তালাক ও তাহলীল

যুক্তির দলীল

কুরআন ও ছহীহ হাদীছের স্পষ্ট বিধান মওজূদ থাকতে সেখানে কারু কোন রায় বা যুক্তি চলে না (আহযাব ৩৩/৩৬)। তালাকের স্পষ্ট বিধান পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হওয়া সত্ত্বেও এবং রাসূল (ছাঃ)-এর যামানা, আবুবকর (রাঃ)-এর খেলাফতকাল এবং ওমর (রাঃ)-এর খেলাফতকালের প্রথম দুই বা তিন বছর কুরআনী তালাকের বাস্তব প্রচলন থাকার পরেও একত্রিত তিন তালাককে তিন তালাক বায়েন গণ্য করার প্রথা চালু হয় মূলতঃ কিছু যুক্তির দোহাই পেড়ে। যা পূর্বের আলোচনায় প্রমাণিত হয়ে গেছে। কিন্তু প্রশ্ন হ’ল, আমরা কি যুক্তির অনুসরণ করব? না সুন্নাহর অনুসরণ করব?

ওমর ফারূক (রাঃ) নিজে হজ্জে তামাত্তুকে অপসন্দ করতেন। অথচ তাঁর বড় ছেলে আব্দুল্লাহ বিন ওমর (রাঃ) হজ্জে তামাত্তু করেন। ফলে লোকেদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছিলেন, أفرسولُ الله صلى الله عليه وسلم أحَقُّ أنْ يُّتَّبَعَ سنتُه ام سنةُ عُمَرَ؟ ‘রাসূলের সুন্নাত অধিক অনুসরণ যোগ্য, না ওমরের সুন্নাত? [1]

অনুরূপভাবে হযরত আলী (রাঃ) বলেন, لو كان الدينُ بالرأى لكان أسفلُ الخُف أولى بالمسح من أعلاه- ‘যদি দ্বীন মানুষের রায় অনুযায়ী হ’ত, তাহ’লে মোযার উপরে মাসাহ করার চেয়ে তার নীচে মাসাহ করা অধিক উত্তম হ’ত।[2]

ওমর ফারূক (রাঃ) নিঃসন্দেহে ভাল নিয়তে কাজ করেছিলেন ও তালাকের ব্যাপারে আইনী কঠোরতা আরোপ করেছিলেন। শাসক হিসাবে এরূপ সাময়িক অধিকার ইসলামী আমীরদের রয়েছে। কিন্তু এটাতো মানতেই হবে যে, এলাহী বিধান চিরন্তন। তাই যত কঠোরতাই দেখানো হৌক না কেন, দুর্বল জীব মানুষ যেকোন সময় সীমা অতিক্রম করে যেতে পারে এবং সেটাই হয়েছে। ফলে উক্ত কঠোরতার পরিণামে নিষ্কৃতির পথ না পেয়ে তাহলীল-এর ন্যায় নোংরা পথ বেছে নিতে মুসলিম স্বামী-স্ত্রী বাধ্য হয়েছে এবং আজও হচ্ছে। অতএব আমাদের উচিত ছিল কুরআনী তালাক বিধানের দিকে ফিরে যাওয়া। কিন্তু না গিয়ে একত্রিত তিন তালাককে তিন তালাক গণ্য করার কঠোর ও বিদ‘আতী প্রথাকে টিকিয়ে রাখার জন্য আমাদের ওলামায়ে কেরাম বিভিন্ন যুক্তির অবতারণা করেছেন। যেমন-

