মাসায়েলে কুরবাণী ও আক্বীক্বা

بسم الله الرحمن الرحيم

‘করুণাময় কৃপানিধান আল্লাহর নামে (শুরু করছি)’

نحمده و نصلى على رسوله الكريم أما بعد:

কুরবানীর সংজ্ঞা

আরবী ‘কুরবান’ (قربان) শব্দটি ফারসী বা ঊর্দূতে ‘কুরবানী’ রূপে পরিচিত হয়েছে, যার অর্থ ‘নৈকট্য’। পারিভাষিক অর্থে  القُرْبَانُ مَا يُتَقَرَّبُ بِهِ إِلَى اللَّهِ تَعَالَى   ‘কুরবানী’ ঐ মাধ্যমকে বলা হয়, যার দ্বারা আল্লাহর নৈকট্য হাছিল হয়’।[1] প্রচলিত অর্থে, ঈদুল আযহার দিন আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে শারঈ তরীকায় যে পশু যবহ করা হয়, তাকে ‘কুরবানী’ বলা হয়’। সকালে রক্তিম সূর্য উপরে ওঠার সময়ে ‘কুরবানী’ করা হয় বলে এই দিনটিকে ‘ইয়াওমুল আযহা’ বলা হয়ে থাকে।[2] যদিও কুরবানী সারাদিন ও পরের দু’দিন করা যায়।

(২) গুরুত্ব

আল্লাহ বলেন,

(ক) وَالْبُدْنَ جَعَلْنَاهَا لَكُم مِّن شَعَائِرِ اللَّهِ لَكُمْ فِيهَا خَيْرٌ  (الحج ৩৬)-

‘আর কুরবানীর পশু সমূহকে আমরা তোমাদের জন্য আল্লাহর নিদর্শন সমূহের অন্তর্ভুক্ত করেছি। এর মধ্যে তোমাদের জন্য কল্যাণ রয়েছে’ (হজ্জ ২২/৩৬)

(খ) আল্লাহ আরও বলেন, وَفَدَيْنَاهُ بِذِبْحٍ عَظِيمٍ، وَتَرَكْنَا عَلَيْهِ فِي الْآخِرِينَ (الصافات ১০৭-১০৮)- ‘আর আমরা তার (অর্থাৎ ইসমাঈলের) পরিবর্তে যবহ করার জন্য দিলাম একটি মহান কুরবানী’। ‘এবং আমরা এটিকে (অর্থাৎ কুরবানীর এ প্রথাটিকে) পরবর্তীদের মধ্যে রেখে দিলাম’ (ছাফফাত ৩৭/১০৭-১০৮)

(গ) আল্লাহ বলেন, فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَانْحَرْ (الكوثر ২)-  ‘তুমি তোমার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে ছালাত আদায় কর এবং কুরবানী কর’ (সূরা কাওছার ১০৮/২)। কাফির-মুশরিকরা তাদের দেব-দেবী ও বিভিন্ন কবর ও বেদীতে পূজা দেয় ও মূর্তির উদ্দেশ্যে কুরবানী করে থাকে। তার প্রতিবাদ স্বরূপ মুসলমানকে আল্লাহর জন্য ‘ছালাত আদায়ের ও তাঁর উদ্দেশ্যে কুরবানী করার’ হুকুম দেওয়া হয়েছে। ঈদুল আযহার দিন প্রথমে আল্লাহর জন্য ঈদের ছালাত আদায় করতে হয়, অতঃপর তাঁর নামে কুরবানী করতে হয়। অনেক মুফাসসির এভাবেই আয়াতটির তাফসীর করেছেন।[3]

(ঘ) আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন,

مَنْ كَانَ لَهُ سَعَةً وَلَمْ يُضَحِّ فَلاَ يَقْرِبَنَّ مُصَلاَّنَا رواه ابن ماجه بإسناد حسن-

‘সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যে ব্যক্তি কুরবানী করল না, সে যেন আমাদের ঈদগাহের নিকটবর্তী  না হয়’।[4] 

