তাফসীরুল কুরআন - (৩০তম পারা)

সূরা বুরূজ

(নক্ষত্ররাজি)

সূরা শাম্স-এর পরে মক্কায় অবতীর্ণ।

সূরা ৮৫, আয়াত ২২, শব্দ ১০৯, বর্ণ ৪৫৯।

بِسْمِ اللہِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِیْمِ

পরম করুণাময় অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে (শুরু করছি)।

(১) শপথ নক্ষত্রশোভিত আকাশের
وَالسَّمَاءِ ذَاتِ الْبُرُوجِ
(২) শপথ প্রতিশ্রুত দিবসের
وَالْيَوْمِ الْمَوْعُودِ
(৩) শপথ সাক্ষ্যদাতার ও উপস্থিতগণের।
وَشَاهِدٍ وَمَشْهُودٍ
(৪) অভিশপ্ত হয়েছে গর্তওয়ালারা
قُتِلَ أَصْحَابُ الْأُخْدُودِ
(৫) বহু ইন্ধনযুক্ত আগুনওয়ালারা।
النَّارِ ذَاتِ الْوَقُودِ
(৬) যখন তারা সেখানে উপবিষ্ট ছিল
إِذْ هُمْ عَلَيْهَا قُعُودٌ
(৭) এবং বিশ্বাসীগণের সাথে যে আচরণ তারা করছিল, তা প্রত্যক্ষ করছিল।
وَهُمْ عَلَى مَا يَفْعَلُونَ بِالْمُؤْمِنِينَ شُهُودٌ
(৮) তারা তাদের থেকে প্রতিশোধ নিয়েছিল কেবল এ কারণে যে, তারা বিশ্বাস স্থাপন করেছিল মহাপরাক্রান্ত ও মহাপ্রশংসিত আল্লাহর উপরে।
وَمَا نَقَمُوا مِنْهُمْ إِلَّا أَنْ يُؤْمِنُوا بِاللَّهِ الْعَزِيزِ الْحَمِيدِ
(৯) যার হাতে রয়েছে আসমান ও যমীনের মালিকানা। বস্ত্ততঃ আল্লাহ সবকিছু প্রত্যক্ষ করেন।
الَّذِي لَهُ مُلْكُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَاللَّهُ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ شَهِيدٌ
(১০) নিশ্চয়ই যারা মুমিন পুরুষ ও নারীদের নির্যাতন করেছে, অতঃপর তারা তওবা করেনি, তাদের জন্য রয়েছে জাহান্নামের শাস্তি এবং রয়েছে তীব্র দহন জ্বালা।
إِنَّ الَّذِينَ فَتَنُوا الْمُؤْمِنِينَ وَالْمُؤْمِنَاتِ ثُمَّ لَمْ يَتُوبُوا فَلَهُمْ عَذَابُ جَهَنَّمَ وَلَهُمْ عَذَابُ الْحَرِيقِ
(১১) পক্ষান্তরে যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে, তাদের জন্য রয়েছে জান্নাত। যার তলদেশ দিয়ে প্রবাহিত হয় নদীসমূহ। আর এটাই হ’ল বড় সফলতা।
إِنَّ الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ لَهُمْ جَنَّاتٌ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ ذَلِكَ الْفَوْزُ الْكَبِيرُ
(১২) নিশ্চয় তোমার পালনকর্তার পাকড়াও অত্যন্ত কঠিন।
إِنَّ بَطْشَ رَبِّكَ لَشَدِيدٌ
(১৩) তিনিই প্রথম সৃষ্টি করেন এবং তার পুনরাবৃত্তি করেন।
إِنَّهُ هُوَ يُبْدِئُ وَيُعِيدُ
(১৪) তিনি ক্ষমাশীল, প্রেমময়,
وَهُوَ الْغَفُورُ الْوَدُودُ
(১৫) তিনি আরশের মালিক, তিনি মহিমাময়।
ذُو الْعَرْشِ الْمَجِيدُ
(১৬) তিনি যা চান তাই করেন।
فَعَّالٌ لِمَا يُرِيدُ
(১৭) তোমার কাছে সেনাদলের খবর পৌঁছেছে কি?
هَلْ أَتَاكَ حَدِيثُ الْجُنُودِ
(১৮) ফেরাঊনের ও ছামূদের?
فِرْعَوْنَ وَثَمُودَ
(১৯) বরং কাফেররা মিথ্যারোপে লিপ্ত আছে।
بَلِ الَّذِينَ كَفَرُوا فِي تَكْذِيبٍ
(২০) অথচ আল্লাহ তাদেরকে চারদিক থেকে পরিবেষ্টন করে আছেন।
وَاللَّهُ مِنْ وَرَائِهِمْ مُحِيطٌ
(২১) বরং এটি মর্যাদামন্ডিত কুরআন,
بَلْ هُوَ قُرْآنٌ مَجِيدٌ
(২২) যা সুরক্ষিত ফলকে লিপিবদ্ধ।
فِي لَوْحٍ مَحْفُوظٍ

বিষয়বস্ত্ত :

(ক) আল্লাহর উপরে ঈমান আনার অপরাধে বিগত যুগের জনৈক বাদশাহ কর্তৃক একদল মুমিনকে জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যার বিষয় বর্ণনা করা হয়েছে। (খ) অতঃপর ফেরাঊন ও ছামূদ জাতির ধ্বংসের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে রাসূল (ছাঃ)-কে কষ্টদানকারী মক্কার মুশরিক নেতৃবৃন্দ এবং মুমিন নর-নারীদের নির্যাতনকারী সকল যুগের যালেমদের ধ্বংস করে দেবার হুমকির বিষয়টি কঠোর ভঙ্গিতে বর্ণনা করা হয়েছে। (গ) সাথে সাথে মযলূম মুমিনদের পরকালীন সফলতা বর্ণনা করা হয়েছে।

তাফসীর :

(১) وَالسَّمَآءِ ذَاتِ الْبُرُوْجِ ‘শপথ নক্ষত্রশোভিত আকাশের’।

بُرُوْجٌ -এর একবচন بُرْجٌ অর্থ প্রকাশিত হওয়া। এ কারণে নারীর পর্দাহীনতাকে تَبَرُّجٌ বলা হয়। একই কারণে উঁচু টাওয়ারকে এবং গুম্বজকে ‘বুর্জ’ বলা হয়। এখানে অর্থ হ’ল ‘গ্রহ ও নক্ষত্ররাজি’। কেননা তা উচ্চাকাশে অত্যন্ত উজ্জ্বলভাবে প্রকাশিত হয়। بُرُوْجٌ অর্থ ‘রাশিচক্র’ করা ভুল। যেমন রাশি গণনার মাধ্যমে মানুষের শুভাশুভ নির্ধারণকারী তথাকথিত জ্যোতিষীরা ও ‘কোয়ান্টাম’ অনুসারীরা করে থাকেন। অথচ ভাগ্যনিয়ন্তা হলেন আল্লাহ। এতে মানুষের বা অন্য কারু কোন হাত নেই। যেমন আল্লাহ বলেন, وَعِنْدَهُ مَفَاتِحُ الْغَيْبِ لاَ يَعْلَمُهَا إِلاَّ هُوَ ‘অদৃশ্যের চাবিসমূহ কেবল তাঁর (আল্লাহর) কাছেই রয়েছে। তিনি ব্যতীত অন্য কেউ তা জানে না’ (আন‘আম ৬/৫৯)। তিনি স্বীয় নবীকে বলেন, قُلْ لاَ أَمْلِكُ لِنَفْسِي نَفْعًا وَلاَ ضَرًّا إِلاَّ مَا شَاءَ اللهُ وَلَوْ كُنْتُ أَعْلَمُ الْغَيْبَ لاَسْتَكْثَرْتُ مِنَ الْخَيْرِ وَمَا مَسَّنِيَ السُّوءُ ‘তুমি বল, আল্লাহ যা ইচ্ছা করেন, তা ব্যতীত আমি আমার নিজের জন্য ভাল বা মন্দ কিছুই করার ক্ষমতা রাখি না। যদি আমি অদৃশ্যের খবর জানতাম, তাহ’লে তো আমি প্রভূত কল্যাণ লাভ করতাম এবং কোন অকল্যাণই আমাকে স্পর্শ করত না’ (আ‘রাফ ৭/১৮৮)

হিন্দু জ্যোতিষীরা তাদের দেবতাদের নামানুসারে শনি, রবি, সোম, মঙ্গল প্রভৃতি বাংলা সাতটি বারের ন্যায় আকাশের সাতটি গ্রহের নামকরণ করেছেন। অথচ এখনকার গণনায় গ্রহের সংখ্যা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। অতঃপর তাদের কক্ষপথসমূহে বারোটি রাশি আছে বলে কল্পনা করেছেন ও নিজেদের পসন্দমত নামকরণ করেছেন। যথা : মেষ (ভেড়া), বৃষ (মহিষ), মিথুন, কর্কট, সিংহ, কন্যা, তুলা, বৃশ্চিক, ধনু, মকর, কুম্ভ ও মীন। এইসব গ্রহ ও রাশির প্রভাবে পৃথিবীতে খরা, বৃষ্টি ও মানুষের মঙ্গলামঙ্গল হয়ে থাকে বলে তারা বিশ্বাস করেন। অথচ কেবলমাত্র এটাই সত্য, যা কুরআন বলেছে যে, আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টির সময় আল্লাহ মাসের গণনা ১২টি করেছেন’ (তওবা ৯/৩৬)। সূর্যের আবর্তন-বিবর্তনে যা পৃথিবীতে প্রকাশিত হয় এবং গ্রীষ্মকাল-শীতকাল ইত্যাদি ঋতু বৈচিত্র্য একই কারণে হয়ে থাকে।

অনেক তাফসীরে بُرُوْجٌ -এর অনুবাদ ‘রাশিচক্র’ করা হয়েছে, যা মূল শব্দের স্পষ্ট বিরোধী। কেননা ‘বুরূজ’ অর্থ ‘প্রকাশ্য’। অথচ কেবল নক্ষত্ররাজিই হ’ল প্রকাশ্য, যা খালি চোখে দেখা যায়। সূর্য ও চন্দ্র অন্যতম নক্ষত্র, যা আল্লাহর হুকুমে দিবসে ও রাত্রিতে প্রকাশিত হয় এবং যা সর্বদা প্রাণীকুলের সেবায় নিয়োজিত (লোকমান ৩১/২০)। সূর্য, চন্দ্র ও নক্ষত্ররাজি কারু মঙ্গলামঙ্গলের ক্ষমতা রাখে না। আল্লাহ বলেন, وَمِنْ آيَاتِهِ اللَّيْلُ وَالنَّهَارُ وَالشَّمْسُ وَالْقَمَرُ لاَ تَسْجُدُوا لِلشَّمْسِ وَلاَ لِلْقَمَرِ وَاسْجُدُوا لِلَّهِ الَّذِي خَلَقَهُنَّ إِنْ كُنْتُمْ إِيَّاهُ تَعْبُدُونَ ‘আল্লাহর নিদর্শনাবলীর অন্যতম হ’ল রাত্রি, দিন, সূর্য ও চন্দ্র। তোমরা সূর্যকে সিজদা করো না, চন্দ্রকেও নয়। তোমরা সিজদা কর আল্লাহকে, যিনি এগুলি সৃষ্টি করেছেন। যদি তোমরা সত্যিকার অর্থে তাঁরই ইবাদত করে থাক’   (হা-মীম সাজদাহ ৪১/৩৭)। রাসূল (ছাঃ) বলেন, তোমার প্রতিপালক বলেছেন, আমার বান্দা মুমিন ও কাফের হয়ে যাবে। এক্ষণে যে বলে আল্লাহর রহমতে ও তাঁর অনুগ্রহে আমাদের উপর বৃষ্টি বর্ষিত হয়েছে (مُطِرنا بفضل الله ورحمته) সে ব্যক্তি আমার উপর বিশ্বাসী এবং নক্ষত্রের উপর অবিশ্বাসী। পক্ষান্তরে যদি সে বলে, অমুক নক্ষত্রের কারণে বৃষ্টি হয়েছে, তাহ’লে সে আমার প্রতি অবিশ্বাসী এবং নক্ষত্রের প্রতি বিশ্বাসী’।[1]