(১) পাকিস্তানের প্রধান মুফতী মাওলানা মুহাম্মাদ শফী স্বীয় তাফসীরে উক্ত আয়াতের সুন্দর আলোচনা শেষে ‘একত্রে তিন তালাক’ শিরোনামে বলেন, ‘এ প্রশ্নের যুক্তিভিত্তিক উত্তর এই যে, কোন কাজের পাপ কাজ হওয়া তার প্রতিক্রিয়ার পথে বাধার সৃষ্টি করে না। অন্যায়ভাবে হত্যা করা পাপ হ’লেও যাকে গুলী করে বা কোন অস্ত্রের আঘাতে হত্যা করা হয়, সে নিহত হয়েই যায়। এই গুলী বৈধভাবে করা হ’ল, কি অবৈধভাবে করা হয়েছে, সেজন্য মৃত্যু অপেক্ষা করে না। চুরি সব ধর্মমতেই পাপ, কিন্তু যে অর্থ-সম্পদ চোরাই পথে পাচার করা হয়, তা তো হাতছাড়া হয়েই গিয়েছে। এমনিভাবে যাবতীয় অন্যায় ও পাপের একই অবস্থা যে, এর অন্যায় ও পাপ হওয়া এর প্রতিক্রিয়ার ক্ষেত্রে কোন বাধার সৃষ্টি করে না। এই মূলনীতির ভিত্তিতে শরী‘আত প্রদত্ত নীতি-নিয়মের প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করে প্রয়োজন ব্যতীত স্বীয় সমস্ত ক্ষমতাকে শেষ করে দেয়া এবং একই সঙ্গে তিন তালাক দিয়ে নিষ্কৃতি লাভ করা যদিও রাসূল (ছাঃ)-এর অসন্তুষ্টির কারণ, যা পূর্ববর্তী বর্ণনায় উল্লেখ করা হয়েছে, এজন্য সমগ্র উম্মত একবাক্যে একে নিকৃষ্ট পন্থা বলে উল্লেখ করেছে এবং কেউ কেউ নাজায়েযও বলেছে, কিন্তু তা সত্ত্বেও যদি কেউ এ পদক্ষেপ নেয়, তবে এর ফলাফলও তাই হবে, বৈধ পথে অগ্রসর হ’লে যা হয়। অর্থাৎ তিন তালাক হয়ে যাবে এবং শুধু প্রত্যাহার নয়, বিবাহ বন্ধন নবায়নের সুযোগও আর থাকবে না। হুযূর (সাঃ)-এর মীমাংসাই এ ব্যাপারে বড় প্রমাণ যে, তিনি অসন্তুষ্ট হয়েও তিন তালাকই কার্যকরী করেছেন। হাদীস গ্রন্থে অনুরূপ বহু ঘটনার বর্ণনা রয়েছে’।[3]

জবাব : অথচ আমরা দেখতে পাই যে, কুরআনে বর্ণিত প্রথম দু’টি তালাককে তালাক বলা হ’লেও তা বন্দুকের গুলীর মত ছিল না। কেননা তা ছিল রাজ‘ঈ তালাক। যা দিলে স্ত্রীকে ফেরৎ পাওয়া যায়। অথচ বন্দুকের গুলীতে কারু রাজ‘আত হয় না বরং মৃত্যু হয়। দ্বিতীয়তঃ রাসূল (ছাঃ) অসন্তুষ্ট হ’লেও তিন তালাক কার্যকরী করেছেন- এমন কোন বিশুদ্ধ দলীল কোথাও নেই, ইতিপূর্বের আলোচনায় যা প্রমাণিত হয়েছে।

