তাফসীরুল কুরআন - (৩০তম পারা)

সূরা যোহা

(পূর্বাহ্ন)

সূরা ফজরের পরে মক্কায় অবতীর্ণ।

সূরা ৯৩, আয়াত ১১, শব্দ ৪০, বর্ণ ১৬৪।

بِسْمِ اللہِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِیْمِ

পরম করুণাময় অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে (শুরু করছি)।

(১) শপথ পূর্বা ‡‎হ্নর,
وَالضُّحَى
(২) শপথ রাত্রির, যখন তা নিথর হয়;
وَاللَّيْلِ إِذَا سَجَى
(৩) তোমার পালনকর্তা তোমাকে পরিত্যাগ করেননি বা তোমার উপরে বিরূপ হননি।
مَا وَدَّعَكَ رَبُّكَ وَمَا قَلَى
(৪) নিশ্চয়ই পরকাল তোমার জন্য ইহকালের চাইতে শ্রেয়।
وَلَلْآخِرَةُ خَيْرٌ لَكَ مِنَ الْأُولَى
(৫) তোমার পালনকর্তা সত্বর তোমাকে দান করবেন। অতঃপর তুমি সন্তুষ্ট হয়ে যাবে।
وَلَسَوْفَ يُعْطِيكَ رَبُّكَ فَتَرْضَى
(৬) তিনি কি তোমাকে ইয়াতীমরূপে পাননি? অতঃপর তিনি আশ্রয় দিয়েছেন।
أَلَمْ يَجِدْكَ يَتِيمًا فَآوَى
(৭) তিনি তোমাকে পেয়েছিলেন পথ সম্পর্কে অনবহিত। অতঃপর তোমাকে পথ প্রদর্শন করেছেন।
وَوَجَدَكَ ضَالًّا فَهَدَى
(৮) তিনি তোমাকে পেয়েছিলেন নিঃস্ব। অতঃপর অভাবমুক্ত করেছেন।
وَوَجَدَكَ عَائِلًا فَأَغْنَى
(৯) অতএব তুমি ইয়াতীমের প্রতি কঠোর হবে না।
فَأَمَّا الْيَتِيمَ فَلَا تَقْهَرْ
(১০) এবং সাহায্যপ্রার্থীকে ধমকাবে না।
وَأَمَّا السَّائِلَ فَلَا تَنْهَرْ
(১১) অতঃপর তুমি তোমার পালনকর্তার অনুগ্রহের কথা বর্ণনা কর \
وَأَمَّا بِنِعْمَةِ رَبِّكَ فَحَدِّثْ

বিষয়বস্ত্ত :

এই সূরাতে দু’টি বিষয়বস্ত্ত রয়েছে। (১) দিবস ও রাত্রির কসম করে আল্লাহ বলছেন যে, তিনি তাঁর রাসূলের সাথে কখনোই সম্পর্কচ্ছেদ করেননি বা তাঁর প্রতি রুষ্ট হননি। বরং আশ্বাস রয়েছে এই মর্মে যে, পূর্বের চাইতে আগামীতে তাঁর প্রতি অনুগ্রহ এবং অহি-র অবতরণ আরও বৃদ্ধি পাবে এবং তাতে তিনি আরও খুশী হবেন (১-৫ আয়াত)।

(২) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর উপরে বিগত দিনে কৃত কয়েকটি অনুগ্রহের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে প্রমাণ পেশ করা হয়েছে যে, আগামী দিনেও তা অব্যাহত থাকবে। অতঃপর রাসূল (ছাঃ)-কে উক্ত নে‘মতসমূহের শুকরিয়া আদায়ের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে (৬-১১ আয়াত)।

গুরুত্ব :

একদা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মু‘আয বিন জাবালকে বলেন, তুমি কি ছালাতে সূরা আ‘লা, ফজর, শাম্স, লায়েল, যোহা পড়তে পারো না’? [1]

শানে নুযূল :

হযরত জুনদুব বিন আব্দুল্লাহ বিন সুফিয়ান আল-বাজালী (রাঃ) বলেন যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) অসুস্থতার কারণে দু’রাত বা তিনরাত তাহাজ্জুদের জন্য উঠতে পারেননি। তাতে জনৈকা মহিলা[2] এসে বলল,يَا مُحَمَّدُ مَا أَرَى شَيْطَانَكَ إِلاَّ قَدْ تَرَكَكَ  ‘হে মুহাম্মাদ! আমি মনে করি তোমার শয়তানটা তোমাকে ছেড়ে গেছে’। তখন এই সূরাটি নাযিল হয়’।[3] উল্লেখ্য যে, জুনদুব বিন আব্দুল্লাহ (রাঃ) মাদানী ছাহাবী ছিলেন। এখানে বর্ণিত ঘটনাটি মক্কার। তিনি এটি অন্য ছাহাবী থেকে শুনে বর্ণনা করে থাকবেন। হাদীছের পরিভাষায় একে ‘মুরসাল ছাহাবী’ বলা হয়। যা গ্রহণযোগ্য। কেননা হাদীছ বর্ণনার ক্ষেত্রে সকল ছাহাবী ন্যায়নিষ্ঠ।

একটি প্রথা :