এতে বুঝা যায় যে, জ্যোতিষ শাস্ত্রের উপর ঈমান আনা কুফরী কাজ। যেমন রাসূল (ছাঃ) বলেন, مَنْ أَتَى كَاهِناً أَوْ عَرَّافاً فَصَدَّقَهُ بِمَا يَقُولُ فَقَدْ كَفَرَ بِمَا أُنْزِلَ عَلَى مُحَمَّدٍ ‘যে ব্যক্তি ভাগ্যগণনাকারী অথবা জ্যোতিষীর কাছে যায় এবং তার কথা বিশ্বাস করে, সে ব্যক্তি মুহাম্মাদের উপর অবতীর্ণ শরী‘আতের সাথে কুফরী করে।[2] কিন্তু যদি কেউ এতে বিশ্বাসী না হয়েও এদের কাছে যায়, তবে সেটাও সম্পূর্ণরূপে হারাম। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, مَنْ أَتَى عَرَّافًا فَسَأَلَهُ عَنْ شَىْءٍ لَمْ تُقْبَلْ لَهُ صَلاَةٌ أَرْبَعِينَ لَيْلَةً ‘যে ব্যক্তি জ্যোতিষীর কাছে যায় এবং তার কাছে কোন কথা জিজ্ঞেস করে, তার চল্লিশ দিনের ছালাত কবুল হবে না’।[3]

নমরূদের রাজত্বকালে তারকাপূজারীদের বিরুদ্ধে ইবরাহীম (আঃ) লড়াই করেছিলেন এবং এসবের স্রষ্টা আল্লাহর প্রতি ইবাদতের জন্য মানুষকে আহবান জানিয়েছিলেন। কুরআনের আহবানও সেদিকে। যা তাওহীদে ইবাদতের মূলকথা। অথচ তাফসীরকারগণ অনেকে নিজেদের অজান্তে মুশরিক জ্যোতিষীদের খপ্পরে পড়ে গেছেন।[4] বস্ত্ততঃ জ্যোতিষ শাস্ত্র মুশরিকদের তৈরী একটি জাহেলী শাস্ত্র। এই শাস্ত্রের প্রভাবে একসময় ফেরাঊনী অত্যাচারে হাযার হাযার ইস্রাঈলী শিশুর জীবন গেছে। পরে আল্লাহর রহমতে মূসা (আঃ)-এর আবির্ভাবে এর স্রোত দমিত হয়। পরবর্তীতে সুলায়মান (আঃ) এর বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। ইসলাম আসার পর এটা স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়। কিন্তু প্রাচীন গ্রীকদের অনুসরণে কিছু নামধারী মুসলিম পুনরায় এর পিছনে ছুটেছেন। তারা কুরআনের সূরা নহল ১৬ আয়াত ও তার সমমর্মের আন‘আম ৯৭ আয়াতকে তাদের হীন স্বার্থে ব্যবহার করেছেন। সেইসাথে আলোচ্য আয়াতের ‘বুরূজ’ শব্দের অপব্যাখ্যা করেছেন ‘রাশিচক্র’ বলে। অথচ আল্লাহ বলেছেন, وَبِالنَّجْمِ هُمْ يَهْتَدُونَ ‘নক্ষত্রের সাহায্যেও তারা পথ নির্দেশ পায়’ (নাহল ১৬/১৬)। অন্যত্র তিনি বলেন, وَهُوَ الَّذِي جَعَلَ لَكُمُ النُّجُومَ لِتَهْتَدُوا بِهَا فِي ظُلُمَاتِ الْبَرِّ وَالْبَحْرِ ‘তিনি তোমাদের জন্য নক্ষত্ররাজিকে সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা এগুলির সাহায্যে অন্ধকারে পথের সন্ধান পেতে পার স্থলে ও সমুদ্রে’ (আন‘আম ৬/৯৭)। এ আয়াতের ব্যাখ্যায় ক্বাতাদাহ (রাঃ) বলেন, আল্লাহ নক্ষত্ররাজি সৃষ্টি করেছেন তিন উদ্দেশ্যে। এক- নিম্ন আকাশকে সুশোভিত করা। দুই- শয়তানের প্রতি নিক্ষেপের উপকরণ হিসাবে (মুলক ৬৭/৫) এবং তিন- পথিকের পথ-নির্দেশের জন্য (নাহল ১৬/১৬)। যে ব্যক্তি উক্ত তিনটি কারণ ব্যতীত অন্য কোন অর্থে এটি ব্যবহার করবে, সে ভুল করবে। সে তার অংশ (ঈমান) নষ্ট করল এবং যে বিষয়ে তার জ্ঞান নেই, তার প্রতি ব্যর্থ চেষ্টা করল’। অন্য বর্ণনায় এসেছে, সে এমন বিষয়ে অনর্থক চেষ্টা করল, যে বিষয়ে নবী ও ফেরেশতাদেরও কোন জ্ঞান নেই (রাযীন)[5]

(২) وَالْيَوْمِ الْمَوْعُوْدِ ‘ শপথ প্রতিশ্রুত দিবসের’। অর্থাৎ ক্বিয়ামত দিবসের।

(৩) وَشَاهِدٍ وَّمَشْهُوْدٍ ‘ শপথ সাক্ষ্যদাতার ও উপস্থিতগণের’।

আল্লাহ এখানে তিনটি বস্ত্তর শপথ করেছেন। নক্ষত্রশোভিত আকাশের, ক্বিয়ামত দিবসের এবং ক্বিয়ামতের দিন উপস্থিত ‘শাহেদ’ ও ‘মাশহূদের’। অর্থাৎ দুনিয়ার আদালতে আসামী ও সাক্ষী হাযির হওয়ার ন্যায় ঐদিন আল্লাহর আদালতে জিন-ইনসান ও তাদের কৃতকর্মের সাক্ষ্যদাতাগণ সকলের শপথ।

ইমাম বাগাভী বলেন, অধিকাংশ বিদ্বানের মতে শাহেদ ও মাশহূদ অর্থ জুম‘আর দিন ও আরাফাহর দিন (ইবনু কাছীর)। কারণ ঐদিন সকলে উপস্থিত হয় এবং ফেরেশতাগণ তাদের সাক্ষী হয়। বস্ত্ততঃ বিদ্বানগণ কারণ বিবেচনায় কোন বিষয়কে খাছ করলেও আয়াতের বক্তব্যটি ‘আম। যা দুনিয়া ও আখেরাতে পরিব্যপ্ত।

জনৈক ব্যক্তি হযরত হাসান বিন আলী (রাঃ)-কে এবিষয়ে জিজ্ঞেস করলে তিনি তাকে বলেন, هل سألت أحدا قبلى؟ ‘তুমি কি আমার পূর্বে কাউকে এ প্রশ্ন করেছ’? লোকটি বলল, হ্যাঁ। আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর ও আব্দুল্লাহ ইবনু যুবায়ের (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করেছি। তারা বলেছেন, কুরবানীর দিন এবং জুম‘আর দিন। তখন হাসান (রাঃ) বললেন, না। বরং ‘শাহেদ’ অর্থ মুহাম্মাদ (ছাঃ)। অতঃপর তিনি কুরআনের নিম্নোক্ত আয়াতটি পাঠ করেন, فَكَيْفَ إِذَا جِئْنَا مِنْ كُلِّ أُمَّةٍ بِشَهِيْدٍ وَجِئْنَا بِكَ عَلَى هَـؤُلاَءِ شَهِيْداً- ‘আর সেদিন কি অবস্থা হবে, যেদিন আমরা প্রত্যেক উম্মতের মধ্য হ’তে একজন সাক্ষ্যদাতাকে (অর্থাৎ তাদের নবীকে) ডেকে আনব এবং তোমাকে দাঁড় করাবো তাদের সকলের উপরে সাক্ষ্যদাতা হিসাবে’ (নিসা ৪/৪১)। অতঃপর তিনি বলেন, ‘মাশহূদ’ অর্থ ক্বিয়ামতের দিন। এরপর তিনি নিম্নোক্ত আয়াতটি পাঠ করেন, ذَلِكَ يَوْمٌ مَّجْمُوْعٌ لَّهُ النَّاسُ وَذَلِكَ يَوْمٌ مَّشْهُوْدٌ- ‘সেটি এমন এক দিন, যেদিন সকল মানুষ একত্রিত হবে। আর সেদিনটি যে হাযির হওয়ার দিন’ (হূদ ১১/১০৩; ইবনু কাছীর)

তাছাড়া অন্য আয়াতে বলা হয়েছে, إِنَّا أَرْسَلْنَاكَ شَاهِداً وَمُبَشِّراً وَّنَذِيْراً ‘হে নবী! আমরা তোমাকে সাক্ষ্যদাতা, সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে প্রেরণ করেছি’ (আহযাব ৩৩/৪৫)। বস্ত্ততঃ ক্বিয়ামতের দিন আগে-পিছের সকল উম্মত একত্রে সমবেত হবেন। যাদের সাক্ষ্যদাতা হবেন স্ব স্ব নবীগণ এবং সকলের সাক্ষী হবেন শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)। এছাড়া বিগত সকল উম্মতের উপর সাক্ষী হবে উম্মতে মুহাম্মাদী এবং রাসূল (ছাঃ) হবেন তাদের উপর সাক্ষী’ (বাক্বারাহ ২/১৪৩)। এতদ্ব্যতীত সাক্ষী হিসাবে উপস্থিত থাকবেন প্রত্যেক মানুষের সার্বক্ষণিক সাথী ও সাক্ষ্যদাতা ফেরেশতামন্ডলী। যেমন আল্লাহ বলেন, وَجَاءَتْ كُلُّ نَفْسٍ مَّعَهَا سَائِقٌ وَّشَهِيْدٌ ‘সেদিন প্রত্যেক ব্যক্তি আগমন করবে। তার সাথে থাকবে একজন চালক ও একজন সাক্ষ্যদাতা’ (ক্বাফ ৫০/২১)। সাক্ষী হবে মানুষের ত্বক ও তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সমূহ (হা-মীম সাজদাহ ৪১/২০-২২; নূর ২৪/২৪; ইয়াসীন ৩৬/৬৫)

وَالْيَوْمِ الْمَوْعُوْدِ বলার পরেই وَشَاهِدٍ وَّمَشْهُوْدٍ বলাতে শেষোক্ত ব্যাখ্যার যথাযর্থতার প্রতি ইঙ্গিত পাওয়া যায়।

