সূরা নাবা
(সংবাদ)
সূরা মা‘আরেজ-এর পরে মক্কায় অবতীর্ণ।
সূরা ৭৮, আয়াত ৪০, শব্দ ১৭৪, বর্ণ ৭৬৬।
بِسْمِ اللہِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِیْمِ
পরম করুণাময় অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে (শুরু করছি)।
(১) তারা পরস্পরে কি বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে? | عَمَّ يَتَسَاءَلُونَ |
(২) মহা সংবাদ সম্পর্কে, | عَنِ النَّبَإِ الْعَظِيمِ |
(৩) যে বিষয়ে তারা মতভেদ করে । | الَّذِي هُمْ فِيهِ مُخْتَلِفُونَ |
(৪) কখনোই না, শীঘ্র তারা জানতে পারবে। | كَلَّا سَيَعْلَمُونَ |
(৫) অতঃপর কখনোই না, শীঘ্র তারা জানতে পারবে। | ثُمَّ كَلَّا سَيَعْلَمُونَ |
(৬) আমরা কি যমীনকে বিছানাস্বরূপ করিনি? | أَلَمْ نَجْعَلِ الْأَرْضَ مِهَادًا |
(৭) এবং পাহাড় সমূহকে পেরেকস্বরূপ? | وَالْجِبَالَ أَوْتَادًا |
(৮) আর আমরা তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি জোড়ায়-জোড়ায়, | وَخَلَقْنَاكُمْ أَزْوَاجًا |
(৯) এবং তোমাদের জন্য নিদ্রাকে করেছি ক্লান্তি দূরকারী। | وَجَعَلْنَا نَوْمَكُمْ سُبَاتًا |
(১০) আমরা রাত্রিকে করেছি আবরণ | وَجَعَلْنَا اللَّيْلَ لِبَاسًا |
(১১) এবং দিবসকে করেছি জীবিকা অন্বেষণকাল। | وَجَعَلْنَا النَّهَارَ مَعَاشًا |
(১২) আমরা তোমাদের মাথার উপরে নির্মাণ করেছি কঠিন সপ্ত আকাশ | وَبَنَيْنَا فَوْقَكُمْ سَبْعًا شِدَادًا |
(১৩) এবং তন্মধ্যে স্থাপন করেছি কিরণময় প্রদীপ। | وَجَعَلْنَا سِرَاجًا وَهَّاجًا |
(১৪) আমরা পানিপূর্ণ মেঘমালা হ’তে প্রচুর বারিপাত করি। | وَأَنْزَلْنَا مِنَ الْمُعْصِرَاتِ مَاءً ثَجَّاجًا |
(১৫) যাতে তদ্বারা উৎপন্ন করি শস্য ও উদ্ভিদ | لِنُخْرِجَ بِهِ حَبًّا وَنَبَاتًا |
(১৬) এবং ঘনপল্লবিত উদ্যানসমূহ। | وَجَنَّاتٍ أَلْفَافًا |
(১৭) নিশ্চয়ই বিচার দিবস সুনির্ধারিত। | إِنَّ يَوْمَ الْفَصْلِ كَانَ مِيقَاتًا |
(১৮) যেদিন শিঙ্গায় ফুঁক দেওয়া হবে, অতঃপর তোমরা দলে দলে সমাগত হবে | يَوْمَ يُنْفَخُ فِي الصُّورِ فَتَأْتُونَ أَفْوَاجًا |
(১৯) আর আকাশ খুলে দেওয়া হবে। অতঃপর তা বহু দরজা বিশিষ্ট হবে | وَفُتِحَتِ السَّمَاءُ فَكَانَتْ أَبْوَابًا |
(২০) আর পর্বতমালা চালিত হবে। অতঃপর তা মরীচিকা হয়ে যাবে। | وَسُيِّرَتِ الْجِبَالُ فَكَانَتْ سَرَابًا |
(২১) নিশ্চয়ই জাহান্নাম ওঁৎ পেতে আছে। | إِنَّ جَهَنَّمَ كَانَتْ مِرْصَادًا |
(২২) সীমালংঘনকারীদের ঠিকানা রূপে। | لِلطَّاغِينَ مَآبًا |
(২৩) সেখানে তারা অবস্থান করবে যুগ যুগ ধরে। | لَابِثِينَ فِيهَا أَحْقَابًا |
(২৪) সেখানে তারা আস্বাদন করবে না শীতলতা কিংবা পানীয়। | لَا يَذُوقُونَ فِيهَا بَرْدًا وَلَا شَرَابًا |
(২৫) কেবল ফুটন্ত পানি ও দেহনিঃসৃত পুঁজ ব্যতীত। | إِلَّا حَمِيمًا وَغَسَّاقًا |
(২৬) যথার্থ কর্মফল হিসাবে। | جَزَاءً وِفَاقًا |
(২৭) নিশ্চয়ই তারা (আখেরাতে) জওয়াবদিহিতার আশা করত না | إِنَّهُمْ كَانُوا لَا يَرْجُونَ حِسَابًا |
(২৮) এবং আমাদের আয়াতসমূহে তারা পুরোপুরি মিথ্যারোপ করত। | وَكَذَّبُوا بِآيَاتِنَا كِذَّابًا |
(২৯) আর আমরা তাদের সকল কর্ম গণে গণে লিপিবদ্ধ করেছি। | وَكُلَّ شَيْءٍ أَحْصَيْنَاهُ كِتَابًا |
(৩০) অতএব তোমরা স্বাদ আস্বাদন কর। আর আমরা এখন তোমাদের কিছুই বৃদ্ধি করব না কেবল শাস্তি ব্যতীত। | فَذُوقُوا فَلَنْ نَزِيدَكُمْ إِلَّا عَذَابًا |
(৩১) নিশ্চয়ই মুত্তাক্বীদের জন্য রয়েছে সফলতা। | إِنَّ لِلْمُتَّقِينَ مَفَازًا |
(৩২) রয়েছে উদ্যানসমূহ ও আঙ্গুরসমূহ | حَدَائِقَ وَأَعْنَابًا |
(৩৩) আর সমবয়সী কুমারীগণ। | وَكَوَاعِبَ أَتْرَابًا |
(৩৪) এবং পূর্ণ পানপাত্র। | وَكَأْسًا دِهَاقًا |
(৩৫) তারা সেখানে কোনরূপ অনর্থক ও মিথ্যা কথা শুনবে না। | لَا يَسْمَعُونَ فِيهَا لَغْوًا وَلَا كِذَّابًا |
(৩৬) এটা তোমার প্রভুর পক্ষ হ’তে যথোচিত প্রতিদান। | جَزَاءً مِنْ رَبِّكَ عَطَاءً حِسَابًا |
(৩৭) যিনি আসমান ও যমীন এবং এতদুভয়ের মধ্যবর্তী সবকিছুর পালনকর্তা, দয়াময়। কেউ তাঁর সাথে কথা বলার ক্ষমতা রাখে না। | رَبِّ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَمَا بَيْنَهُمَا الرَّحْمَنِ لَا يَمْلِكُونَ مِنْهُ خِطَابًا |
(৩৮) যেদিন রূহ ও ফেরেশতাগণ সারিবদ্ধভাবে দাঁড়াবে। দয়াময় আল্লাহ যাকে অনুমতি দিবেন সে ব্যতীত কেউ কথা বলতে পারবে না এবং সে সঠিক কথা বলবে। | يَوْمَ يَقُومُ الرُّوحُ وَالْمَلَائِكَةُ صَفًّا لَا يَتَكَلَّمُونَ إِلَّا مَنْ أَذِنَ لَهُ الرَّحْمَنُ وَقَالَ صَوَابًا |
(৩৯) সে দিবস সুনিশ্চিত। অতঃপর যে ব্যক্তি ইচ্ছা করে সে তার পালনকর্তার প্রতি ঠিকানা নির্ধারণ করুক। | ذَلِكَ الْيَوْمُ الْحَقُّ فَمَنْ شَاءَ اتَّخَذَ إِلَى رَبِّهِ مَآبًا |
(৪০) আমরা তোমাদেরকে আসন্ন শাস্তি সম্পর্কে সতর্ক করলাম। যেদিন মানুষ প্রত্যক্ষ করবে যা সে অগ্রিম প্রেরণ করেছে এবং অবিশ্বাসী ব্যক্তি বলবে, হায়! আমি যদি মাটি হতাম!! | إِنَّا أَنْذَرْنَاكُمْ عَذَابًا قَرِيبًا يَوْمَ يَنْظُرُ الْمَرْءُ مَا قَدَّمَتْ يَدَاهُ وَيَقُولُ الْكَافِرُ يَا لَيْتَنِي كُنْتُ تُرَابًا |
সূরার বিষয়বস্ত্ত :
সূরাটিতে চারটি বিষয়বস্ত্ত রয়েছে। ১- ক্বিয়ামতের ভয়াবহতা বর্ণনা (১-৩)। ২- মূর্খদের ধমক প্রদান (৪-৫)। ৩- জ্ঞানীদের জন্য ক্বিয়ামতের প্রমাণ উপস্থাপন (৬-১৬)। ৪- ক্বিয়ামতের পর চূড়ান্ত শাস্তি (১৭-৩০) অথবা সুখের বর্ণনা (৩১-৪০)।
১ম বিষয়বস্ত্ত : ক্বিয়ামতের ভয়াবহতা বর্ণনা (১-৩) :
عَمَّ يَتَسَاَءلُوْنَ- عَنِ النَّبَإِ الْعَظِيْمِ- الَّذِيْ هُمْ فِيْهِ مُخْتَلِفُوْنَ-
(১) তারা পরস্পরে কি বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে?
(২) মহা সংবাদ সম্পর্কে,
(৩) যে বিষয়ে তারা মতভেদ করে’।
সকল যুগের নাস্তিক ও বস্ত্তবাদীদের ন্যায় মক্কার মুশরিকদের ধারণা ছিল মানুষের পরিণতি দুনিয়াতেই শেষ। অন্যান্য বস্ত্ত যেমন পচে-গলে মাটিতে মিশে যায়, মানুষও তেমনি মাটি হয়ে শেষ হয়ে যাবে। অতএব খাও-দাও ফুর্তি করো। শক্তি ও সাধ্যমত অন্যের উপর যুলুম করো। নিজের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য নিশ্চিত করো। তাদের এই বস্ত্তগত চিন্তাধারার বিপরীতে আল্লাহর রাসূল হযরত মু হাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) যখন তাদেরকে ক্বিয়ামত ও আখেরাতে জওয়াবদিহিতার ভয় প্রদর্শন করলেন, মুশরিক নেতাদের মধ্যে তখন বিতর্ক শুরু হয়ে গেল। কেউ বিশ্বাস করল, কেউ অবিশ্বাস করল। ‘আছ বিন ওয়ায়েল একটা জীর্ণ হাড় এনে রাসূলের সামনে গুঁড়া করে বলল, আল্লাহ কি এই হাড়টাকেও জীবিত করবেন? রাসূল (ছাঃ) বললেন, হ্যাঁ। তিনি তোমাকে মৃত্যু দান করবেন। অতঃপর পুনর্জীবিত করবেন এবং জাহান্নামে দাখিল করবেন।[1] মুশরিক নেতাদের যখন এই অবস্থা, তখন সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর পক্ষ হ’তে সৃষ্টিসেরা মানবজাতির উদ্দেশ্যে সরাসরি আসমানী বার্তা চলে এল।-
(১) عَمَّ يَتَسَاءَلُوْنَ ‘তারা পরস্পরে কি বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে’? এখানে عَمَّ প্রশ্নবোধক অব্যয়। যা আসলে ছিল عَنْ مَا। অর্থ, ‘কি বিষয়ে’? নূন ও মীম সংযুক্ত করে এবং মীম-এর আলিফ ফেলে দিয়ে عَمَّ করা হয়েছে সহজে উচ্চারণ করার জন্য। যেমন প্রশ্নবোধক অন্যান্য অব্যয় فِيْمَ ও مِمَّ প্রভৃতিতে করা হয়েছে। এখানে عَمَّ অর্থ فِيْمَ হ’তে পারে। দু’টির অর্থ একই।
يَتَسَاءَلُوْنَ ক্রিয়ার শব্দমূল হ’ল سَوَالٌ অর্থ ‘প্রশ্ন’ বা জিজ্ঞাসা। সেখান থেকে تَسَاءُلٌ মাছদারের অর্থ ‘পরস্পরে জিজ্ঞাসাবাদ করা’। আয়াতে বর্ণিত ক্রিয়াপদের কর্তা হ’ল ‘কুরায়েশ নেতাগণ’। অত্র আয়াতে আল্লাহ অবিশ্বাসী নেতাদের পারস্পরিক বিতর্ক সুন্দর বাণীচিত্রের মাধ্যমে আমাদের নিকট তুলে ধরেছেন এটা বুঝানোর জন্য যে, সকল যুগের সকল অবিশ্বাসীর চিন্তাধারা একই রূপ।
(২) عَنِ النَّبَاِ الْعَظِيْمِ ‘মহা সংবাদ সম্পর্কে’।
দুনিয়াতে মানুষের জন্য সবচেয়ে বড় সুসংবাদ হ’ল জন্মগ্রহণ করা ও বেঁচে থাকা। পক্ষান্তরে সবচেয়ে বড় দুঃসংবাদ হ’ল মৃত্যুবরণ করা ও বিলীন হওয়া। এ দুনিয়াতে কেউ মরতে চায় না। বিলীন হ’তে চায় না। অথচ দেখা যাচ্ছে যে, যে মানুষের জন্য লক্ষ-কোটি বছর ধরে আসমান-যমীন ও এর মধ্যকার সবকিছুর সৃষ্টি, সেই মানুষের গড় আয়ু একশ’ বছরেরও কম। সেরা সৃষ্টি মানুষ কি এতই অন্তঃসারশূন্য যে, পৃথিবীতে সে মাত্র কিছুদিনের জন্য আবির্ভূত হয়েই নিঃশেষে হারিয়ে যাবে? অথচ এখানে তার কামনা-বাসনার সবকিছু সে পায় না। বরং বলা চলে যে, অনেক কিছুই সে পায় না। তাই এ অস্থায়ী ও অসম্পূর্ণ জগৎ থেকে তাকে চিরস্থায়ী ও পরিপূর্ণ আরেকটি জগতে হিজরত করতে হয়, যেখানে সে তার চাহিদামত সবকিছুই পাবে পরিপূর্ণভাবে। অতএব ইহজাগতিক মৃত্যুর পরেই তার জন্য সবচেয়ে বড় সুসংবাদ হ’ল পরজগতের জন্য পুনরুত্থান ও পুনর্জন্মলাভ করা। অত্র আয়াতে আল্লাহ মানুষকে সেই সুসংবাদটিই শুনিয়েছেন। আর তা হ’ল মৃত্যুর পরে পুনরুত্থান যা ক্বিয়ামতের দিন ঘটবে। কিছু মানুষ পুনর্জন্মবাদে বিশ্বাস করে। কিন্তু তা এই দুনিয়াতেই। যার কোন ভিত্তি নেই বা যৌক্তিকতা নেই। মৃত্যুর পরে পুনরুত্থান দিবসের এই ঘটনাকেই আল্লাহ النَّبَاِ العْظِيْمِ বা ‘মহাসংবাদ’ বলে অভিহিত করেছেন। যেমন অন্যত্র আল্লাহ বলেন,يَا أَيُّهَا النَّاسُ اتَّقُوْا رَبَّكُمْ إِنَّ زَلْزَلَةَ السَّاعَةِ شَيْءٌ عَظِيْمٌ. ‘হে লোক সকল! তোমাদের পালনকর্তাকে ভয় কর। নিশ্চয়ই ক্বিয়ামতের প্রকম্পন একটি ভয়ংকর বিষয়’ (হজ্জ ২২/১)।
(৩) الَّذِىْ هُمْ فِيْهِ مُخْتَلِفُوْنَ ‘যে বিষয়ে তারা মতভেদ করে’।
মতভেদ কেন হ’ল? কারণ সসীম জ্ঞানের মানুষ কেবল নগদটাই দেখে, বাকীটা বোঝে না। সে যা দেখে না তা বুঝতে চায় না। অথচ তার দেখার বাইরে লুকিয়ে আছে অকাট্য সত্যের অসীম জগৎ। আমরা নিয়মিত দেখি যালেম তার শক্তি ও বুদ্ধির জোরে অসহায় ও দুর্বলের উপর যুলুম করে যাচ্ছে। এরপরেও সে দুনিয়াতে খ্যাতি ও প্রশংসা কুড়াচ্ছে। অন্যদিকে সৎ ও নিরপরাধ হওয়া সত্ত্বেও মযলূম মার খাচ্ছে ও বদনাম কুড়াচ্ছে। এভাবে যালেম ও মযলূম উভয়ে এক সময়ে দুনিয়া থেকে বিদায় হয়ে যাচ্ছে। বাস্তব জীবনের এ অবস্থা নিশ্চিতভাবে দাবী করে যে, জীবনের পরিপূর্ণতার জন্য এমন একটি জগৎ অপরিহার্য, যেখানে যালেম যথার্থ শাস্তি পাবে এবং মযলূম তার যথার্থ পুরস্কার পাবে। যেখানে প্রত্যেকেই যথাযথ ‘স্থান’ ও ‘মর্যাদা’ পাবে। আর সে জগতটাই হ’ল পরজগৎ। মৃত্যুর পরেই যার শুরু এবং ক্বিয়ামতের দিন হবে যার পূর্ণতা। যদি এটা না থাকে, তাহ’লে Survival of the fittest ‘যোগ্যতমের বেঁচে থাকার’ মতবাদ অনুযায়ী সবল ও দুর্বলের পরস্পরের হানাহানিতে মানবসমাজ হবে অগ্নিগর্ভ। এক সময় দেখা যাবে যে, যালেমদের সর্বাধুনিক বোমার হামলায় সমগ্র পৃথিবীতে ধ্বংসলীলা ঘটে গেছে। প্রাচীন যুগের ন্যায় আধুনিক যুগের নাস্তিক ও বস্ত্তবাদীরাও কেবল বর্তমান নিয়ে ভাবেন, ভবিষ্যৎ নিয়ে তাদের কোন মাথাব্যথা নেই। তাই তারা দ্বিধাহীনচিত্তে বলেন, ‘নগদ যা পাও হাত পেতে নাও বাকীর খাতা শূন্য থাক’। এদের কারণেই পৃথিবী হয়ে উঠেছে অশান্তিময়। বস্ত্ততঃ আখেরাতে জওয়াবদিহিতা ও শাস্তির ভয় মানুষকে ইহকালে নিয়ন্ত্রিত জীবনে উদ্বুদ্ধ করে। যার অবর্তমানে সে হয় শয়তানের প্রতিমূর্তি। তাই ইবলীসের শিখন্ডী এই সব জ্ঞানপাপীদেরকে আল্লাহ পরবর্তী দু’আয়াতে প্রচন্ড ধমক দিয়েছেন।
২য় বিষয়বস্ত্ত : মূর্খদের ধমক প্রদান (৪-৫ আয়াত)।
(৪-৫) ثُمَّ كَلاَّ سَيَعْلَمُوْنَ كَلاَّ سَيَعْلَمُوْنَ- ‘কখনোই না। শীঘ্র তারা জানতে পারবে’। ‘অতঃপর কখনোই না। শীঘ্রই তারা জানতে পারবে’।
অর্থাৎ পুনরুত্থান সম্পর্কে তারা যে অবিশ্বাস পোষণ করছে এবং ক্বিয়ামতকে অস্বীকার করছে, তা কখনোই সত্য নয়। বরং তাদের এ দাবী অসার মাত্র। যে ক্বিয়ামত সম্পর্কে তারা মতভেদ করছে, নিশ্চিতভাবে তা আসবেই। তাকে প্রতিরোধ করার ক্ষমতা কারু নেই। সত্বর তারা জানতে পারবে। সত্বর তারা তাদের মিথ্যাচারের পরিণতি ভোগ করবে।
এখানে কখনোই না, অতঃপর কখনোই না, পরপর দু’বার বলার অর্থ হ’ল ধমকের পর ধমক দেওয়া। সাধারণ মূর্খরা সহজে কথা শোনে। কিন্তু জ্ঞানী মূর্খরা সহজে হার মানতে চায় না। তাই তাদের জন্য এই ব্যবস্থা।
৩য় বিষয়বস্ত্ত : জ্ঞানীদের জন্য ক্বিয়ামতের প্রমাণ উপস্থাপন (৬-১৬)।
(৬-১৬) أَلَمْ نَجْعَلِ الْأَرْضَ مِهَادًا ..... وَجَنَّاتٍ أَلْفَافًا
অত্র ১১টি আয়াতে বর্ণিত বিষয়গুলিকে আল্লাহপাক ক্বিয়ামতের প্রমাণস্বরূপ বর্ণনা করেছেন। কেননা এইসব বিশাল ও বিস্ময়কর সৃষ্টি যিনি প্রথমবার অস্তিত্বে এনেছেন কেবল একটা হুকুম ‘কুন ফাইয়াকূন’ (হও, অতএব হয়ে গেল)-এর মাধ্যমে, তাঁর পক্ষে মানুষের মত একটা ক্ষুদ্র জীবকে পুনরায় সৃষ্টি করা ও পুনরুত্থান ঘটানো কোন ব্যাপারই নয় (ইয়াসীন ৩৬/৮২-৮৩, রূম ৩০/২৭)। যেমন আল্লাহ মানবজাতির প্রতি প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে বলেন, أَأَنْتُمْ أَشَدُّ خَلْقًا أَمِ السَّمَاءُ، بَنَاهَا ‘তোমাদের সৃষ্টি করা অধিকতর কঠিন, না আসমান সৃষ্টি করা? (অথচ) তিনি তাকে নির্মাণ করেছেন’ (নাযে‘আত ৭৯/২৭)। অতঃপর প্রথম প্রমাণস্বরূপ আল্লাহ বলেন,
(৬) أَلَمْ نَجْعَلِ الْأَرْضَ مِهَادًا ‘আমরা কি যমীনকে বিছানাস্বরূপ করিনি’?