(২) পাকিস্তানের অন্যতম খ্যাতনামা আলেম মাওলানা মওদূদী স্বীয় তাফসীরে উক্ত বিষয়ের পক্ষে যুক্তি দিয়ে গিয়ে বলেন, ‘এর উপমা দেওয়া যায় যে, কোন এক পিতা তার ছেলেকে তিন শত টাকা দিয়ে বললেন, তুমিই এ টাকার মালিক, যেভাবে ইচ্ছা তুমি এ টাকা খরচ করতে পার। এরপর তিনি তাকে উপদেশ দিয়ে বললেন, যে অর্থ আমি তোমাকে দিলাম তা তুমি সতর্কতার সাথে উপযুক্ত ক্ষেত্রে ক্রমান্বয়ে খরচ করবে যাতে তা থেকে যথাযথ উপকার পেতে পার। আমার উপদেশের তোয়াক্কা না করে তুমি যদি অসতর্কভাবে অন্যায় ক্ষেত্রে তা খরচ করে কিংবা সমস্ত অর্থ একসাথে খরচ করে ফেল তাহ’লে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এরপর আমি খরচ করার জন্য আর কোন   টাকা-পয়সা তোমাকে দিব না। এখন পিতা যদি এই অর্থের পুরোটা ছেলেকে আদৌ না দেয়, তাহ’লে সে ক্ষেত্রে এসব উপদেশের কোন অর্থই হয় না। যদি এমন হয় যে, উপযুক্ত ক্ষেত্র ছাড়াই ছেলে তা খরচ করতে চাচ্ছে, কিন্তু টাকা তার পকেট থেকে বের হচ্ছে না অথবা পুরো তিন শত টাকা খরচ করে ফেলা সত্ত্বেও মাত্র একশত টাকাই তার পকেট থেকে বের হচ্ছে এবং সর্বাবস্থায় দুইশত টাকা তার পকেটেই থেকে যাচ্ছে, তাহ’লে এই উপদেশের আদৌ কোন প্রয়োজন নেই’।[4]

জবাব : দুর্ভাগ্য তিনি তিনটি তালাককে তিনশত টাকার সাথে তুলনা করেছেন। টাকা যদি হারিয়ে যায় বা কেউ চুরি বা ছিনতাই করে নেয়, বা কাউকে হাদিয়া দেওয়া হয়, তাহ’লে কি টাকার উপরে কোন মালিকানা থাকে? এছাড়া টাকা একটি বস্ত্ত মাত্র, যা ফেলে দিলে চুকে গেল। কিন্তু তালাক কি তাই? তালাকের নির্দিষ্ট নিয়ম-পদ্ধতি আছে, যা না মানলে তালাক হিসাবে গণ্য হয় না। এর সঙ্গে দু’টি জীবন, সংসার ও সন্তান পালনের দায়বদ্ধতা জড়িত আছে। একে ফেলনা মনে করার কোন কারণ নেই। আর সেকারণেই রাসূল (ছাঃ) ক্রুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে গিয়ে বলেছিলেন, আল্লাহর কিতাব নিয়ে খেলা হচ্ছে? আমরা কি তাই করছি না? রাসূলের এই ক্রোধকে সোজা অর্থে গ্রহণ না করে আমরা বাঁকা অর্থে গ্রহণ করেছি এবং তাঁর ক্রোধের কারণ একত্রিত তিন তালাককে আমরা তিন তালাক গণ্য করেছি। কাল ক্বিয়ামতের মাঠে রাসূল (ছাঃ) যদি ক্রুদ্ধ হয়ে শাফা‘আত না করেন, তখন বিজ্ঞ ওলামায়ে কেরাম কি জওয়াবদিহী করবেন, ভেবে দেখেছেন কি?

উল্লেখ্য যে, মাওলানা মওদূদী স্বীয় তাফহীমুল কুরআনে সূরায়ে বাক্বারাহর উপরোক্ত আয়াতের তাফসীর করতে গিয়ে দীর্ঘ আলোচনার অবতারণা করেছেন[5] এবং একত্রিত তিন তালাককে তিন তালাক গণ্য করার পক্ষে ৩টি হাদীছ ও অন্যূন ১১টি আছার পেশ করেছেন। পেশকৃত হাদীছ সমূহের মধ্যে তিনটিই যঈফ ও মুনকার। এরপর ছাহাবায়ে কেরামের উক্তি বা ‘আছার’গুলির প্রায় সবই মুছান্নাফে আবদুর রাযযাক, মুছান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, মুওয়াত্ত্বা, দারাকুৎনী, আবুদাঊদ, ত্বাহাভী প্রভৃতি গ্রন্থ থেকে চয়ন করা হয়েছে। যার মধ্যে (ক) ইবনু আববাস (রাঃ) থেকে চারটি আছার-এর তিনটি ছহীহ ও যঈফ (খ) ইবনু মাসঊদ (রাঃ) থেকে দু’টি আছার-এর একটি যঈফ ও একটি ছহীহ (গ) হযরত ওছমান ও আলী (রাঃ) থেকে দু’টি আছার-এর একটি যঈফ ও একটি মওযূ বা জাল। বাকীগুলির অবস্থাও অনুরূপ। যে সমস্ত আছার ছহীহ সূত্রে বর্ণিত সেগুলি বুখারী ও মুসলিম বর্ণিত মওকূফ হাদীছের বিরোধী হওয়ায় অগ্রহণযোগ্য। মাওলানা মওদূদী ওমর (রাঃ)-এর যুগের কথিত ইজমা দ্বারা রাসূল (ছাঃ)-এর ও আবুবকর (রাঃ)-এর যুগের প্রচলিত সুন্নাহকে অগ্রহণযোগ্য বলতে চেয়েছেন।[6] যা নিতান্তই অযৌক্তিক।