(৪-৭)قُتِلَ أَصْحَابُ الْأُخْدُوْدِ، النَّارِ ذَاتِ الْوَقُوْدِ، إِِذْ هُمْ عَلَيْهَا قُعُوْدٌ، وَهُمْ عَلَى مَا يَفْعَلُوْنَ بِالْمُؤْمِنِيْنَ شُهُوْدٌ- ‘অভিশপ্ত হয়েছে গর্তওয়ালারা’। ‘বহু ইন্ধনযুক্ত আগুনওয়ালারা’। ‘যখন তারা সেখানে উপবিষ্ট ছিল’। ‘এবং বিশ্বাসীগণের সাথে যে আচরণ তারা করছিল, তা প্রত্যক্ষ করছিল’।

ফার্রা বলেন, পূর্বের আয়াতসমূহে বর্ণিত শপথের জওয়াব হিসাবে অত্র আয়াত নাযিল হয়েছে। হযরত ঈসা ও মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর মধ্যবর্তী সময়ে ঘটে যাওয়া একটি হৃদয় বিদারক ঘটনার খবর দিয়ে অত্র আয়াতগুলিতে যালেমদের উপরে অভিশাপ দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ গর্তওয়ালারা অভিশপ্ত হয়েছে। যারা প্রজ্বলিত অগ্নিকুন্ডে মুমিন         নর-নারীদের জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যা করেছে এবং এই মর্মান্তিক দৃশ্য বসে বসে উপভোগ করেছে।

(৪) قُتِلَ أَصْحَابُ الْأُخْدُوْدِ ‘অভিশপ্ত হয়েছে গর্তওয়ালারা’।

এখানে قُتِلَ অর্থ لُعِنَ অভিশপ্ত হয়েছে। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ) বলেন, كُلُّ شَيْئٍ فِى الْقُرْآنِ قُتِلَ فَهُوَ لُعِنَ ‘কুরআনে যেখানেই قُتِلَ এসেছে, সেখানেই তার অর্থ হবে لُعِنَ অর্থাৎ অভিশপ্ত হয়েছে (কুরতুবী)

ফার্রা বলেন, قُتِلَ -এর পূর্বে একটি ‘লাম তাকীদ’ (لَ) উহ্য রয়েছে। অর্থাৎ لَقُتِلَ ‘অবশ্যই ধ্বংস হয়েছে গর্তওয়ালারা’। যেমন وَالشَّمْسِ وَضُحَاهَا ‘সূর্য ও প্রভাতকালের শপথ’ করার পর পরপর ৭টি শপথ শেষে আল্লাহ বলছেন, قَدْ أَفْلَحَ مَنْ زَكَّاهَا ‘যে নিজের নফসকে শুদ্ধ করেছে, সে অবশ্যই সফলকাম হয়েছে’ (শাম্স ৯১/৯)

الأُخْدُوْدُ অর্থ الحفر المستطيل فى الارض ‘ভুগর্ভের দীর্ঘ বড় গর্ত’। এর উৎপত্তি خَدٌّ থেকে। যার অর্থ ‘মুখগহবর’। এখানে অগ্নিগহবর বুঝানো হয়েছে।

(৫) النَّارِ ذَاتِ الْوَقُوْدِ ‘বহু ইন্ধনযুক্ত আগুনওয়ালারা’।

পূর্ব বাক্যের الأُخْدُوْدُ হ’তে بدل الاشتمال হয়েছে। অর্থাৎ বহু ইন্ধনযুক্ত আগুনের গর্ত। الْوَقُوْدُ অর্থ ইন্ধন। কোন কোন বিদ্বান ذَاتُ الْوَقُوْدِ পড়েছেন। যার অর্থ أحرقتهم النار ذات الوقود ‘বহু দাহিকাশক্তি সম্পন্ন আগুন তাদেরকে জ্বালিয়ে দিল’ (কুরতুবী)। ‘গর্তওয়ালারা অভিশপ্ত হয়েছে’ বলে তাদের পরকালীন ধ্বংসের কথা বলা হয়েছে। ইহকালে গর্তওয়ালা যালেমরা জিতে গেলেও মানবতার কাছে ওরা চিরদিনের জন্য পরাজিত হয়েছে এবং ইতিহাসে ঘৃণিত হয়েছে। পক্ষান্তরে নিহত ঈমানদার নর-নারীগণ চিরকালের জন্য বরণীয় ও সম্মানিত হয়েছে।

(৬) إِِذْ هُمْ عَلَيْهَا قُعُوْدٌ ‘যখন তারা সেখানে উপবিষ্ট ছিল’।

(৭) وَهُمْ عَلَى مَا يَفْعَلُوْنَ بِالْمُؤْمِنِيْنَ شُهُوْدٌ ‘এবং বিশ্বাসীগণের সাথে যে আচরণ তারা করেছিল, তা প্রত্যক্ষ করছিল’।

গর্তওয়ালা কারা?

(১) মুহাম্মাদ ইবনে ইসহাক বলেন, ইয়ামনের ইহুদী বাদশাহ ইউসুফ যু-নুওয়াস বিন তুববা‘ আল-হিমইয়ারী জানতে পারলেন যে, নাজরানের পেŠত্তলিক অধিবাসীরা সব তাওহীদবাদী ঈসায়ী হয়ে গেছে জনৈক আব্দুল্লাহ ইবনুছ ছামির (عبد الله بن الثامر) নামক ছোট্ট বালকের ইবাদতগুযারী ও তার অলৌকিক ক্রিয়াকর্মে মুগ্ধ হয়ে। যু-নুওয়াস নাজরানবাসীকে এখতিয়ার দিলেন। হয় তারা শিরকপন্থী ইহুদী হবে, না হয় মৃত্যুকে আলিঙ্গন করবে। এতে নাজরানবাসীগণ মৃত্যুকে বেছে নিল। তথাপি তাওহীদবাদী ঈসায়ী ধর্ম ছাড়তে রাযী হ’ল না। তখন বাদশাহ অনেকগুলি গভীর ও দীর্ঘ অগ্নিকুন্ড তৈরী করে সেখানে তার সেনাবাহিনীর মাধ্যমে একদিন সকালেই প্রায় ২০ হাযার জীবন্ত নর-নারী ও শিশুকে পুড়িয়ে হত্যা করেন। একজন মাত্র ব্যক্তি দাওস যু-ছা‘লাবান (دوس ذو ثعلبان) কোনক্রমে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। তিনি গিয়ে শামের রোম সম্রাট ক্বায়ছারকে খবর দেন। তিনি হাবশার শাসক নাজাশীকে নির্দেশনামা পাঠান। নাজাশী তখন আরিয়াত্ব ও আবরাহা (أرياط و أبرهة) নামক দুই সেনাপতির অধীনে একদল খ্রিষ্টান সেনা পাঠিয়ে দেন। তারা গিয়ে ইয়ামনকে ইহুদী দুঃশাসন থেকে মুক্ত করেন। যা পরবর্তী ৭০ বছর অব্যাহত থাকে। ইউসুফ যু-নুওয়াস পালিয়ে গিয়ে সাগরে ঝাঁপ দিয়ে ডুবে মরেন।[6]

(২) মুহাম্মাদ ইবনে ইসহাক-এর অন্য বর্ণনায় এসেছে যে, নাজরানবাসীরা ইতিপূর্বে মূর্তিপূজারী ছিল। সেখানে একজন ঈসায়ী ধর্মযাজকের আবির্ভাব ঘটে। যিনি রাস্তার ধারে তাঁবু টাঙিয়ে সর্বদা সেখানে ছালাত ও ইবাদতে রত থাকতেন। এর মধ্যে জাদুবিদ্যা শিক্ষাকারী জনৈক বালক আব্দুল্লাহ ইবনুছ ছামির যাওয়া-আসার পথে উক্ত ঈসায়ীর কাছে উঠা-বসার মাধ্যমে ঈসায়ী হয়ে যায় এবং এক আল্লাহর উপরে বিশ্বাস স্থাপন করে নিষ্ঠাবান ধার্মিকে পরিণত হয়। তার মাধ্যমে অনেক অলৌকিক ক্রিয়াকান্ড সম্পাদিত হ’তে থাকে। বহু লোক নানাবিধ রোগ-ব্যাধি ও বিপদাপদ থেকে মুক্ত হ’তে থাকে। ফলে তারা সব ঈসায়ী হয়ে যায়।

উল্লেখ্য যে, ইসলাম আসার পর বিগত ইহুদী-নাছারা ধর্ম রহিত হয়ে গেছে। এখন ইসলাম হ’ল মানবজাতির জন্য আল্লাহর মনোনীত একমাত্র ধর্ম (আলে ইমরান ৩/১৯)। এর বাইরে কোন ধর্ম আল্লাহর নিকট কবুলযোগ্য নয় (আলে ইমরান ৩/৮৫)

লোকদের দলে দলে ঈসায়ী হওয়ার খবর পেয়ে নাজরানের পৌত্তলিক শাসক ঐ বালককে গ্রেফতার করে রাজদরবারে এনে বলেন, أفسدتَ علىَّ أهلَ قريتى وخالفتَ دينى ودينَ آبائى: لأُمثِّلَنَّ بك- ‘তুমি আমার উপরে আমার জনগণকে বিগড়ে দিয়েছ। তুমি আমার ও আমার বাপ-দাদার ধর্মের বিরোধিতা করেছ। আমি তোমার হাত-পা কেটে দেব’। তারপর বালককে হত্যা করার নানাবিধ চেষ্টা ব্যর্থ হয়। তখন বালক বলে যে, আপনি আমাকে হত্যা করতে পারবেন না, যতক্ষণ না আপনি এক আল্লাহর উপর ঈমান আনবেন। বাদশাহ তাই করলেন এবং বালককে হত্যা করলেন। কিন্তু তিনিও সেখানেই ধ্বংস হয়ে গেলেন। তখন থেকেই নাজরানে ঈসায়ী ধর্ম শিকড় গাড়ে।[7] যা শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর যামানা পর্যন্ত ছিল এবং পরে তারা সবাই ইসলাম কবুল করে ধন্য হয়।

(৩) ইমাম আহমাদ (হা/২৩৯৭৬), মুসলিম (হা/৩০০৫), তিরমিযী (হা/৩৩৪০) প্রমুখ ছোহায়েব রূমী (রাঃ) প্রমুখাৎ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) হ’তে এ বিষয়ে যে দীর্ঘ হাদীছ বর্ণনা করেছেন সংক্ষেপে তা নিম্নরূপ :