অন্য আয়াতে فِرَاشاً (বিছানা) শব্দ এসেছে (বাক্বারাহ ২/২২)। এখানে ‘বিছানা’ বলতে এমন আশ্রয়স্থলকে বুঝানো হয়েছে, যা সৃষ্টিজগতের জন্য অনুকূল, মযবুত এবং নিরাপদ বিচরণ ক্ষেত্র। অন্যত্র পৃথিবীর বিশেষণ হিসাবে ذَلُوْلاً (অনুগত) বলা হয়েছে (মুল্ক ৬৭/১৫)। এজন্যেই তো ভূ-পৃষ্ঠে কর্ষণ ও চাষাবাদ এমনকি আধুনিক ফেরাঊনদের বারংবার বোমা বিস্ফোরণ ও ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা করা সত্ত্বেও পৃথিবী সামান্য নড়াচড়াও করে না। কেননা আল্লাহর হুকুমে তা রয়েছে বিছানার ন্যায় ধীরস্থির ও বান্দার জন্য নিরাপদ আশ্রয়স্থল। এজন্য আল্লাহপাক এর মধ্যে দান করেছেন মধ্যাকর্ষণ শক্তি। যার কারণে পৃথিবী সূর্য থেকে ঝুলে থাকে এবং তার পৃষ্ঠে বিচরণকারী সৃষ্টিকুলকে সর্বদা নিজের দিকে আকৃষ্ট করে ধরে রাখে। সেই সাথে রয়েছে বায়ুর চাপ। যে কারণে কিছু উপরে ছুঁড়ে মারলে তা আবার পৃথিবীর বুকে ফিরে আসে। ঠিক বিছানা বা দোলনা যেভাবে শিশুকে আকর্ষণ করে এবং সেখানেই সে আরাম বোধ করে ও ঘুমিয়ে যায়। পৃথিবীর এই আকর্ষণী ক্ষমতা যদি আল্লাহ না দিতেন, তাহ’লে ভূপৃষ্ঠে প্রাণীকুল যেকোন সময় পৃথিবী থেকে ছিটকে পড়ে মহাশূন্যে হারিয়ে যেত। অন্য আয়াতে এসেছে مَهْدًا (ত্বোয়াহা ২০/৫৩; যুখরুখ ৪৩/১০) যার অর্থ দোলনা, যা বাচ্চাদের জন্য নিরাপদ আশ্রয়স্থল। দোলনা ও বিছানা একই মর্ম বহন করে। আল্লাহ বলেন, وَالْأَرْضَ فَرَشْنَاهَا فَنِعْمَ الْمَاهِدُوْنَ ‘আমরা পৃথিবীকে বিছিয়ে দিয়েছি। অতএব আমরা কতই না সুন্দর বিস্তৃতকারী? (যারিয়াত ৫১/৪৮)। এভাবে পৃথিবীকে যিনি অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্বে এনেছেন, তিনি কি তোমাদের মৃত্যুর পর তোমাদের পুনরায় অস্তিত্বে আনতে পারেন না?
(৭) وَالْجِبَالَ أَوْتَادًا ‘এবং পাহাড় সমূহকে পেরেকস্বরূপ?’
এটি ক্বিয়ামতের দ্বিতীয় প্রমাণ। এখানে পাহাড়কে ‘পেরেক’ বলা হয়েছে এজন্য যে, পাহাড় ভূগর্ভ থেকে উঠে আসে এবং পৃথিবীকে শক্তভাবে চেপে রাখে। যাতে হেলতে না পারে। যেমনভাবে ঘরের চালে পেরেকসমূহ বাঁশ বা কাঠের কাঠামোকে পরস্পরে মযবুতভাবে বেঁধে রাখে, যাতে তা বিচ্ছিন্ন বা এলোমেলো না হয়ে যায়। পৃথিবীর বুকে পাহাড় মানবদেহে হাঁড়ের ন্যায়। যা ব্যতীত মানুষ দাঁড়াতে বা চলতে পারে না। অনুরূপভাবে পাহাড় পৃথিবীকে শক্তভাবে ধরে না রাখলে সে মহাশূন্যে উল্টে-পাল্টে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত। এতদ্ব্যতীত পাহাড় আমাদের জন্য তার বুকে পানি ও মাথায় বরফ সঞ্চয় করে রাখে। যা ঝর্ণা ও নদী আকারে প্রবাহিত হয়। পাহাড় পানিভরা মেঘকে আটকে দিয়ে তার পাদদেশের অঞ্চলগুলিতে বৃষ্টি বর্ষণে সাহায্য করে। পাহাড়ের দেহ ঘিরে থাকে অসংখ্য ভেষজ, ফলজ ও বনজ বৃক্ষরাজি, যা বান্দার মঙ্গলের জন্য আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন। এছাড়াও পাহাড় মানুষের নানাবিধ কল্যাণে নিয়োজিত রয়েছে। তবে তার সবচেয়ে বড় অবদান হ’ল এই যে, সে পেরেক স্বরূপ পৃথিবীকে মযবুতভাবে ধরে রাখে, যাতে পৃথিবী নড়াচড়া করতে না পারে। যেটা খুবই সম্ভব ছিল। কেননা ভূ-পৃষ্ঠের কোন অংশে মানব বসতি বেশী, কোন অংশে কম। কোন অংশে পানির ভাগ বেশী, কোন অংশে কম। ফলে ওযনের তারতম্য হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু ওযনের এই তারতম্যে পৃথিবীর ভারসাম্যে কোনরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা যায় না পাহাড়ের কারণে। যা আল্লাহ প্রয়োজন অনুযায়ী পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে স্থাপন করেছেন। অন্য আয়াতে رَوَاسِىَ শব্দ এসেছে (রা‘দ ১৩/৩, মুরসালাত ৭৭/২৭ প্রভৃতি), যার অর্থ পাহাড়, যা পৃথিবীর দৃঢ়তা রক্ষাকারী (ثوابت)।
(৮) وَخَلَقْناَكُمْ أزْوَاجاً ‘আর তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি জোড়ায়-জোড়ায়’।
এটি ক্বিয়ামতের তৃতীয় প্রমাণ। অর্থাৎ পুরুষ ও নারীরূপে। যাতে পরস্পরের মিলনে মানুষের বংশধারা অব্যাহত থাকে। এই জোড়া পরস্পরে বিপরীতধর্মী এবং পরস্পরের প্রতি তীব্র আকর্ষণশীল। জোড়া কেবল মানুষের মধ্যে নয়; বরং প্রাণী ও জড় জগতের সর্বত্র বিরাজমান। বিজ্ঞানের পরিভাষায় যাকে বলা হয় পজেটিভ বা প্রোটন এবং নেগেটিভ বা ইলেকট্র্ন। শুধু এগুলিতেই নয়; বরং আমাদের জানা-অজানা সকল ক্ষেত্রেই জোড়ার অস্তিত্ব রয়েছে, যা পরস্পরের বিপরীতধর্মী। যেমন রংয়ের মধ্যে সাদা ও কালো, গুণের মধ্যে ভাল ও মন্দ, উজ্জ্বলতার মধ্যে আলো ও অাঁধার, প্রশস্ততার মধ্যে চওড়া ও সরু ইত্যাদি। এবিষয়টি আল্লাহ অন্যত্র বলেছেন বিস্তৃতভাবে। যেমন তিনি বলেন, سُبْحَانَ الَّذِيْ خَلَقَ الْأَزْوَاجَ كُلَّهَا مِمَّا تُنْبِتُ الْأَرْضُ وَمِنْ أَنْفُسِهِمْ وَمِمَّا لاَ يَعْلَمُوْنَ ‘মহাপবিত্র তিনি, যিনি জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করেছেন সবকিছুকে, যমীন থেকে উৎপন্ন উদ্ভিদরাজিকে এবং মানুষকে ও তাদের অজানা সব বস্ত্তকে’ (ইয়াসীন ৩৬/৩৬)। আল্লাহ অন্যত্র বলেন, وَمِنْ كُلِّ شَيْءٍ خَلَقْنَا زَوْجَيْنِ لَعَلَّكُمْ تَذَكَّرُوْنَ ‘আমরা প্রত্যেক বস্ত্ত জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করেছি, যাতে তোমরা উপদেশ গ্রহণ করতে পার’ (যারিয়াত ৫১/৪৯)। অত্র বিষয়টি বিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎসমূল হিসাবে গণ্য।
ভাল-র পাশাপাশি মন্দ সৃষ্টির উদ্দেশ্য হ’ল যাতে গুণীরা গুণহীনদের দেখে সতর্ক হয় এবং নিজেদের উচ্চগুণ ও বড়ত্ব লাভের জন্য আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে। সাথে সাথে গুণহীনরা ধৈর্যধারণ করে এবং গুণবানদের সম্মান ও মর্যাদা প্রদান করে। এভাবে সকল ক্ষেত্রে বিপরীতধর্মী জোড়া সৃষ্টির মাধ্যমে এটা বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, জগত সংসার সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য উভয়টির মধ্যে সুষ্ঠু সমন্বয় ও ভারসাম্য রক্ষা করা আবশ্যক। তা না হ’লে পৃথিবী অচল হয়ে পড়বে। এর মধ্যে একথারও ইঙ্গিত রয়েছে, যিনি আদমকে সৃষ্টি করেছেন, যখন সে কিছুই ছিল না (দাহর ৭৬/১)। অতঃপর তার থেকে তার জোড়া সৃষ্টি করেছেন (নিসা ৪/১)। একইভাবে আদম সন্তানের মৃত্যুর পর মাটি হয়ে যাবার পর তাকে ক্বিয়ামতের দিন আবার সৃষ্টি করবেন। এছাড়া একথারও ইঙ্গিত রয়েছে যে, সৃষ্টিজগত সবই জোড়ায় জোড়ায়। বেজোড় কেবল একজন। তিনি সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ। তিনি বলেন, ‘কুল হুওয়াল্লাহু আহাদ’ (তুমি বল, তিনি আল্লাহ এক)।
(৯) وَجَعَلْنَا نَوْمَكُمْ سُبَاتًا ‘এবং তোমাদের জন্য নিদ্রাকে করেছি ক্লান্তি দূরকারী’। এটি ক্বিয়ামতের চতুর্থ প্রমাণ।
মানুষসহ সকল প্রাণীর জন্য নিদ্রা হ’ল আল্লাহর একটি বিশেষ অনুগ্রহ। নিন্দ্রা না থাকলে মানুষ কোন কাজেই উদ্যম ও আগ্রহ খুঁজে পেত না। অন্য আয়াতে নিদ্রাকে আল্লাহর অস্তিত্বের অন্যতম নিদর্শন (آية) হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে। যেমন আল্লাহ বলেন, وَمِنْ آيَاتِهِ مَنَامُكُمْ بِاللَّيْلِ وَالنَّهَارِ وَابْتِغَاؤُكُمْ مِنْ فَضْلِهِ إِنَّ فِي ذَلِكَ لَآيَاتٍ لِقَوْمٍ يَسْمَعُوْنَ ‘আর তাঁর নিদর্শনসমূহের মধ্যে অন্যতম হ’ল রাত্রি ও দিনে তোমাদের নিদ্রা এবং তোমাদের তাঁর কৃপা অন্বেষণ। নিশ্চয়ই এর মধ্যে শ্রবণকারী সম্প্রদায়ের জন্য নিদর্শনাবলী নিহিত রয়েছে’ (রূম ৩০/২৩)। নিদ্রার সবচেয়ে বড় সুফল হিসাবে বলা হয়েছে, سُبَاتًا বা ক্লান্তি দূরকারী। এই ক্লান্তি দৈহিক ও মানসিক উভয়টিই হ’তে পারে। ব্যথাতুর ব্যক্তি ঘুমিয়ে গেলে ব্যথা ভুলে যায়। শোকাতুর ব্যক্তি নিদ্রা গেলে শোক ভুলে যায়। ঘুম থেকে উঠলে তার দেহ-মন তরতাযা হয়ে ওঠে। আধুনিক বিজ্ঞান বলছে, কমপক্ষে ছয় মিনিট গভীর ঘুম হ’লে ক্লান্তি দূর হয়ে নবজীবন লাভ হয়। ঘুম তাই আল্লাহ প্রদত্ত এক অমূল্য মহৌষধ। যা দেহ ও মনে স্বস্তি ও শান্তি দানকারী (রূম ৩০/২৩)।
سُبَاتًا অর্থ শান্তি (راحة)। আর সেখান থেকেই এসেছে يوم السبت শান্তি বা ছুটির দিন। যাকে বাংলায় আমরা ‘শনিবার’ বলে থাকি। এইদিন আল্লাহ কিছু সৃষ্টি করেননি। তাই ইহুদীদের জন্য এটা সাপ্তাহিক ইবাদতের দিন হিসাবে ছুটির দিন (weekly holiday)। ঘুম আসাটাও যেমন আল্লাহর বিশেষ রহমত, ঘুম থেকে জেগে ওঠাও তেমনি আল্লাহর বিশেষ রহমত। ঘুমকে হাদীছে ‘মৃত্যু’ বলা হয়েছে। সেজন্য ঘুমাতে যাওয়ার সময় দো‘আ পড়তে হয় ‘বিসমিকা আল্লাহুম্মা আমূতু ওয়া আহ্ইয়া’ ‘তোমার নামেই হে আল্লাহ আমি মরি ও বাঁচি’। অনুরূপভাবে ঘুম থেকে উঠেই বলতে হয় ‘আলহামদু লিল্লা-হিল্লাযী আহ্ইয়া-না বা‘দামা আমা-তানা ওয়া ইলাইহিন নুশূর’ ‘যাবতীয় প্রশংসা সেই আল্লাহর জন্য যিনি আমাদেরকে মৃত্যু দান করার পর জীবন দান করেন এবং তাঁর নিকটেই হবে পুনরুত্থান’।[2]
বস্ত্ততঃ ঘুমিয়ে যাওয়া ও ঘুম থেকে ওঠার মধ্যে রয়েছে মৃত্যু ও পুনরুত্থানের বাস্তব উদাহরণ। এর মধ্যেই নিহিত রয়েছে ক্বিয়ামতের সত্যতার অকাট্য প্রমাণ। এই দো‘আ পাঠের মাধ্যমে মানুষকে সর্বদা মৃত্যুর কথা এবং তার প্রভুর নিকটে ফিরে যাবার কথা স্মরণ করানো হয়। যা তাকে দুনিয়াপূজা থেকে ও শয়তানের তাবেদারী করা হ’তে বিরত থাকতে উদ্বুদ্ধ করে। ঘুম ও তা থেকে জেগে ওঠা কোনটারই এখতিয়ার মানুষের হাতে নেই। এই নিদ্রা তার জন্য চিরনিদ্রা হ’তে পারত। যেমন আল্লাহর হুকুমে আছহাবে কাহফের যুবকেরা তাদের কুকুরসহ এক পাহাড়ী গুহায় ৩০৯ বছর ঘুমিয়ে ছিল’ (কাহফ ১৮/২৫)। পরে আল্লাহর হুকুমে জেগে উঠে তারা পরস্পরে জিজ্ঞাসাবাদে বলল, আমরা একদিন বা তার কিছু অংশ ঘুমিয়েছিলাম (কাহফ ১৮/১৯)। ফলে দেখা যাচ্ছে যে, নিদ্রা যাওয়া ও নিদ্রা থেকে জেগে ওঠার মাধ্যমে দৈনিক আমাদের মৃত্যু ও ক্বিয়ামত হচ্ছে। অতএব ঘুম থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে মৃত্যু ও পুনরুত্থান সম্পর্কে এবং মানুষের অসহায়ত্ব ও আল্লাহর একচ্ছত্র ক্ষমতা সম্পর্কে। বহুপূর্বে লন্ডন ইউনিভার্সিটির এনাটমীর প্রফেসর Devid Fresher মানবদেহের অত্যাশ্চর্য শৈলী দেখে অবাক বিস্ময়ে বলে ওঠেছিলেন, Our minds are overwhelmed by immensity and majesty of nature. ‘প্রকৃতির বিশালতা ও রাজকীয় ক্রিয়াকর্ম আমাদের হৃদয়কে অভিভূত করে’।
(১০) وَجَعَلْناَ اللَّيْلَ لِبَاسًا ‘আমরা রাত্রিকে করেছি আবরণ’।
‘লেবাস’ অর্থ পোষাক যা লজ্জা নিবারণ করে। এখানে রাত্রিকে পোষাক বলা হয়েছে এজন্য যে, রাত্রি তার অন্ধকার দ্বারা দিবসের আলোর সামনে পর্দা টাঙিয়ে দেয়, যাতে মানুষসহ জীবজগত নিরিবিলি পরিবেশে সুস্থিরভাবে নিদ্রা যেতে পারে। আবার শেষরাতে উঠে শান্ত-সমাহিত চিত্তে আল্লাহর ইবাদতে রত হ’তে পারে। এছাড়া আল্লাহর এই সৃষ্টিজগতের নিগূঢ় তত্ত্ব উপলব্ধি করার জন্য চিন্তাশীল, গবেষক ও বিজ্ঞানীদের জন্য রাতের নিরিবিলি সময়ের চাইতে উত্তম পরিবেশ আর কখন আছে? Tennyson কি রাতের নক্ষত্রখচিত আকাশের দিকে হৃদয় দিয়ে তাকিয়ে স্রষ্টার অস্তিত্বে বিশ্বাসী হয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে বলে ওঠেননি? What a marvellous imagination God Almighty has? ‘সর্বশক্তিমান আল্লাহ কি বৈচিত্র্যময় পরিকল্পনারই না অধিকারী’? আল্লাহ বলেন, وَهُوَ الَّذِي جَعَلَ لَكُمُ اللَّيْلَ لِبَاسًا وَالنَّوْمَ سُبَاتًا وَجَعَلَ النَّهَارَ نُشُوْرًا ‘তিনিই সেই সত্তা, যিনি তোমাদের জন্য রাত্রিকে করেছেন আবরণ, নিদ্রাকে করেছেন ক্লান্তি দূরকারী এবং দিবসকে করেছেন উত্থান সময়’ (ফুরক্বান ২৫/৪৭)।