ক্বিরাআত শাস্ত্রের ইমাম বলে খ্যাত আবুল হাসান আহমাদ বিন মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহ ইবনু কাছীর আবু বাযা আল-মুক্বরী হ’তে একক সূত্রে বর্ণিত একটি প্রথা এই যে, সূরা যোহা থেকে আম্মাপারার সর্বশেষ সূরা নাস পর্যন্ত ক্বারী প্রতিটি সূরা শেষে ‘আল্লাহু আকবর’ বলবেন। কেউ বলেছেন ঐ সাথে যোগ করবেন ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু আল্লাহু আকবর’। কেউ বলেছেন, সূরা লায়েল-এর শেষ থেকে তাকবীর বলতে হবে।[4]

ক্বারীগণ বলে থাকেন, সাময়িক বিরতি শেষে জিব্রীল যখন এই সূরাটি নিয়ে আগমন করেন এবং শেষ পর্যন্ত পাঠ করেন, তখন আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) খুশীতে ‘আল্লাহু আকবর’ বলে ওঠেন’। ইবনু কাছীর (রহঃ) বলেন, এই বর্ণনার পক্ষে তাঁরা কোন সনদ উল্লেখ করেননি, যার ভিত্তিতে ছহীহ বা যঈফ নির্ধারণ করা যেতে পারে (তাফসীর ইবনু কাছীর)[5]

ইমাম কুরতুবী বলেন, কুরআনের প্রতিটি সূরা, আয়াত ও বর্ণ মুতাওয়াতির যা অবিরত ধারায় বর্ণিত হয়েছে। তাতে কোনরূপ কমবেশী হওয়ার সুযোগ নেই। অতএব বর্ণিত ‘তাকবীর’ কখনোই কুরআনের অংশ নয়। ‘বিসমিল্লাহ’ যেখানে প্রতি সূরার শুরুতে প্রথম থেকেই লিখিত থাকা সত্ত্বেও তা কুরআনের অংশ নয়। তাহ’লে ‘তাকবীর’ কিভাবে কুরআনের অংশ হবে, যা লিখিত নেই? এটি এককভাবে বর্ণিত একটি প্রথা হিসাবে চালু হয়েছে, যা ক্বারী আব্দুল্লাহ ইবনু কাছীর পসন্দ করেছেন। তিনি এটাকে ওয়াজিব বলেননি, যা পরিত্যাগ করা অন্যায় হবে (কুরতুবী)। অতএব এই প্রথা থেকে বিরত থাকা আবশ্যক।

তাফসীর :

(১-২) وَالضُّحَى، وَاللَّيْلِ إِذَا سَجَى ‘শপথ পূর্বাহ্নের’। ‘শপথ রাত্রির, যখন তা নিথর হয়’।

আরবদের পরিভাষায় সূর্যোদয়ের স্বল্পকালীন পরবর্তী সময়কে ‘যোহা’ বলা হয় (কুরতুবী)। অনেকে পুরা দিবসকে ‘যোহা’ বলেছেন (কুরতুবী, ইবনু কাছীর, তানতাভী)। যেমন আল্লাহ বলেন, أَوَ أَمِنَ أَهْلُ الْقُرَى أَنْ يَّأْتِيَهُمْ بَأْسُنَا ضُحًى وَّهُمْ يَلْعَبُوْنَ- ‘আর জনপদের লোকেরা কি নিশ্চিন্ত হয়ে গেছে যে, তাদের উপর আমার আযাব এসে পড়বে দিনের বেলায়, যখন তারা থাকবে খেলাধুলায় মত্ত’ (আ‘রাফ ৭/৯৮)।

 سَجَا يَسْجُوْ سَجْوًا ‘রাত্রি নিথর হওয়া’।إِذَا سَجَى  অর্থ إذا سكن أهله وأصواتهم فيه ‘যখন এর অধিবাসীগণ ও তাদের আওয়াযসমূহ নীরব হয়ে যায়’ (তানতাভী)। অর্থাৎ রাত্রি যখন গভীর হয়। যেমন অন্যত্র আল্লাহ বলেন, وَجَعَلَ اللَّيْلَ سَكَنًا ‘এবং রাতকে করেছেন নিথর’ (আন‘আম ৬/৯৬)।

আল্লাহ এখানে সূর্য করোজ্জ্বল দিবসের এবং তার বিপরীত নিকষ কালো আঁধারে ঢাকা নিষুতি রাতের শপথ করার মাধ্যমে একদিকে যেমন তাঁর অসীম কুদরত ও ক্ষমতার পরিচয় তুলে ধরেছেন, অন্যদিকে তেমনি বান্দাকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে, তোমার শব্দমুখর যবান ও কর্মমুখর জীবনের যখন অবসান হবে, তখন নীরব ও নিঃশব্দ রাতের মত তোমার শক্তিহীন, শব্দহীন ও প্রাণহীন লাশটি পড়ে থাকবে অসহায়ভাবে দাফনের অপেক্ষায়। অতএব হে বান্দা! প্রতিদিন সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত এবং দিবস ও রাত্রির আগমন ও নির্গমন থেকে শিক্ষা নাও। মহাশক্তিধর আল্লাহকে ভয় কর ও তাঁর উপরে মিথ্যারোপ বন্ধ কর।