প্রাক-ইসলামী যুগের জনৈক বাদশাহর একজন জাদুকর ছিল। জাদুকর বৃদ্ধ হয়ে গেলে তার স্থলাভিষিক্ত হওয়ার জন্য একজন বালককে তার নিকটে জাদুবিদ্যা শেখার জন্য নিযুক্ত করা হয়। যাতায়াতের পথে একটি গীর্জায় একজন ঈসায়ী ধর্মযাজক ছিলেন। বালকটি দৈনিক তার কাছে বসত। ঈসায়ী ধর্মযাজকের বক্তব্য শুনে সে ঈসায়ী হয়ে যায়। কিন্তু তা গোপন রাখে। একদিন দেখা গেল যে, বড় একটি হিংস্র জন্তু (সিংহ) রাস্তা আটকে দিয়েছে। লোকেরা ভয়ে আগাতে পারছে না। বালকটি মনে মনে বলল, আজ আমি দেখব, পাদ্রীর দাওয়াত সত্য, না জাদুকরের দাওয়াত সত্য। সে একটি পাথরের টুকরা হাতে নিয়ে বলল,اللهم إن كان أمر الراهب أحب إليك من أمر الساحر فاقتل هذه الدابة حتى يمضى الناس- ‘হে আল্লাহ! যদি পাদ্রীর দাওয়াত তোমার নিকটে জাদুকরের দাওয়াতের চাইতে অধিক পসন্দনীয় হয়, তাহ’লে এই জন্তুটাকে তুমি মেরে ফেল, যাতে লোকেরা যাতায়াত করতে পারে’ বলেই সে পাথরটি নিক্ষেপ করল এবং জন্তুটি সাথে সাথে মারা পড়ল। এখবর পাদ্রীর কানে পৌঁছে গেল। তিনি বালকটিকে ডেকে বললেন, يا بنى أنت أفضل منى وإنك ستبتلى، فإن ابتليت فلا تدلّ علىّ ‘হে বৎস! তুমি আমার চাইতে উত্তম। তুমি অবশ্যই সত্বর পরীক্ষায় পতিত হবে। যদি হও, তবে আমার কথা বলো না’। বালকটির কারামত চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। তার মাধ্যমে অন্ধ ব্যক্তি চোখ ফিরে পেত। কুষ্ঠরোগী সুস্থ হ’ত এবং অন্যান্য বহু রোগ ভাল হয়ে যেত। ঘটনাক্রমে বাদশাহর এক মন্ত্রী ঐ সময় অন্ধ হয়ে যান। তিনি বহুমূল্য উপঢৌকনাদি নিয়ে বালকটির নিকটে আগমন করেন। বালকটি তাকে বলে, ما أنا أشفى أحدًا إنما يشفى الله فإن أنت أمنت بالله دعوت الله فشفاك- ‘আমি কাউকে রোগমুক্ত করি না। এটা কেবল আল্লাহ করেন। এক্ষণে যদি আপনি আল্লাহর উপরে বিশ্বাস স্থাপন করেন, তাহ’লে আমি আল্লাহর নিকটে দো‘আ করব। অতঃপর তিনিই আপনাকে সুস্থ করবেন’। মন্ত্রী ঈমান আনলেন। বালক দো‘আ করল। অতঃপর তিনি চোখের দৃষ্টি ফিরে পেলেন। পরে রাজদরবারে গেলে বাদশাহর প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন যে, আমার পালনকর্তা আমাকে সুস্থ করেছেন। বাদশাহ বলেন, তাহ’লে আমি কে? মন্ত্রী বললেন, لا، بل ربى وربك الله- ‘না। বরং আমার ও আপনার পালনকর্তা হ’লেন আল্লাহ’। তখন বাদশাহর হুকুমে নির্যাতন শুরু হয়। এক পর্যায়ে তিনি উক্ত বালকের নাম বলে দেন। তখন বালককে ধরে এনে একই প্রশ্নের একই জবাব পেয়ে তার উপরেও চালানো হয় কঠোর নির্যাতন। ফলে এক পর্যায়ে সে পাদ্রীর কথা বলে দেয়। তখন বৃদ্ধ পাদ্রীকে ধরে আনলে তিনিও একই জওয়াব দেন। বাদশাহ তাদেরকে ধর্ম ত্যাগ করতে বললে তারা অস্বীকার করেন। তখন পাদ্রী ও মন্ত্রীকে জীবন্ত করাতে চিরে তাদের মাথাসহ দেহকে দু’ভাগ করে ফেলা হয়। এরপর বালকটিকে পাহাড়ের চূড়া থেকে ফেলে দিয়ে মেরে ফেলার হুকুম দেয়া হয়। কিন্তু তাতে বাদশাহর লোকেরাই মারা পড়ে। অতঃপর তাকে নদীর মধ্যে নিয়ে নৌকা থেকে ফেলে দিয়ে পানিতে ডুবিয়ে মারার হুকুম দেওয়া হয়। কিন্তু সেখানেও বালক বেঁচে যায় ও বাদশাহর লোকেরা ডুবে মরে। দু’বারেই বালকটি আল্লাহর নিকটে দো‘আ করেছিল, اَللَّهُمَّ اكْفِنِيهِمْ بِمَا شِئْتَ ‘হে আল্লাহ! এদের হাত থেকে আমাকে রক্ষা কর যেভাবে তুমি চাও’। পরে বালকটি বাদশাহকে বলে, আপনি আমাকে কখনোই মারতে পারবেন না, যতক্ষণ না আপনি আমার কথা শুনবেন। বাদশাহ বললেন, কি সে কথা? বালকটি বলল, আপনি সমস্ত লোককে একটি ময়দানে জমা করুন। অতঃপর একটা তীর নিয়ে আমার দিকে নিক্ষেপ করার সময় বলুন, بِاسْمِ اللهِ رَبِّ الْغُلاَمِ ‘বালকটির পালনকর্তা আল্লাহর নামে’। বাদশাহ তাই করলেন এবং বালকটি মারা পড়ল। তখন উপস্থিত হাযার হাযার মানুষ সমস্বরে বলে উঠল, آمَنَّا بِرَبِّ هَذَا الْغُلاَمِ ‘আমরা বালকটির প্রভুর উপরে ঈমান আনলাম’। তখন বাদশাহ বড় বড় ও দীর্ঘ গর্ত খুঁড়ে বিশাল অগ্নিকুন্ডে নিক্ষেপ করে সবাইকে হত্যা করেন। নিক্ষেপের আগে প্রত্যেককে তাওহীদ বর্জনের বিনিময়ে মুক্তির কথা বলা হয়। কিন্তু কেউ তা মানেনি। শেষ দিকে একজন মহিলা তার শিশু সন্তান কোলে নিয়ে ইতস্ততঃ করছিলেন। হঠাৎ কোলের অবোধ শিশুটি বলে ওঠে, اِصْبِرِي يَا أُمَّاهُ، فَإِنَّكِ عَلَى الْحَقِّ ‘ধৈর্য ধরো মা! কেননা তুমি সত্যের উপরে আছো’। তখন বাদশাহর লোকেরা মা ও শিশুপুত্রকে একসাথে অগ্নিকুন্ডে নিক্ষেপ করে’। তিরমিযীর বর্ণনা অনুযায়ী ঐদিন ৭০ হাযার মানুষকে পুড়িয়ে মারা হয় (সনদ জাইয়িদ)। তবে একথাটি রাবী ছোহায়েব রূমীর হ’তে পারে। কেননা তাঁর নিকট নাছারাদের ইল্ম ছিল (ইবনু কাছীর)

উল্লেখ্য যে, বিগত যুগে গর্তওয়ালা যালেম সম্রাট ছিল তিনজন। ১. আলোচ্য ইয়ামনের বাদশাহ ইউসুফ যু-নুওয়াস বিন তুববা‘। ২. রোম সম্রাট কনস্টান্টাইন বিন হিলাসী। যখন সিরিয়ার খ্রিষ্টানরা তাওহীদ ছেড়ে ক্রুশ পূজা শুরু করে। তখন তিনি তাদের পুড়িয়ে মারেন। ৩. পারস্য (বাবেল) সম্রাট বুখতানছর। যখন তিনি তাকে সিজদা করার জন্য লোকদের নির্দেশ দেন। তখন (নবী) দানিয়াল ও তাঁর সাথীগণ এতে নিষেধ করেন। ফলে সম্রাট তাদের আগুনে নিক্ষেপ করে হত্যা করেন’।[8] ইবনু কাছীর বলেন, আরবের অন্তর্ভুক্ত ইয়ামনের নাজরানবাসীদের পুড়িয়ে মারার ঘটনা কুরআনে অত্র সূরায় বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু পারস্য সম্রাট ও রোম সম্রাটের মানুষ পুড়িয়ে মারার ঘটনা সম্পর্কে কুরআনে কিছুই বর্ণিত হয়নি (ইবনু কাছীর)

শিক্ষণীয় বিষয় :

উপরে বর্ণিত কাহিনীর প্রতি ইঙ্গিত করে আল্লাহপাক অত্র আয়াতগুলি নাযিল করেন ও মক্কার নির্যাতিত মুসলমানদের সান্ত্বনা দেন। যাহহাকের বর্ণনা মতে রাসূল (ছাঃ)-এর জন্মবর্ষে ইয়ামনের বুকে ঘটে যাওয়া (কুরতুবী) এই হৃদয়বিদারক ঘটনা বর্ণনা করে রাসূল (ছাঃ) স্বীয় ছাহাবা ও উম্মতকে সাবধান করেছেন যেন তারা দুনিয়াবী লাভের চিন্তায় শাসন-নির্যাতনের মুখে ঈমান থেকে বিচ্যুত না হয় এবং আখেরাতকে হাতছাড়া না করে।

উক্ত ঘটনায় দেখা গেছে যে, ঐ বৃদ্ধ পাদ্রী ও মন্ত্রীকে মাথায় করাত দিয়ে জীবন্ত চিরে দু’ভাগ করে ফেলা হয়েছে। তথাপি তারা ঈমান ত্যাগ করেননি। ছোট্ট বালকটির ঈমান ও ধৈর্য আরও বেশী বিস্ময়কর। সে বাদশাহকে নিজের মৃত্যুর পদ্ধতি বলে দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে যে, মৃত্যুবরণের চেয়ে সত্যকে রক্ষা করা তার নিকটে অনেক বেশী মূল্যবান। বস্ত্ততঃ বালকটির এই সত্যনিষ্ঠা ও হাসিমুখে মৃত্যুবরণের দৃশ্য হাযার হাযার মানুষের হৃদয়কে উদ্বেলিত করে এবং তারা সবাই সাথে সাথে মুসলমান হয়ে যায়। পরবর্তীতে তারাও হাসিমুখে ঈমানের বিনিময়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে। একেই বলে ‘জীবনের চেয়ে দীপ্ত মৃত্যু তখনি জানি, শহীদী রক্তে হেসে ওঠে যবে যিন্দেগানি’। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, أَفْضَلُ الْجِهَادِ كَلِمَةُ حَقٍّ عِنْدَ سُلْطَانٍ جَائِرٍ- ‘শ্রেষ্ঠ জিহাদ হ’ল যালেম শাসকের সামনে হক কথা বলা’।[9] তিনি আরও বলেন, لاَ تُشْرِكْ بِاللهِ شَيْئاً وَإِنْ قُتِلْتَ وَحُرِّقْتَ- ‘তুমি শিরক কর না। যদিও তোমাকে হত্যা করা হয় ও জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়’।[10]