(১১) وَجَعَلْنَا النَّهَارَ مَعَاشًا ‘এবং দিবসকে করেছি জীবিকা অন্বেষণকাল’।
এখানে مَعَاشًا অর্থ وقت معاش ‘জীবিকা অন্বেষণকাল’। রাতের নিদ্রাশেষে দিনের আলোয় মানুষ ও পশুপক্ষী স্ব স্ব রূযীর তালাশে বেরিয়ে যাবে। এটাই হ’ল আল্লাহ প্রদত্ত ব্যবস্থাপনা। ভূপৃষ্ঠে, ভূগর্ভে, পানিরাশিতে ও সৌরলোকের সর্বত্র আল্লাহ তাঁর অনুগ্রহরাজি ছড়িয়ে রেখেছেন। একমাত্র জ্ঞানবান সৃষ্টি মানুষকে এসব তালাশ করে এনে তা ভোগ করার জন্য এবং বেশী বেশী আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ ও তাঁর শুকরিয়া আদায়ের জন্য তিনি জোরালো ভাষায় তাকীদ দিয়েছেন (জুম‘আ ৬২/১০, বাক্বারাহ ২/১৭২)। আল্লাহ আসমান-যমীন ও এতদুভয়ের মধ্যস্থিত প্রকাশ্য ও গোপন নে‘মত সম্ভারকে মানুষের অনুগত করে দিয়েছেন (লোকমান ৩১/২০)। মানুষকে অবশ্যই সেসব নে‘মত সন্ধানের জন্য নিরন্তর প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে।
দিবসের সবচেয়ে বড় নে‘মত হ’ল সূর্য। সূর্যের কিরণ যদি পৃথিবীতে না আসত, তাহ’লে মানুষ, পশু, উদ্ভিদজগৎ কারু মধ্যে শক্তি-সামর্থ্য সৃষ্টি হ’ত না। সূর্য জীবদেহে শক্তির যোগান দেয়। তাই আমরা শক্তিশালী হই, উদ্ভিদজগৎ শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। আমাদের খাদ্য চাউল ও গম ইত্যাদি স্ব স্ব গাছের শিষে শুকিয়ে শক্ত হয়। অতঃপর তা আমাদের জন্য খাবার উপযুক্ত হয়। যদি দিবসের সূর্য না থাকত, তাহ’লে আমরা কখনোই উঠে দাঁড়াবার শক্তি পেতাম না। সূর্য হ’ল জ্বালানীর উৎস। যদি মানুষ সেখান থেকে জ্বালানী গ্রহণের যোগ্যতা অর্জন করতে পারে, তাহ’লে পৃথিবীতে জ্বালানীর কোন অভাব থাকবে না ইনশাআল্লাহ।
উল্লেখ্য যে, শিল্পোন্নত দেশসমূহের শিল্প কারখানাসমূহ হ’তে মাত্রাতিরিক্ত হারে কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমনের ফলে বায়ুমন্ডলে যে উষ্ণায়নের সৃষ্টি হয়েছে, যার জন্য সূর্যের তাপ আটকে থাকছে ভূপৃষ্ঠে। আর এর প্রতিক্রিয়ায়- যাকে ‘গ্রীন হাউস ইফেক্ট’ (Green house effect) বলা হচ্ছে, বায়ুমন্ডলের ওযোন (Ozone) স্তর ছিদ্র হয়ে গেছে এবং পৃথিবীতে ঘন ঘন ঝড়-প্লাবন, সিডর-সাইক্লোন ইত্যাদি হচ্ছে। তাছাড়া এই উষ্ণায়নের ফলে উত্তর মেরু থেকে শুরু করে বরফাচ্ছাদিত মহাদেশ এন্টার্কটিকার বরফ গলে যাচ্ছে। দ্রুত গলে যাচ্ছে চিলির আন্দিজ পর্বতমালার বিশাল বরফ স্তূপ ও হিমালয়ের হিমবাহ সমূহ। সেই সাথে বেড়ে যাচ্ছে সমুদ্রে পানির উচ্চতা। ফলে বাংলাদেশসহ সমুদ্রোপকূলের বহু দেশের নিম্নাঞ্চল হয়ত অদূর ভবিষ্যতে তলিয়ে যাবে এবং আশ্রয়হারা হবে লাখ লাখ বনু আদম। ভোগবাদী ও পুঁজিবাদী দেশগুলোর নেতৃবৃন্দ বিশ্বব্যাপী এই ধ্বংসলীলা ও ব্যাপক গণহত্যার জন্য দায়ী। তাই সোলার সেল-এর ব্যবহার সর্বত্র শুরু হ’লে এবং পেট্রোল-ডিজেল ও কয়লা পোড়ানো বন্ধ হ’লে পৃথিবী গ্রীন হাউস ইফেক্ট থেকে মুক্ত হবে। সেই সাথে মানবজাতি বেঁচে যাবে তাদের নিজ হাতে সৃষ্ট আসন্ন ধ্বংসযজ্ঞের হাত থেকে। রাত্রি ও দিবসের উপরোক্ত বর্ণনার মধ্যে মানুষের জন্য যেমন কর্মকালের সময় ভাগ করে দেওয়া হয়েছে, তেমনি আল্লাহ তাঁর ইবাদতের জন্যও সময় ভাগ করে দিয়েছেন।
(১২) وَبَنَيْنَا فَوْقَكُمْ سَبْعاً شِدَاداً ‘আমরা তোমাদের মাথার উপর নির্মাণ করেছি কঠিন সপ্ত আকাশ’।
سبْعًا شِدَادًا অর্থ سبع سموات محكمات ‘সুদৃঢ় সপ্ত আকাশ’। পৃথিবী সৃষ্টির পর আল্লাহ সাত আসমান সৃষ্টি করেন। যেমন তিনি বলেন, هُوَ الَّذِي خَلَقَ لَكُمْ مَا فِي الْأَرْضِ جَمِيْعًا ثُمَّ اسْتَوَى إِلَى السَّمَاءِ فَسَوَّاهُنَّ سَبْعَ سَمَاوَاتٍ وَهُوَ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمٌ ‘তিনিই সেই সত্তা, যিনি তোমাদের জন্য সৃষ্টি করেছেন ভূমন্ডলের সবকিছু। অতঃপর মনোসংযোগ করেছেন নভোমন্ডলের দিকে। অতঃপর তাকে বিন্যস্ত করেছেন সপ্ত আকাশে। বস্ত্ততঃ তিনি সকল বিষয়ে সুবিজ্ঞ’ (বাক্বারাহ ২/২৯)। আল্লাহ বলেন, ثُمَّ اسْتَوَى إِلَى السَّمَاءِ وَهِيَ دُخَانٌ فَقَالَ لَهَا وَلِلْأَرْضِ ائْتِيَا طَوْعًا أَوْ كَرْهًا قَالَتَا أَتَيْنَا طَائِعِيْنَ- فَقَضَاهُنَّ سَبْعَ سَمَاوَاتٍ فِي يَوْمَيْنِ وَأَوْحَى فِي كُلِّ سَمَاءٍ أَمْرَهَا وَزَيَّنَّا السَّمَاءَ الدُّنْيَا بِمَصَابِيْحَ وَحِفْظًا ذَلِكَ تَقْدِيرُ الْعَزِيْزِ الْعَلِيْمِ ‘অতঃপর তিনি আকাশের দিকে মনোনিবেশ করেন। যা ছিল ধূম্র বিশেষ। অতঃপর তিনি ওটাকে ও পৃথিবীকে বললেন, তোমরা উভয়ে এসো ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায়। তারা বলল, আমরা এলাম অনুগত হ’য়ে’। ‘অতঃপর তিনি তাকে দুই দিনে সপ্তাকাশে পরিণত করলেন এবং প্রত্যেক আকাশে তার বিধান প্রত্যাদেশ করলেন। আর আমরা দুনিয়ার আকাশকে সুশোভিত করলাম প্রদীপমালা দিয়ে এবং তাকে করলাম সুরক্ষিত। এটি পরাক্রমশালী সর্বজ্ঞ আল্লাহর ব্যবস্থাপনা’ (হা-মীম সাজদাহ ৪১/১১-১২)।
উল্লেখ্য যে, আল্লাহ পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন রবি ও সোম দু’দিনে। সেখানে খাদ্য-শস্য সৃষ্টি করেছেন মঙ্গল ও বুধ দু’দিনে। আকাশ সৃষ্টি করেছেন বৃহস্পতি ও শুক্র দু’দিনে। অতঃপর শুক্রবারের শেষ দিকে আদমকে সৃষ্টি করেন। আর এদিনেই ক্বিয়ামত হবে’ (কুরতুবী, তাফসীর উক্ত আয়াত)। ভূপৃষ্ঠ থেকে উপরে পাঁচটি স্তরে প্রায় সাড়ে এগারো শত কিঃ মিঃ ব্যাপী বায়ুমন্ডল রয়েছে যা পৃথিবীর জন্য নিরাপত্তা প্রাচীর হিসাবে বিরাজ করছে। যার মধ্যে একটি স্তর হ’ল ওযোন (Ozone) স্তর। প্রায় ৩০ কিঃ মিঃ ব্যাপী ওযোন গ্যাসের এই স্তরকে বলা হয় পৃথিবীর জন্য ‘প্রোটেকশন শিল্ড’ (Protection shield) বা রক্ষাব্যুহ। যা সূর্যের ক্ষতিকর অতিবেগুনী রশ্মি থেকে পৃথিবীকে রক্ষা করে এবং পৃথিবীতে জীবজগতের বাসোপযোগী আবহাওয়াগত উষ্ণ পরিবেশ গড়ে তোলার পিছনে অসাধারণ ভূমিকা পালন করে। এতদ্ব্যতীত মহাকাশ থেকে অবিরতভাবে অগ্নিময় যে বিরাট বিরাট উল্কাপিন্ড সেকেন্ডে ৬ হ’তে ৪০ মাইল বেগে প্রতিদিন গড়ে দুই কোটির উপরে শূন্যলোকে নিক্ষিপ্ত হয়, তা পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে এসে নিঃশেষ হয়ে যায়। ফলে পৃথিবী সাক্ষাৎ ধ্বংস থেকে রক্ষা পায়। বায়ুমন্ডল তাই আমাদের জন্য আল্লাহর এক অপার অনুগ্রহ। বায়ুমন্ডল ছাড়িয়ে উপরে গেলে শুরু হয় বায়ুশূন্য ইথার জগত। যেখানে রয়েছে নীহারিকাপুঞ্জ ও অসংখ্য গ্রহ ও নক্ষত্ররাজি। সেসব নক্ষত্র এত বড় যে, আমাদের বিশাল সূর্য ঐসবের কাছে বিন্দুতুল্য। প্রাপ্ত হিসাব মতে সবচাইতে দূরবর্তী নক্ষত্রটি পৃথিবী থেকে ১৩০০ কোটি (১৩ বিলিয়ন) আলোকবর্ষ দূরে অবস্থান করছে। আলোর গতি প্রতি সেকেন্ডে ১ লক্ষ ৮৬ হাযার মাইল বা তিন লক্ষ কিলোমিটার। সে হিসাবে এক বছরকে এক আলোকবর্ষ বলা হয়। এক্ষণে তা ১৩০০ কোটি আলোকবর্ষ হ’লে কত দূরে হয়, তা চিন্তার বিষয়। এরপরেও আইনস্টাইনের ধারণা মতে মহাবিশ্বের আয়তন (محيط الكون) প্রায় দু’হাযার মিলিয়ন আলোকবর্ষের মতো (তানতাভী)। সুবহা-নাল্লা-হি ওয়া বেহামদিহী...।
পৃথিবী থেকে বহু আলোকবর্ষ দূরে থাকায় আমরা এগুলির মিটিমিটি আলো দেখতে পাই। বহু নক্ষত্রের আলো আজও আমাদের দৃষ্টিপথে আসেনি। নভোমন্ডলের বিভিন্ন রহস্য মানব জাতির কাছে এখনো অজানা রয়েছে। তাই সাত আসমানের স্তর পরিচিতি এখনো বিজ্ঞানীদের কাছে অজ্ঞাত। মনুষ্যকুলের মধ্যে একমাত্র শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) এই সব স্তর ভেদ করে অগ্নিস্ফুলিঙ্গসমূহ এড়িয়ে মি‘রাজে গিয়েছিলেন আল্লাহর হুকুমে। আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ ও নির্দেশ ব্যতীত আসমান ও যমীনের সীমানা পেরিয়ে যাওয়া মানুষের সাধ্যের অতীত। আল্লাহ বলেন, يَا مَعْشَرَ الْجِنِّ وَالْإِنْسِ إِنِ اسْتَطَعْتُمْ أَنْ تَنْفُذُوْا مِنْ أَقْطَارِ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ فَانْفُذُوْا لاَ تَنْفُذُوْنَ إِلاَّ بِسُلْطَانٍ ‘হে জিন ও মনুষ্যজাতি! যদি তোমাদের ক্ষমতা থাকে আসমান ও যমীনের সীমানা পার হবার, তাহ’লে বের হয়ে যাও। কিন্তু তোমরা তা পারবে না আল্লাহর হুকুম ব্যতীত’ (রহমান ৫৫/৩৩)।
আলোচ্য আয়াতে সপ্ত আকাশকে شِدَادٌ বা ‘কঠিন’ বলার মধ্যে বিজ্ঞানীদের জন্য ইঙ্গিত রয়েছে যে, এসব আসমানের গঠন প্রকৃতি এমন, যা ভেদ করা কঠিন ও দুরূহ। অন্য আয়াতে আসমানকে سَقْفًا مَحْفُوْظاً বা ‘সুরক্ষিত ছাদ’ বলা হয়েছে (আম্বিয়া ২১/৩২)। বায়ুমন্ডল আমাদের জন্য সেই সুরক্ষিত ছাদ হিসাবে কাজ করছে। এতদ্ব্যতীত নক্ষত্ররাজি রাতের অন্ধকারে আলো দিয়ে ও দিক নির্দেশনা দিয়ে এবং বহু অজানা সেবা দিয়ে প্রতিনিয়ত জীবজগতকে লালন করে যাচ্ছে। যা আল্লাহর ‘রব’ বা পালনকর্তা হওয়ার বড় প্রমাণ।
(১৩) وَجَعَلْنَا سِرَاجاً وَّهَّاجًا ‘এবং তন্মধ্যে স্থাপন করেছি কিরণময় প্রদীপ’।
এখানে ‘প্রদীপ’ অর্থ সূর্য। وَهَّاجًا অর্থ وَقَّادًا ‘জ্বলন্ত’। মাত্র একটি শব্দে সূর্যের এই পরিচয় দানের মধ্যে বিজ্ঞানীদের জন্য রয়েছে অফুরন্ত চিন্তার খোরাক। পৃথিবী থেকে অন্যূন ৩ লক্ষ ৩০ হাযার গুণ ভারী সূর্য নিঃসন্দেহে একটি বিশাল জ্বলন্ত গ্যাসপিন্ড। যার উপরিভাগের তাপমাত্রা প্রায় ৫৬০০ ডিগ্রী সেলসিয়াস। যার ২০০ কোটি ভাগের একভাগ পৃথিবীর উপর পড়ে। তাতেই আমরা সূর্য কিরণে জ্বালা অনুভব করি। আসমানের বুকে সূর্যকে আল্লাহ বিশেষভাবে সৃষ্টি করেছেন সৃষ্টিসেরা মানুষের সেবাদানের জন্য। মানুষের আশ্রয়স্থল পৃথিবীকে সূর্য থেকে এমন দূরে ও এমন কোণে স্থাপন করা হয়েছে, যেখান থেকে সূর্য সামান্য এগিয়ে এলে পৃথিবী জ্বলেপুড়ে নিঃশেষ হয়ে যাবে। আবার সামান্য পিছিয়ে গেলে তা ঠান্ডা ও বরফাবৃত হয়ে যাবে।
উল্লেখ্য যে, সূর্য থেকে পৃথিবী ৯ কোটি ৩০ লক্ষ মাইল দূরে ২৩.৫ ডিগ্রি কোণে অবস্থিত। তাছাড়া পৃথিবীর কক্ষপথ এবং আহ্নিকগতি ও বার্ষিকগতি এমনভাবে নির্ধারণ করা হয়েছে, যেখান থেকে সামান্যতম নড়চড় হবার অবকাশ দেওয়া হয়নি। আল্লাহ বলেন, وَاللهُ يُقَدِّرُ اللَّيْلَ وَالنَّهَارَ ‘আল্লাহই রাত্রি ও দিবসের হিসাব নির্ধারণ করেন’ (মুযযাম্মিল ৭৩/২০)। সূর্যের আকর্ষণে পৃথিবী নির্ধারিত দূরত্বে এমনভাবে ঝুলে রয়েছে, যেমন দাড়িপাল্লা রশিতে ঝুলে থাকে। ঝুল কমবেশী হ’লে যেমন পাল্লার ওযনে কমবেশী হয়ে যায়, পৃথিবীর অবস্থিতি তেমনি বিনষ্ট হয়ে যাবে। ক্বিয়ামতের দিন সূর্য ও পৃথিবীর মধ্যকার চৌম্বিক আকর্ষণ আল্লাহর হুকুমে ছিন্ন হবে অথবা তারতম্য ঘটবে ইস্রাফীলের ফুৎকারের মাধ্যমে। আর সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীর ও আকাশরাজির বর্তমান অবস্থা পরিবর্তিত হয়ে আল্লাহর হুকুমে নতুন পৃথিবীর রূপ ধারণ করবে (ইবরাহীম ১৪/৪৮)।
সূর্যের অবদানেই পৃথিবীতে জীবনের উন্মেষ, অবস্থিতি ও তৎপরতা সম্ভবপর হচ্ছে। সূর্যের এই অতুলনীয় খেদমতের জন্য কিছু মানুষ সূর্যকে দেবতা বলে পূজা করে। অথচ তারা সূর্যের সৃষ্টিকর্তা ও পালনকর্তা আল্লাহকে ভুলে যায়। তাই আল্লাহ বলেন, وَمِنْ آيَاتِهِ اللَّيْلُ وَالنَّهَارُ وَالشَّمْسُ وَالْقَمَرُ لاَ تَسْجُدُوْا لِلشَّمْسِ وَلاَ لِلْقَمَرِ وَاسْجُدُوْا لِلَّهِ الَّذِيْ خَلَقَهُنَّ إِنْ كُنْتُمْ إِيَّاهُ تَعْبُدُوْنَ- ‘তাঁর নিদর্শন সমূহের মধ্যে অন্যতম হ’ল রাত্রি, দিন, সূর্য ও চন্দ্র। তোমরা সূর্য বা চন্দ্রকে সিজদা করো না। বরং তোমরা আল্লাহকে সিজদা করো, যিনি এগুলিকে সৃষ্টি করেছেন, যদি নাকি তোমরা কেবল তাঁরই ইবাদত করে থাক’ (হা-মীম সাজদাহ ৪১/৩৭)।