(ঙ) এটি ইসলামের একটি ‘মহান নিদর্শন’ (شعار عظيم ), যা ‘সুন্নাতে ইবরাহীমী’ হিসাবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নিজে মদীনায় প্রতি বছর আদায় করেছেন এবং ছাহাবীগণও নিয়মিতভাবে কুরবানী করেছেন। অতঃপর অবিরত ধারায় মুসলিম উম্মাহর সামর্থ্যবানদের মধ্যে এটি চালু আছে। এটি কিতাব ও সুন্নাহ এবং ইজমায়ে উম্মত দ্বারা সুপ্রমাণিত।[5]

(৩) উদ্দেশ্য

কুরবানীর মূল উদ্দেশ্য আল্লাহভীতি অর্জন করা। যাতে মানুষ এটা উপলব্ধি করে যে, আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহের কারণেই শক্তিশালী পশুগুলি তাদের মত দুর্বলদের অনুগত হয়েছে এবং তাদের গোশত, হাড়-হাড্ডি-মজ্জা ইত্যাদির মধ্যে তাদের জন্য রূযী নির্ধারিত হয়েছে। জাহেলী যুগের আরবরা আল্লাহর নৈকট্য হাছিলের অসীলা হিসাবে তাদের মূর্তির নামে কুরবানী করত। অতঃপর তার গোশতের কিছু অংশ মূর্তিগুলির মাথায় রাখত ও তার উপরে কিছু রক্ত ছিটিয়ে দিত। কেউবা উক্ত রক্ত কা‘বা গৃহের দেওয়ালে লেপন করত। মুসলমানদের কেউ কেউ অনুরূপ করার চিন্তা করলে নিম্নের আয়াতটি নাযিল হয়।[6]  আল্লাহ বলেন,

لَنْ يَّنَالَ اللَّهَ لُحُوْمُهَا وَلاَ دِمَاؤُهَا وَ لَكِنْ يَّنَالُهُ التَّقْوَى مِنْكُمْ (الحج ৩৭)-

অর্থঃ ‘কুরবানীর পশুর গোশত বা রক্ত আল্লাহর নিকটে পৌঁছে না। বরং তাঁর নিকটে পৌঁছে কেবলমাত্র তোমাদের ‘তাক্বওয়া’ বা আল্লাহভীতি’ (হজ্জ ২২/৩৭)

(৪) হুকুম : কুরবানী সুন্নাতে মুওয়াক্কাদাহ। এটি ওয়াজিব নয় যে, যেকোন মূল্যে প্রত্যেককে কুরবানী করতেই হবে। লোকেরা যাতে এটাকে ওয়াজিব মনে না করে, সেজন্য সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও হযরত আবুবকর ছিদ্দীক্ব (রাঃ) ও ওমর ফারূক্ব (রাঃ) অনেক সময় কুরবানী করতেন না। আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর, আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস, বেলাল, আবু মাসঊদ আনছারী প্রমুখ ছাহাবী থেকেও অনুরূপ বর্ণিত হয়েছে।[7]

(৫) তাৎপর্য : (১) আল্লাহর রাহে জীবন উৎসর্গ করার জাযবা সৃষ্টি করা (২) ইবরাহীমের পুত্র কুরবানীর ন্যায় ত্যাগ-পূত আদর্শকে পুনরুজ্জীবিত করা (৩) উত্তম খানা-পিনার মাধ্যমে ঈমানদারগণের মধ্যে আনন্দের বন্যা বইয়ে দেওয়া এবং (৪) আল্লাহর অনুগ্রহকে স্মরণ করা ও তাঁর বড়ত্ব প্রকাশ করা।