বালকটিকে হত্যার পরপরই তার অনুসারী হাযার হাযার নারী-পুরুষকে শিরক বর্জন করে তাওহীদ বরণ করার অপরাধে জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছিল। রাসূল (ছাঃ)-এর যুগে খুবায়েব, আছেম, ইয়াসির পরিবার কি এর অন্যতম উদাহরণ নয়? যুগে যুগে ক্বিয়ামত পর্যন্ত এরূপ অত্যাচার-নির্যাতন মুমিন নর-নারীর উপর হ’তে থাকবে। এরপরেও ইসলাম যিন্দা থাকবে। বরং তা একদিন ভূপৃষ্ঠের প্রতিটি মাটির ঘরে ও ঝুপড়ি ঘরে প্রবেশ করবে বলে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ভবিষ্যদ্বাণী করে গেছেন।[11] ইসলামের বিজয় ও অগ্রযাত্রাকে রোখার ক্ষমতা যালেমদের হবে না। তবে আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী গভীর ধৈর্য, দৃঢ় মনোবল ও সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে যথাযোগ্য প্রস্ত্ততিসহ মুসলিম নেতৃবৃন্দকে সম্মুখে এগিয়ে যেতে হবে (আনফাল ৮/৬০)

এখানে আরেকটি বিষয় লক্ষণীয় যে, ইহুদী অত্যাচারী শাসক ইউসুফ যু-নুওয়াসের ধ্বংসের পর ক্ষমতায় বসা খ্রিষ্টান গভর্ণর আবরাহা কা‘বাগৃহের প্রতি ঈর্ষান্বিত হয়ে তাকে ধ্বংসের উদ্দেশ্যে একই বছরে মক্কা অভিযান করেন এবং আল্লাহর গযবে ধ্বংস হয়ে যান। অত্যাচারী ইহুদী শাসক ইউসুফ যু-নুওয়াস এবং ক্ষমতাগর্বী খ্রিষ্টান শাসক আবরাহা উভয়ের ধ্বংসের ঘটনা ঘটে যায় স্রেফ তাওহীদ ও শিরকের আদর্শিক সংঘাতের কারণে। দু’টি ঘটনাতেই তাওহীদের বিজয় হয়। মুহাদ্দিছগণের পরিভাষায় এরূপ ঘটনাবলীকে ‘ইরহাছাত’ (من باب إلارهاص) -এর অন্তর্ভুক্ত গণ্য করা হয়। যা ভবিষ্যৎ নবী আগমনের ভিত্তি ও নিদর্শন স্বরূপ ছিল। মানুষের সসীম জ্ঞান যা বুঝতে সর্বদা অক্ষম।

(৬-৭) إِذْ هُمْ عَلَيْهَا قُعُوْدٌ، وَهُمْ عَلَى مَا يَفْعَلُوْنَ بِالْمُؤْمِنِيْنَ شُهُوْدٌ ‘যখন তারা সেখানে উপবিষ্ট ছিল’। ‘এবং বিশ্বাসীগণের সাথে যে আচরণ তারা করছিল, তা প্রত্যক্ষ করছিল’।

এখানে إِذْ -এর عامل হ’ল পূর্ববর্তী বাক্যের قُتِلَ অর্থাৎ তারা অভিশপ্ত হয়েছে তখনই, যখন তারা অগ্নিকুন্ডে তাদের নিক্ষেপ করছিল এবং তারা তা প্রত্যক্ষ করছিল। عَلَيْهَا অর্থ عندها ‘অগ্নিকুন্ডের পাশে’। يَفْعَلُوْنَ -এর উহ্য কর্তা হ’ল ‘কাফেররা’। عَلَى অর্থ مع অর্থাৎ মুমিনদের সাথে যে ব্যবহার করা হচ্ছিল’। এখানে ‘তারা বসে বসে প্রত্যক্ষ করছিল’ বলার মধ্যে শ্লেষমিশ্রিত ক্ষোভ রয়েছে ঐসব লোকদের প্রতি, যারা অন্যায় দেখে প্রতিবাদ করে না বা প্রতিরোধের কোন ব্যবস্থা নেয় না।

(৮-৯) وَمَا نَقَمُوْا مِنْهُمْ إِلاَّ أَنْ يُؤْمِنُوْا بِاللهِ الْعَزِيْزِ الْحَمِيْدِ، الَّذِيْ لَهُ مُلْكُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَاللهُ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ شَهِيْدٌ- ‘তারা তাদের থেকে প্রতিশোধ নিয়েছিল কেবল এই কারণে যে, তারা বিশ্বাস স্থাপন করেছিল মহাপরাক্রান্ত ও মহাপ্রশংসিত আল্লাহর উপরে’। ‘যার হাতে রয়েছে আসমান ও যমীনের মালিকানা। বস্ত্ততঃ আল্লাহ সবকিছু প্রত্যক্ষ করছেন’।

অর্থাৎ উক্ত মযলূম মানুষগুলির একমাত্র অপরাধ ছিল আল্লাহর উপর ঈমান আনা। আর একারণেই তাদের উপরে প্রতিশোধ নেওয়া হয়েছিল। যদি তারা যুগ যুগ ধরে চলে আসা বাপ-দাদার ধর্মের উপরে টিকে থাকত এবং আল্লাহর উপরে ঈমান না আনতো, তাহ’লে তাদের উপরে এই যুলুম নেমে আসত না।

এখানে আল্লাহ স্বীয় ছিফাত হিসাবে ‘আযীয’ (মহাপরাক্রান্ত) ও ‘হামীদ’ (মহাপ্রশংসিত) এনেছেন। অতঃপর বলেছেন, যার হাতে রয়েছে আসমান ও যমীনের মালিকানা এবং তিনি সবকিছু দেখছেন’। একথাগুলির মধ্যে যালেমদের প্রতি প্রচ্ছন্ন হুমকি রয়েছে। বরং প্রকাশ্যেই বলে দেয়া হয়েছে যে, অত্যাচারী যত বড় শক্তিশালী হৌক না কেন, তার অত্যাচার প্রতিরোধে তিনি ‘আযীয’ বা মহাপরাক্রান্ত। আর মযলূমের পক্ষে যালেমদের বদলা নেয়ার জন্য তিনি ‘হামীদ’ বা চির প্রশংসিত। আসমান ও যমীনের বাইরে পালাবার কোন ক্ষমতা যালেমদের নেই। আর এসবের উপরেই রয়েছে আল্লাহর একচ্ছত্র আধিপত্য ও নিরংকুশ মালিকানা। তাই যে কোনভাবেই হৌক আল্লাহ যালেমদের প্রতিশোধ নেবেনই।

وَاللهُ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ شَهِيْدٌ ‘বস্ত্ততঃ আল্লাহ সবকিছু প্রত্যক্ষ করছেন’। অর্থ عالم بأعمال خلقه لا ةخفى عليه خافية ‘তিনি তার সৃষ্টজীবের কর্মসমূহ জানেন। তাঁর নিকট কোন কিছুই গোপন থাকেনা’। এর দ্বারা যালেম ও মযলূম উভয়কে হুঁশিয়ার করা হয়েছে। যালেম যেন যুলুম না করে এবং মযলূম যেন ধৈর্য হারিয়ে কুফরী না করে। বরং যালেমদের জানা উচিত যে, তাদের এই যুলুম হ’ল উম্মতের জাগৃতির সোপান (بل هذه النقم هى الموقظات للأمم والأفراد)। মযলূমকে তাই আল্লাহর উপর ঈমান রেখে সকল প্রকার বৈধ পথে যালেমকে রুখে দাঁড়াবার সার্বিক প্রস্ত্ততি নিতে হবে (আনফাল ৮/৬০)

(১০) إِنَّ الَّذِيْنَ فَتَنُوا الْمُؤْمِنِيْنَ وَالْمُؤْمِنَاتِ ثُمَّ لَمْ يَتُوْبُوْا فَلَهُمْ عَذَابُ جَهَنَّمَ وَلَهُمْ عَذَابُ الْحَرِيْقِ ‘নিশ্চয়ই যারা মুমিন পুরুষ ও নারীদের নির্যাতন করেছে, অতঃপর তারা তওবা করেনি, তাদের জন্য রয়েছে জাহান্নামের শাস্তি এবং রয়েছে তীব্র দহন জ্বালা’।

অর্থাৎ গর্তওয়ালা কাফেররা যেসব নারী-পুরুষকে ঈমান আনার কারণে পুড়িয়ে হত্যা করেছে অথবা মক্কাবাসীরা শেষনবী ও তাঁর সাথীদের উপরে এবং যুগে যুগে যালেমরা ঈমানদারগণের উপরে যেসব নির্যাতন করে চলেছে, অথচ তারা তওবা করেনি, তাদের জন্য জাহান্নামে দ্বিগুণ শাস্তি রয়েছে। এক তো কুফরীর শাস্তি। দ্বিতীয় ঈমানদারগণকে নির্যাতন করার শাস্তি। জাহান্নামে এই দ্বিগুণ শাস্তি কিভাবে দেওয়া হবে, সেটা আল্লাহ ভাল জানেন। তবে আমরা যেমন তিনশ’ পাওয়ারের হিটার ব্যবহার করি, আবার হাযার পাওয়ারের হিটার ব্যবহার করি। অনুরূপভাবে জাহান্নামের হিটারের সুইচ যাঁর হাতে, তিনি সেখানে কাকে কিভাবে শাস্তি দিবেন, কত মাত্রায় দিবেন, সেটা তিনিই ভাল জানেন। আল্লাহ আমাদেরকে রক্ষা করুন -আমীন!

হাসান বাছরী বলেন,أنظروا الى هذا الكرم والجود، قةلوا أولياءه وهو يدعوهم إلى الةوبة والمغفرة- ‘আল্লাহর দয়া ও করুণা দেখ, তার বন্ধু ঈমানদারগণকে যারা অন্যায়ভাবে হত্যা করল, তিনি তাদেরকেও তওবা ও ক্ষমা প্রার্থনার আহবান জানাচ্ছেন’ (ইবনু কাছীর)। অর্থাৎ যদি তারা তওবা ও ক্ষমা প্রার্থনা করে, তাহ’লে তিনি ঐ দুরাচার কাফেরদের ক্ষমা করে দেবেন। নইলে জাহান্নামে শাস্তি দিবেন। এর মধ্যে মুমিনদের ফিৎনায় নিক্ষেপকারী ও যুগে যুগে নির্যাতনকারী যালেমদের প্রতি যেমন হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করা হয়েছে, তেমনি তাদেরকে যুলুম থেকে তওবা করার আহবান জানানো হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে এক গভীর দূরদৃষ্টি। কেননা যালেমরা যদি একবার ভেবে নেয় যে, তাদের পাপের কোন ক্ষমা নেই, তাহ’লে তারা যিদ বশে অধিক পাপকাজে উৎসাহী হবে। আর যদি মনে করে যে, তওবা করলে আল্লাহ তাদের ক্ষমা করবেন, তাহ’লে তারা দ্রুত অনুতপ্ত হয়ে ফিরে আসবে এবং তার জীবনের মোড় পবিবর্তন হয়ে যেতে পারে। আল্লাহ বলেন, قُلْ يَا عِبَادِيَ الَّذِيْنَ أَسْرَفُوْا عَلَى أَنْفُسِهِمْ لاَ تَقْنَطُوْا مِنْ رَّحْمَةِ اللهِ إِنَّ اللهَ يَغْفِرُ الذُّنُوْبَ جَمِيْعاً إِنَّهُ هُوَ الْغَفُوْرُ الرَّحِيْمُ- ‘হে রাসূল! তুমি বলে দাও যে, হে আমার বান্দারা! যারা নিজেদের নফসের উপরে যুলুম করেছ, তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। অবশ্যই আল্লাহ সকল গোনাহ মাফ করে থাকেন। নিশ্চয়ই তিনি ক্ষমাশীল ও দয়াময়’ (যুমার ৩৯/৫৩)