সূর্যের আলো এবং চনেদ্রর আলোর মধ্যকার পার্থক্য অন্য আয়াতে বর্ণিত হয়েছে যথাক্রমে ضِيَاءٌ ও نُوْرٌ বলে (ইউনুস ১০/৫)। যার অর্থ কিরণ ও জ্যোতি। এর মধ্যেই বিজ্ঞানের একটি বড় উৎস লুকিয়ে আছে যে, চন্দ্রের নিজস্ব কোন আলো নেই। সে সূর্যের আলোয় আলোকিত। দু’টির প্রতিক্রিয়াও ভিন্ন। সূর্যের কিরণে দেহে জবালা ধরায় ও শক্তি বাড়ায়। চন্দ্রের জ্যোতিতে জ্বালা নেই, আছে পেলব পরশ। ফলে দু’টির ফলাফল ও কল্যাণকারিতাও ভিন্ন। বস্ত্ততঃ ‘আসমান ও যমীন দাঁড়িয়ে আছে আল্লাহর হুকুমে। অতঃপর যখন তিনি ডাক দিবেন, তখন সবকিছুর অবস্থা পরিবর্তিত হয়ে যাবে এবং আমরা স্ব স্ব কবর থেকে বেরিয়ে আল্লাহর নিকটে সমবেত হব’ (রূম ৩০/২৫)।
(১৪) وَأَنْزَلْنَا مِنَ الْمُعْصِرَاتِ مَاءً ثَجَّاجاً ‘আমরা পানিপূর্ণ মেঘমালা হ’তে প্রচুর বারিপাত করি’।
ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, الْمُعْصِرَاتِ অর্থ ‘বায়ু’। অন্য বর্ণনায় এসেছে,السحاب অর্থাৎ ‘মেঘ’। ثَجَّاجاً অর্থ كَثِيْرًا ‘প্রচুর’ বা مُتَتَابِعًا ‘মুষলধারে’। এখানে অর্থ দাঁড়াচ্ছে وأنزلنا من ذوات الرياح المعصرات ماء متتابعا ‘আমরা বর্ষণ করি মেঘময় বায়ুর মাধ্যমে মুষলধারে বৃষ্টি’।
‘সূর্যের’ বর্ণনার পরেই ‘বৃষ্টি’র বর্ণনা এসেছে। যা ইঙ্গিত বহন করে যে, সূর্যকিরণ হ’ল মেঘ সৃষ্টি ও বৃষ্টিপাতের প্রধানতম কারণ। সাগরের লবণাক্ত পানি সূর্যতাপে বাষ্প হয়ে উপরে উঠে যায়। অতঃপর তা পরিচ্ছন্ন হয়ে মেঘ ও বৃষ্টিতে পরিণত হয়। অতঃপর বায়ু প্রবাহ তাকে বহন করে আল্লাহর হুকুম মত প্রয়োজনীয় স্থানে বর্ষণ করে (ফুরক্বান ২৫/৪৮)। বৃষ্টি একসাথে পড়লে মাটি ধুয়ে চলে যেত ও ব্যাপক ভূমিক্ষয় হ’ত। তাই তাকে সরু ও সূক্ষ্ম ধারায় বর্ষণ করা হয়। যাতে ভূমিক্ষয় না হয় বা কচি চারা ও অংকুরসমূহ ভেঙ্গে নষ্ট না হয়। বৃষ্টির সঙ্গে পাঠানো হয় বিদ্যুৎ (রূম ৩০/২৪)। যার মধ্যে থাকে নাইট্রোজেন। এক হিসাবে জানা যায় যে, বছরে পৃথিবীতে যে বিদ্যুৎ চমকায় বা বজ্রপাত হয়, তাতে প্রায় এক কোটি টন নাইট্রোজেন বা ইউরিয়া সার বৃষ্টির মাধ্যমে মাটির সাথে মিশে যায়। যা ভূমির উর্বরা শক্তি বৃদ্ধি করে। এইভাবে প্রাকৃতিক নিয়মেই আল্লাহ বান্দার রূযীর জন্য ভূমিকে উর্বর ও সমৃদ্ধ করে রাখেন। আল্লাহ বলেন, وَمِنْ آيَاتِهِ أَنَّكَ تَرَى الْأَرْضَ خَاشِعَةً فَإِذَا أَنْزَلْنَا عَلَيْهَا الْمَاءَ اهْتَزَّتْ وَرَبَتْ إِنَّ الَّذِي أَحْيَاهَا لَمُحْيِ الْمَوْتَى إِنَّهُ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ ‘তাঁর অন্যতম নিদর্শন এই যে, তুমি ভূমিকে দেখতে পাও শুষ্ক। অতঃপর যখন আমরা তাতে বৃষ্টি বর্ষণ করি, তখন সেটি আন্দোলিত হয় ও স্ফীত হয়। বস্ত্ততঃ যিনি একে জীবিত করেন, তিনিই মৃতকে জীবন দান করবেন। নিশ্চয়ই তিনি সকল বিষয়ের উপর ক্ষমতাশালী’ (হা-মীম সাজদাহ ৪১/৩৯)।
যদি কেউ প্রশ্ন করেন, সাগরের লবণাক্ত ও বিষাক্ত পানি (ওয়াক্বি‘আহ ৫৬/৬৮-৭০) আকাশে কোন্ ফ্যাক্টরী বা রিফাইনারীতে পরিশোধন করা হয় এবং শতকরা ১১.১ ভাগ হাইড্রোজেন ও ৮৮.৯ ভাগ অক্সিজেন সমপরিমাণে মিশিয়ে মহাশূন্যে কে পানি তৈরী করেন। কে সেটাকে দূষণমুক্ত ও রিফাইন করেন? অতঃপর সেই লক্ষ-কোটি গ্যালন বিশুদ্ধ পানি আকাশে কোথায় কিভাবে মওজুদ থাকে? কে তাকে মৌসুম মত বহন করে এনে সুন্দর ও সুবিন্যস্ত ধারায় জমিতে বর্ষণ করে? বস্ত্তবাদী ও নাস্তিক্যবাদীদের কাছে এসবের কোন জবাব আছে কি?
হ্যাঁ অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীতে যথাক্রমে শিল্পবিপ্লব ও বিজ্ঞানের নানামুখী আবিষ্কারে হতচকিত হয়ে সাময়িকভাবে অনেক বিজ্ঞানী বিভ্রান্ত হয়ে গিয়েছিলেন এবং সবকিছু Amusement of Nature ‘প্রকৃতির লীলাখেলা’ মনে করতেন। কিন্তু এখন তাদের অধিকাংশের হুঁশ ফিরেছে এবং আলফ্রেড হোয়াইট হেড (১৮৬১-১৯৪৭), আর্থার এডিংটন (১৮৮২-১৯৪৪), জেম্স জীনস (১৮৭৭-১৯৪৬) সহ বহুসংখ্যক বিজ্ঞানী স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে, Nature is alive. ‘প্রকৃতি এক জীবন্ত সত্তা’। ডব্লিউ, এন, সুলিভানের ভাষায় বিজ্ঞানীদের বক্তব্যের সার নির্যাস হ’ল ‘The ultimate nature of the universe is mental’ ‘বিশ্বলোকের চূড়ান্ত প্রকৃতি হ’ল মানসিক’। অর্থাৎ বিশ্বলোক আপনা-আপনি সৃষ্টি হয়নি বা এটা কোন বিগব্যাঙ (Big Bang) বা মহা বিস্ফোরণের ফসল নয় বা অন্ধ-বোবা-বধির কোন ন্যাচার বা প্রকৃতি নয়, বরং একজন মহাজ্ঞানী ও কুশলী সৃষ্টিকর্তার মহা পরিকল্পনার ফসল এবং তিনিই হচ্ছেন ‘আল্লাহ’, যিনি বিশ্বচরাচরের সৃষ্টিকর্তা ও পালনকর্তা। যাঁর পূর্ব নির্ধারিত পরিকল্পনায় সবকিছু চলছে (ইউনুস ১০/৩,৩১, রা‘দ ১৩/২, সাজদাহ ৩২/৫)।
(১) যদি কেউ দ্রুতগতি সম্পন্ন ও দীর্ঘদেহী রেলগাড়ীকে রেল লাইনের উপর দৌড়াতে দেখে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেন যে, পেট্রোল ও লোহার ঘর্ষণে আগুন ও বাষ্পের জোরে ওটা আপনা-আপনি চলছে, এর কোন চালক বা আবিষ্কারক নেই, তাহ’লে তাকে কি বলা হবে? যদি সে বলে যে, আমি দূর থেকে চালককে দেখছি না বা আবিষ্কারককে দেখিনি, অতএব আমি এসবে বিশ্বাস করি না। তাহ’লে তাকে কি বলা হবে? (২) বাংলাদেশে জন্মগ্রহণকারী কোন ছেলে যদি বলে যে, এককালে এদেশে মোঘল, তুর্কী, বৃটিশ ও পাকিস্তানী শাসন ছিল বলে আমি বিশ্বাস করি না, যেহেতু আমি তা দেখিনি, তাহ’লে তাকে কি বলা যাবে? অনুরূপভাবে যদি কেউ বিশ্বলোক ও সৌরজগত সম্পর্কে ধারণা করে যে, সূর্য-চন্দ্র, গ্রহ-নক্ষত্র সবই এক্সিডেণ্টের সৃষ্টি এবং এসব চলছে আপনা-আপনি প্রাকৃতিক নিয়মে, এসবের কোন সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা বা বিধানদাতা কখনো ছিল না, এখনো নেই। কারণ তাকে আমরা চোখের সামনে দেখতে পাই না। তাহ’লে তাকে কেবল হস্তীমূর্খ ছাড়া আর কি বলা যাবে? (৩) যদি কেউ বলে যে, অমুক প্রেসে বিস্ফোরণ ঘটার ফলে সেখান থেকে আপনা-আপনি বড় বড় অভিধান ও গবেষণা গ্রন্থসমূহ সৃষ্টি হয়েছে ও বের হয়েছে, তাহ’লে সেকথা কি কেউ বিশ্বাস করবে? (৪) হে অবিশ্বাসী! তোমার দেহ যে অক্সিজেন, কার্বণ, হাইড্রোজেন প্রভৃতি ৬০ প্রকার প্রাণহীন পদার্থ দিয়ে সৃষ্টি, ঐ অণুতে জীবনের উষ্ণতা আসে কোত্থেকে? তুমি বা তোমার বিজ্ঞান আজ পর্যন্ত কি সেই এটম বা অণু দেখতে পেয়েছে? না কেবল অনুমিতি ও ধারণার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বিজ্ঞান তাহ’লে কিভাবে ঐ নিষ্প্রাণ গায়েবী এটমের উপর ঈমান আনলো? পৃথিবীর মধ্যাকর্ষণ শক্তি এবং চুম্বকের যে প্রবল আকর্ষণী শক্তি, তা কি কেউ কখনো স্বচক্ষে দেখতে পেয়েছে? নাকি কেবল অনুভূতি ও অনুমিতির মাধ্যমে অমোঘ বাস্তবতাকে স্বীকার করে নেয়া হয়েছে? তাই তো দেখি, প্রায় সকল বিজ্ঞানী একথা বলেন যে, Science gives us but a partial knowledge of reality ‘বিজ্ঞান আমাদেরকে কেবল আংশিক সত্যের সন্ধান দেয়’। তারা স্রেফ অনুমানের ভিত্তিতে কাজ শুরু করে থাকেন। তারা বলেন, আমরা কতিপয় বাহ্য প্রকাশকে দেখি মাত্র, মূল বস্ত্ততে দেখিনা’। ভূগর্ভে ও নভোমন্ডলে পরিচালিত সকল প্রকারের বিজ্ঞান গবেষণা মূলতঃ অনুমানভিত্তিক।
মুশকিল হ’ল নাস্তিক্যবাদীরা যতই নিজেদেরকে প্রগতিবাদী দাবী করুক না কেন, তারা মূলতঃ বিদ্বেষবশত ধর্মের বিরুদ্ধে ও আল্লাহর বিরুদ্ধে এসব অযৌক্তিক কথা বলেন। তাদের অবিমৃষ্যকারিতায় বিরক্ত হ’য়ে বিজ্ঞানী ড. এ.ভি. হিলি (A.V. Hili) বলেন, I should be the last to claim that we, scientific men, are less liable to prejudice than other educated men. অর্থাৎ ‘আমরা বিজ্ঞানীরা অন্যান্য শিক্ষিত লোকদের চাইতে কম বিদ্বেষপরায়ণ- এই দাবী করতে আমি অপারগ’। অথচ বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী আইনস্টাইন (১৮৭৯-১৯৫৫ খৃঃ) বলেছেন, Religion without science is blind and Science without religion is lame. ‘বিজ্ঞান ব্যতীত ধর্ম অন্ধ এবং ধর্ম ব্যতীত বিজ্ঞান পঙ্গু’। আর আখেরী যামানায় সেই ধর্ম হ’ল আল্লাহ প্রেরিত সর্বশেষ ও পূর্ণাঙ্গ দ্বীন ‘ইসলাম’। অন্য কিছুই নয়।
ধর্মীয় নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত বিহঙ্গের মত স্বেচ্ছাচারী জীবনের প্রতি আসক্ত এইসব দুনিয়াপূজারী তথাকথিত আধুনিকতাবাদীরা স্রেফ যিদ ও হঠকারিতাবশত আল্লাহ ও তাঁর প্রেরিত এলাহী বিধান ইসলামী জীবন ব্যবস্থাকে অস্বীকার করে। নইলে চূড়ান্ত বিচারে ইচ্ছায় হৌক অনিচ্ছায় হৌক ইসলামের কাছেই সকলকে মাথা নত করতে হচ্ছে এবং হবে। যেমন করে যাচ্ছে আসমান ও যমীনের সবকিছু (আলে ইমরান ৩/৮৩)। এমনকি ধর্মদ্রোহী বস্ত্তবাদীর ঐ মোটা মগযটা শয়তানের তাবেদারী করলেও তার দেহটা ঠিকই আল্লাহর আনুগত্য করে। ফলে সে তার বার্ধক্য-জ্বরা ও মৃত্যুকে ঠেকাতে পারে না। এ যুগের আইনস্টাইন বলে খ্যাত লন্ডনের পদার্থবিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং (জন্ম : ১৯৪২ খৃঃ) কি এর বড় দৃষ্টান্ত নন? ১৯৬৩ সাল থেকে যার কেবল মাথা ব্যতীত সারা দেহ অবশ হয়ে এযাবত পঙ্গু হয়ে রয়েছে? মেঘমালা সৃষ্টি ও তা থেকে বৃষ্টিবর্ষণ, অতঃপর তার মাধ্যমে মৃত যমীনকে জীবিত করণের মধ্যেই রয়েছে ক্বিয়ামতের জ্বলন্ত প্রমাণ।
(১৫-১৬) وَّجَنَّاتٍ أَلْفَافًا لِنُخْرِجَ بِهِ حَبَّا وَّنَبَاتَا- ‘যাতে তদ্বারা উৎপন্ন করি শস্য ও উদ্ভিদ’। ‘এবং ঘনপল্লবিত উদ্যানসমূহ’।
বৃষ্টি বর্ষণের প্রধান উদ্দেশ্য হিসাবে আল্লাহ বলেন, তার দ্বারা আমি বান্দার জন্য শস্য, উদ্ভিদ ও উদ্যানসমূহ সৃষ্টি করি। এখানে মানুষ ও গবাদিপশুর খাদ্য হিসাবে প্রধান তিনটি জাতের উৎপন্ন দ্রব্যের নাম করা হয়েছে। যার প্রত্যেকটি স্ব স্ব জাতের প্রতিনিধিত্ব করে। যেমন حَبًّا বা শস্যদানা বলতে চাউল, গম, যব ইত্যাদি বুঝানো হয়েছে। نَبَاتَا বা উদ্ভিদ বলতে নানাবিধ সবজি, ঘাস ইত্যাদিকে বুঝানো হয়েছে যা কাঁচা অবস্থায় খেতে হয়। অতঃপর جَنَّاتٍ বা উদ্যান বলতে খেজুর, আঙ্গুর, কলা, আম ইত্যাদি বাগিচাকে বুঝানো হয়েছে। বলা বাহুল্য, এটা আল্লাহর এক অপূর্ব সৃষ্টি কৌশল যে, একই বৃষ্টি দিয়ে তিনি বিভিন্ন জাতের ও বিভিন্ন স্বাদের ফল ও ফসল উৎপন্ন করেন। যার মধ্যে জ্ঞানী সম্প্রদায়ের জন্য নিদর্শন সমূহ রয়েছে (রা‘দ ১৩/৪)।
উপরে বর্ণিত ৬ হ’তে ১৬ পর্যন্ত ১১টি আয়াত আল্লাহ যমীন ও আসমান এবং তন্মধ্যকার সৃষ্টিকুল বিষয়ে বর্ণনা করেছেন পুনরুত্থান বা ক্বিয়ামতের প্রমাণ হিসাবে। তিনি ইঙ্গিত করেছেন যে, মানুষ ছাড়াও এইসব বিশাল সৃষ্টিকে যিনি অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্বে এনেছেন (বাক্বারাহ ২/১১৭; দাহর ৭৬/১) এবং কোনরূপ নমুনা বা পূর্বদৃষ্টান্ত ছাড়াই প্রথমবার সৃষ্টি করেছেন (আম্বিয়া ২১/১০৪), তাঁর পক্ষে এটা খুবই সহজ এগুলিকে ধ্বংস করে দ্বিতীয়বার সৃষ্টি করা (রূম ৩০/২৭)। অতএব মানুষের মত একটা সামান্য প্রাণীর মৃত্যুর পর পুনরুত্থান ঘটানো তাঁর জন্য খুবই সহজ কাজ। যদিও অবিশ্বাসীরা এতে বিস্ময় প্রকাশ করে (ক্বাফ ৫০/২-৩)। আল্লাহ বলেন,
أَوَلَمْ يَرَ الْإِنْسَانُ أَنَّا خَلَقْنَاهُ مِنْ نُّطْفَةٍ فَإِذَا هُوَ خَصِيْمٌ مُّبِيْنٌ- ََوضََرَبَ لَنَا مَثَلاً وَنَسِيَ خَلْقَهُ قَالَ مَنْ يُّحْيِي الْعِظَامَ وَهِيَ رَمِيْمٌ- قُلْ يُحْيِيْهَا الَّذِيْ أَنشَأَهَا أَوَّلَ مَرَّةٍ وَهُوَ بِكُلِّ خَلْقٍ عَلِيْمٌ-