(৬) ফাযায়েল

(ক) মা আয়েশা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন,

مَا عَمِلَ ابْنُ آدَمَ مِنْ عَمَلٍ يَوْمَ النَّحْرِ أَحَبَّ إِلَى اللَّهِ مِنْ إِهْرَاقِ الدَّمِ، وَ إِنَّهُ لَيُؤْتَى يَوْمَ الْقِيَامَةِ بِقُرُوْنِهَا وَ أَشْعَارِهَا وَ أَظْلاَفِهَا، وَ إِنَّ الدَّمَ لَيَقَعُ مِنَ اللهِ بِمَكَانٍ قَبْلَ أَنْ يَّقَعَ بِالْأَرْضِ، فَطِيْبُوْا بِهَا نَفْسًا رواه الترمذى وابن ماجه-

‘কুরবানীর দিনে রক্ত প্রবাহিত করার চেয়ে প্রিয় আমল আল্লাহর নিকটে আর কিছু নেই। ঐ ব্যক্তি ক্বিয়ামতের দিন কুরবানীর পশুর শিং, লোম ও ক্ষুর সমূহ নিয়ে হাযির হবে। আর কুরবানীর রক্ত যমীনে পতিত হওয়ার আগেই তা আল্লাহর নিকটে বিশেষ মর্যাদার স্থানে পৌঁছে যায়। অতএব তোমরা কুরবানী দ্বারা নিজেদের নফ্সকে পবিত্র কর’।[8]

(খ) যিলহাজ্জ মাসের ১ম দশকের ফযীলত

আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন,

مَا مِنْ أَيَّامٍ الْعَمَلُ الصَّالِحُ فِيْهِنَّ  أَحَبُّ إِلَى اللهِ مِنْ هذِهِ الْاَيَّامِ الْعَشَرَةِ قَالُوْا يَا رَسُوْلَ اللهِ وَ لاَ الْجِهَادُ فِى سَبِيْلِ اللهِ؟ قَالَ وَلاَ الْجِهَادُ فِىْ سَبِيْلِ اللهِ إِلاَّ رَجُلٌ خَرَجَ بِنَفْسِهِ وَ مَالِهِ فَلَمْ يَرْجِعْ مِنْ ذَلِكَ بِشَيْئٍ رواه البخارىُّ-

‘যিলহাজ্জ মাসের ১ম দশকের নেক আমলের চেয়ে প্রিয়তর কোন আমল আল্লাহর কাছে নেই। ছাহাবায়ে কেরাম বললেন, হে রাসূল! আল্লাহর রাস্তায় জিহাদও নয়? রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, জিহাদও নয়। তবে ঐ ব্যক্তি, যে নিজের জান ও মাল নিয়ে বেরিয়েছে, আর ফিরে আসেনি (অর্থাৎ শাহাদাত বরণ করেছে)’।[9]

(গ) আরাফার দিনের ছিয়াম

আবূ ক্বাতাদাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন,

صِيَامُ يَوْمِ عَرَفَةَ أَحْتَسِبُ عَلَى اللهِ أَنْ يُّكَفِّرَ السَّنَةَ الَّتِىْ قَبْلَهُ وَالسَّنَةَ الَّتِىْ بَعْدَهُ رواه مسلم-

‘আরাফার দিনের নফল ছিয়াম (যারা আরাফাতের বাইরে থাকেন তাদের জন্য) আমি আল্লাহর নিকট আশা করি যে, তা বিগত এক বছরের ও পরবর্তী এক বছরের গুনাহের কাফফারা হবে’।[10]

(৭) কুরবানীর ইতিহাস

আল্লাহ বলেন,

وَلِكُلِّ اُمَّةٍ جَعَلْنَا مَنْسَكًا لِّيَذْكُرُوا اسْمَ اللهِ عَلَى مَا رَزَقَهُمْ مِّنْ مبَهِيْمَةِ الْأَنْعَامِ طـــــــَهُكُمْ إِلـهُ وَّاحِدٌ فَلَهُ أَسْلِمُوْا ط وَ بَشِّرِ الْمُخْبِتِيْنَ- (الحج ৩৪)-