(৩) مَا وَدَّعَكَ رَبُّكَ وَمَا قَلَى ‘তোমার পালনকর্তা তোমাকে ত্যাগ করেননি বা তোমার উপরে বিরূপ হননি’।

অর্থাৎ কাফেরদের মিথ্যাচার ও অপপ্রচার অনুযায়ী তোমার প্রভু তোমাকে পরিত্যাগ করেননি বা তোমার উপরে রুষ্ট হননি। এখানে ইবনু আববাস ও ইবনু যুবায়ের (রাঃ) ‘তাশদীদ’ ছাড়াই مَا وَدَعَكَ পড়েছেন। যার অর্থ مَا تَرَكَكَ ‘তোমাকে পরিত্যাগ করেননি’। তবে অন্য সবাই ما وَدَّعَكَ তাশদীদযুক্ত পড়েছেন। যার অর্থ مَا قَطَعَكَ قَطْعَ المودِّع ‘তোমাকে ছাড়েননি বিদায় দানকারীর বিদায়ের ন্যায়’ (কুরতুবী)

وَماَ قلَى অর্থ وما أبغضك ‘তোমার প্রতি রুষ্ট হননি’। আসলে হওয়া উচিত ছিল وَمَا قَلاَكَ কিন্তু পূর্বের ক্রিয়ায় كَ উল্লেখিত হওয়ায় এবং আয়াতের শেষে হওয়ায় অলংকার শাস্ত্রের বিধি অনুযায়ী এখানে كَ কর্মপদ বিলুপ্ত করা হয়েছে। যেমন অন্য আয়াতে বলা হয়েছে, وَالذَّاكِرِيْنَ اللهَ كَثِيْراً وَّالذَّاكِرَاتِ ‘আল্লাহকে স্মরণকারী পুরুষ ও নারীগণ’ (আহযাব ৩৩/৩৫)। এখানে শেষে اللهَ কর্মপদ উল্লেখ করা হয়নি পূর্বে উল্লেখিত হওয়ার কারণে।

এ আয়াত নাযিলের মাধ্যমে রাসূল (ছাঃ)-কে এ বিষয়ে নিশ্চিত করা হয়েছে যে, যখন থেকে আল্লাহ তোমাকে ভালবেসেছেন এবং তোমার উপরে ‘অহি’ নাযিল শুরু হয়েছে, তখন থেকে আল্লাহ কখনোই তোমার উপরে রুষ্ট বা বিরূপ হননি। বরং সর্বদা তোমার উপরে তাঁর অনুগ্রহ বর্ষিত হ’তে থাকবে। দিবস ও রাত্রির শপথের মধ্যে এ গূঢ় রহস্য লুকিয়ে রয়েছে যে, যে রাসূল সারা দিন কঠিন বিরোধিতার মুখে তাওহীদের দাওয়াত দেন এবং রাতের বেলায় আল্লাহর সন্তুষ্টির নিমিত্তে তাহাজ্জুদের ছালাতে মগ্ন থাকেন, দয়ালু আল্লাহ কি কখনো সেই রাসূলকে পরিত্যাগ করতে পারেন?

(৪) وَلَلْآخِرَةُ خَيْرٌ لَّكَ مِنَ الْأُولَى ‘নিশ্চয় পরকাল তোমার জন্য ইহকালের চাইতে শ্রেয়।

এটি পৃথক বক্তব্য হিসাবে এসেছে এবং শুরুতে لام تاكيد এনে বাক্যটিকে নিশ্চয়তা বোধক করা হয়েছে। বলা হয়েছে যে, আখেরাত নিশ্চিতভাবে দুনিয়ার চাইতে উত্তম। কেননা আল্লাহ বলেন, أَعْدَدْتُ لِعِبَادِى الصَّالِحِيْنَ مَا لاَ عَيْنَ رَأَتْ، وَلاَ أُذُنَ سَمِعَتْ، وَلاَ خَطَرَ عَلَى قَلْبِ بَشَرٍ، فَلاَ تَعْلَمُ نَفْسٌ مَا أُخْفِيَ لَهُمْ مِنْ قُرَّةِ أَعْيُنٍ جَزَاءً بِمَا كَانُوا يَعْمَلُونَ ‘আমি আমার নেককার বান্দাদের জন্য এমন সব পুরস্কার প্রস্ত্তত করে রেখেছি, যা কোন চক্ষু কখনো দেখেনি, কর্ণ কখনো শোনেনি, মানুষের হৃদয় কখনো কল্পনা করেনি’। ‘কোন মানুষ জানেনা তার কৃতকর্মের পুরস্কার হিসাবে তার জন্য চক্ষু শীতলকারী কত বস্ত্ত লুক্কায়িত রয়েছে’।[6] রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, জান্নাতের একটি চাবুক রাখার স্থান দুনিয়া ও তার মধ্যকার সবকিছুর চাইতে উত্তম’।[7]

মিথ্যারোপ, অপবাদ, গালি, ছিদ্রান্বেষণ- এগুলি সব ইহকালীন জীবনের অনুষঙ্গ। এগুলিতে ধৈর্য ধারণের বিনিময়ে পরকালে রয়েছে অফুরন্ত শান্তি। ইহকালের ক্ষণস্থায়ী কষ্টকর জীবনের বিপরীতে পরকালের চিরস্থায়ী শান্তির জীবন নিঃসন্দেহে উত্তম। অতএব আল্লাহ সান্ত্বনা দিয়ে বলেন, হে রাসূল! কাফেরদের দেয়া অপবাদে দুঃখিত ও মর্মাহত হবেন না।

আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) একটি চাটাইয়ের উপরে শুয়েছিলেন। তাতে তাঁর পিঠে দাগ পড়ে যায়। তিনি জেগে উঠলে আমি তাঁর পিঠে হাত বুলাতে লাগলাম এবং বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! যদি আপনি আমাদের অনুমতি দিতেন, যাতে আমরা আপনার চাটাইয়ের উপর (নরম) কিছু বিছিয়ে দেই। তখন রাসূল (ছাঃ) বললেন, مَا لِيْ وَلِلدُّنْيَا مَا أَنَا وَالدُّنْيَا إِنَّمَا مَثَلِي وَمَثَلُ الدُّنْيَا كَرَاكِبٍ ظَلَّ تَحْتَ شَجَرَةٍ ثُمَّ رَاحَ وَتَرَكَهَا- ‘আমার জন্যই বা কি? আর দুনিয়ার জন্যই বা কি? আমিই বা কি? আর দুনিয়াই বা কি? আমার ও দুনিয়ার তুলনা তো একজন সওয়ারীর ন্যায়, যে গাছের ছায়াতলে আশ্রয় নিল। অতঃপর রওয়ানা হ’ল ও তাকে ছেড়ে গেল’।[8]

(৫) وَلَسَوْفَ يُعْطِيْكَ رَبُّكَ فَتَرْضَى ‘তোমার পালনকর্তা সত্বর তোমাকে দান করবেন। অতঃপর তুমি সন্তুষ্ট হয়ে যাবে’।

سوف তাকীদ ও নিশ্চয়তার জন্য এসেছে। যা আখেরাতে হবে। ইবনু কাছীর বলেন, আখেরাতে তাঁকে উচ্চ সম্মান প্রদান করা হবে এবং তাঁর উম্মতের ব্যাপারে তাঁকে সন্তুষ্ট করা হবে’। আখেরাতে দেওয়া সম্মানসমূহের মধ্যে প্রধান হ’ল হাউয কাওছার দান ও সমগ্র মানবজাতির জন্য শাফা‘আতের অনুমতি প্রদান। যাকে কুরআনে ‘মাক্বামে মাহমূদ’ বা ‘সর্বোচ্চ প্রশংসিত স্থান’ বলা হয়েছে।[9]

ইবনু ইসহাক বলেন, যার অর্থ হ’ল الفَلْج فى الدنيا والثواب فى الآخرة ‘দুনিয়াতে সফলতা ও আখেরাতে উত্তম প্রতিদান’ (কুরতুবী)। বস্ত্ততঃ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর জীবনে দুনিয়াতেও সফলতা ছিল এবং আখেরাতে তো সফলতা আছেই।

(৬) أَلَمْ يَجِدْكَ يَتِيْماً فَآوَى ‘তিনি কি তোমাকে ইয়াতীমরূপে পাননি? অতঃপর তিনি আশ্রয় দিয়েছেন’।

এখান থেকে পরপর তিনটি আয়াতে আল্লাহ স্বীয় রাসূলকে সান্ত্বনা দিয়েছেন এবং তাঁকে দুনিয়াতে যেসব নে‘মত ইতিমধ্যে দান করেছেন, সেগুলি স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। প্রথম যে বড় অনুগ্রহ তাঁর উপর তিনি করেছিলেন, সেটি এই যে, তিনি পিতৃহীন ইয়াতীমরূপে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। অতঃপর মাতৃহারা হন। সেই অসহায় অবস্থায় আল্লাহ তাঁর বৃদ্ধ দাদা ও পরে তাঁর চাচা আবু তালেবের আশ্রয়ে তাঁকে লালন-পালন করেন। দাদা ও চাচার অন্তরে আল্লাহ এমন মহববত ঢেলে দিয়েছিলেন যে, নিজের সন্তানের চাইতে ইয়াতীম মুহাম্মাদের প্রতি তাদের স্নেহ ছিল অপার ও অপরিসীম। এমনকি নবুঅত লাভের পরে প্রচন্ড বিপদ-মুছীবতের মধ্যেও বৃদ্ধ চাচা আবু তালেব-এর মধ্যে সেই স্নেহের সামান্যতম ঘাটতি দেখা যায়নি। কেবলমাত্র ভাতিজার মহববতে চাচা আবু তালেব তিনটি বছর কুরায়েশদের কঠিন বয়কট ও অন্নবস্ত্রের কষ্ট সহ্য করেছেন। তথাপি ভাতিজাকে ছাড়েননি। সেই সাথে বনু হাশেম গোত্র ইসলাম কবুল না করা সত্ত্বেও রাসূল (ছাঃ)-এর নিরাপত্তায় তারা ছিল অটুট দেওয়ালের মত। বস্ত্ততঃ এসবই ছিল আল্লাহর অদৃশ্য ব্যবস্থাপনার ফল। এখানে কোন যুক্তি বা বস্ত্তগত ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব নয়।