‘মানুষ কি দেখে না যে, আমরা তাকে সৃষ্টি করেছি শুক্রবিন্দু থেকে? অতঃপর সে হয়ে গেল প্রকাশ্য ঝগড়াটে’। ‘সে আমাদের বিষয়ে নানাবিধ কথা বলে, অথচ নিজের সৃষ্টির কথা সে ভুলে যায়। সে বলে, কে এই সব হাড়-হাড্ডি জীবিত করবে যখন তা পচে-গলে যাবে’? ‘তুমি বলে দাও, যিনি প্রথমবার এগুলিকে সৃষ্টি করেছিলেন, তিনিই এগুলিকে জীবিত করবেন। তিনি সকল সৃষ্টি সম্পর্কে সম্যক অবগত’ (ইয়াসীন ৩৬/৭৭-৭৯)। উপরে বর্ণিত আয়াতগুলোর নিগূঢ় তত্ত্ব এবং আল্লাহর অপূর্ব সৃষ্টিকৌশল ও জীবজগতের লালন-পালন প্রক্রিয়া জানার জন্য মুসলমান শিক্ষার্থীকে সৌরবিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান, দেহতত্ত্ব, উদ্ভিদবিদ্যা, প্রাণীবিদ্যা, পদার্থবিদ্যা প্রভৃতিতে দক্ষতা লাভ করতে হবে। তাতে তার ঈমান বৃদ্ধি পাবে ইনশাআল্লাহ। কেননা এর দ্বারা আল্লাহর গুণাবলী সম্পর্কে সে অধিকতর জ্ঞান লাভ করবে। আর দুনিয়াতে সত্যিকারের আল্লাহ প্রেমিক তিনিই, যিনি স্বীয় প্রেমাস্পদের গুণাবলী সম্পর্কে যথাযথভাবে ওয়াকিফহাল। এজন্যই আল্লাহ বলেন, إِنَّمَا يَخْشَى اللهَ مِنْ عِبَادِهِ الْعُلَمَاءُ ‘বান্দাদের মধ্যে জ্ঞানীরাই মাত্র আল্লাহ্কে ভয় করে’ (ফাত্বির ৩৫/২৮)। এখানে ‘জ্ঞানী’ বলতে কেবল শরী‘আতের জ্ঞান নয়, বরং বিজ্ঞানের জ্ঞানও গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য বিজ্ঞানকে আরবীতে ‘ইলম’ (العلم) বলা হয়। তাই আল্লাহভীরু বিজ্ঞানীই হ’তে পারেন আল্লাহর নিকটে অধিকতর প্রিয়।
৪র্থ বিষয়বস্ত্ত : ক্বিয়ামতের পর চূড়ান্ত শাস্তি ও সুখের বর্ণনা (১৭-৪০)।
(ক) ক্বিয়ামতের অবস্থা বর্ণনা (১৭-২০ আয়াত) :
إِنَّ يَوْمَ الْفَصْلِ كَانَ مِيْقَاتاً، يَوْمَ يُنْفَخُ فِي الصُّوْرِ فَتَأْتُوْنَ أَفْوَاجاً، وَّفُتِحَتِ السَّمَاءُ فَكَانَتْ أَبْوَاباً، وَسُيِّرَتِ الْجِبَالُ فَكَانَتْ سَرَاباً-
‘নিশ্চয়ই বিচার দিবস সুনির্ধারিত’। ‘যেদিন শিঙ্গায় ফুঁক দেওয়া হবে, অতঃপর তোমরা দলে দলে সমাগত হবে’। ‘আর আকাশ খুলে দেওয়া হবে। অতঃপর তা বহু দরজা বিশিষ্ট হবে’। ‘আর পর্বতমালা চালিত হবে। অতঃপর তা মরীচিকা হয়ে যাবে’।
ব্যাখ্যা : সূরা শুরু করা হয়েছে ‘মহাসংবাদ’ দিয়ে, এক্ষণে তা সংঘটিত হওয়ার সময়কার অবস্থা কেমন হবে, সে বর্ণনা দেওয়া হচ্ছে। সৃষ্টি ও লালন-পালন শেষে অতঃপর পৃথিবীর ধ্বংস ও প্রলয়কাল প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন, এটা অবশ্যই হবে এবং সুনির্ধারিত তারিখেই হবে। আর সেই তারিখ কেবল আল্লাহর ইলমেই রয়েছে (মুল্ক ৬৭/২৬)। যদিও বিজ্ঞানীরা অনুমান করেন যে, আগামী ৫০০ কোটি বছর পর সূর্য দীপ্তিহীন হয়ে যাবে এবং পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। সম্প্রতি ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জনৈক গবেষক গ্রেগরি ল্যাফলিক জানিয়েছেন, আগামী ৫০০ কোটি বছরের মধ্যে ধীরে ধীরে কক্ষপথ বদলাবে। ফলে এসময় বুধ বা মঙ্গলের সঙ্গে পৃথিবীর সংঘর্ষ অবশ্যম্ভাবী। আর তাতেই লুপ্ত হয়ে যাবে প্রাণের অস্তিত্ব। আর তাতে ঘটতে পারে মহাপ্রলয় বা ডুম্সডে (Dooms day)। অতি সাম্প্রতিক গবেষণায় বিজ্ঞানীগণ প্রমাণ পেয়েছেন যে, কোন নক্ষত্রের মৃত্যুর সময় সে তার পার্শ্ববর্তী গ্রহকে গিলে ফেলছে। জ্যোতির্বিজ্ঞানের অধ্যাপক অ্যালেক্স উলজজান বলেন, একই ভাগ্য আমাদের পৃথিবীর জন্যও অপেক্ষা করছে। সূর্য তখন ‘লোহিত দানবে’ পরিণত হবে এবং পৃথিবীকে গিলে ফেলবে। যদিও সেই ভয়ংকর ঘটনাটি ঘটতে এখনো পাঁচশ’ কোটি বছর সময় লাগবে’।
আমরা বলব, ক্বিয়ামতের ইল্ম স্রেফ আল্লাহর নিকটে রয়েছে। অন্যের কাছে নয়। বরং তা আসবে আকস্মিকভাবে আল্লাহর হুকুমে। যেমন তিনি বলেন, وَلاَ يَزَالُ الَّذِينَ كَفَرُوا فِي مِرْيَةٍ مِنْهُ حَتَّى تَأْتِيَهُمُ السَّاعَةُ بَغْتَةً أَوْ يَأْتِيَهُمْ عَذَابُ يَوْمٍ عَقِيمٍ ‘আর যারা কুফরী করে তারা (ইসলামে) সন্দেহ করা হ’তে বিরত হবে না, যতক্ষণ না তাদের নিকটে ক্বিয়ামত এসে পড়বে আকস্মিকভাবে অথবা এসে পড়বে সেই বন্ধ্যা দিনের শাস্তি (যাতে সামান্যতম স্বস্তি নেই)। (হজ্জ ২২/৫৫)।
(১৭) إِنَّ يَوْمَ الْفَصْلِ كَانَ مِيْقَاتًا ‘নিশ্চয়ই বিচার দিবস সুনির্ধারিত’। يَوْمَ الْفَصْلِ অর্থ ‘ফায়ছালার দিন’। আর তা হ’ল ক্বিয়ামতের দিন। কেননা ঐদিন আল্লাহ বান্দার ভাল-মন্দ কাজ-কর্মের বিচার-ফায়ছালা করবেন। كَانَ مِيْقَاتًا অর্থ موقتا لأجل معدود গণিত সময়সীমা যা নির্ধারিত, যেখান থেকে কোনরূপ কমবেশী হবে না। আল্লাহ বলেন, وَمَا نُؤَخِّرُهُ إِلاَّ لِأَجَلٍ مَعْدُوْدٍ ‘আর আমরা ক্বিয়ামতের দিনটাকে কিছুকালের জন্য স্থগিত রেখেছি মাত্র’ (হূদ ১১/১০৪)। এখানে সরাসরি يَوْمَ القِيامَةِ বা ‘ক্বিয়ামতের দিন’ না বলে يَوْمَ الْفَصْلِ বা ‘বিচারের দিন’ বলার মাধ্যমে ক্বিয়ামতের মূল উদ্দেশ্যকেই সামনে আনা হয়েছে এবং বান্দাকে পরকালীন জওয়াবদিহিতার বিষয়ে হুঁশিয়ার করা হয়েছে। যাতে সে দুনিয়াতে প্রস্ত্ততি গ্রহণ করে।
(১৮) يَوْمَ يُنْفَخُ فِي الصُّوْرِ فَتَأْتُوْنَ أَفْوَاجاً ‘যেদিন শিঙ্গায় ফুঁক দেওয়া হবে, অতঃপর তোমরা দলে দলে সমাগত হবে’। অর্থাৎ ক্বিয়ামতের দিন।
অন্য আয়াতে দু’বার ফুঁক দেয়ার কথা এসেছে (ইয়াসীন, ৩৬/৪৯,৫১; যুমার ৩৯/৬৮)। প্রথম ফুঁকের আওয়াজে সবার মৃত্যু হবে এবং দ্বিতীয় ফুঁকের আওয়াজে সবাই জীবিত হবে ও কবর থেকে বেরিয়ে হাশরের ময়দানে আল্লাহর নিকটে জমা হবে। আবূ হুরায়রা (রাঃ) বলেন, উভয় ফুঁকের মধ্যবর্তী সময়কাল সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হ’লে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, চল্লিশ। কিন্তু এই চল্লিশ দিন, মাস, না বছর তা বলতে তিনি অস্বীকার করেন। অতঃপর রাসূল (ছাঃ) বলেন যে, আল্লাহ ঐ সময় এমন বৃষ্টি বর্ষণ করবেন, যার স্পর্শে মরা-সড়া নিশ্চিহ্ন মানুষ সব বেঁচে উঠবে স্ব স্ব মেরুদন্ডের নিম্নদেশের অস্থিখন্ড (عَجْبُ الذَّنْبِ) অবলম্বন করে। কেননা মানুষের অস্থিসমূহের ঐ অংশটুকু বিনষ্ট হবে না’।[3] যদি কেউ বলেন, আগুনে পুড়িয়ে ভস্ম করার পর তার দেহের কিছুই অবশিষ্ট থাকে না, সে অবস্থায় কিসের অবলম্বনে সেদিন মানুষের দেহ গঠিত হবে? জওয়াব এই যে, এটি স্বাভাবিক কবরের লাশ সম্পর্কে বলা হয়েছে। এক্ষণে পুড়িয়ে ভস্ম করার অস্বাভাবিক অবস্থার সময়কার জবাব এই যে, মানবদেহের সবকিছু নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলেও তার মূল অণুবীজ, কখনো নিশ্চিহ্ন হয় না। তাকে অবলম্বন করে দেহ গঠিত হ’তে পারে। যেমন দুনিয়াতে মায়ের গর্ভে পিতার শুক্রাণুকে ঘিরে দেহ গঠিত হয়ে থাকে। আর আল্লাহর জন্য তো কোন অবলম্বনের প্রয়োজন হয় না।
(১৯) وَفُتِحَتِ السَّمَاءُ فَكَانَتْ أَبْوَاباً ‘আর আকাশ খুলে দেওয়া হবে। অতঃপর তা বহু দরজা বিশিষ্ট হবে’।
আসমান অত্যন্ত সুরক্ষিত। যা ভেদ করে যে কেউ উপরে উঠতে পারে না। প্রত্যেক আসমানে রয়েছে দরজাসমূহ এবং রয়েছে দাররক্ষী ফেরেশতাগণ। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে নিয়ে মে‘রাজে গমনের সময় জিব্রীল (আঃ) সপ্ত আকাশের প্রত্যেক দরজায় প্রবেশের পূর্বে দাররক্ষী ফেরেশতার অনুমতি নিয়েছিলেন।[4] ক্বিয়ামতের দিন যখন আসমান বিদীর্ণ হবে, তখন দরজাসমূহ দিয়ে ফেরেশতাদের দুনিয়াতে নামিয়ে দেয়া হবে (ফুরক্বান ২৫/২৫)। এই বিদীর্ণ হওয়ার অর্থ দরজা সমূহ খুলে দেওয়া। দ্বিতীয় ফুঁকদানের পর আসমান ও যমীন পুনরায় বহাল হয়ে যাবে এবং নতুন আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টি হবে ও সকল মানুষ মহাপরাক্রান্ত আল্লাহর সম্মুখে উপস্থিত হবে’ (ইবরাহীম ১৪/৪৮)। নতুন সেই পৃথিবী সমতল হবে। তাতে কোনরূপ বক্রতা বা উঁচু-নীচু থাকবে না (ত্বোয়াহা ২০/১০৬-১০৭)।
(২০) وَسُيِّرَتِ الْجِبَالُ فَكَانَتْ سَرَاباً ‘আর পর্বতমালা চালিত হবে। অতঃপর তা মরীচিকা হয়ে যাবে’।
বিশাল ও সুদৃঢ় পর্বতমালা ঐদিন মরীচিকার ন্যায় অস্তিত্বহীন বস্ত্ততে পরিণত হবে, যা ধূনিত তুলার ন্যায় হয়ে যাবে (ক্বারে‘আহ ১০১/৫) এবং সমূলে উৎপাটিত হয়ে মেঘখন্ড সমূহের ন্যায় বিক্ষিপ্ত হয়ে চালিত হবে (ত্বোয়াহা ২০/২০৫; নমল ২৭/৮৮)।
মু‘আল্লাক্বা খ্যাত কবি লাবীদ বিন রাবী‘আহ বলেন,
أَلاَ كُلُّ شَيْئٍ مَا خَلاَ اللهَ بَاطِلٌ + وَكُلُّ نَعِيْمٍ لاَ مَحَالَةَ زَائِلٌ
‘মনে রেখ আল্লাহ ব্যতীত সকল কিছুই বাতিল। আর প্রত্যেক নে‘মত অবশ্যই ধ্বংসশীল’। তবে শেষের অংশটি হাদীছে নেই এবং এটি লাবীদের কি-না সেবিষয়ে মতভেদ রয়েছে। কবিতাংশটি ছিল রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট খুবই প্রিয়। তিনি বলেন,
أَصْدَقُ كَلِمَةٍ قَالَهَا الشَّاعِرُ كَلِمَةُ لَبِيَدٌ : أَلاَ كُلُّ شَيْءٍ مَا خَلاَ اللهَ بَاطِلُ
‘কবিরা যত কবিতা বলেছেন, তার মধ্যে সবচেয়ে সত্য কথা হ’ল লাবীদের কথা : আল্লাহ ব্যতীত সবকিছুই বাতিল’।[5]
উল্লেখ্য যে, লাবীদ পরে ইসলাম কবুল করেন ও কবিতা ছেড়ে দেন। ৪১ হিজরীতে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
উপরের চারটি আয়াতে ক্বিয়ামত সংঘটনকালের ভয়ংকর অবস্থা বর্ণিত হয়েছে। অতঃপর বিচার শেষে জাহান্নাম ও জাহান্নামীদের অবস্থা প্রসঙ্গে আল্লাহ নিম্নোক্ত আয়াত সমূহে বলেন,
৪ (খ) ক্বিয়ামতের পর জাহান্নামীদের শাস্তি (২১-৩০) :
(২১-২২) إِنَّ جَهَنَّمَ كَانَتْ مِرْصَادًا، لِّلْطَّاغِيْنَ مَآباًً ‘নিশ্চয় জাহান্নাম ওঁৎ পেতে আছে’। ‘সীমালংঘনকারীদের ঠিকানা রূপে’।
مِرْصَادٌ অর্থ ঘাঁটি, যেখানে বসে কারু অপেক্ষা করা হয়। জাহান্নাম হবে ঘাঁটি কাফির-মুশরিক ও সীমালংঘনকারী ফাসিক-মুনাফিকদের জন্য। আল্লাহ বলেন, وَإِن مِّنْكُمْ إِلاَّ وَارِدُهَا كَانَ عَلَى رَبِّكَ حَتْماً مَّقْضِيّاً ‘আর তোমাদের প্রত্যেকেই ওটা (অর্থাৎ পুলছিরাত) অতিক্রম করবে। এটা তোমার প্রতিপালকের অমোঘ সিদ্ধান্ত’ (মারিয়াম ১৯/৭১)। হাসান বছরী ও ক্বাতাদাহ বলেন, إن على النار رَصَدًا لا يدخل أََحد الجنة حتى يجتاز عليه، فمن جاء بجواز جاز، ومن لم يجئ بجواز حبس- ‘জাহান্নামের উপরে সেতু রয়েছে। সেটা অতিক্রম না করে কেউ জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। এখানে যে ব্যক্তি পার হওয়ার অনুমতিসহ আসবে, সে ব্যক্তি অতিক্রম করবে। আর যে ব্যক্তি সেটা নিয়ে আসতে পারবে না, সে আটকে যাবে’ (কুরতুবী)। বস্ত্ততঃ জাহান্নামের উপরের এই পুলকেই বলা হয় الصِّرَاطُ বা ‘পুলছেরাত’। যা অতীব সূক্ষ্ম ও অতীব ধারালো। জাহান্নামী ব্যক্তি তা পার হ’তে গিয়ে আটকে যাবে এবং জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে। পক্ষান্তরে জান্নাতীগণ স্বচ্ছন্দে চোখের পলকে পার হয়ে যাবে এবং তারা কোনরূপ অগ্নিতাপ অনুভব করবে না।[6] আল্লাহ আমাদেরকে পুলছেরাত পার হওয়ার তাওফীক দান করুন আমীন! উল্লেখ্য যে, ৮ম হিজরীর জুমাদাল ঊলা মাসে রোমকদের বিরুদ্ধে মুতার যুদ্ধে রওয়ানার সময় সম্ভাব্য শহীদ সেনাপতি আব্দুল্লাহ বিন রাওয়াহা উক্ত আয়াত পাঠ করে কেঁদে বুক ভাসিয়েছিলেন ও সবার নিকটে দো‘আ চেয়েছিলেন যেন তিনি ওটা পার হ’তে পারেন।
(২৩) لاَبِثِيْنَ فِيْهَا أَحْقَابًا ‘সেখানে তারা অবস্থান করবে যুগ যুগ ধরে’।