‘প্রত্যেক উম্মতের জন্য আমরা কুরবানীর বিধান রেখেছিলাম, যাতে তারা যবহ করার সময় আল্লাহর নাম স্মরণ করে এজন্য যে, তিনি চতুষ্পদ গবাদি পশু থেকে তাদের জন্য রিযিক নির্ধারণ করেছেন। অনন্তর তোমাদের উপাস্য মাত্র একজন। অতএব তাঁর নিকটে তোমরা আত্মসমর্পণ কর এবং আপনি বিনয়ীদের সুসংবাদ প্রদান করুন’ (হজ্জ ২২/৩৪)

আদম (আঃ) -এর দুই পুত্র ক্বাবীল ও হাবীল -এর দেওয়া কুরবানী থেকেই কুরবানীর ইতিহাসের গোড়াপত্তন হয়েছে। তারপর থেকে বিগত সকল উম্মতের উপরে এটা জারি ছিল। তবে সেই সব কুরবানীর নিয়ম-কানূন আমাদেরকে জানানো হয়নি। মুসলিম উম্মাহর উপরে যে কুরবানীর নিয়ম নির্ধারিত হয়েছে, তা মূলতঃ ইবরাহীম (আঃ) কর্তৃক পুত্র ইসমাঈল (আঃ)-কে আল্লাহর রাহে কুরবানী দেওয়ার অনুসরণে ‘সুন্নাতে ইবরাহীমী’ হিসাবে চালু হয়েছে।[11] যা মুক্বীম ও মুসাফির সর্বাবস্থায় পালনীয়।[12] রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মাদানী জীবনে দশ বছর নিয়মিত কুরবানী করেছেন।[13]

ইবরাহীমী কুরবানীর সংক্ষিপ্ত ইতিহাস বর্ণনা করে আল্লাহ বলেন,

فَلَمَّا بَلَغَ مَعَهُ السَّعْىَ قَالَ يَابُنَىَّ اِنِّىْ اَرَى فِى الْمَنَامِ اَنِّىْ اَذْبَحُكَ فَانْظُرْ مَاذَا تَرَىط قَالَ ياَأَبَتِ افْعَلْ مَا تُؤْمَرُ سَتَجِدُنِىْ إِنْ شَآءَ اللهُ مِنَ الصَّابِرِيْنَ- فَلَمَّا أَسْلَمَا وَ تَلَّهُ لِلْجَبِيْنِ- وَ نَادَيْنَاهُ أَنْ يَّا إِبْرَاهِيْمُ- قَدْ صَدَّقْتَ الرُّؤْيَا ج إِنَّا كَذَالِكَ نَجْزِى الْمُحْسِنِيْنَ- إِنَّ هذَا لَهُوَ الْبَلاَءُ الْمُبِيْنُ- وَفَدَيْنَاهُ بِذِبْحٍ عَظِيْمٍ- وَ تَرَكْنَا عَلَيْهِ فِى الْآخِرِيْنَ- سَلاَمٌ عَلَى إِبْرَاهِيْمَ- (الصافات ১০২-১০৯)-

‘যখন সে (ইসমাঈল) তার পিতার সাথে চলাফেরা করার বয়সে উপনীত হ’ল, তখন তিনি (ইবরাহীম) তাকে বললেন, হে বৎস! আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, আমি তোমাকে যবহ করছি। অতএব বল, তোমার মতামত কি? ছেলে বলল, হে আববা! আপনাকে যা নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, তা প্রতিপালন করুন। ইনশাআল্লাহ আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের মধ্যে পাবেন’ (ছাফফাত ৩৭/১০২)। অতঃপর যখন পিতা ও পুত্র আত্মসমর্পণ করল এবং পিতা পুত্রকে উপুড় করে ফেলল’ (১০৩), ‘তখন আমরা তাকে ডাক দিলাম, হে ইবরাহীম (১০৪)! ‘নিশ্চয়ই তুমি তোমার স্বপ্ন সত্যে পরিণত করেছ। আমরা এমনিভাবে সৎকর্মশীল বান্দাদের পুরষ্কৃত করে থাকি’ (১০৫)। ‘নিশ্চয়ই এটি একটি সুস্পষ্ট পরীক্ষা’ (১০৬)। ‘আর আমরা তার (অর্থাৎ ইসমাঈলের) পরিবর্তে যবহ করার জন্য দিলাম একটি মহান কুরবানী’ (১০৭)। ‘এবং আমরা এটিকে (অর্থাৎ কুরবানীর এ প্রথাটিকে) পরবর্তীদেরকে মধ্যে রেখে দিলাম’ (১০৮)। ‘ইবরাহীমের উপরে শান্তি বর্ষিত হোক’ (১০৯)!