(৭) وَوَجَدَكَ ضَالاًّ فَهَدَى ‘তিনি তোমাকে পেয়েছিলেন পথ সম্পর্কে অনবহিত। অতঃপর তোমাকে পথ প্রদর্শন করেছেন’।

এখানে ضَالاًّ অর্থ غير عالم ‘অনবহিত’। কেননা অহি নাযিলের পূর্বে রাসূল (ছাঃ) শরী‘আতের কিছুই জানতেন না। যেমন আল্লাহ বলেন, وَعَلَّمَكَ مَا لَمْ تَكُنْ تَعْلَمُ ‘এবং তিনি তোমাকে শিখিয়েছেন, যা তুমি জানতে না’ (নিসা ৪/১১৩)فَهَدَى অর্থ فَأَرْشَدَكَ ‘অতঃপর তোমাকে পথ প্রদর্শন করেছেন’ (কুরতুবী)

অর্থাৎ ইতিপূর্বে তুমি ইসলামী শরী‘আত বিষয়ে অবগত ছিলে না। অতঃপর আল্লাহ তোমাকে নবুঅতের মাধ্যমে পথ প্রদর্শন করেছেন। যেমন অন্যত্র আল্লাহ বলেন,مَا كُنْتَ تَدْرِيْ مَا الْكِتَابُ وَلاَ الْإِيْمَانُ ‘তুমি জানতে না কিতাব কি বা ঈমান কি?’ (শূরা ৪২/৫২)। মক্কায় অবতীর্ণ সূরা ইউসুফের শুরুতে উক্ত কাহিনী বর্ণনার সূচনায় আল্লাহপাক স্বীয় রাসূলকে বলছেন, وَإِن كُنْتَ مِنْ قَبْلِهِ لَمِنَ الْغَافِلِيْنَ ‘যদিও তুমি ইতিপূর্বে ছিলে এ বিষয়ে অনবহিতদের অন্তর্ভুক্ত’ (ইউসুফ ১২/৩)। অর্থাৎ তুমি এ বিষয়ে কিছু জানতে না।

অনুরূপভাবে আলোচ্য আয়াতে وَوَجَدَكَ ضَالاًّ অর্থ তিনি তোমাকে পেয়েছিলেন সঠিক পথ সম্পর্কে অনবহিত। অতঃপর তিনি তোমাকে ইসলামের পথ প্রদর্শন করেন।

এখানে ضَالاًّ অর্থ ‘পথভ্রষ্ট’ নয়। কেননা পথভ্রষ্ট সেই ব্যক্তিকে বলা হয়, যিনি পথ পেয়েও পথ হারান। কোন রাসূলের জীবনে এমন কিছু ঘটার প্রশ্নই ওঠে না।

فَهَدَى অর্থ فَهَدَاكَ ‘অতঃপর তোমাকে পথ প্রদর্শন করেছেন’। তবে এর অর্থ আরও ব্যাপক। فَهَدَاكَ وَهُدِىَ بِكَ ‘তিনি তোমাকে পথ প্রদর্শন করেছেন ও তোমার মাধ্যমে অন্যকে পথ দেখিয়েছেন’। ফলে তিনি هَادٍ وَمَهْدِىٌ ‘পথ প্রদর্শক ও পথপ্রাপ্ত’।

(৮) وَوَجَدَكَ عَائِلاً فَأَغْنَى ‘তিনি তোমাকে পেয়েছিলেন নিঃস্ব। অতঃপর অভাবমুক্ত করেছেন’।

অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা তোমাকে রিক্তহস্ত পেয়েছিলেন। অতঃপর তোমাকে অভাবমুক্ত করেন। প্রথমে খাদীজার ব্যবসায়ে অংশীদারী কারবারের মাধ্যমে এর সূচনা হয়। অতঃপর বিবাহের পর খাদীজা (রাঃ)-এর সমস্ত ধন-সম্পদ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর খিদমতে উৎসর্গিত হয়।

ক্বাতাদাহ বলেন, উপরে বর্ণিত তিনটি অবস্থা ছিল রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নবুঅত-পূর্বকালের তিনটি স্তর বিশেষ (ইবনু কাছীর)। তবে নবুঅত-পরবর্তীকালে জিহাদে গণীমত লাভের ফলে তিনি ও মুসলমানগণ অভাবমুক্ত হয়েছিলেন।

(৯) فَأَمَّا الْيَتِيْمَ فَلاَ تَقْهَرْ ‘অতএব তুমি ইয়াতীমের প্রতি কঠোর হবে না’।

قَهَرَ يَقْهَرُ قَهْرًا অর্থ ‘বিজয়ী হওয়া’। যেমন আল্লাহ বলেন, وَهُوَ الْقَاهِرُ فَوْقَ عِبَادِهِ وَهُوَ الْحَكِيْمُ الْخَبِيْرُ ‘তিনি তাঁর বান্দাদের উপরে পরাক্রান্ত। তিনি প্রজ্ঞাময় ও সর্বজ্ঞ’ (আন‘আম ৬/১৮)। এখানে فَلاَ تَقْهَرْ অর্থ لاَ تَسَلَّطْ عَلَيْهِ بِالظُّلْمِ وَلاَ تَحْتَقِرْ ‘যুলুমের মাধ্যমে তার উপর চেপে বসো না বা তাকে লাঞ্ছিত করো না’ (কুরতুবী)। আদব শিক্ষা দেওয়ার জন্য কঠোরতা এই নিষেধের অন্তর্ভুক্ত নয়।