অর্থাৎ কাফির-মুশরিকগণ জাহান্নামে চিরকাল থাকবে।[7]আল্লাহ মুনাফিক ও কাফিরদেরকে জাহান্নামে একত্রিত করবেন (নিসা ৪/১৪০) বরং মুনাফিকরা জাহান্নামের সর্বনিম্ন স্তরে থাকবে এবং তারা কোনরূপ সাহায্য পাবে না (নিসা ৪/১৪৫)। আর এই চরম শাস্তির একমাত্র কারণ হ’ল তাদের কপটতাপূর্ণ আচরণ এবং সীমালংঘন ও হঠকারিতা, যা তারা আল্লাহর বিরুদ্ধে ও আল্লাহ প্রেরিত দ্বীনের বিরুদ্ধে দুনিয়াতে করেছিল।
أَحْقَابًا বহুবচন। অর্থ دهورا مةةابعة غير نهاية ‘পরপর সীমাহীন যুগসমূহ’। একবচনে حُقُبٌ অর্থ ‘যুগ’ বা দীর্ঘ সময়কাল। এখানে دهور না বলে أحقاب বলার কারণ এই যে, আরবদের নিকটে حُقُبٌ শব্দটাই ‘দূরতম সময়কাল’ বুঝানোর জন্য ব্যবহৃত হ’ত। বহুবচন ব্যবহারের উদ্দেশ্য হ’ল- যখন একটা যুগ শেষ হবে তখন আরেকটা যুগ শুরু হবে। এইভাবে চিরকাল তারা জাহান্নামে থাকবে। হাসান বছরী বলেন, এর অর্থ হ’ল خلود বা ‘চিরকাল’। ‘যার কোন সীমা নির্দিষ্ট নেই’। এক হুক্ববার (حقبة) সময়কাল দুনিয়ার হিসাবে ২ কোটি ৮৮ বছর বা তার কম ও বেশী মর্মে যতগুলি বর্ণনা বিভিন্ন তাফসীর গ্রন্থে দেখতে পাওয়া যায়, সবগুলিই হয় ‘বানোয়াট’ (موضوع) , অথবা ‘অত্যন্ত দুর্বল’ (ضعيف جِدًا) সূত্রে বর্ণিত। অতএব হুক্ববার সঠিক অর্থ সেটাই যা উপরে বর্ণিত হয়েছে। কুরতুবী, ইবনু কাছীর, ক্বাসেমী, তানতাভী সকলে একই অর্থ বর্ণনা করেছেন।
(২৪) لاَ يَذُوْقُوْنَ فِيْهَا بَرْداً وَّلاَ شَرَاباً ‘যেখানে তারা আস্বাদন করবে না শীতলতা কিংবা পানীয়’।
অর্থাৎ জাহান্নামে তারা শীতলকারী কোন বায়ু বা দেহ পুষ্টকারী কোন পানীয় পাবে না। اَلْبَرْدُ অর্থ الرَّوح والراحة ‘ঠান্ডা বাতাস ও শান্তি, তন্দ্রা ও নিদ্রা’। সব অর্থই পরস্পরের পরিপূরক। এ কারণেই বলা হয় منع البردُ البردَ ‘শীত ঘুম নষ্ট করেছে’।
(২৫) إِلاَّ حَمِيْماً وَّغَسَّاقاً ‘কেবল ফুটন্ত পানি ও দেহনিঃসৃত পুঁজ ব্যতীত’। পূর্বের বাক্য থেকে استثناء منقطع অথবা بدل হয়েছে। অর্থাৎ শীতল বায়ু ও উত্তম পানীয়ের বদলে তারা পাবে ফুটন্ত পানি ও দেহনিঃসৃত পুঁজ। الغَسَّاق অর্থ صديدُ أهلِ النار وقَيْحُهم ‘জাহান্নামীদের দেহনিঃসৃত ঘাম ও পুঁজ-রক্ত সমূহ’।
(২৬) جَزَاءً وِّفَاقاً ‘যথার্থ কর্মফল হিসাবে’।
এখানে جَزَاءً যবরযুক্ত হয়েছে مصدر হিসাবে। অর্থাৎ جزاء موافقة أعمالهم فى الدنيا ‘দুনিয়াতে তাদের কর্ম অনুযায়ী যথাযথ প্রতিফল’। মুক্বাতিল বলেন,
وَافَقَ الْعَذَابُ الذَّنْبَ فَلاَ ذَنْبَ أَعْظَمُ مِنَ الشِّرْكِ وَلاَ عَذَابَ أَعْظَمُ مِنَ النَّارِ-
‘শাস্তি হবে পাপ অনুযায়ী। আর শিরকের চাইতে বড় পাপ আর নেই এবং জাহান্নামের চাইতে বড় শাস্তি আর নেই’। أجارنا الله من ذلك بمنه وكرمه ‘আল্লাহ তাঁর অনুগ্রহে ও করুণায় আমাদেরকে উক্ত শাস্তি থেকে রেহাই দিন’- আমীন!
(২৭-২৮) إِنَّهُمْ كَانُوْا لاَ يَرْجُوْنَ حِسَاباً، وَكَذَّبُوْا بِآيَاتِنَا كِذَّاباً ‘নিশ্চয়ই তারা (আখেরাতে) জওয়াবদিহিতার আশা করত না’। ‘এবং তারা আমাদের আয়াতসমূহে পুরাপুরি মিথ্যারোপ করত’।
এখানে لاَ يَرْجُوْنَ অর্থ لا يخافون অথবা لا يعتقدون ‘তারা ভয় করত না বা ধারণা করত না’। দু’টির অর্থ একই। حِسَاباً অর্থ مُحَاسَبَةً عَلَى أَعْمَالِهِمْ ‘তাদের আমলের হিসাব-নিকাশ বা জওয়াবদিহিতা’। শুধু তাই নয়, তারা আখেরাতকে পুরোপুরি মিথ্যা মনে করত। অতএব وَيْلٌ يَّوْمَئِذٍ لِّلْمُكَذِّبِيْنَ ‘দুর্ভোগ সেদিন মিথ্যারোপকারীদের জন্য’ (মুরসালাত ৭৭/১৫)।
শাস্তির কারণ :
জাহান্নামের শাস্তির বর্ণনার পর এক্ষণে আল্লাহ তাদের শাস্তির কারণ ব্যাখ্যা করছেন। আর তা হ’ল তাদের অবিশ্বাস ও মিথ্যারোপ। মানুষের মধ্যে আল্লাহ প্রধান দু’টি শক্তি দান করেছেন। ধারণাশক্তি ও কর্মশক্তি। ধারণাশক্তি দ্বারাই কর্মশক্তি পরিচালিত হয়। ধারণা বা আক্বীদা সুন্দর হ’লে কর্ম সুন্দর হয়। নইলে তার বিপরীত হয়। আক্বীদা ও আমল দু’টিই যাতে আল্লাহমুখী হয়, সেজন্য ইবরাহীম (আঃ) দো‘আ করেছেন, رَبِّ هَبْ لِي حُكْمًا وَأَلْحِقْنِي بِالصَّالِحِيْنَ ‘হে আমার প্রতিপালক! আমাকে প্রজ্ঞা দান কর এবং আমাকে সৎকর্মশীলদের অন্তর্ভুক্ত কর’ (শো‘আরা ২৬/৮৩)। একইভাবে সুলায়মান (আঃ) নিজের জন্য দো‘আ করেছেন, رَبِّ أَوْزِعْنِي أَنْ أَشْكُرَ نِعْمَتَكَ الَّتِي أَنْعَمْتَ عَلَيَّ وَعَلَى وَالِدَيَّ وَأَنْ أَعْمَلَ صَالِحًا تَرْضَاهُ وَأَدْخِلْنِي بِرَحْمَتِكَ فِي عِبَادِكَ الصَّالِحِيْنَ ‘হে আমার প্রতিপালক! আমাকে সামর্থ্য দাও যাতে আমি তোমার নে‘মতের শুকরিয়া আদায় করতে পারি, যা তুমি আমাকে ও আমার পিতা-মাতাকে দান করেছ এবং যাতে আমি তোমার পসন্দনীয় সৎকর্ম সমূহ করতে পারি। আর তুমি স্বীয় অনুগ্রহে আমাকে তোমার সৎকর্মশীল বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত কর’ (নমল ২৭/১৯)।
এই ধারণা বা চিন্তাশক্তিকে শয়তানী জ্ঞান অথবা ইলাহী জ্ঞান দু’টির যেকোন একটির দ্বারা সজ্জিত করার স্বাধীনতা আল্লাহ মানুষকে দিয়েছেন (দাহর ৭৬/৩)। যা তিনি অন্য কোন প্রাণীকে দেননি। আর এই স্বাধীনতা দেওয়ার কারণ হ’ল মানুষকে পরীক্ষা করা যে কে দুনিয়াতে সর্বোত্তম কর্ম সম্পাদন করে (মুল্ক ৬৭/২)।
অত্র আয়াতে আললাহ দু’দিকেই ইঙ্গিত করেছেন। প্রথমতঃ তাদের ধারণায় একথা আসেনি যে, মৃত্যুর পরে তাদের পুনরুত্থান হবে এবং আল্লাহর সম্মুখে তাদের সকল কর্মের হিসাব দিতে হবে। শয়তানের তাবেদারী করতে গিয়ে তারা এই বিশ্বাস থেকে দূরে সরে গিয়েছিল। ফলে তাদের সমস্ত কাজকর্ম হয়েছিল স্বেচ্ছাচারমূলক। যদিও তারা এগুলিকেই উত্তম কাজ মনে করত (কাহফ ১৮/১০৩-০৪)। আল্লাহ অন্যত্র বলেন,وَمَنْ كَانَ فِيْ هَـذِهِ أَعْمَى فَهُوَ فِيْ الآخِرَةِ أَعْمَى وَأَضَلُّ سَبِيْلاً- ‘যে ব্যক্তি এ দুনিয়াতে অন্ধ, সে ব্যক্তি আখেরাতেও অন্ধ এবং সর্বাধিক পথভ্রষ্ট’ (ইসরা ১৭/৭২)। অর্থাৎ হঠকারী ও জ্ঞানান্ধ হওয়ার কারণে সে দুনিয়াতে সঠিক পথ খুঁজে পায়নি। ফলে আখেরাতেও সে অন্ধ হয়ে উঠবে (ত্বোয়াহা ২০/১২৪) এবং আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত হবে (ঐ, ১২৬)।
(২৮) وَكَذَّبُوْا بِآيَاتِنَا كِذَّابًا অর্থ وكذبوا بآياتنا تكذبباً ‘তারা আমাদের আয়াত সমূহে পুরোপুরি মিথ্যারোপ করেছিল’। আল্লাহ প্রেরিত কিতাব এবং নবীদের হেদায়াতসমূহকে তারা অগ্রাহ্য করেছিল।
آيات অর্থ কুরআনের আয়াতসমূহ এবং আল্লাহর সৃষ্টি ও নিদর্শনসমূহ- যা সৃষ্টিকর্তার প্রমাণ হিসাবে মানুষের সামনে মওজুদ রয়েছে। মনের চোখ দিয়ে দেখলে যেকোন জ্ঞানী ব্যক্তি যেকোন সৃষ্টির মধ্যে সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর নিদর্শনসমূহ দেখতে পাবেন। যেমন শিল্পের মধ্যে শিল্পীর নিদর্শন ফুটে ওঠে। কিন্তু বস্ত্তবাদী মানুষ অন্যায় যিদ ও হঠকারিতা বশে আল্লাহ ও আখেরাতকে সর্বদা মিথ্যা প্রতিপন্ন করার অপচেষ্টা করে থাকে।
শয়তানী প্ররোচনায় মানুষ একসময় আল্লাহকে অস্বীকার করে বসে। হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, يَأْتِى الشَّيْطَانُ أَحَدَكُمْ فَيَقُولُ مَنْ خَلَقَ كَذَا مَنْ خَلَقَ كَذَا حَتَّى يَقُولَ مَنْ خَلَقَ رَبَّكَ فَإِذَا بَلَغَهُ فَلْيَسْتَعِذْ بِاللهِ وَلْيَنْتَهِ- ‘শয়তান তোমাদের কারু কাছে এসে বলে, এটা কে সৃষ্টি করেছে? ওটা কে সৃষ্টি করেছে? অবশেষে সে বলে, তোমার প্রতিপালককে কে সৃষ্টি করেছে? যখন শয়তান এ পর্যন্ত পৌঁছে যায়, তখন সে যেন আল্লাহর নিকট আশ্রয় চায় এবং ঐ ব্যক্তির সাথে তর্ক করা থেকে বিরত হয়’। অন্য বর্ণনায় এসেছে সে যেন বলে, ‘আমি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলগণের উপরে বিশ্বাস স্থাপন করেছি।[8]
ওছমান বিন আবুল ‘আছ (রাঃ)-এর বর্ণনায় এসেছে রাসূল (ছাঃ) বলেন, মনের মধ্যে শয়তানের খটকা বুঝতে পারলে সাথে সাথে আল্লাহর আশ্রয় গ্রহণ করে আঊযুবিল্লাহ পড়বে ও বাম দিকে তিনবার থুক মারবে। তাতে শয়তান চলে যাবে’।[9] সকল যুগের নাস্তিক ও বস্ত্তবাদীরা মানবরূপী শয়তান হিসাবে অন্য মানুষকে আল্লাহ ও আখেরাত থেকে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য নানারূপ তর্ক ও ধোঁকার ধূম্রজাল সৃষ্টি করে থাকে। এদের বক্তব্য ও লেখনী থেকে দূরে থাকাই নিরাপদ।
(২৯) وَكُلَّ شَيْءٍ أَحْصَيْنَاهُ كِتَاباً ‘আর আমরা তাদের সকল কর্ম গণে গণে লিপিবদ্ধ করেছি’।
এখানে كُلَّ যবরযুক্ত হয়েছে উহ্য ক্রিয়ার কর্ম হিসাবে। الْحَصٰي অর্থ ‘কংকর’। সেখান থেকে أَحْصٰي يُحْصِيْ إِحْصَاءً ‘গণনা করা’। যেমন أَحْصَيْنَا كُلَّ شَيْءٍ ‘আমরা সবকিছু গণনা করেছি’। এক্ষণে আয়াতের অর্থ দাঁড়াবে كَتَبْنَاهُ كِتَابًا ‘আমরা কিতাবে অর্থাৎ আমলনামায় সেগুলি লিপিবদ্ধ করেছি’। প্রত্যেক বান্দার জন্য লেখক ফেরেশতা নিযুক্ত রয়েছে। যারা সর্বাবস্থায় বান্দার ভাল-মন্দ সকল কর্ম লিপিবদ্ধ করে থাকে’ (ইনফিত্বার ৮২/১০-১১)। আর আল্লাহ কোন অবস্থায় বান্দা থেকে গাফেল থাকেন না (বাক্বারাহ ২/৭৪, ৮৫ প্রভৃতি)। তিনি বলেন, إِذْ يَتَلَقَّى الْمُتَلَقِّيَانِ عَنِ الْيَمِيْنِ وَعَنِ الشِّمَالِ قَعِيدٌ- مَا يَلْفِظُ مِنْ قَوْلٍ إِلاَّ لَدَيْهِ رَقِيبٌ عَتِيدٌ- ‘স্মরণ রেখ, দু’জন ফেরেশতা তার ডানে ও বামে বসে তার কর্মসমূহ লিপিবদ্ধ করে’। ‘মানুষ যে কথাই মুখে উচ্চারণ করে, তা লিপিবদ্ধ করার জন্য তৎপর প্রহরী তার নিকটেই সদা প্রস্ত্তত রয়েছে’ (ক্বাফ ৫০/১৭-১৮)।
(৩০) فَذُوْقُوْا فَلَنْ نَّزِيْدَكُمْ إِلاَّ عَذَاباً ‘অতএব তোমরা স্বাদ আস্বাদন কর। আর আমরা এখন তোমাদের কিছুই বৃদ্ধি করব না কেবল শাস্তি ব্যতীত’।
জাহান্নামীদের শাস্তিদান বিষয়ে এটি কুরআনের সম্ভবতঃ সর্বাধিক ভীতিকর আয়াত। কেননা এখানে বলা হয়েছে যে, আমরা জাহান্নামীদের কেবল শাস্তিই বৃদ্ধি করব। তাদের প্রতি কখনোই কোনরূপ দয়া বা শিথিলতা প্রদর্শন করব না। তাদের আযাব কেমন হবে, সে বিষয়ে আল্লাহ বলেন,إِذِ الْأَغْلاَلُ فِيْ أَعْنَاقِهِمْ وَالسَّلاَسِلُ يُسْحَبُوْنَ، فِيْ الْحَمِيْمِ ثُمَّ فِيْ النَّارِ يُسْجَرُوْنَ- ‘যখন বেড়ী ও শৃংখল তাদের গলদেশে পরিয়ে তাদেরকে টেনে নিয়ে যাওয়া হবে’। ‘ফুটন্ত পানিতে, অতঃপর তাদেরকে আগুনে জ্বালানো হবে’ (মুমিন ৪০/৭১-৭২)। অন্যত্র আল্লাহ বলেন,
إِنَّ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا بِآيَاتِنَا سَوْفَ نُصْلِيهِمْ نَاراً كُلَّمَا نَضِجَتْ جُلُوْدُهُمْ بَدَّلْنَاهُمْ جُلُوْداً غَيْرَهَا لِيَذُوْقُوا الْعَذَابَ إِنَّ اللهَ كَانَ عَزِيْزًا حَكِيْمًا-
‘যারা আমাদের আয়াতসমূহকে অস্বীকার করে, সত্বর আমরা তাদেরকে জাহান্নামে প্রবেশ করাবো। যেখানে তাদের দেহের চামড়াগুলো যখনই জ্বলে-পুড়ে নিঃশেষ হবে, তখনই অন্য চামড়া দিয়ে তা বদলে দেব। যাতে তারা শাস্তি আস্বাদন করতে পারে। নিশ্চয়ই আল্লাহ মহা পরাক্রান্ত ও প্রজ্ঞাময়’ (নিসা ৪/৫৬)। এভাবেই চলতে থাকবে চিরকাল। এগুলো হবে স্রেফ তাদের অবাধ্যতা ও দুষ্কর্মের মর্মান্তিক প্রতিফল।
২৭ ও ২৮ আয়াতে জাহান্নামীদের নষ্ট আক্বীদার বর্ণনা দেওয়া হয়েছে এবং ২৯ ও ৩০ আয়াতে তাদের অন্যায় কর্মের মন্দ ফলাফল বিবৃত হয়েছে। আল্লাহ বলেন, أَفَحَسِبْتُمْ أَنَّمَا خَلَقْنَاكُمْ عَبَثاً وَّأَنَّكُمْ إِلَيْنَا لاَ تُرْجَعُوْنَ ‘তোমরা কি ভেবেছ যে, আমরা তোমাদেরকে অনর্থক সৃষ্টি করেছি এবং তোমরা আমাদের কাছে ফিরে আসবে না’? (মুমিনূন ২৩/১১৫)। আমাদেরকে অবশ্যই আমাদের প্রভুর কাছে ফিরে যেতে হবে এবং জীবনের সকল হিসাব পেশ করতে হবে। অতএব জ্ঞানীগণ সাবধান! যেন ক্বিয়ামতের দিন আমাদের লজ্জিত হ’তে না হয়। আল্লাহ বলেন,