হযরত ইবরাহীম (আঃ)-এর ৮৬ বৎসর বয়সে ইসমাঈল বিবি হাজেরার গর্ভে এবং ৯৯ বছর বয়সে ইসহাক্ব বিবি সারাহর গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন। ইবরাহীম (আঃ) সর্বমোট ২০০ বছর বেঁচে ছিলেন।[14]

ঘটনা: ফার্রা বলেন, যবহের সময় ইসমাঈলের বয়স ছিল ১৩ বছর। ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, ঐ সময় তিনি কেবল সাবালকত্বে উপনীত হয়েছিলেন।[15] এমন সময় পিতা ইবরাহীম স্বপ্নে দেখলেন যে, তিনি বৃদ্ধ বয়সের একমাত্র সন্তান নয়নের পুত্তলি ইসমাঈলকে কুরবানী করছেন। নবীদের স্বপ্ন ‘অহি’ হয়ে থাকে। তাদের চক্ষু মুদিত থাকলেও অন্তরচক্ষু খোলা থাকে। ইবরাহীম (আঃ) একই স্বপ্ন পরপর তিনরাত্রি দেখেন। প্রথম রাতে তিনি স্বপ্ন দেখে ঘুম থেকে উঠে ভাবতে থাকেন, কি করবেন। এজন্য প্রথম রাতকে (৮ই যিলহাজ্জ) ‘ইয়াউমুত তারবিয়াহ’ (يوم الةروية)  বা ‘স্বপ্ন দেখানোর দিন’ বলা হয়। দ্বিতীয় রাতে পুনরায় একই স্বপ্ন দেখার পর তিনি নিশ্চিতভাবে বুঝতে পারেন যে, এটা আল্লাহর পক্ষ হ’তে নির্দেশ হয়েছে। এজন্য এ দিনটি (৯ই যিলহাজ্জ) ‘ইয়াউমু আরাফা’ (يوم عرفة)  বা ‘নিশ্চিত হওয়ার দিন’ বলা হয়। তৃতীয় দিনে পুনরায় একই স্বপ্ন দেখায় তিনি ছেলেকে কুরবানী করার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেন। এজন্য এ দিনটিকে (১০ই যিলহাজ্জ) ‘ইয়াউমুন নাহর’ (يوم النحر) বা ‘কুরবানীর দিন’ বলা হয় ।[16]

এই সময় ইবরাহীম (আঃ) শয়তানকে তিন স্থানে তিনবার সাতটি করে পাথরের কংকর ছুঁড়ে মারেন।[17] উক্ত সুন্নাত অনুসরণে উম্মতে মুহাম্মাদীও হজ্জের সময় তিন জামরায় তিনবার শয়তানের বিরুদ্ধে কংকর নিক্ষেপ করে থাকে এবং প্রতিবারে আল্লাহর বড়ত্ব ঘোষণা করে ‘আল্লাহু আকবার’ বলে থাকে।[18]