পূর্বের তিনটি আয়াতে তিনটি নে‘মতের বর্ণনা দেওয়ার পর এক্ষণে রাসূল (ছাঃ)-কে তিনটি বিষয়ের নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে। যার প্রথমটি হ’ল, তুমি কোন ইয়াতীমের উপরে কঠোর হবে না। কেননা তুমি নিজেই ইয়াতীম ছিলে। বস্ত্ততঃ আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) মা-বাপ হারানোর শূন্যতা ভালভাবে বুঝতেন। যদিও এর বেদনা তাঁকে বুঝতে দেননি তাঁর স্নেহময় দাদা ও চাচাগণ। সাহল বিন সা‘দ (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, أَنَا وَكَافِلُ الْيَتِيمِ لَهُ وَلِغَيْرِهِ كَهَاتَيْنِ فِى الْجَنَّةِ ‘আমি ও ইয়াতীমের অভিভাবক, তার বা অন্যের, জান্নাতে পাশাপাশি থাকব এই দু’টি আঙ্গুলের মত। এসময় তিনি শাহাদাত ও মধ্যমা আঙ্গুলী দু’টি পাশাপাশি রেখে ইশারা করেন।[10]

আবুদ্দারদা (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট জনৈক ব্যক্তি নিজের কঠোর হৃদয়ের অভিযোগ পেশ করলে রাসূল (ছাঃ) তাকে বলেন, إِنْ أَرَدْتَ أَنْ تَلْيِيْنَ قَلْبَكَ فَأَطْعِمِ الْمِسْكِينَ وَامْسَحْ رَأْسَ الْيَتِيمِ ‘যদি তুমি তোমার হৃদয়কে নরম করতে চাও, তাহ’লে মিসকীনকে খাওয়াও এবং ইয়াতীমের মাথায় হাত বুলাও’।[11] ইবনু ওমর (রাঃ) কোন ইয়াতীমকে দেখলে মাথায় হাত বুলাতেন এবং তাকে কিছু উপহার দিতেন (কুরতুবী)। ক্বাতাদাহ বলেন, كُنْ لِلْيَتِيْمِ كَالْأَبِ الرَّحِيْمِ- ‘ইয়াতীমের জন্য তুমি হও দয়াশীল পিতার মত’ (ইবনু কাছীর)

(১০) وَأَمَّا السَّائِلَ فَلاَ تَنْهَرْ ‘এবং সাহায্যপ্রার্থীকে ধমকাবে না’।

نَهَرَ يَنْهَرُ نَهْرًا -السَّائِلَ ‘প্রার্থীকে ধমকানো’। সেখান থেকে لاَ تَنْهَرْ অর্থ لاَ تَزْجُرْ ‘ধমকাবে না’। এটি হ’ল দ্বিতীয় বিষয়

সাহায্যপ্রার্থী ফকীর-মিসকীন অসহায় কিংবা বিপদগ্রস্ত যেই-ই হৌক না কেন, তার প্রতি কঠোর আচরণ করা যাবে না। সে মনে ব্যথা পায় এমন ব্যবহার করা যাবে না। সাহায্য দু’ধরনের হ’তে পারে জ্ঞানগত ও বস্ত্তগত। যদি কেউ শরী‘আত বা আখেরাতের বিষয় জানতে চায়, তাহ’লে তার প্রতি সদয় হওয়ার জন্য রাসূল (ছাঃ)-কে সূরা ‘আবাসায় বিশেষভাবে তাকীদ দেওয়া হয়েছে। ফলে রাসূল (ছাঃ)-এর চরিত্র এমনভাবে গড়ে উঠেছিল যে, চরম ক্রুদ্ধ অবস্থায়ও তিনি নিজেকে সংযত রাখতেন। আল্লাহ বলেন, وَلَوْ كُنْتَ فَظاًّ غَلِيْظَ الْقَلْبِ لاَنْفَضُّواْ ‘যদি তুমি কর্কশভাষী ও কঠোর হৃদয় হতে, তাহ’লে লোকেরা তোমার পাশ থেকে সরে যেত’ (আলে ইমরান ৩/১৫৯)।

অপারগ অবস্থায় কিছু দিতে না পারলে সে অবস্থায় আল্লাহ বলেন, وَإِمَّا تُعْرِضَنَّ عَنْهُمُ ابْتِغَاءَ رَحْمَةٍ مِّنْ رَّبِّكَ تَرْجُوْهَا فَقُلْ لَّهُمْ قَوْلاً مَّيْسُوْراً- ‘তোমার পালনকর্তার করুণার প্রত্যাশায় থাকাকালে যদি কোন সময় তাদেরকে বিমুখ করতে হয়, তা’হলে তাদের সাথে নম্রভাবে কথা বলো’ (বনী ইস্রাঈল ১৭/২৮)। ক্বাতাদাহ বলেন, আলোচ্য আয়াতে আল্লাহ স্বীয় রাসূলকে উপদেশ দিচ্ছেন যে, رد المسكين برحمة ولين ‘(বাধ্যগত অবস্থায়) মিসকীনকে ফিরাও দয়া ও নম্রতার সাথে’ (ইবনু কাছীর)। তবে সংশোধন ও কল্যাণের স্বার্থে কঠোর হওয়াটা এই নিষেধের অন্তর্ভুক্ত নয়।