وَيَوْمَ يَعَضُّ الظَّالِمُ عَلَى يَدَيْهِ يَقُولُ يَا لَيْتَنِيْ اتَّخَذْتُ مَعَ الرَّسُوْلِ سَبِيْلاً -يَا وَيْلَتَى لَيْتَنِيْ لَمْ أَتَّخِذْ فُلاَنًا خَلِيْلاً- لَقَدْ أَضَلَّنِيْ عَنِ الذِّكْرِ بَعْدَ إِذْ جَاءَنِيْ وَكَانَ الشَّيْطَانُ لِلْإِنْسَانِ خَذُوْلاً- وَقَالَ الرَّسُولُ يَا رَبِّ إِنَّ قَوْمِي اتَّخَذُوا هَذَا الْقُرْآنَ مَهْجُورًا-
‘যেদিন যালেম ব্যক্তি নিজের দু’হাত কামড়ে বলবে, হায়! যদি আমি (দুনিয়াতে) রাসূলের সাথে সৎপথ অবলম্বন করতাম’! ‘হায় দুর্ভোগ! যদি আমি অমুককে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করতাম’। ‘আমাকে তো সে বিভ্রান্ত করেছিল আমার নিকটে উপদেশ (কুরআন) আসার পরে। বস্ত্ততঃ শয়তান মানুষের জন্য মহাপ্রতারক’। ‘রাসূল সেদিন বলবেন, হে আমার প্রতিপালক! আমার কওম এই কুরআনকে পরিত্যাগ করেছিল’ (ফুরক্বান ২৫/২৭-৩০)।
৪ (গ) ক্বিয়ামতের পর জান্নাতীদের পুরস্কার (৩১-৪০) :
২১-৩০ পর্যন্ত ১০টি আয়াতে জাহান্নামীদের শাস্তি বর্ণনা শেষে ৩১ থেকে ৪০ পর্যন্ত সূরার শেষ ১০টি আয়াতে জান্নাতীদের পুরস্কার বর্ণনা করা হয়েছে। কুরআনের অলৌকিক বর্ণনা রীতির অন্যতম হ’ল তার مَثَانِىْ রীতি অর্থাৎ পরপর বিপরীতমুখী বর্ণনা। ফলে যেখানেই ঈমানের বর্ণনা, তার পরেই আসে কুফরের বর্ণনা। যেখানেই জাহান্নামের শাস্তির বর্ণনা, তার পরেই আসে জান্নাতের পুরস্কারের বর্ণনা। এখানে সেই রীতিই অনুসৃত হয়েছে, যা কুরআনের শুরু থেকেই রয়েছে। বান্দা দুনিয়াতে যেসব বস্ত্তকে দেখে এবং যেগুলিকে সর্বাধিক আনন্দদায়ক মনে করে, সেগুলিকেই নমুনাস্বরূপ এখানে বর্ণনা করা হয়েছে। যাতে তারা সেদিকে আকৃষ্ট হয়। নইলে দুনিয়ার সর্বাধিক আকর্ষণীয় বস্ত্তও জান্নাতের কোন বস্ত্তর সাথে তুলনীয় নয়। জান্নাতের বস্ত্তসমূহ সম্পর্কে হাদীছে কুদসীতে আল্লাহ বলেন, أَعْدَدْتُ لِعِبَادِىَ الصَّالِحِيْنَ مَا لاَ عَيْنٌ رَأتْ وَلاَ أُذْنٌ سَمِعَتْ وَلاَ خَطَرَ عَلىَ قَلْب بَشَرٍ- ‘আমি আমার সৎকর্মশীল বান্দাদের জন্য (জান্নাতে) প্রস্ত্তত করে রেখেছি এমন সব আনন্দদায়ক বস্ত্ত, যা কোন চোখ কখনো দেখেনি, কোন কান কখনো শোনেনি এবং মানুষের কল্পনায় যা কখনো আসেনি’।[10] পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেন, فلاَ تَعْلَمُ نَفْسٌ مَّا أُخْفِيَ لَهُمْ مِّنْ قُرَّةِ أَعْيُنٍ جَزَاءً بِمَا كَانُوْا يَعْمَلُوْنَ- ‘কোন (ঈমানদার) ব্যক্তি জানে না তার সৎকর্মের পুরস্কার হিসাবে কি ধরনের চক্ষুশীতলকারী প্রতিদান সমূহ (আমার নিকটে) লুক্কায়িত রয়েছে’ (সাজদাহ ৩২/১৭)।
দুনিয়াতে শাস্তি ও পুরস্কার দু’ধরনের হয়ে থাকে। মনোগত ও বস্ত্তগত। আখেরাতেও অনুরূপ হবে। আলোচ্য সূরার শেষাংশে ৩১ হ’তে ৩৬ পর্যন্ত ৬টি আয়াতে পরকালে নেককার বান্দাদের জন্য বস্ত্তগত পুরস্কারের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। যেমন আল্লাহ বলেন,
(৩১) إِنَّ لِلْمُتَّقِيْنَ مَفَازاً ‘নিশ্চয়ই মুত্তাক্বীদের জন্য রয়েছে সফলতা’।
আল্লাহভীরু সৎকর্মশীল বান্দাগণ চোখের পলকে পুলছেরাত পার হ’তে সক্ষম হবেন। আর এটা হবে দুনিয়াতে তাদের আল্লাহর অবাধ্যতা হ’তে বিরত থাকার এবং তাঁর দেওয়া বিধান অনুযায়ী জীবন পরিচালনার অনন্য পুরস্কার। مَفَازٌ অর্থ موضع فوزٍ ونجاةٍ وخلاصٍ مما فيه اهلُ النار ‘সফলতা, মুক্তি ও দোযখবাসীদের শাস্তি সমূহ হ’তে মুক্ত স্থান’। এজন্য পানিশূন্য ময়দানকে مَفَازَةٌ বলা হয় (কুরতুবী)।
اَلتَّقْوَى অর্থ التوقى مما يكره ‘অপসন্দনীয় বস্ত্ত থেকে বিরত থাকা’। এর মূল ধাতু হ’ল وَقْوَى، وِقَايَةٌ، تُقَاةٌ যার অর্থ ‘বিরত থাকা’। واو -কে تاء করে تقوى করা হয়েছে। শারঈ অর্থে ‘ইসলাম’ বিরোধী কর্ম থেকে বিরত থাকা’। رَجُلٌ تَقِىٌّ অর্থ ভীরু ব্যক্তি। পারিভাষিক অর্থে ‘আল্লাহভীরু ব্যক্তি’। মুমিনের চাইতে মুত্তাক্বী এক দর্জা উপরে, যিনি নিজের সৎকর্ম সমূহের মাধ্যমে ও খালেছ দো‘আর মাধ্যমে আল্লাহর শাস্তি থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখেন (কুরতুবী)। মুত্তাক্বী ব্যক্তি লাগামবদ্ধ প্রাণীর ন্যায় নিয়ন্ত্রিত জীবন যাপন করেন। তিনি যা খুশী বলতে বা করতে পারেন না। তিনি সর্বদা অন্যায় ও অপসন্দনীয় কর্ম হ’তে বিরত থাকেন। কথিত আছে যে, একবার ওমর (রাঃ) উবাই ইবনু কা‘ব (রাঃ)-কে তাক্বওয়া সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, আপনি কি কখনো কাঁটা বিছানো পথে চলেছেন? তিনি বলেন, হ্যাঁ, চলেছি। উবাই (রাঃ) বললেন, কিভাবে চলেছেন? ওমর (রাঃ) বললেন, খুব সাবধানে কষ্টের সাথে চলেছি। উবাই (রাঃ) বললেন, فذلك التقوى ‘ওটাই হ’ল তাক্বওয়া’ (কুরতুবী, ইবনু কাছীর)।
(৩২) حَدَائِقَ وَأَعْنَاباً ‘রয়েছে উদ্যানসমূহ ও আঙ্গুর সমূহ’।
অর্থাৎ তাদের সফলতার প্রতিদান স্বরূপ রয়েছে খেজুর-আঙ্গুর ইত্যাদি ফল-ফলাদির বাগিচাসমূহ। এখানে আঙ্গুরসমূহ অর্থ আঙ্গুর বাগিচাসমূহ।
(৩৩) وَكَوَاعِبَ أَتْرَابًا ‘আর সমবয়সী কুমারীগণ’।
كَوَاعِبَ বহুবচন। একবচনে كَاعِبٌ অর্থ নবোদ্ভিন্ন তরুণী। الأتراب অর্থ الأقران فى السن ‘সমবয়সী’। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ক্বিয়ামতের দিন পুরুষ ও নারী সকলের বয়স ৩০ বা ৩৩ বছরের হবে।[11] হযরত আয়েশা ছিদ্দীকা (রাঃ) বলেন, একদিন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) গৃহে প্রবেশ করলেন। তখন এক বৃদ্ধা আমার নিকটে বসা ছিল। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ইনি কে? আমি বললাম, উনি সম্পর্কে আমার খালা হন। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, لاَ تَدْخُلُ الجنَّةَ عَجُوْزٌ ‘কোন বৃদ্ধা জান্নাতে প্রবেশ করবে না’। একথা শুনে বৃদ্ধা কাঁদতে লাগল। আয়েশা (রাঃ) এই খবর গিয়ে জানালে রাসূল (ছাঃ) তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন যে, ঐ সময় সকল নর-নারী যৌবনপ্রাপ্ত হবে।[12] এর মধ্যে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)-এর বাক্যরসের প্রমাণ পাওয়া যায়। অতঃপর রাসূল (ছাঃ) আয়াত পাঠ করলেন, إِنَّا أَنْشَأْنَاهُنَّ إِنْشَاءً، فَجَعَلْنَاهُنَّ أَبْكَاراً ‘আমরা জান্নাতী রমণীদের সৃষ্টি করেছি বিশেষরূপে’। ‘আমরা তাদেরকে তৈরী করেছি কুমারী হিসাবে’।[13]
অন্য আয়াতে এই নারীদের ‘হূর’ (حُوْرٌ) বলা হয়েছে (রহমান ৫৫/৭২; ওয়াকি‘আহ ৫৬/২২)।
প্রশ্ন হ’তে পারে যে, কুরআনে পুরুষদের জন্য হূর দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু নারীদের জন্য কি দেওয়া হবে, তা বলা হয়নি, এর কারণ কি? উত্তর এই যে, পুরুষেরা নারীদের প্রতি অধিক আসক্ত (Active) বিধায় তাদের কথাটাই বলা হয়েছে গুরুত্ব দিয়ে। নইলে পুরুষ ও নারী প্রত্যেকে তাদের চাহিদামতে সবকিছু জান্নাতে পাবে (হা-মীম সাজদাহ ৪১/৩১)।
(৩৪) وَكَأْساً دِهَاقاً ‘এবং পূর্ণ পানপাত্র’।
كَأْسًا অর্থ পেয়ালা যা জান্নাতী শরাবের জন্য তৈরীকৃত। دِهَاقًا অর্থ পরিপূর্ণ ও স্বচ্ছ, যা বারবার ঝালিয়ে পরিছন্ন করা হয়। أدهقتُ الكأسَ أى ملأتُها অর্থ ‘আমি পেয়ালা ভালভাবে পূর্ণ করেছি’। এক্ষণে كَأْساً دِهَاقاً অর্থ كأس خمر ذات دهاقٍ ‘শরাবপাত্র, যা পরিপূর্ণ’। নিঃসন্দেহে সেই শরাবের স্বাদ-গন্ধ ও কার্যকারিতা দুনিয়ার শরাবের মত হবে না। বরং তা জান্নাতী ব্যক্তিকে নিষ্কাম আনন্দে উদ্বুদ্ধ করবে।
(৩৫) لاَ يَسْمَعُوْنَ فِيْهَا لَغْواً وَّلاَ كِذَّاباً ‘তারা সেখানে কোনরূপ অনর্থক ও মিথ্যা কথা শুনবে না’।
অর্থাৎ জান্নাতী শরাব পান করার ফলে তাদের জ্ঞান ও বিচারবুদ্ধিতে কোন তারতম্য হবে না এবং তারা কোনরূপ বাজে ও অনর্থক কথা বলবে না। যেরূপ দুনিয়াতে শরাব পানের ফলে হয়ে থাকে। তারা সেখানে পরস্পরে মিথ্যারোপ করবে না। অন্য আয়াতে বলা হয়েছে, لاَ لَغْوٌ فِيْهَا وَلاَ تَأْثِيْمٌ ‘সেখানে কোন বেফায়দা কথা নেই বা (মিথ্যাচারের) পাপ নেই’ (তূর ৫২/২৩)। বরং জান্নাত হ’ল ‘দারুস সালাম’ বা ‘শান্তির নীড়’। আল্লাহ বলেন, لَهُمْ دَارُ السَّلاَمِ عِنْدَ رَبِّهِمْ وَهُوَ وَلِيُّهُمْ بِمَا كَانُوا يَعْمَلُوْنَ ‘তাদের জন্য তাদের প্রতিপালকের নিকট রয়েছে শান্তির গৃহ। আর তিনিই তাদের অভিভাবক তাদের সৎকর্মের কারণে’ (আন‘আম ৬/১২৭)। সেখানে সকল কথা ও কাজ হবে ত্রুটিমুক্ত। তিনি বলেন, لاَ يَسْمَعُوْنَ فِيْهَا لَغْواً وَلاَ تَأْثِيْماً، إِلاَّ قِيْلاً سَلاَماً سَلاَماً ‘সেখানে কেউ কোন অনর্থক ও পাপের কথা শুনবে না’। ‘কেবলই শুনবে সালাম আর সালাম (শান্তি আর শান্তি)’। (ওয়াক্বি‘আহ ৫৬/২৫-২৬)।
(৩৬) جَزَاءً مِّنْ رَّبِّكَ عَطَاءً حِسَاباً ‘এটা তোমার প্রভুর পক্ষ হ’তে যথোচিত প্রতিদান’। অর্থাৎ উপরে বর্ণিত পুরস্কারসমূহ তোমার প্রভুর পক্ষ হ’তে তার নেক বান্দাদের জন্য সৎকর্মের বস্ত্তগত প্রতিদান। আয়াতে বর্ণিত عَطَاءً ও حِسَاباً একই অর্থ বদলা ও দান।
حِسَابًا অর্থ كثيرًا বহু বা পরিপূর্ণ। যেমন আরবগণ বলে থাকেন, أعْطانى فأحسبنى ‘তিনি আমাকে দান করলেন, অতঃপর পরিপূর্ণ করে দিলেন’। أحسبت فلانا অর্থ كثَّرت له العطاءَ ‘আমি তাকে বেশী করে দান করলাম’। حَسْبِىَ اللهُ অর্থ اللهُ كَافِىٌّ لِىْ ‘আল্লাহ আমার জন্য যথেষ্ট’।
বাক্যের শুরুতে جَزَاءً উহ্য ক্রিয়ার মাছদার হওয়ায় যবরযুক্ত হয়েছে। এক্ষণে আয়াতে বর্ণিত বাক্যের পূর্ণ রূপ হ’ল- جزاهم جزاءً من ربك جزاءً حسابًا أى كَافِيًا وَافرًا ‘তোমার পালনকর্তার পক্ষ হ’তে তাদের বদলা দেওয়া হবে বেশী করে পরিপূর্ণরূপে’। এই পুরস্কার কত হবে সে বিষয়ে কুরআনে প্রতিটি নেক আমলের জন্য ১০ গুণ (আন‘আম ৬/১৬০), ৭০০ গুণ (বাক্বারাহ ২/২৬১) এমনকি কারু কারু ক্ষেত্রে ‘বেহিসাব’ (যুমার ৩৯/১০) নেকীর কথা বলা হয়েছে। এটা সৎকর্মের মান হিসাবে (حسب أعمالهم) সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর এখতিয়ারাধীন বিষয়। তাঁকে বাধ্য করার কেউ নেই এবং তিনি কোন নিয়মের বাধ্য নন। ‘তিনি যাকে যত খুশী পুরস্কার দিয়ে থাকেন’ (বাক্বারাহ ২/২৬১)।
(৩৭) رَبِّ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَمَا بَيْنَهُمَا الرحْمَنِ لاَ يَمْلِكُوْنَ مِنْهُ خِطَاباً ‘যিনি আসমান ও যমীন এবং এতদুভয়ের মধ্যবর্তী সবকিছুর পালনকর্তা, দয়াময়। কেউ তাঁর সাথে কথা বলার ক্ষমতা রাখে না’।
অত্র আয়াতে অবিশ্বাসীদের জন্য মানসিক আযাবের খবর দেওয়া হয়েছে। মুমিনগণ আল্লাহর অনুমতিক্রমে তাঁর সাথে কথা বলতে পারবেন (হূদ ১১/১০৫) কিংবা কারু জন্য সুফারিশ করতে পারবেন (বাক্বারাহ ২/২৫৫; ত্বোয়াহা ২০/১০৯)। কিন্তু কাফির-মুশরিক ও মুনাফিকদের এই সুযোগ দেওয়া হবে না। এমনকি তাদের চোখ অন্ধ করে দেওয়া হবে (ইসরা ১৭/৭২; ত্বোয়াহা ২০/১২৪) এবং তারা আল্লাহকে সামনা-সামনি দেখার মহা সৌভাগ্য হ’তে বঞ্চিত হবে। যেমন আল্লাহ বলেন, كَلاَّ إِنَّهُمْ عَنْ رَبِّهِمْ يَوْمَئِذٍ لَمَحْجُوْبُوْنَ ‘কখনোই না। তারা সেদিন তাদের প্রতিপালক হ’তে পর্দার অন্তরালে থাকবে’ (মুত্বাফফিফীন ৮৩/১৫)। আল্লাহ্কে দেখার মত সৌভাগ্য হ’তে বঞ্চিত হওয়া ও তাঁকে সামনে পেয়েও কথা বলার ও নিজের অসহায়ত্ব প্রকাশ করে ক্ষমা প্রার্থনার সুযোগ থেকে মাহরূম হওয়া এবং তার জন্য কারু কোন সুফারিশ করার এখতিয়ার না থাকার চাইতে মর্মান্তিক কোন মানসিক শাস্তি আর হ’তে পারে কি? আল্লাহ আমাদের রক্ষা করুন!