জাহান্নামের আযাব ও দহনজ্বালার আযাবের অর্থ এটাও হ’তে পারে যে, যালেমদের আযাব দুনিয়া ও আখেরাতে দু’জায়গাতেই হবে এবং সাধারণতঃ সেটাই হয়ে থাকে। যেমন আল্লাহ বলেন, وَلَنُذِيْقَنَّهُمْ مِنَ الْعَذَابِ الْأَدْنَى دُوْنَ الْعَذَابِ الْأَكْبَرِ لَعَلَّهُمْ يَرْجِعُوْنَ- ‘আমরা অবশ্যই তাদেরকে বড় শাস্তির পূর্বে লঘু শাস্তির স্বাদ আস্বাদন করাব, যাতে তারা ফিরে আসে’ (সাজদাহ ৩২/২১)। নিঃসন্দেহে যালেমদের এই শাস্তি দুনিয়াতেই হবে। নইলে আখেরাতে তো আর ফিরে আসার সুযোগ নেই। আদ, ছামূদ, ফেরাঊন, আবু জাহল, আবু লাহাবসহ বিগত যুগের ও বর্তমান যুগের কোন যালেমই আল্লাহর এই শাস্তি থেকে রেহাই পায়নি, পাবেও না। বলা চলে যে, এটা আল্লাহর এক সাধারণ নীতি। এছাড়া আখেরাতের কঠিন শাস্তি তো আছেই। যা দুনিয়াবী শাস্তির তুলনায় হাযার গুণ বেশী। যেমন আল্লাহ বলেন, لَهُمْ عَذَابٌ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَلَعَذَابُ الْآخِرَةِ أَشَقُّ وَمَا لَهُم مِّنَ اللهِ مِنْ وَّاقٍ ‘দুনিয়ার জীবনে এদের জন্য রয়েছে আযাব এবং অবশ্যই আখেরাতের আযাব এর চাইতে কঠোরতম। আল্লাহর কবল থেকে তাদের রক্ষাকারী কেউ নেই’ (রা‘দ ১৩/৩৪)।

(১১)إِنَّ الَّذِينَ آمَنُوْا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ لَهُمْ جَنَّاتٌ تَجْرِيْ مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ ذَلِكَ الْفَوْزُ الْكَبِيْرُ- ‘পক্ষান্তরে যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে, তাদের জন্য রয়েছে জান্নাত। যার তলদেশ দিয়ে প্রবাহিত হয় নদীসমূহ। আর এটাই হ’ল বড় সফলতা’।

অর্থাৎ যারা বাপ-দাদার আমল থেকে চলে আসা কুসংস্কার ছেড়ে খালেছ তাওহীদে বিশ্বাস স্থাপন করেছিল, সেইসব ঈমানদার নর-নারীকে যেসব যালেমরা অগ্নিকুন্ডে নিক্ষেপ করে হত্যা করেছে, একইভাবে মক্কার মুশরিক নেতারা এবং পরবর্তীকালে যেসব যালেমরা শক্তির জোরে ঈমানদারগণের উপরে যুলুম করে চলেছে, ঐসব ঈমানদার ও সৎকর্মশীল মানুষের জন্য আল্লাহ প্রস্ত্তত করে রেখেছেন শান্তিময় জান্নাত, যার নীচ দিয়ে প্রবাহিত হয় নদী ও ঝর্ণাসমূহ এবং এটাই হ’ল সবচেয়ে বড় সফলতা। যালেমদের দৃষ্টিতে ঈমানদাররা পরাজিত ও ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু আল্লাহর দৃষ্টিতে ঈমানদারগণ জয়ী ও সফল হয়েছে। জ্ঞানী ও বিবেকবান সমাজও সেটাই মনে করেন। তা না হ’লে যে নবীগণ দুনিয়াতে কেবল নির্যাতিতই হয়েছেন, মৃত্যুর পরে বিশ্বব্যাপী তাদের অনুসারী দল কিভাবে সৃষ্টি হয়?

সসীম জ্ঞানের মানুষ আল্লাহর এ কথায় নিশ্চয়ই হাসবে ও তাচ্ছিল্য করবে। কিন্তু তারা জানে না যে, তাদের জ্ঞানের বাইরে বহু জিনিস লুকিয়ে আছে, যা তাদের ধারণা ও কল্পনার অলিন্দে কখনোই প্রবেশ করতে পারে না। আমরা প্রতিনিয়ত দেখছি যালেম সর্বদা জয়ী হচ্ছে ও মযলূম পরাজিত হচ্ছে। যালেম তার অর্থ-বিত্ত ও শক্তির জোরে সর্বত্র বাহবা কুড়াচ্ছে। প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় হরহামেশা তাদের প্রশংসাগীতি হচ্ছে। অন্যদিকে নির্দোষ নিরপরাধ মযলূম সদা বদনামগ্রস্ত হচ্ছে। দুনিয়ার এ অবস্থা নিশ্চিতভাবে দাবী করে যে, এমন একটি জগত অপরিহার্য, যেখানে যালেম তার প্রাপ্য শাস্তি পাবে এবং মযলূম তার যথার্থ পুরস্কার পাবে। নিঃসন্দেহে সেই জগতটাই হ’ল আখেরাত। দুনিয়ার সফলতা-ব্যর্থতা চূড়ান্ত কিছু নয়। বরং চূড়ান্ত হ’ল আখেরাতের ফায়ছালা। আল্লাহপাক অত্র আয়াতে ঈমানদার ও সৎকর্মশীল নর-নারীদের জন্য আগাম সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে জান্নাতের সুসংবাদ দিয়েছেন। জান্নাত যেন অপেক্ষায় আছে ঈমানদার নর-নারীদের পাবার জন্য। ক্বিয়ামতের দিন যখন তারা সেখানে প্রবেশ করবে, তখন দাররক্ষীসহ চারিদিক থেকে ফেরেশতাগণের অভিবাদনের আওয়ায আসবে সালাম আর সালাম। سَلاَمٌ عَلَيْكُمْ طِبْتُمْ فَادْخُلُوْهَا خَالِدِيْنَ ‘আপনাদের উপর সালাম। আসুন! শান্তির সাথে চিরকালের জন্য এখানে প্রবেশ করুন’।[12] নিঃসন্দেহে এটিই হ’ল বড় সফলতা। দুনিয়ায় যার কোন তুলনা নেই। আল্লাহ আমাদেরকে সেই সফলতা দান করুন- আমীন!

(১২) إِنَّ بَطْشَ رَبِّكَ لَشَدِيْدٌ ‘নিশ্চয়ই তোমার পালনকর্তার পাকড়াও অত্যন্ত কঠিন’। এর মাধ্যমে যালেমদের প্রতি কঠোর হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করা হয়েছে।

মুবাররাদ বলেন, এটি পূর্ববর্তী শপথের জওয়াব হিসাবে এসেছে অর্থাৎ وَالسَّمَاءِ ذَاتِ الْبُرُوْجِ ‘নক্ষত্রশোভিত আকাশের শপথ’ বলার পরে মধ্যবর্তী বাক্যগুলি শপথের তাকীদ হিসাবে এসেছে। হাকীম তিরমিযীও একথা বলেছেন। অর্থাৎ যারা রাসূল (ছাঃ)-কে অবিশ্বাস করে বা তাঁর আনীত শরী‘আতের অবাধ্যতা করে এবং ঈমানদার নর-নারীদের উপর যুলুম করে, তাদের বিরুদ্ধে শপথ করে আল্লাহ বলছেন যে, অবশ্যই তোমার প্রভুর পাকড়াও অত্যন্ত কঠিন। যখন তিনি ধরবেন, তখন সেখান থেকে নিষ্কৃতির কোন পথ আর থাকবে না। অতএব সাবধান হও হে মানুষ! তওবা করে যুলুম ও অবাধ্যতা হ’তে নিবৃত্ত হও! আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অনুগত হও!!

আল্লাহ বলেন, وَالَّذِيْنَ كَذَّبُوْا بِآيَاتِنَا سَنَسْتَدْرِجُهُمْ مِنْ حَيْثُ لاَ يَعْلَمُوْنَ، وَأُمْلِي لَهُمْ إِنَّ كَيْدِي مَتِيْنٌ ‘যারা আমাদের আয়াতসমূহে মিথ্যারোপ করে, আমরা তাদের অজান্তে ধীরে ধীরে তাদের পাকড়াও করি’। ‘আমি তাদেরকে অবকাশ দেই। নিশ্চয়ই আমার কৌশল অত্যন্ত মযবুত’ (আ‘রাফ ৭/১৮২-৮৩; ক্বলম ৬৮/৪৪-৪৫)। তিনি বলেন, وَكَذَلِكَ أَخْذُ رَبِّكَ إِذَا أَخَذَ الْقُرَى وَهِيَ ظَالِمَةٌ إِنَّ أَخْذَهُ أَلِيمٌ شَدِيدٌ ‘আর এভাবেই তোমার প্রতিপালক অত্যাচারী জনপদকে পাকড়াও করেন। নিঃসন্দেহে তাঁর পাকড়াও অত্যন্ত মর্মন্তুদ ও কঠোর’ (হূদ ১১/১০২)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, إِنَّ اللهَ لَيُمْلِى لِلظَّالِمِ حَتَّى إِذَا أَخَذَهُ لَمْ يُفْلِتْهُ ثُمَّ قَرَأَ ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ যালেমকে অবকাশ দেন। অবশেষে যখন তিনি তাকে ধরেন, তখন আর সুযোগ দেন না। অতঃপর তিনি হূদ ১০২ আয়াতটি পাঠ করেন’।[13]

(১৩) إِنَّهُ هُوَ يُبْدِئُ وَيُعِيْدُ ‘তিনি প্রথম সৃষ্টি করেন এবং তার পুনরাবৃত্তি করেন’। অর্থাৎ যাবতীয় সৃষ্টির সূচনা তিনিই করেছেন এবং সবকিছু ধ্বংস হয়ে যাবার পরে তিনিই আবার পুনরুত্থান ঘটাবেন। মানুষ মরে মাটি হয়ে যাবে। কিন্তু তাঁর হুকুমে ক্বিয়ামতের দিন সবাই পুনর্জীবিত হবে। আর যিনি প্রথমবার সৃষ্টি করেন, তাঁর পক্ষে পুনরায় সৃষ্টি করা খুবই সহজ। আল্লাহ বলেন, وَهُوَ الَّذِي يَبْدَأُ الْخَلْقَ ثُمَّ يُعِيدُهُ وَهُوَ أَهْوَنُ عَلَيْهِ وَلَهُ الْمَثَلُ الْأَعْلَى فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَهُوَ الْعَزِيْزُ الْحَكِيْمُ ‘তিনিই সৃষ্টির সূচনা করেন। অতঃপর তার পুনরাবৃত্তি করবেন। আর এটি তাঁর জন্য অতীব সহজ। নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলে সর্বোচ্চ স্থান তাঁরই। তিনি মহাপরাক্রান্ত ও প্রজ্ঞাময়’ (রূম ৩০/২৭)