(১১) وَأَمَّا بِنِعْمَةِ رَبِّكَ فَحَدِّثْ ‘অতঃপর তুমি তোমার পালনকর্তার অনুগ্রহের কথা বর্ণনা কর’।

অর্থ اشكر لنعمة ربك عليك ‘তোমার উপর তোমার প্রতিপালকের অনুগ্রহ সমূহের শুকরিয়া আদায় কর’। এটি হ’ল তৃতীয় বিষয়, যা আল্লাহ আদেশ করেছেন।

এখানে নির্দেশ নবীর প্রতি হ’লেও তা সকলের প্রতি প্রযোজ্য। আল্লাহর অনুগ্রহে মানুষ দুনিয়াতে এসেছে ও চলাফেরা করছে। মানুষের উপরে আল্লাহর অনুগ্রহের শেষ নেই। অতএব প্রত্যেক মানুষের উপরে অবশ্য কর্তব্য হ’ল প্রতি মুহূর্তে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করা।

মুজাহিদ বলেন, এখানে রাসূল (ছাঃ)-এর প্রতি বিশেষ অনুগ্রহ হ’ল- নবুঅত ও কুরআন (ইবনু কাছীর), যা কেবল রাসূল (ছাঃ)-এর জন্য নয়, সমগ্র মানবজাতির জন্য সর্বশেষ ও শ্রেষ্ঠতম নে‘মত। এই নে‘মতের শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও প্রচার-প্রসার করাই হ’ল আল্লাহর সবচেয়ে বড় কৃতজ্ঞতা বর্ণনা। আল্লাহ স্বীয় রাসূলকে বলেন, يَا أَيُّهَا الرَّسُوْلُ بَلِّغْ مَا أُنْزِلَ إِلَيْكَ مِنْ رَّبِّكَ وَإِنْ لَّمْ تَفْعَلْ فَمَا بَلَّغْتَ رِسَالَتَهُ- ‘হে রাসূল! তোমার প্রতিপালকের পক্ষ হ’তে তোমার নিকটে যা অবতীর্ণ হয়েছে, তা তুমি পৌঁছে দাও। যদি তুমি তা না কর, তাহ’লে তুমি তাঁর রিসালাত পৌঁছে দিলে না’ (মায়েদাহ ৫/৬৭)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, خَيْرُكُمْ مَنْ تَعَلَّمَ الْقُرْآنَ وَعَلَّمَهُ ‘তোমাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ সেই ব্যক্তি, যে কুরআন শিক্ষা করে ও অন্যকে শেখায়’।[12] তিনি আরও বলেন, بَلِّغُوا عَنِّى وَلَوْ آيَةً ‘একটি আয়াত জানলেও তা তোমরা আমার পক্ষ থেকে পৌঁছে দাও’।[13]

কুরআন ও হাদীছ ছাড়াও অন্যান্য নে‘মতের শুকরিয়া আদায় করা যরূরী। আমর বিন মায়মূন তার কোন বিশ্বস্ত ভাইকে পেলে বলতেন, গতকাল আল্লাহ আমাকে ছালাত আদায়ের তাওফীক দিয়েছেন বা অমুক নেকীর কাজ করার অনুগ্রহ দান করেছেন’। এমনিতরো অভ্যাস আবু ফেরাস আব্দুল্লাহ বিন গালিব সহ অনেক মনীষীর ছিল (কুরতুবী)। উদ্দেশ্য ছিল উক্ত আয়াতের হুকুম অনুযায়ী আল্লাহর নে‘মতের শুকরিয়া বর্ণনা করা।

মালেক বিন নাযলাহ (রাঃ) বর্ণিত একটি হাদীছে এসেছে যে, একদিন জনৈক ব্যক্তি জীর্ণবস্ত্র পরিধান করে রাসূল (ছাঃ)-এর কাছে এলো। রাসূল (ছাঃ) তাকে জিজ্ঞেস করলেন, أَلَكَ مَالٌ؟ ‘তোমার কি মাল-সম্পদ আছে’? লোকটি বলল, হে আল্লাহর রাসূল! সকল প্রকারের মাল আছে। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে বললেন, إِذَا آتَاكَ اللهُ مَالاً فَلْيُرَ عَلَيْكَ ‘যখন আল্লাহ তোমাকে মাল দিয়েছেন, তখন তার নিদর্শন তোমার উপরে প্রকাশ পাওয়া উচিত’।[14]

আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) বর্ণিত অন্য একটি হাদীছে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) বলেন, إِنَّ اللهَ جَمِيْلٌ يُحِبُّ الْجِمَالَ وَيُحِبُّ أَنْ يَّرَى أَثْرَ نِعْمَتِهِ عَلَى عَبْدِهِ ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ সুন্দর। তিনি সৌন্দর্যকে পসন্দ করেন এবং স্বীয় বান্দার উপরে তাঁর নে‘মতের নিদর্শন দেখতে ভালবাসেন’।[15]

আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, لاَ يَشْكُرُ اللهَ مَنْ لاَ يَشْكُرُ النَّاسَ ‘যে ব্যক্তি মানুষের শুকরিয়া আদায় করে না, সে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে না’।[16] অর্থাৎ মানুষের প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বীকার করাটা হ’ল আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বীকারের পূর্বশর্ত।

জাবের বিন আব্দুল্লাহ (রাঃ) বর্ণিত হাদীছে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,

مَنْ أُعْطِىَ عَطَاءً فَوَجَدَ فَلْيَجْزِ بِهِ وَمَنْ لَمْ يَجِدْ فَلْيُثْنِ فَإِنَّ مَنْ أَثْنَى فَقَدْ شَكَرَ وَمَنْ كَتَمَ فَقَدْ كَفَرَ-

‘যে ব্যক্তি কিছু দান করল, অতঃপর সে তা পেল। তার উচিত হ’ল বিনিময়ে কিছু প্রদান করা (অর্থাৎ দো‘আ করা)। যদি কিছু না পায়, তাহ’লে তার উচিত প্রশংসা করা। কেননা যে ব্যক্তি প্রশংসা করল, সে ব্যক্তি শুকরিয়া আদায় করল। আর যে ব্যক্তি চুপ থাকল, সে অকৃতজ্ঞ হলো’।[17]

সারকথা : 

যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য আত্মনিবেদন করে, আল্লাহ তাকে কখনো পরিত্যাগ করেন না।


[1]. বুখারী হা/৬১০৬, মুসলিম হা/৪৬৫; মিশকাত হা/৮৩৩; বিস্তারিত আলোচনা দ্রষ্টব্য : সূরা ফজর।

[2]. ইনি নিকটতম প্রতিবেশী চাচা আবু লাহাবের স্ত্রী ও আবু সুফিয়ানের বোন উম্মে জামীল ‘আওরা বিনতে হারব (ইবনু কাছীর)

[3]. বুখারী হা/৪৯৫০,৪৯৫১; মুসলিম হা/১৭৯৭; নাসাঈ হা/১১৬৮১; ত্বাবারী হা/৩৭৫০৩।

[4]. হাকেম ২/২৩০ হা/২৯০৫ উবাই বিন কা‘ব হ’তে; সিলসিলা যঈফাহ হা/৬১৩৩; বাগাভী, ইবনু কাছীর, কুরতুবী হা/৬৩৮১ ও ৬৩৮২।

[5]. তাফসীর ইবনু কাছীরের দারুল কুতুবিল ইলমিয়াহ (বৈরূত : ১৪১৯/১৯৯৮ খৃঃ) সংস্করণে কুর্রা (القراء) লেখা হয়েছে। কিন্তু দারুল হাদীছ (কায়রো : ১৪২৩/২০০২ খৃঃ) সংস্করণে ফার্রা (الفراء) লেখা হয়েছে। প্রথমটাই সঠিক। কেননা বক্তব্যের শেষদিকে ইবনু কাছীর বহুবচনের ক্রিয়া ব্যবহার করে বলেছেন, ولم يرو ذلك باسناد ‘তারা এব্যাপারে কোন সনদ উল্লেখ করেননি’। সম্ভবতঃ মুদ্রণকালে ভুলক্রমে ক্বাফ-এর বদলে ‘ফা’ লেখা হয়েছে। সেকারণ القراء -এর বদলে الفراء হয়ে গেছে।

[6]. বুখারী হা/৩২৪৪, মুসলিম হা/২৮২৪, মিশকাত হা/৫৬১২; সাজদাহ ৩২/১৭।

[7]. বুখারী হা/৩২৫০, মিশকাত হা/৫৬১৩।

[8]. তিরমিযী হা/২৩৭৭; আলবানী, মিশকাত হা/৫১৮৮ ‘রিক্বাক্ব’ অধ্যায়; ছহীহাহ হা/৪৩৯।

[9]. বনু ইস্রাঈল ১৭/৭৯; বুখারী হা/৭৪৪০, মুসলিম হা/১৯৩; মিশকাত হা/৫৫৭২।

[10]. বুখারী হা/৫৩০৪, ৬০০৫; আবুদাঊদ হা/৫১৫০ মিশকাত হা/৪৯৫২ ‘শিষ্টাচার সমূহ’ অধ্যায়-২৫, ‘সৃষ্টির প্রতি দয়া’ অনুচ্ছেদ-১৫।

[11]. আহমাদ হা/৭৫৬৬; ত্বাবারাণী, ছহীহাহ হা/৮৫৪।

[12]. বুখারী হা/৫০২৭; মিশকাত হা/২১০৯।

[13]. বুখারী হা/৩৪৬১; মিশকাত হা/১৯৮।

[14]. নাসাঈ হা/৫২২৪; আহমাদ হা/১৭২৬৮, হাদীছ ছহীহ; মিশকাত হা/৪৩৫২।

[15]. আবু ইয়া‘লা হা/১০৫৫, সনদ হাসান; তিরমিযী হা/২৮১৯, মিশকাত হা/৪৩৫০ ‘পোষাক’ অধ্যায়।

[16]. আবুদাঊদ হা/৪৮১১; ছহীহাহ হা/৪১৭।

[17]. আবুদাঊদ হা/৪৮১৩; তিরমিযী হা/২০৩৪; ছহীহাহ হা/৬১৭।