَدْ عَلِمْتُ، رَجِعْهاَ وَتَلاَ يَاأَيُّهَا النَبِىُّ إِذَا طَلَّقْتُمُ النِّسَاءَ فَطَلِّقُوْهُنَّ لِعِدَّتِهِنَّ الأية، رواه  أبوداؤد- ح/২১৯৬،

وَفِىْ لَفْظٍ لِأَحْمَدَ ح/২৩৮৭: طَلَّقَ رُكَانَةُ امْرأَتَهُ ثَلاَثًا فِىْ مَجْلِسٍ وَاحِدٍ، فَحَزِنَ  عَلَيْهَا حُزْنًا شَدِيْدًا، قَالَ فَسَأَلَهُ رَسُوْلُ الله صَلّى الله عَلَيْهِ وَ سَلَّمَ: كَيْفَ طَلَّقْتَهَا؟ قَال: طَلَّقْتُهَا ثَلاَثًا فَقَالَ: فىْْ مَجْلِسٍ وَاحِدٍ؟ قَال: نعم، قال: فَإِنَّمَا تِلْكَ وَاحِدَةً فَارْجِعْهَا إِنْ شْئْتَ، قَالَ: فَرَاجَعَهاَ-

‘আব্দু ইয়াযীদ আবু রুকানা তার স্ত্রী উম্মে রুকানাকে তালাক দেন। এতে তিনি দারুণভাবে মর্মাহত হন। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে জিজ্ঞেস করলেন, কিভাব তালাক দিয়েছ? তিনি বললেন, এক মজলিসে তিন তালাক দিয়েছি। রাসূল (ছাঃ) তাকে বললেন, আমি জানি। ওটা এক তালাক হয়েছে। তুমি স্ত্রীকে ফেরত নাও। অতঃপর তিনি সূরা তালাক্ব-এর ১ম আয়াতটি পাঠ করে শুনান।[6] আবু ইয়ালা একে ছহীহ বলেছেন।

মন্তব্য : ইমাম শাওকানী (রহঃ) বলেন, রুকানার এ হাদীছকে অনেকে ত্রুটিপূর্ণ বলেছেন মুহাম্মাদ ইবনে ইসহাকের কারণে। কিন্তু অনুরূপ সনদে তারাই আবার বিভিন্ন আহকাম বিষয়ে দলীল গ্রহণ করেছেন।[7] তবে অত্র হাদীছ সনদ ও মতন উভয় দিক দিয়ে ছহীহ সূত্রে বর্ণনা করেছে আবুদাঊদ স্বীয় সুনানে[8] এবং আব্দুর রাযযাক স্বীয় মুছান্নাকে ইবনু জুরাইজের সূত্রে জনৈক বনূ রাফে‘ হ’তে, অতঃপর ইকরিমা অতঃপর ইবনু আববাস হ’তে। আহমাদ বর্ণনা করেছে মুহাম্মাদ ইবনে ইসহাকের সূত্রে এবং মুহাম্মাদ ইবনে ইসহাক বিশ্বস্ত’।[9]

উল্লেখ্য যে, আবুদাঊদ অন্য সূত্রে উক্ত হাদীছ বর্ণনা করেন। যেখানে البةة) ‘আলবাত্তাতা’ শব্দ এসেছে (হা/২২০৮)। যার অর্থ ‘নিশ্চিত তালাক’। রাসূল (ছাঃ) তাকে কসম করতে বলেন, তখন তিনি বলেন যে, আমি এক তালাকের নিয়ত করেছিলাম। বলে রাসূল (ছাঃ) তাকে তার স্ত্রী ফেরৎ নিতে বলেন। এক্ষণে প্রশ্ন: যদি ঐ ব্যক্তি একত্রিত তিন তালাক বায়েন দেওয়ার নিয়ত করত, তাহ’লে তাই-ই পতিত হ’ত।

জবাব : হাদীছটি ‘মুযত্বারাব’। ইমাম আহমাদ বলেন, এর সকল সূত্রই যঈফ। ইমাম বুখারীও একে ‘যঈফ’ বলেছেন।[10]



[1].মুসলিম হা/ ১৪৭২; ফিক্বহুস সুন্নাহ ২/২৯৯।

[2]. মুসলিম হা/১৪৭৩।

[3]. নাসাঈ হা/৩৪৩০।

[4]. মুহাল্লা ৯/৩৮৮ টীকা; মাসআলা ১৯৪৫; যাদুল মা‘আদ ৫/২২০-২১।

[5].মিশকাত হা/৩২৫৪।

[6]. আবুদাঊদ হা/২১৯৬; আহমাদ হা/২৩৮৭; আওনুল মা‘বূদ ৬/২৭৯; যাদুল মা‘আদ ৫/২২৯।

[7]. নায়লুল আওত্বার ৮/২১।

[8]. ছহীহ আবু দাউদ হা/১৯২২।

[9]. হাশিয়া মুহাল্লা ৯/৩৯১।

[10]. যাদুল মা‘আদ ৫/২৪১; ইরওয়াউল গালীল হা/২০৬৩, ৭/১৩৯।