পক্ষান্তরে ইবনু আববাস (রাঃ) বর্ণিত ও বুখারী-মুসলিম সংকলিত ছহীহ মরফূ হাদীছগুলি, যেখানে পরিষ্কারভাবে বলা হয়েছে যে, রাসূল (ছাঃ), আবুবকর ও ওমরের যুগের প্রথম দুই বা তিন বছর একত্রিত তিন তালাককে এক তালাক গণ্য করা হ’ত। তার পক্ষে মাওলানা কোন কথা বলেননি। তিনি বিদ‘আতী তালাকের পক্ষে যুক্তি পেশ করলেও কুরআন ও সুন্নাতে নববীর পক্ষে যুক্তি পেশ করেননি।

(৩) মিশকাত শরীফের বাংলা অনুবাদক মাওলানা নূর মোহাম্মাদ আজমী বলেন, মাহমূদ বিন লবীদের হাদীছ (১৮নং) হইতে বুঝা যায় যে, একসাথে তিন তালাক দেওয়া বিদ‘আত ও হারাম। তাবেয়ীনদের মধ্যে হজরত তাউছ ও ইকরেমা বলেন, যেহেতু ইহা সুন্নাতের বিপরীত অতএব ইহাকে সুন্নাত অনুসারে এক তালাকই (রজয়ী) গণ্য করিতে হইবে। ছাহাবীদের মধ্যে হজরত আবদুল্লাহ বিন আববাছ বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও আবুবকর ও ওমরের খেলাফতের দুই বছর কাল (একসাথে) তিন তালাক এক তালাকই ছিল। অতঃপর হযরত ওমর বলিলেন,.. সুতরাং এখন হইতে আমাদের ইহাকে (তিন তালাক রূপে) কার্যকরী করিয়া দেওয়াই উচিত’। রাবী বলেন, ‘অতঃপর তিনি উহাকে কার্যকরী করিয়াছিলেন।

কিন্তু জম্হুরে ছাহাবা, তাবেয়ীন ও ইমামগণ সকলেই বলেন, একসাথে তিন তালাক দেওয়া বেদআত ও গোনাহর কাজ, তবে ইহাতে তিন তালাক হইয়া যাইবে’।... মোটকথা, এ আলোচনা দ্বারা... দেখা গেল যে, ইহার উপর মুজতাহিদ ছাহাবীগণের ইজমা হইয়া গিয়াছে এবং পরবর্তী ইমামগণও ইহার উপর একমত হইয়াছেন।[7]

জবাব : ইজমা-এর দাবী অগ্রহণযোগ্য। কেননা ‘ইজমা’ বলতে উম্মতের ঐক্যমত বুঝায়। অথচ সকল ছাহাবী এ বিষয়ে একমত হননি। যা আমরা ইতিপূর্বে দেখে এসেছি। দ্বিতীয়তঃ ইজমায়ে ছাহাবা সুন্নাতে নববীকে বাতিল করতে পারে না। তৃতীয়তঃ পরবর্তী সকল ইমাম এ ব্যাপারে একমত হননি। অতএব ইজমা-র দাবী অযৌক্তিক।