(১৪-১৫) وَهُوَ الْغَفُوْرُ الْوَدُوْدُ، ذُو الْعَرْشِ الْمَجِيْدُ ‘তিনি ক্ষমাশীল, প্রেমময়। ‘তিনি আরশের মালিক, তিনি মহিমাময়’।

অর্থাৎ তিনি তওবাকারী ও ক্ষমাপ্রার্থনাকারী সকল বান্দার প্রতি ক্ষমাশীল এবং বান্দার প্রতি প্রেমময় ও দয়ার্দ্র্যচিত্ত। কারণ মানুষ হ’ল আল্লাহর অত্যন্ত প্রিয় সৃষ্টি, যাকে তিনি নিজ দু’হাতে সৃষ্টি করেছেন (ছোয়াদ ৩৮/৭৫) এবং যাকে দুনিয়ার সকল সৃষ্টির উপরে সম্মানিত করেছেন (বনী ইসরাঈল ১৭/৭০)। তারা পাপ করে তওবা করলে যেমন তিনি ক্ষমা করেন, তেমনি পাপী ও নিরপরাধ সকল বান্দাকে তিনি আলো দিয়ে, বায়ু দিয়ে, পানি দিয়ে এক কথায় সকল প্রকার নে‘মত দিয়ে বাঁচিয়ে রাখেন। কারণ তিনি প্রেমময়। তিনি অতীব দয়াশীল ও স্নেহময়। তিনি কেবল মানুষের সৃষ্টিকর্তাই নন; বরং মহান আরশের মালিক। যার বিস্তৃতি এত বিশাল যে, তার মধ্যে ‘আসমান ও যমীন সবই পরিবেষ্টিত’ (বাক্বারাহ ২/২৫৫)

হাফেয ইবনু কাছীর বলেন, এখানে الْمَجِيْدُ -এর শেষে পেশ অথবা যের দু’টিই পড়া যাবে। দুটিই ছহীহ। পেশ পড়লে তখন ওটা আল্লাহর ছিফাত হবে এবং যের পড়লে আরশ-এর ছিফাত হবে (ইবনু কাছীর)

আরশ ও কুরসী :

হযরত আবু যর গেফারী (রাঃ) বলেন, আমি মাসজিদুল হারামে প্রবেশ করলাম। দেখলাম রাসূল (ছাঃ) একা আছেন। তখন আমি তাঁর নিকটে গিয়ে বসলাম। অতঃপর আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আপনার নিকট সর্বোত্তম কোন্ আয়াতটি নাযিল হয়েছে? তিনি বললেন, আয়াতুল কুরসী (বাক্বারাহ ২/২৫৫)। মনে রেখ, مَا السَّمَوَاتُ السَّبْعُ فِي الْكُرْسِيِّ إِلاَّ كَحَلْقَةٍ مُلْقَاةٍ بِأَرْضِ فَلاَةٍ وَفَضْلُ الْعَرْشِ عَلَى الْكُرْسِيِّ كَفَضْلِ تِلْكَ الْفَلاَةِ عَلَى تِلْكَ الْحَلْقَةِ ‘কুরসীর তুলনায় সাত আসমান প্রশস্ত ময়দানে ফেলে রাখা একটি আংটির মত। আর আরশের তুলনায় কুরসীও অনুরূপ একটি আংটির মত’ (মুছান্নাফ ইবনু আবী শায়বাহ, কিতাবুল ‘আরশ)। শায়খ আলবানী (রহঃ) বলেন, কুরসী বিষয়ে এটি ব্যতীত আর কোন ছহীহ মরফূ হাদীছ নেই। তিনি বলেন, আরশের পরে কুরসী হ’ল আল্লাহর সবচেয়ে বড় সৃষ্টি এবং দু’টি সম্পূর্ণ পৃথক বস্ত্ত। ‘কুরসী’ অর্থ আল্লাহর পা রাখার স্থান (موضغ القدمين) নয় বা তাঁর ইলম কিংবা রাজত্ব নয়। এসব বিষয়ে রাসূল (ছাঃ) থেকে কোন ছহীহ হাদীছ বর্ণিত হয়নি।[14]

(১৬) فَعَّالٌ لِّمَا يُرِيْدُ ‘তিনি যা চান, তাই করেন’। অর্থাৎ তার হুকুমকে রদ করার ক্ষমতা কারু নেই এবং তিনি দ্রুত হিসাব গ্রহণকারী ও দ্রুত শাস্তি দানকারী’ (রা‘দ ১৩/৪১; আন‘আম ৬/১১৫, ১৬৫)। তিনি যা করেন, তাতে প্রশ্ন তোলার ক্ষমতা কারু নেই (আম্বিয়া ২১/২৩)। তিনি যদি কাউকে কষ্ট দেন, তা দূর করার কেউ নেই তিনি ব্যতীত। আর তিনি যদি কারু মঙ্গল করেন, তবে সেটাকেও রদ করার ক্ষমতা কারু নেই। সব কিছুর উপরে তিনি একচ্ছত্র ক্ষমতাশালী। তিনি প্রজ্ঞাময় ও সর্বজ্ঞ (আন‘আম ৬/১৭-১৮; ইউনুস ১০/১০৭)।

মৃত্যুশয্যায় শায়িত হযরত আবুবকর (রাঃ)-কে দেখতে আসা ছাহাবীগণ বললেন, ألا نأتيك بطبيب ‘আমরা কি আপনার জন্য ডাক্তার আনব না’? জওয়াবে তিনি বললেন, قد رآنى ‘তিনি আমাকে দেখেছেন’। ছাহাবীগণ বললেন, فما قال لك؟ ‘তিনি আপনাকে কি বলেছেন? জবাবে আবুবকর ছিদ্দীক (রাঃ) বললেন, قَالَ: إِنِّىْ فَعَّالٌ لِّمَا يُرِيْدُ ‘তিনি বলেছেন যে, আমি যা চাই তাই করি’ (কুরতুবী, ইবনু কাছীর)সুবহানাল্লাহ, কত বড় তাওয়াক্কুল!

(১৭-১৮) هَلْ أَتَاكَ حَدِيْثُ الْجُنُوْدِ، فِرْعَوْنَ وَثَمُوْدَ ‘তোমার কাছে সেনাদলের খবর পৌঁছেছে কি? ‘ফেরাঊনের ও ছামূদের’?

অত্র আয়াতে স্বীয় রাসূলকে সান্ত্বনা দিয়ে আল্লাহ বলেন, দোর্দন্ড প্রতাপ শাসক ফেরাঊন ও তার বিশাল সেনাদলকে এবং দুর্ধর্ষ ছামূদ জাতিকে আমি চোখের পলকে ধ্বংস করেছি এবং তাদের নাম-নিশানা মুছে দিয়েছি তাদের সীমাতিরিক্ত বাড়াবাড়ির কারণে। অতএব হে রাসূল! তুমি ভয় পাবে না। তোমার প্রতিপক্ষ মক্কার কাফেররা তাদের তুলনায় কিছুই নয়। তাদের বাড়াবাড়ির পরিণামও বিগত জাতিগুলোর মতই হবে। ওরা তোমার কোনই ক্ষতি করতে পারবে না। যেমন পারেনি ছামূদ জাতির নবী ছালেহ এবং ফেরাঊনের কাছে প্রেরিত নবী মূসা ও হারূণের। এখানে ছামূদ ও ফেরাঊনকে নির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করার কারণ হ’ল ছামূদ ছিল আরবদের একটি জাতি। যাদের ধ্বংসলীলার ঘটনা আরবদের নিকটে প্রসিদ্ধ ছিল। অন্যদিকে ফেরাঊনের ঘটনা ছিল মিসরের এবং তা কিতাবধারী ইহুদী-নাছারাদের নিকটে খুবই পরিচিত ছিল।

 فِرْعَوْنَ وَثَمُوْدَ তার পূর্ববর্তী حَدِيْثُ الْجُنُوْدِ থেকে بدل হয়েছে। অর্থাৎ ফেরাঊন ও ছামূদের সেনাদলের পরিণতির খবর তুমি জানো কি?

(১৯-২০) بَلِ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا فِيْ تَكْذِيْبٍ، وَاللهُ مِنْ وَرَآئِهِمْ مُّحِيْطٌ ‘বরং কাফেররা মিথ্যারোপে লিপ্ত আছে’। ‘অথচ আল্লাহ তাদেরকে চারদিক থেকে পরিবেষ্টন করে আছেন’। অর্থাৎ আল্লাহ তাদের পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব রাখেন।

এখানে تَكْذِيْبٍ অর্থ تكذيب للحق والوحي مع وضوح آياته وظهور بيناته عنادًا وبغيًا ‘আল্লাহর নিদর্শন সমূহ প্রকাশিত হওয়া সত্ত্বেও হঠকারিতা ও বিদ্রোহ বশে তারা হক ও অহি-র ব্যাপারে মিথ্যারোপ করে’ (ক্বাসেমী)

অর্থাৎ মক্কার কাফেররা ছামূদ, ফেরাঊন প্রমুখ বিগত কাফেরদের মন্দ পরিণতি জানা সত্ত্বেও শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর উপরে মিথ্যারোপে লিপ্ত রয়েছে। তাই এতে বিস্ময়ের কিছু নেই। বরং এদের মিথ্যারোপ পূর্বেকার সকল মিথ্যারোপের চাইতে বেশী। অথচ তারা বিলক্ষণ জানে যে, তারা চারিদিক থেকে আল্লাহর ঘেরাওয়ের মধ্যে রয়েছে। তাঁর পাকড়াও থেকে বাঁচার ক্ষমতা যেমন ফেরাঊন ও ছামূদ জাতির হয়নি, তেমনি মক্কার কাফেরদের এমনকি কোন যুগের কাফির-মুনাফিকদের হবে না। একথা বলার মাধ্যমে আল্লাহ সকল যুগের ঈমানদার নর-নারীর উপরে ও ইসলামের প্রচার ও প্রসারে নিবেদিতপ্রাণ নেতৃবৃন্দের উপরে নির্যাতনকারী কাফের ও ফাসেকদের হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন।

مِنْ وَرَآئِهِمْ অর্থ ‘তাদের পিছন থেকে’। যেমন অন্য আয়াতে এসেছে, وَرَاءَ ظَهْرِهِ ‘তার পিঠের পিছন থেকে’ (ইনশিক্বাক্ব ৮৪/১০)। অর্থাৎ الله مُحْصٍ عليهم أعمَالَهم ومُجازِيْهم على جَمِيْعها ‘আল্লাহ তাদের সকল কর্ম গণনা করে রাখছেন এবং তিনি সবগুলির যথাযথ বদলা দিবেন’ (ক্বাসেমী)।অথবা এর দ্বারা এটা বুঝানো হয়েছে যে, যালেমরা পিছন দিক দিয়েও পালাবার পথ পাবে না। সেদিকেও আল্লাহ তাদের ঘিরে রেখেছেন।

(২১-২২) بَلْ هُوَ قُرْآنٌ مَّجِيْدٌ، فِيْ لَوْحٍ مَّحْفُوْظٍ ‘বরং এটি মর্যাদামন্ডিত কুরআন’ ‘যা সুরক্ষিত ফলকে লিপিবদ্ধ’।