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) থেকে ছহীহ সনদে মুসনাদে আহমাদে[19] বর্ণিত হয়েছে যে, ইবরাহীম (আঃ) ছেলেকে কুরবানীর প্রস্ত্ততি নিলেন এবং তাকে মাটিতে উপুড় করে ফেললেন। এমন সময় পিছন থেকে আওয়ায এলো  (يَا اِبْرَاهِيْمُ قَدْ صَدَّقْتَ الرُّؤْيَا)   ‘হে ইবরাহীম! তুমি স্বপ্ন সার্থক করেছ’ (ছাফফাত ১০৫)। ইবরাহীম পিছন ফিরে দেখেন যে, একটি সুন্দর শিংওয়ালা ও চোখওয়ালা সাদা দুম্বা   (كَبْشٌ أَبْيَضُ أَقْرَنُ أَعْيَنُ)   দাঁড়িয়ে আছে। অতঃপর তিনি সেটি মিনা প্রান্তরে (‘ছাবীর’ টীলার পাদদেশে) কুরবানী করেন। ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, এজন্য আমরা কুরবানীর সময় অনুরূপ ছাগল-দুম্বা খুঁজে থাকি।[20] তিনি বলেন, ঐ দুম্বাটি ছিল হাবীলের কুরবানী, যা জান্নাতে ছিল, যাকে আল্লাহ ইসমাঈলের ফিদ্ইয়া হিসাবে পাঠিয়েছিলেন।[21] ইবরাহীম উক্ত দুম্বাটি ছেলের ফিদ্ইয়া হিসাবে কুরবানী করলেন ও ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন  (يَا بُنَىَّ اَلْيَوْمَ وُهِبْتَ لِىْ)   ‘হে পুত্র! আজই তোমাকে আমার জন্য দান করা হ’ল।[22]

নিঃসন্দেহে এখানে মূল উদ্দেশ্য যবহ ছিলনা, বরং উদ্দেশ্য ছিল পিতা-পুত্রের আনুগত্য ও তাক্বওয়ার পরীক্ষা নেওয়া। সে পরীক্ষায় উভয়ে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন পিতার পূর্ণ প্রস্ত্ততি এবং পুত্রের স্বতঃস্ফূর্ত সম্মতি ও আনুগত্যের মাধ্যমে।

ইমাম কুরতুবী উপরোক্ত ১০৭ নং আয়াত  وَفَدَيْنَاهُ بِذِبْحٍ عَظِيْمٍ   উল্লেখ করে বলেন, এ আয়াতটি দলীল হ’ল এ বিষয়ে যে, উট ও গরুর চেয়ে ছাগল কুরবানী করা উত্তম’। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নিজেও শিংওয়ালা দু’টো করে ‘খাসি’ কুরবানী দিতেন। অনেক বিদ্বান বলেছেন, যদি এর চাইতে উত্তম কিছু থাকত, তবে আল্লাহ তাই দিয়ে ইসমাঈলের ফিদ্ইয়া দিতেন’।[23] তবে উট, গরু, ভেড়া বা ছাগল দ্বারা কুরবানীর ব্যাপারে স্পষ্ট হাদীছ রয়েছে এবং আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) হজ্জের সময় গরু ও উট কুরবানী করেছেন।



[1]. মাজদুদ্দীন ফীরোযাবাদী, আল-ক্বামূসুল মুহীত্ব (বৈরুত ছাপাঃ ১৪০৬/১৯৮৬) পৃঃ ১৫৮।

[2]. শাওকানী, নায়লুল আওত্বার (কায়রো ছাপাঃ ১৩৯৮/১৯৭৮) ৬/২২৮ পৃঃ।

[3]. মির‘আতুল মাফাতীহ শরহ মিশকাতুল মাছাবীহ  (লাক্ষ্ণৌ ছাপাঃ ১৯৫৮) ২/৩৪৯;  ঐ,  (বেনারস ছাপাঃ ১৯৯৫) ৫/৭১ পৃঃ।

[4]. ইবনু মাজাহ, আলবানী-ছহীহ ইবনু মাজাহ হা/২৫৩২; আহমাদ, বায়হাক্বী, হাকেম, দারাকুৎনী, মির‘আত (বেনারস) ৫/৭২; নায়লুল আওত্বার  ৬/২২৭ পৃঃ।

[5]. মির‘আত ৫/৭১, ৭৩ পৃঃ।

[6]. তাফসীরে ইবনে কাছীর (বৈরুত ছাপাঃ ১৪০৮/১৯৮৮) ৩/২৩৪; তাফসীরে কুরতুবী  (বৈরুত ছাপাঃ ১৪০৫/১৯৮৫) ১২/৬৫ পৃঃ।