(৪) বোখারী শরীফের বাংলা অনুবাদক মাওলানা আজিজুল হক ‘বিশেষ দ্রষ্টব্য’ঃ শিরোনামে বলেন,

এক সঙ্গে তিন তালাক দিলে তিন তালাক প্রবর্তিত হওয়া ইহাই পূর্বাপর সকল ইমামগণের স্থির সিদ্ধান্ত।...বিশিষ্ট ইমামগণের পর উক্ত বিষয়ে ভিন্ন মতামতও দেখা দিয়াছিল বটে, কিন্তু তাহা অত্যন্ত দুর্বল ও সমর্থহীন এবং অতি ক্ষুদ্র একটি লা-মজহাবী উপদলের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। দুঃখের বিষয় আখেরী যামানার ধর্মীয় বিপর্যয়ের স্রোতে ঐ দুর্বল মতামতও ভাসিয়া আসিয়াছে এবং অপেক্ষাকৃত সহজ সুলভ হওয়ায় তাহাও এক শ্রেণীর লোকের সহায়তা পুষ্ট হইয়া বহু মুখের চর্চার বস্ত্ত ইহয়া উঠিয়াছে’।[8]

তিনি বলেন, এক সঙ্গে তিন তালাক যদি শুধু এক তালাক গণ্য হইত, তবে এখানে হযরতের ঐরূপ ক্রোধ ও অসন্তুষ্টির কোন কারণই ছিল না; এক তালাক দেওয়ার কোন ঘটনায় হযরত (ছাঃ) ঐরূপ রাগান্বিত ও অসন্তুষ্ট হইয়াছেন বলিয়া কোথাও দেখা যায় না। ...সুতরাং একত্রে তিন তালাক দেওয়া কোরআনের বিধানে প্রাপ্ত অধিকার অনাবশ্যক প্রয়োগ করাই সাব্যস্ত হয়, যাহা কোরআন নিয়া খেলা করারই নামান্তর। কিন্তু খেলা করতঃ কাহারও উপর আঘাত করিলে সেই আঘাতের পরিণাম প্রতিক্রিয়া অবশ্যই প্রবর্তিত হয় এবং সেই জন্যই ঐরূপ খেলা রাগ ও অসন্তুষ্টি কারণ হইয়া থাকে।[9]

জবাব : এ বিষয়ে যে ভিন্নমত আছে, সেকথা তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন। কিন্তু তাদেরকে লা-মজহাবী বলে মনের ঝাল মিটিয়েছেন। যেটা কোন মুহাদ্দিছ বিদ্বানের এবং কোন নিরপেক্ষ জ্ঞানী আলেমের আচরণ হ’তে পারে না। তিনি রাসূলের ক্রোধকে পরোয়া না করলেও আমরা আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলের ক্রোধ থেকে বাঁচতে চাই।

(৫) মাওলানা আশরাফ আলী থানভী বলেন, এক সঙ্গে তিন তালাক দিলে তাহাও তালাক। যেমন, যদি কেহ তার স্ত্রীকে বলে যে, তোকে তিন তালাক বা এইরূপ বলে ‘তোকে তালাক’ ‘তোকে তালাক’ ‘তোকে তালাক’, তবে তিন তালাক হইয়া বায়েন মোগাল্লাযা হইয়া যাইবে’।[10]

(৬) মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুর রহীম বলেন, স্বামী স্ত্রীকে এক সঙ্গে কিংবা সুন্নতী নিয়মে তিন তালাক দিলে সে স্ত্রীকে ফিরিয়ে রাখার কোনো উপায় থাকে না। সে তার জন্যে হারাম হয়ে যায়, হারাম হয়ে যায়- বলতে হবে- চিরতরে, তবে শরীয়ত একটি মাত্র উপায়ই উন্মুক্ত রাখা হয়েছে। তা হলোঃ ‘সে স্ত্রীলোকটি অপর স্বামী বিয়ে করবে’। তারপর সেই দ্বিতীয় স্বামী যদি তালাক দেয় তার পরে যদি তারা পুনর্মিলিত হ’তে চায় এবং আল্লাহর বিধান কায়েম রাখতে পারবে বলে যদি মনে করে, তাহলে তাদের দু’জনের পুনরায় বিবাহিত হতে কোন দোষ নেই’ (বাক্বারাহ ২৩০)