(৩৮) يَوْمَ يَقُوْمُ الرُّوْحُ وَالْمَلآئِكَةُ صَفاًّ لاَّ يَتَكَلَّمُوْنَ إِلاَّ مَنْ أَذِنَ لَهُ الرحْمَنُ وَقَالَ صَوَاباً ‘যেদিন রূহ ও ফেরেশতাগণ সারিবদ্ধভাবে দাঁড়াবে। দয়াময় আল্লাহ যাকে অনুমতি দিবেন সে ব্যতীত কেউ কথা বলতে পারবে না এবং সে সঠিক কথা বলবে’।
এখানে ‘কথা বলতে পারবে না’ অর্থ সুফারিশ করতে পারবে না। যেমন অন্যত্র আল্লাহ বলেন, مَنْ ذَا الَّذِي يَشْفَعُ عِنْدَهُ إِلاَّ بِإِذْنِهِ ‘কে আছে যে আল্লাহর নিকট সুফারিশ করবে, তাঁর অনুমতি ব্যতীত’? (বাক্বারাহ ২/২৫৫)। অতঃপর وَقَالَ صَوَابًا ‘সে সঠিক কথা বলবে’ অর্থ লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলবে। অর্থাৎ ঐদিন সুফারিশ হবে ঐ ব্যক্তির জন্য, যে ব্যক্তি দুনিয়াতে খাঁটি মনে তাওহীদের স্বীকৃতি দিয়েছে।
অত্র আয়াতের শেষাংশে ঐ সকল লোকদের জন্য মানসিক প্রশান্তি ও বিশেষ অনুগ্রহের কথা বলা হয়েছে, إِلاَّ مَنْ أَذِنَ لَهُ الرحْمَنُ ‘যাদেরকে আল্লাহ তাঁর সঙ্গে কথা বলার অনুমতি দিবেন’। নিঃসন্দেহে তারা হবেন ঐ সকল ভাগ্যবান ঈমানদার ব্যক্তি, যারা দুনিয়াতে আল্লাহর উপরে সর্বাবস্থায় দৃঢ় বিশ্বাস পোষণ করতেন। এটা হবে তাদের জন্য জান্নাতে প্রদত্ত বস্ত্তগত পুরস্কারের বাইরে বাড়তি মানসিক প্রশান্তির পুরস্কার।
আয়াতে বর্ণিত ‘রূহ’ (اَلرُّوْحُ) শব্দের ব্যাখায় বিদ্বানগণের পক্ষ হ’তে আট প্রকারের বক্তব্য এসেছে। ইবনু আববাস (রাঃ) বলেছেন, বনু আদমের রূহসমূহ। শা‘বী, যাহহাক প্রমুখ বলেছেন, জিব্রীল। কেউ বলেছেন, কুরআন। কিন্তু ইবনু জারীর ত্বাবারী কোনটিতেই নিশ্চিন্ত হ’তে পারেননি। ইবনু কাছীর বলেন, والأشبه- والله أعلم- أنهم بنوآدم ‘সর্বাধিক সামঞ্জস্যপূর্ণ অর্থ হ’ল- বনু আদম। তবে আল্লাহ ভাল জানেন’ (ইবনু কাছীর)। অর্থাৎ ঐদিন ফেরেশতা ও ঈমানদার আদম সন্তানগণ সারিবদ্ধভাবে দাঁড়াবে আল্লাহর সম্মুখে।
(৩৯) ذَلِكَ الْيَوْمُ الْحَقُّ فَمَنْ شَآءَ اتَّخَذَ إِلَى رَبِّهِ مَآباً ‘সে দিবস সুনিশ্চিত। অতঃপর যে ব্যক্তি ইচ্ছা করে, সে তার পালনকর্তার প্রতি ঠিকানা নির্ধারণ করুক’।
ذَلِكَ الْيَوْمُ الْحَقُّ অর্থ الكائن الواقع لامحالة ‘যা অবশ্যই সংঘটিত হবে, যে দিবসে কোনরূপ সন্দেহ নেই’। ‘অতঃপর যে ব্যক্তি ইচ্ছা করে সে তার নেক আমলের মাধ্যমে স্বীয় প্রভুর কাছে ঠিকানা নির্ধারণ করুক’। আল্লাহ বলেন, وَاتَّقُوْا يَوْمًا تُرْجَعُوْنَ فِيْهِ إِلَى اللهِ ثُمَّ تُوَفَّى كُلُّ نَفْسٍ مَا كَسَبَتْ وَهُمْ لاَ يُظْلَمُوْنَ- ‘তোমরা ভয় কর সেইদিনকে, যেদিন তোমরা ফিরে যাবে আল্লাহর কাছে। অতঃপর প্রত্যেক ব্যক্তি তার আমল অনুযায়ী যথাযথ বদলা পাবে এবং তাদের উপর কোনরূপ যুলুম করা হবে না’ (বাক্বারাহ ২/২৮১)।
‘জান্নাতে’ ঠিকানা নির্ধারণের কথা না বলে ‘তার পালনকর্তার প্রতি ঠিকানা নির্ধারণ করুক’ বলার মধ্যে এ বিষয়ে ইঙ্গিত রয়েছে যে, আল্লাহর সন্তুষ্টিই হ’ল প্রধান কাম্য। জান্নাত হ’ল তার ফলাফল মাত্র। অতএব বান্দাকে সর্বদা আল্লাহর সন্তুষ্টি হাছিলের উদ্দেশ্যে কাজ করতে হবে। কেননা শুধুমাত্র আমলের মাধ্যমে কেউ জান্নাত পাবে না আল্লাহর রহমত ব্যতীত।[14]
(৪০) إِنَّا أَنْذَرْنَاكُمْ عَذَاباً قَرِيْباً يوْمَ يَنْظُرُ الْمَرْءُ مَا قَدَّمَتْ يَدَاهُ وَيَقُوْلُ الْكَافِرُ يَا لَيْتَنِيْ كُنْتُ تُرَابًا ‘আমরা তোমাদেরকে আসন্ন শাস্তি সম্পর্কে সতর্ক করলাম। যেদিন মানুষ প্রত্যক্ষ করবে যা সে অগ্রিম প্রেরণ করেছে এবং অবিশ্বাসী ব্যক্তি বলবে, হায়! আমি যদি মাটি হ’তাম!
এখানে عَذَاباً قَرِيْباً ‘আসন্ন আযাব’ বলার কারণ ক্বিয়ামত নিশ্চিতভাবেই আসবে সেটা বুঝানো। কেননা যেটা নিশ্চিত, অথচ সেটা কখন কোন মুহূর্তে হবে সেটা অনিশ্চিত, এমন বিষয়কে আসন্ন হিসাবেই গণ্য করা হয়ে থাকে। অতএব ‘আসন্ন আযাব’ অর্থ ‘আখেরাতের আযাব’। আর তা হ’ল মৃত্যু ও ক্বিয়ামত। কেননা من مات فقد قامت قيامته ‘যে ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করল, তার ক্বিয়ামত শুরু হয়ে গেল’। মৃত্যুর পরেই তার চোখের পর্দা খুলে যায় এবং আখেরাতের দৃশ্যাবলী তার সামনে স্পষ্ট হয়ে যায় (ক্বাফ ৫০/২২)। এ কারণেই মৃত্যুকে ‘ক্বিয়ামতে ছুগরা’ (القيامة الصغرى) বা ছোট ক্বিয়ামত বলা হয়। অত্র আয়াতে পুনরুত্থান বিষয়ে কাফেরদের অবিশ্বাসের কঠোর প্রতিবাদ করা হয়েছে।
يَوْمَ يَنْظُرُ الْمَرْءُ مَا قَدَّمَتْ يَدَاهُ অর্থাৎ যেদিন মানুষ তার ভাল-মন্দ ছোট-বড় সব আমল তার সামনে উপস্থিত দেখবে এবং আগে-পিছের সবকিছুই সামনে প্রত্যক্ষ করবে (কাহফ ১৮/৪৯; ক্বিয়ামাহ ৭৫/১৩)।
وَيَقُوْلُ الْكَافِرُ يَا لَيْتَنِيْ كُنْتُ تُرَابًا অর্থাৎ কাফেররা বলবে হায়! যদি আমরা দুনিয়াতে মাটি হয়ে থাকতাম এবং মানুষ হিসাবে সৃষ্ট না হ’তাম। আখেরাতে আল্লাহর সূক্ষ্ম ন্যায়বিচার দেখে এবং অবিশ্বাসীদের মর্মান্তিক পরিণতি দেখে তারা ভীত-বিহবল হয়ে এসব কথা বলবে। দুনিয়াতে থাকতে তারা পুনরুত্থানকে বিশ্বাস করেনি। তাই যা খুশী তাই করেছে। কিন্তু এখন তাদের হুঁশ ফিরবে। যদিও তখন তা কোন কাজে আসবে না। ফলে আফসোস ব্যতীত তাদের আর কিছুই করার থাকবে না। আল্লাহ বলেন, قُلْ يَوْمَ الْفَتْحِ لاَ يَنْفَعُ الَّذِينَ كَفَرُوْا إِيمَانُهُمْ وَلاَ هُمْ يُنْظَرُوْنَ ‘বিচার দিবসে অবিশ্বাসীদের বিশ্বাস স্থাপন কোন কাজে আসবে না এবং তাদেরকে কোনরূপ অবকাশ দেওয়া হবে না’ (সাজদাহ ৩২/২৯)। অন্যত্র আল্লাহ বলেন, وَمَا هُمْ بِخَارِجِيْنَ مِنَ النَّارِ ‘আর তারা জাহান্নাম থেকে বের হ’তে পারবেনা’। (বাক্বারাহ ২/১৬৭)।
হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেছেন যে, ক্বিয়ামতের দিন পশু-পক্ষী সবকিছুকে পুনর্জীবিত করা হবে। অতঃপর তাদের পারস্পরিক অধিকার আদায় ও নির্যাতনের প্রতিশোধ নেয়া হবে। এমনকি শিংবিহীন ছাগলের উপর শিংওয়ালা ছাগলের অত্যাচারের প্রতিশোধ নেওয়া হবে। এভাবে বিচার সমাপ্ত হ’লে আল্লাহ বলবেন, كُونِي تُرَابًا ‘তোমরা সব মাটি হয়ে যাও’। তখন সব মাটি হয়ে যাবে। এ দৃশ্য দেখে কাফেররা আক্ষেপ করে বলবে, يَا لَيْتَنِىْ كُنْتُ تُرَابًا ‘হায় যদি আমি মাটি হয়ে যেতাম? তাহলে জাহান্নামের কঠিন শাস্তি হতে বেঁচে যেতাম’।[15] পশু-পক্ষীর বিচারের বিষয়টি কাফেরদের ভয় দেখানোর উদ্দেশ্যে প্রতীকী বিচার হতে পারে। কেননা তাদের জন্য শারঈ বিধান মান্য করার কোন বাধ্যবাধ্যকতা নেই।
এক্ষণে আয়াতের মর্মার্থ হ’তে পারে তিন প্রকারের। ১. দুনিয়াতে মাটি হয়েই থাকতাম এবং মানুষ হয়ে সৃষ্টি না হ’তাম! ২. মাটি হয়ে কবরেই থাকতাম। পুনরুত্থিত না হতাম! ৩. ক্বিয়ামতের দিন পশু-পক্ষীর বিচার শেষে মাটি হয়ে যাবার ন্যায় আমিও যদি মাটি হয়ে যেতাম! আল্লাহ আমাদের রক্ষা করুন- আমীন!
সারকথা :
আত্মভোলা মানুষকে পুনরুত্থান ও বিচার দিবস সস্পর্কে সতর্ক করা। অতএব اَلنَّبَأُ الْعَظِيْمُ বা মহা সংবাদ হ’ল ক্বিয়ামত অর্থাৎ মৃত্যুর পরে পুনরুত্থান দিবসের সংবাদ। আর এই ‘মহা সংবাদ’-এর ঘোষণা এবং হুঁশিয়ারী দিয়েই কুরআনের ৩০তম পারা সূরা ‘আম্মা’ দিয়ে তার যাত্রা শুরু করল।[1]. মুস্তাদরাকে হাকেম হা/৩৬০৬; ইবনে কাছীর, সূরা ইয়াসীন ৭৮ নং আয়াতের ব্যাখ্যা দ্রঃ।
[2]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/২৩৮২, ২৩৮৪; বুখারী হা/৬৩২৪।
[3]. বুখারী হা/৪৯৩৫, মুসলিম হা/২৯৫৫, মিশকাত হা/৫৫২১।
[4]. বুখারী হা/৩৪৯, মুসলিম হা/১৬৩, মিশকাত হা/৫৮৬৪।
[5]. বুখারী হা/৩৮৪১, মুসলিম হা/২২৫৬, মিশকাত হা/৪৭৮৬ ‘বক্তৃতা ও কবিতা’ অনুচ্ছেদ।
[6]. বুখারী হা/৭৪৩৯, মুসলিম হা/১৮৩, মিশকাত হা/৫৫৭৯ ‘হাউয ও শাফা‘আত’ অনুচ্ছেদ-৪।
[7]. আহযাব ৩৩/৬৪; যুমার ৩৯/৭১-৭২; তাগাবুন ৬৪/১০; নিসা ৪/৪৮, ১১৬; মায়েদাহ ৫/৭২।
[8]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৬৫-৬৬ ‘ঈমান’ অধ্যায়, ‘মনের খটকা’ অনুচ্ছেদ।
[9]. মুসলিম হা/২২০৩, মিশকাত হা/৭৭।
[10]. বুখারী হা/৪৭৭৯, মুসলিম হা/২৮২৪; মিশকাত হা/৫৬১২ ‘ক্বিয়ামতের অবস্থা ও সৃষ্টির সূচনা’ অধ্যায়-২৮ ‘জান্নাত ও তার অধিবাসীদের বিবরণ’ অনুচ্ছেদ-৫।
[11]. তিরমিযী হা/২৫৪৫ ‘জান্নাত বাসীদের বয়স’ অনুচ্ছেদ, সনদ হাসান, মিশকাত হা/৫৬৩৯।
[12]. তিরমিযী হা/২৫৩৯।
[13]. ওয়াক্বি‘আহ ৫৬/৩৬-৩৭; শামায়েলে তিরমিযী হা/২০৫; সনদ হাসান; সিলসিলা ছহীহাহ হা/২৯৮৭; রাযীন, মিশকাত হা/৪৮৮৮ ‘শিষ্টাচার’ অধ্যায়-২৫ ‘রসিকতা’ অনুচ্ছেদ-১২।
[14]. মুসলিম হা/২৮১৬ ‘মুনাফিকদের বিবরণ’ অধ্যায়-৫০, অনুচ্ছেদ-১৭; মিশকাত হা/২৩৭২।
[15]. মুসলিম হা/২৫৮২, মিশকাত হা/৫১২৮; হাকেম হা/৩২৩১; সিলসিলা ছহীহাহ হা/১৯৬৬।