[7]. বায়হাক্বী (হায়দারাবাদ, ভারতঃ ১৩৫৬ হিঃ; ঐ, বৈরুতঃ দারুল মা‘রিফাহ, তারিখ বিহীন) ৯/২৬৪-২৬৬; মির‘আত ৫/৭২-৭৩; তাফসীরে ইবনে কাছীর ৩/২৩৪; তাফসীরে কুরতুবী ১৫/১০৮-১০৯ পৃঃ।

[8]. তিরমিযী, ইবনু মাজাহ, মিশকাত-আলবানী (বৈরুত ছাপাঃ ১৪০৫/১৯৮৫),  হা/১৪৭০; ঐ, মির‘আত সহ হা/১৪৮৭, সনদ ‘হাসান’। ইবনুল ‘আরাবী বলেন যে, কুরবানীর ফযীলত বর্ণনায় কোন ছহীহ হাদীছ পাওয়া যায় না’। ছাহেবে মির‘আত বলেন, বিভিন্ন ‘শাওয়াহেদ’ -এর কারণে সম্ভবতঃ ইমাম তিরমিযী হাদীছটিকে ‘হাসান’ বলেছেন। দ্রঃ  মির‘আত  ২/৩৬২-৬৩ পৃঃ; ঐ, ৫/১০৪; তুহফাতুল আহওয়াযী শরহ তিরমিযী (কায়রো ছাপাঃ ১৯৮৭) ৫/৭৫ পৃঃ।

[9]. বুখারী, মিশকাত হা/১৪৬০ ‘ছালাত’ অধ্যায় ‘কুরবানী’ অনুচ্ছেদ।

[10]. মুসলিম, মিশকাত হা/২০৪৪ ‘ছওম’ অধ্যায়, ‘নফল ছিয়াম’ অনুচ্ছেদ।

[11]. শাওকানী, নায়লুল আওত্বার  ৬/২২৮ পৃঃ।

[12]. তাফসীরে কুরতুবী (বৈরুত: ১৪০৫/১৯৮৫)  ১৫/১০৯ পৃঃ; নায়ল ৬/২৫৫পৃঃ।

[13]. তিরমিযী, মিশকাত  হা/১৪৭৫ ‘ছালাত’ অধ্যায়, ‘কুরবানী’ অনুচ্ছেদ।

[14]. তাফসীরে ইবনে কাছীর ৪/১৬; মুওয়াত্ত্বা, তাফসীরে কুরতুবী ২/৯৮-৯৯ পৃঃ।

[15]. তাফসীরে কুরতুবী ১৫/৯৯ পৃঃ।

[16]. তাফসীরে কুরতুবী ১৫/১০২ পৃঃ।

[17]. তাফসীরে কুরতুবী ১৫/১০৬ পৃঃ।

[18]. মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মুওয়াত্ত্বা মালেক, মিশকাত হা/২৬২১, ২৬২৬ ‘হজ্জ’ অধ্যায়, ‘কংকর নিক্ষেপ’ অনুচ্ছেদ।

[19]. মুসনাদে আহমাদ হা/২৭০৭, তাহক্বীক্ব: আহমাদ শাকির ১/২৯৭পৃঃ; সনদ ছহীহ, তাহক্বীক্ব তাফসীরে  ইবনে কাছীর (কায়রো ছাপাঃ দারুল হাদীছ ২০০২) ৭/২৮ পৃঃ।

[20]. তাফসীরে ইবনে কাছীর ৪/১৭ পৃঃ; ঐ, তাহক্বীক্ব, সনদ ছহীহ ৭/২৮ পৃঃ ।

[21]. তাফসীরে কুরতুবী ১৫/১০৭ পৃঃ।

[22]. তাফসীরে কুরতুবী ১৫/১০৭ পৃঃ।

[23]. তাফসীরে কুরতুবী ১৫/১০৭ পৃঃ।