একথার মধ্যে অবিশ্বাসীদের প্রতি ধমক ও তাচ্ছিল্য রয়েছে। কারণ তারা আল্লাহর কালামকে দূরে নিক্ষেপ করে নিজেদের প্রবৃত্তির অনুসারী হয়েছে। অথচ তারা যে কুরআনকে মিথ্যা সাব্যস্ত করছে, তা অতীব পবিত্র ও উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন। এটি কোন সৃষ্ট বস্ত্ত নয়; বরং সরাসরি আল্লাহর কালাম। এটি সর্বোচ্চ স্থানে সুরক্ষিত ফলকে লিপিবদ্ধ। যাতে কোন বাতিলের প্রবেশাধিকার নেই (হামীম সাজদাহ ৪১/৪২) বা কোনরূপ পরিবর্তন ও কমবেশী করার সুযোগ নেই (আন‘আম ৬/১১৫; ইউনুস ১০/১৫; কাহফ ১৮/২৭)। অতএব কুরআনের উপর কাফেরদের অবিশ্বাস ও মিথ্যারোপে কিছুই যায় আসে না। তারা এর কোনই ক্ষতি করতে পারবে না।

এর মধ্যে মুমিনদের প্রতি উপদেশ রয়েছে, তারা যেন অভ্রান্ত সত্যের উৎস পবিত্র কুরআনকে অাঁকড়ে থাকে এবং সার্বিক জীবনে তার অনুসারী হয়ে দুনিয়া ও আখেরাতে সফলকাম হয়।

সারকথা :

অত্র সূরায় বিগত সময়ে গর্তওয়ালাদের জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যা করার ঘটনা এবং ফেরাঊন ও ছামূদ জাতির ধ্বংসের ঘটনা স্মরণ করিয়ে দিয়ে আল্লাহ তাঁর রাসূল ও উম্মতে মুহাম্মাদীকে কুরআনী সত্য দৃঢ়ভাবে অাঁকড়ে ধরার ও তার বিধানসমূহ বাস্তবায়নে জীবন উৎসর্গ করার প্রতি উৎসাহিত করেছেন।


[1]. বুখারী হা/৮৪৬, মুসলিম হা/৭১, মিশকাত হা/৪৫৯৬।

[2]. আহমাদ হা/৯৫৩২, আবূদাঊদ হা/৩৯০৪, মিশকাত হা/৪৫৯৯।

[3]. মুসলিম হা/২২৩০, মিশকাত হা/৪৫৯৫।

[4]. দুর্ভাগ্য, এই শিরকী বিশ্বাসকে মানুষের হৃদয়ে দৃঢ়ভাবে প্রোথিত করার জন্য বিভিন্ন নভোথিয়েটারে সৌরজগত প্রদর্শনের নামে প্রতিদিন এইসব রাশিগুলিই দেখানো হয় এবং বিভিন্ন পঞ্জিকায় ও পত্রিকায় রাশিফল প্রচার করা হয়। এগুলি মানুষকে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস থেকে দূরে নিয়ে যাচ্ছে। তাওহীদ বিশ্বাস থেকে মুখ ফিরানোর আরেকটি শয়তানী ফাঁদ ‘কোয়ান্টাম মেথড’-এর নেতারা একই উদ্দেশ্যে এই আয়াতকে তাদের প্রতারণার পক্ষে প্রমাণ হিসাবে পেশ করেছেন। অতএব জান্নাতপিয়াসী মুমিনগণ সাবধান!

উল্লেখ্য যে, জ্যোতিষীরা ভাগ্য গণনার জন্য প্রাচীন যুগেই তৈরী করেছেন রাশিচক্র। রাশিচক্র মাকড়শার জালের মত একটি চক্রাকার চিত্র, যাতে সূর্যের গতিপথ অনুসারে ১২টি রাশি স্থির করা হয়েছে। সেখানে বিশেষ কোন দিনে নক্ষত্রমন্ডলের পটভূমিতে দেখানো হয় বিভিন্ন গ্রহ, সূর্য ও চন্দ্রের অবস্থান। এই অবস্থান অনুসারে নেওয়া হয় ভাগ্য গণনার সিদ্ধান্ত। পশ্চিমা বিশ্বে ‘শুক্র’ (ভেনাস)-কে প্রেমের দেবী বলা হয়। অতএব শুক্র যদি রাশিচক্রের বিশেষ স্থানে থাকে, তাহ’লে জ্যোতিষীরা বলে থাকেন জাতকের উপর প্রেম ভর করেছে। পক্ষান্তরে ভারতীয় পুরাণে ‘শুক্র’ অসুরদের গুরু। অতএব ভারতীয় মতে জ্যোতিষীরা বলে থাকেন, জাতকের উপর প্রেমের বদলে হিংস্রতা ভর করেছে। ফলে কোন ব্যক্তি পশ্চিমাদের রাশিচক্র অনুসারে প্রেমে ডুববে এবং ভারতীয় মতে হিংস্রতায় মেতে উঠবে; যা পরস্পর বিরোধী। এছাড়াও পশ্চিমারা সূর্যের হিসাবে ভাগ্য গণনা করে এবং ভারতীয়রা চন্দ্রের হিসাবে গণনা করে। সবকিছুই কাল্পনিক। ফলে মতভেদ স্বাভাবিক।

 بُرُوْجٌ        শব্দটি কুরআনের চার জায়গায় এসেছে। যথা সূরা নিসা ৭৮, হিজর ১৬, ফুরক্বান ৬১ ও বুরূজ ১। এগুলির মধ্যে সূরা নিসা ৭৮ আয়াতে ‘বুরূজ’ অর্থ দুর্গসমূহ। কারণ এখানে مُشَيَّدَةٍ বিশেষণ রয়েছে, যার অর্থ সুদৃঢ়। তাছাড়া পৃথিবীতে সামরিক দুর্গগুলি অন্যের থেকে পৃথক ও সুপ্রকাশিত। বাকী তিনটি আয়াতে ‘বুরূজ’ অর্থ নক্ষত্ররাজি, যা আকাশে প্রকাশিত হয়। কিন্তু উক্ত আয়াত তিনটির অনুবাদে অনেকের ভুল হয়েছে। যেমন (১) মাওলানা মহিউদ্দীন খান برج অর্থ হিজর ১৬ ও ফুরক্বান ৬১ আয়াতে করেছেন ‘রাশিচক্র’। কিন্তু সূরা বুরূজ ১ আয়াতে অর্থ করেছেন ‘শপথ গ্রহ-নক্ষত্রশোভিত আকাশের’ যা সঠিক। অতঃপর তিনি পরবর্তী দার্শনিক তাফসীরবিদদের ধারণাসমূহের প্রতিবাদ করেছেন। যেমন সমগ্র আকাশমন্ডলী বার ভাগে বিভক্ত। এর প্রত্যেক ভাগকে برج বলা হয়। তাদের ধারণা এই যে, স্থিতিশীল নক্ষত্রসমূহ এসব বুর্জ-এর মধ্যেই অবস্থান করে। গ্রহসমূহ এখানে অবতরণ করে ইত্যাদি। (২) ড. মুজীবুর রহমান আগের দু’টির অনুবাদ ঠিক করেছেন। কিন্তু সূরা বুরূজে এসে করেছেন ‘রাশিচক্র’। (৩) ই. ফা. বা. (ঢাকা) ফুরক্বান ৬১-এর অনুবাদ ‘রাশিচক্র’ করেছে। অথচ বাকী দু’টিতে ‘গ্রহ-নক্ষত্র’ ও ‘বুর্জশোভিত’ লিখেছে। এতে বুঝা যায়, বুর্জ-এর অর্থ তাঁদের কাছে পরিষ্কার নয়। (৪) ইংরেজী তাফসীরে আব্দুল্লাহ ইউসুফ আলী অর্থ ও ব্যাখ্যা করেছেন Zodiacal Signs ১২টি ‘রাশিচক্রের প্রতীকসমূহ’ (হিজর ১৫/১৬ টীকা ১৯৫০)। (৫) মদীনা ইসলামিক ইউনিভার্সিটির প্রফেসর আবুবকর আল-জাযায়েরী স্বীয় আয়সারুত তাফাসীরে ১২টি রাশি ও কক্ষপথ বলেছেন। (৬) সঊদী সরকার প্রকাশিত ছালাহুদ্দীন ইউসুফের উর্দূ তাফসীরে পরবর্তী কোন কোন তাফসীরকারের নামে ১২টি রাশি বলা হয়েছে এবং এতে কোন দোষ নেই’ বলেছেন (হিজর ১৬)। বুরূজ ১-এর তাফসীর ও তার বঙ্গানুবাদে বলা হয়েছে, ‘রাশিচক্র যা নক্ষত্রমালার প্রাসাদ ও অট্টালিকার মত। তার আকাশে প্রকাশ ও স্পষ্ট হওয়ার কারণে ‘বুরূজ’ বলা হয়’। (৭) শায়খ উছায়মীনও ১২টি বুর্জ নামসহ কবিতাকারে লিখেছেন এবং তার মধ্যে ৩টি বসন্তকালের জন্য, ৩টি গ্রীষ্মকালের জন্য, ৩টি শরৎকালের জন্য ও ৩টি শীতকালের জন্য ভাগ করেছেন। তিনি ‘বুরূজ’ বলতে উক্ত ১২টি ‘নক্ষত্রের বিশাল সমষ্টি’-কে বুঝিয়েছেন। অথচ এগুলি স্রেফ ধারণা ও কল্পনা ছাড়া কিছুই নয়। কেননা পৃথিবী থেকে আকাশে খোলা চোখে কেবল ১২টি নয়, বরং অগণিত নক্ষত্ররাজি দেখা যায়। তাদের কক্ষপথ বা রাশিচক্র কিছুই দেখা যায় না। আর কুরআন সর্বদা মানুষের জন্য সহজবোধ্য উদাহরণসমূহ পেশ করে থাকে। আল্লাহ সর্বাধিক অবগত।

[5]. বুখারী তা‘লীক্ব; মিশকাত হা/৪৬০২ ‘চিকিৎসা ও ঝাড়ফুঁক’ অধ্যায়।

[6]. তাফসীর ইবনে কাছীর; সীরাতে ইবনে হিশাম (মিসর : বাবী হালবী প্রেস, ২য় সংস্করণ ১৩৭৫ হিঃ/১৯৫৫ খৃঃ) ১/৩৭ পৃঃ।

[7]. তাফসীর কুরতুবী; সীরাতে ইবনে হিশাম ১/৩৫ পৃঃ।

[8]. সীরাতে ইবনে হিশাম ১/৩১, টীকা-২।

[9]. তিরমিযী হা/২১৭৪; মিশকাত হা/৩৭০৫ ‘নেতৃত্ব ও বিচার’ অধ্যায়।

[10]. আহমাদ; মিশকাত হা/৬১; ছহীহাহ হা/৯১৪।

[11]. আহমাদ হা/২৩৮৬৫; মিশকাত হা/৪২।

[12]. যুমার ৩৯/৭৩; ফুরক্বান ২৫/৭৫; ইউনুস ১০/৯-১০।

[13]. বুখারী হা/৪৬৮৬; মুসলিম হা/২৫৮৩; মিশকাত হা/৫১২৪।

[14]. বিস্তারিত দ্রষ্টব্য : সিলসিলা ছহীহাহ হা/১০৯।