কিন্তু যদি রাগের বশবর্তী হয়ে অথবা পরিণাম সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণে একসঙ্গে তিন তালাকই দিয়ে দেয়,...এরপর যে দুঃখ ও অনুতাপ জাগে স্বামীর অন্তরে, তার প্রতিকারের কোনো উপায়ই থাকে না তার হাতে। অনেক ক্ষেত্রে আবার দেখা যায়, তিন তালাক দেওয়ার পরও স্বামী-স্ত্রী হিসেবে তারা বসবাস করতে থাকে। এ হচ্ছে সুস্পষ্টরূপে জ্বিনার অবস্থা, নিঃসন্দেহে তা’ হারাম। তাই কোনো লোকেরই এক সঙ্গে তিন তালাক দেওয়া উচিত নয়। এর পরিণাম তালাকদাতা স্বামীকেই ভোগ করতে হয়। আর সে পরিণাম অত্যন্ত দুঃখময়, নিতান্ত অবাঞ্ছনীয় এবং অত্যন্ত মর্মাান্তিক।[11]

মন্তব্য : সকলের একই দলীয় সুর। অহি-র বিধানকে যুক্তি দিয়ে খন্ডন করার অপচেষ্টা মাত্র। অথচ ঈমানের দাবী হ’ল- অহি-র বিধানের পক্ষে যুক্তি পেশ করা, বিপক্ষে নয়। অহেতুক বিতর্ক নয়, কিতাব ও সুন্নাতের প্রতি অটুট আনুগত্যের মধ্যেই ইহকালীন মঙ্গল ও পরকালীন মুক্তি নিহিত।



[1]. মুসনাদে আহমাদ ২/৯৫।

[2]. ছহীহ আবুদাঊদ হা/১৪৭।

[3]. বঙ্গানুবাদ তাফসীর মাআরেফুল ক্বোরআন, অনুবাদ ও সম্পাদনা : মাওলনা মুহিউদ্দীন খান ১৪১৩ হিঃ, পৃঃ ১২৮।

[4]. তাফহীমুল কুরআন, অনুবাদ: মাওলানা মুজাম্মিল হক (ঢাকা : আধুনিক প্রকাশনী ৩য় সংষ্করণ ১৯৯৭), ১৭/২১০ পৃঃ।

[5]. ঐ, বঙ্গানুবাদ পৃঃ ১৯৯-২১০।

[6]. তাফহীমুল কুরআন, অনুবাদ: মাওলানা মুজাম্মিল হক (ঢাকা: আধুনিক প্রকাশনী ৩য় সংষ্করণ ১৯৯৭), পৃঃ ২০৩-৪।

[7]. বঙ্গানুবাদ মেশকাত শরীফ (ঢাকা : এমদাদিয়া লাইব্রেরী ২য় মুদ্রণ, ১৯৮৭) ৬/৩১৯-২০।

[8].বঙ্গানুবাদ : বোখারী শরীফ (ঢাকা : হামিদিয়া লাইব্রেরী, ৫ম সংষ্করণ ১৪১৭/১৯৯৭) ৬/১৬৭।

[9]. প্রাগুক্ত ৬/১৬৭-৬৮।

[10]. বঙ্গানুবাদ বেহেশতী জেওর, অনুবাদ: মাওলানা শামছুল হক ফরিদপুরী (ঢাকা : এমদাদিয়া লাইব্রেরী, ৯ম মুদ্রণ ১৯৯০), দ্বিতীয় ভলিউম, ৪র্থ খন্ড পৃঃ ৩২।

[11]. পরিবার ও পারিবারিক জীবন (ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ১ম প্রকাশ ১৯৮৩), পৃঃ ৫৯৭, ৫৯৬।